গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর বিশ্ব এক নতুন সঙ্কটের মুখোমুখি। খোলা চোখে যুদ্ধটা পরাশক্তি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনর আর অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভেলোরেমির জেলেনস্কির মধ্যে মনে হলেও। আসলে তা নয়। বিশ্ববাসী ঠিকই বুঝতে পারছে মূল যুদ্ধটা চলছে দুই পরাশক্তি আমেরিকা আর রাশিয়ার মধ্যে। পারমাণবিক বোমার অধিকারী দুই পরাশক্তির মধ্যে এই যুদ্ধ শুধু আমেরিকা আর ইউরোপ কাঁপাচ্ছে না, গোটা বিশ্বকে ফেলেছে হুমকিতে। যুদ্ধের প্রভাব মুক্ত নয়, আমাদের ছোট এই শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশও।
রাশিয়া সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে শুধু পারমাণবিক বোমা নয়, স্বৈরাচারী একনায়ক ভøাদিমির পুতিনের মতো একজন মানবতাবিরোধী শাসকও পেয়েছে। যার ঠাণ্ডা মাথার নিষ্ঠুরতায় গোটা বিশ্ব আজ আতঙ্কিত। ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে রাশিয়ার সৈনিকদের পরিকল্পিত গোলাবর্ষণের ঘটনায় ইউরোপে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
পুতিনের যোগ্য শিষ্য রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ইতোমধ্যে মস্কোতে সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেছেন, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে পারমাণবিক।’ অনলাইন বিবিসি সূত্রে প্রকাশ, প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, ‘রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার একমাত্র বিকল্প হলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।’ এর জবাবে ল্যাভরভ বলেছেন, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে শুধু পারমাণবিক যুদ্ধ। এ বিষয়টি আছে শুধুমাত্র পশ্চিমা রাজনীতিকদের মাথায়। রাশিয়ার মানুষের মাথায় এ চিন্তা নেই। যদি আমাদের বিরুদ্ধে প্রকৃতপক্ষেই যুদ্ধ হয়, তাহলে যারা এই পরিকল্পনা করছেন, আমার মতে আমাদের বিরুদ্ধে এমন পরিকল্পনা করছেন তারা।’ সের্গেই ল্যাভরভ যুক্তরাষ্ট্রকে অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘তারাও ইউরোপকে পরাধীন করছে। ইউক্রেনে বর্তমান সরকার একটি নাৎসিপন্থী শাসকগোষ্ঠী। গ্যাংগুলো মারিউপোলসহ বিভিন্ন শহরে লুটপাট করছে। ইউক্রেনিয়ানরা এখন বেসামরিক জনগণকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার নিরাপত্তার বিনিময়ে পশ্চিমারা ন্যাটোকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছে।’
এক সময়ের দুর্দান্ত প্রতাপশালী বিশ্বপরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছয়টি মতান্তরে সাতটি অঞ্চল স্বাধীনতার দাবি করলেও রাশিয়ার আগ্রাসনের কাছে শেষ পর্যন্ত তারা নত হতে বাধ্য হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পদ এবং শক্তিও ১৫ ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি স্বাধীন রাষ্ট্র বিশ্ব মাতব্বরি দাবি না করলেও রাশিয়া তা মানতে রাজি নয়। গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানবাধিকার, জনগণের ভোটাধিকার ও সুশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন একনায়কতান্ত্রিক কায়দায় শুধু রাশিয়া নয় দুনিয়ার অন্যান্য দেশে প্রতিষ্ঠিত একনায়কদের নিয়ে বিশ্ব শাসনের দুঃস্বপ্ন দেখছেন। তার এমন মনোভাবের কারণেই আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা তাকে নব্য হিটলার আখ্যা দিয়েছেন। পারমাণনিক বোমার অধিকারী রাশিয়ার আছে জাতিসংঘের ভেটো পাওয়ার। সোভিয়েত ইউনিয়নের নিষ্ঠুরতম গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি ((KGB, Russian ভাষায় পুরো সংস্থাটির পুরোনাম Komitet Gosudarstvennoy Bezopasnosti, English ভাষায় পুরো সংস্থাটির পুরোনাম Committee for State Security, foreign intelligence and domestic security agency of the Soviet Union.) -এর সাবেক এজেন্ট পুতিনের হাতে এত ক্ষমতা আরেকটি মানবতাবিধ্বংসী বিশ্বযুদ্ধের হুমকিতে ফেলেছে গোটা দুনিয়ার শান্তিপ্রিয় অধিবাসীদের।
রাশিয়া হঠাৎ করেই ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায়নি। এই তদন্তের শিকড় অনেক গভীরে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫ খণ্ড হলেও রাশিয়া মনে করে, সেই সবার অভিভাবক। স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও কর্তৃত্ব ছাড়তে চায় না। রাশিয়া চায় তার কথার মতোই চলবে ইউক্রেনসহ বাকিরা। সঙ্কটের সূচনা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এই দ্বন্দ্ব থেকেই। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে পুতিন ‘ব্রেজনেভ ডকট্রিন’ একটি নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন। ব্রেজনেভ তত্ত্বে বলা হয় যে, পূর্ব ইউরোপের যেসব দেশ ওয়ারশ চুক্তির সদস্য ছিল, সেসব দেশের সার্বভৌমত্ব হবে সীমিত (Limited Sovereignty) এর অর্থ হলো, ওয়ারশ প্যাক্টের যারা সদস্য, তাদের আংশিক সার্বভৌমত্ব ওয়ারশ চুক্তির শর্ত মোতাবেক বিসর্জন দিতে হবে। এই যুক্তিতে রাশিয়া ইউক্রেনের ন্যাটোয় যোগদানের বিরোধিতা করে। কিন্তু ইউক্রেন বলে যে, ১৯৯৪ সালের চুক্তি মোতাবেক তিনটি বৃহৎ শক্তি আমেরিকা, রাশিয়া এবং ইংল্যান্ড তার স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি দিয়েছে। এই কারণে রাশিয়ার বক্তব্য অযৌক্তিক এবং গ্রহণযোগ্য নয়।
কী ছিল ১৯৯৪ সালের চুক্তিতে
সাবেক পারমাণবিক শক্তিধর পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম অঙ্গরাজ্য ইউক্রেন যখন স্বাধীনতা লাভ করে সেই সময় কয়েকটি পারমাণবিক বোমার মালিকানা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিল ইউক্রেন। রাশিয়া এ বোমাগুলো দাবি করলে ইউক্রেন তার সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি চায়। তখন ১৯৯৪ সালে আমেরিকা, রাশিয়া, ইংল্যান্ড এবং ইউক্রেনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তিতে ইউক্রেনকে আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও রাশিয়া স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার গ্যারান্টি দেয়। বিনিময়ে ইউক্রেন পারমাণবিক বোমাগুলো রাশিয়ার হাতে তুলে দেয়। এখন প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর কেন রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে।
কেন এই আগ্রাসন এবং পরিণতি কী
এ ক্ষেত্রে ‘ব্রেজনেভ ডকট্রিন’ ছাড়াও রাশিয়ার আরেকটি দাবি হলো, ইউক্রেন ন্যাটো অথবা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারবে না। ইউক্রেনকে থাকতে হবে রুশ সামরিক জোট কালেক্টিভ সিকিউরিটি ট্রাস্ট অর্গানাইজেশন (সিএসটিও)-এ। রুশ নিয়ন্ত্রিত সামরিক জোট সিএসটিও ছাড়াও তাদের একটি অর্থনৈতিক জোট রয়েছে। এই অর্থনৈতিক জোটের নাম ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (ইইইউ)। সিএসটিওর সদস্য হলো আর্মেনিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান ও কিরগিজস্তান। ইইইউ ঐ চারটি রাষ্ট্র ছাড়াও তুর্কমেনিস্তানও ইইইউর সদস্য। রাশিয়া ইউক্রেনক্রেও এই জোটে চায়। কিন্তু ইউক্রেনের আপত্তি দু’টি কারণে ১. রাশিয়া তার বিশ্বস্ত প্রতিবেশী নয়। তারা ইউক্রেনকে অশান্ত করতে সেদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহযোগিতা করছে। ২০১৪ সালে রাশিয়া সেই বিদ্রোহীদের সমর্থনে প্রথমবার ইউক্রেনে প্রবেশ করে। তখন প্রেসিডেন্ট পুতিন সমর্থিত বিদ্রোহীরা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বেশ বড় একটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর থেকেই তারা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে। যুদ্ধ বন্ধে একটি আন্তর্জাতিক মিনস্ক শান্তি চুক্তি হয়েছিল, কিন্তু লড়াই তাতে থামেনি। বরং বিভিন্ন ছলছুতায় রাশিয়া তথাকথিত শান্তিরক্ষী পাঠানোর নামে ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহযোগিতা করছে। তাই রাশিয়ার মতো বৃহত্তম সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্রের আগ্রাসন থেকে বাঁচতে তাদের ন্যাটো জোট ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়ার বিকল্প নেই। ২. কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও তাজিকিস্তান হলো এশীয় রাষ্ট্র। তাই তারা ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (ইইইউ)। অন্যদিকে ইউরোপীয় রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেন ন্যাটো বা ইইউতে যোগ দেবে এটাই স্বাভাবিক। সবেমাত্র ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলোনস্কি ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের আনুষ্ঠানিক আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন। এখনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। অথচ এর কয়েক বছর আগেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক সদস্য লিথুনিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া ন্যাটো এবং ইইউতে যোগদান করেছে। অথচ রাশিয়া তাদের নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলেনি।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংঘাতের নেপথ্যে মূল কারণ হিসেবে রয়েছে ন্যাটো। ন্যাটোর আওতায় রয়েছে ৩০টি দেশ। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানি। আর এই গোষ্ঠীভুক্ত হওয়ার চেষ্টায় রয়েছে ইউক্রেন। এ ঘটনা নিয়েই মূলত দেশ দুটির মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়। বিভিন্ন ইস্যুতে আগে থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তলানিতে রয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রই রয়েছে ন্যাটোভুক্ত দেশের তালিকায়। এদিকে, ইউক্রেন চাইছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানির মতো দেশগুলোর সঙ্গে তারাও ন্যাটোর আওতায় চলে আসুক। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একই গোষ্ঠীতে প্রতিবেশী ইউক্রেনকে দেখতে চায় না রাশিয়া।
দায়ভার আছে পশ্চিমাবিশ্ব এবং আমেরিকারও
পোল্যান্ডের সীমান্তবর্তী ও ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য লুভিউয়ের ইভান ফ্রাঙ্কো ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইউরি মেলনিক। তিনি মনে করেন, ‘এটা খুব সহজ কথা। ইউক্রেনে যা ঘটছে, তার বেশির ভাগ দায়ভার পশ্চিমা দেশগুলোর। হামলার আগের দিনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, রাশিয়া হামলা করলে তিনি ইউক্রেনকে সমর্থন করবেন কি না। বাইডেন বলেছিলেন, তিনি ব্যাপকভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন, কিন্তু ইউক্রেনে সেনা পাঠাবেন না। এটি ছিল চরম ভুল। তিনি বলতে পারতেন, ‘আমি জানি না... সব বিকল্প পথ খোলা আছে, আমরা পরে সিদ্ধান্ত নেব।’ এটা করে তিনি রুশ আগ্রাসন বন্ধ করতে পারতেন। তিনি বলেছিলেন, আমেরিকানরা অংশ নেবে না। এটা রাশিয়ানদের আক্রমণের জন্য আরও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।’
তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যদি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ইউক্রেনের পতন ঘটতে থাকে তাহলে সেটা শুধু আমার দেশের জন্য নয়, পশ্চিমা বিশ্বের জন্যও বিপর্যয়ের কারণ হবে। যার অর্থ হলো, এই শতাব্দীতে এসেও কেউ তার প্রতিবেশী দেশ আক্রমণ করতে পারে, সেনাবাহিনী ও জনগণকে হত্যা করতে পারে এবং সেটাকে তাদের ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। রাশিয়া যদি এটা করতে পারে, অন্যরা কেন পারবে না? চীন কেন তাইওয়ান আক্রমণ করবে না? এর মাধ্যমে একটি প্যান্ডোরার বাক্স খুলে গেছে এবং রাশিয়া আরও শক্তিশালী হতে চলেছে। তারা আরও অনেক কিছু করবে। এখন তারা মনে করবে, আমরা ইউক্রেনে সফল হয়েছি, এরপর কেন ইউরোপ নয়, বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোতে নয়। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হলে এ হামলা হতো না। এত বছর ধরে আমরা ন্যাটো জোটে থাকার চেষ্টা করেও কেন জোটের অংশ নয়? এর কারণ পশ্চিমা রাজনীতিবিদদের ওপর রাশিয়ার চাপ। ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য হতে না দেওয়ার পেছনে রাশিয়ার স্বার্থ রয়েছে। আজ যদি ইউক্রেনের পতন হয়, তাহলে সেটা সমগ্র পশ্চিমা দেশ এবং এই গ্রহের জন্য অত্যন্ত গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে চলেছে।’
রাশিয়া-ইউক্রেন: কার সামরিক শক্তি কত?
ইউক্রেনে ২৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার ভোর থেকে হামলা শুরু করেছে রাশিয়া। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, রুশ বাহিনীর হামলায় ৪০ জনেরও বেশি ইউক্রেনিয়ান সৈন্য নিহত হয়েছেন। এছাড়া অভিযানের প্রথম ঘণ্টায় ১০ জন বেসামরিক নাগরিকও নিহত হয়েছেন। ইউক্রেনও তার সাধ্যমতো রাশিয়ার হামলার জবাব দিচ্ছে। এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করেছে। প্রতিবেশী দুই দেশের সামরিক সক্ষমতা কেমন, কার চেয়ে কে এগিয়ে- অনেকের মনে এখন এমন প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামরিক শক্তি পর্যবেক্ষণকারী গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, সামরিক শক্তির বিচারে বিশ্বের ১৪০টি দেশের মধ্যে রাশিয়ার অবস্থান দ্বিতীয়। অন্য দিকে, ইউক্রেনের অবস্থান ২২তম। তাই দুই দেশের মধ্যে সৈন্যসংখ্যা, যুদ্ধবিমান, রণতরী বা সামরিক সরঞ্জামেও ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার মোট সৈন্যসংখ্যা আট লাখ ৫০ হাজার, আর ইউক্রেনের সৈন্যসংখ্যা মাত্র দুই লাখ। তবে উভয় দেশের রিজার্ভ সৈন্য রয়েছে আরও আড়াই লাখ করে। এ ছাড়া রাশিয়ার আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যসংখ্যা আড়াই লাখ, এই সংখ্যা ইউক্রেনের মাত্র ৫০ হাজার।
অন্য দিকে, রাশিয়ার মোট সামরিক বিমান রয়েছে ৪ হাজার ১৭৩টি, যেখানে ইউক্রেনের মাত্র ৩১৮টি। পাশাপাশি রাশিয়ার যুদ্ধবিমান ৭৭২টি, ইউক্রেনের এই সংখ্যা মাত্র ৬৯টি। এর মধ্যে শুধুমাত্র আক্রমণকারী বিমান রাশিয়ার রয়েছে ৭৩৯টি, ইউক্রেনের মাত্র ২৯টি। রাশিয়ার সামরিক পরিবহন বিমান ৪৪৫টি হলেও ইউক্রেনের পরিবহন বিমান মাত্র ৩২টি। আবার রাশিয়ার মোট হেলিকপ্টার সংখ্যা ১,৫৪৩টি, যেখানে অ্যাটাক হেলিকপ্টারই ৫৪৪টি। অন্যদিকে ইউক্রেনের মোট হেলিকপ্টার রয়েছে ১১২টি যার মধ্যে অ্যাটাক হেলিকপ্টার ৩৪টি।
গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার বলছে, রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর কাছে এই মুহূর্তে ট্যাংক রয়েছে ১২ হাজার ৪২০টি। অন্যদিকে, ইউক্রেনের ট্যাংকের সংখ্যা দুই হাজার ৫৯৬টি। এছাড়া আর্মড ভেহিকেল রাশিয়ার ৩০,১২২টি, ইউক্রেনের ১২,৩০৩টি, স্বয়ংক্রিয় আর্টিলারি রাশিয়ার আছে ৬,৫৭৪টি, ইউক্রেনের আছে ১,০৬৭টি। রাশিয়ার মোবাইল রকেট প্রজেক্টর রয়েছে ৩,৩৯১টি, ইউক্রেনের আছে ৪৯০টি।
সামরিক নৌযানের দিক থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে রাশিয়া। দেশটির সামরিক নৌযান ৬০৫টি থাকলেও ইউক্রেনের রয়েছে মাত্র ৩৮টি। এর মধ্যে রাশিয়ার একটি বিমানবাহী রণতরী থাকলেও ইউক্রেনের এরকম কোনো রণতরী নেই। একইভাবে রাশিয়ার রয়েছে ৭০টি সাবমেরিন, যেখানে ইউক্রেনের কোনো সাবমেরিন নেই। তাছাড়া রাশিয়ার রয়েছে অত্যাধুনিক ১৫টি ডেস্ট্রয়ার, কিন্তু ইউক্রেনের একটি ডেস্ট্রয়ারও নেই। এছাড়া রাশিয়ার রয়েছে ১১টি ফ্রিগেট, যা একটিও নেই ইউক্রেনের। মাইন ওয়্যারফেয়ার নৌযান ইউক্রেনের কাছে একটা থাকলেও রাশিয়ার রয়েছে ৪৯টি। রাশিয়ার করভেট সংখ্যা ৮৬টি, যেখানে ইউক্রেনের করভেট মাত্র একটি। রাশিয়ার পেট্রোল ভেসেল আছে ৫৯টি, ইউক্রেনের রয়েছে ১৩টি।
রাশিয়ার ১,২১৮টি বিমান বন্দর রয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেনের বিমানবন্দর সংখ্যা মাত্র ১৮৭টি। এর বাইরে রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র। কিন্তু ইউক্রেনের এ রকম কোনো অস্ত্র নেই। একইসঙ্গে রাশিয়ার কাছে এস-৪০০ নামের অত্যন্ত শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনের কাছে এ ধরনের কোনো কিছু নেই। সামরিক খাতে ব্যায়েও রাশিয়া অনেক এগিয়ে রয়েছে। দেশটি প্রতি বছর সামরিক খাতে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ব্যয় করে, সেখানে ইউক্রেন মাত্র এক হাজার ১৮৭ কোটি ডলার ব্যয় করে। গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স-২০২২ অনুযায়ী, বিশ্বে সামরিক সক্ষমতায় শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে রাশিয়া, চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন, পাকিস্তান ও ব্রাজিল।
সারাবিশ্বে প্রভাব পড়তে শুরু : বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি
গোটা বিশ্বজুড়ে যখন কোন যুদ্ধের প্রভাব পড়ে তখনই তাকে বিশ্বযুদ্ধ বলে যোগ্য করা হয়। বিশ্বযুদ্ধ থেকে কোন দেশই মুক্ত থাকতে পারে না। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে বিশ্বের সব দেশ। ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে আটকে পড়া বাংলাদেশি জাহাজের নাবিক হাদিসুর রহমান নিহত হয়েছেন রাশিয়ার গোলার আঘাত। ইউক্রেনে অধ্যয়নরত ভারতের দু’জন ছাত্রও নিহত হয়েছেন।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বদলে গেছে পৃৃথিবীর মানচিত্রও। এই যুদ্ধেও এমন কিছু ঘটার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য লুভিউয়ের ইভান ফ্রাঙ্কো ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইউরি মেলনিক বলেছেন, ‘আমাদের বার্তা হলো বিশ্ব যদি পরিস্থিতিটিকে এমনভাবে দেখে যে, এটি একটি টিভি শো বা গ্ল্যাডিয়েটর শো তাহলে এটা ইউক্রেন এবং বিশ্বের বাকি দেশগুলোর জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনছে।’ ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি শোনার কারণ। সামরিক শক্তিতে বিশ্বের দ্বিতীয় রাশিয়া, আর ইউক্রেনের অবস্থান ২২তম। তাই ২-এর সঙ্গে ২২-এর যুদ্ধ একতরফাই হওয়ার কথা থাকলেও বিষয়টি যে এত সহজেই শেষ হবে না তা বর্তমান পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছে। ইউক্রেনের পাশে আছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা। ইউক্রেন সঙ্কট নিয়ে ইউক্রেনের চেয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দৃশ্যমান উদ্বেগ বেশি। এই যুদ্ধ শুধু ইউক্রেনে সীমাবদ্ধ থাকবে এমন ভাবার কারণ নেই। এখন দেখার বিষয় জাতিসংঘ কী করতে পারে? পুতিনকে চাপে রাখতে পশ্চিমারা নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে।
যুদ্ধের শুরুতেই জ্বালানি তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব পড়বে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে।
বিবিসি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেছেন, ইউক্রেনে স্বল্পপাল্লার অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল পাঠাচ্ছে। প্রয়োজনে ইউক্রেনে ব্রিটিশ সেনা পাঠানোরও কথা জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। বিবিসি আরো বলছে, যুক্তরাজ্য থেকে সমরাস্ত্রের প্রথম চালান গত সোমবার ইউক্রেনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও ঠিক কোন ধরনের সমরাস্ত্র পাঠানো হয়েছে, সেটি জানাননি ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে রাশিয়া বোমা হামলা চালানোর পর প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি একে যুদ্ধাপরাধ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ঐ হামলাটি যে বেসামরিক লোকজনকে লক্ষ্য করে চালানো হয়েছিল তার সাক্ষী রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোও অভিযোগ করছে যে রুশ আগ্রাসনের সময় যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ওই দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এসব অভিযোগ নিয়ে নিজস্ব তদন্ত শুরুর করার কথা বিবেচনা করছে। এই আদালতে প্রধান কৌঁসুলি করিম খান বলছেন, ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটেছে এ কথা মনে করার ‘বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি’ রয়েছে। তিনি জানান, তারা যে তদন্ত চালাবেন তাতে তারা দেখবেন ইউক্রেইনের বর্তমান লড়াই এবং ২০১৪ সালে সে দেশের ওপর প্রথম রুশ আগ্রাসনের সময় ইউক্রেনে কোন যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা।
ইউক্রেনে চার রুশ সেনা অধিনায়ক নিহত
ইউক্রেনের শত্রুপক্ষের খুব কাছাকাছি যাওয়ার পর রাশিয়ার সেনাবাহিনীর অন্তত চারজন অধিনায়ক নিহত হয়েছে বলে পশ্চিমা দেশের কর্মকর্তারা বলছেন। তাদের উদ্ধৃত করে বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা গর্ডন কোরেরা জানাচ্ছেন, রুশ ৩১তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির উপপ্রধান এক স্নাইপারের গুলিতে নিহত হয়েছেন। একজন ডিভিশনাল কমান্ডার এবং রেজিমেন্টাল কমান্ডারও নিহত হন। রুশ বাহিনীর কোন কোন অধিনায়ক সৈন্য নিয়ে রণক্ষেত্রের অনেকখানি সামনে চলে গিয়েছেন। তাদের লক্ষ্য আরও বেশি ইউক্রেনিয়ান এলাকা দখল করা। তারা নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে সম্মুখভাগে চলে যাওয়ার পর অনেকেই বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছেন।
ইউক্রেনে চলমান বিশেষ সামরিক অভিযানে কতজন রুশ সেনা হতাহত হয়েছেন, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো তার হিসাব দেয় দুই দিন যুদ্ধ চলার পর। বিবিসি সূত্রে জানা যায়, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, ইউক্রেন অভিযানে ৪৯৮ রুশ সেনা নিহত হন, আহত হয়েছেন এক হাজার ৫৯৭ জন। ইউক্রেন অভিযানে রুশ সেনাদের হতাহত হওয়ার তথ্য নিয়ে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই ভাষ্য সে দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। এত দিন ইউক্রেন অভিযানে রুশ সেনাদের হতাহত হওয়ার কথা মস্কো স্বীকার করে নিলেও তারা সুনির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা উল্লেখ করেনি। এবারই প্রথম রুশ সেনাদের হতাহত হওয়ার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করল মস্কো।
একই সঙ্গে রাশিয়া দাবি করেছে, চলমান সামরিক অভিযানে ইউক্রেনের দুই হাজার ৮৭০ সেনা নিহত হন, আহত হয়েছেন তিন হাজার ৭০০ সেনা। কিয়েভ অবশ্য তাদের সেনাদের হতাহত হওয়ার বিষয়ে কোনো হিসাব দেয়নি। ইউক্রেনে রুশ সেনাদের হতাহত হওয়ার যে পরিসংখ্যান মস্কো দিয়েছে, তার কিয়েভের হিসাবের চেয়ে কম। কিয়েভের দাবি, তারা পাঁচ হাজার ৮৪০ রুশ সেনাকে হত্যা করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে সেনাদের হতাহত হওয়া নিয়ে মস্কো ও কিয়েভ যে দাবি করেছে, তা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি বিবিসি। যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে, ইউক্রেনে রাশিয়ার বহু সেনা প্রাণ হারিয়েছেন। আগে ইউক্রেনের জরুরি সেবা বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাশিয়ার হামলায় জরুরি সেবা বিভাগের ১০ সদস্য নিহত হন আর বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন দুই হাজারের বেশি। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের কারণে দেশটি থেকে ১০ লাখ মানুষ পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন। তাঁর এই নির্দেশের পরই ইউক্রেনে তিন দিক থেকে হামলা শুরু করে রুশ বাহিনী।
রুশ বাহিনী ইউক্রেনের তিন দিক থেকে হামলা জোরদার করেছে। হামলার সপ্তম দিনে ২ মার্চ বুধবার ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খারকিভ, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মারিওপোল, উত্তরাঞ্চলের চেরনিহিভ শহরে বিমান ও গোলা হামলা বাড়িয়ে দেয় রাশিয়া। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দরনগরী খেরসন দখলে নিয়েছে তারা। দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে রাশিয়ার ছত্রীসেনারা নেমে শহরটি দখল নেয়ার চেষ্টা করছেন।
ইউক্রেন শর্ত মানলে ‘মুহূর্তেই' হামলা বন্ধ করবে রাশিয়া
যুদ্ধ এখনো চলছে। প্রতিরোধসহ নানা কৌশলের মাধ্যমে রুশ সেনাদের অগ্রগতি ধীর করে দিতে সক্ষম হয়েছে ইউক্রেনের বাহিনী। ইউক্রেনের বাহিনীর এই সক্ষমতা পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়াচ্ছে। কিন্তু রুশ সেনাদের অগ্রগতি কিভাবে ধীর করে দিতে সক্ষম হলো ইউক্রেন?
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সমরশক্তির সংখ্যাগত দিক বিবেচনায় নিলে ইউক্রেনের চেয়ে রাশিয়া অনেক বেশি শক্তিশালী। তা সত্ত্বেও যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের বাহিনীর ‘ভালো’ করার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় কাজ করেছে। এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে, ভালো প্রস্তুতি, জাতীয় সংহতি ও রাশিয়ার ভুল। এগুলোর সমন্বিত প্রভাব ইউক্রেনে রাশিয়ার অগ্রগতি কমিয়ে দিয়েছে।
ইউক্রেন শর্তের একটি তালিকা মেনে নিলে এই মুহূর্তেই সেখানে সামরিক অভিযান বন্ধ করে দিতে রাশিয়া প্রস্তুত। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ গত ৭ মার্চ সোমবার একথা বলেছেন। রাশিয়ার শর্ত বা দাবিদাওয়াগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, মস্কো চায় ইউক্রেন সামরিক তৎপরতা বন্ধ করুক, নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য সংবিধান পরিবর্তন করুক, ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে রাশিয়ার ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকার করে নিক এবং দোনেৎস্ক ও লুহান্সক বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিক। ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ চালানোর কথা বলে আগ্রাসন শুরুর ১২তম দিনে এসে রাশিয়া এই প্রথম স্পষ্ট বিবৃতিতে তাদের শর্তগুলো কিয়েভকে জানাল। পেসকভ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ফোনে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ইউক্রেন শর্তগুলো সম্পর্কে জানে। তাদেরকে বলা হয়েছে, এসব শর্ত পূরণ করলে এ মুহূর্তেই রাশিয়ার সামরিক অভিযান বন্ধ হতে পারে। তবে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। রাশিয়া কিয়েভ দখলে নিতে চাইছে সে কথা ‘সত্য নয়’ জানিয়ে পেসকভ বলেন, ‘আমরা আসলেই ইউক্রেনকে নিরস্ত্র করছি। আমরা এটা করে ছাড়ব। তবে মূল বিষয়টি হচ্ছে, ইউক্রেন সামরিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করুক। তাদের উচিত সেনাবাহিনীর তৎপরতা বন্ধ করা। তখন আর কেউ গুলি ছুড়বে না।’ ওদিকে, নিরপেক্ষতার প্রশ্নে পেসকভ বলেন, ইউক্রেন ন্যাটো বা অন্য কেনো জোটে যোগ দিতে পারবে না, এবং সেজন্য তাদেরকে দেশের সংবিধান সংশোধন করতে হবে। দুই দেশের প্রতিনিধিরা যুদ্ধ বিরতির লক্ষ্যে গত ৭ মার্চ সোমবার বেলারুশে তৃতীয়বারের মতো বৈঠক করার দিনেই রাশিয়ার এসব দাবি নতুন করে তুলে ধরলেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র।
রাশিয়ার চারজন সেনাধিনায়ক নিহত হওয়ার পর এক কথা স্বীকার করতেই হবে, তারা যে সামরিক শক্তির বড়াই করছিল তাতে কিছুটা হলেও ধাক্কা লেগেছে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে রুশ হামলায় আগুন ধরার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। কেন্দ্রটির ক্ষয়ক্ষতি-সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য এখনো সামনে আসেনি। তবে কেন্দ্রটির বিকিরণের মাত্রা এখনো স্বাভাবিক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ে ইউক্রেন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। একই সঙ্গে সংস্থাটি তার ইমার্জেন্সি সেন্টারকে যেকোনো মুহূর্তে সাড়া দেওয়ার অবস্থায় রেখেছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে পরমাণু সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগ তুলেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেছেন, রাশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে। রাশিয়া ১৯৮৬ সালের চেরনোবিল বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি চায় বলে অভিযোগ করেন তিনি।
জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের বেপরোয়া পদক্ষেপ এখন পুরো ইউরোপের নিরাপত্তাকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র তার ‘নিউক্লিয়ার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম’ সক্রিয় করেছে। তারা জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে সৌদি আরব। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে পৃথক ফোনালাপে এ প্রস্তাব দেন সৌদির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
জাতিসংঘে ভোট এবং রাশিয়ার শত্রু দেশের তালিকা প্রকাশ
গত ২ মার্চ ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের নিন্দা জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করেছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ। প্রস্তাবে রাশিয়াকে অবিলম্বে ইউক্রেন থেকে সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে ১৪১টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। বিপক্ষে মাত্র পাঁচটি ভোট পড়ে। ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। ভোট না দেয়া দেশগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইরান, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ব্রাজিল, আলজেরিয়া, বলিভিয়া, চীন, কিউবা, ইরাক ও কাজাখস্তানসহ ৩৫ দেশ। যে দেশগুলো প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে তারা হলো, রাশিয়া. বেলারুশ, সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং ইরিত্রিয়া। এই প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটি হওয়ার আগে প্রস্তাবক দেশগুলির পক্ষে আশা করা হয়েছিল, প্রস্তাবের পক্ষে একশটি ভোট পড়বে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৪১টি দেশ প্রস্তাব সমর্থন করায় তারাও কিছুটা অবাক হয়েছে। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেয়ারবক বলেছেন, ‘এটি ঐতিহাসিক ফলাফল। এই ফল থেকে স্পষ্ট, যখন শান্তির উপর আঘাত আসে, তখন সকলে একসঙ্গে দাঁড়ায়।’
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে নেয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, রাশিয়া যেন অবিলম্বে ইউক্রেনে হামলা বন্ধ করে এবং সেনা ফিরিয়ে নেয়। তারা বেআইনিভাবে হুমকি দিচ্ছে এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে শক্তিপ্রয়োগ করছে।
প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের ফলে পশ্চিমা দেশ ও তার মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে সেগুলোর জবাবে পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে রাশিয়া। যেসব দেশ ও অঞ্চল রাশিয়ার প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, সেসবের একটি তালিকা তৈরি করেছে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই তালিকায় থাকা দেশ ও অঞ্চলসমূহ হলো- সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, আলবেনিয়া, অ্যান্ডোরা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্সি, অ্যাঙ্গুইলা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, জিব্রাল্টার, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮ দেশ, আইসল্যান্ড, কানাডা, লিচটেনস্টেইন, মাইক্রোনেশিয়া, মোনাকো, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, স্যান মারিনো, উত্তর মেসিডোনিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, ইউক্রেন, মন্টিনিগ্রো ও জাপান। রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিন থেকে জারি করা ডিক্রি অনুযায়ী, বন্ধুত্বপূর্ণ নয়- তালিকায় থাকা দেশ ও অঞ্চলসমূহের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে এখন থেকে রুশ মুদ্রা রুবল ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়া, এই দেশ ও অঞ্চলসমূহের কোনো কোম্পানির সঙ্গে যদি রুশ কোনো কোম্পানি বাণিজ্যিক চুক্তি করতে চায়, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রুশ কোম্পানিকে অবশ্যই সরকারের অনুমোদন নিতে হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে ডিক্রিতে।
বাংলাদেশে যুদ্ধের প্রভাব
ইউক্রেনের ওলভিয়া সমুদ্রবন্দরে হামলার শিকার ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজের নিহত থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান গোলার আঘাতে নিহত হয়েছেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ সঙ্কটে এই যুদ্ধে বাংলাদেশে শুধু এতটুকু প্রভাবই পড়েনি। দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব আরো অনেক এবং দীর্ঘমেয়াদি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
জার্মান বার্তা সংস্থা ডিডব্লিউ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক দুই দিকে থেকেই সমস্যায় পড়েছে। রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য তুলনামূলকভাবে অনেক কম। ইউক্রেনের সাথে আরো কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ৪৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির বিপরীতে রফতানি করেছে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের পণ্য। বাংলাদেশের মোট রফতানির প্রায় ৯৫ শতাংশই হলো তৈরি পোশাক ও বস্ত্রসামগ্রী আর রাশিয়া থেকে আমদানির ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে সবজি ও তেল। একই সময়ে ইউক্রেন থেকে ৫১ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানির বিপরীতে দেশটিতে রফতানি করা হয়েছে ৩১ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের পণ্য। আমদানির বেশিরভাই হলো সবজি। তবে যুদ্ধের কারণে দুই দেশের সঙ্গে মোট ১৮০ কোটি ডলারের পণ্য বাণিজ্যের পুরোটাই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। এমনিতেই যুদ্ধকালীন সময় বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়, বাণিজ্য ব্যয়বহুল হয়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তাতে করে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি ফজলুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘যে চালানগুলো রাশিয়া অভিমুখে রয়েছে, সেগুলো ঠিকঠাকমতো পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হতে পারে, এমনকি বাধাগ্রস্তও হতে পারে। তবে পণ্য রফতানির বিপরীতে প্রাপ্য মূল্য পেতে আরো বেশি সমস্যা হতে পারে। আর নতুন করে রফতানির কার্যাদেশ কমে যাওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। সব মিলিয়ে রাশিয়ায় ৬০ কোটি ডলারের বেশি বার্ষিক রফতানি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।’’
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান মনে করেন, ইউক্রেন সংকট থেকে প্রাথমিকভাবে আঘাতটা আসবে খাদ্যপণ্য, বিশেষত গম এবং জ্বালানি তেলে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ববাজারে গমের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জোগান দেয় রাশিয়া ও ইউক্রেন। চলমান সংঘাতের সাথে রাশিয়ার ওপর আরোপিত পশ্চিমাদের বিধিনিষেধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের ও তেলের সরবরাহ কমে যাবে, বাড়বে দাম। তখন বাংলাদেশকেও বেশি দামে এগুলো কিনতে হবে, যা দেশের ভেতর মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে।’’
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) গত বছর নভেম্বর মাসে দেশের ভেতর জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে উচ্চ হারে, যা অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতিকে ঊর্ধ্বমুখী করেছে পরের মাসেই। এখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দর ব্যারেল প্রতি ১১০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। দাম যদি নেমে না আসে, তাহলে বিপিসি শিগগিরই আবার দাম বাড়াবে কিনা তা আপাতত নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু বাড়ালে মূল্যস্ফীতিও আরেক দফা বেড়ে যাবে, যা মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা আরো কমিয়ে দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে যে, চলতি অর্থবছর গড় মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। পাঁচ দশমিক ৩০ শতাংশের মধ্যে।” মূল্যস্ফীতির হার আটকে রাখা কঠিন হবে বলেও মন্তব্য করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ তো গেলো অর্থনৈতিক দিক ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকেও বিপদে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার নিন্দায় ভোট দানে বিরত থাকায় বাংলাদেশকে করোনার টিকা দেবে না লিথুয়ানিয়া। লিথুয়ানিয়ান ন্যাশনাল রেডিও অ্যান্ড টেলিভিশন দেশটির প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র রাসা জাকিলাইটিয়েনের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ তাদের মিত্রদের কাছ থেকে এমন আরো নেতিবাচক সিদ্ধান্ত আসার আশংকা করছেন বিশ্লেষকরা।
রাশিয়ার আগ্রাসনের শিকার সাতটি মুসলিম প্রধান প্রজাতন্ত্র
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে এই অঞ্চলের সাতটি কারো কারো মতে ছয়টি মুসলিম দেশ স্বাধীনতার দাবি করেছিল। কিন্তু রুশ আগ্রাসনের কারণে তারা তাদের স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনি। যেমন: চেচনিয়া, ইঙ্গোশেটিয়া, দাগেস্তান, কারচে-চের্কেসিয়া, বাশকোরতুস্তান ও তাতারস্তান। চেচনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছে রাশিয়ার অধীনতা নেমে নিতে।
পিউ রিসার্চের মতে, বর্তমানে রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার ১১.৪ শতাংশ মুসলিম। ২০১৭ সালের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাশিয়ায় মুসলিমদের সংখ্যা ১০ লাখ ২২ হাজার। তবে রুশ মুসলিমরা মনে করে, রাশিয়ায় মুসলমানের প্রকৃত সংখ্যা ২৫ লাখেরও বেশি। দীর্ঘ রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পরও বর্তমানে রাশিয়ার সাতটি অঞ্চলে মুসলিমরা তাদের সংখ্যাধিক্য ধরে রেখেছে। যার বেশির ভাগ রুশ ফেডারেশনের অধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র। নি¤েœ সে অঞ্চলগুলোর পরিচিতি তুলে ধরা হলো:
১. ইঙ্গোশেটিয়া : ইঙ্গোশেটিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক নাম ‘ইঙ্গোশেটিয়া প্রজাতন্ত্র’। এটি রাশিয়ার একটি স্বায়ত্তশাসিত কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক অঞ্চল। তিন হাজার ছয় শ’ ২৮ বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট ইঙ্গোশেটিয়ার ৯৬ শতাংশ অধিবাসী মুসলিম। মাগাস তার রাজধানী। ইঙ্গোশ মুসলিম শাফেয়ি মাজহাব ও সুন্নি মতবাদের অনুসারী। বেশির ভাগ মানুষ ইঙ্গোশ ভাষা ব্যবহার করে। উনিশ শতকে এটি রুশ সাম্রাজ্যের অধীন হয়। ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইঙ্গোশেটিয়াকে চেচনিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে ‘দ্য চেচেন-ইঙ্গোশ অটোনমাস রিপাবলিক’ ঘোষণা করে। ১৯৯১ সালে চেচনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করলে ইঙ্গোশেটিয়া নব গঠিত রুশ ফেডারেশনে যোগদান করে। প্রচুর খনিজসম্পদের অধিকারী হলেও এটি অন্যতম দরিদ্র অঞ্চল। বর্তমানে ইঙ্গোশেটিয়া চার শর বেশি মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
২. চেচনিয়া : চেচনিয়া প্রজাতন্ত্রও রাশিয়ার একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। চেচনিয়ার ৯৫ শতাংশ নাগরিক মুসলিম। ১৭ হাজার তিন শ’ বর্গকিলোমিটার আয়তনের চেচনিয়ার রাজধানী শহর গ্রোজনি। ধারণা করা হয়, ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে চেচনিয়ায় ইসলামের আগমন হয়। তবে ইসলামী শাসন স্থিতিশীল হয় ৭৩০ খ্রিস্টাব্দের পর। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে চেচনিয়ায় রুশ আগ্রাসন শুরু হয়। এরপর তিন শতাব্দীকালেও শেষ হয়নি চেচেন মুসলিমদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। নিকট-অতীতেও চেচনিয়া দুটি ভয়াবহ যুদ্ধের মুখোমুখি হয়। ১৯৯৪-৯৬ প্রথম রুশ-চেচেন যুদ্ধ এবং ১৯৯৯-২০০০ দ্বিতীয় রুশ-চেচেন যুদ্ধ। ২০০১ সালে রাশিয়া ও চেচনিয়ার মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ২০০৩ সালে রাশিয়া চেচনিয়ার জন্য নতুন সংবিধান রচনা হলে চেচেনিয়ায় শান্তি ফিরতে শুরু করে।
৩. দাগেস্তান : ২০ হিজরিতে ওমর রা.-এর শাসনামলে সাসানিদের পরাজিত দাগেস্তানের ‘বাবুল আবওয়াব’ শহর জয় করেন সাহাবি সুরাকা ইবনে আমর রা.। এরপর থেকে দাগেস্তান ওই অঞ্চলে ইসলামের দুর্গ হিসেবেই ভূমিকা পালন করে আসছে। ‘দাগেস্তান প্রজাতন্ত্রে’ জন্মগ্রহণ করেন কিংবদন্তি স্বাধীনতাসংগ্রামী ইমাম শামিল। রুশ বিপ্লবের পর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে দাগেস্তানকে সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত করা হয় এবং রুশ ফেডারেশন গঠিত হওয়ার পর স্বায়ত্তশাসন অক্ষুণœ রাখা হয়। তবে স্থানীয় মুসলিমরা কখনোই রুশ আগ্রাসন মেনে নেয়নি। ১৯৯৯ সালে দাগেস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করে। দাগেস্তানের আয়তন ৫০ হাজার তিন শ’ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যার ৮২.৬০ শতাংশ মুসলিম। রাজধানী শহর মাকাসকালা। রুশ বিপ্লবের আগে দাগেস্তানে এক হাজার ৭০০ মসজিদ ও ৭৬৬টি মাদরাসা ছিল, যা পরিচালনা করতেন আড়াই হাজার আলেম ও কাজি। সোভিয়েত সরকার তা বন্ধ করে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর দাগেস্তানে মুসলিম জাগরণ হয়। সেপ্টেম্বর ২০০৩-এর পরিসংখ্যান অনুসারে বর্তমানে দাগেস্তানে ৫৫৭টি সাধারণ মসজিদ, ১০৯১টি নামাজ কক্ষ, ১৬টি ইসলামী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, ১৪১টি মাদরাসা এবং ৩২৪টি মসজিদভিত্তিক মক্তব রয়েছে।
৪. কারচে-চের্কেসিয়া : হিজরি দ্বিতীয় শতকে মুসলিমরা আর্মেনিয়া জয় করার পর ওই অঞ্চল মুসলিম শাসনাধীন হয়। খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতক থেকে চের্কেসিয়ায় রুশ আগ্রাসন শুরু হয়। কারচে-চের্কেসিয়ার আয়তন ১৪ হাজার ২৭৭ বর্গকিলোমিটার। চের্কেসিয়ার জনসংখ্যার ৬৪.২ শতাংশ মুসলিম। ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত হয় এবং ১৯২৮ সালে স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার চের্কেস নেতারা রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
৫. বাশকোরতুস্তান : রুশ সংবিধান অনুযায়ী এটি রুশ ফেডারেশনের অধীন একটি সার্বভৌমত্বহীন স্বাধীন রাষ্ট্র। আয়তন এক লাখ ৪৩ হাজার ৬০০ বর্গ কিলোমিটার। রাজধানী উফা। এটি রাশিয়ার সবচেয়ে জনবহুল ও খনিজসমৃদ্ধ এলাকা। বাশকোরতুস্তানকে সংক্ষেপে বাশখিরও বলা হয়। বাশখিরের জনসংখ্যার ৫৮.৬২ শতাংশ মুসলিম। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টীয় দশম শতকে এখানে ইসলামের আগমন হয় এবং মোগল মুসলিমদের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা পায়। তবে ষষ্ঠদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রুশ আগ্রাসনে তারা স্বাধীনতা হারায়। বাশখির সোভিয়েত রাশিয়ার প্রথম গঠিত প্রজাতন্ত্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ১১ অক্টোবর ১৯৯০ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তবে রহস্যজনক কারণে তা প্রত্যাহার করে বাশখির নেতারা রুশ ফেডারেশনে যোগদান করে।
৬. কাবার্ডিনো-বালকারিয়া : কাবার্ডিনো-বালকারিয়া অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে। মুসলিমরা খাজার রাজ্য জয় করার পর সেখানে ইসলামের অগ্রযাত্রা শুরু হয় এবং তা অব্যাহত থাকে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, যখন রুশ সাম্রাজ্যের কাছে অত্র অঞ্চল স্বাধীনতা হারায়। কাবার্ডিনো-বালকারিয়ার মোট আয়তন ১২ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার। রাজধানী শহর নলচিক। ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট এলব্রাস এখানে অবস্থিত। কাবার্ডিনো-বালকারিয়ার জনসংখ্যার ৫৫.৪ শতাংশ মুসলিম।
৭. তাতারস্তান : রাশিয়ার একটি স্বায়ত্তশাসিত কেন্দ্রীয় অঞ্চল। খ্রিস্টীয় দশম শতকে এখানে ইসলামের বিস্তার ঘটে এবং দ্বাদশ শতকে ব্যাপক প্রসার লাভ করে। ১৪৩৮ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খানের একজন বংশধর কাজানকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, যা ১৫৫২ খ্রিস্টাব্দে রুশ সাম্রাজ্যের কাছে স্বাধীনতা হারায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পরও তাতার মুসলিমরা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ১৯৯৪ সালে তাতার জনগণ গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু তাতার নেতারা ১৯৯৪ সালে সম্পাদিত এক চুক্তির অধীনে রুশ ফেডারেশনে যোগদান করে। তাতারস্তানের আয়তন ৬৮ হাজার বর্গকিলোমিটার। রাজধানী শহর কাজান। জনসংখ্যার ৫৩.৮ শতাংশ মুসলিম।
ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতনের সময় ইউক্রেন ইসরাইলের পক্ষ নিয়েছিল। এরপরও মজলুমদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এতে ইউক্রেন যেন বুঝতে পারে যে জালিমের পক্ষে অবস্থান নেয়া ঠিক নয়। আর রাশিয়া শক্তিধর রাষ্ট্র বলে ইউক্রেনের ওপর জবরদখল চালাচ্ছে। এখন আমাদের উচিত হবে রাশিয়ার মতো সকল জবরদখলকারীদের বয়কট করা।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
আপনার মন্তব্য লিখুন