post

ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের চিন্তার ব্যাপকতা

সাইফুল্লাহ মোহাম্মাদ তোফায়েল

১৮ এপ্রিল ২০২৪

ইসলামী আন্দোলনে শামিল হওয়া সম্মানিত সাথীদের চিন্তার ক্ষেত্রে ব্যাপকতা বা সার্বজনীনতা চাই। Comprehensivness যাকে বলে, সেই সার্বিক চিন্তা না থাকলে আন্দোলনের কাজে বেশিদিন সক্রিয় থাকা সম্ভব হয় না। সহজ ভাষায় আমাদের কিছু কথা আছে- “আমরা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর রাজ কায়েম করতে চাই, আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমরা চাই খোদাহীনতার বিরুদ্ধে একটি চাপের সঞ্চার করতে। গায়রুল্লাহর দাসত্ব থেকে মানুষকে ফিরিয়ে এনে এক আল্লাহর দাসত্বের শৃঙ্খলে নিয়ে আসতে। খোদাহীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূলোচ্ছেদ করে নবুয়্যতি সভ্যতা ও সংস্কৃতির পুনরুত্থান করতে চাই আমরা।

আমরা চাই সৎ লোকের শাসন কায়েম করতে, আর অসৎ লোকদের হাত থেকে নেতৃত্ব ছিনিয়ে এনে নেতৃত্বের চাবিকাঠি সৎ নেতৃত্বের হাতে দিতে। আমাদের আন্দোলন নিছক রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় কোনো আন্দোলন নয়; আমরা বৃহৎ অর্থে একটি জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর দল। আমরা চাই পৃথিবীতে এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব কায়েম করতে।” সুতরাং আমাদের উদ্দেশ্য যখন এত ব্যাপক, তখন আমাদের চিন্তায়ও থাকতে হবে ব্যাপকতা। এজন্য আমাদের যে জ্ঞানের প্রয়োজন, যে প্রজ্ঞার প্রয়োজন, যে রুহানিয়াতের প্রয়োজন, যে আমলি শক্তির প্রয়োজন, যে নৈতিক পবিত্রতা প্রয়োজন এবং যে আখলাকি শক্তির প্রয়োজন, তাঁর গোটা রসদই গ্রহণ করতে হবে কিতাবুল্লাহ (আল কুরআন) ও সুন্নাতে রাসূল (আল হাদীস) থেকে। জানতে হবে রাসুলুল্লাহ সা.-এর সিরাত, আসহাবদের (রা.) জীবনকথা । উপর্যুক্ত কথাগুলোকে মনের মধ্যে রপ্ত করে নিতে হবে। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে উপরে যা লিখলাম তা তো আমরা সবাই জানি, তাহলে চিন্তা কীভাবে করব? 

আমি উদাহরণের জন্য এখন দুটো পরিচিত হাদীস উল্লেখ করতে চাই। পরিচিত হাদীস উল্লেখ করার কারণ হলো, একই হাদীস আমাদের একেকজনের মনে কী কী চিন্তার উন্মেষ ঘটায় তার সম্মন্ধে সম্যক অবগত হওয়ার জন্য। 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে একবার একজন বেদুইন লোক দেখা করে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে এমন কাজের কথা বলুন, যা আমায় জান্নাতে নিয়ে যাবে। রাসূল সা. বললেন, “তা’বুদুল্লাহা ওয়ালা তুশরিকু বিহি শাইআ ওয়া তুকিমুস সালাতাল মাকতুবা ওয়া তুতিয যাকাতাল মাফরুজা ওয়া তাসুমু রমাদানা” অর্থ- তুমি আল্লাহর বন্দেগি করবে, তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবে না, ফরজ নামাজ আদায় করবে, নির্ধারিত যাকাত দান করবে এবং রমজানের রোজা পালন করবে।’’

আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখব, ইসলামের মূল লক্ষ্য ও নবী-রাসূলগণের দুনিয়ায় আগমনের মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ “ইসলামকে অন্য সকল ধর্ম ও মতবাদের উপর বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে”- এই আহ্বান কিন্তু হাদীসটিতে নেই। নেই পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন। অথচ হাদীসের শেষাংশে রাসূল সা. ঐ ব্যক্তি সম্মন্ধে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো জান্নাতবাসীকে দেখে চক্ষু শীতল করতে চায়, সে এই লোকটিকে দেখে নিক।’

আল কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী রাসূল সা.-কে আল্লাহ তায়ালা রিসালাতের ব্যাপারে কঠোরভাবে বলেছেন যে, “হে রাসূল! তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার কাছে যা কিছু নাযিল করা হয়েছে তা মানুষের কাছে পৌঁছাও। যদি তুমি এমনটি না করো, তাহলে তোমার দ্বারা তাঁর রিসালাতের হক আদায় হবে না।” [মায়িদাহ-৩৭] 

সুতরাং সন্দেহাতীতভাবে চিরন্তন সত্য হলো রাসূল সা. মানুষকে দ্বীন ইসলামের পূর্ণাঙ্গ দাওয়াত দিয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠা করেছেন। হাদীসটিতে এক বাক্যেই ঐ ব্যক্তিকে জান্নাতি ব্যক্তি বলার যে সংকীর্ণ অর্থ আমরা গ্রহণ করছি, বাস্তবিক অর্থে আমাদের প্রিয় নবী সা. তা বলেলনি। বেদুইন লোককে তিনি যে কথাগুলো বলেছিলেন, তা ছিল মূলত রাসূল সা.-এর ধারাবাহিক শিক্ষাদানের একটি প্রক্রিয়ার অংশ। অর্থাৎ এই লোক পরকালে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের শিক্ষা পেয়ে গেছেন। তিনি রাসূল সা.-এর সাথে জিহাদে অংশগ্রহণ করতে প্রস্তুত। নিজের জান  ও মাল ইতোমধ্যে আল্লাহর রাহে সঁপে দিয়েছেন। এজন্যই তিনি স্পেশালি অন্যান্য আমলিয়াতের ব্যাপারেও জেনে নিলেন, যেন আল্লাহর কাছে তাঁর আমলের খাতাটা আরও বড় করা যায়।

আমরা যখন আল কুরআন পড়ি, তখন এমন কিছু আয়াত দেখতে পাই যা আমাদেরকে তাৎক্ষণিক জান্নাতে যাওয়ার ব্যাপারে অধিকতর আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। হ্যাঁ, আল কুরআনের সম্মোহনী শক্তি এতটাই প্রখর যে, যেকোনো পাপী ব্যক্তিও এই কুরআন একবার পড়লে তার অন্তর ঈমানের আলোয় আন্দোলিত হয়। তখন মনে হয় আলহামদুলিল্লাহ! এই আয়াতটির বাস্তব রূপ আমার মধ্যে আছে। আমি পরকালে বিশ্বাস করি- আল কুরআনে বলা হয়েছে এর পুরস্কার দেওয়া হবে। আমি ঈমান এনেছি কিতাবসমূহের ওপর- এজন্য আমি পুরস্কৃত হব। আমি ঈমান এনেছি ফেরেশতা, নবী-রাসূলদের ওপর। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে।

আরেক ধরনের আয়াত পাওয়া যায় কুরআনে এরকম- যারা অধিকতর পরহেজগার, আল্লাহ তাদেরকে জান্নাত দান করবেন। যারা সৎকর্মশীল, তাদের জন্যও রয়েছে জান্নাত। সুতরাং এ সকল আয়াত যখন আমরা দেখি, স্বাভাবিকভাবেই আমরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ি। কারণ, আমরা এ সকল ক্রাইটেরিয়া ভালোভাবেই মেনে চলি জন্যই এমনটা অনুভূত হয়। শুধু তা-ই নয়; নামাজ বেহেশতের চাবি। নামাজ মুমিনের মেরাজস্বরূপ। দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। এখানে কোনো হাদীসই কম গুরুত্বপূর্ণ এমন নয়। রাবির দিক থেকে সব হাদীসই গ্রহণযোগ্য। এরকম অসংখ্য হাদীস আমরা পাই, যা আমাদের জান্নাত সম্মন্ধে একধরনের বুঝ তৈরি করে দেয়। 

