জনৈক শায়খের জিজ্ঞাসা: (১) ইসলামী দেশে বিরোধী দল কেমন হবে? (২) তারা কি ইসলামবিরোধী হবে? (৩) নাকি মুসলিমবিরোধী হবে? (৪) নাকি সরকারবিরোধী হবে? (৫) নাকি এর কোনোটাই না?
প্রথম জিজ্ঞাসায়ই মুহতারাম শায়খ সাহেব ইসলামী রাষ্ট্রে বিরোধী দলের অস্তিত্ব স্বীকার করেই বোধ করি বাকি প্রশ্নগুলো রেখেছেন। আর যদি বিরোধী দল নাইবা থাকে তাহলে পরবর্তী চারটি প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির কোনো দরকার পড়বে না।
এখন দেখা যাক ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ ও ‘মুসলিম রাষ্ট্রের’ মধ্যে পার্থক্য কী? এক কথায় ইসলামী রাষ্ট্র হলো, যে রাষ্ট্রের গভর্নমেন্ট অ্যাবস্যুলেটলি কোরআন-সুন্নাহর অনুসারী এবং রাষ্ট্রের সংবিধানও সম্পূর্ণ কোরআন-সুন্নাহর পরিপূরক, সেই রাষ্ট্রই হলো ইসলামী রাষ্ট্র। আর যে রাষ্ট্রের গভর্নমেন্ট তথাকথিত মুসলিম, তাদের যাপিত জীবন পরিপূর্ণ ইসলামী শরিয়ার অধীন নয় এবং রাষ্ট্রের সংবিধানও সম্পূর্ণ কোরআন-সুন্নাহর পরিপূরক নয়, সেগুলিকে সাধারণ মুসলিম রাষ্ট্র বলা যেতে পারে। দুনিয়ায় ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা (conception) এসেছে মহাগ্রন্থ আল কোরআন ও সুন্নাহর ভাষ্য থেকে, আর তা বাস্তবে রূপদান করে গেছেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) নিজেই এবং তৎপরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদার নেতৃবৃন্দ। রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, তখন সেটি ছিল প্রথমত নগররাষ্ট্র। এই নগররাষ্ট্রই ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে, যেমন যুদ্ধ বিজয়ের মাধ্যমে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বেচ্ছা আনুগত্যের মাধ্যমে কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইসলামবিরোধীদের ইসলাম কবুলের মাধ্যমে এর ব্যাপ্তি ঘটে। পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদার নেতৃত্বে এসে এ রাষ্ট্রের বিস্তৃতি আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাথমিক দিনগুলোতে বিভিন্ন গোষ্ঠী বা গোত্রের সাথে আপস ও সমঝোতাই ছিল মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রের নীতি। ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দের গোড়ার দিক থেকে শুরু করে ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিন পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে নবী (সা) মদিনা সংলগ্ন কয়েকটি গোত্রের সাথে বেশ কিছু সংখ্যক চুক্তি সম্পাদন করে মদিনা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। (ওয়াকিদি ১৯৭, ৩৮৮ পৃ:) ইতোমধ্যে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে বিজিত এলাকাসমূহ ইসলামী নগররাষ্ট্রের সাথে যুক্ত হয়। প্রথমত যেসব এলাকা মদিনা রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয় সেসব ছিল মদিনায় ইহুদি গোত্রসমূহের অধীন এবং ঐসব এলাকা মদিনা থেকে বেশি দূরে না থাকায় রাসূল (সা) সহজেই তা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম ছিলেন। খুব সম্ভবত ওয়াদি আল-কুরা ছিলেন কেন্দ্র থেকে প্রেরিত ওয়ালি (প্রশাসক/গভর্নর) শাসনাধীন সর্বপ্রথম এলাকা। (ওয়াকিদি-৭১১ পৃ.) মনে করা হয় সপ্তম হিজরির প্রথম ভাগে ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া গোত্রের বিখ্যাত সাঈদী পরিবারের আমর বিন সাঈদ সংশ্লিষ্ট এলাকার গভর্নর নিযুক্ত হন। (জুবায়রি ১৭৬-১৮৩ পৃ.) এমনভাবে তাইফ, দাবা, জেদ্দা প্রভৃতি এলাকা মদিনা রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ঐসব এলাকা ওয়ালি বা গভর্নর শাসিত অঞ্চলের আওতায় আনা হয়। মূলত মক্কা বিজয়ের পর ইসলামী রাষ্ট্রের সঙ্গে আরব গোত্রসমূহ ও তাদের এলাকাগুলোর প্রশ্নে এক উল্লেখযোগ্য ও দৃশ্যমান কৌশলগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ইতোমধ্যে যেসব গোত্র ও এলাকা সন্ধিপত্রে আবদ্ধ হতো তারা যতক্ষণ পর্যন্ত না মদিনার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভেঙে পড়তো ততক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিষয়ে, সবদিক থেকে স্বাধীন ছিল। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী তাদেরকে নবী (সা)এর মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব বিনা আপত্তিতে মেনে নিতে হতো। কোনো গোত্র বা এলাকা, তা যুদ্ধের মাধ্যমে হোক কিংবা আপস অথবা সন্ধির মাধ্যমে হোক বিজিত হলে সকল অবস্থায় তাদেরকে মদিনা রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার প্রেরিত একজন ওয়ালির অধীনে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্বের অধীনত্ব অবশ্যই মেনে চলতে হতো। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল ‘নাজরান’। এলাকাটি মদিনা রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কর্তৃত্বের অন্তর্ভুক্ত হলে ইসলামী আইন কোরআন-সুন্নাহর সংবিধান সেখানকার খ্রিষ্টান প্রজারা বিনাদ্বিধায় মেনে নিয়ে চুক্তি অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘জিযিয়া’ (কর) প্রদান করে আনুগত্যের পরিচয় দিতে বাধ্য হয়। (নাজরান চুক্তি, ফুতুহ আল বুলদান ৭৫-৭৯ পৃ., মাজমুয়াত আল ওয়াসাইক ৮০-৯৬ পৃ.) শুধু তাই নয়, নাজরানের খ্রিষ্টান প্রজা সাধারণ তাদের নিজেদের মধ্যকার স্থানীয় বিরোধ নিষ্পত্তির প্রশ্নে মদিনা রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে অনুরোধ জানালে নবী (সা) ৯ম হিজরি তথা ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের কোনো এক সময়ে বিশিষ্ট সাহাবী আবু উবায়দাহ বিন জাররাহ (রা)কে সেখানে প্রেরণ করেন। অনেকের মতো তাকে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে খাজনা সংগ্রহকারী অথবা ধর্মীয় শিক্ষক হিসাবে শুধু প্রেরণ করা হয়নি, বরং তাকে স্থানীয় প্রজাদের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ছোটখাটো বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত দিতে হতো। বর্ণিত আছে যে, নবী (সা) তাকে বলেছেন, ‘তাদের সঙ্গে যাও এবং তাদের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যাপারে বিশ্বস্ততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত দাও।’ (ইবনে ইসহাক, ২২৭, ইবনে সা’দ ৩য়,-৪১১-১২ পৃ.) ইবনে ইসহাক এটিকে ‘অফিস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (দ্র: ঐ) কিন্তু এর অধিকারীকে ইবনে খালদুন বলেছেন ‘ওয়ালি’। (পূর্বে উল্লিখিত ১ম, ৮৩৭ পৃ.) বনু আল-হারিস বিন কা’ব এর গোত্র থেকে বিরাট সংখ্যক লোককে ইসলামে বায়আত করে দশম হিজরির জিলকদ মাসে তথা ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে খালিদ বিন ওয়ালিদ নবী (সা)এর পরামর্শে রাষ্ট্রীয় চুক্তি সংক্রান্ত প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করে খাজরাজ গোত্রের নাজ্জার পরিবারের এক তরুণ আনসারি আমর বিন হাযমকে ঐ অঞ্চলটির জন্য ওয়ালি বা গভর্নর নিযুক্ত করেন। (ইবনে হিশাম, ৩য় ৫৯৪-৯৫ পৃ., ফুতুহ আল-বুলদান ৮০ পৃ., আনসাব আল-আশরাফ ১ম, ৫২৯-৩০ পৃ., তাবারি ৩য়,-১২৮ পৃ., ইবনে খালদুন ১ম, ৮৪৩ পৃ., উসদ ৪র্থ, ৬৮-৬৯ পৃ.; উসদ-এ বর্ণিত হয়েছে, তার নিযুক্তির সময় তিনি ১৭ বছরের তরুণ ছিলেন। খালিদের তৎপরতার বিষয়ে মাজমুয়াত আল-ওয়াসাইক ৭১-৭৩ পৃ. এবং নাজরানে নতুন গভর্নরকে দেয়া নির্দেশাবলি সম্বন্ধে উক্ত পুস্তকের ১০৪, ১০৯ পৃ. দ্রষ্টব্য) নিযুক্ত নতুন তরুণ গভর্নর তার প্রদেশকে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে সম্পূর্ণ শরিয়াতি বিধান মোতাবিক প্রজা সাধারণকে নিষ্ঠার সাথে পরিচালনা করতেন এবং জনসাধারণ তা বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নিত। আল--ইয়েমেনের পারসিক গভর্নর ‘বাযানের’ ইসলাম গ্রহণ (কাত্তানি, ২৪০-৪১ পৃ., এক বর্ণনা মতে পুত্র কর্তৃক খসরু পারভেজের হত্যার কিছুদিন পর বাযান ধর্মান্তরিত হন) এবং নবী (সা)-এর রাজনৈতিক কর্তৃত্বের আনুগত্য স্বীকার করে আরব উপদ্বীপের দক্ষিণাংশের আঞ্চলিক রাজনীতির প্রশ্নে মদিনা রাষ্ট্রের প্রশাসনিক এবং সাংবিধানিক কার্যক্রমে এক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের ফলে গোটা ইয়েমেন প্রদেশ যা ছিলো দীর্ঘকালের জন্য সে আমলের বৃহৎ শক্তিবর্গের রাজনৈতিক ক্রীড়াঙ্গন, সেটি ইসলামী রাষ্ট্রের একটি প্রদেশে বা প্রশাসনিক ইউনিটে পরিণত হওয়ায় ইসলামী রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্বের এক নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়। (তাবারি, ৩য়, ২২৭-২৮ পৃ.) এমনি করে মদিনা-ইসলামী রাষ্ট্রের সীমা-পরিসীমা যেমন বাড়তে থাকে তেমনি রাষ্ট্রের আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক ওয়ালি বা গভর্নরগণ কেন্দ্রীয় নির্দেশনা এবং ইসলামী সংবিধানের আলোকে প্রশাসনিক কার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালনা করেন। নিম্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বা প্রদেশের নাম এসবের ওয়ালি বা গভর্নরদের তালিকা প্রদত্ত হলো: তাবারির মতে- ১. সানা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা: শাহর বিন বাযান। ২. হামাদান: আমির বিন শাহর আল হামদানি। ৩. বালাযুরির মতে: যাবিদ, মারিব, রিমা, এডেন ও উপকূলীয় এলাকার জন্য: আবু মুসা আল আশআরি, ৪. নাজরান, রিমা ও যাবিদের মধ্যবর্তী এলাকার জন্য: খালিদ বিন সাঈদ বিন আল আস, ৫. আক ও আশাআ এলাকাদ্বয়ের জন্য: আত তাহির বিন আবি হালাহ, ৬. আল জানাদ এলাকার জন্য: ইয়ালা বিন উমাইয়া, ৭. নাজরানের জন্য: আমর বিন হাযম, ৮. হাযরামাওতের জন্য: যিয়াদ বিন লাবিদ, ৯. বনু মুয়াবিয়া বিন কিনদাহর দায়িত্বে: আল-মুহাজির বিন আবি উমাইয়াহ, পরবর্তীতে যায়দ বিন লাবিদ, ১০. আল সকাসিক ও আল সাকুনের জন্য: উক্কাশাহ বিন শাওর আল গাওসি। (উসদ্ ৫ম ২ ইবনে খালদুন ভূ ১, ৮৪৩ পৃ.। কাত্তানী ১ম, ২৪৩ পৃ.) নবী (সা) প্রবর্তিত সাধারণ নীতিমালার ভিত্তিতে প্রশাসকগণ তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন। ইয়েমেনের গভর্নর হিসাবে মুআয বিন যাবালের যোগদানের পূর্বে নবী করিম (সা)এর সাথে যে কথোপকথন হয়েছিলো এক বর্ণনায় সেটি লক্ষ্য করা যায়। বর্ণনা মতে রাসূল (সা) তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কিভাবে তুমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে? তিনি উত্তরে বললেন, ‘আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী। পুনঃ রাসূল (সা) শুধালেন, যদি তুমি বিষয়টি সম্পর্কে সেখানে (কুরআনে) কিছু না পাও তখন? তিনি উত্তরে বললেন, আমি সিদ্ধান্ত নেবো আল্লাহর নবীর সুন্নাহ অনুসারে। অতঃপর নবী (সা) পুনরায় প্রশ্ন করলেন, সেখানেও তুমি যদি কিছু না পাও তখন? তিনি উত্তর দেন, ‘আমি তখন স্বয়ং একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাবো।’ এ পর্যায়ে নবী (সা) বললেন, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আল্লাহর নবীর প্রতিনিধিকে সঠিক হিদায়াত দান করেছেন যা আল্লাহর নবী পছন্দ করেন।’ (ইবনে সা’দ ৩য়, ৫৪৮পৃ.) এর অর্থ এই যে, কুরআন ও সুন্নাহর সাধারণ পথনির্দেশসমূহের ভিত্তিতে গভর্নরগণ এবং একই কারণে অন্যান্য নির্বাহী কর্মকর্তাগণ নিজস্ব এখতিয়ারে স্বাধীনভাবে প্রশাসন চালাবেন। এ ছাড়াও প্রশাসকগণ নিজ নিজ এলাকায় পৌঁছাবার প্রারম্ভে নবী (সা) তাদেরকে সময়োপযোগী নির্দেশনা প্রদান করতেন। উদাহরণস্বরূপ মুয়াজ ও তার নিজ লোকদেরকে কালিমা গ্রহণ, প্রত্যহ পাঁচবার সালাত আদায় এবং যাকাত প্রদানের প্রশ্নে আহবান জানাতে নবী (সা) নির্দেশ দেন। জাবালকে জনতার সর্বোত্তম সম্পদ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেন এবং নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্তদের অভিশাপ থেকে মুক্ত থাকার জন্য উপদেশ দেন। (ইবনে ইসহাক, ৬৪৪ পৃ., ইবনে সা’দ, ৩য়, ৫৮৪ পৃ.) আর এক বর্ণনামতে তিনি তাকে এ নির্দেশনাও প্রদান করেন যে, কাঠিন্য সৃষ্টি করার পরিবর্তে বিষয়টি যেন সহজ করে দেয়া হয়, ঘৃণা সৃষ্টির পরিবর্তে যেন শুভসংবাদ পরিবেশন করা হয় এবং বিরোধ না বাড়িয়ে যেন সহায়তার হাত প্রসারিত রাখা হয়।’ (ইবনে ইসহাক, ৬৪৪, মুসলিম, কিতাব আল ঈমান।) জনতাকে যাতে উত্তম আচরণ ও দয়া প্রদর্শন করা হয়, সে বিষয়েও নবী (সা) তাঁকে নির্দশনা দেন।’ (ইবনে সা’দ ৩য়, ৫৮৪ পৃ.) নবী (সা) আরও নির্দেশনা দিতেন এই মর্মে যে, ‘যদি কোনো ইহুদি বা খ্রিষ্টান স্বেচ্ছায় ঈমানদার মুসলমানে পরিণত হয় এবং ইসলাম ধর্মেও অনুসরণ করে তবে সে একজন বিশ্বাসী। অধিকার ও বাধ্যবাধকতার প্রশ্নে সে ভিন্ন কিছু নয়। আর যদি কেউ স্বধর্ম আঁকড়িয়ে থাকে, তবে তা থেকে তাকে ফেরানো যাবে না। প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ককে, পুরুষ হোক আর নারী, দাস হোক আর মুক্ত (অমুসলিম) অবশ্যই এক স্বর্ণ দিনার অথবা সমমূল্যের কাপড় বায়তুলমালে জমা দিতে হবে এবং যে এটা করবে তাকে আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা দেয়া হলো আর যে এটা অবজ্ঞা করবে সে আল্লাহ, রাসূল (সা) এবং বিশ্বাসীদের দুশমন।’ (ইবনে ইসহাক, ৬৪৭-৪৮, আবু ইউসুফ, কিতাব আল খারাজ, ৪০-৪১। ওয়াট, মুহাম্মদ অ্যাট মদিনা, পৃ. ১২৮) অবশ্য পূর্বেই বলা হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমগণ ইসলামী সংবিধান মানতে বাধ্য থাকলেও স্ব স্ব ধর্মীয় অধিকার পালনে তারা স্বাধীন। স্ব স্ব পারিবারিক ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানও সরকারের প্রশাসনিক নীতিমালার আওতায় পালনের অধিকার সংরক্ষিত থাকবে। (কাত্তানি, ১ম, ২৪৫ পৃ.) মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমদের সত্যিকারের কী অধিকার ও মর্যাদা তা নবী (সা) কৃত একটি চুক্তি থেকে জানা যায়। চুক্তিটির অংশ বিশেষ নবী (সা) একটি ঐতিহাসিক পত্র থেকে এখানে তুলে ধরা হলো: আল্লাহর প্রেরিত রাসূল মুহাম্মদ (সা) এর পক্ষ থেকে নাজরানের অধিবাসীদের নিকট এই পত্র। নাজরান ও তাদের অনুসারীদের উপরে আল্লাহর নিরাপত্তা (জিওয়ার) রয়েছে এবং আল্লাহর নবী রাসূল মুহাম্মদ (সা) এর জিম্মাহ রয়েছে। রাসূল (সা) তাদের জন্য, তাদের সমাজের জন্য, তাদের জমিনের এবং মালামালের জন্য, তাদের মধ্যে যারা অনুপস্থিত রয়েছে এবং যারা উপস্থিত উভয় ক্ষেত্রেই এবং তাদের গির্জার ও সেখানকার কোনো বিশপকে তার ধর্মীয় এলাকা থেকে এবং কোনো সাধুকে তার মর্যাদা থেকে এবং কোনো গির্জার তত্ত্বাবধায়ককে তার দায়িত্ব থেকে সরানো হবে না এবং ছোট বা বড় যা কিছু তাদের করতলগত রয়েছে, সকল কিছুর। কোনো প্রকার সুদ থাকবে না এবং জাহেলি যুগের কোনো রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ আর থাকবে না (লা-দাম্মাল-জাহিলিয়া)। তাদের কেউ কোনো অধিকার দাবি করলে সেখানে সুবিচার রয়েছে (তাদের নিজেদের হাতে), তারা যে অন্যায় করছে না বা কোনো জুলুম সহ্য করছে না (তা দেখার) দায়িত্ব নাজরানের। অতঃপর কেউ যদি অন্যায় সুদ গ্রহণ করে তার দায়িত্বের বিষয়ে আমার কোনো জিম্মাহ থাকবে না। তাদের কেউ অপরের কৃত অন্যায়ের জন্য শাস্তি ভোগ করবে না। এই দলিলের শর্তানুযায়ী (তাদের জন্য) আল্লাহর আশ্রয় (জিওয়ার) এবং রাসূল (সা)-এর জিম্মাহ চিরদিন থাকবে, যতদিন পর্যন্ত না আল্লাহর আইন নিপতিত হয়। (মাজমুয়া তুল-ওয়াসাইক, ৮১-৮২ পৃ.; তুল, ওয়াট, মুহাম্মদ অ্যাট মদিনা, ৩৫৯-৬০ পৃ.; কাত্তানি, ১ম খন্ড, ৩৯২ পৃ.) উক্ত আলোচনায় ইসলামী রাষ্ট্র এবং তার সরকার, সংবিধান, প্রশাসন, অধীনস্থ প্রজা সাধারণ, মুসলিম, অমুসলিম, বিভিন্ন গোত্র ও অঞ্চল বা এলাকা সর্ববিষয়ে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এটাও ধারণা পাওয়া যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্র যেহেতু আল কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনার নিগড়ে সাংবিধানিকভাবে বিধিবদ্ধ, সেহেতু এ সংবিধান বা আইনের কিংবা ঐ আলোকে প্রশাসন বা সরকারের বিরোধিতা করার অধিকার, অধীনস্থ প্রজাসাধারণ যেমন কোনো মুসলিমেরও নেই, তেমনি কোনো অমুসলিমেরও নেই, যদিও অমুসলিমরা তাদের ধর্মীয় আচরণে স্বাধীনতা ভোগ করবে। এ ক্ষেত্রে কোরআনের ভাষ্য হলো- ‘লি ইউজ হিরাহু আলাদ-দ্বীন।’ অর্থাৎ দ্বীন ইসলাম সেখানে বিজয়ী ভূমিকায় থাকবে। তবে অন্য সব দ্বীন বা ধর্মকে বিলীন করে নয়। সে কারণে ইসলামী রাষ্ট্রে সরকার বা প্রশাসনের বিরোধিতা করার জন্য কোনো বিরোধী দলেরও প্রয়োজন থাকার কথা নয়। তবে ইসলামী সরকার কোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী কোনো কার্যক্রম চালাচ্ছেন কিনা সে বিষয়ে সচেতন জনগণ সরকারকে সতর্ক করতে পারবে।
লেখক : গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ
আপনার মন্তব্য লিখুন