ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক, এটা মিয়ানমার স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করলেও সারাবিশ্বে সর্বজনস্বীকৃত বিষয়। বাংলায় ইসলাম আগমনের সময়কাল থেকেই আরাকানে ইসলামের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চল দীর্ঘকালব্যাপী আরাকানের অংশ হিসেবে শাসিত হওয়ার কারণে চট্টগ্রাম থেকেই আরাকানের বিভিন্ন স্থানে ইসলামের সুমহান বাণী সম্প্রসারিত হতে থাকে। পরবর্তীতে ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দে মিঙসুয়ামুঙ ওরফে নরমিখলা যার মুসলিম নাম ছিল মুহাম্মদ সুলায়মান শাহ কর্তৃক আরাকান পুনরুদ্ধারের পর থেকে আরাকানে মুসলমানদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। এমনকি আরাকানের রাজধানী লংগ্রেত থেকে ম্রোহঙ এ স্থনান্তর করা হলে সেখানকার প্রায় সকল অধিবাসীই মুসলিম ছিলেন এবং ম্রোহংয়ের অধিবাসীদেরকেই রোহিঙ্গা নামে আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে রোহিঙ্গা বলতে আরাকানের মুসলমানদেরকেই ধরে নেয়া হয়। কেননা রোহিঙ্গারাই ছিলেন আরাকানের প্রধান মুসলিম জনগোষ্ঠী। জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের নামে আবারো মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে আরাকানে। স্থানীয় মগজনগোষ্ঠী এবং প্রশাসনের প্রকাশ্য সহায়তায় আরাকানের মংডু এবং আকিয়ার এলাকায় চলছে নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজ। রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে বিরানভূমিতে পরিণত করছে গ্রামের পর গ্রাম। রোহিঙ্গা যুবতী নারীদের অপহরণ করা হচ্ছে নির্দ্বিধায়। ইতোমধ্যে প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক যুবতী নারীকে অপহরণ করা হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। খাল, বিল এবং জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে মহিলাদের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ধর্ষণ শেষে নির্মমভাবে তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। মুসলমানদেরকে হত্যা করে তাদের দাড়ি গোফ মুড়িয়ে গেরুয়া পোষাক পরিয়ে বৌদ্ধলাশ সাজিয়ে মিডিয়ার সামনে মুসলমানদেরকেই দাঙ্গা সৃষ্টিকারী এবং ঘাতক হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে সেখানে। মানবিক বিপর্যয়ের এক জ্বলন্ত জাহান্নামে পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গাদের বসতভিটে। এমন নির্মমতায় প্রাণ হারাচ্ছে অসহায় নারী শিশু ও বৃদ্ধসহ সেখানকার খেটে খাওয়া অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিতসহ সমগ্র রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী। সর্বস্ব হারিয়ে নিজেদের প্রাণটুকু বাঁচানোর তাগিদে তারা পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছে পাশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে। কিন্তু বাংলাদেশ তাদেরকে আশ্রয় দিতে সক্ষম কি না কিংবা আশ্রয় দিলেই এ সমস্যার সমাধান হবে কি না এসব বিতর্কের কারণে বাংলাদেশ সরকারও ভীষণভাবে কঠোরতা অবলম্বন করে তাদেরকে আশ্রয়ের কোন সুযোগ দিচ্ছে না। বরং আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের দৃঢ়চেতা বক্তব্যে জাতি আশাহত হয়েছে। এমনকি যারা মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল, নদীর অথৈ জলে অসহায় মানুষদের খাবার পানীয় সরবরাহ করছিল তাদের দিকে জাতিগত দাঙ্গার মদদদাতার অভিযোগ তুলে বিবেকবান মানুষকে হতবাক করেছে। নির্যাতিত নিস্পেষিত অসহায় রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু করা তো দূরের কথা বরং যারা কিছু করার চেষ্টা করছেন তাদের দিকেও অযাচিত ও অনাকাংখিত সন্দের আঙ্গুল উচ্চকিত করা হচ্ছে। ফলে আহত ও নির্যাতিত অসহায় মানুষগুলোকে অবর্ণনীয় কষ্টের মাধ্যমে নদী আর সাগর জলেই মৃত্যুমুখে গমন করতে হচ্ছে। বিশ্বায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি ও মানবিক উৎকর্ষতার এ উন্নত যুগে সকলের চোখের সামনে এমন মানবিক বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছে নিবিঘœভাবে। কেউ যেন নেই দেখবার, সাহায্যের হাত বাড়াবার কিংবা ন্যূনতম সহানুভূতি প্রকাশ করবার। চোখের সামনে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে রাখাইন রাজ্য নামে পরিচিত আরাকান রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী একটি মুসলিম জনগোষ্ঠী। অথচ তারা আরাকানেরই মূল জনগোষ্ঠী, জন্মগতভাবেই আরাকানের নাগরিক, তাদের হাতেই পরিপুষ্টি অর্জন করেছে আরাকানের ইতিহাস ঐতিহ্য। শুধুমাত্র মুসলিম হওয়ার অপরাধেই তাদের ওপর চলছে এ অমানবিক নির্যাতন। অথচ রোহিঙ্গারাই আরাকানের প্রথম বসতি স্থাপনকারী মূল ধারার সুন্নি আরব মুসলমান। আরাকান রাজ্যের মুসলিম সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হিসেবে রোহিঙ্গাদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। কিন্তু মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের নৃতাত্ত্বিক অস্তিত্বকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে আরাকান অঞ্চল থেকে মুসলিম সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যকে স্মৃতিপট থেকে মুছে ফেলতে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ফলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বর্তমানে নিজ দেশে নাগরিকত্বহীন অবস্থায় পরবাসী হয়ে জীবন যাপন করছে। অথচ রোহিঙ্গাদের কেউ হাজার বছর, কেউ পাঁচ শতাধিক বছর আর কেউবা কয়েকশত বছর ধরে সেখানে বসবাস করছে। মূলত বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিশেষত ব্রিটিশ বিদায়ের শেষপর্বে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়ে অমীমাংশিত ও প্রশ্নবোধক অধ্যায়ের সূচনা হয়; যার ফলে অদ্যাবধি রোহিঙ্গাদেরকে আরাকানের অভিবাসী আশ্রিত মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করতে হচ্ছে এবং বারবার তাদেরকে স্বদেশভূমির ভিটেমাটি ত্যাগ করে বাংলাদেশে শরণার্থীর জীবন বেছে নিতে হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটের প্রেক্ষাপট আরাকান এককালে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকলেও অধুনাকালে মিয়ানমারের একটি প্রদেশ। অনুরুপভাবে রোহিঙ্গারাও এক সময় স্বাধীন আরাকানের অমাত্যসভা থেকে শুরু করে রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখলেও বর্তমানে তারা আরাকানের সবচেয়ে নিগৃহীত জাতিগোষ্ঠী। ১৭৮৪ সালে বর্মীরাজ বোধপায়া কর্তৃক আরাকান দখলের মধ্য দিয়েই মূলত রোহিঙ্গাদের নিগৃহীত জীবনের সূচনা হয়। অতঃপর ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তিলগ্নে ব্রিটিশ কূটকৌশলের ফলে তাদের জীবনে দ্বিতীয়বারের মত অনিশ্চয়তা নেমে আসে। স্বাধীনতা-উত্তর বার্মায় ১৯৬২ সালে সামরিক জান্তা নে উইন কর্তৃক ক্ষমতা দখলের পর হতে রোহিঙ্গারা ক্রমশ নাগরিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হতে থাকে। অবশেষে ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনের নামে তাদেরকে বহিরাগত হিসেবে চিহ্নি করে কল্লা বা বিদেশী আখ্যা দিয়ে দেশ থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে। রোহিঙ্গারা জন্মসূত্রে আরাকানের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের জীবনে এ দূর্ভোগের পিছনে নি¤েœাক্ত কারণ উল্লেখ করা যায়- প্রথমত, রোহিঙ্গারা দীর্ঘ হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় আরাকানের অমাত্যসভাসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন থাকলেও তারা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র কোন ধারা সৃষ্টি করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে বর্মীরাজ বোধপায়া কর্তৃক ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান দখলের পর আরাকানের সর্বময় ক্ষমতা বর্মীদের হাতে চলে যায়। তারা পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাসহ আরাকানী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে হত্যা করে। অবশিষ্টদের অনেকেই প্রাণ ভয়ে বাংলায় পালিয়ে আসে এবং ১৮২৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধের মাধ্যমে আরাকান দখল পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময়ে দেশের বাইরে অবস্থান করে। এ সময়ে সিন পিয়ানসহ অনেক আরাকানী নেতা স্বদেশ পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম পরিচালনা করলেও বিভিন্ন কারণে তারা ব্যর্থ হয়। ফলে বাংলায় আশ্রিত রোহিঙ্গাসহ আরাকানে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা নেতৃত্বের দিক থেকে আরো পিছিয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, ১৮২৬ সালে আরাকানে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তারা রোহিঙ্গাদেরকে বাহ্যিক কিছু সুযোগ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত করে। শাসকগোষ্ঠী নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রয়োজনেই আরাকানের প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্র ছাড়াও কৃষি, ব্যবসায় প্রভৃতি কাজের জন্য বাংলায় আশ্রিত রোহিঙ্গাসহ আরাকানীদেরকে স্বদেশে বসবাসের সুযোগ প্রদান করে। এ সময় রোহিঙ্গাদের নেতৃস্থানীয় শিক্ষিত শ্রেণীর অনেকেই আরাকানে ফিরে না গিয়ে বাংলার কক্সবাজার ও বান্দরবান অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। মধ্যবিত্ত ও নিুবিত্ত শ্রেণীসহ কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা স্বদেশে ফিরে গেলেও নেতেৃত্বের ক্ষেত্রে নতুন করে কোন অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। পক্ষান্তরে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা ব্রিটিশের কর্তৃত্বকে সহজে মেনে না নেবার কারণে বরাবরই তারা মুসলমানদেরকে শত্রু মনে করতো। ফলে বার্মায় পুরোপুরিভাবে ব্রিটিশ কর্র্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার পর রোহিঙ্গারা যাতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে না পারে সেজন্য তাদেরকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত না করে স্থানীয় মগদের প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এমনকি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বার্মাকে স্বাধীনতা প্রদানের পূর্বে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বিষয়ে মগদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। স্বাধীনতা উত্তর মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন বর্মী ও স্থানীয় মগরা সে ইস্যুকে ক্রমশ শক্তিশালী করে তোলে; যার সর্বশেষ পরিনতি হিসেবে রোহিঙ্গারা কল্লা বা ভিনদেশী চিহ্নিত হয়ে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হয়। ব্রিটিশ শাসিত বার্মাকে মুক্ত করার আন্দোলনে রোহিঙ্গারা স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা অং সানকে সমর্থন দিয়ে বার্মাকে ব্রিটিশ শাসন মুক্ত করলেও তারা তাদের অধিকার ফিরে পায়নি। স্বাধীনতা উত্তর বার্মার শাসক গোষ্ঠী বিভিন্ন অজুহাতে তাদেরকে মিয়ানমার বা আরাকানের নাগরিক হিসেবে গ্রহণ না করে শুধুমাত্র আরাকানের বাসিন্দা হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে। রোহিঙ্গারা আরাকানের স্বাধিকার আন্দোলন শুরু করলে রাজনৈতিক কৌশলে তাদের এ পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। অতঃপর তাদের উপর চালানো হয় ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭৮-৭৯ সালে প্রায় তিন লক্ষ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বালাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের চাপ ও বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কূটনৈতিক তৎপরতায় বিষয়টির বাহ্যিক সমাধান নিশ্চিত হয়। তাই রোহিঙ্গাদের নিঃশেষ করে দেবার জন্য কৌশল অবলম্বন করে ১৯৮২ সালে বিতর্কিত বর্ণবাদী নাগরিকত্ব আইন ঘোষণা করেন। এ আইনে নাগরিকদের ঈরঃরুবহ, অংংড়পরধঃব এবং ঘধঃঁৎধষরুবফ শ্রেণীতে ভাগ করে ১৮২৩ সালের পরে আগত বলে অংংড়পরধঃব কিংবা ১৯৮২ সালে নতুনভাবে দরখাস্ত করে ঘধঃঁৎধষরুবফ ঈরঃরুবহ ঘোষণা করার ব্যবস্থা করে। উক্ত আইনের ৪নং প্রভিশনে আরো শর্ত দেয়া হয়, কোন জাতিগোষ্ঠী রাষ্ট্রের নাগরিক কিনা তা নির্ধারণ করবে আইন-আদালত নয়; সরকারের নীতি-নির্ধারণী সংস্থা ঈড়ঁহপরষ ড়ভ ঝঃধঃব. এ আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভাসমান নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রোহিঙ্গাদের কাছে কালো আইন হিসেবে বিবেচিত এ আইন তাদের সহায়-সম্পত্তি অর্জন, ব্যবসায়-বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা সাভির্সে যোগদান, নির্বাচনে অংশগ্রহণ কিংবা সভা-সমিতির অধিকারসহ সার্বিক নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়। বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাসহ প্রচার মাধ্যমগুলো তাদেরকে সেখানকার স্থায়ী নাগরিক হিসেবে সম্বোধন করে। ১৯৭৮ এবং ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গাদেরকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে মিয়ানমার সরকার বিভিন্ন অপারেশনের নামে আরাকানে এক অমানবিক নির্যাতন চালায়। তবে তাদের এ অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ অপারেশনে তারা হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং দুইপর্বে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে তাদের পৈতৃক বসতবাড়ী থেকে উচ্ছেদের মাধ্যমে প্রতিবেশী বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ সরকার সীমিত সামর্থ্য নিয়েই অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ত্রাণ কার্যক্রমসহ আশ্রায়ন ক্যাম্প তৈরী করে আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতায় বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তথাপিও রোগ-শোক, অনাহার-অর্ধাহারে নাফ নদী পেরিয়ে আসা অসংখ্য লোক প্রাণ হারায়; যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও কৌশল অবলম্বন করে দ্বি-পক্ষীয় ভিত্তিতে এ সমস্যার সমাধান করেন। যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যার প্রেক্ষাপটে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ। তাই রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য বাংলাদেশকেও উদ্যোগ নিতে হবে। আরাকানী মুসলমানদের সাথে বাংলাদেশের সহস্র বছরের বন্ধন ও ঐতিহ্যকে সামনে রেখে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও ধর্মীয়সহ বহুমাত্রিক বন্ধনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে দেশের স্বার্থে; মানবতার জন্য বাংলাদেশেরই এগিয়ে আসা উচিত। রোহিঙ্গা সমস্যাকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বের নিকট গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরতে হবে; এক্ষেত্রে বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলিকে সমস্যা সমাধানের জন্য উৎসাহিত করে ওআইসিসহ আন্তর্জাতিক মুসলিম সংস্থাগুলো মিলে জাতিসংঘের কাছে এর গুরুত্ব তুলে ধরে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। সেইসাথে মিয়ানমার সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টাও করা উচিত। মূলত আরাকানে মুসলিম জাতিসত্তা বিনাশ করে এককভাবে মগ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়েই রোহিঙ্গাদেরকে বসতবাড়ী থেকে উচ্ছেদ করে দেশের বিভন্ন স্থান থেকে মগদের এনে প্রত্যাবাসন করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে স্বাধীন আবাসভূমি ছাড়া রোহিঙ্গাদের মুক্তির বিকল্প কোন পথ খোলা নেই বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু স্বাধীকার আন্দোলনের নিমিত্তে কিছু কিছু সংগঠন কাজ করলেও মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গানীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মত সাংগঠনিক ও বৈপ্লবিক শক্তি কোনটিই তাদের নেই। এ প্রেক্ষিতে অসহনীয় নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহকে মানবাধিকারের মমত্ববোধ নিয়ে এগিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মন্তব্য লিখুন