২. এখন আমরা বোঝার জন্য আরেক ধরনের হাদীস পেশ করব। হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রা. বলেন, আমাকে লোকদের সাথে যুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল এই সাক্ষ্যদান করে, নামাজ কায়েম করে, যাকাত আদায় করে। আর তারা যখনই এই কাজগুলো সম্পাদন করল, তখনই তাদের জান ও মাল আমার থেকে বাঁচিয়ে নিল। এরপর তাদের হিসাব আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ। 

আমরা খেয়াল করে দেখব, এই হাদীসে রাসূল সা. তাঁর বিখ্যাত একজন সাহাবীকে অনেক বড় কিছু কাজের কথা বলে দিচ্ছেন। প্রথম হাদীসে ব্যক্তির তারবিয়ত বা প্রশিক্ষণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে আর দ্বিতীয় হাদীসে ইসলামী রাষ্ট্র গঠন, রক্ষা করা, যাকাত আদায়ের ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্ক করা ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে। 

হাদীস দুটো থেকে আমরা বুঝতে পারি, একটি ব্যাপারে সুসংবাদ পেয়ে গেলেই আমাদের জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য স্থায়ী কোনো উপসংহারে পৌঁছে যায় না; বরং প্রথম থেকে শুরু করে রাসূলের জীন্দেগানির ২৩ বছরে ঘটা, সৃষ্টি হওয়া খুটিনাটি প্রতিটি কথা, কাজ, সকল আদেশ, বিধি-নিষেধ নিজের জীবনের জন্য কবুল করে একটি সুনির্দিষ্ট পথে যাত্রা করাই হলো জীবনের লক্ষ্য। 

এখন কোনো মুসলমান যদি এই বিধিবিধান ও পূর্ণাঙ্গ হেদায়াত থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কোনো একটি মাত্র আয়াত বা হাদীস আকড়ে ধরে থাকেন এবং তা থেকে এই অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, সম্ভবত সৎকর্ম ছাড়া ঈমান আনলেই, জিহাদ ছাড়া আমল করলেই, ইকামাতে দ্বীনের কাজ ছাড়া অন্যান্য সকল ধর্মীয় কাজ করলেই, মুসলমানদের অধিকার নিয়ে কাজ করলেই (যদিও এতে সংকীর্ণ অর্থে অর্ধেক জাতীয়তাবাদী ও অর্ধেক সেক্যুলার রাজনীতি মিশ্রিত আছে) হেদায়েত নিশ্চিত হয়ে যাবে- তাহলে এতে ব্যক্তির চিন্তার ক্ষেত্রে ব্যাপকতা প্রকাশ পায় না। বরং একধরনের ‘সংকীর্ণ ইসলাম’ চিন্তা তাকে গ্রাস করেছে বলে প্রতীয়মান হয়।

দ্বীন কায়েম একটি ক্রীয়াশীল বা কর্মমূখী কাজ। এটি করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কাজ করতে হয়। প্রতি ক্ষণে ও সময়ে কর্মসূচি প্রণয়নের দরকার পড়ে- যা আমরা রাসূলের নবুয়্যতের গোটা জিন্দেগিতে দেখতে পাই। কুরআন পড়লে সাথে সাথে আমাদেরকে এটাই মাথায় রাখতে হবে যে, এই অবস্থাটা রাসূলের সাথে ঘটেছে। যেমন : আল কুরআনের সূরা কাহাফে আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে বলছেন, “হে মুহাম্মাদ! যদি এরা (তোমার) এ শিক্ষার প্রতি ঈমান না আনে, তাহলে দুশ্চিন্তায় তুমি হয়তো এদের পেছনে নিজের প্রাণটি খোয়াবে।” তার মানে নবী মুহাম্মদ মানুষদেরকে রিসালাতের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা দেওয়ার জন্য এতই কর্মচঞ্চল ছিলেন, যেন তাঁকে দেখলে মনে হতো এই বুঝি প্রাণটাই চলে যাচ্ছে! কুরআনের আয়াত থেকে বাস্তবে ঘটা সকল ঘটনার উপলব্ধি এবং রাসূলের জীবনে বাস্তবে ঘটা সকল ঘটনা কুরআন, হাদীস ও সিরাতে খুঁজে পাওয়ার উপলব্ধি করতে হবে। 

এই উপলব্ধির জন্য আমাদেরকে নিশ্চয়ই ঐ কিতাব-পত্রই পড়তে হবে, যা রাসূলের দৈনন্দিন জীবনের আমল, আখলাক, যুদ্ধ, সন্ধি, দাওয়াত ও সংগঠিত জীবন সম্পর্কে সম্মুখ অবগত করে । কিন্তু এ সকল সাহিত্য না পড়ে যদি এমন সব সাহিত্য পড়ি বা রচনা করি, যার মধ্যে রাসূলের জিন্দেগানির ধারাবাহিক কার্যক্রমের কোনো পরিকল্পনা নেই, কর্মপদ্ধতি সম্মন্ধে আইডিয়া নেই এবং সার্বিক জীবনব্যবস্থা নিয়ে নেই কোনো আলোচনা, তাহলে কি আমাদেরকে সেই সাহিত্য পরিপূর্ণতা দান করবে?

বর্তমান সময়ের বেশ কিছু নতুন নতুন বই-পুস্তক আমরা দেখতে পাই- যেখানে চিন্তার ক্ষেত্রে ইসলামের যে ব্যাপকতা থাকা দরকার তা অনেকটাই পাওয়া যায় না। যেমন : এক লেখায় আমরা দেখলাম, যেখানে একজন কর্পোরেট একজন মুসলিম ব্যক্তির কথা টেনে নিয়ে বলা হয়েছে- আমাদেরকে উনার মতো সৎ চাকরিজীবী হতে হবে।  তিনি ভালো বেতনে চাকরি করেন। অফিসে সঠিকভাবে খাতা মেইনটেইন করেন। রাস্তায় আসা-যাওয়া করতে করতে তিনি দোয়া ও দুরুদ পড়েন। এমনকি রুজিতে কোনো হারাম মিশ্রিত নেই উনার। বলা হচ্ছে এই ধরনের মানুষের জন্য রয়েছে মুক্তি। উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে তরুণ প্রজন্মকে। তরুণরা যেন উনার মতো ধার্মিক ও ভালো ক্যারিয়ারিস্ট হয়।

নিঃসন্দেহে এই চাকরিজীবী ভাইটির হালাল রুজি এপ্রিশিয়েটেড। উনি দোয়া দরুদ পড়েন, আলহামদুলিল্লাহ। উনি যে মাপের সৎ ব্যক্তি, তা হয়তো আমাদের জন্য অনুসরণীয় হবে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো- ইসলাম কি শুধু এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ? প্রথমত বাংলাদেশ একটি জুলুমতান্ত্রিক দেশ। ফাসেকদের রাজত্ব চলছে এখানে। সমাজের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি দিক ও বিভাগে রয়েছে অসৎ ব্যক্তিদের উল্লাস। অন্যদিকে ভারতীয় আধিপত্যবাদ গিলে খাচ্ছে আমাদের। একদিকে ইসলামী আন্দোলনের ব্যাপারে তারা খরগহস্ত, অন্যদিকে আমাদের সার্বভৌমত্বের জন্যও তারা হুমকিস্বরূপ। এমতাবস্থায় এ দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কোন ধরনের কর্মসূচী দেওয়া উচিত? অথচ এসব বইপত্র দেশে লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হচ্ছে। আর অনেকে ধরে নিচ্ছেন আসলে ইসলামের বিজয়ই হচ্ছে।

শুধু আমাদের চিন্তার দৈন্যতার কারণে, চিন্তার সংকীর্ণতার জন্যই এমনটা মনে হচ্ছে। মুসলমানদের চিন্তার এহেন দুরবস্থার জন্য আমাদেরকে আমাদের অতীতের স্বর্ণযুগে ফিরে যেতে হবে। সেখানে আমরা দেখতে পাব ইসলামী আন্দোলনের জন্য, ইসলামের বিকাশের জন্য, ইসলামী শক্তির উত্থানের জন্য এবং নাজাত বা মুক্তির জন্য কীরকম কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করতে হতো।

আমরা এ ব্যাপারে সহীহ বুখারী, আবু দাউদ ও নাসাঈ শরীফের একটি হাদিস পেশ করছি, যে হাদীসটি একেবারেই প্রথম সময়কালের সাহাবিদের মধ্যে একজন হযরত খাব্বাব ইবনে আরাত (রা.) বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, যে সময় মুশরিকদের কঠোর নির্যাতনে আমরা ভীষণ দুরবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়েছিলাম, সে সময় একদিন আমি দেখলাম নবী (সা.) কা’বাঘরের দেয়ালের ছায়ায় বসে রয়েছেন। আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আপনি কি আমাদের জন্য দোয়া করেন না? এ কথা শুনে তাঁর চেহারা আবেগে-উত্তেজনায় রক্তিমবর্ণ ধারণ করল এবং তিনি বললেন- “তোমাদের পূর্বে যেসব মু’মিন দল অতিক্রান্ত হয়েছে, তারা এর চাইতেও বেশি নিগৃহীত হয়েছে। তাঁদের কাউকে মাটিতে গর্ত করে তার মধ্যে বসিয়ে দেওয়া হতো এবং তারপর তাঁর মাথার ওপর করাত চালিয়ে দু’টুকরা করে দেওয়া হতো। কারও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সন্ধিস্থলে লোহার চিরুনি দিয়ে আঁচড়ানো হতো, যাতে তারা ঈমান প্রত্যাহার করে। আল্লাহর কসম! এ কাজ সম্পন্ন হবেই, এমনকি এক ব্যক্তি সান’আ থেকে হাদ্বারামাউত পর্যন্ত নিঃশঙ্ক চিত্তে সফর করবে এবং আল্লাহ‌ ছাড়া আর কারও ভয় তার মনে থাকবে না।”

এই হাদীসটি থেকে জানা যায় ইসলামকে প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদেরকে কী পরিমাণ কষ্ট, নির্যাতন ও কী পরিমাণ পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। আল্লাহ তা’আলার সুন্নাতই হচ্ছে, ইসলামী আন্দোলনে যুক্ত হলে আমাদের পরীক্ষার সম্মুখীন হতেই হবে। তাও সেটা হবে বাস্তব পরীক্ষা; কোনো বায়বীয় পরীক্ষা নয়। আল্লাহ বলেন, 

লোকেরা কি মনে করে রেখেছে, “আমরা ঈমান এনেছি” কেবল এ কথাটুকু বললেই তোমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে, আর পরীক্ষা করা হবে না? আল্লাহ এখানে বলেই দিয়েছেন, আমরা ঈমান এনেছি এ কথা বলেই কাজ শেষ নয়। বাস্তব পরীক্ষা দিতে হবে। অপর আয়াতে বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার হয়ে যায় আমাদের জন্য- “তোমরা কি মনে করেছো তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে যাবে, অথচ এখনও তোমরা সে অবস্থার সম্মুখীন হওনি, যে অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী (ঈমানদার)গণ? তাঁরা সম্মুখীন হয়েছিল নির্মমতা ও দুঃখ-ক্লেশের এবং তাঁদেরকে অস্থির করে তোলা হয়েছিল। এমনকি রাসূল ও তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তাঁরা চিৎকার করে বলে উঠেছিল, আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে? (তখনই তাঁদেরকে সুখবর দেওয়া হয়েছিল (এই মর্মে যে) জেনে রাখো, আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে।” (আল বাকারাহ : ২১৪)

এই আয়াতগুলো পড়লে গা শিউরে ওঠে। আল্লাহ যখন নবী করিম সা.-কে এভাবে বলেছেন- যেহেতু সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তা সহ্য করে এসেছেন, এর বাস্তব সাক্ষী দিয়ে এসেছেন, এটা কী করে সম্ভব যে পরবর্তী যুগের মুসলমানদের আরও বেশি বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে না?

সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর পরীক্ষার বাস্তবতা ও মুহাম্মাদ সা.-এর উম্মতের আরও বেশি নির্যাতনের শিকার হওয়ার আলটিমেটাম আরেকটি বিষয় প্রমাণ করিয়ে দেয় যে, নিশ্চয়ই সাহাবায়ে কেরাম এত ছোট ও সংকীর্ণ কাজের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতেন না। এটা কী করে হতে পারে যে, মিনিমাম অর্জনের জন্য মাক্সিমাম ত্যাগ? অর্থাৎ একটি দিক ও বিভাগের প্রতিষ্ঠার জন্য সাহাবাগণ এত এত ত্যাগ ও বাস্তব পরীক্ষার সম্মুখীন হননি; বরঞ্চ ইসলামের সকল দিক ও বিভাগ অর্থাৎ ব্যক্তি ও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও রাজনীতি, সভ্যতা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি, পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক নীতি, আইন ও আদালত, আচার-ব্যবহার, দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাশক্তিসহ মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সমাজে ওহি’র চিন্তার আদলে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই নবী-রাসূলগণ এবং সাহাবায়ে কেরামগণ নির্যাতনের এমন বাস্তব সাক্ষী দিয়েছেন।

সুতরাং আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যেকোনো একটি আমলের বিষয়ে। যেকোনো একটি স্তরে সৎ হয়ে দ্বীনের কাজ করাকেই দ্বীন বলে না; বরঞ্চ মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগ নিয়ে যখন আমরা কাজ করব এবং যখন আমরা এ সকল স্তরকে নবুয়্যতের আলোয় রঙ্গিন করব কিংবা করার চেষ্টারত থাকব, তখনই কেবল আমরা দাবি করতে পারি যে আমরা আমাদের চিন্তার ক্ষেত্রে ব্যাপকতা আনতে পেরেছি। মনে রাখতে হবে, আমরা চাই দুনিয়াতে সমস্ত মানুষ আল্লাহর দাসত্ব ও নবীর আনুগত্যের শৃঙ্খলে আসুক। মানব জীবনের সকল ধারা, সকল মতবাদ ও সকল দর্শন আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গিন হোক এবং অন্য সকল মতবাদ, অন্য সকল চিন্তা ও অন্য সকল আন্দোলন থেকে আমাদের আন্দোলন বিজয়ী হোক। সবার ওপরে থাকুক।

চিন্তার ব্যাপকতার ক্ষেত্রে আমাদেরকে সর্বপ্রথম নিজেদের উপলব্ধি বা বুঝের জায়গাটা শক্ত করতে হবে। আরবি ফাহম শব্দের অর্থ উপলব্ধি। বোধশক্তিসম্পন্ন হওয়া। অনেক জানার নাম ইলম নয়; বরং গভীর উপলব্ধির নামই হলো ইলম। আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন- আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাঁকে দ্বীনের গভীর উপলব্ধি দান করেন। আর এই উপলব্ধির জন্য প্রথমেই আমাদেরকে ভালোভাবে আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং এর কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে জানতে হবে। 

আর এজন্য ভালোভাবে পড়তে হবে। আত্মস্থ করতে হবে। আমরা অনেক সময় ভাসা ভাসা জ্ঞান রাখি। কারণ, ভালোভাবে বুঝে পড়ি না। এ ব্যাপারে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ.) বলেন, “যা কিছু পড়বেন চোখ খোলা রেখে পড়বেন। তুলনামূলক চিন্তা নিয়ে পড়বেন। কাজের বিষয়টা বের করে নেবেন। গ্রহণযোগ্য বিষয়টা গ্রহণ করে নেবেন- গ্রহণযোগ্য নয় এমন বিষয়কে নোট করবেন। সে ব্যাপারে অধিক অনুসন্ধান করতে হবে।”

এরপরে আমাদের মধ্যে আরেকটি শ্রেণি আছেন যারা শুধু জানা ও ব্যাপক জানার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। আপনি যে আদর্শ ও যে সত্যের আহ্বানে এসেছেন, সেই আদর্শের প্রতি আপনাকে নজরানা পেশ করতে হবে। আমাকে-আপনাকে কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। সকল নবীই ওহির জ্ঞানের পড়েই দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ শুরু করেছেন। সকল নবীরই শুরুতে দাওয়াত ছিল, “হে আমার স্বগোত্রীয় ভাইয়েরা! আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই।” (আল আরাফ-৫৯)।

খেয়াল করতে হবে এখানে কিন্তু ‘এক ইলাহ’-এর কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়টা উপলব্ধিতে আনতে হবে। আল্লাহ কিন্তু একক, অদ্বিতীয় এবং এক রাজাধিরাজ, শাসক ও বিচারক। এতে কারও কোনো হিস্যা নেই। আল্লাহ অপর আয়াতে বলেন, ‘দুই ইলাহ গ্রহণ করো না। ইলাহ তো মাত্র একজন। কাজেই তোমরা আমাকেই ভয় করো।’ (নাহল-৫১)

সুতরাং এক ইলাহের দিকে আহ্বান মানেই হলো এটি ক্রিয়াশীল কাজ। গতিশীল কাজ। প্রায়োগিক ও বাস্তবিক কার্যক্রম। এটি কোনো বায়বীয় বাণী নয়, যা শুধু মুখে আমরা ঈমান এনেছি উচ্চারণ করেই বসে থাকব; বরং এই ‘ইলাহ’ গ্রহণ করার অর্থ এর স্বপক্ষে কাজ হবে সার্বক্ষণিক। আল্লাহ যেমন বলেন, শুধু আল্লাহর ইবাদতের জন্যই আমাদের সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং আমাদের সার্বক্ষণিক অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টাই কাজের মধ্যেই থাকতে হবে। প্রতিদিন ইসলামী কার্যক্রম বৃদ্ধি করাই হলো ইবাদতের মূল শর্ত। আমরা সবাই একটি হাদিস জানি যা আমাদের রিপোর্টেও রয়েছে, “ধ্বংস তার জন্য যার আজকের দিনটি গতকালের চেয়ে উত্তম হলো না।” অর্থাৎ গতকাল আমি ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যা কাজ করেছি, আজ হবে তার দ্বিগুণ। কাল হবে আরও বেশি। পরশু তা আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। এটিই হচ্ছে চিন্তার ব্যাপকতার আরেকটি দাবি।

ব্যাপকতর চিন্তার আরেকটি মৌলিক দাবি হচ্ছে ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হওয়া। অর্থাৎ বিলীন হয়ে যাওয়া। ইসলামের মধ্যে আত্মনিয়োগ করা। ইসলামে আত্মলীন হয়ে যাওয়া। আমরা যেখানেই যাব, সেখানেই যেন ইসলামী আন্দোলনের জীবন্ত চিত্র ভেসে ওঠে। নবী করিম সা.-এর একটি হাদীসে তিনি বলেন, ‘তাদেরকে দেখলে যেন আল্লাহর কথা স্মরণ হয়! আল্লাহু আকবার।’

আমাদেরকে দেখে মানুষ যেন বুঝে যে সেই ইসলামী আন্দোলনের কর্মী। আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী ব্যক্তি। সাথে সাথে যেন মানুষের হৃদয়ে আল্লাহ ভয় জাগ্রত হয়। আমাদের অবস্থা এমন হওয়া উচিত, যেন সবকিছুতেই ইসলাম, ইসলামি আন্দোলনই আমাদেরকে ঘিরে রাখে। আমাদের সমস্ত বাসনা, কল্পনাশক্তি ও চিন্তাধারাতেই যেন ইসলামী আন্দোলনের উদ্দেশ্য থাকে। রাসূল সা. বলেন, “মানুষ পূর্ণ মুমিন তখনই হয়, যখন তার অবস্থা এ পর্যায়ে উপনীত হয় যে তার বন্ধুতা-শত্রুতা, দেওয়া না দেওয়া সবকিছুই নির্ভেজালভাবে একমাত্র আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। পার্থিব ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রেরণা তার জন্য খতম হয়ে যায়।”

আল্লাহর রাসূলের এ দুটো হাদীস এবং আমাদের চিন্তা ও কাজের ব্যাপকতা থেকে নিশ্চয়ই সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে আমাদেরকে চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি ও দ্বীনের কাজ পূর্ণাঙ্গভাবে  করতে হবে;  সংকীর্ণ অর্থে নয়। সবশেষে আমি আরেকটি কথা বলতে চাই, আমাদেরকে আগে বুঝে নিতে হবে আমরা কী চাই। আর তা কীভাবে চাই সেটিও আত্মস্থ করে নিতে হবে। তবেই আমরা মহান মঞ্জিলে পৌঁছতে সক্ষম হব। আমাদের জীবনের সমস্ত ইবাদত, চিন্তা-ভাবনা, আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা, আমলিয়াত, ফাহম সব কিছুই নবুয়্যতি আদর্শের আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে । আর সে অনুপাতেই আমাদের চিন্তাশক্তি আরও ব্যাপকতর হতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক, বলেন- “মানুষ পূর্ণ মুমিন তখন হয়, যখন তার অবস্থা এ পর্যায়ে উপনীত হয় যে তার বন্ধুতা-শত্রুতা , দেওয়া না দেওয়া, সবকিছুই নির্ভেজালভাবে একমাত্র আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। পার্থিব ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রেরণা তার জন্য খতম হয়ে যায়।”

আল্লাহর রাসূলের এ দুটো হাদীস এবং আমাদের চিন্তা ও কাজের ব্যাপকতা থেকে নিশ্চয়ই সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে আমাদেরকে চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি ও দ্বীনের কাজ পূর্ণাঙ্গভাবে  করতে হবে; সংকীর্ণ অর্থে নয়। সবশেষে আমি আরেকটি কথা বলতে চাই, আমাদেরকে আগে বুঝে নিতে হবে আমরা কী চাই। আর তা কীভাবে চাই সেটিও আত্মস্থ করে নিতে হবে। তবেই আমরা মহান মঞ্জিলে পৌঁছতে সক্ষম হব। আমাদের জীবনের সমস্ত ইবাদত, চিন্তা-ভাবনা, আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা, আমলিয়াত, ফাহম সব কিছুই নবুয়্যতি আদর্শের আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। সেই অনুপাতেই আমাদের চিন্তাশক্তি আরও ব্যাপকতর হতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : ইসলামী আন্দোলনের কর্মী

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির