post

আমি মানুষকে ভালোবেসে যাই

ইয়াসিন মাহমুদ

২৩ মে ২০২২

মানুষ স্বভাবজাতভাবেই নিজেকে ভালোবাসে। সে তার প্রভুকেও ভালোবাসে। এটা হলো- স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির প্রেম। অন্যটি হলো হলো- সৃষ্টির সঙ্গে সৃষ্টির ভালোবাসা। নিজের প্রতি ভালোবাসার সূত্র ধরেই মানুষ তার  বাবা-মা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি, পরিবার- পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু- বান্ধবকে ভালোবাসে। পবিত্র কুরআনে এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা- আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন এবং তারা আল্লাহকে ভালোবাসে। (সূরা মায়িদা : ৫৪)

মানুষকে ভালোবাসার আনন্দ অন্যরকম। এ আনন্দ যে পায়নি নিশ্চয় তিনি মানুষকে ভালোবাসতে পারেনি। মানুষকে ভালোবাসার আনন্দ মানুষের অন্তরকে বড় করে। প্রশস্ত করে। শত কষ্টকে ভুলিয়ে রাখে। শত বেদনাকে লুকিয়ে ফেলে। অনবরত কেবলই মানুষের জন্য ভাবনা তাকে বিভোর করে। কারণ এই মানুষের ভালোবাসা তাকে প্রশান্তির ছোঁয়া বুলিয়ে দেয় জীবনজুড়ে।

মানুষকে নিয়ে আমরা ভাগাভাগি করি। দলাদলি করি। মানুষের মনে ভাঙন সৃষ্টি করি। বিভেদের দেয়াল নির্মাণ করি প্রতিনিয়ত। অথচ ভালোবাসা-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠাই এই মানুষের দায়িত্ব। একজন মানুষ যখন সুন্দর হয়। তখন সুন্দর হয়ে ওঠে একটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। সবকিছুর ভালো-মন্দের মূলেই মূলত মানুষ।

মানুষকে গ্রহণ করার আনন্দ ভীষণ থেকে ভীষণতর। আর এই মানুষকে গ্রহণ করতে হলে সুন্দরের পূজারি হতে হবে। সুন্দরকে গ্রহণের আকাক্সক্ষী হতে হবে। সুন্দরের সাধক হতে হবে। আর এরকম সুন্দর আহবানের মাধ্যমেই একমাত্র মানুষকে সত্য ও কল্যাণের পথে আনা সম্ভব। সুন্দরকে উপেক্ষা করে কিংবা সুন্দরের পথকে এড়িয়ে কখনো মানুষকে মুক্তির  মোহনায় পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই সুন্দরই মুক্তি। সুন্দরই কল্যাণ। আর এই পথ নাজাতের ঠিকানা। আর সেই পথ সুগমের জন্য প্রয়োজন মানুষকে ভালোবাসা। ভালোবাসাহীন পৃথিবী শুধুই ধু ধু মরুভূমি। যেখানে সুন্দরের চাষাবাদ কিংবা সুন্দরকে জাগানোই সময় অপচয় ছাড়া বৈকি। ভালোবাসাহীন পৃথিবী কেবল ঘৃণা আর হৃদয়হীনতার আবাসভূমি। 

আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে একজন আরেকজনকে ভালোবাসি। ভাবের আদান প্রদান করি। প্রীতি-সম্প্রীতি স্থাপন করি। একজন আরেকজনের প্রতি ঝুঁকে যাই। একজন আরেকজনের প্রয়োজনে- অপ্রয়োজনে এগিয়ে আসি। সাহায্য করি। জান কুরবান করি। এটি নিশ্চয় একজনের প্রতি অন্যের অগাধ বিশ্বাস ও আস্থার একান্ত বহিঃপ্রকাশ। এতো কিছুর পরেও একজনের প্রতি আরেকজনের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। ফলে আমাদের বিশ্বাসে চিড় ধরে। আমরা বিশ্বাসের মান বজায় রাখতে পারি না। আর এই ধরনের বিশ্বাসহীনতা থেকেই কেবল বন্ধুত্ব নষ্ট হয়। সম্পর্কের অবনতি ঘটে। টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে জীবন প্রবাহ। আর এমন ঘটনা আমাদেরকে মর্মাহত করে তোলে। বিমর্ষ করে। আমাদেরকে চরমভাবে আশাহত করে। তারপরেও তো জীবন পথে পাড়ি দিতে হয়। আশাহত মনটারে দেখাতে হয় আলোর প্রকাশ। দেখাতে হয় বিশাল আকাশের সীমাহীন উদারতা।

মহান আল্লাহ মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। আর মানুষকে কেবল দিয়েছেন বুদ্ধি- আকল। সত্য- মিথ্যা পার্থক্য করবার ক্ষমতা। ভালো- মন্দ পরিমাপ করবার বোধ। যা অন্য কোনো প্রাণীকে তিনি দান করেননি। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কার সাথে কিভাবে চলব। কিভাবে বলব। সব কিছুরই নির্ধারিত পদ্ধতি ও রীতি রয়েছে। তারপরও আমরা বেমালুম ভুলে যাই সেই পথ ও মত। মানবিক দুর্বলতার ঘোরে পাশবিক শক্তির কাছে আমরা নিজেদেরকে সোপর্দ করি। মানুষের প্রতি মানুষ হয়ে অবিচার করি। জুলুম করি। মানুষের প্রতি নিজের বড়াই ও করায়ত্ত প্রকাশে নিজেকে বেশ দক্ষ ও পাকাপোক্ত ভাবি। এগুলো মানুষের কলুষিত চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। এর বিপরীতে রয়েছে মানুষকে ভালোবাসার অফুরন্ত আনন্দ।

মানুষ হিসাবে আমাদের প্রত্যেকেই একই রক্ত-মাংসের তৈরি। সবারই শরীরে রয়েছে রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধ, হিংসা। কেউ এটাকে সংবরণ করতে পারি। আবার কেউ এটাকে শক্তি হিসাবে প্রয়োগ করি। অন্যকে ঘায়েল করতে চাই বিভিন্ন উপায়ান্তরে। দুজনের দুই বৈশিষ্ট্য। কেউ প্রতিশোধপরায়ণ হই। আবার কেউ ধৈর্যের বাঁধ নির্মাণ করি আপন বুকে। ক্ষমা ও মহানুভবতার সুবাস ছড়িয়ে দেই।

মানুষ হিসাবে এটা সবারই একটা স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হলো- অন্যের ওপর নিজের প্রাধান্য তালাশ করা। অন্যের চেয়ে নিজেকে বড় ভাবা। নিজের সামনে অন্যের প্রশংসা শুনতে না পারা। এমন তরো শত শত বিষয় আছে যা আমরা হরহামেশা করে থাকি। অথচ এগুলো আমাদের চরিত্রের মন্দ দিক। এ প্রসঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন-

কুকুরের কাজ কুকুর করেছে

কামড় দিয়েছে পায়,

তা বলে কুকুরে কামড়ান কি রে

মানুষের শোভা পায়?

     (উত্তম ও অধম)

মানুষ হিসাবে সবারই একটা মন আছে। কখনো হাসে। কখনো কাঁদে। এটা মূলত আমাদের ভালো লাগা-মন্দ লাগার অনুভূতির কারণেই হয়ে থাকে। যখন কোন বিষয়ে কষ্ট পায় তখন চোখের কোণে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরে। আবার পরম আনন্দে চোখে- মুখে তৃপ্তির হাসি। উল্লাসে ফেটে পড়া। এটা নিতান্তই ইন্দ্রিয় অনুভূতি। এই মুহূর্তগুলোর কোনো ব্যাখ্যা থাকে না। কেবলই উপভোগের। এক্ষেত্রে একটা বিষয় থেকেই যায় ভালো মুহূর্ত তো উপভোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু খারাপ মুহূর্তগুলো? এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা উল্লেখ করতে চাই- একবার সম্রাট আকবর সমুদ্র তীর দিয়ে হাঁটছিলেন। সাথে ছিলেন বীরবল। এক পর্যায়ে সম্রাট আকবর বেলাভূমিতে লম্বা দাগ কাটলেন। বীরবলকে বললেন, আমার এই দাগটিকে তুমি কি ছোট করে দিতে পারবে? বীরবল খানিক চিন্তা করলেন। এরপর সম্রাটের দাগের চেয়ে আরো বড় একটি দাগ কাটলেন।

বীরবল সম্রাটকে বললেন, দেখুন  হুজুর, আপনার দাগটি কত ছোট হয়ে গেছে! স¤্রাট আকবর তো থ!

এই ঘটনার শিক্ষাটা এমনভাবে নিতে পারি- কেউ আপনাকে ছোট করে দেখছে। আপনাকে চরম অপমান করেছে। আপনার প্রেস্টিজ পাংচার করে ছেড়েছে। আপনার সবকিছু শেষ। আপনি মানুষের সামনে যেতে পারছেন না। এই অপমান আপনাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আপনি কেন প্রতিশোধ নিচ্ছেন না। আপনি কিভাবে নিজের সামনে নিজের অপমান মেনে নিলেন। এটা কি করে সম্ভব। আপনার প্রভাব- প্রতিপত্তি কোনো দিক থেকে কমতি নেই। আপনার নফস আপনাকে এমন প্রভাবের কথা স্মরণ করে উত্তেজিত করার প্রণোদনা ও প্ররোচিত করলেও আপনি নিজেকে স্থির রাখুন। আপনি বরং থেমে যান। যিনি আপনাকে নিয়ে ভর্ৎসনায় মেতে উঠেছিল। আপনাকে হেনস্তা করে সুখ মিটিয়েছিল সেই আপনার কাছে বশ্যতা স্বীকার করবে। ক্ষমা চাইবে। তার নিজের ভুলের জন্য নিজেকে নিজে তিরস্কার করবে। শুধু একটু সময়ের অপেক্ষা। বলতে পারেন সময়েরই প্রতিশোধ।

কেউ আপনাকে ক্ষতি সাধন করার পর আমরা কেউই চুপ থাকার কথা না। অন্তত পক্ষে প্রতিশোধ না নিতে পারলেও নিজের ভেতর নিজেই অস্বস্তিবোধ করি। দ্রোহের আগুনে দগ্ধ হই নিজের অজান্তে নিজেই। কবি জসীম উদ্দীন আমাদেরকে এ ব্যাপারে সুন্দর একটি নির্দেশনা দিয়েছেন-

আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর,

আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।

যে মোরে করিল পথের বিবাগী-

পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি,

          (প্রতিদান)

আমাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন থাকি। ব্যক্তিগত সুখ-শান্তি নিয়ে প্রচণ্ড রকম চিন্তা-ভাবনা করি। নিজের ভালো থাকাটা নিশ্চিতের জন্য কতরকম না ফিকির করি। অথচ আমার আশপাশের মানুষদের নিয়ে কখনো ভেবেছি? কখনো অন্যের ভালো সংবাদে আলহামদুলিল্লাহ বলতে পেরেছি। অন্যের কল্যাণে নিজেকে একান্তভাবে নিবেদন করেছি। এ প্রশ্নগুলো নিশ্চয় বারবার এসে যায় সহসা। নতুন করে নিজের ভেতরটা ঝালাই করি। পরিশুদ্ধতার রঙে রেঙে উঠুক হৃদয়। আজ থেকে কেবল নিজেকে নয়; অন্যকেও প্রাধান্য দিতে শিখি।

পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি

এ জীবন মন সকলি দাও 

তার মতো সুখ কোথাও কি আছে? 

আপনার কথা ভুলিয়া যাও।

(সুখ- কামিনী রায়)

লেখক : কবি ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির