post

ইসলামী আন্দোলনের পথে আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত হওয়াই আমাদের কাজ

১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

মকবুল আহমাদ#

Bishesh-Rochana3দ্বিতীয় পর্ব

হজরত আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা) আবু উবায়দা (রা) প্রথম ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম। হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) ইসলাম গ্রহণের দ্বিতীয় দিনে তারই প্রচেষ্টায় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু উবায়দা (রা)-এর মাক্কী জীবন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই অগ্নিপরীক্ষার এক দুর্বিষহ জীবন। প্রথম যুগে ইসলাম গ্রহণকারী অন্যসব সাহাবীর মতো তিনিও আর্থিক সঙ্কট, দুঃখ-কষ্ট, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। কিন্তু আবু উবায়দা (রা)-এর ঈমানী পরীক্ষা ইতিহাসে আদর্শের যেকোনো অনুসারীর বিচারে এক বিরল ঘটনা। প্রতিটি ঈমানী পরীক্ষাতেই তিনি ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে মহান আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শকে সমুন্নত করেছেন। কিন্তু বদরের যুদ্ধে তাঁর অকল্পনীয় ঈমানী পরীক্ষা অতীতের সব পরীক্ষাকে ম্লান করে দিয়েছে। বদর প্রান্তরে তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে আবু উবায়দা (রা) মৃত্যুকে পরওয়া না করে প্রচন্ড আক্রমণে শত্রুবাহিনীর দুর্ভেদ্য ব্যূহকে ছত্রভঙ্গ করতে সমর্থ হন। এতে মুশরিকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়ে যায়। এ সুযোগে আবু উবায়দা (রা) জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে শত্রুবাহিনীকে ধরাশায়ী করতে করতে সম্মুখপানে অগ্রসর হচ্ছিলেন ও তার চতুর্দিকে ঘুরে ফিরে আক্রমণ চালাচ্ছিলেন। কুরাইশ বাহিনীও বারবার তাকে প্রতিরোধ করার ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত ছিলো। এরই ফাঁকে শত্রুবাহিনীর ব্যূহ থেকে এক ব্যক্তি আবু উবায়দাকে (রা) বারবার চ্যালেঞ্জ করছিল। তিনিও আক্রমণের গতি পরিবর্তন করে প্রতিবারই তার সে চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। আবু উবায়দা (রা)-এর এই দুর্বলতার সুযোগে হঠাৎ সে তাঁর ওপর প্রচন্ড আঘাত হেনে বসল। তিনি তড়িৎগতিতে পাশ কাটিয়ে গেলে অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন। সে আবু উবায়দার (রা) সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে শত্রুনিধনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। ধৈর্যহীনতার চরম পর্যায়ে আবু উবায়দার (রা) তরবারির প্রচন্ড এক আঘাতে তার শির দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ল। প্রিয় পাঠক! ভূলুণ্ঠিত এ ব্যক্তি কে? আগেই আলোচনা করেছি, আবু উবায়দার (রা) ঈমান সর্বকালের কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় এমনভাবে উত্তীর্ণ যে, তা কোনো কল্পনাকারীর কল্পনারও ঊর্ধ্বে। স্তম্ভিত হবেন, ভূলুণ্ঠিত ব্যক্তির পরিচয়ে। সে আর কেউ নয়, সে হলো আবু উবায়দার পিতা আবদুল্লাহ ইবনে জাররাহ। এ ক্ষেত্রে আবু উবায়দা (রা) তার পিতাকে হত্যা করেননি। তিনি হত্যা করেছেন পিতার অবয়বে শিরকের প্রতিমূর্তিকে। মহান আল্লাহ তাঁর ও পিতার মাঝে সংঘটিত এ ঘটনা সম্পর্কে আল কুরআনের আয়াত নাজিল করলেন। “তুমি পাবে না আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী এমন কোনো সম্প্রদায় যারা ভালোবাসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধচারীদেরকে, হোক না এই বিরুদ্ধচারীরা তাদের পিতা, পুত্র ভ্রাতা অথবা তাদের জ্ঞাতি-গোত্র। এদের অন্তরে আল্লাহ সুদৃঢ় করে দিয়েছেন ঈমান এবং তাদের শক্তিশালী করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে রুহ দ্বারা। এদের প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেথায় তারা স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তার প্রতি সন্তুষ্ট, তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখো, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে। (সূরা আল-মুজাদালা : ২২) হজরত বারা’আ ইবনে মালেক (রা) হজরত বারা’আ ইবনে মালেক (রা) তার বাহিনীর যোদ্ধাদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন : হে আনসার ভাইয়েরা কখনো আপনারা মদীনায় ফিরে যাওয়ার চিন্তা করবেন না। এই মুহূর্ত  থেকেই আপনাদের জন্য আর মদীনা নয়; আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তাওহিদের বাণীকে চির সমুন্নত করে জান্নাতের দিকে অগ্রসর হোন। এই বলে তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে শত্রুবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বারা’আ ইবনে মালেক (রা) দক্ষতার সাথে দুইধারী তরবারি চালিয়ে তার দুই পাশের দুশমনদের ধরাশায়ী করে সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলেন। মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের যোদ্ধাদের শিরñেদ করতে করতে তিনি এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। এ আঘাতে মুসায়লামাতুল কাজ্জাব ও তার বাহিনীর মধ্যে হঠাৎ ভীতি ও ত্রাসের সৃষ্টি হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা যুদ্ধ ময়দানসংলগ্ন বাগানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো। যে বাগানটি পরবর্তী সময়ে অগণিত মৃতদেহের স্তূপের কারণে ‘হাদিকাতুল মাউত’ বা লাশের বাগান নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানাবিধ ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বাগানটি উঁচু ও প্রশস্ত দুর্ভেদ্য প্রাচীর দিয়ে বেষ্টিত ছিল। যুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে প্রাণ রক্ষার জন্য মুসায়লামাতুল কাজ্জাব ও তার অনুসারী যোদ্ধারা এ বাগানে আশ্রয় নিয়ে দ্রুত এর একমাত্র গেটটি বন্ধ করে দেয়। এভাবে নিজেরা নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে তার ভেতর  থেকে মুসলিম বাহিনীর ওপর বৃষ্টির মতো তীর বর্ষণ শুরু করে। এতে মুসলমানদের নিশ্চিত বিজয় আবার অনিশ্চয়তার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। মুসলিম যোদ্ধাদের পক্ষে তাদের মোকাবেলা করার সমস্ত পথ যেন রুদ্ধ হয়ে আসে। এ অবস্থায় মুসলিম বাহিনীর অন্যতম বীর সিপাহসালার হজরত বারা’আ ইবনে মালেক (রা) যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তনের মাধ্যমে শত্রুদের প্রতি এক চরম ও শেষ আঘাত হানার জন্য পরিকল্পনা নেন। তিনি তৎক্ষণাৎ একটি ঢাল সংগ্রহ করে তাঁর বাহিনীর লোকদের উদ্দেশ করে বললেন : আমি এ ঢালের ওপরে বসে পড়ি, তোমরা আমাকে উঁচুতে উঠিয়ে ১০-১২টি বর্শা ফলকের সাহায্যে তুলে এ গেটের  ভেতরে নিক্ষেপ কর। হয় আমি দুশমনদের হাতে শহীদ হয়ে যাবো অথবা ভেতরে গিয়ে তোমাদের জন্য এ বাগানের গেট খুলে দেবো। দেখতে না দেখতেই বারা’আ ইবনে মালেক আল আনসারী (রা) উন্মুক্ত তরবারি হাতে তার ঢালটির ওপর বসে পড়লেন। অত্যন্ত হালকা পাতলা ও ছিপ-ছিপে আনসার যুবক বারা’আকে কয়েকজনে খুব সহজেই ঢালে বসিয়ে মাথার ওপর তুলে নিলেন এবং সাথে সাথে অন্য কয়েকজন বর্শাধারী তাদের বর্শা ফলকে তাকে ওপরে তুলে গেটের ভেতরে মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের হাজার হাজার অনুগত যোদ্ধার মাঝে সজোরে নিক্ষেপ করলেন। বারা’আ অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের মাঝে বজ্রপাতের ন্যায় লাফিয়ে পড়ে অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে গেট রক্ষীবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তলোয়ার, বর্শা এবং তীরের উপর্যুপরি আঘাত তার গোটা দেহকে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলল; কিন্তু বারা’আ ইবনে মালেক আল আনসারী (রা) তাদের গেট রক্ষী বেষ্টনীর দশজনকে হত্যা করে পরিশেষে গেট খুলে দিতে সমর্থ হলেন। এ দিকে সাথে সাথে অপেক্ষমাণ বীর মুসলিম যোদ্ধারা আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে বাঁধভাঙা স্রোতের মতো ভেতরে ঢুকতে শুরু করলেন, যা ছিল এক নজিরবিহীন ভয়াল চিত্র। মুহূর্তে উভয় পক্ষের মধ্যে পুনরায় ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মুসলমানদের প্রচন্ড আক্রমণের মুখে মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের বাহিনী প্রাণ ভয়ে দিগি¦দিক ছোটাছুটি করতে লাগল আর মুসলিম যোদ্ধারা এ সুযোগে তাদেরকে দলে দলে নিঃশেষ করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। এমনকি শেষ পর্যন্ত মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের অবশিষ্ট বিশ হাজার সৈন্যের কবর রচনা করে তার দেহরক্ষী বাহিনীসহ তাকে ঘিরে ফেলে সবাইকে জাহান্নামের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করা হলো। সমস্ত বাগান বিশ হাজার মুরতাদের লাশের স্তূপে পরিণত হয়ে গেল। অন্য দিকে এই দুঃসাহসী বীর যোদ্ধা বারা’আ ইবনে মালেক আল আনসারী (রা) এ গেট খুলতে গিয়ে আশিটির অধিক তীর, বর্শা ও তরবারির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলেন, তাঁকে বিশেষ চিকিৎসার জন্য চিকিৎসা তাঁবুতে প্রেরণ করা হলো। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) দীর্ঘ এক মাস ধরে নিজে বারা’আ (রা)-এর খেদমতে নিয়োজিত থাকলেন। ধীরে ধীরে বারা’আ (রা) সুস্থ হয়ে উঠলেন। তাঁর এই মহান ত্যাগ এবং কোরবানির বদৌলতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তারই হাতে মুসলমানদের এ যুদ্ধে বিজয় দান করে জাজিরাতুল আরবকে চিরদিনের জন্য ভন্ডনবী ও মুরতাদের হাত থেকে পবিত্র করলেন। তাঁর জীবনের সর্বোচ্চ আকাক্সক্ষা যে, তিনি যেন শাহাদাতের মৃত্যুর মাধ্যমে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হতে পারেন। সর্বশেষ তিনি পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে মুসলমানদের তুসতর কেল্লা বিজয়ের জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। এই তুসতর কেল্লা বিজয়ের যুদ্ধে তিনি আল্লাহর দরবারে শাহাদাতের জন্য দোয়া করেছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর দোয়া কবুল করে নেন। এ যুদ্ধের এক পর্যায়ে তিনি শত্রুর তরবারির আঘাতে শাহাদাতের কোলে ঢলে পড়েন। বহু আকাক্সিক্ষত শাহাদাতের মাধ্যমে তিনি  রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্যের পথ রচনা করে পরবর্তী উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য প্রেরণা সৃষ্টি করে যান। জীবন্ত শহীদ হজরত তালহা (রা) ওহুদের ময়দানে নেতার আদেশ অমান্য করার কারণে সুস্পষ্ট বিজয় পরাজয়ে রূপান্তরিত হলো। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তীরন্দাজ বাহিনীর প্রতি আদেশ দিয়েছিলেন, তাঁরা কোনো অবস্থাতেই যেন গিরিপথ থেকে সরে না আসেন। কিন্তু যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছে দেখে তাদের একদল বলছিল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ বলবৎ ছিল যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার সময় পর্যন্ত। সুতরাং এখন বিজয় অর্জিত হয়েছে, এখন আর এখানে প্রহরা দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আরেক দলের অভিমত ছিল, যুদ্ধে জয়-পরাজয় বলে নয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরবর্তী আদেশ না আসা পর্যন্ত এখান থেকে সরা যাবে না। এ ধরনের মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়ার ফলে বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবা স্থান ত্যাগ করে সরে এসেছিলেন। এই সুযোগে মক্কার কুরাইশ বাহিনী অরক্ষিত সেই গিরিপথেই আক্রমণ করেছিল। তাদের আক্রমণে ওহুদের রণপ্রান্তরে মুসলিম বাহিনী চরমভাবে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল। মুসলমানদের রক্তে ওহুদের প্রান্তরে যেন প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। ইসলাম বিরোধীদের একমাত্র লক্ষ্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া। সাহাবায়ে কেরাম তখন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছেন। মুষ্টিমেয় কয়েকজন জানবাজ সাহাবা নিজেদের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘিরে রেখেছেন। শত্রুদের অস্ত্রের আঘাত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র শরীরে যেন না লাগে, এ জন্য সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘিরে মানববন্ধন তৈরি করে নিজেদের শরীরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হেফাজত করতে যেয়ে হজরত আম্মার ইবনে ইয়াজিদ শাহাদাত বরণ করলেন। কাফির বাহিনী নানা ধরনের অস্ত্র দিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আক্রমণ করছিল। এ সময় কাফিরদের তীরের আঘাতে হজরত কাতাদা ইবনে নুমান (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুর) চোখ কোটর ছেড়ে বের হয়ে এলো। মুখের কাছে এসে চোখ ঝুলতে থাকলো। হজরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে অবস্থান করে কাফিরদের দিকে তীর ছুড়তে থাকলেন। ‘আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তুনির থেকে তীর বের করে হজরত সা’দের হাতে দিচ্ছিলেন এবং বলছিলেন হে সা’দ! তোমার ওপর আমার মাতা-পিতা কোরবান হোক, তুমি তীর চালাও।’ হজরত আবু দুজানা আল্লাহর নবীকে এমনভাবে বেষ্টন করেছিলেন যে, কাফিরদের সমস্ত আঘাত তাঁর দেহেই লাগে এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন অক্ষত থাকেন। হজরত তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) এক হাতে তরবারি ও অন্য হাতে বর্শা নিয়ে নবীর ওপর আক্রমণকারীদেরকে প্রতিহত করছিলেন। এক সময় শত্রুর আক্রমণ এতটা তীব্র হলো যে, মাত্র ১২ জন আনসার আর মক্কার মোহাজির হজরত তালহা (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) ব্যতীত আর কেউ নবীর পাশে স্থির থাকতে পারলেন না। এ অবস্থায় কাফিরদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করলেন, ‘আক্রমণের মুখে শত্রুদেরকে যে পিছু হটাতে বাধ্য করবে সে জান্নাতে আমার সাথে অবস্থান করবে।’ হজরত তালহা (রা) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি শত্রুদেরকে আক্রমণ করবো।’ আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে অনুমতি দিলেন না। আনসারদের মধ্যে একজন বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি আক্রমণ করতে যাবো।’ আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে অনুমতি দিলেন। কিছুক্ষণ পরই তিনি শাহাদাত বরণ করলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার সেই আগের ঘোষণা দিলেন। হজরত তালহা (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) পুনরায় এগিয়ে এলেন। এবারও আল্লাহর নবী তাঁকে নিষেধ করলেন। এভাবে পরপর ১২ জন আনসারই শাহাদাতবরণ করলেন। এবার নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত তালহাকে (রা) এগিয়ে যাবার অনুমতি দিলেন। হজরত তালহা (রা) সিংহ বিক্রমে কাফিরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এর মধ্যেই পাপিষ্ঠ আবদুল্লাহ ইবনে কামিয়াহ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আঘাত করে তাঁর দান্দান মোবারক শহীদ করলো। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রক্তাক্ত হয়ে পড়লেন। হজরত তালহা আল্লাহর নবীকে হেফাজত করতে গিয়ে নিজের একটি হাত হারালেন। তিনি রক্তাক্ত দেহে এক হাতেই তরবারি ধারণ করে কাফিরদের আক্রমণ প্রতিরোধ করছেন এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজের কাঁধে উঠিয়ে নিলেন। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কাঁধে, কাফিরদের আঘাতে নিজের এক হাত বিচ্ছিন্ন। একটি মাত্র হাত দিয়ে তরবারি চালনা করে কাফিরদের আক্রমণ প্রতিহত করছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে নিরাপদ স্থানের দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। চরমভাবে আহত অবস্থায় একজন মানুষকে কাঁধে নিয়ে পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠা এবং শত্রুকে প্রতিহত করা ছিলো খুবই কঠিন ব্যাপার। হজরত তালহা (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুর) নিজের দেহের প্রতি লক্ষ্য ছিলো না। তাঁর দেহ থেকে তখন অবিরাম ধারায় রক্ত ঝরছিল। সেদিকে তাঁর ভ্রƒক্ষেপ ছিল না। তাঁর সমস্ত সত্তা দিয়ে তিনি তখন অনুভব করছিলেন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হেফাজত করতে হবে। এক সময় তিনি আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে পাহাড়ের এক গুহায় পৌঁছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাঁধ থেকে নামিয়েই জ্ঞানহারা হয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন। হজরত আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) বলেন, ‘আমি আর হজরত উবাইদাসহ অনেকেই অন্য দিকে যুদ্ধ করছিলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্ধানে এসে দেখলাম তিনি আহত অবস্থায় পড়ে আছেন। আমরা তাঁর সেবা-যতœ করতে অগ্রসর হতেই তিনি বলেন, ‘আমাকে নয়, তোমাদের বন্ধু তালহাকে দেখো।’ হজরত আবু বকর (রা) বলেন, আমরা দেখলাম তিনি জ্ঞানহারা হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর শরীর থেকে একটি হাত বিচ্ছিন্ন প্রায়। গোটা শরীর অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। ৮০টিরও বেশি আঘাত ছিল তাঁর শরীরে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হেফাজত করতে গিয়েই তিনি তাঁর হাত হারিয়েছিলেন এবং এতগুলো আঘাত সহ্য করেছিলেন। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরবর্তীকালে হজরত তালহা সম্পর্কে বলতেন, ‘কেউ যদি কোনো মৃত মানুষকে পৃথিবীতে বিচরণশীল দেখতে চায়, তাহলে সে যেন তালহাকে দেখে নেয়।’ হজরত তালহাকে ‘জীবন্ত শহীদ’ বলা হতো। ওহুদের প্রসঙ্গ উঠলেই হজরত আবু বকর (রা) বলতেন, ‘সেদিনের যুদ্ধের সমস্ত কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন হজরত তালহা (রা)। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত তালহা (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুকে) পৃথিবীতে জীবিত থাকতেই জান্নাতের সুসংবাদ দান করেন। হজরত হানযালা (রা)-এর শাহাদাত হজরত হানযালা (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) ওহুদের যুদ্ধে প্রথমে যোগ দিতে পারেননি। তিনি ছিলেন সুন্দর সুঠাম দেহের অধিকারী সুদর্শন যুবক। কথিত আছে সুন্দরী তন্বী-তরুণী এক ষোড়শীকে তিনি সবেমাত্র পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করেছিলেন। সেদিন ছিল তাঁর বাসর রাত। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি বাসর রাত অতিবাহিত করেছেন। ফরজ গোছল আদায়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন হজরত হানযালা (রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু)। এমন সময় তিনি সংবাদ পেলেন ওহুদের ময়দানে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাতিল কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি ফরজ গোছল উপেক্ষা করে তরবারি হাতে ওহুদের ময়দানের দিকে ছুটলেন। আল্লাহর এই ব্যঘ্র ‘আল্লাহু আকবার’ বলে গর্জন করে শত্রু বাহিনীর ভেতরে প্রবেশ করে শত্রু নিধন করতে থাকলেন। শত্রুর অস্ত্রের আঘাতে এক সময় তিনি শাহাদাত বরণ করলেন। যুদ্ধ শেষে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শহীদানদের দাফন করছেন। এমন সময় হজরত হানযালার (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুর) সদ্য বিবাহিতা এবং বিধবা স্ত্রী এসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার স্বামীর ওপর গোছল ফরজ ছিল, তাঁকে গোছল না দিয়ে দাফন করবেন না।’ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবীর লাশের সন্ধান করবেন, এ সময় হজরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবগত করলেন, ইয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! হানযালাকে গোছল দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। মহান আল্লাহ তাঁর ওপর এত খুশি হয়েছেন যে, ফেরেশতাদের মাধ্যমে তাঁকে গোছল করিয়েছেন।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে এ কথা জানিয়ে দিলেন। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম হজরত হানযালা (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুর) লাশের কাছে গিয়ে দেখলেন, তাঁর লাশ থেকে জান্নাতি সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে আর মাথার চুল ও মুখের দাড়ি থেকে সুগন্ধযুক্ত পানি ঝরছে। পৃথিবীর সমস্ত আকর্ষণের মাথায় পদাঘাত করে হজরত হানযালা (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) ওহুদের রণক্ষেত্রে ছুটে এসেছিলেন। মহান আল্লাহ তাঁকে তাঁর এই উত্তম কর্মের পুরস্কার কিভাবে দান করেছিলেন, পৃথিবীর মানুষ তা ওহুদের রণক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করেছিল। হজরত আমর ইবনে জামুহ (রা)-এর শাহাদাত হজরত আমর ইবনে জামুহ (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) ছিলেন পঙ্গু। মসজিদে নববীর অদূরেই তিনি বাস করতেন। এই সাহাবী ঠিকভাবে হাঁটতে পারতেন না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন তিনি। তবুও তিনি যুদ্ধে যাবেন। পিতার জিদ দেখে তাঁর সন্তানগণ তাঁকে আটকিয়ে রেখে তাঁর চার সন্তান ওহুদের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে আবেদন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার সন্তানগণ আমাকে যুদ্ধে যেতে দিতে দিচ্ছে না। আমার ইচ্ছা আমি আল্লাহর পথে শাহাদাতবরণ করে জান্নাতে এভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটবো।’ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “আল্লাহ তোমাকে জিহাদের দায়িত্ব থেকে মুক্তিদান করেছেন।” এরপর তিনি হজরত আমরের সন্তানদের বললেন, ‘‘তোমাদের পিতা যদি যেতে চায় তাহলে বাধা না দিলেও পারো। আল্লাহ তাঁর ভাগ্যে শাহাদাত লিখে রাখতে পারেন।” হজরত আমরের (রা) সন্তানগণ ওহুদের দিকে চলে গেল। তিনি ভাবলেন, তাঁর সন্তানগণ যদি শাহাদাতবরণ করে, তাহলে তাঁর আগেই তাঁরা আল্লাহর জান্নাতে যাবে। হজরত আমর (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) দেখলেন, একজন কিশোর তরবারি ঝুলিয়ে তাঁর দিকেই আসছে। কিশোর এসে তাঁর কাছে দোয়া চেয়ে ওহুদের দিকে চলে গেল। তিনি নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, ‘হে আমার আল্লাহ! তুমি আমাকে আর আমার বাড়িতে ফিরিয়ে এনো না।’ হজরত আমর ইবনে জামুহ (রাদিয়াল্লাহ তা’য়ালা আনহু) ওহুদের রণপ্রান্তরে উপস্থিত হলেন। মক্কার ইসলামবিরোধী বাহিনীর ভেতরে তিনি প্রবেশ করে বীরবিক্রমে আক্রমণ করলেন। তিনি তাকিয়ে দেখলেন, তাঁর আশপাশেই তাঁর সন্তানগণ যুদ্ধ করছে। তাঁর চোখের সামনে তাঁর এক সন্তান শাহাদাতবরণ করলেন। কাফিরদের শাণিত অস্ত্র এক সময় তাঁর পঙ্গু দেহকে দ্বিখন্ডিত করে দিল। তিনি শাহাদাতবরণ করলেন। হজরত আমরের স্ত্রী তাঁর স্বামী এবং সন্তানের লাশ গ্রহণ করার জন্য উট নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে ওহুদের ময়দানে এলেন। লাশ উটের পিঠে উঠিয়ে তিনি উটকে বাড়ির দিকে নিতে চাইলেন। উট স্থির থাকলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ কথা জানানোর পর তিনি হজরত আমরের (রা) স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার স্বামী বাড়ি থেকে আসার সময় কি কিছু বলেছিল?’ হজরত আমর ইবনে জামুহ (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুর) স্ত্রী জানালেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার স্বামী আল্লাহর কাছে দোয়া করে বলেছিল, ‘হে আমার আল্লাহ! তুমি আমাকে আর আমার বাড়িতে ফিরিয়ে এনো না।’ এ কথা শোনার পর আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ আমরের দোয়া কবুল করে নিয়েছেন। তাকে ওহুদের ময়দানেই অন্তিম শয়ানে শুইয়ে দাও।’ কেউ কেউ মনে করেন সাহাবীদের ওপর জুলুম নির্যাতন কাফের-মুশরিকদের পক্ষ থেকে হয়েছে। আজকের সময়ে তো ঐ পরিস্থিতি নেই। কিন্তু তারা জানে না এই পথের পথিকদের কেয়ামত পর্যন্ত একই অবস্থা মোকাবেলা করতে হবে। ইমাম আবু হানিফা (রহ) ইমাম আবু হানিফা জালিম শাসকের অধীনে প্রধান বিচারপতি হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় খলিফা আবুল মুনসুর ইমাম আবু হানিফাকে ৩০টি বেত্রাঘাত করে জখম করে এবং তাকে এক হাজার দিরহাম দিলে তিনি তাও প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তাকে চাবুকাঘাত, নজরবন্দী করে আটকে রাখে। পরে জেলখানায় বিষপানে তাকে হত্যা করা হয়। ইমাম মালেক (রহ) খলিফা মুনসুরের চাচাতো ভাই মদীনার গভর্নর জাফরের নির্দেশে ইমাম মালেক থেকে কথামতো ফতোয়া আদায় করতে না পেরে দেহের কাপড় খুলে তাকে চাবুকাঘাত করে এবং তাঁর রক্তাক্ত দেহ নিয়ে উটের ওপর বসিয়ে সারা শহর প্রদক্ষিণ করানো হয়। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ) ইমাম আহমদ ইবন হাম্বলকে হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়ে খলিফা মামুনের দরবারে নিয়ে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলে পথিমধ্যে খলিফার মৃত্যুর খবর আসে। পরবর্তীতে মুতাসিমের সময় ইমামকে চারটি ভারী বেড়ি পরিয়ে রমজান মাসে রোদে বসিয়ে চাবুকাঘাত করা হয়। তিনি সংজ্ঞাহীন হলে তলোয়ার ফলা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ) ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে ৭২০ হিজরিতে ফতোয়া দেয়াকে কেন্দ্র করে একাধিকবার নজরবন্দী ও কারাবরণ করতে হয়েছে। কারাগারে বসেও তিনি লেখনী চালাতে থাকেন অতি দ্রুত বেগে। তাঁর সত্য প্রকাশে কারাপ্রাচীর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বিরোধী পক্ষ হিংসার আগুনে তাঁকে পুড়িয়ে ছারখার করে ফেলতে চায়। এবার রাজার হুকুমে তাঁর কাছ থেকে বইপত্র, খাতা, কলম, কালি দোয়াত সব কিছুই ছিনিয়ে নেয়া হয়, তবুও তিনি দমেননি। ছেঁড়া টুকরো কাগজ জমা করে কয়লা দিয়ে তাতে লিখতে থাকেন। এভাবে সত্যের নির্ভীক সেনানী আমৃত্যু লড়ে গেছেন অসত্যের বিরুদ্ধে। শহীদ সাইয়েদ কুতুব (রহ) ১৯৪৫ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের ও ইংরেজদের মধ্যে দেশবিরোধী চুক্তি হয়। ইখওয়ান এ চুক্তির বিরোধিতা করলে চালানো হয় দমন-নিপীড়ন ও নির্যাতন। কয়েক সপ্তাহে সাইয়েদ কুতুবসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাবন্দী করা হয়। জ্বরে আক্রান্ত কুতুবকে চালানো হয় ৬ ঘণ্টার সশস্ত্র অমানবিক নির্যাতন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর কামড়িয়ে সাইয়েদ কুতুবকে এদিক সেদিক নিয়ে যেত। এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় ৭ ঘণ্টার রিমান্ডে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তাকে। আগুন দ্বারা সারা শরীর ঝলসে দেয়া হয়। মাথার ওপর উত্তপ্ত গরম পানি দিয়ে আবার ঢালা হতো বরফ। পুলিশের লাথি আর ঘুষি ছিলো নিত্যদিনের জুলুম। এক বছর পর প্রস্তাব দেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে এই বলে যদি আপনি ক্ষমা চেয়ে কয়েকটি লাইন লিখে দেন, যা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে। তাহলে আপনাকে মুক্তি দেয়া হবে। সাইয়েদ কুতুব জবাব দিলেন, ‘আমার অবাক লাগে যে, এ সকল লোক মজলুমকে বলছে জালিমের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে। আল্লাহর শপথ! যদি কয়েকটি শব্দ উচ্চারণের ফলে আমাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নাজাত দেয় তবু আমি তা বলতে প্রস্তুত নই। আমি আমার রবের দরবারে এমনভাবে হাজির হতে চাই যে, আমি তার ওপর সন্তুষ্ট আর তিনি আমার ওপর সন্তুষ্ট। জেলখানায় যখন তাকে ক্ষমা চাইতে বলা হতো তখন তিনি বলতেন, যদি আমাকে কারাবন্দী করা সঠিক হয় তাহলে সঠিক সিদ্ধান্তের ওপর আমার সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আর যদি অন্যায়ভাবে আমাকে আটক রাখা হয় তাহলে আমি জালিমের কাছে করুণা ভিক্ষা চাইতে রাজি নই। এরপর তাকে সরকার শিক্ষামন্ত্রীর পদ দিতে টোপ দেয়। তিনি বলেন, আমি দুঃখিত। মন্ত্রিত্ব গ্রহণ আমার পক্ষে সেই পর্যন্ত সম্ভব নয়, যতক্ষণ মিসরের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামী ছাঁচে ঢেলে সাজানোর এখতিয়ার দেয়া না হবে। ইখওয়ানের কর্মীদের পেট্রল ঢেলে আগুনে নিক্ষেপ, শরীরে সিগারেটের আগুন ও লোহার শেকলে বেঁধে বৈদ্যুতিক শক, উলঙ্গ করে ভাইয়ের সামনে বোনকে নির্যাতন করা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ১৯৬৬ সালের ২৮ আগস্ট ভোররাতে সাইয়েদ কুতুব ও তার সঙ্গী মুহাম্মদ হাওয়ালের ফাঁসি কার্যকর করা হলো। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।) সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ) মাওলানা মওদূদী (রহ)কে ১৯৪৮ সালে ৪ঠা অক্টোবর পাকিস্তান সরকার জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে। অনেকবার তিনি কারাবরণ করেছিলেন। আবার আন্দোলনের মুখে মুক্তও হয়েছেন। মাওলানা মওদূদী (রহ) ‘কাদিয়ানি সমস্যা’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ রচনার জন্য সামরিক আদালত তাঁকে মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রদান করেন। এ বইটি তখন বাজারে বিক্রি হয়েছে এখনো হচ্ছে বইটি বেআইনিও হয়নি। মাওলানা মওদূদীকে (রহ) যখন উক্ত আদেশ শোনানো হয়, তিনি তখন শান্ত। ফাঁসির সেলে নিজেই হেঁটে যান। মাওলানা মওদূদীকে প্রাণভিক্ষা করার কথা বলা হলো। তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘আপনারা মনে রাখবেন আমি কোনো অপরাধ করিনি। আমি কিছুতেই তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইব না এবং আমার পক্ষে অন্য কেউ যেন প্রাণভিক্ষা না চায়। না আমার মা, না আমার ভাই, না আমার স্ত্রী-পুত্র পরিজন। জামায়াতের লোকদের কাছেও আমার এই অনুরোধ। কারণ জীবন ও মরণের সিদ্ধান্ত হয় আসমানে, জমিনে নয়।’ তিনি শাহাদাতের জন্য প্রস্তুত হন। এই আদেশ রেডিও-টিভিতে প্রচারিত হওয়ার পর দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সরকার তখন ফাঁসির আদেশ কারাদন্ডে রূপান্তরিত করে। তারপরও বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় অব্যাহত থাকলে পাকিস্তান সরকার মাওলানা মওদূদীকে (রহ) নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ঈমানের পরীক্ষা হয় দুঃখ-কষ্ট ও মুসিবতের সময় মানুষের ঈমানের পরীক্ষা হয় দুঃখ-কষ্ট ও মুসিবতের সময়। কিন্তু যখন কোনো সঙ্কটকাল আসে, তখন আসল ও মেকির পার্থক্যটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। খন্দকযুদ্ধ এই কাজটিই করেছে। মদীনার মুসলমানদের দলে এক বিরাট সংখ্যক মুনাফিক ও মেকি ঈমানদার ঢুকে পড়েছিলো। তাদের সত্যিকার পরিচয়টা সাধারণ মুসলমানদের সামনে উদঘাটন করার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এই কাজে বিরোধীদের সকল বাধার পরও তার বান্দাদের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যেমন রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের কথা আল্লাহ নিজেই মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু শর্ত হচ্ছে বান্দাদেরকে আল্লাহর সাহায্য ও রহমত পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। এই যোগ্যতা অর্জন করার জন্য কিছু গুণাবলি অর্জন করা প্রয়োজন। এ ধরনের অসংখ্য গুণাবলির কথা মহান আল্লাহ-তায়ালা ঘোষণা করেছেন। তার মধ্যে কয়েকটি মৌলিক বিষয় আলোচনা করা হলোÑ ধৈর্য সাফল্যের চাবিকাঠি ঈমানদারদের গোটা পার্থিব জীবনকেই সবর বা ধৈর্যের জীবন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ঈমান আনার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোনো ব্যক্তির নিজের অবৈধ আশা-আকাক্সক্ষাকে অবদমিত করা, আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমাসমূহ মেনে চলা, আল্লাহর নির্ধারিত ফরজসমূহ পালন করা, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজের সময়, অর্থসম্পদ, নিজের শ্রম, নিজের শক্তি ও যোগ্যতা এমনকি প্রয়োজনের মুহূর্তে প্রাণ পর্যন্ত কোরবানি করা, এটা সার্বক্ষণিক সবর, স্থায়ী সবর, সর্বাত্মক সবর এবং জীবনব্যাপী সবর। কুরআনে বলা হয়েছে, তারা দুইবার পুরস্কৃত হবে তাদের সবরের কারণে। তারা মন্দের জওয়াবে ভালো করে এবং আমি তাদেরকে যা দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। (সূরা কাসাস : ৫৪) আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন, ‘অতএব, আপনি সবর করুন নিশ্চয়ই আল্লাহ্র ওয়াদা সত্য। আপনি আপনার গোনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং সকাল-সন্ধ্যায় আপনার পালনকর্তার প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা করুন।’ (সূরা আল-মু’মিন : ৫৫) মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বর্ণিত আছে, ‘ধৈর্যশীল ছাড়া এ গুণ আর কারো ভাগ্যে জোটে না। এবং অতি ভাগ্যবান ছাড়া এ মর্যাদা আর কেউ লাভ করতে পারে না।’ (সূরা হামিম আস-সাজদাহ : ৩৫) আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘এর আগে এমন অনেক নবী চলে গেছে যাদের সাথে মিলে বহু আল্লাহওয়ালা লড়াই করেছে। আল্লাহর পথে তাদের ওপর যেসব মুসিবত এসেছে তাতে তারা মনমরা ও হতাশ হয়নি, তারা দুর্বলতা দেখায়নি এবং তারা বাতিলের সামনে মাথা নত করে দেয়নি। এ ধরনের সবরকারীদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৪৬) মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, “(হে মুসলমানগণ) তোমাদের অবশ্যি ধন ও প্রাণের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে এবং তোমরা আহলি কিতাব ও মুশরিকদের থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনবে। যদি এমন অবস্থায় তোমরা সবর ও তাকওয়ার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো তাহলে তা হবে বিরাট সাহসিকতার পরিচায়ক।” (সূরা আলে ইমরান : ১৮৬) কুরআনে বর্ণিত আছে, ‘‘তোমাদের ভালো হলে তাদের খারাপ লাগে এবং তোমাদের ওপর কোনো বিপদ হলে তারা খুশি হয়। তোমরা যদি সবর করো এবং আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো তাহলে তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের কোনো কৌশল কার্যকর হতে পারে না। তারা যা কিছু করছে আল্লাহ তা চতুর্দিক থেকে বেষ্টন করে আছেন।” (সূরা আলে ইমরান : ১২০) আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী (রহ) ইসলামী আন্দোলন সাফল্যের শর্তাবলী বইয়ে ধৈর্যের চিত্রটি তুলে ধরেছেন এভাবে : ‘ধৈর্যের অর্থ হচ্ছে তাড়াহুড়ো না করা, নিজের প্রচেষ্টার ত্বরিত ফল লাভের জন্য অস্থির না হওয়া এবং বিলম্ব দেখে হিম্মত হারিয়ে না বসা। ধৈর্যশীল ব্যক্তি সারাজীবন একটি উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্য অনবরত পরিশ্রম করতে থাকে এবং একের পর এক ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েও পরিশ্রম থেকে বিরত হয় না। মানুষের সংশোধন ও পরিগঠনের কাজ অন্তহীন ধৈর্যের মুখাপেক্ষী। বিপুল ধৈর্য ছাড়া কোনো ব্যক্তি এ কাজ সম্পাদনে সক্ষম হয় না। তিক্ত স্বভাব, দুর্বল মত ও সঙ্কল্পহীনতার রোগে আক্রান্ত না হওয়া। ধৈর্যশীল ব্যক্তি একবার ভেবেচিন্তে যে পথ অবলম্বন করে তার ওপর অবিচল থাকে এবং একাগ্র ইচ্ছা ও সঙ্কল্পের পূর্ণ শক্তি নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। বাধা বিপত্তির বীরোচিত মোকাবেলা করা এবং শান্তচিত্তে লক্ষ্য অর্জনের পথে যাবতীয় দুঃখ কষ্ট বরদাশত করা। ধৈর্যশীল ব্যক্তি যেকোনো ঝড়-ঝঞ্ঝার পর্বতপ্রমাণ তরঙ্গাঘাতে হিম্মতহারা হয়ে পড়ে না। দুঃখ-বেদনা, ভারাক্রান্ত ও ক্রোধান্বিত না হওয়া। যে ব্যক্তিকে সমাজ সংশোধন ও পরিগঠনের খাতিরে কিছু অপরিহার্য ভাঙার কাজও করতে হয়, বিশেষ করে যখন দীর্ঘকালের বিকৃত সমাজে তাকে এ কর্তব্য সম্পাদন করতে হয়, তখন অবশ্যই তাকে বড়ই নিম্নস্তরের হীন ও বিশ্রী রকমের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়। যদি সে গাল খেয়ে হাসবার ও নিন্দাবাদ হজম করার ক্ষমতা না রাখে এবং দোষারোপ ও মিথ্যা প্রোপাগান্ডাকে নির্বিবাদে এড়িয়ে গিয়ে স্থিরচিত্তে ও ঠান্ডা মস্তিষ্কে নিজের কাজে ব্যস্ত না থাকতে পারে, তাহলে এ পথে পা না বাড়ানোই তার জন্য বেহতর কারণ এ পথে কাঁটা বিছানো। এর প্রত্যেকটি কাঁটা এই দৃঢ় মনোবল নিয়ে মুখ উঁচিয়ে আছে যে, মানুষ অন্য যে কোনোদিকে নির্বিঘেœ অগ্রসর হতে পারে কিন্তু এ দিকে তাকে এক ইঞ্চিও এগিয়ে আসতে দেয়া হবে না। এ অবস্থায় যে ব্যক্তি কাপড়ের প্রত্যেকটি কাঁটা ছাড়াতে ব্যস্ত হবে সে কেমন করেই বা অগ্রসর হবে। এই পথে এমন সব লোকের প্রয়োজন যারা নিজের কাপড়ে কোনো কাঁটা বিঁধলে কাপড়ের সেই অংশটি ছিঁড়ে কাঁটা গাছের গায়ে রেখে দিয়ে নিজের পথে এগিয়ে যেতে থাকবে। নৈতিক চরিত্রই আমাদের উত্তম হাতিয়ার আল্লাহ তায়ালা মানুষের সফলতার ও ব্যর্থতার মানদন্ড হিসেবে শুধুমাত্র দুনিয়ার সফলতাকেই উল্লেখ করেননি। বরং বান্দাহর সফলতা হচ্ছে যে উদ্দেশ্যে এই পৃথিবীতে আল্লাহ তাকে পাঠিয়েছেন তার ক্ষেত্রে সে কতটুকু সার্থকতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে তার ওপর। কিন্তু বস্তুবাদী জীবনদর্শনে এই দুনিয়ার ধন-সম্পদ, ক্ষমতা কর্তৃত্বকেই সে সবকিছু মনে করে। এসব কিছু পেলে সে আনন্দে উল্লসিত হয় এবং বলে আল্লাহ আমাকে মর্যাদা দান করেছেন। আবার না পেলে বলে আল্লাহ আমাকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করেছেন। অর্থাৎ ধন-সম্পদ ও ক্ষমতা কর্তৃত্ব পাওয়া না পাওয়াই হচ্ছে তার কাছে মর্যাদা ও লাঞ্ছনার মানদন্ড। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে আল্লাহ দুনিয়ায় যাকে যা কিছুই দিয়েছেন পরীক্ষার জন্যই দিয়েছেন। ধন ও শক্তি দিয়েছেন পরীক্ষা করার জন্য। এগুলো পেয়ে মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। কিন্তু মানুষের অবস্থা হচ্ছে যে, আল্লাহ বলেন, ‘তার রব যখন তাকে পরীক্ষায় ফেলেন এবং  তাকে সম্মান ও নিয়ামত দান করেন তখন সে বলে, আমার রব আমাকে সম্মানিত করেছেন। আবার যখন তিনি তাকে পরীক্ষায় ফেলেন এবং তার রিজিক তার জন্য সঙ্কীর্ণ করে দেন তখন সে বলে, আমার রব আমাকে হেয় করেছেন।’ (সূরা আল ফাজর : ১৫-১৬) আমাদেরকে অগণিত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। সবর, দৃঢ়তা, অবিচলতা ও দ্বিধাহীন সঙ্কল্পের মাধ্যমে সমস্ত বিপদ-আপদের মোকাবেলা করে যখন আমরা আল্লাহর পথে এগিয়ে যেতে থাকবো তখনই আমাদের ওপর বর্ষিত হবে অনুগ্রহরাশি আর এই কঠিন দায়িত্বের বোঝা বহন করার জন্য আমাদের  অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রয়োজন। একটি হচ্ছে নিজের মধ্যে সবর ও সহিষ্ণুতার শক্তি। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে খুশুখজু আন্তরিকতাসহকারে নিবিষ্ট চিত্তে সদা নামাজ পড়ার মাধ্যমে নিজেকে শক্তিশালী করার শক্তি। দৃঢ়তা ও সাহসিকতা ঈমানের অনিবার্য দাবি একটি আদর্শবাদী দল যখন নিজেদের আদর্শ প্রচার করতে শুরু করে, তখন এই আদর্শের বিরোধী লোকগণ তাদের প্রতিরোধ করতে উদ্যত হয়। ফলে উভয় দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এই দ্বন্দ্বের তীব্রতা যতই বৃদ্ধি পায় আদর্শবাদী দল বিরুদ্ধবাদীদের মোকাবেলায় ততই উন্নত চরিত্র ও মহান মানবিক গুণ মাহাত্ম্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে থাকে। সে তার কর্মনীতি দ্বারা প্রমাণ করে যে, মানবসমষ্টি-তথা গোটা সৃষ্টিজগতের কল্যাণ সাধন ভিন্ন তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। বিরুদ্ধবাদীদের ব্যক্তিসত্তা কিংবা তাদের জাতীয়তার সাথে এর কোনো শত্রুতা নেই। শত্রুতা আছে শুধু তাদের গৃহীত জীবনধারা ও চিন্তা মতবাদের সাথে। তা পরিত্যাগ করলেই তার রক্তপিপাসু শত্রুকেও প্রাণভরা ভালোবাসা দান করতে পারে। বুকের সঙ্গে মিলাতে পারে। পরন্তু সে আরও প্রমাণ করবে যে বিরুদ্ধ পক্ষের ধন-দৌলত কিংবা তাদের ব্যবসায় ও শিল্পপণ্যের প্রতিও তার কোনো লালসা নেই, তাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ সাধনাই একমাত্র কাম্য। তা লাভ হলেই যথেষ্ট। তাদের ধন-দৌলত তাদেরই সৌভাগ্যের কারণ হবে। কঠিন ও কঠোরতম পরীক্ষার সময়ও এই দল কোনোরূপ মিথ্যা, প্রতারণা ও শঠতার আশ্রয় নেবে না। কূটিলতা ষড়যন্ত্রের প্রত্যুত্তরে তারা সহজ-সরল কর্মনীতিই অনুসরণ করবে। প্রতিশোধ গ্রহণের তীব্র উত্তেজনার সময়ও অত্যাচার-অবিচার, উৎপীড়নের নির্মমতায় মেতে উঠবে না। যুদ্ধেও প্রবল সংঘর্ষের কঠিন মুহূর্তেও তারা নিজেদের নীতি আদর্শ পরিত্যাগ করবে না। কারণ সেই আদর্শের প্রচার প্রতিষ্ঠার জন্যই তো তার জন্ম। এ জন্য সততা, সত্যবাদিতা, প্রতিশ্রুতি পূরণ, নির্মল আচার-ব্যবহার ও নিঃস্বার্থ কর্মনীতির ওপর তারা দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘মনমরা হয়ো না, দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাকো।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৩৯) আল্লাহপাক ঘোষণা করেন, ‘হে ঈমানদারগণ সবরের পথ অবলম্বন করো, বাতিলপন্থীদের মোকাবেলায় দৃঢ়তা দেখাও, হকের খেদমত করার জন্য উঠে পড়ে লাগো এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। আশা করা যায়, তোমরা সফলকাম হবে।’ (সূরা আলে-ইমরান : ২০০) মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বর্ণিত আছে, ‘(হে মুসলমানগণ) তোমাদের অবশ্যই ধন ও প্রাণের পরীক্ষায় সম্মুখীন হতে হবে এবং তোমরা আহলি কিতাব ও মুশরিকদের থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনবে। যদি এমন অবস্থায় তোমরা সবর ও তাকওয়ার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো, তাহলে তা হবে বিরাট সাহসিকতার পরিচায়ক। (সূরা আলে-ইমরান : ১৮৬) (চলবে) সহায়ক গ্রন্থ মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (সা)Ñনঈম সিদ্দিকী। সিরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড। আসহাবে রাসূলের জীবনকথা। লেখক : ভারপ্রাপ্ত আমির, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির