আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরপরই ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও মুজাদ্দিদগণ ইসলামী আন্দোলনের কার্যক্রমকে আলাদা আলাদাভাবে পরিচালনা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফলে আরবে ইখওয়ানুল মুসলিমিন, এশিয়ায় জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দেশসমূহে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য জোরালোভাবে কার্যক্রম চালু হয়। এসকল আন্দোলনে রয়েছে দীর্ঘদিনের ইতিহাস, ঐতিহ্য। রয়েছে হাজার হাজার শাহাদাতের নজরানা। শাহাদাতে আলান্নাস এর দাবি নিয়ে লক্ষ লক্ষ যুবক, কিশোর-কিশোরী আন্দোলন করছেন, শহীদ হয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর শেষ হলে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই ইসলামী আন্দোলনগুলোর ওপর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও মার্কিন পুঁজিবাদ, ধর্মহীন গণতন্ত্র, লিবারেল সেক্যুলারিজম ও লিবারেলিজম হিংস্র আক্রমণ করে। যদিও ইসলামী আন্দোলনের রাস্তাটা কোনো সময়ই ফুলবিছানো ছিল না, আর থাকবেও না। তবুও এই শতাব্দীর শুরু থেকে আন্দোলনের ওপর চলতে থাকে নয়া ষড়যন্ত্র। এর মধ্যে পারিভাষিক ষড়যন্ত্র বেশ উল্লেখযোগ্য। যেমন: ইসলামী রাষ্ট্র, হিজাব, নারী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ইত্যাদি।
বাংলা অঞ্চলে ইংরেজদের দীর্ঘদিনের শাসন; অপরদিকে উসমানী শাসনামলের পতনে মুসলমানদের শেষ সম্বল মুসলিম ভূখণ্ড/রাষ্ট্র হাতছাড়া হতে থাকে। একে একে ইসলামী আইন বাতিল করে ব্রিটিশ শাসকরা এই অঞ্চলে তাদের তৈরি করা আইন প্রতিষ্ঠা করে যায়। মুসলমানদের হাতে নামমাত্র কিছু মাদ্রাসা ও ইবাদাতের জন্য কিছু মসজিদ থেকে যায়। আর রাষ্ট্র, বিচারালয়, সমাজ, সংস্কৃতি, যুদ্ধ, সবকিছু চলতে থাকে অনৈসলামিক আইনের মাধ্যমে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর আহ্বান নিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী আন্দোলন-এর সৃষ্টি হয়। উপমহাদেশে জন্ম হয় জামায়াতে ইসলামীর। ১৯৪৮ সালে বাংলাদেশ অঞ্চলে জামায়াতে ইসলামীর কার্যক্রম শুরু হয় এবং ছাত্রদের কার্যক্রম শুরু হয় এর কিছুদিন পরই।
জামায়াতে ইসলামীর মূল লক্ষ্য হলো, মানুষের জীবনের যতগুলো দিক ও বিভাগ আছে এবং সমাজের যতগুলো উপাদান (SOCIAL ELEMENTS) আছে, রাষ্ট্রের যতগুলো অর্গান (ORGAN OF STATE) আছে এবং পুরো পৃথিবীর যে ব্যবস্থাপনা আছে এর সকল দিক ও বিভাগকে নবুয়তের হেদায়াতের আলোকে পরিচালিত করা। মানুষের জীবনের সকল দিক ও বিভাগ যেমন: দর্শন, চিন্তাশক্তি, ধ্যান-ধারণা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ধর্ম ও নৈতিকতা, আইন ও আদালত, যুদ্ধ ও সন্ধি, সভ্যতা ও সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি ও অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, আচার-ব্যবহার ও দৃষ্টিভঙ্গি সব কিছুই পরিচালিত হবে আল্লাহর দাসত্ব এবং নবীগণের হেদায়াতের ওপর এবং একইসাথে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে সকল প্রকার ফাসেক ও আল্লাহদ্রোহ নেতৃত্বের মূলোৎপাটন করে তাদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে এনে আল্লাহমুখী, আল্লাহভীরু, সৎ ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা। ইসলামে এই কাজগুলোকে বলা হয় দ্বীনে হক কিংবা হুকুমাতে ইলাহিয়ার কাজ। অন্য ভাষায় এটিই ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। আর এই কাজের নামই কুরআনের পরিভাষায় বলা হয় জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ। এটিই শাহাদাতে হক, এটিই ইকামাতে দ্বীন, এটিই তাজদিদে দ্বীন এবং এই কর্মসূচির বাস্তব ফল হলো একটি ইসলামী রাষ্ট্র। আমাদের আলটিমেট গোল বা লক্ষ্য হলো- ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা।
আমরা যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্র নিয়ে আলাপ করব সুতরাং এই টার্মের মধ্যেই আমরা থাকি। পৃথিবীর প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন রাসূল (সা) নিজে। পরবর্তীতে এই রাষ্ট্রের বিস্তৃত রূপ হলো খিলাফাতুন আলা মিনহাজিন নবুয়্যত এর অন্তর্ভুক্ত ভূখণ্ডগুলো। এই শাসনব্যবস্থা শেষ হওয়ার পর উমাইয়া, আব্বাসী, মুঘল আমল, সুলতানী আমল কোনো না কোনোভাবে, বিভিন্ন মাত্রা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ইসলামী ধারার রাষ্ট্র ছিল এবং এই রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন সময়ে মানবতা, নৈতিক শিক্ষা, শিল্প, জ্ঞান চর্চা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাহিত্যে মুসলমানদেরকে সার্ভ করেছে। ক্রুসেডাররা ইসলামী শাসনের অন্তর্ভুক্ত ভূখণ্ডের বিরুদ্ধে সামরিক ষড়যন্ত্র শুরু করে। শুধু সামরিক যুদ্ধেই নয় এমনকি তারা এক ধরনের ঘৃণ্য প্রোপাগান্ডায় মেতে ওঠে ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইসলাম, মুসলমান ও অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে পশ্চিমা শক্তিসহ অন্যান্য শক্তি খোলাখুলিভাবে আক্রমণে যায়। যার সর্বশেষ সংস্করণ হলো ইসলামী রাষ্ট্র ও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ওয়ার অন টেরর এর পর এটা ভিন্নমাত্রা পায়। তখন পশ্চিমাদের নিজেদের সৃষ্টি করা আইএসআইএস এর মাধ্যমে একটি ক্লোন ইসলামী রাষ্ট্র ক্রিয়েট করে। যার ভিত্তিই ছিল মুসলমানদেরকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করা। এদেরকে পুঁজি করে পশ্চিমা শক্তি ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বের ওপর প্রোপাগান্ডা পরিচালনা শুরু করে। এ থেকেই তারা এক ধরনের ভয় সৃষ্টি করেছে বিশ্বব্যাপী। ঠিক তখনি মুসলমানরা ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ শব্দগুলোর মধ্যে এক ধরনের ট্যাবু আবিষ্কার করেন। যা শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের জন্যই ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে মুসলমান জনগোষ্ঠী এবং ইসলামী আন্দোলনের ওপর। যার ভুক্তভোগী বেশির ভাগ বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন।
আমেরিকা, পশ্চিমা গোষ্ঠী ও ভারতীয় আধিপত্যবাদ- এই তিনটি শক্তির কাছে মূল শত্রু হলো আল ইসলাম। আর বাংলাদেশে মূলত এদের পাপেট সরকারই দীর্ঘকাল প্রতিষ্ঠিত ছিল। ফলে এই শক্তি আমাদেরকে রাজনৈতিক, ইসলামিক, কালচারাল ও নৈতিক সকল ক্ষেত্রেই পরাজিত করতে মরিয়া হয়ে থাকত। এজন্য এরা ‘ইসলামী রাষ্ট্র’, ‘হিজাব’, ‘নারী’, ‘সংখ্যালঘু’, ‘ফ্রি মিক্সিং’, ‘সমকামিতা’ ইত্যাদি বিষয়ের সাথে সব সময়ই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকত এবং এই টার্মগুলো দিয়েই ইসলামী আন্দোলনকে ইসলামের শত্রুদের সাহায্যে কোণঠাসা করে রাখত।
হাল আমলে এজন্যই আমরা কল্যাণরাষ্ট্র, হিজাবের ব্যাপারে সরলতা, নারী-পুরুষের প্রাধান্য নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পারিভাষিক কথা শুনতে পাই। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শুনা যায় ‘কল্যাণরাষ্ট্র’ শব্দটি। দেখুন প্রথমেই বলে যাক, ইসলাম একটি কল্যাণমুখী জীবনব্যবস্থার নাম। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে কল্যাণ কী এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ইসলামের দৃষ্টিতে ‘কল্যাণ বা খাইর’ হলো সেই কাজ, যে কাজ একজন ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ শান্তি, সুবিচার, পবিত্রতা ও পরকালে নাজাতের নিশ্চয়তা দান করে থাকে। কল্যাণের পথ হলো সেই পথ, যে পথ পবিত্র, নৈতিকতা সম্পন্ন ও আজাদির পথ। ইসলামে আজাদ বলা হয় সেই পথ বা ব্যক্তিকে যা দুনিয়ার গোলামিতে নিমজ্জিত না থেকে কেবল এক ইলাহ, এক রবের দাসত্ব ও বন্দেগি করে।
সূরা আল আরাফের ৩ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায়, তাফহীমুল কুরআনে উক্ত কথাটিই বলা হয়েছে। এখানে ‘রব’কে অনুসরণ না করে অন্য অভিভাবককে অনুসরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। দুনিয়ায় একজন ব্যক্তির অভিভাবক একজনই। তা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হোক কিংবা অরাজনৈতিক ক্ষেত্রে হোক কিংবা রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রেই হোক। সুতরাং বুঝা যায়, যিনি আল্লাহকে একমাত্র অভিভাবক মান্য করেন তিনিই মুক্ত। আর যিনি অন্য আরেকজন নেতা কিংবা গোষ্ঠীর কাছে নিজের রাজনৈতিক ও নৈতিক ইচ্ছা সঁপে দিয়েছেন তিনি দুনিয়ার গোলাম। আর আল্লাহকে মান্য করেছে বলে তিনিই আজাদ দাস এবং এই আজাদির মধ্যেই সবচেয়ে বড় কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
এরকম ফজরের দুই রাকাত সুন্নাতে কল্যাণ, দোয়ায় কল্যাণ, কুরআন শিক্ষাদানে কল্যাণ, কুরআন শিক্ষা অর্জনে কল্যাণ, সাদকা দানে কল্যাণ, জিহাদে মগ্ন থাকায় কল্যাণ ইত্যাদি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ইসলামে কল্যাণ শব্দটি মূলত একটি আধ্যাত্মিক (SPIRITUAL) উপাদান এবং এই শব্দটি সব সময় ইসলামের বিভিন্ন অনুষঙ্গের সাথেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে বর্তমান সময়। এই সময়ে যেভাবে ‘কল্যাণরাষ্ট্র’ ব্যবহৃত হচ্ছে সেটা নিয়ে আমি যথেষ্ট দ্বিধান্বিত। মুসলমানদের জন্য, ইসলামী আন্দোলনমুখী দলের জন্য এমন রাষ্ট্র কতটুকু কল্যাণকর! প্রথমত ইসলামী রাষ্ট্র ধারণার বিকল্প হিসেবে ‘কল্যাণরাষ্ট্র বা ওয়েলফেয়ার স্টেইট’ শব্দটির ব্যবহার হচ্ছে। এই ওয়েলফেয়ার স্টেইট মূলত কী?
Welfare state বা কল্যাণরাষ্ট্র: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে উইলিয়াম টেম্পল (William Temple) নামক জনৈক ব্যক্তি, CHRISTIANITY & SOCIAL ORDER নামক বইয়ে সর্বপ্রথম ‘Welfare State’ (ওয়েলফেয়ার স্টেইট) বা কল্যাণরাষ্ট্র শব্দটির প্রবর্তন করেন। তখন থেকেই এটি জনপ্রিয় হতে থাকে।
প্রচলিত ধারার ওয়েলফেয়ার স্টেইট এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়:
১. সামাজিক ন্যায়বিচার ২. সামাজিক নিরাপত্তা ৩. সার্বজনীন কল্যাণ ৪. অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ৫. মানবিক মর্যাদা ৬. উন্নয়ন ৭. গণতন্ত্র ৮. ব্যক্তি স্বাধীনতা ৯. সামাজিক বীমা ও ১০. দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি।
উক্ত পরিভাষাগুলো আমাদের দেশে হরহামেশা ব্যবহৃত হয়। যেমন: সাম্য, মানবিক মর্যাদা, শান্তি, সম-অধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রভৃতি শব্দগুলো এর কাছাকাছি শব্দ। প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামের ন্যায়বিচার, আদালত, মিযান, ইনসাফ, হক, ন্যায্যতা, ইসলামে নফসের স্বাধীনতা, ইসলামী হুকুমাত, আমীর, কাজি, ইত্যাদির মতো এত ওজনদার শব্দমালা বাদ দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে ধার করে গরিব শব্দগুলো ইসলামী আন্দোলনের সাথে কেন ব্যবহার করা হচ্ছে?
খোদ পশ্চিমা রাষ্ট্রেই কল্যাণরাষ্ট্রের অনেক সমালোচনা রয়েছে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ উমর চাপড়ার বই আমাদের উচ্চতর সিলেবাসে রয়েছে। ‘ইসলাম অ্যান্ড দ্য ইকোনোমিক চ্যালেঞ্জ’ বইটিতে তিনি ওয়েলফেয়ার স্টেইট এর সমালোচনা করেছেন এবং লেইসেজ ফেয়ার নীতি (LAISSEZ-FAIRE) যা পুঁজিবাদের একটি অর্থনৈতিক দর্শন, তিনি এর বিরোধিতা করেছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী-অর্থনীতিবিদ ও বিভিন্ন ইসলামী চিন্তক বলেছেন, আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্রের ভিত্তি মূলত ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। মোহাম্মদ উমর চাপড়া তার ‘Towards a Just Monetary System’ বইয়ে বলেছেন, কল্যাণরাষ্ট্রের অর্থনীতি মূলত সুদভিত্তিক অর্থনীতি। এছাড়া ধর্মীয় নৈতিকতাহীন এই ব্যবস্থা পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় আনতে পারে। যেহেতু ধর্মহীন নীতির ওপর বিশ্বাসী সেহেতু এটি পারিবারিক বন্ধন ধ্বংস করতে পারে। অতিরিক্ত ব্যক্তি স্বাধীনতার স্লোগানের জন্ম দিয়ে এটি মানুষকে নফস নির্ভরতার দিকে ডাকে এবং সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এই কল্যাণরাষ্ট্র ‘কর’ভিত্তিক, জাকাত ভিত্তিক নয়।
কল্যাণরাষ্ট্র ধারণা ভোগবাদী, পুঁজিবাদিতার দিকে আহ্বান করে। এর মধ্যে মুসলমানদের মুক্তি নয় এমনকি আধ্যাত্মিক কোনো উন্নতি সাধনও এর মূল উদ্দেশ্য নয়। সুতরাং আধুনিক ওয়েলফেয়ার স্টেইট বা কল্যাণরাষ্ট্র ধারণা মূলত পশ্চিমাদের তৈরি করা ফাঁপা বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। এটি কল্যাণের নামে লিবারেলিজম ও পুঁজিবাদ লালন করে থাকে।
এখন আমরা একটু দেখি পৃথিবীতে বর্তমানে কোন কোন রাষ্ট্রকে কল্যাণরাষ্ট্র বলা হয়? ‘World Population Review 2024 ২০২৪’ এর রিপোর্ট অনুযায়ী পৃথিবীতে সর্বাধিক কল্যাণরাষ্ট্র হলো-ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইডেন, আমেরিকা, ইতালি, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, জাপান, নেদারল্যান্ডস, স্পেইন, লাতভিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা এমনকি অবৈধ দখলদার ইসরাইলও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জেনে রাখা ভালো, ওসব রাষ্ট্রের অর্থনীতি অনেক ভালো, সামাজিক নিরাপত্তাও ভালো, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সাম্য মানবাধিকার ইত্যাদি অনেক ভালো। ফলে তারা ওয়েলফেয়ার স্টেইট এর আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে মূলত ওয়েলফেয়ার স্টেইট কী।
‘ইসলামী রাষ্ট্র’
এ পর্যায়ে আমরা দেখব ইসলামী রাষ্ট্র কী। সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ) বলেছেন, ইসলামী রাষ্ট্র মূলত এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে জাতীয়তাবাদের নাম গন্ধও থাকবে না। এটি একটি IDEOLOGICAL STATE বা আদর্শবাদী রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্বের একক দাবিদার আল্লাহ তায়ালা এবং এই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন প্রণেতা/ প্রয়োগকারী প্রধান হলেন মুহাম্মদ (সা)। আর সর্বোচ্চ তাকওয়াবান কর্মীরা হলেন এই রাষ্ট্রের কর্মকর্তা। তিনি ‘ইসলামী হুকুমাত কিসতরাহ কায়েম হ্যোতা হ্যায়’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ইসলামী রাষ্ট্রের মূল কথা হলো এই বিশ্ব সাম্রাজ্য আল্লাহর। এখানে কোনো ব্যক্তি, জাতি, গোষ্ঠী কিংবা গোটা মানবজাতিরও সার্বভৌমত্বের ওপর কোনো অধিকার নাই।
প্রশ্ন আসবে মানুষ হিসেবে তাহলে এই রাষ্ট্রে আমাদের অবস্থান কী? উত্তর হলো, এই রাষ্ট্রে আমরা কেবল আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করব। এটি এমন এক রাষ্ট্র হবে যেখানে সামষ্টিক ও ব্যক্তিগতভাবে আমাদের প্রত্যেককে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। জামায়াতে ইসলামী ও মাওলানা মওদূদীর সাহিত্য পড়ে আমরা পাই যে, “ইসলামী রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী, কোর্ট কাচারি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, আইন কানুন, কর ও খাজনা পরিচালনা পদ্ধতি, পররাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধ, সন্ধি প্রভৃতি সব বিষয়ই ধর্মহীন রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। সেক্যুলার রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ইসলামী রাষ্ট্রের কেরানি, এমনকি চাপরাশি হওয়ারও যোগ্য নয়। সে রাষ্ট্রের পুলিশ ইনস্পেক্টর জেনারেল (IGP) ইসলামী রাষ্ট্রের একজন সাধারণ কনস্টেবল হবারও যোগ্যতা রাখে না। ধর্মহীন রাষ্ট্রের ফিল্ড মার্শাল এবং জেনারেলরা ইসলামী রাষ্ট্রে সাধারণ সিপাহি পদেও ভর্তি হবার যোগ্যতা রাখে না।’’
সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে এটি একটি ইসলামী নৈতিকতা সম্পন্ন, পবিত্র, সত্যাশ্রয়ী রাষ্ট্র হবে। এতে অনৈসলামিক সংস্কৃতি তো দূরের বিষয় এর ধারণা পর্যন্ত থাকতে পারবে না।
এছাড়াও ইসলামী রাষ্ট্রের কতগুলো মৌলিক নীতি আছে। যেমন:
১. সার্বভৌমত্ব ধারণা : ইসলামী শাসনব্যবস্থা বা রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রথম মূলনীতি হলো- রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এককভাবে আল্লাহ তায়ালার। আল্লাহ তায়ালাই এই রাষ্ট্রের আইনি সার্বভৌমত্বের অধিকারী, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের অধিকারী। ঈমানদারদের শাসন হলো ‘খেলাফত’ বা আল্লাহর প্রতিনিধিত্বশীল শাসনব্যবস্থা। এখানে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তির সমষ্টি বল্গাহীন ঘোড়ার মতো কাজ করার কোনো অধিকার নাই। একমাত্র আল্লাহর কুরআন ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ অনুযায়ীই এই রাষ্ট্র চলবে। আল্লাহ বলেন, ‘‘যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ের ফায়সালা দিয়ে দেন তখন কোনো মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর সেই ব্যাপারে নিজে ফায়সালা করার কোনো অধিকার নেই। আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানি করে সে সুস্পষ্ট গোমরাহিতে লিপ্ত হয়।’’ (সূরা আহযাব-৩৬)
২. ইসলামী বিধান কায়েম : এই রাষ্ট্রের মৌলিক আরেকটি নীতি হলো- এই রাষ্ট্র কোনো রকম পরিবর্তন ও পরিবর্ধন, কৌশল ও যুগ পরিবেশের কথা বিবেচনা না করে ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে ইসলামী জীবন-বিধান প্রতিষ্ঠা করবে। রাষ্ট্র থেকে সব ধরনের মাসিয়াত দূর করবে এবং সব ধরনের ভালো কাজের তারা জন্ম দেবে। এই মূলনীতি নিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘‘এরা এমন সব লোক যাদেরকে আমি যদি পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দান করি তাহলে এরা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং খারাপ কাজে নিষেধ করবে। আর সমস্ত বিষয়ের পরিণাম আল্লাহর হাতে।’’ (সূরা হজ্জ-৪১)
৩. আদল : ইসলামী রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি হলো- এই রাষ্ট্রে সুবিচার কায়েম হবে। ধনী-গরিব, বড় পদবি-কিংবা ছোট পদবি, শ্রেণি, জাতি, সংখ্যালঘু হিসেবে করে কাউকে আলাদাভাবে বিচার করা হবে না। সবার ব্যাপারেই ন্যায়, পবিত্র ও সত্যনিষ্ঠ বিচার ফায়সালা করা হবে।
আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন, ‘‘তোমাদের পূর্বে যেসব উম্মাত অতিক্রান্ত হয়েছে, তারা এ জন্য ধ্বংস হয়েছে যে, নিম্ন পর্যায়ের অপরাধীদেরকে আইন অনুযায়ী শাস্তি দান করত, আর উচ্চ পর্যায়ের অপরাধীদেরকে ছেড়ে দিতো। সে সত্তার শপথ, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ নিহিত। আমার আপন কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করত, তবে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে ফেলতাম।’’ (খেলাফত ও রাজতন্ত্র)
৪. বিশ্বব্যাপী আল্লাহর বাণী গালেব : ইসলামী রাষ্ট্রের আরেকটি মূলনীতি হলো, বিশ্বব্যাপী এই রাষ্ট্র আল্লাহর বাণীকে গালেব করবে, জিন্দা করবে, বুলন্দ করবে। এরই লক্ষ্যে এই রাষ্ট্র তার ভূখণ্ড বৃদ্ধি করবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, “তাদের সাথে লড়াই করো যেন ফিতনা নির্মূল হয়ে যায় এবং দ্বীন পুরোপুরি আল্লাহর জন্য হয়ে যায়।” (সূরা আনফাল)
৫. মুনকার দমন ও মারুফ কাজের নির্দেশ দান : এই দুনিয়ায় যত অপকর্ম, যত অন্যায় ও দুর্নীতি হয় এর মূলে মূলত সরকার দায়ী থাকে। এদের মধ্যে ইসলামী আইন, ইসলামী নৈতিকতা না থাকার ফলে তারা দুনিয়ায় অপকর্ম করে বেড়ায়। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্র তার নৈতিকতা হারায়। ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ হলো সকল পাপাচার, দুর্নীতি, অনৈতিকতা, অন্যায়, জুলুম, খুন, ধর্ষণ সব কিছু সমূলে উৎপাটন করে তদস্থলে ভয়-ডরহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং আমল, আখলাক, সততা, ন্যায়, ইনসাফ, আদল প্রতিষ্ঠা করা। সাথে সাথে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা চালু করা। এর জন্য সমস্ত শক্তি নিয়োগ করবে।
৬. জবাবদিহিতা ও শুরা-ঈ পদ্ধতি : ইসলামী রাষ্ট্র ও এর সরকার হবে জবাবদিহিমূলক সরকার। এই সরকার মূলত আল্লাহর প্রতিনিধি। এখানে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত। সকল মানুষই খলিফা আর সবাই এখানে মতামতের ভিত্তিতে আলহুল হাল্লে ওয়াল আকদ এর মাধ্যমে একটি একক কর্তৃত্বশালী সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। ফলে এখানে জবাবদিহিতা নিশ্চিত এবং সকল কার্যই পরামর্শের ভিত্তিতে হবে।
যে কয়েকটা মূলনীতি আমরা এখানে আলোচনা করলাম এর মধ্যে কোনো একটিতেও বৈশ্বিক উন্নতি, পুঁজিবাদ কিংবা ভোগবাদিতার লেশমাত্র পাওয়া যাবে না। আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্র মূলত সেক্যুলারদেরই একটি প্রজেক্ট মাত্র। যখন সেক্যুলার ব্যবস্থা পরাজিত হয়েছে তখন অর্থনীতিকে মানুষের হাত বদলের মাধ্যমে একটি কাল্পনিক উন্নতি সাধন দেখানোই মূলত এই ব্যবস্থার কাজ। টাকা যত হাত বদল হয় ততই এর মূল্য বাড়ে। কল্যাণরাষ্ট্র প্রকল্পটি মূলত সেই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটাই আমাদের মধ্যে উপস্থাপন করছে যা এর আগে সেক্যুলারিজমের নাম ধরে আমাদের মাঝে এসেছিল। কল্যাণরাষ্ট্র বা ওয়েলফেয়ার শব্দটি একটি ষড়যন্ত্র। যদিও এটি কল্যাণকর শব্দই মনে হয় তবুও বুঝতে হবে পশ্চিমারা মূলত বিভিন্ন টার্মিনোলজি ব্যবহার করে পরিকল্পনা সাজায় আর এদের মূল টার্গেট হলো ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যাপারে জনমনে ভীতি সঞ্চার করা।
সুতরাং ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের চিন্তায় নামমাত্র একটি মুসলিম রাষ্ট্র, কিংবা ওয়েলফেয়ার মূলক রাষ্ট্র অথবা সার্বজনীন উন্নয়নমূলক রাষ্ট্র নয়, তাদের মন-মগজ ও মস্তিষ্কে একটি পরিপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র থাকবে যা মূলত আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত ও রাসূল (সা)-এর মাধ্যমে প্রদর্শিত রাষ্ট্র।
নদী যখন স্থির থাকে তখন এর নিচের অংশ বুঝা যায় না কী অবস্থায় আছে। যখন জোয়ার আসে তখন দেখা যায় নিচ থেকে অনেক নর্দমাযুক্ত, কাদাযুক্ত পানি বের হয়ে আসে। সমাজ বা কোনো আন্দোলনও এমন। ওপরের অংশ দিয়ে ভেতরের অংশ বোঝা যায় না। যখন ভেতরের পর্যালোচনা সামনে আসে তখন দেখা যায় চরিত্রহীনতা ও নিয়ত সমাজ ও আন্দোলনকে ধ্বংস করে ফেলে। সময় ও ক্ষণ যদিও স্থির আছে এর নিচের অংশে কী আছে বুঝা যাচ্ছে না।
ফলে ইমান, আমল, নিয়ত, ইহসান ও খুলুসিয়াত নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ করে যাওয়াই এখন মূল কাজ। যেন জোয়ার আসলে ইসলামী রাষ্ট্রের জোয়ার হয়-কল্যাণরাষ্ট্র কিংবা সেক্যুলার রাষ্ট্রের নয়। আল্লাহ আমাদেরকে একটি কার্যকর ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রকাশক ও চিন্তক
আপনার মন্তব্য লিখুন