সাতচল্লিশের দেশ-বিভাগোত্তরকালে পূর্ব-পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রে সাম্যবাদ বা সম্পদের সুষম বণ্টনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক অঙ্গনে প্রভাববলয় সৃষ্টি করে। এ সময় সাম্যবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত কবিরা হন: সিকানদার আবু জাফর, আবদুল গনি হাজারী, মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আল মাহমুদ, আহমদ ছফা, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, ফরহাদ মযহার, হুমায়ূন কবির, মুহম্মদ নূরুল হুদা, খান মোহাম্মদ ফারাবী প্রমুখ। এ-সব কবি মূলত স্বদেশের সামগ্রিক মুক্তিসংগ্রামে সাম্যবাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় উজ্জীবিত। পঞ্চাশের এইসব কবির সামনে বিশ, তিরিশ ও চল্লিশের সাম্যবাদী বিশাল কবিগোষ্ঠী অনুপ্রেরণার জায়গারূপে কাজ করেছে। এছাড়া বিশ্বসাহিত্যে বিভিন্ন ভাষার সাম্যবাদী কবি ও কবিতা এদের মন ও মননে ছায়া ফেলেছে। কৈশোরে আল মাহমুদ কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী ও বিদ্রোহীমূলক কবিতাবলী দ্বারা প্রভাবিত হন। এছাড়া তুর্কি সাম্যবাদী কবি নাজিম হিকমতের কবিতার সাথে পরিচয় ঘটে- সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য অনুবাদের মাধ্যমে। যৌবনে তিরিশের দশকের বিষ্ণু দে, চল্লিশের সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও মঙ্গলাচরণের সাম্যবাদী কাব্যজগতের অধিবাসী হন। তবে অন্য কবিদের থেকে বিষ্ণু দে-র মননধর্মিতা ও আঙ্গিকশৈলী তাকে বেশি আকৃষ্ট করে। ‘সোনালি কাবিন’ পর্যন্ত মার্কসবাদী সাম্যবাদে আল মাহমুদের আস্থা অনেকাংশে প্রকাশিত হয়। তবে পরবর্তীকালে আল মাহমুদের কবিতায় ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’র মাধ্যমেই যে ইসলামী আদর্শ ও ঐতিহ্যের রূপায়ণের সূচনা, সেটা বলা যাবে না। ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’- প্রাথমিক এইসব কাব্যগ্রন্থের কোথাও ইসলামে অবিশ্বাস ও অনাস্থার পরিচয় নেই; বরং প্রতিটি কাব্যেই ইসলামী ঐতিহ্যের কিছু কিছু স্বাক্ষর আছে। এমনকি ‘সোনালি কাবিনে’ সাম্যবাদের প্রতি প্রবল আস্থা থাকার পরও ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’য় কুরআনের আয়াত- ‘ফাবি আইয়ি আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্জ্বিবান’ বা ‘তুমি তোমার প্রভুর কোন্ কোন্ নিদর্শনকে অস্বীকার করবে?’- ব্যবহৃত হয়েছে। পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারা কবির রক্তে বহমান থাকার কারণে ইসলামকে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি বা চাননি। সমালোচকের মতে, ‘‘ইসলামে ভ্রাতৃত্ববোধ, শ্রেণীহীন সমাজের ধারণা, ফসলের সুষম বণ্টন, ধনীদের সম্পদে গরিবদের অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলো থাকায় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সাথে ইসলামের সম্পর্ক একেবারে পরস্পরবিরাধী নয়। সে কারণে এক ধরনের সমাজতন্ত্রীয় চিন্তা যুগে যুগে ইসলামের মধ্যে দেখা যায়।’’ আল মাহমুদ মার্কসীয় সাম্যবাদ থেকে দূরে সরে গেলেও মেহনতি মানুষের সংগ্রামী জীবনের কথা ভুলে যাননি, বরং ইসলামের সাম্যচেতনায় প্রাণিত হন। জেলখানায় বসে তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের আকাল ও ক্ষুধার্ত মানুষের শহরের দিকে ছুটে চলা, অনাহারী শিশুদের মৃতদেহের চিত্র দেখে মর্মাহত হন। প্রিয়তমার প্রতি কবির আকুতি জানিয়েছেন যে, ‘মুষ্টি ভিক্ষা’ দিয়ে দারিদ্র্য দূর করা যায় না, এর জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার প্রয়োজন; এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে দেশের সাধারণ মানুষই। আর গণমানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা থাকায় তাদের উত্থানের শব্দ তিনি শুনতে পেয়েছেন। দেয়ালের ওপাশ থেকে ঘুমভাঙা মানুষের কোলাহল! যারা অধিক রাতে ঘুমায় আর জাগে সকালের আগে। যারা ঠেলে। চালায়। হানে। ঘোরায়। ওড়ায়। পোড়ায়। আর হাত মুঠো করে এগিয়ে যায়। সভ্যতার তলদেশে যাদের ঘামের অমোঘ নদী কোনোদিন শুকোয় না। শোনো তাদের কলরব। মানব সভ্যতার নির্মাণ সম্ভব হয়েছে শ্রমিকশ্রেণীর শ্রম ও ঘামের কল্যাণে। কবি এই শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তাদের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ এবং তাদের আত্মপ্রকাশকে স্বাগত জানিয়েছেন। কেননা শ্রমিকগোষ্ঠীর শ্রমকে সকল সভ্যতা শোষণ করেছে। শ্রমপ্রক্রিয়া যখন পুঁজিপতির দখলে আসে তখন তার দুটো বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। প্রথমত, শ্রমিক কাজ করে পুঁজিপতির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে, যার দখলে তার শ্রম। দ্বিতীয়ত, তার শ্রমে উৎপাদিত দ্রব্যের মালিকও পুঁজিপতি। শ্রমপ্রক্রিয়া ক্রয়ের মাধ্যমে পুঁজিপতি যা করে, তা হলো জীবন্ত শ্রমকে সে যুক্ত করে উৎপাদিত দ্রব্যের প্রাণহীন উপাদানের সঙ্গে। তার দিক থেকে শ্রমপ্রক্রিয়া কিনে-নেওয়া একটি পণ্য অর্থাৎ শ্রমশক্তি ভোগ ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু উৎপাদনের উপায় জোগান না-দেয়া পর্যন্ত এই শ্রমশক্তি ভোগ কোনো কাজে লাগবে না। ক্রয়কৃত বিভিন্ন দ্রব্যের মধ্যে শ্রমপ্রক্রিয়াও একটি প্রক্রিয়া যার মালিক পুঁজিপতি। সুতরাং উৎপাদিত দ্রব্যেরও মালিকও সে-ই। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’র পরে ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ ও ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’য় কবি স্পষ্টভাবে ইসলামের সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেন। এ ক্ষেত্রে সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী কবি মুহম্মদ ইকবাল এবং বাংলা কবিতার চল্লিশের দশকের শক্তিমান কবি ফররুখ আহমদের গণমুখী ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তিকামী কাব্যলোক তাকে সন্দীপিত করে। ফলে ‘গিফারীর শেষ দিনে’র মত কবিতা তিনি লেখেন যেখানে উমাইয়া রাজাদের সম্পদশালীদের বিরুদ্ধে গিফারীর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে। ১৩৯০-এর শারদীয় সংখ্যা ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় এ কবিতার পাদটীকায় কবির মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য: ‘‘গিফারী ছিলেন মধ্যযুগে ইসলামের এক অসাধারণ মেধাসম্পন্ন বিপ্লবী। যিনি প্রথমে ধর্মে এবং ইসলামের ধর্মীয় পটভূমিতে সমাজতন্ত্রের ধারাটি সংলগ্ন করেন।’’ গিফারীর জীবনের বিপ্লব ও করুণ পরিণতিকে আল মাহমুদ সংলাপধর্মী কাব্যে রূপ দেন। স্ত্রীর সাথে কথোপকথনে গিফারীর পরিচয় প্রকাশিত হয়ে যায়: - আমি কৃষ্ণা ছায়াসঙ্গিনী তোমার, হে গিফারী। সেই কালো সাপ, যাতে প্রবিষ্ট ছিলে ঈমানের তীক্ষè তরবারি তুমি। সোনা ও চাঁদির পাহাড় নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে তুমি ছিলে পবিত্র কোরানের তুফান। আমি বাতাসের বেগ নিয়ে তোমার ঝড়কে চুম্বন করি প্রিয়তম। আমি তোমার জানাজার পবিত্র সাথিদের ডেকে আনবো। - উমাইয়া রাজারা আমাকে মৃত্যুর ভয়ে টলাতে চাইতো। হে আমার কালো ছায়া সুর্মাদানী, পৃথিবীর পিঠের চেয়ে এর উদর আমার চিরকাল কাম্য ছিলো তোমার কসম। মৃত্যুভয়হীন এমন এক সাহসী বিপ্লবী ইতিহাসে সত্যিই বিরল। তিনি নিজের জন্য এক খণ্ড কাফন সঞ্চয়েরও বিরোধী ছিলেন। দামেস্ক ও মক্কার ধনীদের সম্পদের পাহাড় তৈরির বিরুদ্ধে তিনি এক প্রতিবাদী ঝড়ের মতো ব্যক্তিত্ব। সে জন্যই তাকে নির্জন ‘রবজার নির্জন প্রান্তরে’ নির্বাসনে একাকী মৃত্যুবরণ করতে হয়। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপক্ষে এবং সাম্যবাদী ধারণার পক্ষে বিশ্বাস স্থাপনের দৃষ্টান্ত গিফারীর জীবনে উজ্জ্বল হয়ে আছে; ইতিহাসের এ সাক্ষ্যকে আল মাহমুদ কবিতায় রূপ দেবার দুটি কারণ আছে: এক. পরিবর্তিত আদর্শ ইসলামের প্রতি আস্থা; দুই. মার্কসীয় আদর্শের পরিবর্তন হলেও ইসলামের সাম্যবাদী মনোভাবে অবিচলতা। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার ধারক ও বাহক ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রতি কবি ‘ইহুদিরা’ কবিতায় তীব্র আক্রমণ ও ধ্বংস কামনা করেন তাদের ঐতিহাসিক কার্যাবলীকে স্মরণে রেখে। পবিত্র কুরআন পাঠে কবি অর্জন করেন মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে বিচরণ করার এক নতুন ও চিরন্তন অর্থ। কবি এই পাঠেই উপলব্ধি করেন বিশ্বব্যাপী পুঁজির উৎস, বিকাশ ও পরিণতির ইতিহাস। কবির ভাষ্য- কুরআন পাঠের আগে আমার জানাই ছিল না যে, মানুষের ধর্মগ্রন্থগুলোর ভেতর প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে আছে পুঁজি গঠনের অন্য এক বিস্ময়কর ইতিহাস। পতনোন্মুখ সামন্ততন্ত্র ও উদীয়মান ধনতন্ত্রকে আজ থেকে চৌদ্দশো বছর আগেই নিরাকরণের এক বৈপ্লবিক চেষ্টা। একদিকে দাসপ্রথার উচ্ছেদের প্রাথমিক কানুন প্রচলিত করে সামন্তসমৃদ্ধির ভিত্তি কাঁপিয়ে দেওয়া। অন্যদিকে নির্দ্বিধায় সুদকে হারাম ঘোষণা করে উদীয়মান ইহুদি পুঁজির সাথে সরাসরি সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটিয়ে, জাকাতের বাধ্যতামূলক বিধানের মধ্যে বায়তুলমাল গঠন করে কল্যাণ ও সুষম ইসলামী সাম্যবাদী জনগণতান্ত্রিক খেলাফত প্রতিষ্ঠার এক গৌরবোজ্জ্বল বৈপ্লবিক কাহিনী কুরআন ও হাদীসের সংস্পর্শে না এলে আমি কোনেদিন জানতামই না যে বিশ্বব্যাপী সামন্ততন্ত্রকে বিদীর্ণ করে আরবের বিতাড়িত ইহুদি পুঁজিই শেষ পর্যন্ত ধনতন্ত্রের উদ্গাতা। ধনতন্ত্রের ¯্রষ্টা এই ইহুদি জাতি পৌত্তলিকদের লুণ্ঠনের ভয়ে নিজেদের সমস্ত স্বর্ণপিণ্ড, অলংকার, ইত্যাদি দিয়ে সমিরি নামের একজন শিল্পীর পরামর্শে পূজার উদ্দেশ্যে গাভীর স্বর্ণময় মূর্তি নির্মাণ করে, পৌত্তলিকরা সম্ভবত আরেক পৌত্তলিক জাতির দেবমূর্তি অপহরণ করবে না, এই যুক্তিতে। এভাবে ইহুদিদের স্বর্ণপিণ্ডের পূজা শুরু হয়- হযরত মুসা (আ.) সিনাইয়ের সর্Ÿোচ্চ চূড়ায় আল্লাহর আদেশখোদিত ফলক সংগ্রহ করে আনার আগেই। পুঁজির প্রতি এই জাতির সীমাহীন লোভ, লালসা ও অন্ধ মোহের কারণে কবি মনে করেন, ইহুদিবাদ মানবজাতির প্রতি ধনতন্ত্রের উদগাতাদের চিরস্থায়ী এক অনিষ্টকর চিন্তাধারা ও ব্যবস্থা। ‘ইহুদিরা’ কবিতার ভাষায়- অনিষ্টকর অন্ধকারে যখন পৃথিবী আচ্ছন্ন হয়ে যায়। চারদিকে ডাইনীদের ফুৎকারের মতো হাওয়ার ফিসফাস, আর পাখিরা গুপ্ত সাপের আতঙ্কে আশ্রয় ছেড়ে অন্ধকারে ঝাঁপ দেয় ঠিক তখুনি, ইহুদিরা হেসে ওঠে। বিশ্ব প্রকৃতিতে ও সমাজে সমস্ত অশুভ, আতঙ্ক ও অকল্যাণের সাথে ইহুদিরা জড়িত বলেই কবির বিশ্বাস। তবে কবি হতাশ না হয়ে প্রবলভাবে বিশ্বাস করেন- ‘সমস্ত রহস্যের দরোজা’ পার হয়ে ‘শেষতম বাণী’ হাতে পৃথিবীতে সর্বশেষ নবী মুহম্মাদ সা. এসেছেন, তিনিই পৃথিবীতে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার উপযুক্ত ব্যক্তি। ইহুদিরা যতই ধনতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটাক, যতই আনন্দ-উল্লাসে পৃথিবী ভাসিয়ে দিক; কবি নিশ্চিত- ইহুদিরা হাসুক তবু সম্পদের সুষম বণ্টন অনিবার্য। ইহুদিরা নাচুক, তবু ধনতন্ত্রের পতন আসন্ন। আর মানুষ মানুষের ভাই। মানুষের মাঝে সম্পদের ইনসাফভিত্তিক বণ্টনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধনতন্ত্রের পতন এবং মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সজাগ সমাজের স্বপ্ন কবি নির্মাণ করেন। যদিও এই স্বপ্ন বুননে ইহুদি পরিচালিত বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৃষ্ট সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ঘটা স্বাভাবিক। ১৯৪৮ সালে লক্ষ লক্ষ আরব প্যালেস্টিনিয়ানকে (চধষরংঃধরহ) তাদের মাতৃভূমি থেকে জবরদস্তিমূলকভাবে উচ্ছেদ করে সেখানে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই আগ্রাসন চালু আছে। পৃথিবীর নির্যাতিত জনগণ বিপ্লবী রাজনীতির মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে পুঁজির মালিক, লুণ্ঠনকারী ও সা¤্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে- এমন এক প্রত্যয় ঝলসিত হয়েছে কবির কণ্ঠে। এইসব মানব শত্রু শ্রেণীর ‘কেয়ামত’ অর্থাৎ সমাপ্তি যে অদূর ভবিষ্যতে রচিত হবে সে ব্যাপারে কবি নিঃসন্দেহ। কবির আমেরিকাবিরোধী মনোভাবের ব্যাখ্যা একজন সমালোচক করেন এভাবে: আল মাহমুদের মনোভাব ধনতন্ত্রের বিরোধী; আমরা দেখেছি ইসলাম ধর্ম পুঁজিবাদ ও ধনতন্ত্রবাদকে ঘৃণা করে। সেদিক দিয়ে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদকে অপছন্দ করবার একটি স্বাভাবিক কারণ তাঁর রয়েছে। সারা পৃথিবীর সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা সেই অর্থে আমেরিকা-বিরোধী এবং প্রায় লেখাপত্রে সেই বিরাগ তাঁরা প্রকাশ করেন। সাম্যবাদী গোষ্ঠীভুক্ত ভারতীয়রাও আমেরিকা-বিরোধী কবিতা কম লেখেননি। কবি জীবন সায়াহ্নে এসেও পৃথিবী ও মানুষের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থাশীল ও আশাবাদী। কবি বিশ্বাস করেন সাম্য-মৈত্রী-ভ্রাতৃত্ব-ভালোবাসার অকৃত্রিম মানবিকতা ছাড়া অন্য কোনো শক্তি এখানে প্রভুত্ব কায়েম করতে পারবে না। সত্তর বছর বয়সে লেখা “শূন্য থেকে সাম্যে” কবিতায় এই অভিব্যক্তিই কাব্যরূপ পেয়েছে। আমি শূন্য থেকে এসেছি বলেই রক পাখির ডিমের মত ঐশ্বর্যভরা পৃথিবীকে বুকের ভেতর অনুভব করি। কি উষ্ণ, কি সমুদ্রের তৃপ্তিতে ভরা, কি হীরকের দ্যুতিতে সমুজ্জ্বল বরফের প্রান্তর। এই তো পৃথিবী। এই তো আমার আত্মা আমার আছে, আছে অনিঃশেষ শব্দের দোলনা। কে এর উপর প্রভুত্ব করবে। সাম্য, মৈত্রী ও ভালোবাসা ছাড়া? ভ্রাতৃত্বের বণ্টন ছাড়া? কবি তাই আর ধ্বংস-মৃত্যু, নৈঃশব্দ মানুষের কঙ্কাল নিয়ে কাব্য রচনা করতে অনিচ্ছুক। হত্যা-রক্তপাত-আগ্রাসন-পুঁজির প্রতাপহীন এক সাম্যবাদী, সুখী-সুন্দর পৃথিবী নির্মাণ শেষ পর্যন্ত কবির স্বপ্ন হয়ে বারবার আলো জ্বালিয়েছে কাব্য যাত্রার শুরু থেকে শেষাবধি। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, মার্কসীয় ও ইসলামী সাম্যবাদে আস্থার উভয় পর্বেই কবি জনগণের মাঝে সম্পদের সুষম বণ্টন ব্যবস্থা, পুঁজিবাদী ও সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির বিনাশ চেয়েছেন। অর্থাৎ তিনি সাম্যবাদী আদর্শ থেকে কখনোই দূরে সরে যাননি, শুধু পথের বদল করেছেন, লক্ষ্য নয়। সাম্যবাদে আস্থা ও প্রত্যয় আল মাহমুদের কবিতায় একটা বড় জায়গা জুড়ে বিরাজমান। তবে স্পষ্ট দুটি পর্বে সেটা প্রবাহিত: এক. মার্কসীয় সাম্যবাদ, দুই. ইসলামের সাম্যবাদী চেতনা। সমগ্র কাব্যজগতের দিকে দৃষ্টি দিলে এটা লক্ষণীয় যে, স্বদেশের ও বিশ্বের অধিকার বঞ্চিত জনগণের জন্য শ্রেণী-বৈষম্যহীন সাম্যের বা সুষম বণ্টনব্যবস্থার একটি সমাজ বিনির্মাণ কবির একান্ত কাম্য। এই লক্ষ্য ও চেতনাপ্রবাহ কাব্যে প্রকাশ করে বাংলাদেশের কবিতায় আল মাহমুদ সাম্যবাদী ভাবাদর্শের একজন শক্তিমান কবিরূপে চিহ্নিত। লেখক : কবি ও গবেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন