post

ইতিহাসে অমলিন শহীদ আবদুল মালেক । ডা. মো. আনোয়ারুল ইসলাম

২৪ জুন ২০১৯

ইতিহাসে অমলিন শহীদ আবদুল মালেক । ডা. মো. আনোয়ারুল ইসলামযখন তুমি এসেছিলে ভবে কেঁদেছিলে তুমি হেসেছিলো সবে। এমন জীবন তুমি করিও গঠন মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন। - কাজী নজরুল ইসলাম

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল। মাত্র ২২ বছর। এই ছোট্ট জীবনে শহীদ আবদুল মালেকের একেকটি কর্ম যেন একেকটি ইতিহাস হয়ে আছে। তার কর্মময় জীবন ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি কর্মীর জন্যই অনুপ্রেরণা। তিনি জীবনে যেমন একটি সুন্দর ক্যারিয়ার তৈরি করেছিলেন, তেমনি ইসলামী আন্দোলনের প্রয়োজনে সে ক্যারিয়ার সেক্রিফাইস করে প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কাছে সকল বাধা তুচ্ছ, সকল পিছুটান নিঃস্ব। আব্বু তার কাছাকাছি বড় ভাই হওয়ার কারণে তার নিকট হতে অনেক স্মৃতিকথা শুনেছি। আরেক বড় ভাই আব্দুল খালেক সাহেবের নিকট থেকেও কিছু তথ্য জেনেছি। সমসাময়িক ইসলামী আন্দোলনের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেক স্মৃতিচারণ পড়েছি। ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মী থাকার কারণে ক্ষণে ক্ষণে তার মতো পাঞ্জেরির প্রয়োজনও অনুভব করেছি।

অদম্য মেধাবী আবদুল মালেক

বাড়ির পাশেই খোকশাবাড়ী স্কুল। পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী সে স্কুলেই ভর্তি করার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু শিশু আবদুল মালেক স্কুলে যেতে নারাজ। বড় ভাই আব্দুল খালেক এ ব্যাপারে ভর্ৎসনা করায় সে বাড়ি থেকে চলেও গিয়েছিল। পরে বাবা মোহাম্মদ আলী মুন্সী তাকে স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেন। সেই যে স্কুলে যাওয়া, তারপর কোন পিছুটান তাকে দমাতে পারেনি। আব্দুল জলিল সাহেব ছিলেন খোকশাবাড়ী প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি শিশু আবদুল মালেককে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। সব কয়টি প্রশ্নের উত্তর পেয়ে তিনি এতই অভিভূত হলেন যে আবদুল মালেককে তিনি সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে নিলেন। প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে গোসাইবাড়ী হাইস্কুল। এলাকার মধ্যে এ স্কুলটির বেশ সুনাম ছিল। শিশু আবদুল মালেক সে স্কুলে পড়ার আগ্রহ পোষণ করায় তাকে সে স্কুলে ভর্তি করা হলো। কোনো কারণে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি আবদুল মালেক। কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষায় তার রেজাল্ট দেখে শিক্ষকরা আফসোস করলেন এবং জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা থেকে যেন আবদুল মালেক বঞ্চিত না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকলেন। যথারীতি আবদুল মালেক জুনিয়র পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখলেন। আবদুল মালেক চাচ্ছিলেন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিতে। কিন্তু গোসাইবাড়ী হাইস্কুলে তখনও বিজ্ঞান বিভাগ ছিল না। আবদুল মালেক চাচ্ছিলেন বগুড়া জিলা স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে। ভর্তি হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে চাচ্ছিলেন না প্রধান শিক্ষক মুজিবুর রহমান সাহেব। সেদিন আবদুল মালেকের অদম্য মেধায় অভিভূত হয়ে তিনি বলেছিলেন, দরকার হলে আবদুল মালেকের জন্য হলেও আমরা আমাদের স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করব, তবুও তাকে অন্য কোথাও যেতে দিব না। বগুড়া জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক আজিজুর রহমান স্যারের সাথে দেখা করে ভর্তির কথা জানালে, ভর্তির জন্য ফরম জমার সময় শেষ হওয়ায় তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেন। সহকারী প্রধান শিক্ষক শামসুদ্দিন স্যারের অনুরোধে তাকে ফরম জমা দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হলো। ভর্তি পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করলেন। স্কুলের হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেন। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বাবা মারা গেলেন। পরীক্ষার কারণে তাকে জানতে দেয়া হলো না। মারা যাওয়ার ২ দিন পর বড় ভাই মাস্টার আব্দুল বারী দেখা করতে গেলেন আবদুল মালেকের সাথে। পরীক্ষার খোঁজখবর নেয়ার পর আবদুল মালেকও বাড়ির খোঁজ জানতে চাইলেন। বড় ভাই কৌশলে জানালেন যে উপস্থিত সবাই ভালো আছেন। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বাইরে বেশি ঘোরাফেরা না করে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা শেষ করেই বাড়ি আসার জন্য পরামর্শ দিলেন। কারও মাধ্যমে বাবার মৃত্যুর খবর জেনে পরীক্ষা যেন খারাপ না হয় সে জন্যই এমন পরামর্শ দিলেন। পরে পরীক্ষা শেষে বাড়ির নিকটবর্তী হতেই প্রতিবেশীর কাছে বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। এসএসসি পরীক্ষায় রাজশাহী বোর্ডে মেধা তালিকায় ত্রয়োদশ স্থান অধিকার করে ভর্তি হলেন স্বনামধন্য রাজশাহী কলেজে। রাজশাহী কলেজ থেকে মেধা তালিকায় ৪র্থ স্থান অধিকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগ্রহ জানালেন। বড় ভাই আব্দুল বারী আবদুল মালেককে সাথে নিয়ে ঢাকা পৌঁছলেন বিকাল প্রায় ৩টার সময়। কিন্তু ২টার সময় ভর্তি ফরম জমা দেয়ার সময় শেষ হওয়ায় অফিসের কর্মকর্তারা তাদের কিছুই করার নেই বলে জানিয়ে দিলেন। আব্দুর বারী সাহেব চলে আসার পূর্বে তাদেরকে আবদুল মালেকের অ্যাকাডেমিক কাগজ পত্রগুলো দেখার অনুরোধ করলেন। অফিসের কর্মকর্তারা কাগজপত্র দেখে বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রধান ড. কামাল হোসেনকে বিষয়টি জানালেন। ড. কামাল হোসেন নিজেই এসে কাগজপত্র দেখলেন এবং এমন মেধাবী ছাত্রকে ফিরিয়ে না দিয়ে ফরম পূরণ করে জমা দিতে বললেন। এবারও ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হলেন আবদুল মালেক। প্রথমে জিন্নাহ হলে সিটের আবেদন করে না পাওয়ায় ড. কামাল হোসেন স্যার পরে ফজলুল হক হলে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই থেকে ফজলুল হক হলে ১১২ নং কক্ষেই কাটিয়েছেন তিনি। অবশেষে আরেকটি কৃতিত্বপূর্ণ রেজাল্ট অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার পূর্বেই ইবলিসের ষড়যন্ত্রে অকালেই নিভে গেল এ অদম্য মেধাবীর প্রাণ। কবি ফররুখ আহমদের ভাষায়- ইবলিসের ষড়যন্ত্রে নিভে গেল অকালে যে প্রাণ জান্নাতের ফুল হয়ে ফুটেছে সে এখন অম্লান।

মায়ের স্বপ্ন

একটা তারা খসে পড়লো। খসে পড়লো আকাশ থেকে। ...উহ, কি ভীষণ যুদ্ধ। তারায় তারায় যুদ্ধ। আকাশের বুক কেঁপে উঠছে। হঠাৎ, হঠাৎ একটা খসে পড়লো তাঁর কোলে। চমকে উঠেছিলেন তিনি। ঘুম ভেঙে গিয়েছিল শহীদ আবদুল মালেকের আম্মার। অদ্ভুত সেই স্বপ্নের মানে তবু বুঝতে পারেননি তিনি। শহীদ আবদুল মালেক গর্ভে থাকা অবস্থায় দেখা এ স্বপ্নের তাৎপর্য বুঝতে পারেননি তিনি। শহীদের জন্মের পরও অতটা উপলব্ধি করতে পারেননি। পরে বুঝতে পেরেছিলেন আকাশের বুকে যুদ্ধে খসে পড়া তারার মত জীবনের সত্য-অসত্যের চিরন্তন যুদ্ধে এক নির্ভীক সৈনিক ছিল তাঁর ছেলে। বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর ছেলে ছিল বিংশ শতাব্দীর বুকে ইসলামকে প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এক কাফেলার সেনানায়ক। তাঁর ছেলের রক্ত এনেছে এদেশের মুসলিম জনতার মনে এক প্রাণবন্যা। তাঁর শাহাদাতের পর ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন এক অনবদ্য সনেট। সেখানে তিনি লিখেছেন, “পরম সাফল্য আর যে পেয়েছে সত্যের সন্ধান, দুর্লভ সম্ভ্রম আর সৌভাগ্যের অধিকারী সেই শহীদের মুখচ্ছবি দেখো (গ্লানিমার চিহ্ন নেই; মহান ত্যাগের পথে সে আজ উন্নত; মহীয়ান)।” ইকামাতে দ্বীনের কাজকে অগ্রাধিকার

পৃথিবীর হাজারও কাজের ভিড়ে ইকামাতে দ্বীনের এ কাজ যেন, সবচেয়ে প্রিয় হয়। আর কোন বাসনা নেইতো আমার কবুল করো তুমি হে দয়াময়। হ্যাঁ, সত্যিই পৃথিবীর সকল কাজের মধ্যে ইকামাতে দ্বীনের কাজকেই সবচেয়ে বেশি প্রিয় করে নিয়েছিলেন শহীদ আবদুল মালেক। দ্বীনকে তিনি অন্যতম নয় বরং একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। আর এ উদ্দেশ্য পূরণে বাধা হিসেবে যা কিছু সামনে এসেছে তা মাড়িয়ে এগিয়ে গেছেন। স্কুলজীবনে তিনি লজিং থাকতেন মৌলভী মহিউদ্দিন সাহেবের বাসায়। মহিউদ্দিন সাহেব গাইবান্ধায় এক সেমিনারে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আব্দুর রহিম আলোচিত ‘জীবনের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত’ বিষয়টি সকলকে বুঝানোর সময় অনুসন্ধিৎসু শহীদ আবদুল মালেক প্রশ্ন করেছিলেন ‘চাচা, এ পথের সন্ধান কিভাবে পাওয়া যায়?’ হ্যাঁ এ পথের সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন বলেই বগুড়া জিলা স্কুলে ভর্তি হয়েই বাবার কাছে চিঠি লিখেছিলেন, ‘বাড়ির কথা ভাবি না, আমার শুধু এক উদ্দেশ্য, খোদা যেন আমার উদ্দেশ্য সফল করেন। কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছি এবং কঠোর সংগ্রামে অবতীর্ণ, দোয়া করবেন খোদা যেন সহায় হন। আমি ধন-সম্পদ কিছুই চাই না, শুধু মাত্র যেন প্রকৃত মানুষ রূপে জগতের বুকে বেঁচে থাকতে পারি।’ কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে প্রবেশ করলেন তখন তার এ সংকল্প আরও দৃঢ় হলো। তাইতো ফজলুল হক হলের তার রুমের দরজার ওপর লিখে রেখেছিলেন শহীদ সাইয়েদ কুতুবের সেই বিপ্লবী বাণী ‘আমরা ততদিন পর্যন্ত নিস্তব্ধ হব না, নীরব হব না, নিথর হব না, যতদিন না কোরআনকে এক অমর শাসনতন্ত্র হিসেবে দেখতে পাই। আমরা এ কাজে হয় সফলতা অর্জন করব নয় মৃত্যুবরণ করব।’ এ মহান মঞ্জিলে পৌঁছার জন্য মায়ের বন্ধনও ছিন্ন করার দৃপ্ত শপথ নিয়েছিলেন তিনি। লিখেছিলেন ‘মায়ের বন্ধন ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। বৃহত্তর কল্যাণের পথে সে বন্ধনকে ছিঁড়তে হবে। কঠিন শপথ নিয়ে আমার পথে আমি চলতে চাই। আশীর্বাদ করবেন। সত্য প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামে যেন আমার জীবনকে আমি শহীদ করে দিতে পারি। আমার মা এবং ভাইয়েরা আশা করে আছেন আমি একটা বড় কিছু হতে যাচ্ছি। কিন্তু মিথ্যা সে সব আশা। আমি বড় হতে চাইনে, আমি ছোট থেকেই সার্থকতা পেতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হয়ে বিলেত থেকে ফিরে যদি বাতিল পন্থীদের পিছনে ছুটতে হয় তবে কী লাভ? আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসগুলোর চেয়ে ইসলামী ছাত্রসংঘের অফিস আমার জীবনে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জানি আমার কোনো দুঃসংবাদ শুনলে মা কাঁদবেন, কিন্তু উপায় কী বলুন? বিশ্বের সমস্ত শক্তি আল্লাহর দেয়া জীবনবিধানকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। আমরা মুসলমান যুবকরা বেঁচে থাকতে তা হতে পারে না। হয় বাতিলের উৎখাত করে সত্যের প্রতিষ্ঠা করব নচেৎ সে চেষ্টায় আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে। আপনারা আমায় প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করুন জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও যেন বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারি। কারাগারের নিরন্ধ্র অন্ধকার, সরকারি যাঁতাকলের নিষ্পেষণ আর ফাঁসির মঞ্চও যেন আমায় ভড়কে দিতে না পারে।’ সরল আর সাদাসিধে ছিল যে জীবন

আখিরাতের জীবনের তুলনায় একান্তই এক মুসাফিরখানা, এই দুনিয়াকে কখনোই প্রাধান্য দেননি শহীদ আবদুল মালেক। কষ্ট করে কোনোমতে জীবন পার করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যেত তার জীবনে। নূর মোহাম্মদ মল্লিক ভাই তার একটি লেখায় লিখেছেন, একদিন সকালে দেখি মালেক ভাই তাঁর পাঞ্জাবি-পাজামা কেচে শুকাবার অপেক্ষা করছেন। তাঁর রুম পূর্বমুখী। এ জন্য ভোরের রোদটাও এদিকে এসে পড়েছে। ঘন ঘন তিনি কাপড়গুলো শুকালো কিনা দেখছিলেন। তখন মাদরাসায়ে দারুত্তালিমের হলরুমে প্রাদেশিক সংঘের কার্যকরী পরিষদের বৈঠক চলছে। এর আগের দিন গভীর রাতে তিনি ফিরেছেন। এরপর পরিষ্কার জামা কাপড় পরে যাওয়ার জন্য তিনি তৈরি হচ্ছেন। সময় হয়ে আসছে অধিবেশনের। আধাভেজা জাম-পাজামা পরেই দায়িত্ব পালনের জন্য মালেক ভাই চলে গেলেন। স্কলারশিপের টাকাতেই তাঁর চলত। কিছু টাকা মায়ের কাছেও পাঠাতেন। অবশিষ্ট টাকা খাওয়া-পরা ও আন্দোলনের জন্য খরচ করতেন। বেশ কয়েকদিন থাকার পর আমি লক্ষ্য করলাম মালেক ভাই ডাইনিং হলে খাচ্ছেন না। মনে করলাম, মজলিসে শূরার বৈঠকের জন্য হয়তো তাঁদের সকলে একসাথে খান সময় বাঁচানোর জন্য। কিন্তু শূরার বৈঠক শেষ হলো। এরপরও তাকে দেখি না। এরপর একদিন দেখলাম, তিনি রুটি আনাচ্ছেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে বললেন, শরীর খারাপ। আমার সন্দেহ হলো। আমার জন্যই বোধ হয় তাকে কষ্ট করতে হচ্ছে। সামান্য ক’টি টাকাতে হয়তো তিনি কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না এবং এ জন্য বিশেষ করে আমার ভার বহনের জন্যই যে তাঁকে অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হচ্ছে বুঝতে পেরে তার কাছ হতে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম। এর আগে একদিন চলে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে পাইনি। বলেছিলেন ‘কোথায় যাবেন?’ কোথা যাবো সত্যিই ঠিক করিনি। এর জন্য নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার অসুবিধা হচ্ছে কি না জানতে চাইলেন। আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ আমি তার কাছে দিব্যি আরামে বড় ভাইয়ের স্নেহে সবাইকে উৎপাতে অতিষ্ঠ করে দিন কাটাচ্ছিলাম। আমার আবার অসুবিধা কী? সে জন্য সত্যি কথাই বলেছিলাম। ‘না’! প্রায় ধমকের সুরে তাঁর কাছে থাকতে বলে চলে গিয়েছিলেন তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক কাজে। মতিউর রহমান নিজামী ভাই লিখেছেন, রাতের ট্রেনে আবদুল মালেক বাড়ি যাবে শুনেছি। দু’একদিনের মধ্যে দেখা হয়নি। সময় মত স্টেশনে গিয়ে হাজির হলাম। আবদুল মালেককে খুঁজে পেতে বেশ সময় লেগেছে। কারণ সে মধ্যম শ্রেণীতে ওঠেনি। আমাকে দেখে সে বেশ অপ্রস্তুত হলো। আমার স্টেশনে যাওয়া তার কাছে কেমন যেন লেগেছে। বেশ একটু জড়সড় হয়ে বলতে লাগল, আপনি স্টেশনে আসবেন জানলে আমি যে করেই হোক দেখা করেই আসতাম। অবশ্য একবার খোঁজ করেছি, আপনাকে পাইনি। আমি কথাগুলোর দিকে কান না দিয়ে কামরাটার দিকে ভালো করে দেখছিলাম। তিল ধারণের জায়গা নেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে সারারাত। আমি চেষ্টা করলাম ইন্টারে জায়গা করে দেয়ার। টিকিটের ঝামেলাও চুকিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু রাজি করা সম্ভব হলো না। আবদুল মালেক অকপটে বলে ফেলল এই লোকগুলোর সাথে আলাপ করলে আমার ভালো লাগবে। তখনো বুঝতে পারিনি কত মর্যাদাবান ব্যক্তির কাছে এই কথাগুলো শুনেছি।

নেতা নয় দায়িত্বশীল ছিলেন শহীদ আবদুল মালেক

জনশক্তির সুবিধা অসুবিধার দিকে নজর রাখতেন সব সময়। অনেক বড় দায়িত্বশীল হয়েও অনেক ছোট কাজ করতে দ্বিধাবোধ ছিল না তার মনে। আবু নাছের ভাইয়ের একটি লেখায় তিনি লিখেছেন, ’৬৭ সনের মাঝামাঝি বোধ হয় ঢাকার গুলশানে শিক্ষাশিবিরে মালেক ভাই ইনচার্জ। নদীর কূলে অস্থায়ী পায়খানার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কয়েকটার নড়বড়ে দশা, অভিযোগ করা হলো। যথানিয়মে মালেক ভাইকে জানালাম, চুপ করে শুনলেন। বেলা ২টা হবে বোধ হয়, নিজামী ভাই মালেক ভাইকে ডেকে আনতে বললেন। কোথাও না পেয়ে পায়খানার দিকেও খোঁজ করতে গেলাম। নিজেকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দেখলাম মালেক ভাই ব্যবহৃত পায়খানাগুলোকেই মজবুত করছেন এক কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে সন্তুষ্ট হলেন না, যেন ধরা পড়ে গেছেন এমন ভাব। এ দিক থেকে তাকে দেখেছি সব সময়ে অত্যন্ত হিসেবি এবং সার্থক, অদেখা আল্লাহকে খুশি করার মাঝেই তিনি ছিলেন ব্যস্ত। তাই এর জন্য তিনি যে সমস্ত পুঁজি বিনিয়োগ করে চলছিলেন তা জনসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পড়ুক এটা তিনি কোনদিন চাইতেন না। বড্ড স্বার্থপর ছিলেন ‘মাহবুবার প্রেমে’। এ কারণেই বোধ হয় পরওয়ারদিগার তাঁকে অত্যন্ত জলদি (আমার দৃষ্টিতে) ডেকে নিয়ে গেলেন নিজের একান্ত কাছে।

সংগঠনের চাওয়াই ছিল তার কাছে বড় পাওয়া

শহীদ আবদুল মালেক তখন ঢাকা শহর শাখার সভাপতি। নিজামী ভাই পূর্ব পাকিস্তান সভাপতি। শহীদ আবদুল মালেককে অত্যন্ত কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে তার। তিনি লিখেছেন, ‘প্রাদেশিক মজলিসে শূরার বৈঠকের মাত্র দু’-একদিন আগে হঠাৎ করে আবদুল মালেক বাড়ি যাবে বলে শুনলাম। ব্যাপারটা কেমন যেন লাগল। আমি ডেকে জিজ্ঞেস করলাম। মনটা বেশ ভারাক্রান্ত মনে হলো ওর। বাড়ি যাওয়াটা প্রয়োজন মনে করছি, কিন্তু আপনাকে না বলে বাড়ি যাচ্ছি এ কথা বলতে পারি না, মালেক উত্তর করল। ছোটখাটো কারণে সে বাড়ি যেতে পারে না। সুতরাং তাকে বাধা দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু একদিকে তার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা ঘনিয়ে এসেছে অন্য দিকে তার অনুপস্থিতিতে মজলিসে শূরার গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন হবে এটা আমার কল্পনা করাও ছিল অসম্ভব। তাই কারণটা জানতে চাইলাম। কী যেন একটা স্বপ্ন দেখে সে বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়েছে। ‘সংগ্রামী জীবনে আমরা স্বপ্নকে এরূপ গুরুত্ব দিতে পারি না, বাস্তবে কিছু ঘটে থাকলে সেটা স্বতন্ত্র কথা। বাড়ি গেলে বেশ সময় যাবে। বরং টেলিগ্রাম করে প্রকৃত অবস্থা জেনে নিলেই তো ভালো হয়।’ আমার মুখ থেকে এতটুকু কথা বের হতেই মালেকের চোখে মুখে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। পরে আমি নিজেই তাকে বাড়ি যাওয়ার জন্য কয়েকবার চাপ দিয়েছি। মালেক উত্তর দিয়েছে, ‘এখন না গেলেও চলবে, বাড়ি থেকে চিঠি পেয়েছি।’ কে জানত যে শহীদ হয়েই সে মায়ের কাছে ফিরে যাবে।

প্রদর্শনেচ্ছার ঠাঁই ছিল না তার জীবনে

যে কয়টি মৌলিক অসৎ গুণাবলী মানুষকে বিপথে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, প্রদর্শনেচ্ছা তার মধ্যে একটি। তা ছাড়া হাদিসে এটিকে প্রচ্ছন্ন শিরক বলে অভিহিত করা হয়েছে। আর শিরক হচ্ছে বড় জুলুম। সব গুনাহ মাফ করলেও শিরকের গুনাহ আল্লাহ মাফ করবেন না। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা যেহেতু অনেক ভালো কাজ করার সুযোগ পায়, তাই শয়তান তার ভালো কাজগুলোকেই তার জন্য ক্ষতিকর অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। এক সময় আমাদের কাজগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিবেদিত না হয়ে মানুষের প্রশংসা পাওয়ার নিমিত্তে সম্পাদিত হতে থাকে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন। ইসলামী আন্দোলনের অগ্রসেনানী শহীদ আবদুল মালেক এ ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইসলামী আন্দোলনের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে যেমন সবসময় ভূমিকা রেখেছেন, সেই সাথে আবার প্রদর্শনেচ্ছা যেন না হয়ে যায় সে ব্যাপারেও সতর্ক ছিলেন সবসময়। নিজামী ভাই লিখেছেন, ‘৬৭-৬৮ সেশন শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত তিনটি শিক্ষাশিবিরের ব্যবস্থাপক হিসেবে আবদুল মালেকের যোগ্যতার প্রচ্ছন্ন রূপটি কর্মীদের সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। বিগত সেশনে সে প্রাদেশিক মজলিসে শূরায় নির্বাচিত হয়নি। এবারে সে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য। দ্রুতগতিতে আন্দোলনে এত সামনে আসা তার কাছে ভালো লাগেনি। আবদুল মালেকের মনে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। নিজের প্রদর্শনী হয় এমন যে কোন প্রোগ্রাম এবার এড়িয়ে যেতে সে বদ্ধপরিকর। তার এরূপ অনমনীয় মনোভাব আর কোনদিন লক্ষ্য করিনি। ব্যাপারটা অবশ্য বুঝতে বাকি রইল না। কিন্তু খুব সহজে এটাকে আমল দিতে চাইনি। কার্যকরী পরিষদের এক বৈঠকে স্কুলকর্মীদের প্রোগ্রাম দেয়ার জন্য আমি জোর করছিলাম। পরিষদ সদস্যদের সবাই চাপ দেয়ার পরও সে রাজি হচ্ছে না। এ ছিল তার সংঘ জীবনের একটা ব্যতিক্রম ঘটনা। মজলিসে শূরার ফয়সালা হিসেবে পেশ করার পর অবশ্য সে মৌন সম্মতি জানাল। একদিন পর হঠাৎ আমার হাতে একটা এনভেলাপ এলো। খুলে দেখি ওটা তার মজলিসে শূরা থেকে ইস্তফাপত্র। আমি বিশেষ কোনো চিন্তা না করে ওটা প্রত্যাখ্যান করলাম। পরে আর একটা বিরাট পত্র এলো যা পড়ার ধৈর্য আমার ছিল না। আমি সরাসরি আলাপ করতে গেলাম। ফজলুল হক হলের পুকুরপাড়ে কয় ঘণ্টা আলাপ হলো হিসাব নেই। ইসলামী আন্দোলনের জন্য যে নৈতিক ও মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন তার কিছুই আমার নেই। অথচ অনেক বেশিই আমাকে সামনে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এটা আন্দোলনের জন্য ক্ষতিকর হবে এবং আমার নিজের জন্যও। এ অভিযোগের জবাব আমি কী দিয়েছিলাম, মনে নেই। তবে সরাসরি কোরআন হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে কথা না বলা পর্যন্ত তাঁর মত পরিবর্তন করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

ক্ষুরধার লেখনী

শহীদ আবদুল মালেক বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা, আর ইসলামী আন্দোলনের বড় দায়িত্ব পালনের পরও তিনি যা লিখে গেছেন তা সত্যিই অবাক করার মতো। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তার প্রবন্ধগুলো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তার প্রায় সব লেখাই শাহাদাতের পূর্বে ২-৩ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ জীবনের উদ্দেশ্য যখন তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল এবং আদর্শ প্রতিষ্ঠার চিন্তা তার মাথায় বিপ্লবী রূপ ধারণ করেছিল, তখন তিনি দ্বীন প্রতিষ্ঠার এক অনন্য উপায় হিসেবে কলম হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিকীতে প্রকাশিত হয় ‘সংশয়ের আবর্তে আমাদের জীবন’ নামে একটি প্রবন্ধ। প্রবন্ধটিতে লেখক জীবনের কোন উদ্দেশ্য খুঁজে না পেয়ে অযৌক্তিক অনেক কিছু লিখেন। প্রতিবাদে সোচ্চার হলো আবদুল মালেকের লেখনী। তিনি লিখলেন, তথ্যবহুল এক বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘প্রত্যয়ের আলোকে আমাদের জীবন’। আধুনিক বস্তুবাদী জীবন দর্শনের ভিতমূলে আঘাত হানলো তার এ যুক্তিপূর্ণ প্রবন্ধটি। ‘ধর্ম ও আধুনিক চিন্তাধারা’ তার আর এক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। মাসিক পৃথিবীতে ‘আধুনিক বিশ্ব’ শিরোনামে নিয়মিত কলাম লিখতেন তিনি। ইসলামী কমিউনিজমের প্রবক্তাদেরকে এবং ডারউইনকে ব্যঙ্গ করে লেখা ‘হুজুর কেবলার দরবারে’ ও ‘জনৈক বিজ্ঞানগুরুকে লিখছি’ তার সুন্দর রস রচনা। এর মধ্যে হাস্যরস যেমন আছে, তেমনি আছে যুক্তি ও তথ্য। শহীদ আবদুল মালেকের লেখা বিভিন্ন চিঠিতেও তার অসামান্য ক্ষুরধার লিখনির দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। জনৈক কামরুলের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘পৌঢ়দের দ্বারা কোন বিপ্লব হবে না। আলী, খালিদ, তারিক, মুহম্মদ বিন কাশিম আর কোতায়বার মত নওজোয়ানরাই কেবল ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারে। সব বাধাকে তুচ্ছ করে গাঢ় তমসার বুক চিরে যেদিন আমরা পথ করে নিতে পারব সেদিন আমরা পৌঁছব এ দুর্গম পথের শেষ মঞ্জিলে। আর সেদিনই হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, যে দিন আমাদের চরিত্র হবে হযরত ইউসুফের (আ) মত সেই দিনই- কেবল সেই দিনই আসবে সাফল্য।’ হ্যাঁ তিনি বিপ্লব হয়তো দেখে যেতে পারেননি, দুনিয়ায় তার হাতে সাফল্য হয়তো ধরা দেয়নি, কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আল্লাহর সন্তুষ্টি তিনি ঠিকই অর্জন করেছেন।

অন্যের জন্য নিজের কষ্ট বরদাস্ত

শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ভাই তার ছাত্রজীবনে শহীদ আবদুল মালেকের সাথে ঘটে যাওয়া কিছু স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ’৬৯ এ দেশে তুমুল আন্দোলন চলছে। তদানীন্তন ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা আবদুল মালেক ভাই এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আমি তখন জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। ইন্টারমিডিয়েট হোস্টেলে থাকি। মালেক ভাই জামালপুরে গিয়েছিলেন। তিনি ঢাকা থেকে রাতের ট্রেনে জামালপুর যান। স্টেশন থেকে নেমে আমার হোস্টেলে যান তখন রাত প্রায় দেড় থেকে দু’ঘণ্টা আছে। তিনি আমার দরজায় নক না করে আমার কক্ষের সামনে হ্যান্ডব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কোন একজন আমাকে ডেকে দিতে চেয়েছিল কিন্তু তিনি ডাকেননি এবং কাউকে ডাকতেও দেননি। ফজরে নামাজ পড়তে উঠে এভাবে তাঁকে আমার কক্ষের দরজায় দণ্ডায়মান দেখে স্বপ্নে দেখার মতোই মনে হয়েছিল। তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন কেন? জিজ্ঞাসা করার আগেই বুকে জড়িয়ে কুশল জিজ্ঞেস করলেন। তখন আমি অভিমানের সুরে মালেক ভাইয়ের দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলাম। তখন তিনি জবাবে বললেন, আপনার রুমমেটের ঘুমের ডিস্টার্ব হতে পারে ভেবে আপনাকেও ঘুম থেকে জাগাইনি। আমার রুমমেট বেচারা তো এ কথা শুনে অবাক! ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দৃঢ়প্রত্যয়

‘তৌহিদী জনতার এ দেশে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠা হবে ইনশাআল্লাহ। আমাদের লাশের ওপর দিয়েই শুধু এর ব্যতিক্রম হতে পারে।’ প্রত্যয়দৃপ্ত এ ঘোষণাটি ছিল শহীদ আবদুল মালেকের। আসলে কোনো আদর্শিক বিপ্লবকে সফল করতে হলে সে আদর্শের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। তাইতো ৯০% মুসলমানের এ দেশে একটি নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য যখন নূর খান শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়, তখন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠলো শহীদ আবদুল মালেকের নেতৃত্বে ইসলামী ছাত্রসংঘ। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরাও থেমে থাকলো না। শুরু হলো হক আর বাতিলের সেই চিরন্তন দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বে প্রাণ উৎসর্গ করার প্রয়োজন দেখা দিলো। তখন সংঘের প্রতিটি শূরা বৈঠকেই ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার ওপর প্রস্তাব নেয়া হতো। শহীদ আবদুল মালেক বলতেন, এ সমস্ত অকেজো ধরনের প্রস্তাব নিয়ে কিছু হবে না। ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার জন্য রক্ত দিতে হবে, প্রাণ দিতে হবে। এ ছাড়া কেউ আমাদের কথা শুনবে না। শহীদ আবদুল মালেক শুধু যে নিজেকেই প্রস্তুত করেছিলেন, তা নয়। ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সেই আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে কার্জন হলে সংঘ আয়োজিত শতাধিক কর্মীর এক জরুরি কর্মিসভায় প্রদত্ত তাঁর বক্তব্য আজো অমর হয়ে আছে। “বাতিলকে গালেব করার জন্য যদি ছেলেরা পারে মায়ের বুক খালি করে রক্ত দিতে, পারে জীবন উৎসর্গ করতে, তবে আমরা যারা হকের জন্য, ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য তথা আল্লাহর দেয়া বিধান ইসলামকে কায়েমের আন্দোলন করছি বলে দাবি করে থাকি, আমরা কি এ ত্যাগ স্বীকার করতে পারব না? এর বদলে বাতিল শুধু দুনিয়াতেই কর্তৃত্ব পায়, পরকালে কিছুই পায় না। কিন্তু আমাদের সামনে তো দুনিয়া ও পরকাল দুটোই আছে। বাতিলের তরে যারা জীবন দিয়েছে তাদের বাবা-মা বা আত্মীয়-স্বজনরা যদি এখনও বেঁচে থাকতে পারে, তারাও যদি সান্ত¡না পেতে পারে তবে সত্যের জন্য, ইসলামের জন্য আমাদের কোরবানির পর আমাদের আব্বা, আম্মা ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য চিন্তা করতে হবে না।’ হ্যাঁ তিনি নিজেই জীবন দিয়ে শহীদি মিছিলের যে সূচনা করে গিয়েছেন, সে মিছিলে প্রতিনিয়তই যোগ দিচ্ছে তাঁর প্রত্যয়দৃপ্ত সাথীরা। আজকে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না হলেও সে সংগ্রাম আরো বেগবান হয়েছে। তাঁর প্রিয় কাফেলা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে একটি স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে।

লেখক : শহীদ আবদুল মালেকের বড় ভাইয়ের ছেলে

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির