আল্লাহর রাসূল কিভাবে দাওয়াতি কাজ করেছেন
ইউনুছ আব্দুদ্দাইয়ান
১৭ এপ্রিল ২০১৭
আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক যুগেই মানবতাকে আল্লাহর পথে আহবান করার জন্য নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। হজরত আদম (আ) থেকে শুরু করে হজরত মুহাম্মদ (সা) পর্যন্ত অসংখ্য নবী ও রাসূল দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। সকল নবী-রাসূলের মৌলিক দাওয়াত ছিল একই কালেমার প্রতি আর তা হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। তাঁরা সকলেই আহবান জানিয়েছেন, তোমরা বল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তুফলিহু’ অর্থাৎ এক আল্লাহর দাসত্ব কবুল কর তাতেই সফলতা লাভ করবে। জীবন-জিন্দেগি আল্লাহর নির্দেশ ও তাঁর প্রেরিত রাসূলের নির্দেশনা অনুযায়ী ঢেলে সাজানোর জন্য তাঁরা আহবান জানিয়েছেন। দুনিয়াতে যারাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে বিধিনিষেধ এর বিরোধিতা করবে তাদের বিরোধিতা করে আল্লাহর অনুগত বান্দাহ হিসেবে জীবন যাপনের চেষ্টা করতেন সকল যুগের নবী-রাসূলদের অনুসারীরা। আর এই কারণেই তাঁরা কায়েমি স্বার্থবাদীদের বাধার সম্মুখীন হতেন। হকপন্থী মানবতা উক্ত বাধাবিপত্তি ধৈর্য ও ইস্তিকামাতের সাথে মোকাবিলা করে সর্বস্তরের মানুষের কাছে হকের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন।
হজরত আদম (আ), হজরত নূহ, হজরত মূসা, হজরত ইবরাহিম ও হজরত ঈসা (আ)সহ সকল নবী-রাসূলের দাওয়াতের ধারাবাহিকতায় আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা) আইয়্যামে জাহিলায়াতের সময় জাজিরাতুল আরবের মক্কার কুরাইশ বংশে আবির্ভূত হন। আরবে সেই সময় অধিকাংশ মানুষ মূর্তিপূজা করতো। কাবাঘর মূর্তি দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। মক্কা বিজয়ের সময় কাবাঘরে তিন শত ষাটটি মূর্তি ছিলো। জাহিলি যুগে লোকেরা মূর্তির সামনে বসতো, তাদের কাছে আশ্রয় চাইতো এবং সাহায্য চাইতো। মূর্তির চারপাশে তাওয়াফ করতো। মূর্তিগুলোর জন্য কুরবানি দিতো। উৎপাদিত ফসলের একাংশ মূর্তির জন্য পৃথক করে রাখতো। কিন্তু দ্বীনি ইবরাহিমকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করেনি। হজ করতো, উমরা করতো, আরাফাত এবং মুযদালিফায় অবস্থান করতো এবং উলঙ্গ হয়ে কাবাঘর তাওয়াফ করতো। সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। নারী-পুরুষ অবাধ সম্পর্ক ছিলো। স্বামীরা অভিজাত বংশের কারো সন্তান লাভের জন্য স্ত্রীকে তার কাছে পাঠাতো। অনেক মানুষ মিলে একজন মহিলাকে বিবাহ করতো। পতিতা মহিলারা ঘরের সামনে প্রকাশ্যে পতাকা টানিয়ে রাখতো। যে কেউ ইচ্ছা করলে তাদেরকে ভোগ করতে পারতো। সহোদর দুই বোনকেও এক সাথে স্ত্রী হিসাবে রাখতো। কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিতো। তাদের কোন সামাজিক মর্যাদা ছিল না। পাপাচার ও নির্লজ্জতা সমাজে ছেয়ে যায়। আরবের মহিলারা সুতার কাজ করতো ও পুরুষেরা কাপড় বুনতো এবং চামড়া শিল্পের সাথে সম্পর্কিত ছিল। তাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ছিল সুদনির্ভর। যুদ্ধবিগ্রহ ছিল তাদের সাধারণ ব্যাপার। একটি বকরি, গাছের পাতা খাওয়াকে কেন্দ্র করে বছরের পর বছর যুদ্ধ লেগে থাকতো। এইসব নেতিবাচক দিকের মধ্যেও তাদের কিছু ভালো গুণ ছিল। তারা ছিল দানশীল-তবে মদ একে অপরকে উপহার দেয়া ছিল তাদের সামাজিক রীতি। তারা অঙ্গীকার পালন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ছিলো। সরলতা ও ধৈর্য তাদের জীবনের ভূষণ ছিলো। অঙ্গীকার পালন করতে তারা সন্তান খুন করতেও দ্বিধা করতো না। এমনি এক পঙ্কিল সমাজে রাসূলে কারীম (সা) জন্ম নিলেন।
আল্লাহর রাসূল জাহিলি সমাজে বড় হলেও পঙ্কিলতা তাঁকে স্পর্শ করেনি। তিনি স্বচ্ছ চিন্তা, দূরদর্শী, সত্যপ্রিয় ও মার্জিত ব্যবহারের অধিকারী ছিলেন। সত্যবাদিতা, আমানতরক্ষা, হৃদয়ের কোমলতা প্রভৃতি গুণের কারণে সকলে তাঁকে ভালবাসতো। তাই হাজরে আসওয়াদ প্রতিস্থাপনের বিরোধ মীমাংসায় তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্বান্ত সকলেই মেনে নেন। হাজরে আসওয়াদ একটি চাদরের মাঝখানে রেখে সকল গোত্রের নেতাদেরকে নিয়ে তিনি তা প্রতিস্থাপন করেন।
মুহাম্মদ (সা) নানাভাবে সমাজ সংস্কারের চেষ্টা করেও কাক্সিক্ষত সমাজ পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন না তাই হেরা পর্বতে ধ্যানে মগ্ন হলেন। পানি ও ছাতু নিয়ে গুহার উপরে উঠে গভীর ধ্যানে মগ্ন হতেন। যে কয়দিন হেরা গুহায় থাকতেন সে কয়দিনের খাবার এক সাথে নিয়ে যেতেন। খাদিজাও তাঁর সাথে যেতেন এবং নিকটবর্তী কোন জায়গায় অবস্থান করতেন। নবুওয়ত পূর্ববতী সময়ে গভীরভাবে তাফাক্কুর ও তাদাববুর করা আল্লাহ পাকেরই পরিকল্পনা ছিলো। এভাবে মূলত তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় শুধুমাত্র মানবীয় বুদ্ধি-বিবেক দিয়ে মানব সমস্যার সমাধান ও সমাজ সংস্কার সম্ভব নয়। এইভাবে চিন্তাভাবনায় তিন বছর পার হওয়ার পর ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্ট সোমবার রাতে হজরত জিবরাইল (আ) প্রথম অহি নিয়ে আগমন করেন। তখন রাসূলে কারীম (সা)-এর বয়স ছিলো ৪০ বছর ৬ মাস বারো দিন। অহি নাজিলের সূচনায় ফেরেশতা এমনভাবে তাঁকে বুকে জড়িয়ে চাপ দেন যে তাঁর সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এরপর ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘পড়’। তিনি জবাব দেন আমি পড়তে জানি না। এইভাবে বুকে জড়ানো ও ছেড়ে দেয়ার পর তৃতীয়বার ছেড়ে দিয়ে বলে পড়ো, ‘ইকরা বি-ইসমি রাব্বিকাল্লাযি খালাক’- পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন জমাটবাঁধা রক্ত থেকে। পড়ো তোমার অতি দয়ালু প্রভুর নামে।
আল্লাহর রাসূলের দাওয়াতের বিষয়বস্তু
সূরা মুদ্দাসসিরের শুরুতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর দাওয়াতের বিষয়বস্তু চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। আর তা হচ্ছে :
হ আখিরাত বিশ্বাস : আল্লাহর আজাবের ভয় প্রদর্শন করা। আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিশ্বে যে কাজ হচ্ছে তার পরিণাম সম্পর্কে জানানো এবং তার ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা।
হ তাওহিদ : রবের শ্রেষ্ঠত্ব ও বড়ত্ব প্রকাশ করা।
হ রেসালাতের দায়িত্ব পালনের জন্য সকল প্রকার অপরিচ্ছন্নতা থেকে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা।
হ কারো প্রতি দয়া বা অনুগ্রহ করার পর অধিক বিনিময়ের প্রত্যাশা না করা। একটির পর আরেকটি কাজের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা অব্যাহত রাখা এবং যে কোন ধরনের ত্যাগ ও কুরবানিকে তুচ্ছ মনে করা।
হ দাওয়াতের কাজ শুরু করার পর শত্রুদের পক্ষ থেকে বিরোধিতা, হাসি ঠাট্টা, উপহাস ও বিদ্রƒপ করা হবে। হত্যার চক্রান্ত করা হবে। বীরত্ব ও দৃঢ়তার সাথে এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করা।
আল্লাহর রাসূল (সা)-এর দাওয়াত ছিলো সার্বজনীন
আল্লাহর রাসূল (সা) বিদায় হজের ভাষণ দেয়ার সময় যারা উপস্থিত ছিলেন সকলেই ঈমানদার ছিলেন। কিন্তু বিদায় হজের ভাষণে তিনি একটি বারের জন্য হে ঈমানদারগণ অথবা হে মুসলমানগণ বলে সম্বোধন করেন নাই। হে মানবতা- ইয়া আইয়ু হান্নাস বলে সম্বোধন করেছেন ৭ বার। এ থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহর রাসূল (সা) এই ভাষণটি মুসলমানদের সামনে দিলেও তাঁর ভাষণের বিষয়বস্তু ছিল অনাগত কালের সমস্ত মানবতা। তাই আজকের প্রেক্ষাপটে অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাঁর এই ভাষণের দিকনির্দেশনা অনুসরণ করা জরুরি। মহান আল্লাহ হচ্ছেন রাব্বুল আলামিন; তিনি শুধু রাব্বুল মুসলিমুন বা রাব্বুন্নাস নন। সকলে প্রতিদিন নামাজে তারই ঘোষণা দিই ‘আল-হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন’। রাসূল (সা) হচ্ছেন রাহমাতুললিল আলামিন। আর কুরআন হচ্ছে হুদাল লিননাস। আর মুসলমানেরা হচ্ছে খায়রাহ উম্মাহ উখরিযাত লিননাস। অতএব, আকাশের চাঁদ ও সুরুয যেমনিভাবে সকলের জন্য কল্যাণকর ও প্রয়োজনীয়, তেমনিভাবে ইসলাম মানবতা ও সৃষ্টিজগতের জন্য কল্যাণকর ও প্রয়োজনীয়। তাই আমাদেরকে ভাবতে হবে আমরা যা ভাবি তাকি মানবতার জন্য; নাকি শুধু নিজেদের জন্য। আমাদের ভাবনা এবং অ্যাকশন সার্বজনীন হতে হবে।
দাওয়াতের কৌশল :
মক্কা ও মাদানি জীবনে ভিন্নতা
দ্বীনে হকের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আল্লাহর রাসূলের মক্কি ও মাদানি যুগের দাওয়াতের ভাষা, কৌশল ও পদ্ধতির মাঝে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। মক্কায় তিনি গোপন দাওয়াতের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করেন এবং মক্কায় তাওহিদ, রেসালাত, আখিরাতের প্রতি জোর দেন। সে সময় সমাজ সভ্যতার সংস্কার, দন্ডবিধিসহ রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের বিধিনিষেধ নাজিল হয়নি। এসব নাজিল হয় মদিনায় হিজরাত করার পর। মক্কায় তিনি ব্যক্তি গঠনের প্রতি গুরুত্ব দেন। আর মদিনায় হিজরত করার পর তিনি সমাজগঠনে ব্রতী হন। মদিনায় যাওয়ার পর মদিনা সনদ ও হোদাইবিয়ার সন্ধিতে যেসব শর্তাবলি উল্লেখ করেন তা আজকের আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সন্ধি ও কূটনতিক পলিসি প্রণয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। তাইতো বলা হয় হোদাইবিয়ার সন্ধিই মূলত মক্কা বিজয়ের সূচনা করে।
প্রথম তিন বছর গোপন দাওয়াত
আল্লাহর রাসূল সর্বপ্রথম তাঁর পরিবার পরিজন, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু বান্ধবকে দাওয়াত দেন। হজরত খাদিজা মহিলাদের মাঝে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। মেয়েদের মাঝে হজরত ফাতিমা। বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে হজরত আবু বকর ও যুবকদের মাঝে চাচাতো ভাই হজরত আলী, ক্রীতদাসদের মাঝে হজরত যায়িদ ইবন সাবিত, সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন।
যারা ইসলাম গ্রহণ করেন তাদের দায়িত্ব ছিল গোপনে অপরের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেয়া। হজরত আবু বকর (রা) এর কাছে যারা যেতো তাদের মাঝে যাদেরকে বিশ্বস্ত মনে করা হতো তিনি তাদেরকে দাওয়াত দেন। এইভাবে তাঁর চেষ্টায় হজরত উসামা, হজরত যোবায়ের, হজরত আবদুর রহমান বিন অরফ, হজরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস, হজরত তালহা বিন আবদুল্লাহ প্রমুখ ইসলাম গ্রহণ করেন। হজরত বেলাল, হজরত আবু ওবায়দা, হজরত আবু সালমা, হজরত আরকাম বিন আরকাম, ওসমান বিন মাযউন, ওবায়দা বিন হারেস, খাব্বান বিন অধরত, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ প্রমুখ প্রথম দিকে যেই চল্লিশ জন ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাঁদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
প্রথম দিকে তাঁদেরকে সকালে দুই রাকাআত এবং সন্ধ্যায় দুই রাকাআত নামাজ আদায় করতে হতো। তাঁরা গোপনে নামাজ আদায় করতেন। নামাজের সময় হলে পাহাড়ে চলে যেতেন। এইভাবে গোপনে প্রথম তিন বছর ব্যক্তিগত পর্যায়ে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ সীমাবদ্ধ ছিলো। এইভাবে ঈমানদারদের একটি দল তৈরি হয়। তারা ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পারস্পরিক সহযোগিতায় এই কাজ আঞ্জাম দেয়। শুরুর দিকে কোরাইশরা গুরুত্ব দেয়নি। তারা মনে করেছিলো অন্যান্য ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের মতই মুহাম্মদ একটা কিছু শুরু করেছে। কিন্তু কালপরিক্রমায় তাদের ভুল ভাঙে এবং তারা বিরোধিতা শুরু করে।
প্রকাশ্যে দাওয়াত ও
দাওয়াতি সমাবেশ
আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে সূরা শুয়ারার একটি আয়াতের মাধ্যমে প্রকাশ্যে দাওয়াতি কাজ শুরুর নির্দেশ দেন। আর তা ছিল, “হে নবী তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দের ভয় প্রদর্শন করো।” আর এই সূরাতে শুরুতেই হজরত মুসা ও ফেরাউনের ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে স্পষ্ট করা হয়েছে যে প্রকাশ্যে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার পর হজরত মুসাকে কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে? আর এইভাবে বাড়াবাড়ি করার কারণে আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনকে কিভাবে শাস্তি দিয়েছেন। অন্যান্য নবীদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী নূহের সম্প্রদায়কে জলোচ্ছ্বাসের মাধ্যমে, আদ, সামুদ, ইবরাহিম ও লুতের সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছেন তার চিত্র তুলে ধরেছেন। এর মাধ্যমে মূলত সাহাবাদেরকে এই মেসেজ দেয়া হয়েছে সত্যপথে যারা চলে আল্লাহ পাক একদিকে তাদেরকে পরীক্ষা করেন এবং অপর দিকে বাড়াবাড়ি যারা করে তাদেরকে মাঝে মধ্যে দুনিয়াতে কঠোর শাস্তি প্রদান করে কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
প্রকাশ্যে দাওয়াত শুরুর নির্দেশ পাওয়ার পর আল্লাহর রাসূল (সা) বনু হাশেমদের সমবেত করেন এবং ৪৫ জনের মত উপস্থিত ছিলো। উক্ত সভায় আবু লাহাবও ছিলো। সে রাসূল (সা)কে কৌশলে তাঁর দাওয়াতি তৎপরতা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে এবং ভয় দেখায় যে, তুমি যদি তোমার কথার ওপর অটল থাকো তাহলে কুরাইশের সব গোত্র তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। সেই দিন মুহাম্মদ (সা) কোন কথা বললেন না। তবে পরে আরেক দিন সমবেত করে স্পষ্ট ভাষায় সকলকে দাওয়াত দিলেন, “সেই আল্লাহর শপথ যিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। আমি তোমাদের প্রতি এবং অন্যসব মানুষের প্রতি আল্লাহর রাসূল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছি। আল্লাহর শপথ তোমরা যেভাবে ঘুমিয়ে থাকো সেভাবেই একদিন মৃত্যুমুখে পতিত হবে। ঘুম থেক যেভাবে জাগ্রত হও সেভাবেই একদিন তোমাদের ওঠানো হবে। এরপর তোমাদের থেকে তোমাদের কৃতকর্মের হিসাব নেয়া হবে। তারপর তোমাদের জন্য রয়েছে জান্নাত বা জাহান্নাম।” আবু তালিব এই কথা শোনে বলে উঠলো তোমার কথা আমার পছন্দ হয়েছে। তুমি তোমার কাজ অব্যাহত রাখো। আমি তোমাকে সাহায্য করবো।
সাফা পাহাড়ে ওঠে দাওয়াতি আহবান
আবু তালিবের কাছ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস পেয়ে তিনি একদিন সাফা পাহাড়ে উঠে আওয়াজ দিলেন, হে বনি ফেহের ও বনি আদি। এই কথা শোনে কোরাইশের সকল গোত্র থেকে লোক সমবেত হওয়া শুরু করল। যিনি যেতে পারেননি তিনি অন্তত একজন প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। এরপর তিনি বললেন, তোমরা বল আমি যদি তোমাদেরকে বলি পাহাড়ের অপর প্রান্তে একদল ঘোড়সওয়ার আত্মগোপন করে আছে তারা তোমাদের ওপর হামলা করবে, তোমরা কি সে কথা বিশ্বাস করবে? সকলেই সমস্বরে বলে উঠল হ্যাঁ বিশ্বাস করবো। কারণ আপনাকে আমরা কখনও মিথ্যা বলতে দেখিনি। তখন তিনি বললেন, শোন আমি তোমাদেরকে এক ভয়াবহ আজাবের ব্যাপারে সাবধান করতে প্রেরিত হয়েছি। এই কথা শোনার পর আবু লাহাব বললো, তুমি কি এই কথা বলার জন্য আমাদেরকে ডেকেছো? তুমি ধ্বংস হও। আবু লাহাবের এই কথা বলার পর আল্লাহ পাক সূরা লাহাব নাজিল করে ঘোষণা করেন যে, আবু লাহাবের দু’টি হাত এবং সে নিজেও ধ্বংস হউক। আল্লাহর রাসূল এই পর্যায়ে আদিষ্ট হন যে, তোমাকে যে আদেশ দেয়া হয়েছে তুমি তা খোলাখুলিভাবে ঘোষণা কর এবং মুশরিকদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। (১৫:৯৪) এই আদেশের পর থেকে তিনি পৌত্তলিকতার বিভিন্ন দিক উদাহরণসহ তুলে ধরে বলেন যে, যারা এসবের পূজা করে এবং নিজের ও আল্লাহর মাঝখানে সেগুলোকে মাধ্যম হিসেবে মনে করে তারা স্পষ্ট ভ্রষ্টতার মাঝে রয়েছে।
এরপর মুশরিকরা আবু তালিবের কাছে একটি প্রতিনিধিদল পাঠায় তার মাধ্যমে তারা মূলত আল্লাহর রাসূলকে দাওয়াতি কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। এতে তারা ব্যর্থ হয়। এরপর তারা চিন্তাগ্রস্ত হলো হজ মওসুমে আল্লাহর রাসূলের কথা যেন লোকেরা না শুনে এই জন্য কী করা যায়? তারা শলাপরামর্শ করতে বসে। কেউ বলে আমরা লোকজনকে বলবো সে একজন গণক জ্যোতিষী। কিন্তু ওলিদ বলে, না সে গণক জ্যোতিষী নয়। তখন তারা বলে, আমরা তাকে পাগল বলবো। ওলিদ বললো, না সে পাগল নয়, আমি পাগলের প্রকৃতি জানি। তখন লোকেরা বললো, আমরা বলব সে একজন কবি। ওলিদ বললো, না সে কবিও নয়। তখন লোকেরা বলল, আমরা বলবো সে একজন জাদুকর। ওলিদ বললো, না সে জাদুটোনা করে না। তখন লোকেরা বললো, আমরা কী বলবো? তখন ওলিদ বললো, তোমরা যে কথাই বলবে লোকেরা তা বিশ্বাস করবে না। তবে জাদুকর বলতে পারো। কারণ তার কথায় স্বামী-স্ত্রী, ভাই-ভাই এবং বিভিন্ন গোত্রে জাদুকরী প্রভাব দেখা যায়।
ব্যক্তিগতভাবে পরিকল্পিতভাবে টার্গেটভিত্তিক দাওয়াত
আল্লাহর রাসূল (সা) আবু জেহেল ও উমর (রা) এর মধ্য থেকে যেকোন একজনকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল ছিলেন। তিনি আল্লাহর কাছে তাদের দুই জনের যেকোনো একজনকে পেতে প্রার্থনা করেছিলেন। তাই আমাদেরকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম ধরে ধরে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে এবং তাদের মাঝে পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে।
চারিত্রিক মাধুর্যতা দিয়ে দাওয়াতি কাজ
কথার চেয়ে চারিত্রিক মাধুর্যতা দিয়ে দাওয়াত দেয়াকেই গুরুত্ব দিতে হবে। আল্লাহর রাসূল (সা) এর চারিত্রিক মাধুর্যতায় আকৃষ্ট হয়েই অনেকই ইসলাম কবুল করেন। এই ক্ষেত্রে সেই বুড়ির কথা উল্লেখ করা যায় যিনি আল্লাহর রাসূল (সা) সম্পর্কে পরিচালিত অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে নিজের ঘর ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেয়ার জন্য ছুটে চলে। পথিমধ্যে আল্লাহর রাসূল (সা) উক্ত বুড়ির সাথে দেখা হয়। রাসুলে কারীম (সা) উক্ত বুড়িকে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছিয়ে দেন। কিন্তু বুড়ি আল্লাহর রাসূলের পরিচয় জানতো না। গন্তব্যস্থলে পৌঁছার পর বুড়িটি আল্লাহর রাসূলের পরিচয় জানার সাথে সাথেই ঈমান কবুল করে। কেননা সে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে তার ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়েই নিজের ঘর ত্যাগ করেছিল।
পরিবার পরিজনের মাঝে
দাওয়াতি কাজ
রাসূলে কারীম (সা) সর্বপ্রথম হজরত খাদিজার কাছেই সত্য প্রকাশ করেছেন এবং সত্যের দাওয়াত দিয়েছেন। আর হজরত খাদিজাই সর্বপ্রথম ইসলাম কবুল করেন। এ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, আমরা যে সত্যে বিশ্বাসী তা প্রথমেই নিজ পরিবার পরিজনের কাছে তুলে ধরতে হবে। আর ব্যক্তি নিজ আদর্শের প্রতি কতটুকু নিষ্ঠাবান তা তার আপন লোকেরাই সবচেয়ে বেশি বলতে পারেন।
পরিবারের মাঝে দাওয়াতি কাজ করার পরও তারা দাওয়াত কবুল করতে না পারে। তার উদাহরণ হচ্ছে হজরত নূহ-এর স্ত্রী ও ছেলে। তাঁর সময়ে সংঘটিত বন্যায় হজরত নূহ (আ)-এর স্ত্রী ও ছেলে মারা যায় কারণ তারা উভয়েই ছিল নাফরমান। তারা দ্বীনের দাওয়াত কবুল করার পরিবর্তে বিরোধিতা করে। তাই তারা অন্যান্য মানুষের সাথে আজাবে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য আল- কুরআনে তাদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আলাহ বলেন, আল্লাহ কাফিরদের অবস্থা বোঝাবার জন্য নূহ ও লুতের স্ত্রীদ্বয়ের কথা উলেখ করেছেন। এই দু’জন মেয়েলোক ছিল আমার দুই নেক বান্দার স্ত্রী। তারা দুইজনই নিজ নিজ স্বামীর সাথে খেয়ানতের অপরাধ করেছে। কিন্তু নেক স্বামীদ্বয় তাদের জন্য আল্লাহর আজাবের মোকাবিলায় কোন উপকারে আসেনি। বরং তাদের দু’জনকেও আদেশ করা হলো, তোমরা অন্যান্যদের সাথে জাহান্নামে প্রবেশ কর। (তাহরিম ১০) এই ঘটনা থেকে বুঝা যায়, স্বামী নেককার হলেও স্ত্রী যদি বদকার হয় তাহলে স্ত্রীকে তার শাস্তিভোগ করতেই হবে। অনুরূপভাবে স্ত্রী নেককার হলে আর স্বামী বদকার হলেও স্বামীকে তার পাপের শাস্তি ভোগ করতে হবে। তার উদাহরণ হচ্ছে ফেরাউন ও তার স্ত্রী আসিয়া। স্বামী-স্ত্রীর পরাস্পরিক দায়িত্ব হচ্ছে পরস্পরকে হেদায়েতের পথে আহবান জানানো। হেদায়েত কবুল না করলে এজন্য জবাবদিহি করতে হবে না। নূহ-এর স্ত্রী ও ছেলের ঘটনা থেকে আমরা শিখতে পাই যে, আল্লাহর হেদায়েত সবার নসিবে নেই। কোন নেককার মানুষের স্ত্রী বা স্বামী বা ছেলে মেয়ে এই পরিচয়ে কেউ আখিরাতে নাজাত পাবে না। আখিরাতে নাজাত পাওয়ার মানদন্ড হচ্ছে আল্লাহর প্রতি যথাযথ ঈমান ও তদানুযায়ী আমল। নূহ (আ) আল্লাহর পেয়ারা নবী হওয়ার পরও তার স্ত্রী বা ছেলে হবার সুবাদে শাস্তি থেকে কেউ পরিত্রাণ পায়নি।
দাওয়াতের বিরোধিতা
হজরত মুহাম্মদ (সা) ইসলামের শাশ্বত বাণী প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নানা ধরনের নির্যাতন ও নিপীড়নের সম্মুখীন হয়েছেন। তদানীন্তন মানুষগুলো তাঁকে নবুওয়ত পূর্ববর্তী সময়ে আল-আমিন, আস-সাদেক উপাধিতে ভূষিত করেছিল। কিন্তু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ এই কালেমার প্রতি দাওয়াত দেয়ার পরপরই তারা নানা অপপ্রচার, বাধা, সামাজিক বয়কট, হত্যা ষড়যন্ত্র ও নির্যাতন শুরু করে দেয়। তারা তাঁর বিরোধিতায় নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
প্রথম ধরন : তাঁকে নিয়ে হাসি তামাশা, বিদ্রƒপ-উপহাস করা হয় এবং মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালানো হয়। তাঁর শিক্ষাকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয় ।
দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষের মাঝে এই সম্পর্কে সন্দেহ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করার জন্য মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালানো হয়।
তৃতীয়ত, তাঁর উপস্থাপিত আদর্শ এবং সঙ্গী-সাথীদেরকে নিরর্থক বিতর্কের বস্তুতে পরিণত করা হয়। নজর ইবন হারেস কয়েকজন দাসী ক্রয় করে রাখে। যারা মুহাম্মদ-এর প্রতি আকৃষ্ট হতো বলে সে সংবাদ পেতো তার সাথে একজন দাসী লাগিয়ে দেয়া হতো সে তাকে গান শোনাতো এবং আকৃষ্ট করে ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করতো।
চতুর্থত, নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হতো। মহাগ্রন্থ আল কুরআনকে কল্পকাহিনী বলে আখ্যায়িত করা হয়।
পঞ্চমত, নবুওয়তের চতুর্থ বছর থেকে জুলুম নির্যাতন শুরু হয়। আবু লাহাবের স্ত্রী পাথর হাতে কাবায় রাসূল (সা) কে মারার জন্য যায়। সে সময় তিনি আবু বকর (রা)সহ নামাজ আদায় করছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তার দৃষ্টিতে পর্দা ঢেকে দেন। ফলে শুধু আবু বকরকে দেখতে পায়। রাসূল (সা) কে দেখেনি। এইভাবে নানা সময়ে তাঁকে কষ্ট দিতো। তিনি যখন নামাজ আদায় করতে দাঁড়াতেন বকরির নাড়িভুঁড়ি তাঁর ঘাড়ে ছুড়ে দিতো। একবার রাসূলে কারীম (সা) সিজদায় গেলে উটের নাড়িভুঁড়ি এমনভাবে ঘাড়ে নিক্ষেপ করা হয় যে তাঁর পক্ষে মাথা তোলা সম্ভব হয়নি। আর দুর্বৃত্তরা এটা দেখে হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে। হজরত ফাতেমা এই সংবাদ পেয়ে দ্রুত আসেন এবং উক্ত নাড়িভুঁড়ি সরিয়ে দেন। উমাইয়া বিন খালফ রাসূলকে দেখলেই কটূক্তি করতো। থুথু নিক্ষেপ করতো। পুরনো হাঁড়ি ভেঙে গুঁড়ো করে তাঁর মুখের দিকে নিক্ষেপ করতো। রাসূলে কারীম (সা) এর ঘরে রান্নার জন্য হাঁড়ি বসানো হলে বকরির নাড়িভুঁড়ি এমনভাবে ফেলা হতো যাতে সোজা গিয়ে পাতিলে পড়ে। মাকামে ইবরাহিমে একবার আল্লাহর রাসূলকে নামাজ আদায় করতে দেখে আবু জেহেল তাঁকে ধমক দেয় এবং বলে আবার এখানে নামাজ আদায় করতে দেখলে ঘাড় মটকে দেবো। আরেকদিন তাঁকে নামাজ পড়তে দেখে ঘাড় মটকানোর জন্য অগ্রসর হয়। কিন্তু একটু পরেই পেছনে ফিরে আসে। লোকেরা তাকে এইভাবে পেছনে ফিরে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ‘আমি আমার এবং মুহাম্মদের মাঝখানে আগুনের একটি পরিখা দেখতে পেয়েছি।’ এমনি অবস্থায় রাসূলে কারীম (সা) ঘরের ভেতর নিরাপদে নামাজ পড়ার জায়গা করে নেন।
হজরত উসমান বিন আফফান ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর চাচা তাকে খেজুরের চাটাইয়ে পেঁচিয়ে নিচ থেকে ধোঁয়া দিতো। হজরত মুসআব বিন উমায়ের এর মা তাঁর ইসলাম গ্রহণের সংবাদ শোনার পর তাঁকে ঘর থেকে বের করে দেয়। হজরত বেলাল ইসলাম গ্রহণ করার পর উমাইয়া বিন খালফ তাঁকে বেঁধে নির্মমভাবে পেটাতো। গলায় রশি বেঁধে উচ্ছৃঙ্খল ছেলেদের হাতে তুলে দিতো তারা মক্কার বিভিন্ন পাহাড়ে টেনেহিঁচড়ে তাঁকে উঠাতো। জোর করে উত্তপ্ত বালুতে শুইয়ে রাখতো এবং বুকের ওপর পাথর চাপা দিতো। কখনও কখনও তাঁকে খাবার দেয়া হতো না এবং তিনি ক্ষুধার্ত অবস্থায় একটু পানি চাইলেও পানি দেয়া হতো না। হজরত আম্মার ইবন ইয়াসের ও তার পরিবারকেও উত্তপ্ত বালুতে শুইয়ে রেখে কষ্ট দেয়া হতো। পানিতে ডুবিয়ে রাখা হতো। আর বলা হতো মুহাম্মদকে গালি না দিলে এবং লাত ওজ্জার প্রশংসা না করলে তোমাদেরকে ছাড়ব না। এমনি কঠিন নির্যাতনের প্রেক্ষিতে একবার ইয়াসির তাদের কথা শুনতে বাধ্য হয় এবং কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহর রাসূলের কাছে আসে। তখন আল্লাহ ওহি নাযিল করে জানিয়ে দেন, যাকে কুফরির জন্য বাধ্য করা হয় কিন্তু তার হৃদয়ে অবিচলিত থাকে। একবার পথ চলতে গিয়ে রাসূলে কারীম (সা) এই দৃশ্য দেখে বলেন, হে ইয়াসির পরিবার তোমরা ধৈর্য ধারণ কর। তোমাদের ঠিকানা হচ্ছে জান্নাত। এইভাবে অত্যাচারে নিষ্পেষিত হয়ে হজরত ইয়াসির ইন্তেকাল করেন। আর তার স্ত্রী হজরত সুমাইয়ার লজ্জাস্থানে আবু জেহেল বর্ষা নিক্ষেপ করে এবং তিনি শহীদ হন। তিনিই প্রথম মহিলা শহীদ।
হজরত আফলাহরে মালিক তার পায়ে রশি বেঁধে জমিনের ওপর হেঁচড়াতো। হজরত খাব্বাব ইবন আরত ছিলেন খোযায়া গোত্রের উম্মে আনমার নামক এক মহিলার দাস। ইসলাম গ্রহণ করার কারণে মুশরিকরা তার মাথার চুল টেনে তুলে ফেলতো। ঘাড় মটকে দিতো। জ্বলন্ত কয়লার ওপরে শুইয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখা হতো যাতে করে তিনি উঠতে না পারেন। হজরত ওমর ইসলাম গ্রহণ করার আগে তার ক্রীতদাসী ইসলাম কবুল করে। এই অপরাধে তাকে মারতে মারতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়তেন এবং বলতেন আমি তোর প্রতি মানবিকতার কারণে মারা বন্ধ করিনি বরং আমার ক্লান্তির কারণে বন্ধ করেছি। হজরত আবু বকর এই ধরনের নির্যাতিত ক্রীতদাস ও দাসীদেরকে ক্রয় করে মুক্ত করে দেন। এইভাবে নির্যাতনের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যায়। তারা সাহাবাদেরকে উটের কাঁচা চামড়ার ভেতরে ঢুকিয়ে রোদে ফেলে রাখতো। কাউকে কাউকে লোহার বর্ম পরিয়ে পাথরের ওপর শুইয়ে রাখা হতো। এমন অবস্থায় যারা ইসলাম গ্রহণ করতো আল্লাহর রাসূল (সা) তাদের সাথে প্রকাশ্যে দেখা সাক্ষাৎ করতেন না। সাহাবায়ে কেরামও তাদের পারস্পরিক সাক্ষাৎ, ইবাদাত বন্দেগি ও দাওয়াত এবং তাবলিগের কাজ গোপনে করতেন। এই সময় আরকাম ইবন আবদুল আরকামের ঘরকে আল্লাহর রাসূল মুসলমানদের সাথে মেলামেশার গোপন কেন্দ্র বানান। কেননা এটা ছিল সাফা পাহাড়ের উপরে এবং মুশরিকদের দৃষ্টিসীমার বাইরে।
নবুওয়তের পঞ্চম বছর জুলুম নির্যাতন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। সেই সময়ই সূরা কাহাফ নাজিল হয়। তাতে এই ইঙ্গিত দেয়া হয় হয় যে ঈমান নিয়ে কোথাও বসবাস যদি আশঙ্কাজনক হয় তখন কুফর ও জুলুম নির্যাতনের কেন্দ্র থেকে হিজরত করতে হবে। আসহাবে কাহাফের ঘটনা থেকে আরেকটি শিক্ষা পাওয়া যায় যে, এই ক্ষেত্রে এমনভাবে কৌশল অবলম্বন করতে হবে যেন শত্রুরা আসল টার্গেট টের না পায়। কেননা যদি তারা টের পায় তাহলে টার্গেট হাসিলে সফলতা লাভ করা সম্ভব হবে না। সূরা কাহাফের পর সূরা জুমার নাজিল করেন। এতে বলা হয়েছে, আল্লাহর জমিন সঙ্কীর্ণ নয়। পৃথিবী প্রশস্ত। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের অফুরন্ত পুরস্কার দেবেন।
দাওয়াতের কতিপয় প্রতিক্রিয়া ও সম্ভাব্য ফলাফল
দাওয়াত দানকারী অতীতে অনেক কটূক্তি ও টিপ্পনী শুনতে হয়েছে। আল্লাহর রাসূলকেও পাগল, গণক, জাদুকর, মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। শেয়াবে আবু তালেবে বন্দী রাখা হয়েছে। চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখা হয়েছিল। ঘাড়ে উটের নাড়িভুঁড়ি চেপে রাখা হতো। তায়েফে প্রস্তরাঘাতে রক্তাক্ত করা হয়েছে। এইভাবে নানা উপায়ে তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং অবশেষে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অন্যান্য নবী-রাসূলদেরকে টিপ্পনী করা হয়েছে। তারা যখন দাওয়াত দিতো কানে কাপড় ঢুকিয়ে রাখতো। হজরত ইউসুফকে জেলখানায় দেয়া হয়েছে। হজরত মূসা দেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। হজরত ইবরাহিমকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছে। হজরত ঈসাকে শূলিবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। হজরত জাকারিয়াকে করাত দিয়ে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে। বনি ইসরাঈলের অনেক নবী-রাসূলকে হত্যা করা হয়েছে।
হজরত নূহ (আ) ছিলেন হজরত ইদরিস (আ)-এর পৌত্র লমকের পুত্র। তিনি ইরাক- আরবের পথভ্রষ্ট লোকদেরকে হেদায়েতের পথে আহবান করার জন্য আল্লাহর নবী-রাসূল হিসেবে আবির্ভূত হন। সূরা আরাফ, হুদ, মুমিনুন, শুআরা, কমর ও নূহসহ কুরআনের পঁয়তাল্লিশ স্থানে তাঁর সম্পর্কে বর্ণিত আছে। নূহ (আ) যে সময় আবির্ভূত হন সে সময় ইরাক ও আরবের লোকেরা অজ্ঞ ছিল এবং গায়রুল্লাহর ইবাদত ও মূর্তিপূজাসহ নানা ধরনের পাপ কাজে লিপ্ত ছিল। তারা আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করত না এবং আল্লাহর ইবাদত করতেও তাদের আপত্তি ছিল না। কিন্তু তারা শিরকের গোমরাহিতে লিপ্ত ছিল। তারা আল্লাহর সাথে অন্যান্য সত্তাকে খোদার সাথে অংশীদার মনে করতো। ওয়াদ, সুয়াআ, ইয়াগুছ, ইয়ায়ুক ও নাসর নামীয় স্বনির্মিত দেবদবীকে তারা খোদার অংশীদার মনে করতো। তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য জাতির মধ্য থেকে এক বিশেষ শ্রেণী সৃষ্টি হলো। তারা যাবতীয় ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার মালিক হয়ে গেল। হজরত নূহ (আ) যখন মানুষকে আলাহর একত্ববাদের দাওয়াত দেয়া শুরু করলেন, তখন তারা জনসাধারণকে হজরত নূহ এর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে এবং তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার করে। হজরত নূহকে হুমকি দেয়া হয়েছে, যদি এখনও ক্ষান্ত না হও তাহলে পাথর মেরে মেরে ফেলবো।’’ (সূরা শুয়ারা ১১৬) এইভাবে একদিকে নির্যাতন করা হয়েছে এবং অপর দিকে নানা ধরনের লোভ লালসা দেয়া হয়েছে। সকল লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে ওঠে আল্লাহর রাসূল (সা) ঘোষণা করেছিলেন, আমার এক হাতে যদি চাঁদ আর আরেক হাতে সূর্য এনে দেয়া হয় তার পরও আমি সত্য থেকে বিচ্যুত হবো না।
আল্লাহ তায়ালার প্রিয় নবী-রাসূলগণ আল্লাহর একত্ববাদের কথাই মানুষদের সামনে পেশ করতেন। কিন্তু তাঁদের আহবানে সাড়া দেয়ার পরিবর্তে অধিকাংশ মানুষ প্রায় সকল নবী-রাসূলকেই বিদ্রƒপ করতো; হেয়প্রতিপন্ন করা হতো। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন: হে নবী! আপনার আগে গত হওয়া অনেক কাওমের নিকট আমি রাসূল পাঠিয়েছি। এমন কখনো হয়নি যে, তাদের কাছে রাসূল এলেন, আর তারা তাঁকে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করেনি। (সূরা হিজর : ১০-১১)
হজরত নূহের দাওয়াত কবুল করার পরিবর্তে তাঁর কওম নানাভাবে তাঁর প্রতি দুর্ব্যবহার করে। কুরআনের নিম্নের কয়েকটি আয়াতে তা চমৎকারভাবে বর্ণিত আছে:
তারা বলত নূহ আমাদের মতই একজন মানুষ। একথা কি করে মেনে নেয়া যায় যে খোদার পক্ষ থেকে তার ওপর অহি এসেছে। (সূরা আরাফ- ৬৩)
তারা আরও প্রচারণা চালাতো যে নূহের আনুগত্য আমাদের মধ্যে নীচ শ্রেণীর লোকেরা না বুঝেই মেনে নিয়েছে। তার কথায় সত্যিই যদি কোন গুরুত্ব থাকতো তাহলে আমাদের মুরব্বিগণ তা অবশ্যই মেনে নিত। (সূরা হুদ : ২৭)
সে যদি খোদার প্রেরিত হতো তাহলে তার সাথে অর্থভান্ডার থাকতো। গায়েবের এলম থাকতো। আর ফেরেশতাদের মতো সে যাবতীয় মানবীয় অভাব থেকে বেপরোয়া হতো। (সূরা হুদ : ৩১)
এই লোক আসলে আমাদের ওপর তার সর্দারি মাতাব্বরি চালাতে চায়। (সূরা মুমিনুন : ২৪)
তার প্রতি কোন জিনের ছায়া লেগেছে যে তাকে পাগল বানিয়ে দিয়েছে। (সূরা মুমিনুন-২৫)
হজরত নূহ (আ) এর কওম ছিল পথভ্রষ্ট। অথচ তারা হজরত নূহকে পথভ্রষ্ট মানুষ হিসেবে মনে করত। এই বিষয়টি কুরআনে এইভাবে বিধৃত আছে:
আমি নূহকে তার কওমের নিকট পাঠালাম। তিনি বলেন, হে আমার দেশবাসী! আল্লাহর দাসত্ব করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। আমি তোমাদের জন্য এক ভীষণ দিনের আজাবের ভয় করি। কওমের সরদাররা জবাব দিলো, আমরা তো দেখতে পাচ্ছি যে, তুমি স্পষ্ট গোমাহির মধ্যে পড়ে আছো। নূহ (আ) বললেন, হে আমার কওম! আমি কোন গোমরাহিতে পড়িনি; বরং আমি রাব্বুল আলামিনের রাসূল। (সূরা আল আরাফ : ৫৯-৬১)
তারা বললো, হে নূহ! তুমি যদি বিরত না হও তাহলে তোমাকে পাথর মেরে শেষ করে দেয়া হবে। নূহ দোয়া করলেন, হে আমার রব! আমার কওম আমাকে মিথ্যা মনে করছে। কাজেই এখন আমার ও তাদের মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দাও এবং আমাকে ও আমার সাথে যেসব মুমিন আছে তাদেরকে নাজাত দাও। অবশেষে আমি তাঁকে ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে একটি জাহাজে তুলে বাঁচিয়ে দিলাম। এরপর বাকি লোকদেরকে ডুবিয়ে দিলাম। নিশ্চয়ই এর মধ্যে এক নিদর্শন রয়েছে। আর তাদের বেশির ভাগ লোকই মুমিন ছিলো না। নিশ্চয়ই আপনার রব মহাশক্তিশালী ও দয়াবান। (সূরা শোয়ারা : ১১৬-১২২)
হজরত নূহ এর কওম কানে কাপড় ঢুকিয়ে রাখতো যাতে কথা না শোনে। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন:
নূহ (আ) বললেন, হে আমার রব! নিশ্চয়ই আমি আমার দেশবাসীকে রাত দিন দাওয়াত দিয়েছি। কিন্তু আমার দাওয়াত তাদের মধ্যে শুধু পালানোর মনোভাব বাড়িয়ে দিয়েছে। আর যখনই আমি তাদেরকে দাওয়াত দিয়েছি, যাতে আপনি তাদেরকে মাফ করে দেন, তারা তাদের কানে আঙুল ঠেসে দিয়েছে, তাদের কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে নিয়েছে, তাদের আচরণে তারা জিদ ধরে রয়েছে এবং খুব বেশি অহঙ্কার করেছে। এরপর আমি তাদেরকে উঁচু আওয়াজে দাওয়াত দিয়েছি। তারপর আমি তাদের কাছে প্রকাশ্যেও তাবলিগ করেছি এবং চুপে চুপেও বুঝিয়েছি। আমি বলেছি, তোমাদের রবের কাছে মাফ চাও, নিশ্চয়ই তিনি বড়ই ক্ষমাশীল। “তিনি তোমাদের জন্য আসমান থেকে খুব বৃষ্টি দেবেন।” তোমাদের মাল ও সন্তান দান করবেন, তোমাদের জন্য বাগান পয়দা করবেন এবং তোমাদের জন্য নদী-নালা বহায়ে দেবেন।’ তোমাদের কি হলো যে, তোমরা আল্লাহর জন্য কোন মানমর্যাদার আশা করো না?’ (সূরা নুহ : ৫-১৩)
হজরত ইবরাহিম (আ) সারা বিশ্ববাসীর নিকট আবির্ভূত নবী। তিনি ইয়াহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের আদি পুরুষ। তাই এই তিন ধর্মের অনুসারীরা তাঁকে মানে। তাঁর বংশে অনেক নবী দুনিয়াতে আসেন। তাই তাঁকে আবুল আম্বিয়া-নবীদের পিতা বলা হয়। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে তাঁকে খলিলুল্লাহ- আল্লাহর বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। চার হাজার বছর পরেও আমরা তাঁরই মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত- মিল্লাতি আবিকুম ইবরাহিম।
হজরত ঈসা (আ)-এর জন্মের আনুমানিক ২১০০ খ্রিষ্টপূর্বকালে হজরত ইবরাহিম (আ)-এর আবির্ভাব হয়। উর শহরে তাঁর জন্ম হয় বলে অনেক ঐতিহাসিক উল্লেখ করেন। তিনি স্বয়ং ইরাক থেকে মিসর এবং শাম ও ফিলিস্তিন থেকে আরব মরুর বিভিন্ন অঞ্চলে ঘোরাফেরা করে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দেন। তিনি এমন এক সময় তাওহিদের বাণী প্রচার করেন যে, দুনিয়ায় আল্লাহর নাম নেয়ার কোন লোক অবশিষ্ট ছিল না। হজরত ইবরাহিমের সময় দেব-দেবীর পূজা হতো। তাঁর ঘরে বারো মাসের বারটি মূর্তি বা দেবতা থাকতো। হজরত ইবরাহিম শিশুকাল থেকেই মূর্তিপূজার বিরোধী ছিলেন। তাঁর পিতা ও পরিবারের অন্যান্যদেরকে মূর্তিপূজা করতে দেখে ভাবতেন, মূর্তির নেই শ্রবণশক্তি, বাকশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি, ভালো বা মন্দ করার ক্ষমতা নেই। খেলনাসদৃশ এইসব মূর্তির পূজা তারা কেন করে? ইরাকের বাবল শহরে বায়াল দেবতার মন্দির প্রসিদ্ধ ছিল। সব শহরে একজন রক্ষক থাকতো তাকে রাব্বুল বালাদ বা শহরের খোদা কিংবা রাসূল আলেহাতা মহাদেব মনে করা হতো। উর শহরের রাব্বুল বালাদ ছিল নান্নার। নান্নার শুধু দেবতাই ছিল না বরং দেশের সবচেয়ে বড় জমিদার, বিরাট ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি ছিল। প্রকৃতপক্ষে দেশ শাসন করতো উক্ত নান্নার এবং দেশের শাসক তার পক্ষ থেকেই দেশ শাসন করতো। উরের যে শাহি খান্দান হজরত ইবরাহিম (আ)-এর সময়ে শাসক ছিল তার প্রতিষ্ঠাতার নাম ছিল উরনামু। তার থেকে এ পরিবার নামু নাম গ্রহণ করে যা আরবি ভাষায় নমরুদ হয়ে পড়ে।
হজরত ইবরাহিম-এর জাতি শিরকে লিপ্ত ছিল। তার জাতির গোটা অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থা শিরকের জাহিলায়াতে নিমজ্জিত ছিল। তাই হজরত ইবরাহিম (আ) তাওহিদের যেই দাওয়াত প্রদান করেন তা শুধু প্রতিমা পূজার ওপরই পড়েনি বরং খোদায়ি দাবিদার শাহি খান্দানের ওপরও এর বিরাট প্রভাব পড়ে। নমরুদ আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না। তার দাবি এই ছিল না যে জমিন ও আসমানের স্রষ্টা সে বরং সে মনে করতো ইরাকের সেই নিরঙ্কুশ শাসনকর্তা ও আইনকর্তা। সে নিজেকে সার্বভৌম শক্তির অধিকারী মনে করতো। তার কথাই আইন। তার ওপরে এমন কেউ নেই যার কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। তাই যখন হজরত ইবরাহিম (আ) নমরুদকে বললেন, হজরত নূহ (আ)-এর প্রতি তাঁর কওমের দুর্বব্যবহার কথা। যে সত্তার হাতে জীবন মরণ তিনিই তার প্রভু। তখন নমরুদ বললো, জীবন ও মৃত্যু আমার হাতে। তখন ইবরাহিম বললেন, বেশ আল্লাহতো পূর্ব দিক থেকে সূর্য উদিত করেন তুমি একবার পশ্চিম দিক থেকে উদিত করে দেখাও। এই কথা শোনার পর নমরুদ হতবাক হয়ে রইল। নমরুদ হজরত ইবরাহিম (আ)-এর সাথে যুক্তি তর্কে হেরে গিয়ে তাঁকে বন্দী করার নির্দেশ দেয়। হজরত ইবরাহিম (আ) দশ দিন বন্দী থাকেন। অতঃপর তাঁকে জীবন্ত জ্বালিয়ে মারার সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করে। তারা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অগ্নিকুন্ড তৈরি করে তার মধ্যে হজরত ইবরাহিমকে নিক্ষেপ করে। তখন আলাহ পাক আগুনকে আদেশ করে ইবরাহিমের জন্য শীতল ও অক্ষতিকর হয়ে যাও। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এই প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে যে: ইবরাহিম বললেন, “তাহলে তোমরা কি আলাহকে বাদ দিয়ে (এমন সব মাবুদের) ইবাদত করো, যারা তোমাদের কোন উপকারও করে না, ক্ষতিও করে না। তোমাদেরকে ধিক! আলাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদের ইবাদত করছো তাদের প্রতিও ধিক। তোমাদের কি কোন আকল নেই?” তারা বললো, “তাকে পুড়িয়ে দাও। তোমাদের মাবুদদেরকে সাহায্য করো, যদি তোমরা কিছু করতেই চাও।” আমি বললাম, “হে আগুন, তুমি ঠান্ডা হয়ে যাও এবং ইবরাহিমের জন্য শান্তিময় হয়ে যাও।” তারা ইবরাহিমের সাথে অন্যায় ব্যবহার করতে চেয়েছিলো, কিন্তু আমি তাদেরকে চরমভাবে ব্যর্থ করে দিলাম। (সূরা আম্বিয়া : ৬৬-৭০)
অতীতে অনেক নবী-রাসূলের দাওয়াত তাদের কওম গ্রহণ করেনি। যেমন হজরত নূহ (আ) প্রায় সাড়ে নয়শত বছর দাওয়াত দেয়ার পরও মাত্র ৪০ জন কিংবা ৮০ জন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে। অতীতে অনেক নবী-রাসূল থাকবেন তাঁরা মাত্র একজন উম্মত নিয়ে কিয়ামতের ময়দানে উপস্থিত হবেন। হজরত দাউদ (আ) এর মত অনুকূল পরিবেশে দ্বীন প্রচারের পরিবেশ কয়জন নবী-রাসূল পেয়েছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই নেতিবাচক পরিবেশে দ্বীন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। তাই তাঁদেরকে নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং এমনকি দেশান্তরিত হতে হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হজরত নূহ (আ) কেন এবং কী কারণে সাড়ে নয়শত বছর ধৈর্যের সাথে দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজ করেছেন? তিনিতো হতাশ হয়ে পড়েননি। তাঁকে হেন কোন কথা ছিল না যা বলা হয়নি। পাগল, জাদুকরসহ সকল ধরনের কটূক্তি করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর মনে একটি কথা বদ্ধমূল ছিল যে, দ্বীনের দাওয়াত খুলুসিয়াতের সাথে পৌঁছানোই হচ্ছে তাঁর দায়িত্ব। উক্ত দায়িত্ব তিনি নিষ্ঠার সাথে কতটুকু পালন করতে পেরেছেন তার সাথেই তাঁর সফলতা নির্ভরশীল। অনুরূপভাবে হজরত সালেহ, হজরত ইবরাহিম, হজরত লুত, হজরত শুয়াইব প্রমুখ নবী-রাসূল শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে ধৈর্য ও হিকমাতের সাথে দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজ করেছেন। একইভাবে হজরত মূসা (আ) সমাজ পরিবর্তনের যে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন তাতে কি কম বাধা-বিপত্তি এসেছে? কিন্তু তিনি উক্ত বাধা কিভাবে মোকাবিলা করেছেন তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা করা জরুরি? আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা) তায়েফে রক্তে রঞ্জিত হয়েছেন। ওহুদে তাঁর দাঁত শহীদ হয়েছে। তার অনেক সাহাবা শহীদ হয়েছেন এবং নির্মমভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু এই সকল বাধা তিনি কিভাবে মোকাবিলা করেছেন? তাঁর কর্মনীতি ও কর্মকৌশল কী ছিল তা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে পর্যালোচনা করা বর্তমান সময়ের দাবি।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম তাঁর মক্কি জীবনে দীন বিজয়ী করার কোন কথা বলেননি; তাঁর ওপর সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা সংক্রান্ত কোন আয়াত মক্কি জীবনে নাযিল হয়নি। মক্কি জীবনে ঈমান মজবুত করা ও ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা দান করা হয়। এই সময় আল্লাহর রাসূল মানুষের মধ্যে তাওহিদ, রেসালাত ও আখেরাত সম্পর্কে যেসব ভুল ধারণা বদ্ধমূল ছিল তা দূর করার চেষ্টা করেন এবং সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে অত্যন্ত দরদভরা ভাষায় আল্লাহর সঠিক পরিচয় তুলে ধরেন। যাঁরা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন তাদের নৈতিক প্রশিক্ষণ ও আত্মগঠনের প্রতি বেশি জোর দেন। মদিনায় হিজরাতের পরই তিনি মানবজীবনের সমস্ত দিক ও বিভাগ, দৃষ্টিভঙ্গি, ধ্যান ধারণা, চরিত্র ও আচরণ, শিক্ষা, অর্থনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, আইন, বিচার, সমাজ ও রাজনীতি আলাহর বিধানের আলোকে ঢেলে সাজানোর কর্মনীতি গ্রহণ করেন।
একটি কথা সকলের কাছে পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন যে অতীতে কখনও সকল মানুষ দাওয়াত কবুল করেনি। দাওয়াতের প্রথম পর্যায়ে নির্যাতন নিপীড়ন চলেছে এবং মুষ্টিমেয় মানুষ দাওয়াত কবুল করেছে। অধিকাংশ মানুষই দাওয়াত অস্বীকার করেছে। আল্লাহর রাসূলের দাওয়াতের জবাবে বলা হয়েছে, তোমার কথায় আমরা আমাদের দেব-দেবীদেরকে ছাড়তে রাজি নই এবং তোমার কথা আমরা মানতে প্রস্তুত নই।
এখানে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন যে, দাওয়াতের প্রথম পর্যায়ে যোগ্যতাসম্পন্ন লোকের আগমন ঘটেছে বেশি। খোলাফায়ে রাশেদিনের সকলেই মক্কি যুগেই ইসলাম কবুল করেন। এই কথা ঠিক যে, মক্কি যুগে অল্প সংখ্যক মানুষ ইসলাম কবুল করলেও তারা হকের ওপর অটল ও অবিচল ছিলেন। আর তাঁরা মদিনায় হিজরত করার পর দলে দলে লোক ইসলামে প্রবেশ করেন। সে সময় তারা প্রতিশোধপ্রবণ হন নাই। বরং অতীতে যারা বাড়াবাড়ি করেছে তাদেরকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন। এখানে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন যে, মদিনায় যাওয়ার পরই সুযোগসন্ধানী তথা মুনাফিকদের অনুপ্রবেশ ঘটে। কেননা বিজয়ের পরিবেশ দেখলেই সুযোগসন্ধানীরা আগমন করে। কিন্তু আল্লাহ পাক মাঝে মধ্যে সাময়িক বিপর্যয় দান করে এই ধরনের সুযোগসন্ধানীদের চরিত্র উন্মোচন করেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন