post

আরাফা দিবস গুরুত্ব ও ফজিলত

মুহাদ্দিস ডক্টর এনামুল হক

০৮ জুলাই ২০২২

মানাসিকে হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। জিলহজ মাসের ৯ তারিখ সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফা ময়দানে চিহ্নিত সীমানার মধ্যে অবস্থান করা মানাসিকে হজের প্রধান রুকন। এ দিনকেই আরাফার দিন বলা হয়। আরাফার ময়দান হেরেম এলাকার বাইরে অবস্থিত। কাবা শরিফ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, মাসজিদুল হারাম রোড হয়ে ২২ কিলোমিটার দূরে ১০.৪ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিস্তৃত আরাফার এ ময়দান। চতুর্দিকে সীমানা-নির্ধারণমূলক উঁচু ফলক রয়েছে। ৯ জিলহজ ভোরে ফজরের সালাত মিনায় আদায় করে সূর্যোদয়ের পর ‘তালবিয়া’ পড়া অবস্থায় রওয়ানা হতে হয় আরাফা অভিমুখে। এ দিনটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও মর্যাদাপূর্ণ। 

আরাফা দিবসের মর্যাদা

১. এই দিনটি ‘ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ ও বিশ্ব মুসলিমের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির দিন। হাদিসে এসেছে, “তারিক বিন শিহাব (রহ) হতে বর্ণিত, এক ইহুদি লোক উমর রা.কে বলল, হে আমিরুল মু’মিনিন! আপনাদের কিতাবে আপনারা এমন একটি আয়াত তিলাওয়াত করে থাকেন যদি সে আয়াতটি আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হতো তাহলে আমরা সে দিনটিকে ঈদ হিসাবে উদযাপন করতাম। তিনি বললেন, সে আয়াত কোনটি? লোকটি বলল, আয়াতটি হলো- আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবনবিধান হিসাবে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদা : ৩)। উমর রা. এ কথা শুনে বললেন, আমি অবশ্যই জানি কখন তা অবতীর্ণ হয়েছে ও কোথায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং অবতীর্ণ হওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সা. কোথায় ছিলেন। সে দিনটি হলো জুমার দিন। তিনি সে দিন আরাফার ময়দানে দাঁড়িয়ে ছিলেন।” (বুখারি-৪৫, ৪১৪৫, ৬৮৪০; মুসলিম-৭৭১০, ৭৭১১, ৭৭১২)

২. আরেক হাদিসের ভাষ্যে এ দিন হলো ঈদের দিনসমূহের মধ্যে একটি দিন। হাদিসের ভাষ্যে; “উকবা ইবন আমির রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, আরাফার দিবস, কুরবানির দিন ও আইয়ামে তাশরিক (কুরবানি পরবর্তী তিন দিন) আমাদের ইসলামের অনুসারীদের জন্য ‘ঈদের দিন। আর এ দিনগুলো খাওয়া-দাওয়া ও পানাহারের দিন।” (তিরমিজি-৭৭৩; আবু দাউদ-২৪২১)

‘উমর রা. বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবন আববাস রা. বলেন, “আম্মার ইবন আবি আম্মার রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. সূরা মায়িদার উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করলেন, তখন তাঁর নিকট এক ইয়াহুদি বসে ছিলো। তিনি বলেন, যদি এ আয়াত আমাদের ইয়াহুদিদের ওপর নাজিল হতো, তাহলে আমরা সে দিনকে ঈদের দিন হিসেবে গণ্য করতাম। তখন আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. বলেন, এ আয়াতটি নাজিল হয়েছে দুটো ঈদের দিনে। তা হলো জুমার দিন ও আরাফার দিন।” (তিরমিজি-৩০৪৪; মিশকাতুল মাসাবিহ-১৩৬৮) 

এ ব্যাপারে অপর হাদিসে এসেছে, “নুবাইশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ----মনে রেখো, এ দিনগুলো হলো পানাহারের দিন এবং মহামহিম আল্লাহর জিকির করার দিন।” (আবু দাউদ-২৮১৫; মুসনাদু আহমাদ-২০৭২৩, ২০৭২৮, ২০৭২৯) 


আরাফায় জোহর-আসর এক সাথে আদায়

জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাজ মিনায় পড়ে আরাফাতের ময়দানের দিকে রওয়ানা হওয়া। আরাফাতে সূর্য হেলার পর অর্থাৎ ১২টার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা হজের গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। ‘মাসজিদে নামিরায়’ জোহর ও আসরের জামাত এক আজান দুই ইকামাতে একত্রে আদায় করলে একত্রে দুই ওয়াক্ত আদায় হয়ে যায়, ওটার নাম ‘জমে তাকদিম’। কিন্তু তাঁবুতে বা অন্য কোনো স্থানে একত্রে নয়। ভিন্ন সময়ে ভিন্নভাবে ওয়াক্ত মত আদায় করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা. সাহাবায়ে কিরামদেরকে নিয়ে জোহর ও আসর সালাত একসাথে আদায় করেন। বিদায় হজ সম্পর্কে দীর্ঘ সহিহ হাদিসে এসেছে, “জাফর ইবন মুহাম্মদ রা. বর্ণিত, তিনি তার পিতার নিকট নিকট হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি জাবির রা.-এর বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসে বর্ণনা করেছেন, ---মহানবী সা. উপত্যকার মধ্যখানে এলেন। তিনি লোকজনকে লক্ষ্য করে খুতবা দিলেন। অতঃপর আজান দেওয়া হল, ইকামত হলো এবং তিনি জোহরের সালাত আদায় করলেন। এরপর ইকামত হলো এবং তিনি আসরের সালাত আদায় করলেন। এ দুয়ের মাঝখানে অন্য কোনো সালাত আদায় করলেন না।” (মুসলিম-৩০০৯; আবু দাউদ-১৯০৭) 


আরাফা দিবসের ফজিলত 

আরাফা দিবসের অনেক ফজিলত সহিহ রিওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে। যেমন-

১. আরাফা দিবসের সিয়াম দু’বছরের গুনাহের কাফফারা : আরাফার দিন সিয়াম পালন করলে এক বছর পূর্বের এবং এক বছর পরের গুনাহ মাফ হয়। সহিহ হাদিসে এসেছে, “আবু কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা.কে আরাফা দিবসের সিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আরাফার দিনের সিয়াম, আমি আশা করি বিগত এক বছর ও আগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসাবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।” (মুসলিম-২৮০৩; তিরমিজি-৭৪৯; আবু দাউদ-২৪২৭) 

অন্য হাদিসে এসেছে, “আবু কাতাদাহ রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা.কে আরাফার সাওম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, আরাফার সাওম পালন করলে বিগত এক বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহ মাফ হয়ে থাকে। এক বর্ণনায় বিগত দুই বছর ও আগামী দুই বছরের গুনাহ মাফ করা হয়ে থাকে।” (মুসলিম-২৮০৪, মুসনাদু আহমাদ-২২৫১৭, ২২৫৮৯)

উল্লেখ্য যে, তবে এ সাওম হাজীদের জন্য নয়, বরং যারা হজ করতে আসেনি তাদের জন্য। হাজীদের জন্য আরাফার দিবসে সাওম রাখা মাকরুহ। রাসূলুল্লাহ সা. বিদায় হজের সময় আরাফা দিবসে সাওম রাখেননি। বরং সবার সম্মুখে তিনি দুধ পান করেছেন। সহিহ সনদে এসেছে, “উম্মুল ফজল বিনত হারিস রা. হতে বর্ণিত যে, লোকেরা আরাফার দিন তার নিকট রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাওম পালন (করা না করা) সম্পর্কে আলোচনা করছিলো। তাদের কেউ কেউ বললেন, তিনি সাওমরত নন। এরপর আমি তার নিকট এক পেয়ালা দুধ পাঠালাম, তিনি আরাফাতে উটের ওপর বসা অবস্থায় ছিলেন। দুধটুকু তিনি তখনই পান করলেন।” (বুখারি- ১৫৭৮, ১৮৮৭, ৫২৯৫; মুসলিম-২৬৮৮, ২৬৯১) 

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, “ইকরামা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু হুরায়রা রা.-এর বাড়িতে প্রবেশ করে আরাফা দিবসে আরাফার ময়দানে থাকা অবস্থায় সওমের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সা. আরাফার ময়দানে আরাফা দিবসের সাওম রাখতে নিষেধ করেছেন। আরাফার দিনে সিয়াম পালন করবেন তারাই যারা হজব্রত পালন করেন না। অর্থাৎ আরাফা ময়দানের বাইরে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের মুসলিম এ সিয়াম পালন করবেন।” (মুসনাদু আহমাদ-৮০৩১; ইবনে মাজাহ-১৭৩২) 

২. আরাফার দিন গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের দিন : এ দিনে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় বান্দাদের মধ্য থেকে অধিক সংখ্যক মানুষকে ক্ষমা করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। হাদিসে এসেছে, “আয়িশা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, আরাফার দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাদের এত অধিক সংখ্যক জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, যা অন্য কোনো দিনে দেন না। তিনি এ দিনে বান্দাদের নিকটবর্তী হন ও তাদের নিয়ে ফিরিশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন, তোমরা কি বলতে পার আমার এ বান্দারা আমার কাছে কী চায়?” (মুসলিম-৩৩৫৪; ইবনে খুযাইমা-২৮২৭) 

ইমাম নববী (রহ) বলেন, এ হাদিসটি আরাফা দিবসের ফজিলতের একটি স্পষ্ট প্রমাণ। ইবন আব্দুল বার (রহ) বলেন, এ দিনে মু’মিন বান্দারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হন। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন গুনাহগারদের নিয়ে ফিরিশতাদের কাছে গর্ব করেন না। তবে তাওবা করার মাধ্যমে ক্ষমা-প্রাপ্তির পরই তা সম্ভব। হাদিসে এসেছে- “আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সা. বলেছেন, যখন আরাফার দিন হয়, তখন আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন। অতঃপর তিনি আরাফায় অবস্থানকারীদের নিয়ে ফিরিশতাদের নিকটে গর্ব করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমার এ সকল বান্দাদের দিকে চেয়ে দেখ। তারা এলোমেলো কেশ ও ধুলায় ধূসরিত হয়ে আমার কাছে এসেছে।” (মুসনাদু আহমাদ-৮০৪৭; ইবনে মাজাহ-৮০১) 

৩. আরাফায় অবস্থানই হজ : এ কথা সহিহ বর্ণনায় এসেছে যে, আরাফায় অবস্থানই হজের মূল কাজ। হাদিসে এসেছে, “আব্দুর রহমান ইবন ইয়ামার আদ দায়লী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.-এর আরাফাতে উপস্থিতকালে তার নিকট উপস্থিত ছিলাম। এমতাবস্থায় নাজদবাসী কিছু লোক তাঁর নিকটে আসলো। তারা হজ সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করলো এবং বললো ইয়া রাসূলুল্লাহ সা.! হজ কিভাবে সম্পন্ন হয়? তিনি বললেন, আরাফায় অবস্থানই হচ্ছে হজ। অতএব যে ব্যক্তি মুজদালিফার রাতে ফজর সালাতের পূর্বেই আরাফাতে এসে পৌঁছতে পারলো তার হজ পূর্ণ হলো। মিনায় তিন দিন (১১, ১২ ও ১৩ জিলহজ) অবস্থান করতে হয়। কিন্তু যদি কোনো ব্যক্তি দুই দিন অবস্থান করে চলে আসে তাতে কোনো অপরাধ নেই। আর তিন দিন পর্যন্ত অবস্থানকে কোনো লোক বিলম্বিত করলে তাতেও কোনো সমস্যা নেই। অতঃপর এক লোককে রাসূলুল্লাহ সা. তার পিছনে আরোহণ করালেন এবং সে লোক তা উচ্চস্বরে ঘোষণা দিতে থাকলো।” (মুসনাদু আহমাদ-১৮৭৭৪; তিরমিজি-৮৮৯) 

৪. অধিক পরিমাণে দোয়া ও জিকির করার উপযুক্ত সময় : ময়দানে আরাফায় দোয়া করাই হজের মুখ্যম ও অন্যতম ইবাদত। এ প্রসঙ্গে মহানবী সা. বলেছেন, “ত্বালহা ইবন উবাইদুল্লাহ ইবন কারিয হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, সবচেয়ে উত্তম দোয়া হলো আরাফা দিবসের দোয়া। আর সর্বশ্রেষ্ঠ কথা যা আমি বলি ও আমার পূর্ববর্তী নবীগণ বলেছেন। তা হলো, আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোনো ইলাহ নেই, রাজত্ব তাঁরই, সকল প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য এবং তিনি সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান।” (তিরমিজি-৩৫৮৫; শুয়াবুল ঈমান-৪০৭২) 

অন্য হাদিসে এসেছে “আয়িশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. পরিব্যাপ্ত দো’আ পছন্দ করতেন ও অন্যগুলো ছেড়ে দিতেন।” (আবু দাউদ-১৪৮৪)

অপর হাদিসে এসেছে, “আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. দোয়া করার সময় হাতের তালু চেহারার দিকে রাখতেন।” (মু’জামুল কবীর-১২২৩৪) 

এসব হাদিসের ব্যাখ্যায় ইবন আব্দুল বার (রহ) বলেন, এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ‘আরাফা দিবসের দোয়া নিশ্চিতভাবে কবুল হবে। আর সর্বোত্তম জিকির হলো ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। ইবন আব্দুল বার, আত-তামহিদ।

ইমাম খাত্তাবি (রহ) বলেন, এ হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, দোয়া করার সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও তাঁর মহত্ত্বের ঘোষণা করা উচিত। ইমাম খাত্তাবি, শান আদ-দোয়া, পৃ: ২০৬।

৫. উকুফে আরাফার দিবস আল্লাহর দ্বীন ও নিয়ামত পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির দিবস

আরাফার দিন মুসলমানদের জিম্মাদারি গ্রহণের দিন, মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর দীন ও নিয়ামত পরিপূর্ণতা এবং দীনের প্রতি আল্লাহ তায়ালার রেজামন্দি ঘোষিত হয়েছে। সহিহ সনদে এসেছে, “আনাস ইবন মালিক রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সা. আরাফার ময়দানে সূর্যাস্তের পূর্বে বেলালকে রা. নির্দেশ দিলেন মানুষদেরকে চুপ করাতে। বেলাল বললেন, আপনারা রাসূলুল্লাহ সা.-এর জন্য নীরবতা অবলম্বন করুন। জনতা নীরব হলো। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ‘হে লোকসকল! একটু পূর্বে জিবরাইল আমার কাছে এসেছেন। তিনি আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আহলে আরাফা ও আহলে মুজদালিফার জন্য আমার কাছে সালাম পৌঁছিয়েছেন ও তাদের অন্যায়ের জিম্মাদারি নিয়েছেন। উমর দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা.! এটা কি শুধুই আমাদের জন্য? তিনি বললেন, এটা তোমাদের জন্য ও তোমাদের পর কিয়ামত পর্যন্ত যারা আসবে তাদের জন্য। উমর রা. বললেন, আল্লাহর অনুকম্পা অঢেল ও উত্তম।” (সহিহুত তারগীব ওয়াত তারহিব-১১৫১)

