post

আল কুরআনের সাহিত্যদর্শন

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

আসাদ বিন হাফিজ#

Songothonযারা সংস্কৃতি চর্চা করেন, লেখালেখি করেন, কাব্যচর্চা বা গল্প-উপন্যাস লেখেন, তাদের সম্পর্কে আমাদের সমাজে একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। স্বাভাবিক কারণেই নুতন ও প্রতিভাবান লেখক এবং শিল্পীরা এতে নিরুৎসাহিত হন। অনেকে এমনও বলেন, কবি বা সাহিত্যিকরা যা লেখেন তা তাদের কল্পনা থেকে লেখেন। কল্পনা কখনো বাস্তব নয়। কল্পনা করে তারা যা লেখেন হুবহু সেই ঘটনাটি হয়তো কখনো ঘটেইনি। ফলে কল্পনা করে যা বলা হয় তা এক ধরনের মিথ্যাচার। কোন মুসলমান মিথ্যা বলতে পারে না, মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিতে পারে না। এই নেতিবাচক মনোভাবটি যখন কোন আলেম প্রকাশ করেন তখন শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্নটি দেখা দেয়, তাহলে কি ইসলাম সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাকে নিরুৎসাহিত করে? প্রশ্নটি নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর। মনগড়া যুক্তির পরিবর্তে এর মীমাংসার জন্য আমাদেরকে কুরআন এবং হাদিসের কাছেই ফিরে যাওয়া উচিত। কারণ কুরআন এবং হাদিসই হচ্ছে আমাদের মূল গাইড। ইসলামের মূল দর্শন কুরআন ও হাদিস থেকেই নিতে হবে। কুরআন ও হাদিসই আমাদের যে কোন সমস্যা ও যে কোন প্রশ্ন সমাধানের চূড়ান্ত পথ ও দিকনির্দেশক। ফলে সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা জায়েজ কিনা, জায়েজ হলে তার সীমারেখা কতটুকু, ইসলাম সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাকে কতটা গুরুত্ব দেয়Ñ এ বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের প্রত্যেকেরই একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে কোন আয়াত নাজিল হয়েছে কিনা, হাদিসে এ ব্যাপারে কোন বক্তব্য এসেছে কিনা, এসে থাকলে তাতে কী বলা হয়েছে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা অর্জন করতে পারলে এক্ষেত্রে কোন বিভ্রান্তি আমাদের ভুল পথে পরিচালিত করতে পারবে না। প্রথমেই জেনে নেয়া দরকার, কালামে পাকে সাহিত্য প্রসঙ্গে একটি দু’টি নয়, অসংখ্য আয়াত নাজিল হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বিষয়টির গুরুত্ব বুঝানোর জন্য কেবল বিক্ষিপ্ত আয়াত নাজিল করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি কবিদের গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য এ প্রসঙ্গে কুরআনে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরাও নাযিল করেছেন। অতএব সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার বিষয়টি কোন হেলাফেলার বিষয় নয়। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যাকে গুরুত্ব দিয়ে কুরআনে পূর্ণাঙ্গ সূরা নাজিল করেছেন, কোন মুসলমান তাকে গুরুত্বহীন মনে করতে পারে না। এবার কুরআনের সূরা আশ শোয়ারা এবং শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক অন্যান্য আয়াতে কী বলা হয়েছে এবং কোন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে আমরা সেদিকে মনোযোগী হবো। কবিদের সম্পর্কে সূরা আশ শোয়ারায় একটি আয়াত খুবই মশহুর। তাতে বলা হয়েছ, ‘এবং কবিদের অনুসরণ করে যারা তারা বিভ্রান্ত। তুমি কি দেখ না যে, তারা প্রতি ময়দানেই উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন কথা বলে যা তারা করে না। তবে তাদের কথা আলাদা, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে, সৎকর্ম করে, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।’ (সূরা আশ শোয়ারা, আয়াত ২২৫-২৭)। এক শ্রেণীর অল্প শিক্ষিত আলেম ও জনসাধারণ আয়াতের প্রথম অংশ পড়ে এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েন যে, তারা আয়াতের শেষ পর্যন্ত পড়ার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। তারা বলে ওঠেন, দেখলে, আল্লাহ কবিদের কেমন অপছন্দ করেন? তিনি তাদেরকে বিভ্রান্ত উপত্যকার অধিবাসী বলে তিরস্কার করেছেন এবং তাদের অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। এসব ব্যক্তি যদি আরো একটু ধৈর্য ধরে আয়াতের শেষ পর্যন্ত পড়তেন তবে তারা দেখতে পেতেন, ‘তবে তারা ছাড়া’ বলে আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ আরেক দল কবির উল্লেখ করেছেন, যাঁরা আল্লাহর অপছন্দনীয় তো নয়ই, বরং আল্লাহর বিশেষ কৃপাধন্য। এসব কবির করণীয় সম্পর্কে আল্লাহ সরাসরি গাইড ও নির্দেশনা দিয়েছেন উক্ত আয়াতে। আল্লাহর নির্দেশনা ও গাইড যারা মেনে চলে তারাই তো যথার্থ ঈমানদার এবং এ ধরনের লোকদের সাফল্য নিশ্চিত। আয়াতের শেষাংশে কবিদের জন্য কতিপয় নির্দেশনা ও মহৎ গুণাবলির উল্লেখ করে আল্লাহ মানবসমাজে এসব কবির যে শুধু শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন তাই নয়, এর মধ্য দিয়ে এসব কবির প্রতি আল্লাহর যে বিশেষ কৃপাদৃষ্টি রয়েছে তা প্রমাণিত হয়। আমরা সন্দেহাতীতভাবেই এ কথা বলতে পারি যে, আল্লাহর উল্লিখিত গুণাবলি যেসব কবির মধ্যে থাকবে তারা আল্লাহর পছন্দনীয় ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন। কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহর পছন্দের তালিকায় উঠে যান, তবে সারা দুনিয়া তাকে অপছন্দ করলেও কিছু যায় আসে না। কবিদেরকে আল্লাহ অপছন্দের তালিকা থেকে পছন্দের তালিকায় উঠে আসার জন্য আল্লাহ বেশি কিছু করতে বলেননি। কবিদেরকে বলেছেন মাত্র চারটি গুণ অর্জন করতে। যদি কোন কবি এ চারটি গুণ অর্জন করতে পারে, তবে দুনিয়া ও আখেরাতে তার সাফল্য অবধারিত। পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি নেই যে, তাঁর সে সাফল্য ছিনিয়ে নিতে পারে। এ গুণ চারটি কী? আল্লাহ বলেন, সে চারটি গুণ হচ্ছে : যারা বিশ্বাস স্থাপন করে, সৎকর্ম করে, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। (সূরা আশ শোয়ারা, আয়াত-২২৭) পবিত্র কালামের এ আয়াতে যে বক্তব্য এসেছে তা বুঝতে হলে কী পদ্ধতিতে ইসলাম তার বক্তব্য উপস্থাপন করে সেদিকে একটু নজর দেয়া দরকার। এটা কুরআনের বক্তব্য উপস্থাপনের একটি বিশেষ টেকনিক। এ টেকনিকটি হচ্ছে, ইসলাম কোন একটি বিষয়কে তুলে ধরার ক্ষেত্রে প্রথমে তার নেতিবাচক এবং পরে তার সাথে সঙ্গতি রেখে ইতিবাচক দিকটি তুল ধরে। যেমন ইসলাম বলে ‘লা ইলাহা’- ‘কোন ইলাহ নেই’, ‘ইল্লাল্লাহ’- আল্লাহ ছাড়া। এখানে মূল আলোচ্য বিষয় আল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। এ বাক্যের প্রথম অংশের কোন মূল্য নেই দ্বিতীয় অংশ ছাড়া। দ্বিতীয় অংশটির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রথম অংশটির অবতারণা করা হয়েছে। এ আয়াতেও কুরআন একই বর্ণনাভঙ্গি ব্যবহার করেছে। সূরা আশ শোয়ারায় আল্লাহ বলেছেন : এবং কবিদের অনুসরণ করে যারা তারা বিভ্রান্ত। তুমি কি দেখ না যে, তারা প্রতি ময়দানেই উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন কথা বলে যা তারা করে না। তবে তাদের কথা আলাদা, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে, সৎকর্ম করে, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। এখানে আল্লাহ ঈমানদার কবিদের মর্যাদা ও গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য প্রথমে মুশরিক কবিদের চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। তাদের পরিচিতি তুলে ধরে বলেছেন : তারা প্রতি ময়দানেই উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন কথা বলে যা তারা করে না। এ বক্তব্যটি বলার পর কোন রকম বিরতি ছাড়াই সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন : তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। বস্তুত এরাই হচ্ছে আল্লাহর পছন্দনীয় কবি, যাদেরকে আল্লাহ মানবতার কল্যাণের জন্য কাব্যচর্চার বিশেষ যোগ্যতা ও প্রতিভা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। নেতিবাচক বক্তব্যের মাধ্যমে ইতবাচক প্রসঙ্গ উজ্জ্বলতর করার কুরআনিক এ বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করার অক্ষমতার কারণে এ আয়াত ব্যবহার করে কেউ কেউ কবিদের মর্যাদা হানি করতে চেয়েছেন। কিন্তু কুরআনিক বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করতে পারলে ইসলাম সাহিত্যচর্চাকে কতটা গুরুত্ব দেয় এবং কবিদের কত উচ্চ মর্যাদা দেয় তা তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারতেন। কুরআনের প্রায় সকল তাফসিরকারই একমত যে, এ আয়াতের মাধ্যমে সাহিত্যচর্চাকে নিরুৎসাহিত করা হয়নি বরং ঈমানদার কবিদেরকে গাইডলাইন দিয়ে তাদের কাব্যচর্চাকে আরো উৎসাহিত করা হয়েছে। ফতহুল বারীর এক রেওয়ায়েত থেকে জানা যায়, এই আয়াত নাজিল হওয়ার পর হযরত আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা), হাসসান বিন সাবিত (রা), কা’ব ইবনে মালিক (রা) প্রমুখ সাহাবী কবি কাঁদতে কাঁদতে রাসূলের খেদমতে হাজির হন এবং আরজ করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাজিল করেছন! আমরাও তো কবিতা রচনা করি, এখন আমাদের উপায় কী? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আয়াতের শেষাংশ পাঠ কর। এ আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, তোমাদের কবিতা যেন অনর্থক এবং ভ্রান্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়। কাজেই তোমরা আয়াতের শেষাংশে উল্লেখিত ব্যতিক্রমীদের শামিল।’ তাফসিরকারগণ আরো বলেছেন, আয়াতের প্রথমাংশে মুশরিক কবিদেরকে বুঝানো হয়েছে। বস্তুত এ আয়াতের মাধ্যমে একদিকে বিপথগামী কবিদের চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে ঈমানদার কবিদের শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণ করা হয়েছে। এতে করে ঈমানদার কবিগণ তাদের কাব্যচর্চা যে নিরর্থক নয় এ ব্যাপারে সন্দেহাতীত হয়েছেন এবং আল্লাহর দেয়া গাইডলাইন মোতাবিক কাব্যচর্চায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করতে উৎসাহিত হয়েছেন। এবার এ আয়াতের আরো একটি বৈশিষ্ট্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করা যাক। আল্লাহ বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন প্রকার স্বভাব, প্রকৃতি ও গুণ দিয়ে ভূষিত করেছেন। আল্লাহর দেয়া এ সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা মানুষের সাধ্যের অতীত। যারা কবি তারা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা ভাবুক, কল্পনাপ্রবণ ও আবেগী। এটা তাদের স্বভাবর্ধম। এ কল্পনাপ্রবণতা না থাকলে কাব্য হবে কিভাবে? এ কল্পনাপ্রবণতা কবিদের জন্য আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত, যে নেয়ামতের কারণে সাধারণ মানুষ যা পারে না তারা তা পারেন, আর পারেন বলেই তারা কবি। কবিদেরকে এ ভাবের জগৎ থেকে, কল্পনাপ্রবণতা থেকে দূরে রাখা আল্লাহর অভিপ্রায় নয়। তবে তারা যেন ভাবের জগতে বিচরণ করতে গিয়ে জগৎ সংসার ভুলে না যায়, সেদিকটিও দেখতে হবে। এ জন্যই আল্লাহ কোথাও কবিদেরকে ভাবের জগৎ থেকে বেরিয়ে আসতে বলেননি, কিন্তু এমন কয়েকটি শব্দ জুড়ে দিয়েছেন যাতে তারা সীমালংঘনকারী হতে না পারে। আল্লাহর বর্ণনাভঙ্গি কত চমৎকার ও তাৎপর্যমন্ডিত। আল্লাহ বলেছেন, তুমি কি দেখ না, যে তারা (কবিরা) প্রতি ময়দানেই উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন কথা বলে যা তারা করে না? তবে তাদের কথা আলাদা, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। এ আয়াতের তাৎপর্যময় অংশ হচ্ছে ‘তবে তাদের কথা আলাদা অংশটুকু।’ এ সংযোজক অংশটির মাধ্যমে আল্লাহ উভয় অংশের মধ্যে এমন একটি সংযোগ সেতু স্থাপন করেছেন যা অতুলনীয় বাকচাতুর্যে পরিপূর্ণ। কবিসত্তার অধিকারী একজন মানুষকে আল্লাহ জানাচ্ছেন, যদি সে তার এ কবি-স্বভাবের সাথে চারটি মাত্র গুণ আয়ত্ত করে নিতে পারে তাহলেই সে আল্লাহর পছন্দনীয় ও প্রিয়ভাজনদের মধ্যে শামিল হয়ে যাবে। এ গুণ চারটি হচ্ছেÑ ঈমান আনা, সৎকর্ম করা, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করা এবং নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করা। এর মাধ্যমে একজন ঈমানদার কবির কী কী বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে তা সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে। ১. একজন কবি ঈমানদার কবিদের অন্তর্ভুক্ত হতে চাইলে প্রথমেই তাকে ঈমান আনতে হবে। ২. ঈমান আনার পর সে তার অসৎ কর্মে লিপ্ত হবে না। ৩. তার ভাবপ্রবণতা যেন তাকে বিপথগামী করতে না পারে সে জন্য সে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করবে। ৪. আর যখনই নিপীড়িত হবে তখনই প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সচেষ্ট হবে। এ আয়াতে উল্লেখিত প্রথম ও দ্বিতীয় গুণ দুটো কবির ব্যক্তিসত্তার সাথে সম্পর্কিত। তৃতীয় ও চতুর্থ গুণ দুটোর সম্পর্ক তার কাব্য ও শিল্প সত্তার সাথে। এখানে একজন কবি বা সাহিত্যিককে আল্লাহ ভাবপ্রবণতা বর্জন করার হুকুম না দিয়ে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করার মাধ্যমে তাকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করতে বলেছেন। এতে করে তার বিপথগামী হওয়ার ভয় যেমন তিরোহিত হবে, তেমনি কাব্য বা শিল্পচর্চা থেকেও তাকে সরে দাঁড়াতে হবে না। এর মধ্য দিয়ে কবিদের প্রতি আল্লাহর এক ধরনের ¯েœহময় প্রশ্রয়তা লক্ষ্য করা যায়। যেমন প্রশ্রয়ধন্য হয় অন্যান্য সন্তানের তুলনায় পিতা-মাতার কাছে কোন আহলাদ সন্তান। পিতা-মাতার কাছে সব সন্তানই প্রিয় কিন্তু তার মধ্য থেকেই এমন দু’একজন থাকে যাকে পিতা-মাতা বেশি ¯েœহ করেন। তাদের সাধ আহলাদ মেটাতে বেশি তৎপর হন। তেমনি আল্লাহর কাছে সব মানুষই তার বান্দা, কিন্তু এই বান্দাদের মধ্যে কবি বা শিল্পীরা আল্লাহর বেশি প্রিয়ভাজন, এ কারণেই তাদের জন্য আল্লাহ আলাদা সূরা নাজিল করেছেন এবং এ সূরার মাধ্যমে তাদেরকে কাব্য ও শিল্পচর্চার উৎসাহ দিয়েছেন। তারা যেন এ কাব্য চর্চা করতে গিয়ে দিকভ্রান্ত ও দিশেহারা না হয়। এ জন্য তাদের কারণীয় সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন, যে আলোচনায় তাদেরকে চারটি অপরিহার্য গুণ অর্জন করতে বলেছেন। এ আয়াতে চতুর্থ যে গুণটির কথা বলা হয়েছে তা মূলত কবি ও শিল্পীদের জন্য আল্লাহর দেয়া একটি কর্মসূচি। যেখানে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত নেই সেখানে কোন না কোন পর্যায়ে মানুষের অধিকার ক্ষুণœ হবেই। এমনকি ইসলামী রাষ্ট্রে শয়তান মানুষকে বিপথগামী করার কাজ থেকে বিরত হবে না। এমতাবস্থায় শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ কোন অন্যায়ে লিপ্ত হলে, হয় সে নিজের অধিকার ক্ষুণœ করবে, নয়তো অন্যের। ফলে মানবিকসত্তা নিপীড়নের শিকার হবে। এ নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার প্রাথমিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কবি, শিল্পী ও সাহিত্যিকদের। মানুষকে অধিকারসচেতন করে তোলার জন্য, নিপীড়ন ও নির্যাতনের ব্যাপারে জনগণকে সজাগ করার জন্য, কিসে এবং কিভাবে মানবতা বিপর্যস্ত হচ্ছে তা স্পষ্ট করার জন্য সভ্যতার সপক্ষে প্রতিশোধের বাণী উচ্চকিত করার প্রথম ও শুরুর দায়িত্ব কবিদের ওপর অর্পণ করা হয়েছে এ বক্তব্যের মাধ্যমে। ঈমানদার কবিদের অপরিহার্য গুণ হিসেবে নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে আল্লাহর পক্ষ থেকে এ কথা জুড়ে দেয়ার এটাই হচ্ছে মূল তাৎপর্য। কারণ সভ্যতা ও মানবতা নিপীড়িত হলে কোমল হৃদয়ের অধিকারী একজন কবি ও শিল্পী বেদনার্ত না হয়ে পারবেন না। কবির কাজ সেই বেদনা অন্তরে পুষে না রেখে তাকে এমনভাবে প্রকাশ করা, যাতে মানবতার সেই অপমান প্রতিরোধে জনগণ সজাগ ও সচেতন হতে পারে, তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য উদ্বুদ্ধ হতে পারে। সূরা আশ শোয়ারা ছাড়াও সূরা আম্বিয়ার ৫ নম্বর আয়াত, সূরা সাফফাতের ৩৬ নং আয়াত, সূরা তুরের ৩০ নং আয়াত, সূরা আল হাজ্জার ৪১ নং আয়াত, সূরা ইয়াসিনের ৬৯ নং আয়াতসহ কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় কবি ও কবিতা প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। এর কারণ তৎকালীন আরবে তখনো গদ্য সাহিত্যের উদ্ভব ঘটেনি। মূলত সাহিত্য বলতেই তখন ছিল কেবলমাত্র কবিতা। এ জন্যই সাহিত্য বলতে কুরআনে কবিতারই উল্লেখ করা হয়েছে। তাই এ আলোচনায় কবি বলতে কবি ও সাহিত্যিক এবং কবিতা বলতে কবিতার সাথে সাহিত্যকে বুঝতে হবে। আর সাহিত্য বলতে গান, নাটক, গল্প, উপন্যাস সবই এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এবার সাহিত্যের সাথে সংস্কৃতির সম্পর্কটি বুঝে নেয়া দরকার। সাহিত্য এবং সংস্কৃতি দুটোই সুকুমার বৃত্তির চর্চা। একজন কবি যে কবিতাটি লেখেন একজন আবৃত্তিশিল্পী তাকেই জনগণের কাছে উপস্থাপন করেন তার শিল্পীত কণ্ঠের মাধ্যমে। একজন নাট্যকার একটি নাটক লিখেই তার দায়িত্ব শেষ করেন। জনতার সামনে উপস্থাপন করার সামগ্রিক দায়িত্বটিই পালন করতে হয় নাট্যকর্মীদের। একটি গান লেখা গীতিকারের দায়িত্ব কিন্তু যদি একজন সুরকার তাতে সুরারোপ না করেন এবং একজন কণ্ঠশিল্পী তাতে কণ্ঠ না দেন তবে সে গানটি গানই হয়ে উঠবে না। তাই শিল্পী ও সাহিত্যিকগণের কর্মকান্ড একই তুলাদন্ডে বিচার্য হওয়ার দাবি রাখে। সাহিত্য এবং সংস্কৃতি পরস্পরের পরিপূরক। একদল সৃষ্টি করে অন্য দল তা পরিবেশ করে। উৎকৃষ্ট সৃষ্টি না হলে যেমন উৎকৃষ্ট জিনিস পরিবশেন করা যায় না, তেমনি উৎকৃষ্ট পরিবেশক না থাকলে উৎকৃষ্ট জিনিস জনতার দৃষ্টির আড়ালেই পড়ে থাকবে, তার স্বাদ জনতা কখনোই পাবে না। এ জন্যই সাহিত্য সংস্কৃতির বিষয়টির আলোচনা এক সাথে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। লক্ষ্য করুন, আল্লাহ পবিত্র কালামে বারবার উল্লেখ করেছেন। পৃথিবী ও আকাশ মন্ডলের সকল কিছুই আল্লাহর প্রশংসাগুণে মুখর। সূরা নিসার ১৩১ নং আয়াত, সূরা বনি ইসরাইলের ৪৪ ও ১১১ নং আয়াত, সূরা নূরের ৩৬-৩৭ নং আয়াত, নমলের ৫৯, ৯৩ নং আয়াত, রূমের ১৭-১৯ নং আয়াত, লোকমানের ২৫-২৬ নং আয়াত, সাবার ১-২ নং আয়াত, সাফফাতের ১৮২ নং আয়াত, জাসিয়ার ৩৬-৩৭ নং আয়াত, সূরা রহমানের ৭৮ নং আয়াত, ওয়াকেয়ার ৭৪, ৯৬ নং আয়াত, হাদীদ, হাশর, সাফ, জুম্মা, তাগাবুনের প্রথম আয়াতসহ অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ মানুষকে তাঁর শানে হামদ পেশ করার তাগিদ দিয়েছেন। এ কথাও তো আমাদেরকে কুরআনই জানিয়েছেন যে, যদি সাগরের সব পানিকে কালি বানিয়ে আল্লাহর মহিমা লেখা শুরু করা হয় তবু দেখা যাবে আল্লাহর মহিমা লেখা শেষ হওয়ার আগেই সাগরের সব পানি ফুরিয়ে যাবে এবং আরো সাগর পানি আনলেও। তার মানে হামদ এ বারিতায়ালার যে সমুদ্র সৃষ্টির কাজে রত রয়েছেন আমাদের কবি ও শিল্পীরা, তাদের জীবন ফুরিয়ে যাবে কিন্তু শেষ হবে না আল্লাহর প্রশংসাগুণ। আমরা আমাদের হৃদয়ের আর্তি দিয়ে আল্লাহর গুণগান গাইবো আর আমাদের ঠোঁটে সেই গুণগানের উৎকৃষ্ট ভাষা তুলে দেবেন আমাদের প্রিয় কবি এবং শিল্পীবৃন্দ। আরো লক্ষ্য করুন, সূরা আহজাবের ৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর ওপর দরুদ পাঠান। হে ঈমানদারগণ তোমরাও তাঁর প্রতি বিশেষভাবে দরুদ পাঠাও। কেবল হামদ নয়, এ আয়াতের মাধ্যমে আমরা পেলাম নাত চর্চার নির্দেশ। এ আয়াতে বলা হয়েছে, নবীর ওপর তো দরুদ পাঠান তিনি, যিনি এ বিশ্বের ¯্রষ্টা, প্রতিপালক, মালিক মুনিব এবং বিশ্বের সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী। তিনি তো পাঠানই, সেই সাথে তাঁর ওপর দরুদ পাঠায় পবিত্র ফেরেশতাকুল। তারপর আল্লাহর ঈমানদারদের নির্দেশ দিচ্ছেন, হে ঈমানদারগণ, তোমরাও তাঁর প্রতি বিশেষভাবে দরুদ পাঠাও। এই বিশেষভাবে দরুদ আপনি কেমন করে পাঠাবেনÑ পাঠাবেন কবিতার ছন্দে ছন্দে, গানের সুরে সুরে। বিশেষভাবে বলতে সুললিতকণ্ঠে অপূর্ব সুর ও ছন্দে হৃদয় উজাড়করা আবেগ নিয়ে নাতে রাসূল ছাড়া আর কোন মাধ্যমে নবীর প্রতি দরুদ ও সালাম প্রেরণ কর সম্ভব? তাই হামদ ও নাতের চর্চা করা, লেখা, সুর দেয়া গাওয়ার মধ্য দিয়ে একজন কবি বা শিল্পী আল্লাহর হুকমকেই বুকে ধারণ করেন। এমনকি এই হামদ ও নাতের প্রতি প্রেমভাব পোষণ ও আল্লাহর হুকুমকে বুকে ধারণ করারই নামান্তর। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, কবি ও শিল্পীরা কেবল হামদ নাতের চর্চা করবে। বরং সূরা আশ শোয়ারায় জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বাণী উচ্চকিত করার যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেই নির্দেশনার আলোকে সমকালীন অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণকে জাগিয়ে তোলাই হচ্ছে কবিদের মূল দায়িত্ব, আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব। কুরআনের যে বাণী আমরা একটু আগে আলোচনা করলাম আমাদের প্রিয় নবী এবং নবীজীর সঙ্গী-সাথীরা কেমনভাবে তার মর্ম উপলব্ধি করেছিলেন এটাও এক বিরাট আলোচনার বিষয়। সভ্যতাকে সজাগ ও সচেতন করার যে অপরিহার্য দায়িত্ব কুরআনের উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহতায়ালা শিল্পী সাহিত্যিকদের ওপর অর্পণ করেছেন, অন্তত রাসূলের জামানায় সেভাবে কোন ব্যাপক ভূমিকা রাখা তাদের জন্য অপরিহার্য ছিল না। কারণ তখন মানবতাকে সজাগ ও সচেতন করার জন্য স্বয়ং রাসূলে করীম (সা) নিজেই উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁকে গাইড করেছিলেন স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিন। এমতাবস্থায় সমাজের সঠিক চিত্র তুলে ধরে মানুষকে তার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অংশগ্রহণের ডাক দেয়ার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই যথেষ্ট ছিলেন। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি, রাসূল (সা) আসহাবে সুফফা বলে পরিচিত একদল সাহাবীকে এমনভাবে জ্ঞান সাধনায় নিয়োজিত করে রেখেছিলেন যে, জ্ঞনের চর্চা করাটাই ছিল তাঁদের মূল কাজ। এমনকি জীবন জীবিকার জন্যও তাদের কোন চিন্তা করতে হতো না ইসলামী সমাজ সম্মিলিতভাবে তাদের জীবিকা সরবরাহ করতো। ইসলাম বিকাশের সেই প্রাথমিক যুগে, যখন বদরের যুদ্ধের মত কঠিন মুহূর্তে মহিলা সাহাবীদেরকেও প্রয়োজনের খাতিরে যুদ্ধের ময়দানে টেনে নেয়া হয়েছিল, সেই সঙ্কটময় মুহূর্তেও মহানবী (সা) আসহাবে সুফফার সেই সাহাবীদেরকে জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত রেখেছিলেন, তাদেরকে যুদ্ধের ময়দানে টেনে নেননি। এ থেকে জ্ঞান চর্চা তথা সাহিত্য সংস্কৃতির সাধনাকে ইসলাম কী পরিমাণ গুরুত্ব দেয় তা সহজেই অনুমেয়। আমাদের প্রিয় নবীর কয়েকটি হাদিস এ ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত ও বিভ্রান্তিমুক্ত করার জন্য যথেষ্ট। সংস্কৃতি চর্চায় রাসূলের ভূমিকা লক্ষ্য করুন। শোকে দুঃখে, আনন্দ বেদনায় রাসূল (সা)কে স্ফূর্তিতে রাখার জন্য সাহাবী কবিরা সব সময়ই কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন তাঁকে। রাসূল (সা) বিজয়ীরবেশে মক্কায় প্রবেশ করেছেন, আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) উটের লাগাম ধরে হাঁটছেন আর গাইছেন; ফকির বংশ, শোনরে ওরে পথ ছেড়ে দে/ সকল ভালো রাসূল মাঝে, নে লুটে নে (ইবন হিশাম, আসসীরাহ ৪/১৩; যাদুল মাআদ৩/৩০)। মুসলমানরা কুবার মসজিদ বানাতে ব্যস্ত। মহানবীও আছেন তাঁদের সাথে। তারা কাজ করছেন আর সমস্বরে ইবন রাওয়াহার (রা) কবিতা আবৃত্তি করছেন; পুণ্য পথের পন্থীরা গড়ে এ মসজিদ/ কুরআন পড়ে দাঁড়িয়ে বসে যায় না নিঁদ। শক্ত আঘাতে পাথর ছুটছে দিগি¦দিক। রাসুলে করীম নিজেও তাঁদের সাথে কণ্ঠ মিলাচ্ছেন। (ওয়াফা আল ওয়াফা ১/১৫৬) বসে আছেন প্রিয়নবী (সা)। কবি আন নাবিগাহ এলেন। আবৃত্তি করতে থাকলেন স্বরচিত কবিতা। যখন বললেন; মর্যাদা ও মহিমায় আমরা পৌঁছি নীলাভ্র ভেদ করে। আরো চাই, তারো ঊর্ধ্বে দেখা যাক আমাদের বিজয় নিশান। কেমন যেন বাড়াবাড়ি মনে হলো নবীজীর কাছে। প্রশ্ন করলেন, আবু লায়লা (কবির ডাক নাম), তারো ঊর্ধ্বে দেখবে তোমার বিজয় নিশান, কোথায়? কবি বললেন, জান্নাতে, হে আল্লাহর হাবীব। এবার মহানবী (সা) বললেন, ঠিক আছে। ইনশাআল্লাহ দেখবে একদিন। (তাবাকাত আশশাফিঈয়াহ আল কুবরা ১/২৪৭, আশশিরু ওয়া আশশুয়ারা ২৮৯)। রাসূলে করীম (সা) নিজে সাহিত্যপ্রেমিক ছিলেন এবং কবিতা শুনতে ভালবাসতেন এতটুকুতেই তাঁর কাব্যপ্রেম সীমাবদ্ধ ছিল না। অন্যদেরও তিনি কবিতার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বলেছেন, যে দুটো মনোরম আভরণে বিশ্বাসীকে আল্লাহ সাজিয়ে থাকেন, কবিতা তার একটি। (তামীয আততাইয়ির মিন আল খাবিস ৯৩) আরো বলেছেন, নিঃসন্দেহে কোন কোন কবিতায় রয়েছে প্রকৃত জ্ঞানের কথা। (আল আদাব আল মুফরাদ-৩৭৮) এ কথা কার না জানা আছে, মহানবীর উপস্থিতিতে তাঁরই নির্দেশনায় মসজিদে নববীতে কবিতা আবৃত্তির জন্য একটি আলাদা মিম্বর (মঞ্চ) তৈরি করা হয়েছিল। সেই মঞ্চে হাসসান বিন সাবিত (রা)সহ সাহাবী কবিরা কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং মহানবী (সা)ও তাঁর অন্যান্য সাহাবীরা নিয়মিত সেই আসরে উপস্থিত থেকে তা উপভোগ করতেন। হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা) বলেছেন, মহানবী (সা) মসজিদে হাসসানের জন্য উঁচু মিম্বর তৈরি করিয়ে নেন। তার উপরে চড়ে হাসসান নবীজির গৌরবগাথা এবং মুশরিকদের নিন্দাকাব্য আবৃত্তি করতেন। কখনো মহানবী (সা) বলতেন, হাসসানের জিভ যতদিন রাসূলের পক্ষ হতে কবিতার বাণী শুনিয়ে যাবে ততদিন তাঁর সাথে জিবরাইল থাকবেন। (তিরমিযী : সুনানা ৫/১৩৮) কেবল কুরআন নয়, কাব্যচর্চার জন্য রাসূলের তাগিদও কম ছিল না। কবিতার জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সাহাবী কবিদের প্রতি কঠোর নির্দেশ ছিল মহানবীর। হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন, মহানবী (সা) বললেন, তোমরা কাফির মুশরিকদের নিন্দা করে কাব্য লড়াইয়ে নেমে পড়। তীরের ফলার চেয়ে তা আরো বেশি আহত করবে তাদের। ইবনু রাওয়াহাকে পাঠানো হলো সম্পূর্ণ মুগ্ধ হতে পারলেন না রাসূল (সা)। কাআব বিন মালিকও এলেন। অবশেষে যখন হাসসান এলেন, বললেন, সবশেষে তোমরা পাঠালে ওকে? তো লেজের আঘাতে সংহারকারী তেজোদৃপ্ত সিংহশাবক কথা শুনে আনন্দে জিভ নাড়তে লাগলেন হাসসান। বললেন যিনি আপনাকে সত্যবাণী দিয়ে পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ! এ জিভ দিয়ে ওদের মধ্য চামড়া ছুলে ফেলার মত গাত্রদাহ সৃষ্টি করে ছাড়ব। কাআব ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) আমাদের নির্দেশ দিলেন যাও, তোমরা মুশরিকদের প্রতিপক্ষ কবিতার লড়াইয়ে লেগে যাও। কারণ মুমিন জিহাদ করে জান দিয়ে মাল দিয়ে। মুহাম্মদের আত্মা যাঁর হাতের মুঠোয় তাঁর শপথ! তোমাদের কবিতা, তীরের ফলা হয়ে তাদের কলজে ঝাঁঝরা করে দেবে। এভাবে রাসূল (সা) আল্লাহর কালামের অনুগত কাব্যকলাকে উৎসাহিত করে তাঁর নেতৃত্বে নব উত্থিত সমাজ বিপ্লবের সাহাবী কবিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে এক নব উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিলেন। সাধারণ সাহাবীদেরকেও তিনি কবিতার ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। হাদিস শরীফ থেকে জানা যায়, তিনি সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের কবিতা শেখাও তাহলে তাদের কথা মিষ্টি ও সুরেলা হবে। এভাবেই মহানবী (সা) অশিক্ষিত সাহাবীদেরকেও কাব্যচর্চায় উৎসাহী করে তোলেন। সমসাময়িক ঈমানদার কবিদের কবিতা নিয়ে রাসূল (সা)-এর ঔৎসুক্য ছিল অতুলনীয়। একবার মহানবী (সা) হযরত হাসসান (রা) কে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আবু বকরকে নিয়ে কোনো কবিতা কি এ পর্যন্ত লিখেছো? হযরত হাসসান (রা) জবাব দিলেন, হ্যাঁ লিখেছি। রাসূল (সা) বললেন শোনাও তো দেখি। কবি হাসসান বিন সাবিত (রা) হযরত আবু বকর (রা)কে নিয়ে লেখা তাঁর কবিতা শোনাতে শোনাতে যখন নিচের পঙক্তিগুলো পড়তে লাগলেন; সুউচ্চ সওর গুহার দ্বিতীয় ব্যক্তি সে তিনিই যখন রক্ত লোলুপ শৃগালেরা মুখে শুঁকে শিখরে এলো। রাসূলের সঙ্গে আছেন সদা এক ছায়াতরু সবাই জানে নবীর পরে তিনি সৃষ্টির মাঝে সবার চেয়ে সেরা। তা শুনে মহানবী (সা) হেসে বললেন, ঠিক বলেছো হাসসান, যা বলেছো তার যোগ্য তিনিই। তিনি ছিলেন কবিদের পৃষ্ঠপোষক। তিনি কবিদের কবিতা শুনতেন এবং তাদের পরামর্শ, উপদেশ ও দিকনির্দেশনা দিতেন। কবিদের উপহার ও উপঢৌকন দেয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সবার চেয়ে অগ্রগামী ও তৎপর। কাব ইবন যুহায়রের কবিতা শুনে তিনি এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, নিজের শরীর থেকে চাদর খুলে তা উপহার দিয়েছিলেন কবিকে। তিনি বলেছেন, কবিদের আর্থিক সহায়তা করা পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার সমতুল্য। এ রকম আরো অসংখ্য ঘটনা আছে, হাদিস আছে, যেসব ঘটনার মধ্য দিয়ে শিল্প সাহিত্যের প্রতি রাসূলে করীমের সীমাহীন ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। কবি ও কবিতাকে, সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের ভালোবাসা তথা সংস্কৃতি চর্চা করা তাই সুন্নাতে রাসূলের অন্তর্ভুক্ত। শিল্পের প্রতি, কবি ও কবিতার প্রতি অবজ্ঞা বা অনাগ্রহ প্রকাশ সুন্নাতে রাসূলের পরিপন্থী। আজ মহানবী বেঁচে নেই, আছে তাঁর উম্মাহ, আছে বিশ্বব্যাপী মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং তাদের নেতৃবৃন্দ মহানবীর এসব সুন্নতকে সমাজে প্রচলন করা এবং জারি রাখার দায়িত্ব আজ এই উম্মাহর। মহানবী (সা)-এর সংগ্রামে রত, জ্ঞানচর্চার এ কুরআনিক গুরুত্বটি কি তারা সেভাবে দিচ্ছেন বা দিতে পারছেন? সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যাপারে ইসলামী দর্শন কি এ দেশের উম্মতে মুহাম্মদীর কাছে পরিষ্কার? ইসলামকে বিজয়ের আসনে দেখতে চাইলে এ প্রশ্নের সদুত্তর আমাদেরকে অবশ্যই খুঁজে পেতে হবে। লেখক : কবি ও সাহিত্যিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির