post

ইউপির প্রথম পর্ব কিছু কথা

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

০৬ এপ্রিল ২০১৬
গণতন্ত্রের সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে সি এফ স্ট্রং বলেছেন, Democracy implies that government which shall rest on the active consent of the governed. অর্থাৎ ‘শাসিতগণের সক্রিয় সম্মতির ওপরে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত, তাকে গণতন্ত্র বলা হয়’। আমাদের দেশের গণতন্ত্র কেতাবে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই বলেই প্রতীয়মান হয়। মূলত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। যেখানে শাসিতগণের সক্রিয় সম্মতির ওপর ভিত্তি করেই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রাসাদ রচিত হয়, সেখানে জাতীয় সংসদের ১৫৩ আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ বিনা ভোটেই জাতীয় সংসদ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। কেউ কেউ হয়তো প্রার্থীসঙ্কটের কথা বলে পুলকবোধ করবেন। কিন্তু আমাদের দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতির অতীত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সুদূর অতীতেও নির্বাচনে কখনো প্রার্থীসঙ্কট দেখা দেয়নি। ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থিতা দাখিল করেছিলেন ৮২ জন। যাচাই-বাচাই ও প্রত্যাহারের পরও মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নিয়েছিলেন ৩৯ জন। মূলত বিপুলসংখ্যক সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন। এতে শ্রেণীবিশেষ পুলকবোধ করলেও তা দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য অবশ্যই অশনিসঙ্কেত। এই যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের সংস্কৃতিটা চালু হয়ে গেল, তা আর কোনোভাবেই আমাদের পিছু ছাড়ছে না। এর আছরটা এখন সকল নির্বাচনের ওপরই পড়ছে। কয়েকদিন আগে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। সেখানে নির্বাচন নামের যে তামাশা শুরু হয়েছে, তাকে আর যাইহোক গণতন্ত্র বা নির্বাচন বলার সুযোগ নেই। প্রার্থীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এই যদি হয় গণতন্ত্রের নমুনা তাহলে স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিতন্ত্র সংজ্ঞায়নটা নতুন করেই করতে হবে বৈকি! গত ২২ মার্চ ইউপি নির্বাচনের প্রথম পর্বটা হয়ে গেল। কিন্তু নির্বাচনের নামে যে প্রসহনটা করা হলো তা জনগণের সাথে তামাশার শামিল। কথিত এ নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, জালভোট, কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, প্রতিপক্ষের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়াসহ নজিরবিহীন সন্ত্রাস ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংঘাত, সংঘর্ষ ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরাই। এ ধাপে শতাধিক স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটেছে। যার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদেরই জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২২ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপে ৭১২টি ইউপি নির্বাচনের সহিংস ঘটনা পর্যালোচনা করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। অবশ্যই, অভ্যন্তরীণ সহিংসতার বিষয়টি স্বীকার করলেও ঘটনাগুলোকে অতীতের তুলনায় নগণ্য বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। নির্বাচনের সময় সংঘটিত সহিংস ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভোটকেন্দ্র থেকে প্রতিপক্ষের এজেন্টদের বের করে দেয়া, কেন্দ্র দখল করা এবং ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল মারা, ব্যালটবাক্স ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা, ভোটকেন্দ্রের বাইরে পেশিশক্তি প্রদর্শন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষ, নির্বাচন কর্মকর্তাকে গুলি করে আহত করাসহ নানা ঘটনা ঘটেছে। দেখা গেছে, এসব ঘটনার সঙ্গে কোন না কোনভাবে ক্ষমতাসীনদের কর্মী-সমর্থকদের জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোথাও আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী, কোথাও আওয়ামী লীগ বনাম প্রশাসন, আবার কোথাও ত্রিমুখী সংঘর্ষ ঘটেছে। অথচ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করেছে। এমনকি বিতর্কিত এ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলে সার্টিফিকেট দেয়া হচ্ছে। অথচ সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে এসব নির্বাচনী অপরাধ প্রতিরোধে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, নির্বাহী বিভাগ কমিশনের চাহিদা মোতাবেক নির্বাচন কমিশনকে যেকোন ধরনের সহযোগিতা করতে বাধ্য এ কথা সংবিধানে সুস্পষ্ট। সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, (It shall be the duty of all executive authorities to assist the election Commission in the discharge of its functions.) অর্থাৎ ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে’। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সরকারতোষণ ও সঙ্কীর্ণ দলীয় মনোবৃত্তির কারণেই দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। গত ২২ মার্চের নির্বাচন ছিল এযাবৎকালের ভয়াবহ প্রাণঘাতী নির্বাচন। জানা গেছে, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ভোটকেন্দ্রের বাইরে ফলাফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ ঘটে। এ সময় গুলিতে নিহত পাঁচজনের সবাই সরকার দলের সমর্থক। নেত্রকোনার খালিয়াজুরীতে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ছোট ভাই নিহত হন। কক্সবাজারের টেকনাফের আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকের মধ্যে সংঘর্ষে দু’জন নিহত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকের মধ্যে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে ১ জন, পটুয়াখালীর বাউফলে ১ জন নিহত হয়েছে। এ ছাড়া ঝালকাঠি সদর ও নলছিটি, কাঁঠালিয়া, বরিশালের বানারীপাড়া, উজিরপুর, বাবুগঞ্জ, গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া, বাগেরহাটের সদর, কচুয়া ও মোরেলগঞ্জ, ভোলার সদর, দৌলতখান, চরফ্যাশন ও বোরহানউদ্দিন, কুমিল্লার দেবিদ্বার, বগুড়ার দুপচাঁচিয়া, খুলনার বটিয়াঘাটা ও দিঘলিয়া, বরগুনা সদর ও আমতলী, পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া, মঠবাড়িয়া ও জিয়ানগর, সিলেট সদর, ময়মনসিংহ সদর ও ফুলপুর, কিশোরগঞ্জ সদর, নরসিংদীর পলাশ, শেরপুর সদর ও নালিতাবাড়ী, মাদারীপুরের শিবচর, সাতক্ষীরার কলারোয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর ও আশুগঞ্জ, নোয়াখালীর সুবর্ণচর ও হাতিয়া, পটুয়াখালী সদর, গলাচিপা, কলাপাড়া, বাউফল, দশমিনা ও মির্জাগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে বগুড়া, লক্ষ্মীপুর ও শেরপুরসহ কয়েকটি জায়গায় আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপি বা জাসদের সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়। নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় নির্বাচন কর্মকর্তাদের থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন ৬৫টি ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ করেছে। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, তাদের কাছে যেসব কেন্দ্রের অনিয়ম ও সংঘর্ষের ঘটনার প্রতিবেদন এসেছে, তার বেশির ভাগের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল জড়িত রয়েছে। ফলে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের অবৈধ প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। কিন্তু কমিশন এসব বিষয়ে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। ভোটকেন্দ্র দখল, গুলি, সহিংসতা, প্রাণহানি আর জালভোটের মহোৎসবের মধ্য দিয়ে প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর গণঅনাস্থা বলে আখ্যায়িত করেছেন বোদ্ধামহল। নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় দেশের বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, এক কথায় বলতে গেলে এটা আওয়ামী স্টাইলের নির্বাচন। সরকারি দলের ছক ও নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখলসহ নানা অনিয়মের কারণে সমগ্র বাংলাদেশের জনগণকে পৃথিবীর মানুষের কাছে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে; চিহ্নিত হয়েছে ভোট ডাকাতের দেশ হিসেবে। সমগ্র নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর গণঅনাস্থা তৈরি হয়েছে। নির্বাচনী সিস্টেমটাকেই ভেঙে ফেলেছে ক্ষমতাসীন দল। পরবর্তী ধাপগুলোতেও এমনই তামাশার নির্বাচন হবে বলে আশঙ্কা অনেকের। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলীয় ভিত্তিতে ইউপি নির্বাচন- সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণেই এতগুলো মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে, অসংখ্য প্রাণহানির আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এ আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কারণে শান্তিপ্রিয় গ্রামে ঘরে ঘরে খুন-সংঘর্ষ-জিঘাংসাকে ছড়িয়ে দিয়েছে সরকার। এসব খুনের দায় সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই বহন করতে হবে। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করেন তারা। নির্বাচনে অস্বাভাবিক ভোটার উপস্থিতিও নির্বাচনকে বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে অন্তত ১২৭টিতে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশের ওপরে ভোট পড়েছে ছয় ইউপিতে। এ হিসাবে এক-চতুর্থাংশ ইউপিতে ৮০ শতাংশের ওপর ভোট পড়েছে। ৭১২টি ইউপির মধ্যে ৫১৪টির প্রাপ্ত ফল পর্যালোচনায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থানীয় সরকারের তৃণমূলের প্রতিষ্ঠান ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্য- এ তিন পদে ভোট দিতে হয়। এতে ৮০ শতাংশের ওপর ভোট পড়া অবিশ্বাস্য ও অস্বাভাবিক। নির্বাচনে অনিয়ম, কেন্দ্র দখল, একের বেশি যোগ্য প্রার্থী না থাকাসহ নানা কারণে ৮০ শতাংশের ওপর ভোট পড়তে পারে। পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, নির্বাচনে কারচুপি, মারধর, ব্যালট ছিনতাই ও কেন্দ্র দখলের প্রতিফলন নির্বাচনী ফলে দেখা যাচ্ছে। ইউপি নির্বাচনে ৮০-৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়তে পারে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বলা হয়, ইউপিতে ৮০ শতাংশের ওপর ভোটের হার অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য। এ নির্বাচনে একজন ভোটারকে তিনটি ব্যালটে ভোট দিতে হয়। গ্রাম-গঞ্জের মানুষ ভোট দেয়ার বিষয়ে এত সক্ষম নন। সিল মারা, কেন্দ্র দখল, জবরদস্তি এবং অনিয়মের প্রতিফলন ঘটেছে নির্বাচনী ফলাফলে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও হতে পারে। সূত্র মতে, নির্বাচনে মারামারি, হাঙ্গামার চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে স্পষ্ট বলা যায় এ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। এর দায় নির্বাচন কমিশন এড়াতে পারে না। যদিও নির্বাচন কমিশন দাবি করে আসছে, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ইউপি নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ভালো ছিল। বিশেষ করে নারী ভোটারদের দীর্ঘ লাইন ছিল। নির্বাচন কমিশন সচিবের কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, ভোটার উপস্থিতির চিত্র গণমাধ্যমে দেখে উৎসাহিত হওয়ার মতো। গ্রামাঞ্চলের নির্বাচন হলেও নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। নির্বাচনে গড়ে ৭৩ দশমিক ৮২ শতাংশ ভোট পড়েছে বলেও জানান তিনি। কমিশনের এই বক্তব্যকে সঠিক মনে করছেন না অভিজ্ঞমহল বরং এসবকে সরকারতোষণই বলা হচ্ছে। গত ২৩ মার্চ ইসি ৫২২টি ইউপির ফল জানিয়েছে। ৫২২ ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগ ৩৯৪, বিএনপি ৩৫, জাতীয় পার্টি (জেপি) ৭, ওয়ার্কার্স পার্টি ২, জাতীয় পার্টি ১, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৩, ইসলামী আন্দোলন ১ ও স্বতন্ত্র ৭৯টিতে জয় পেয়েছে। এতে আওয়ামী লীগ ৫৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে। দলটির প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ৩৬ লাখ ৭৯ হাজার ৫৮২। এ ছাড়া বিএনপি পেয়েছে ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। তাদের ভোট ১১ লাখ ৩২ হাজার ৮৮টি। আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপি এক-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়েছে। বাকি ৫টি দলের মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দলগুলো এক শতাংশের কম পেয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ১টি ইউপিতে জয় পেলেও প্রাপ্ত ভোটের হার ২ দশমিক ৩৪ ভাগ। নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার বেশ কিছুসংখ্যক ভোটার নির্বাচনী দায়িত্বে থাকেন। এ ছাড়াও প্রবাসী, চাকরির কারণে নির্বাচনী এলাকার বাইরে অবস্থান এবং মৃত ভোটারও থাকে। অনেকে অসুস্থতার কারণে ভোট দিতে যান না। এ ছাড়া উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনের সহিংসতার মাত্রা বেশি থাকায় অনেক সাধারণ মানুষ ভোট দেয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এসব কারণে ৮০ শতাংশের ওপর ভোট পড়া কিছুটা হলেও সন্দেহজনক। তবে কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলেন, ইউপিতে সদস্যরা বেশি তৎপর থাকেন। এ কারণে ভোটার উপস্থিতি বেশি থাকে। ফলাফল সার্বিকভাবে পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৫১৪টি ইউপির মধ্যে ৮০ শতাংশের ওপর ভোট পড়েছে ১২৭টিতে, যা প্রায় এক-চতুর্থাংশ। পঞ্চগড়ের চারটি ইউপিতে রেকর্ডসংখ্যক ভোট পড়েছে। এ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৯৩ দশমিক ৩১ ভাগ ভোট পড়েছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা ইউনিয়নে। আওয়ামী লীগের কুদরই-ই-খুদা এ ইউপিতে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এ ইউপিতে ৯ হাজার ৯৬০টি ভোটের মধ্যে ৯ হাজার ২৯৪টি ভোট পড়েছে। বাতিল ভোটের সংখ্যা ২১৩টি। বৈধ ভোটারের সংখ্যা ৯ হাজার ৮১টি। একই উপজেলার বডাবুড়ি ইউপিতে ভোট পড়েছে ৯০ দশমিক ৯০ শতাংশ। এতে ৭ হাজার ৯৫৫টি ভোটের মধ্যে ৭ হাজার ২৩১ ভোট পড়েছে। ১৪৬ ভোট বাতিল হয়ে বৈধ ভোটের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৮৫টিতে। এ ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী তারেক হোসেন জয় পেয়েছেন। ভজনপুর ইউপিতে ৯১ দশমিক ৪১ ভাগ ভোট পড়েছে। এতে বিএনপির প্রার্থী মকসেদ আলী নির্বাচিত হয়েছেন। এ ইউপিতে ১ হাজার ১২৯ ভোটের মধ্যে ১ হাজার ৩২ ভোট পড়েছে। একই উপজেলার দেবনগর ইউনিয়নে ৯০ দশমিক ২০ শতাংশ ভোট পড়েছে। এ ইউপিতে বিএনপির মহসিন উল হক বেসরকারিভাবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ফুলবাড়ী ইউনিয়নে। এ ইউপিতে আওয়ামী লীগের আবদুস সালাম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। খুলনার রূপসা উপজেলার শ্রীফলতলা ইউপিতে ৯১ দশমিক ৬৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। এ ইউপিতেও আওয়ামী লীগের ইসহাক সরদার নির্বাচিত হয়েছেন। যেসব ইউপিতে ৮০ শতাংশের ওপর ভোট পড়েছে সেগুলো হলো, কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমবাড়ীয়া, আমলা, কুর্শা, ছাতিয়ান, তালবাড়ীয়া, পোড়াদহ; কুষ্টিয়ার মিরপুরের বহুলবাড়ীয়া, বারইপাড়া, মালিহাদ, সদরপুর; খুলনার তেরখাদার আজগড়া, দাকোপের কামারখোলা, কৈলাশগঞ্জ, তিলডাঙ্গা, দাকোপ, পানখালী, বাজুয়া, বানীশাস্তা, লাউডোব, দিঘলিয়া উপজেলার আড়ংঘাটা, পাইকগাছার কপিলমুনি, গদাইপুর, দেলুটি, লতা, বটিয়াঘাটার গঙ্গারামপুর, বাটিয়াঘাটা, বালিয়াডাঙ্গা, ভারকোট, রূপসা উপজেলার আইচগাতী, টিএস বাহিরদিয়া, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের এলাঙ্গী, কুশনা, দোড়া, বলুহর, সাফদারপুর, বাগেরহাটের ফকিরহাটের নলধা-মৌভোগ, পিলজংগ, বাহিরদিয়ামানসা, বেতাগা, লখপুর, শুভদিয়া, মোংলার চিলা, মোরেলগঞ্জের বনগ্রাম, রামপালের গৌরম্বা, ভোজপাটিয়া, রাজনগর, হড়কা, যশোরের মনিরামপুরের কাশিমনগর, কুলটিয়া, চালুয়াহাটি, ঢাকুরিয়া, নেহালপুর, ভোজগাতি, মনিরামপুর, মনোহরপুর, হরিদাশকাটি, সাতক্ষীরার আশাশুনির আনুলিয়া, আশাশুনি, কাদাকাটি, কুল্যা, দরগাহপুর, তালার খলিলনগর, সাতক্ষীরা সদর, ব্রহ্মমরাজপুর, ভোমরা, কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের আড়াইসিধা, তারুয়া, পশ্চিম তালশহর, লালপুর, বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ছলিমাবাদ, তেজখালী, কিশোরগঞ্জের বিন্নাটি, মহিনন্দ, মারিয়া, যশোদল, লতিফাবাদ, গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার গোপালপুর, নেত্রকোনার খলিয়াজুরীর খালিয়াজুরি, গাজীপুর, চাকুয়া, মাদারীপুরের শিবচরের সদর, ময়মনসিংহের ফুলপুরের বওলা, পটুয়াখালীর বাউফলের চন্দ্রদ্বীপ, রাঙ্গাবালীর চালিতাবুনিয়া, পিরোজপুরের নেছারাবাদের বলদিয়া, বরগুনার নলটোনা, বরগুনা সদর, বরিশাল সদরের চন্দ্রমোহন, জাগুয়া, ভোলার দৌলতখানের মেদুয়া, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট, পালশা, বুলকীপুর, আলীহাট, খট্টামাধবপাড়া, বোয়ালধার, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার তেঁতুলিয়া, শালবাহান, রংপুরের পীরগাছার কল্যাণী, পাবনার বেড়ার কৈটোলা, চাকলা, ঢালারচর, নতুন ভারেঙ্গা, পুরান-ভারেঙ্গা, বগুড়া দুপচাঁচিয়া তালোড়া, সারিয়াকান্দির চালুয়াবাড়ী, নারচী, বোহাইল, সারিয়াকান্দি, হাটশেরপুর, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের চন্দাইকোনা, ধানগড়া, ধামাইনগর, ধুবিল, পাংগাসী, ব্রহ্মগাছা, সোনাখাড়া এবং সিলেটের জালালাবাদ ইউপি। ইসি সূত্রে জানা গেছে, ৫২২ ইউপি নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৬০ হাজার ৪২ ভোট পেয়েছে, যা প্রদত্ত ভোটের দশমিক ৮৯ শতাংশ। জাতীয় পার্টি (জেপি) ৬৫ হাজার ৩৫৬ ভোট পেয়েছে, যা প্রায় ১ শতাংশ। কমিউনিস্ট পার্টি ৫ হাজার ২২৮ ভোট পেয়েছে, যা দশমিক ০৮ শতাংশ। ওয়ার্কার্স পার্টি ৩৫ হাজার ৬২৫ ভোট পেয়েছে, যা প্রদত্ত ভোটের দশমিক ৫৩ শতাংশ। বিকল্পধারা মাত্র ৩৮৮ ভোট পেয়েছে। জাসদ ৩৭ হাজার ৪৩১ ভোট পেয়েছে, যা প্রদত্ত ভোটের দশমিক ৫৫ শতাংশ। অন্যান্য দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা দেড় হাজারের কম। মূলত রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, মত ও পথ নির্বিশেষ মানুষের সকল অধিকার নিশ্চিত করা। আর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি বৈধ সরকারও থাকে। তাই রাষ্ট্রযন্ত্রকে সাংবিধানিক ও আইনানুগভাবে পরিচালনা করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণেই আমরা রাষ্ট্রের সেসব কল্যাণ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হচ্ছি। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি গণতান্ত্রিক হলেও সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক ব্যবস্থার অভাবে আমরা গণতন্ত্রের সুফল থেকে অনেকটাই বঞ্চিত। গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড (G A Almond)  রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন, (The political system is the legitimate, order maintaining or transforming system in the society ) অর্থাৎ ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো একটি বৈধ, শৃঙ্খলারক্ষাকারী ও রূপান্তর সাধনকারী ব্যবস্থা’। কিন্তু আমরা বোধ হয় এই বিষয়ে তেমন একটা সফল হতে পারিনি। গত ২২ মার্চের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আমাদেরকে সেদিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে, যা কাক্সিক্ষত নয়। লেখক : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির