ভারতের আসামে নাগরিকদের (এনআরসি) চূড়ান্ত তালিকা গত ৩১ আগস্ট প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত তালিকায় ১৯ লক্ষাধিক মানুষের নাম বাদ পড়েছে বলে জানা গেছে। যেসব নাগরিক বাদ পড়েছেন তারা আসামের মোট জনসংখ্যার ৬ শতাংশ। প্রথমবারের খসড়ায় বাদ পড়েছিলেন ৪০ লাখ মানুষ। তবে চূড়ান্ত তালিকায় ঠিক কত সংখ্যক মুসলমান বা কত সংখ্যক হিন্দু বাদ পড়েছেন তা নির্ণয় করা না গেলেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে হিন্দুরাই এই তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন অধিক। ফলে স্থানীয় বিজেপিসহ যারা এই নাগরিকপঞ্জির দাবিতে মুখর ছিল, তারাই এখন অনেকটাই বিপাকে পড়েছে মনে হলেও ষড়যন্ত্রের শেকড় কিন্তু আরও গভীরে। দৃশ্যত তারা যা চেয়েছিলেন চূড়ান্ত এনআরসিতে তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়নি। কারণ, প্রথমবারের খসড়ার মতো এবারও বাদ পড়া বেশির ভাগই বাংলাভাষী হিন্দু। যারা বিজেপির বিশ্বস্ত ভোটব্যাংক বলে পরিচিত। বিষয়টি স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে বলেই মনে হলেও নেপথ্যের খবর কিন্তু আলাদা। মূলত একগুচ্ছ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এনআরসি দিয়ে তা বাস্তবায়নের সূচনা করেছে মাত্র। বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায় অতিসম্প্রতি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে করা গুরুতর অভিযোগের মাধ্যমে। আগে মনে করা হতো যে, কথিত এনআরসি প্রণয়নের মাধ্যমে শুধুই মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিতাড়ন করা হবে। কিন্তু সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা থেকে প্রমাণ হয় যে, এনআরসির উদ্দেশ্য একক নয় বরং বহুমাত্রিক। এমনকি চূড়ান্ত এনআরসিতে অধিক সংখ্যক হিন্দু নাগরিক বাদ পড়ার ক্ষেত্রে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহার বক্তব্যের যোগসূত্র আছে বলে অনেকেই মনে করছেন। সম্প্রতি তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান নিখোঁজ রয়েছেন। দয়া করে আমাদের লোকজনকে সহায়তা করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই।’ তার ভাষায়, ‘এখন সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু রয়েছে। আমরা আমাদের বাড়িঘর খুইয়েছি। তারা আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, তারা আমাদের ভূমি দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বিচার পাইনি।’ মূলত প্রিয়া সাহার বক্তব্যকে স্বাভাবিক মনে করার কোন সুযোগ নেই বরং এর মধ্যে সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র রয়েছে বলেই এখন অনেকটাই প্রমাণিত। কারণ বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক প্রিয়া সাহার এই বক্তব্যকে দেদার সাপোর্ট করে বলেন, “হিন্দু নেত্রী প্রিয়া সাহা বাংলাদেশের ৩ কোটি ৭০ লক্ষ ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিখোঁজ থাকার যে অভিযোগ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে করেছেন তা সঠিক। সরকারের বিভিন্ন হিসেব অনুযায়ী, ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩ কোটি ৭০ লক্ষ হিন্দু রয়েছেন, যাদের মধ্যে একটি বড় অংশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘দৈনিক যুগশঙ্খ’ নামক এক পত্রিকার সাক্ষাৎকারে গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক এ কথা বলেন।” তিনি বলেন, “আজ সারা বাংলাদেশে প্রিয়া সাহার বক্তব্য নিয়ে ঝড় উঠেছে। কিন্তু সরকারের ‘ক’ ও ‘খ’ তফশিলের তালিকা দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন, প্রিয়া সাহার দেওয়া তথ্যে ভুল নেই।” তিনি আরো বলেন, “আসামে প্রকাশিত নাগরিক তালিকায় বাদ পড়া প্রায় ৪০ লক্ষ নাগরিক তো বাংলাদেশ থেকে নিখোঁজ হওয়া মানুষই। তারা বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন আমরা স্বীকার করছি, এনআরসি থেকে বাদ পড়া ৪০ লক্ষ নাগরিক বাংলাদেশি ছিলেন। শুধু আসামেই নয়, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতসহ পুরো ভারতেই বাংলাদেশ থেকে নিখোঁজ ৩ কোটি ৭০ লক্ষ নাগরিকদের অধিকাংশই রয়েছেন।” আসামের চূড়ান্ত এনআরসি থেকে বাদ পড়া প্রায় ২০ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ১২ লাখই হিন্দু বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। আসামের রাজ্য ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি হচ্ছে, বাদপড়া সকলেই প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের নাগরিক। তারা বিভিন্ন সময়ে আসাম তথা ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করে দীর্ঘদিন যাবৎ অবৈধভাবে বসবাস করে আসছে। আর প্রিয়া সাহার সাম্প্রতিক অভিযোগ আর আসামের এনআরসির ফলাফল একই সূত্রে গাঁথা বলেও মনে করা হচ্ছে। যেহেতু প্রিয়া সাহা দাবি করেছেন যে, বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪ কোটির মত সংখ্যালঘু নিখোঁজ রয়েছেন। তাই আসামের এনআরসি থেকে বাদপড়া ১২ লাখ হিন্দুদেরকে নিখোঁজ বাংলাদেশী বলে ভবিষ্যতে দাবি করা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। আসামের পর পশ্চিম বাংলায়ও এনআরসি করার জিকির শুরু হয়েছে ইতোমধ্যেই। যদিও রাজ্য সরকার বিষয়টির ঘোর বিরোধিতা করে প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু থেমে নেই এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের জোর তৎপরতা। পশ্চিম বাংলার বিজেপি সভাপতি দিলিপ ঘোষ তো বলেই দিয়েছে, সেখানে এনআরসি হলে বাদ যাবে ২ কোটি মানুষ। আর এর মধ্যে পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক দেড় কোটি হিন্দু থাকা তো অস্বাভাবিক নয়। তালিকা প্রস্তুতের আগেই ২ কোটি সংখ্যা উল্লেখ করায় এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট। যা সুস্পষ্ট ষড়যন্ত্র বলেই মনে করা হচ্ছে। আসাম ও পশ্চিম বাংলা বাদেও সারা ভারতেই কথিত এনআরসি করার দাবি তুলেছে ভারতের বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা মাফিকই গোটা ভারতেই এনআরসি করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আর প্রিয়া সাহাদের মাধ্যমেই তার যৌক্তিকতা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ, ভারতজুড়ে এনআরসি করা হলে দেখা যাবে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাবেক নেত্রী প্রিয়া সাহার বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটানো হবে পরিকল্পিতভাবেই। আসামে প্রায় ১২ লাখ হিন্দু এনআরসিতে তালিকাভুক্ত হতে ব্যর্থ হওয়ার পর ভারতীয় মহলবিশেষে দাবি করা হচ্ছে যে, এরা বাংলাদেশ থেকে নিখোঁজ হওয়া হিন্দু নাগরিক। আর আসাম-ত্রিপুরা রাজ্য সংলগ্ন বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলকে তাদের পুনর্বাসনের দাবি তোলা হচ্ছে। এতে প্রমাণ হয় আসাম সহ ভারতজুড়ে এনআরসি একদিকে সেদেশ থেকে মুসলিম বিতাড়নের ষড়যন্ত্র এবং একই সাথে প্রিয়া সাহাদের আষাঢ়ে গল্পের যথার্থতা প্রমাণ করা। কিন্তু বিষয়টি যত সহজ সহজ মনে করা হয়েছিল ততটা হয়নি বরং আসামে নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর তা স্থানীয় ক্ষমতাসীন ও অতি উৎসাহীদের মধ্যে ‘হরষ-বিষাদ’ই লক্ষ্য করা গেছে। যদিও স্থানীয়রা ষড়যন্ত্রের গভীরতাকে মোটেই উপলব্ধি করতে পারছেন না। ফলে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রলাপ বকতে শুরু করেছেন। বিজেপি এমপি রাজদ্বীপ রায় বলেছেন, ‘এ নিয়ে উদ্বেগ আমাদের আগেও ছিল, এখন সেটাই প্রতীয়মান হচ্ছে। হিন্দুদের এই তালিকায় মাত্রাতিরিক্তভাবে টার্গেট করা হয়েছে।’ স্থানীয় বিজেপির মুখপাত্র রূপম গোস্বামী এ ব্যাপারে তার অসন্তোষ গোপন করেননি বরং তার বক্তব্যের মাধ্যমে এনআরসির রহস্যই উন্মোচিত হয়েছে। তার দাবি, আসামে ১৯৭৯-১৯৮৫ সাল পর্যন্ত যে বিদেশী-বিরোধী আন্দোলন হয়েছে, তা ছিল মূলত মুসলমানদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এনআরসি দৃশ্যত সেই আন্দোলনের চেতনা অনুযায়ী হয়নি। দেখা যাচ্ছে, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে বাদ পড়ার হার সবচেয়ে কম। সীমান্তবর্তী অঞ্চলেও একই অবস্থা। রাজ্য বিজেপি প্রধান সেবার বলেই ফেলেছেন, এনআরসি হলেও নাগরিকত্ব সংশোধন বিল তো আসবেই। তখন হিন্দু, বৌদ্ধ ও শিখদের নাম চলে আসবে। প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় বিজেপির বহুল প্রতিশ্রুত ও সমালোচিত ওই বিলে মুসলিম নয়, এমন নথিবিহীন শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে। ফলে ওই আইন পাস হলে, এনআরসিতে নাম না আসলেও, অমুসলিম শরণার্থীরা সুরক্ষিত থাকবেন। আর এতেই আসামসহ সারা ভারতে এনআরসি রহস্য রীতিমত স্পষ্ট। মূলত, প্রথম খসড়ার মতো এবারও যে চূড়ান্ত তালিকায় হিন্দুরা বেশি বাদ পড়েছেন এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই বিজেপির। আসামের বিজেপি দলীয় মন্ত্রী হিমান্ত বিশ্ব শর্মা তো বলেই দিয়েছেন, এই এনআরসি দিয়ে বিদেশী তাড়ানো যাবে না। তিনি এনডিটিভিকে বলেছেন, ‘এই চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর বর্তমান এনআরসির ওপর আমরা আস্থা পুরোপুরি হারিয়েছি। প্রচুর প্রকৃত ভারতীয় এই তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন।’ মন্ত্রী আরও দাবি করেন, দক্ষিণ সালমারা ও ধুবরির মতো বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে বাদ পড়ার হার সর্বনিম্ন। অপরদিকে ভূমিপত্র জেলায় অনেক বেশি। তিনি বলেন, ‘এই এনআরসি নিয়ে আমাদের আর কোনো আগ্রহই নেই। এনআরসি বাংলাদেশীদের বের করার কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল বা ফাইনাল নয়। কিছুটা অপেক্ষা করুন। বিজেপি শাসনের অধীনে আপনি আরও অনেক ফাইনাল দেখবেন।’ শুধু বিজেপিই নয়। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস ও অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই ইত্তেহাদুল মুসলিমিন-এর প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসিও এই এনআরসির সমালোচনা করেছেন। কংগ্রেস দলীয় সাবেক রাজ্য মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ বিজেপিকে এজন্য দায়ী করেছেন। তার বক্তব্য হলো, ‘অনেক প্রকৃত ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুরা এই নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়েছেন। অথচ, অনেক বিদেশীরা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। বিজেপিকে ব্যাখ্যা দিতে হবে কোথায় ভুলটা হয়েছে।’ অপরদিকে তৃণমূল কংগ্রেস বলছে, আসাম থেকে বাঙালি তাড়াতেই কেন্দ্রের পরিকল্পনামাফিক এই তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। জ্যেষ্ঠ এক তৃণমূল কংগ্রেস নেতা বলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাদ পড়া ১৯ লাখ মানুষকে নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। আসাদউদ্দিন ওয়াইসির বক্তব্য হচ্ছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, ৫০ লাখ অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে। কিন্তু এনআরসি বলছে ১৯ লাখ। তো অমিত শাহ মিথ্যা বলছেন? নাকি এনআরসি সত্যি? ওআইসি বলে, সঠিকভাবে আপিল আমলে নেয়া হলে, এই সংখ্যা আরও কমে আসবে। এনআরসির কথিত চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর আপাতত আসাম রাজ্যকে বেশ শান্তই মনে হচ্ছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি নেই। প্রায় সব রাজনৈতিক মত ও পথের মানুষ জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের (এনআরসি) বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। গুয়াহাটির রাজনৈতিক মহল এবং সুশীলসমাজে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। ডান-বাম নির্বিশেষে ক্রমেই এনআরসি বিরোধিতার সামাজিক পরিসর বাড়ছে। কেউ কেউ এনআরসির কপিতে আগুনও লাগাচ্ছে। যদিও যে যার অবস্থান থেকে এই বিরোধিতায় নেমেছেন এবং একে অপরকে দোষ দিচ্ছেন; কিন্তু এই প্রথম এনআরসিতে অসন্তুষ্ট দেখা যাচ্ছে অসমিয়া রাজনীতিবিদদেরও। তাদের দাবি, এই প্রক্রিয়ায় আরও বেশি মানুষের ‘রাষ্ট্রবিহীন’ হওয়া উচিত ছিল। অসমিয়া রাজনীতিবিদেরা এত দিন ন্যূনপক্ষে প্রায় অর্ধকোটি আসামবাসীকে ‘অবৈধ’ বললেও চূড়ান্ত এনআরসির পর নিজ জাতিসত্তার মানুষদের মধ্যে তাদের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই রাজনীতিবিদদের দীর্ঘ চার দশকের রাজনৈতিক পুঁজি ছিল অবৈধ নাগরিকত্বের বিষয়টি। এই বিষয়কে সামনে রেখেই বিজেপির সঙ্গে তাদের মৈত্রী গড়ে উঠেছিল। সেই মৈত্রী এখন বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেয়েছে। অনেকেই বলছেন, এনআরসি অসমিয়াদের রাজনৈতিক পুঁজি ছিনতাই করে নিয়েছে। যা ক্ষমতাসীনদের জন্য হিতে বিপরীত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি নিয়ে খোদ বিজেপিতেই নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। হিমন্ত বিশ্বশর্মাসহ বিজেপির প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ উত্তেজক বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন এনআরসির বিপক্ষে। এর কারণ স্পষ্ট। অনেক হিন্দু বাদ পড়ে গেছে চূড়ান্ত তালিকায়, যারা বিজেপির ভোটব্যাংক হিসেবে কাজ করেছে গত দুই নির্বাচনে। হিন্দুধর্মাবলম্বী বাদ পড়া ব্যক্তিদের মধ্যে তফসিলি সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বিধানসভার একজন শিডিউল কাস্ট এমএলএ সপরিবারে এনআরসি থেকে বাদ পড়ায় বিজেপির নেতাদের বিরুদ্ধে সামাজিক পরিসরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। আসামে, বিশেষ করে বরাক উপত্যকায় বিজেপির উত্থানে হিন্দু বাঙালিরা এতদিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এলেও এনআরসির চূড়ান্ত তালিকাকে তারা প্রশাসনিক বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখছে। কংগ্রেস শাসনামলে মন্ত্রিসভায় হিন্দু বাঙালির সংখ্যা থাকত তিন থেকে চারজন। বিজেপির ভোটব্যাংক হওয়ার পর সেই হিস্যাও একজনে ঠেকেছে। এ রকম দুঃখগুলো হঠাৎ বেশি বেশি আলোচনায় আসছে শিলচরে।মুসলমানরা আগেই এনআরসি প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে এবং তারা মনে করছেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকার পরও চূড়ান্ত তালিকায় তাদের কয়েক লাখ মানুষকে বাদ দেওয়া হয়েছে শুধু অসমিয়াদের খুশি রাখার জন্য। এ রকম সংখ্যালঘু বাদ পড়া ব্যক্তিরা সামাজিক পরিসরে এনআরসি-বহির্ভূত বলে দৈনন্দিন রুটি-রুজির সংগ্রামে অধিক বিপন্ন হয়ে পড়বেন বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। গুয়াহাটিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু শ্রমিকদের মধ্যে ভীতির মনোভাব আগের চেয়েও বেড়েছে। এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা গুরুতর ত্রুটিপূর্ণ-এমন অভিযোগ এখন সর্বমহলে। মানবাধিকারকর্মীরা শত শত দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন, যেখানে মা-বাবাকে নাগরিক ঘোষণা করে তাদের কিশোর-কিশোরী সন্তানদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে কোনো কারণ ছাড়াই। বাদ পড়া ১৯ লাখের মধ্যে বিরাটসংখ্যকই বৃদ্ধাকে পাওয়া যাচ্ছে, যাদের বিয়ে হয়েছিল ‘বাবার বাড়ি’ থেকে বহু দূরে এবং মা-বাবার পরিচয়সূত্রের পক্ষে যথেষ্ট প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড় করে পেশ করতে পারেননি তারা। পশ্চিম বাংলার প্রচারমাধ্যমে ইতোমধ্যে এ রকম অনেক অভিযোগ উঠে এসেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, এই রাজ্য থেকে যেসব নারীর আসামে বিয়ে হয়েছিল, তাদের অনেকেই এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত হতে ব্যর্থ হয়েছেন। আবহমানকাল থেকে কোচবিহারের অনেকের বিয়ে হচ্ছে পার্শ্ববর্তী আসামের ধুবড়িতে। আসাম-পশ্চিম বাংলা সীমান্তে অন্যত্রও এ রকম বিয়ের নজির বিপুল। এরূপ অনেক পরিবারেই কেউ কেউ নাগরিকত্বের স্বীকৃতি পেয়েছেন, কেউ কেউ পাননি। ধারণা করা হচ্ছে, চূড়ান্ত এনআরসিতে বাদ পড়া এ রকম বহু মানুষ প্রাথমিকভাবে পশ্চিমবঙ্গে স্থানান্তর হতে পারেন। সামগ্রিক অবস্থায় আসামের পাশাপাশি নয়াদিল্লিতে নীতিনির্ধারকেরা বুঝতে পারছেন, এমন এক কার্যক্রম তারা শুরু করেছিলেন, যার কোনো যৌক্তিক উপসংহার দেয়া যাচ্ছে না। চূড়ান্ত এনআরসির পরও আসামে বিদেশি-প্রশ্ন তীব্রভাবে থেকেই যাচ্ছে। পুরো ব্যাপারে রাজনীতিবিদদের ভয়াবহ এক ব্যর্থতা ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। আসামে অসমিয়া-বাঙালি-ট্রাইবাল নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ রাজনীতিবিদদের ওপর নিজ নিজ পরিসরে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। আপাতত শান্ত হলেও যেকোনো সময় এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। গুয়াহাটিতে রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা এও বলছেন, আসামে সামাজিক বিবাদের ব্যাপকতা কমিয়ে আনার পরিবর্তে এনআরসি তা আরও বাড়াল, শিগগির যার বিধ্বংসী রূপ টের পাওয়া যাবে। কেউ কারও কথায় বিশ্বাস রাখতে পারছে না এ মুহূর্তে। আসামে প্রধান রাজনীতিবিদেরা সবাই জনগণের কাছে অনেকখানি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছেন। এ ঘটনায় রাজনীতিবিদদের বিদেশেও বিপজ্জনক এক জবাবদিহির মুখোমুখি দাঁড়াতে হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডি সম্প্রতি জেনেভা থেকে এক বিবৃতিতে বলেছেন, ভারতকে এটা নিশ্চিত করতে হবে, আসামে একজন ব্যক্তিও রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়বেন না এবং তাদের পুরো প্রক্রিয়ায় তথ্যগত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আসামে এনআরসি থেকে বাদ পড়া কেউই এখনো নিশ্চিত নন, ঠিক কী কী কারণে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। এনআরসি কার্যক্রমের পুরোটা একান্তই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণহীন এক আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এগিয়েছে। এই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন আদালতের কঠোর নির্দেশনাগুলোকে। এনআরসি নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং আসামের নীতিনির্ধারকেরা ধারণাগত সংকটে পড়েছেন। এ বিষয়ে তাদের অবস্থান ও বক্তব্যেও স্ববিরোধিতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আইনগতভাবে চূড়ান্ত এনআরসি থেকে বাদ পড়ার মানে দাঁড়ায় জাতীয়তাহীন হয়ে পড়া রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়া। বিজেপির সর্বোচ্চ স্তরের নেতৃবৃন্দ গত ছয় থেকে সাত বছরে বহুদিন বহুবার বহু জনসভায় বলেছেন, এনআরসি থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের ‘বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে’। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, এনআরসি থেকে বাদ পড়া মানেই ‘রাষ্ট্রবিহীন’ বা ‘বিদেশি’ হয়ে পড়া নয়। ভারতের খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফরে বলে গেছেন, এনআরসি ভারতের নিজস্ব বিষয়। যদিও হিমন্ত বিশ্বশর্মার মতো আসামের কয়েকজন রাজনীতিবিদ নিজেদের এত দিনকার বক্তব্যের নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে যাওয়ায় এখনো বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য দিয়ে মিডিয়া মাতিয়ে রাখতে চাইছেন। কিন্তু আসাম থেকে কাউকে বাংলাদেশে পাঠানোর বিষয়টি আপাতত নয়াদিল্লিতে শোনা যাচ্ছে না। বরং বলা হচ্ছে, এনআরসি থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের আইনগত সহায়তা দেওয়া হবে এবং এখনই কাউকে ডিটেনশন সেন্টারে নেয়া হবে না। ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতৃবৃন্দ স্বীকার করছেন, এনআরসি একটা ত্রুটিপূর্ণ প্রকল্প; কেবল কারিগরি দিক থেকে না, ধারণাগত দিক থেকেও। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডির সাম্প্রতিক বিবৃতির পরই ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, এনআরসি থেকে বাদ পড়া মানেই ‘রাষ্ট্রবিহীন’ হয়ে পড়া নয়। ‘বিদেশি’ হিসেবে শনাক্ত হওয়াও নয়। বরং এ রকম বাসিন্দারা সব ধরনের আইনগত সুবিধা ভোগ করতে থাকবেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বিবৃতি আইনগতভাবে সঠিক হলেও সর্বোচ্চ নেতৃত্বের এত দিনকার রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতির একেবারেই বিপরীত। অবৈধ অভিবাসীদের ওই নেতৃবৃন্দ এত দিন ‘তেলাপোকা’র সঙ্গে তুলনা করে দেশে-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের (এনআরসি) প্রয়োগ করতে চাই। এই রাজ্যে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতেই এই এনআরসির প্রয়োজন। তবে এনআরসিতে নাম না ওঠা কোনো অনুপ্রবেশ এই রাজ্য থেকে ফেরত পাঠানো হবে না। তিনি বলেছেন, ‘আমরা বরাবর বলে আসছি, এই রাজ্যে এক কোটি অনুপ্রবেশকারী আছেন। বাংলাদেশ থেকে তারা এই রাজ্যে ঢুকে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বাস করছেন। এই রাজ্যে এনআরসি তৈরি হলে চিহ্নিত করা যাবে কত অনুপ্রবেশকারী এখানে রয়েছে।’ বিজেপির এই নেতা বলেন, এই রাজ্যে বহু অনুপ্রবেশকারী এসেছেন বাংলাদেশ থেকে। তবে তিনি এ কথাও বলেছেন, ‘২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিষ্টান, পার্সি ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কারণে অন্য দেশ থেকে এখানে এসেছেন, তাদের তাড়ানো যাবে না। এখানে তিব্বতিরা এসে থাকছেন, পার্সিরা এসেছেন। বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের জায়গা দিতে হবে।’ তিনি পাশাপাশি একথাও বলেছেন, এনআরসিতে নাম না থাকলেও তাদের তাড়ানো হবে না এই রাজ্য থেকে। শুধু তাদের ভোটাধিকারসহ অন্যান্য সরকারি সুবিধা মিলবে না। তার ভাষায়, ‘পশ্চিমবঙ্গের ১০০টি বিধানসভা আসনে মুসলিম ভোটের প্রভাব রয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানদের প্রভাব রয়েছে। ফলে এসব সংখ্যালঘুদের এড়িয়ে ভোটে জেতা সম্ভব নয়।’ আর এখানেই এনআরসির মাজেজা খুবই পরিষ্কার। এনআরসি থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের আসামে বা ভারতেই যদি সব ধরনের আইনগত সুবিধা দিয়ে নির্বিঘ্নে থাকতে দেওয়া হয়, তাহলে এত রক্তপাতের মাধ্যমে এত ব্যয়বহুল প্রকল্প কেন নেওয়া হলো, সেটাও বিরাট প্রশ্ন আকারে হাজির হয়েছে আসামের রাজনীতিতে। মূলত আসাম থেকে মুসলিম বিতাড়নের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই আসামে ‘এনআরসি’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে সার্বিক দিক বিবেচনায় আসামের ‘এনআরসি’ কারণ মহুমাত্রিক বলেই মনে হয়। যদিও ভারতের পক্ষে অতীতে বলা হয়েছিল এনআরসিতে বাদ পড়া কাউকে বিতাড়িত করা হবে না। কিন্তু হালে সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, ‘বাদপড়াদের যে বিতাড়িত করা হবে না এমন নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না’। ফলে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তারা এখন বাদপড়া শুধু মুসলমান বিতাড়ন নয় বরং হিন্দুদের জন্য সিলেট অঞ্চলে নির্দিষ্ট ভূমিও দাবি করেছে। তার আগে মুসলমানদেরকে তালিকাভুক্তিতে ব্যর্থতার অজুহাতে সেদেশের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে। মূলত ভারত সরকার প্রিয়া সাহাদের মত বিভীষণদের মাঠে নামিয়ে বহুমাত্রিক ফায়দা হাসিল করতে চায়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকার অনেকটাই লেজেগোবরে অবস্থায় পড়েছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কারণ, প্রিয়া সাহারা তাদের মিশনে পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। আর ভারতের ‘এনআরসি’ প্রকল্প অনেকটাই সুপারফ্লপ। তাই বিষয়টি শেষ পর্যন্ত দেশটির জন্য বুমেরাং ও আত্মঘাতীই হতে পারে। শুধুই সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
লেখক : কলামিস্ট ও কথাসাহিত্যিক
আপনার মন্তব্য লিখুন