৬. আদম সন্তান হতে প্রতিশ্রুতির দিন : এটি এমন দিন যেদিন আল্লাহ তায়ালা বনি আদম থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন। হাদিসে এসেছে, “আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ না’মানে অর্থাৎ আরাফার ময়দানে আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন। তিনি আদমের মেরুদণ্ডে তাঁর যত বংশধরদের রেখেছেন তাদের সবাইকে বের করে এনে অণুর মত তাঁর সামনে ছড়িয়ে দেন। এরপর সরাসরি তাদের সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি কি তোমাদের প্রভু নই? তারা সকলে বলে, হ্যাঁ অবশ্যই; আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি। এটা এ জন্য যে, তোমরা যেন কিয়ামতের দিন না বল, আমরা তো এ বিষয়ে গাফেল ছিলাম। কিংবা তোমরা যেন না বল, আমাদের পিতৃপুরুষরাও তো আমাদের আগে শির্ক করেছে, আর আমরা তো তাদের পরবর্তী বংশধর; তবে কি (শিরকের মাধ্যমে) যারা তাদের আমলকে বাতিল করেছে তাদের কৃতকর্মের জন্য আপনি আমাদেরকে ধ্বংস করবেন-সূরা আরাফ : ১৭২-১৭৩ (মুসনাদু আহমাদ-২৪৫৫; আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন। অতএব, কতই না মহান সেই দিন এবং কতই না মহান সে প্রতিশ্রুতি।

আরাফার ময়দানে হাজীদের করণীয় কাজগুলো

১. আরাফায় পৌঁছে মাসজিদে ‘নামিরা’র কাছে অবস্থান করা মুস্তাহাব তথা উত্তম। সেখানে জায়গা না পেলে আরাফার সীমানার ভিতরে যে কোন স্থানে অবস্থান করা যাবে, এতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে পাশেই ‘উরানা’ নামের একটি উপত্যকা আছে। সেটি আরাফার চৌহদ্দির বাইরে। কাজেই সেখানে যাওয়া যাবে না। ঐখানে অবস্থান করা যাবে না।

২. জোহরের ওয়াক্ত হলে ইমাম সাহেব খুতবা দেবেন। খুতবার পর জোহরের ওয়াক্তেই জোহর ও আসরের সালাত একত্রে জমা করে পড়বেন। দু’ সালাতেরই আযান একবার, কিন্তু ইকামাত দু’বার। কসর করে সালাত আদায়। অর্থাৎ জোহর দু’রাকাত এবং আসরও দু’রাকাত পড়া। জোহরের ওয়াক্তেই আসর আদায় করা। মহানবী সা. মক্কাবাসী ও বহিরাগত সব হাজীকে নিয়ে একত্রে এভাবে সালাত আদায় করেছিলেন। এটা সফরের কসর নয়, বরং হজের কসর। কোনো নফল-সুন্নাত সালাত আরাফায় আদায় করা হয় না। কারণ রাসূলুল্লাহ সা. তা করেননি।

৩. মসজিদে নামিরায় যেতে না পারলে নিজ নিজ তাঁবুতেই উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে জামায়াতের সাথে জোহর-আসর একত্রে জোহরের আউয়াল ওয়াক্তে দুই দুই রাকাত করে কসর ও জমা করে আদায় করা।

৪. আরাফার ময়দানের সীমানা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে অবশ্যই আরাফার পরিসীমার ভিতরে অবস্থান করতে হবে। আরাফার সীমানা চিহ্নিত করে চতুষ্পার্শে অনেক পিলার দেয়া আছে। এর বাইরে অবস্থান করলে হজ হবে না।

৫. সুন্নাত হলো বেশি বেশি দোয়া করা, দোয়ার সময় হাত উঠানো, অত্যন্ত বিন¤্র হওয়া, জিকর করা, তাসবিহ পড়া, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়া, তাওবাহ-ইস্তিগফার করা, কান্নাকাটি করে গোনাহ মাফ চাওয়া, মাতা-পিতা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, আপনজন ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য বেশি বেশি দোয়া করা। তাছাড়া এই দোয়াটি আরো বেশি বেশি পড়া উত্তম। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়াহুয়া আ’লা কুল্লি শায়্যিন ক্বাদীর’(বুখারি- ১৭০৩, ২৮৩৩, ৩৮৯০, ৬০২২; মুসলিম-৩৩৪৩; তিরমিজি-৯৫০, ৩৫৮৫)

এছাড়া নিচের তাসবিহটি বেশি বেশি পড়া; সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী সুবহানাল্লাহিল আজিম। (বুখারি- ৬০৪৩, ৬৩০৪, ৭১২৪; মুসলিম-৭০২১) 

এতদসঙ্গে অন্যান্য মাসনুন দোয়া সূর্যাস্ত পর্যন্ত করা যাবে। সওয়াব কমে যাবে এমন কোনো কাজ করা থেকে সাবধান থাকতে হবে।

৬. যখন সূর্য ডুবে যাবে এবং সূর্য অস্ত গিয়েছে এরূপ নিশ্চিত হবেন তখন প্রশান্ত মনে ধীরে সুস্থে মুজদালিফায় রওয়ানা দিবেন। এ সময় বেশি বেশি তালবিয়া পড়তে থাকবেন। সাবধান, কোনো অবস্থাতেই সূর্যাস্তের আগে আরাফার ময়দান ত্যাগ করা যাবে না।

আরাফার সাওম কোনদিন?

আরাফার সাওম কোনদিন রাখতে হবে, এ নিয়ে দু’টি মত পাওয়া যায়। এক: হাজী সাহেবগণ যেদিন ‘আরাফায় অবস্থান করবেন, সেদিনটিই গণ্য হবে।

কেননা হাদিসে বলা হয়েছে, সাওমু ইয়াওমি আরাফা তথা আরাফার দিবসের সাওম। দুই: হাজী সাহেবগণ ৯ জিলহজ আরাফায় অবস্থান করেন, হেতু যে দেশের যেদিন ৯ জিলহজ হবে, সেদিন সেদেশে আরাফার সাওম রাখা। দু’মতের পক্ষেই দলিল ও যুক্তি নিহিত রয়েছে। তবে আরাফার প্রথম দশদিন অত্যন্ত ফজিলত ও মর্যাদাপূর্ণ হেতু কেউ হাজীদের আরাফায় অবস্থানের দিন এবং সংশ্লিষ্ট দেশের ৯ জিলহজ সাওম পালন করে, তাহলে সেটিও উত্তম হতে পারে বলে ইসলামিক স্কলার্সগণ মতামত দিয়েছেন। ইসলামিক স্কলার্সগণ আরো বলেন, জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ হওয়ায় ১ম জিলহজ হতে ৯ জিলহজ পর্যন্ত লাগাতর সিয়াম পালন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ, হেতু এ দিবসসমূহে সিয়ামসহ বহুবিধ আমল করার চেষ্টা করা দরকার।

অতএব, আরাফা দিবসের গুরুত্ব ও ফজিলত অনুধাবন করত এ দিবসে সিয়ামসহ বহুবিধ আমলে সবাইকে সচেষ্ট হওয়া দরকার। জিলহজ মাসের প্রথম দশকে ইবাদতের ফজিলতও অত্যধিক। সে ব্যাপারেও আমাদেরকে যত্নবান হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাউফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিজুল দারুল হুদা কামিল স্নাতকোত্তর মাদরাসা বিরামপুর, দিনাজপুর

আপনার মন্তব্য লিখুন

Dr. Md Anamul Haque

- 10 months ago

Alhamdulillah

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির