post

আল্লাহর প্রিয় হওয়ার অনন্য আমল

মাওলানা শাহ মোহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ

০২ আগস্ট ২০২২

গত ২৭ মে ২০২২ ঈসায়ী সন রোজ শুক্রবার মিরপুর রোড ধানমন্ডির সোবহানবাগ জামে মসজিদে মে মাসের শেষ জুমায় আল্লাহপাকের হামদ এবং রাসূলুল্লাহ সা.-এর উপর দরুদ পাঠ শেষে মুসল্লিদের লিখিত প্রশ্নের

জবাব দেন সম্মানিত খতিব মাওলানা শাহ মোহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ

প্রশ্ন ১ : কারো অসাক্ষাতে সালাম বিনিময় করার নিয়ম আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। বলা হয় অমুককে আমার সালাম বলো বা সালাম পৌঁছে দিও। আমরা বলে থাকি অমুক আপনাকে সালাম বলেছেন। ইসলামী শরিয়তে এই নিয়ম কতটুকু সঠিক?

জবাব : না, এটি সঠিক নিয়ম নয়। বরং বলতে হবে, তোমার আব্বাকে/অমুককে আসসালামু আলাইকুম। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বলবে, আপনাকে আমার আব্বার পক্ষ থেকে/অমুকের পক্ষ থেকে আসসালামু আলাইকুম। কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, কেউ সালাম দিলে বা অভিবাদন জানালে জবাব কমপক্ষে সমান শব্দে দিতে হবে। উত্তম হবে অতিরিক্ত শব্দ যোগ করে তার চেয়েও সুন্দরভাবে অর্থাৎ ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ বলে। যতো শব্দ যোগ করা হবে ততো দশ দশ করে নেকি বাড়বে। সালাম দেওয়া সুন্নাত এবং জবাব দেওয়া ওয়াজিব। এখানে একটু ব্যতিক্রম। ওয়াজিবের চেয়ে সুন্নাতের সওয়াব বেশি।

প্রশ্ন ২ : জনৈক ব্যক্তি হজের নিয়ত করে টাকা-পয়সা জোগাড় করেছে। বর্তমানে তার এক নিকটতম প্রতিবেশী মারাত্মক রোগে হাসপাতালে। এই মুহূর্তে অপারেশন না করলে তার মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে এবং চিকিৎসার জন্য দেড় লক্ষ টাকা প্রয়োজন। মানুষের কাছে সাহায্য চেয়ে মাত্র পনেরো হাজার টাকা জোগাড় করেছে। জনৈক অমুসলিম বলেছে, তোমাদের ধর্ম বড় অমানবিক, প্রতিবেশী মৃত্যুর মুখোমুখি এবং সে তাকে সহযোগিতা না করে হজে যাচ্ছে। এখন সে কোন কাজটিকে অগ্রাধিকার দিবে?

জবাব : হজ ফরজ হলে বা হজের মান্নত করলে হজ তার ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়। এই দুই অবস্থায় তাকে হজ করতে হবে। আর হজ যদি নফল হয় সেক্ষেত্রে তার এখতিয়ার রয়েছে এ বছর হজ না করে চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা করার। সর্বোত্তম হয় দুটিই একসাথে করার অর্থাৎ হজও করবে এবং চিকিৎসার জন্য সহযোগিতাও করবে। যে ব্যক্তি হজ করবেন নিশ্চয়ই তিনি জাকাত প্রদান করে থাকেন। জাকাত পরিশোধ হয়ে গেলে অগ্রিম জাকাত প্রদান করা যায়। অসুস্থ মানুষকে সেবাদান অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। জাকাত থেকে সম্ভব না হলে সাধারণ দান থেকে সহযোগিতা করলে তিনি সৌভাগ্যবানদের একজন হবেন। অমুসলিম কী বললো সেটি বিবেচ্য নয় বরং ইসলাম কী বলে সেটিই একজন মুসলিমকে খেয়াল করতে হবে। আর এজন্য বিশেষজ্ঞ আলেমের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।

খতিব মহোদয় বলেন, হজ কোনো সাধারণ ইবাদত নয়। যেসব আমলের বিনিময়ে দুনিয়া থেকে জান্নাতের সুসংবাদ লাভ করা যায় হজ তন্মধ্যে একটি। তিনি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ইহরামের কাপড় পরিধান করে যখন একজন হজযাত্রী উচ্চারণ করেন লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক তখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ফেরেশতা ঘোষণা করেন, হ্যাঁ তোমার হাজিরা (লাব্বাইক) গণনা করা হয়েছে এবং পুরস্কৃত করা হয়েছে। পুরস্কৃত করা অর্থ জান্নাতিদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

খতিব মহোদয় রাসূলুল্লাহ সা.-এর হাদিস উদ্ধৃত করে বলেন, মাবরুর হজের পুরস্কার জান্নাত। মাবরুর হজ (কবুল হজ) হতে হলে তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। প্রথম বৈশিষ্ট্য- হজের কবুলিয়াতের জন্য রুজি হালাল হতে হবে। আমাদের সমাজে অনেকে বলে থাকেন, হুজুর আমার বেতনের টাকা জমায়ে আমি হজে যচ্ছি। যদি বলি, সংসার চলে কী করে? তখন লা-জবাব হয়ে যায়। কোনো মানুষের শরীর, তার রক্ত, গোশত, হাড় এসব যদি হারাম উপার্জনে গঠিত হয় তাহলে তা দ্বারা কোনো ইবাদতই আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না বরং সেই শরীর হবে জাহান্নামের লাকড়ি। জনৈক ব্যক্তি একদিন মসজিদে নববিতে উশকো-খুশকো হয়ে দু’হাত তুলে আল্লাহর দরবারে কাতরভাবে প্রার্থনা করছে। তার এই প্রার্থনা দেখে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, তার প্রার্থনা কবুল হবে কী করে? তার বাহন, তার কাপড়-চোপড়, তার শরীর সবই অবৈধ উপার্জনে গঠিত। আল্লাহপাক এমন লোকদের দোয়া-প্রার্থনা কখনো কবুল করেন না।

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য- রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, আমি যে নিয়মে হজ পালন করছি হজ কবুলিয়াতের জন্য সেই নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। সকল ইবাদতের ক্ষেত্রে মনগড়া কোনো নিয়ম অনুসরণ করা যাবে না। হুবহু আল্লাহর রাসূল সা.-এর তরিকা অনুসরণ করতে হবে। ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে সেটি হবে বিদয়াত এবং তা ভ্রষ্টতা ও জাহান্নামে যাওয়ার কারণ।

তৃতীয় বৈশিষ্ট্য- হজ হতে হবে কেবল আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। নাম, যশ, খ্যাতি অর্জন এবং লোকে বলবে হাজি সাহেব বা আলহাজ বা সমাজের মানুষ সমীহ করবে এমন কোনো উদ্দেশ্য থাকলে সেই হজ হজে মাবরুর হবে না।

এ বছরে টাকা-পয়সা জমা দেওয়ার পরে হঠাৎ অতিরিক্ত ব্যয় বাড়ানো নিয়ে খতিব মহোদয় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। হজের মতো ফরজ ইবাদত মধ্যবিত্ত শ্রেণি যাতে সহজে পালন করতে পারে তজ্জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানান। তিনি তাঁর মুসল্লিদের হজের নিয়ত করতে বললে সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দু’হাত তুলে সাড়া দেন।

প্রশ্ন ৩ : কনুই খোলা অবস্থায় নামাজ আদায় করলে কি নামাজ মাকরুহ হবে?

জবাব : না, এটি বাঙালি মাসয়ালা। তবে হাদিসে এতটুকু পাওয়া যায়, রাসূলুল্লাহ দু’কাঁধের উপর কাপড় ঝুলিয়ে দিতেন। আরবের লোকেরা জুব্বার সাথে খাটো হাতা পরিধান করে থাকে। তবে খতিব মহোদয় কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন, আল্লাহপাক আমাদের পিতৃপরিচয় (হে আদম সন্তান! প্রত্যেক ইবাদতের সময় তোমরা নিজ নিজ সুন্দর সাজে সজ্জিত হও- আ’রাফ ৩১) উল্লেখ করে বলেছেন, নামাজের সময় তোমরা উত্তম  পোশাকে সজ্জিত হও। ঘরে সাধারণ যে পোশাকে চলাফেরা করে এমন পোশাক বা গেঞ্জি পরে মসজিদে আসা বেমানান। যে পোশাকে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সম্মুখে যেতে একজন ব্যক্তি ইতস্তত করে এমন পোশাকে আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হওয়া উচিত নয়। পোশাকের ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো পোশাক প্রথমত লজ্জা নিবারণ করবে এবং দ্বিতীয়ত সৌন্দর্যবর্ধক হবে। সাথে সাথে লিবাসুত তাকওয়ার কথা বলা হয়েছে। পোশাক অহঙ্কার প্রকাশক হবে না এবং অপর জাতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হবে না। ভদ্র ও রুচিশীল পোশাক হতে হবে। 

প্রশ্ন ৪ : মৃত্যুর পর রূহের অবস্থান কোথায় হবে?

জবাব : আত্মা ও দেহ দুই মিলেই মানুষ। আত্মা বা রূহ অবিনশ্বর । এর ক্ষয় নেই। রূহ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা.-কে প্রশ্ন করা হলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি বলেন, রূহ আল্লাহর আদেশ। মৃত্যুর পর মানুষের দেহটি সমাহিত করা হয়। সে সময়ে দেহ ও আত্মার সংযোগ ঘটানোর পর মুনকার-নাকির ফেরেশতা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তোমার রব কে? দ্বীন কী? নবী কে? ঠিক ঠিক জবাব দেয়ার পর আল্লাহর নেক বান্দার রূহ ফেরেশতারা ঊর্ধ্বজগতে নিয়ে যান এবং ইল্লিনে সংরক্ষণ করেন। পক্ষান্তরে যারা জবাব দিতে পারে না আজাবের ফেরেশতারা তা মাটির নিচে সিজ্জিনে সংরক্ষণ করেন। মানুষের দেহের সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও মেরুদণ্ডের নিচের এক টুকরো ছোট্ট হাড় নষ্ট হয় না এবং কিয়ামতের দিন সেটি থেকে দুনিয়ায় যে যে রকম চেহারা নিয়ে আছে সেভাবে সবাই উত্থিত হবে।

শ্রুতিলিখন : প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির