১২৫ বছর আগে ১৮৮৬ সালেও বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিকদের শ্রমের মূল্য ছিল খুব কম। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা শ্রম দিয়েও শ্রমিকরা উপযুক্ত মজুরি পেত না। অনেক শ্রমিক পরিবারের শিশুসন্তান পিতাকে চিনতে পারতো না। কারণ শিশুটি যখন ঘুমিয়ে থাকতো পিতা কর্মস্থলে চলে যেত, পিতা যখন ঘরে ফিরতো তখন শিশুটি আবার ঘুমিয়ে পড়তো। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অনেক শিশু তার মায়ের পাশে বসা পিতার দিকে এমনভাবে তাকাতো যেন এই পুরুষ মানুষটি বাইরের মানুষ। ১২ ঘণ্টা শ্রম দিয়ে শ্রমজীবীদের স্বচ্ছন্দে সচ্ছলভাবে সংসার চলতো না। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করতো না। তারা অদৃষ্টের বিধান হিসেবে এ অত্যাচার-অবিচার মেনে নিয়েছিল। মানুষ বোবা পশু নয় তাদের মনে ভাব জাগে, মুখে ভাষা জাগে। একসময় তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠলো।
চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটলো আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে। তারা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে এবং মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করলো। মালিকপক্ষ সব দেশে সবকালেই মনে করে তারা আলাদা জাত। তারা শ্রমিকদের উপর শোষণ করে, নির্যাতন করে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের উপর গুণ্ডা লেলিয়ে দেয়। শিকাগো শহরেও তাই ঘটেছিল। মালিক পক্ষের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীদের গুলিতে বেশ কয়েকজন শ্রমিক নিহত হলো। তাদের মৃত্যু বৃথা যায়নি। দেশে দেশে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়লো। বিভিন্ন দেশের সরকারও এগিয়ে এলো। তারা দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রয়োজনে কলে-কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখার স্বার্থে মালিক পক্ষের সঙ্গে আলোচনা-বৈঠক করে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি এবং কাজের মেয়াদ ৮ ঘণ্টা করার দাবি মেনে নিলো। ১৮৮৬ সালের এ ঘটনা বিশ্বজুড়ে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দাবি পূরণের দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করলো। মে মাসের পহেলা তারিখ বিশ্বের সব দেশে শ্রমজীবী মানুষ ছুটি পালন করে। সভা-সেমিনারের মাধ্যমে নিহত শ্রমিকদের আত্মত্যাগের কথা জীবন দানের স্মৃতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
যারা ১৮৮৬ সালে দরিদ্র শ্রমিকদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছিল তারা এ নৃশংসতার পরিচয় কেন দিয়েছিল? এর মূলে ছিল ঐশ্বর্যের ক্ষুধা। এ ক্ষুধার কোনো শেষ নেই। টাকা ও ক্ষমতা জন্য মানুষের চাহিদা অন্তহীন। টাকা নিজেই তার অতিরিক্ত চাহিদা সৃষ্টি করে। বিদ্যমান প্রয়োজন মিটে গেলে জন্ম হয় নতুন চাহিদার। এ ক্ষুধা মেটানোর জন্য মানুষ ন্যায়-অন্যায় বিচার করে না পাপ-পুণ্য বিচার করে না হালাল-হারাম বিবেচনা করে না। একজন ধনী মানুষকে তার ধনের উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন কুছ বাপকা কুছ আপকা আউর কুছ পাপকা। অর্থাৎ কিছু সম্পদ পাওয়া গেছে পৈতৃক সূত্রে কিছু নিজের উপার্জন আর কিছু পাপের ফসল। পাপ ও অনাচার সম্পদের বন্ধু ও দোসর।
একটা গল্প বলি। শিকারে গিয়েছিলেন দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিশ। রাজকীয় হাতির হাওদায় তার সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। গভীর অরণ্যে এক জায়গায় এসে তারা বিশ্রাম নেয়ার জন্য থামলেন। হাতির হাওদা থেকে তারা বসলেন একটা গাছের নিচে। পরিশ্রান্ত হাতিও শুয়ে পড়লো। এ সময় এক অদ্ভুত দৃশ্য সুলতানের নজরে পড়লো। ঝোপের একটা ব্যাঙ নিচে হাতিটি দেখে অস্থির হয়ে পড়লো। তার এলাকায় হাতি শুয়ে বিশ্রাম নেবে, ব্যাপারটি বুঝি সহ্য হলো না তার। কয়েক লাফে সে হাতির কাছে এসে হাতিটিকে কয়েকবার লাথি মেরে আবার নিজের নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পর পর ব্যাঙটি এসে হাতিকে লাথি মেরে পরে একই জায়গায় গিয়ে বসছে দেখে সুলতান অবাক হলেন। হাতিকে লাথি মারার কারণটি সুলতান খুঁজে পেলেন না। মন্ত্রীর কাছে তিনি এর তাৎপর্য জানতে চাইলেন। প্রধানমন্ত্রী তখন ব্যাঙটির কাছে গিয়ে দেখলেন যে একটা রৌপ্য মুদ্রার উপর শুয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী সুলতানকে এসে বললেন ব্যাঙটির আসলে কোন দোষ নেই। সে ঐশ্বর্যশালী। এই ঐশ্বর্য হারানোর আশঙ্কায় সে তার এলাকায় আসা হাতিকে শত্রু মনে করছে এবং তাকে লাথি মারছে। রূপোর একটি টাকা যদি একটি ব্যাঙকে এমন উদ্ধত ও দুর্বিনীত করতে পারে তাহলে মানুষের আচরণে অহঙ্কার না আসার কারণ নেই। মহান আল্লাহ আমাদেরকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ অর্জন করতেও নিরুৎসাহিত করেছেন।
তিনজন অনুচরসহ হযরত ঈসা আ.-এর সফরে যাওয়ার এবং স্বর্ণমুদ্রা পাওয়ার এবং তার প্রতি তিনজন অনুচরের সীমাহীন লোভ পরিণামে তিনজনেরই মৃত্যুর ঘটনা সবাই জানে। একজনকে খাবার কিনতে পাঠানো হলে সে কেনা খাবারে বিষ মিশিয়ে অন্য দু’জনকে হত্যা করে নিজে যে সম্পদের একা মালিক হতে চেয়েছিল। অন্য দু’জন আধা-আধি নেয়ার পরিকল্পনা করে খাবার নিয়ে আসা লোকটিকে হঠাৎ আক্রমণে মেরে ফেলেছিল। পরে বিষ মেশানো খাবার খেয়ে দু’জন মারা যায়। পারস্যের সাম্রাজ্যের ধনভাণ্ডার মদিনায় আনা হলে তা দেখে কেঁদেছিলেন হজরত ওমর রা.। আবদুর রহমান ইবনে আওফ রা. কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেছিলেন এই ধন-সম্পদ ধ্বংস করেছে তার আগের মালিকদের। আমার ভয় হচ্ছে আমরাও এগুলোর প্রেমে জড়িয়ে পড়বো এবং পরিণামে শেষ হয়ে যাবো।
মালিক শ্রমিকবিরোধ চিরন্তন একটি সমস্যা। মালিকরা শ্রমিকদের কম মজুরি দিয়ে অধিক কাজ করিয়ে নিতে চায়। অধিক উৎপাদন মানে অধিক মুনাফা অধিক অর্থ-সম্পদ। কিন্তু একজন পরিশ্রম করে অথচ ন্যায্য মজুরি পাবে না অন্যজন তাকে বঞ্চিত করে শ্রমের ফল ভোগ করবে এরকম সামাজিক ব্যবস্থা জুলুম। যারা এরকম জীবনব্যবস্থা সমর্থন করে বা কায়েম করতে চায় সেসব জালিমের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা এবং জেহাদ করা ঈমানদার ব্যক্তির কর্তব্য। যারা অন্যের শ্রমের ফল অনধিকারভাবে অন্যায়ভাবে ভোগ করে তারা জালিম। আল্লাহ জীবিকার উপাদান বিশ্বে ছড়িয়ে রেখে দিয়েছেন। বান্দা পরিশ্রম করে মহান রাজ্জাকের নিকট হতে রিযিক গ্রহণ করবে এটাই আল্লাহর বিধান। যে অন্যের শ্রমের ফলভোগ করে তার রিজিকদাতা হয়ে দাঁড়ালো ঐ ব্যক্তিকে জালিম রিযিকদাতা বানিয়ে দেয়, এটা ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ।
ইসলামী সমাজে সকল ব্যক্তিই শ্রমিক। হযরত আদম আ. থেকে হযরত মোহাম্মদ সা. পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলই ছিলেন শ্রমিক। অধিকাংশ নবী মেষ পালকের কাজ করেছেন। আমাদের নবীও মেষ চরাতেন। বিবি খাদিজার ব্যবসায় দায়িত্ব নিয়ে তিনি একাধিক দেশে গেছেন। তিনি কূপ থেকে পানি তোলার পারিশ্রমিক হিসেবে এক বালতির হিসাবে একটি করে খেজুর পারিশ্রমিক পেতেন। তিনি অন্যের ক্ষেতে পানি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শ্রমিকের মজুরি তার গায়ের ঘাম শুকাবার আগে দিয়ে দাও। ইসলামী সমাজে শ্রমিকদের পানাহার এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা মালিকের মতো হতে হবে। গোলামের বা দাস-এর জীবনযাত্রায় মান সম্পর্কে ইসলামের বিধান সুস্পষ্ট। মালিক যে রকম খাবার খাবে যে রকম পোশাক পরিধান করবে যে রকম বিছানায় ঘুমাবে গোলামকেও তাই দিতে হবে। বিদায় হজের ভাষণে রাসূল সা. দাস-দাসীদের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছেন, তাদের ব্যাপারে তোমাদেরকে মহান আল্লাহর নিকট কৈফিয়ত দিতে হবে। জবাবদিহি করতে হবে।
ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান হযরত ওমর রা. তালি দেয়া জামা পরিধান করতেন। বর্তমানে তালি দেয়া জামা গায়ে কোনো সরকারি কর্মচারী তো দূরের কথা কোনো ভিক্ষুকেরও দেখা যায় না। যে সময় খলিফার চেয়ে কম বেতনের কোনো কর্মচারী ছিল না। খলিফা রাষ্ট্রের দরিদ্রতম ব্যক্তির চেয়ে উচ্চতর জীবন যাপন করতেন না। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রে জনগণ হলো রাষ্ট্রের মালিক খলিফা তাদের ভৃত্য। ভৃত্যের জীবনযাত্রার মান মালিকের চেয়ে উন্নত হতে পারে না। হযরত আবু বকর রা. কে পুরাতন কাপড় পরিয়ে কাফন দেয়া হয়েছিল। হযরত ওসমান রা. পিপাসার্ত অবস্থায় শাহাদতবরণ করেন। কারণ তাঁর বাড়িতে পানীয় জলের কোনো কূপ ছিল না। বিদ্রোহীরা তাকে অবরোধ করে রেখে বাইরে থেকে পানি আনা বন্ধ করে দিয়েছিল। রাসূল সা. প্রবর্তিত অর্থব্যবস্থার মূল দর্শন হচ্ছে সমাজে ও রাষ্ট্রে সুষম ভারসাম্যপূর্ণ কার্যকর অর্থব্যবস্থার প্রবর্তন। রাসূল সা. বলেছেন, যার নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ সম্পদ রয়েছে তার উচিত অভাবগ্রস্তকে তা দিয়ে দেয়া। যার নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য ও পানীয় রয়েছে সে যার কাছে ওগুলো নেই তাকে দিয়ে দেবে। আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন, রাসূল সা. এভাবে বিভিন্ন সম্পদের কথা উল্লেখ করে বলতে থাকলেন। তখন আমাদের নিকট প্রতিভাত হলো আমাদের কারোরই প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদের ওপর কোনো অধিকার নেই। রাসূল সা. বলেছেন, দৈহিক পরিশ্রমের মাধ্যমে যা উপার্জিত হয় তাই হচ্ছে উত্তম জীবিকা। শ্রমিকের সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ তার ওপর চাপিয়ে দিতে রাসূল সা. নিষেধ করেছেন।
ইসলামী সমাজে স্বাভাবিক গতিতে জীবনের সকল কাজ সম্পন্ন হবে। মানুষ সুখে-শান্তিতে দুনিয়ার জীবন অতিবাহিত করবে এবং সৎ জীবন যাপন করার কারণে আখেরাতেও মুক্তির আশা করতে পারবে। মানুষের জীবনের মৌলিক প্রয়োজন সকলের প্রায় এক। তাই মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য ভোগের স্তরের পরিমাণও ছিল একই রকম। মালিককে শুধু যে শ্রমিকের সুখ-সুবিধা, আহার-বিনোদনের চাহিদার প্রতিই লক্ষ্য রাখতে হয় তা নয় বরং প্রতিবেশীর প্রয়োজনের প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হয়। প্রতিবেশী অভুক্ত জেনে যদি কেউ দু’বেলা পেট ভরে খায় তবে সে মোমেন থাকে না।
যে কোনো কাজ করাকেই শ্রম বলা হয়। শ্রমিককে ইংরেজিতে Labour বলা হয়, আর আরবীতে বলা হয় আমেল। সাধারণ অর্থে যারা পরিশ্রম করে তাদেরকেই শ্রমিক বলা হয়। প্রচলিত অর্থে সমাজে বা রাষ্ট্রে যারা অন্যের অধীনে অর্থের বিনিময়ে পরিশ্রম করে তাদেরকে শ্রমিক বলা হয়। আল্লাহ পাক রাববুল আলামিন প্রত্যেক মানুষকে তার গোলামি করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর আল্লাহর বিধান মতো কাজ করার নামই আমল। এক অর্থে প্রতিটি মুসলমান শ্রমিক হিসাবে শ্রম দিয়ে থাকেন। একজন প্রেসিডেন্টও শ্রম দিয়ে থাকেন, আবার একজন দিনমজুরও শ্রম দিয়ে থাকেন- এ অর্থে সবাই শ্রমিক। শ্রমের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ মার্শাল বলেছেন “Any exertion of mind or of body undergone partly or of wholly with a view to some good other then pleasure derived directly form the work.”
কুরআন হাদীসের আলোকে শ্রমিকের অধিকার :
১) মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন করে দিবে। আল-হুজুরাত। ২) তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা তোমাদের ভাই, আল্লাহ যে ভাইকে তোমার অধীন করে দিয়েছেন তাকে তাই খেতে দাও যা তুমি নিজে খাও, তাকে তাই পরিধান করতে দাও যা তুমি নিজে পরিধান কর। -বুখারী আবু হুরায়রা রা.। ৩) ক্ষমতার বলে অধীনস্থ চাকর-বাকর-দাসীর প্রতি খারাপ আচরণকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, আপনি কি বলেননি অন্যান্য জাতির তুলনায় এ জাতির মধ্যে ইয়াতিম ও গোলামের সংখ্যা বেশি হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতএব তোমরা তাদেরকে সন্তানের মতো আদর যত্ন করবে এবং তোমরা যাই খাবে তাদেরকে তাই খাওয়াবে। হযরত আবু বকর রা: বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, অধীনস্থদের সাথে ক্ষমতার অপব্যবহারকারী জানাতে প্রবেশ করতে পারবে না। ইবনে মাযাহ্। ৪) আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন- কেউ তার অধীনস্থকে অন্যায়ভাবে এক দোররা মারলেও কিয়ামতের বিচারের দিনে তার থেকে এ বদলা নেয়া হবে।-তাবরানী। ৫) হজরত ওমর রা: বলেন, যৌবনকালে যে ব্যক্তি শ্রম দিয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের খেদমত করেছেন বৃদ্ধকালে সরকার তার হাতে ভিক্ষার ঝুলি দিতে পারে না -ইবনে মাযাহ্। ৬) দাস-দাসীদের সাথে ভালো ব্যবহার সৌভাগ্য, আর তাদের সাথে দুর্ব্যবহার দুর্ভাগ্য। ৭) মজুরকে তার কাজ হতে অংশ দান কর, কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যায় না।- মুসনাদে আহমাদ। ৮) তোমাদের খাদেম যদি তোমার খাদ্য প্রস্তুত করে এবং তা নিয়ে যদি তোমার কাছে আসে যা রান্না করার সময় আগুনের তাপ ও ধোঁয়া তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে তখন তাকে খাওয়াবে। খানা যদি অল্প হয় তবে তার হাতে এক মুঠো, দু’ মুঠো অবশ্যই তুলে দিবে।-মুসলিম। ৯) উমর ইবনে হুরাইস রা. হতে বর্ণিত নবী করিম সা. বলেছেন, তোমরা তোমাদের কর্মচারীদের থেকে যতটা হালকা কাজ নিবে। তোমাদের আমলনামায় ততটা পুরস্কার ও পুণ্য লেখা হবে। ১০) হযরত যুবাইর রা. বলেছেন, নবী করিম সা. চাকরের সাথে একত্রে বসে খেতে বলেছেন। ১১) আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেছেন, এক ব্যক্তি নবী করিম সা.-এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করল হে আল্লাহর রাসূল সা. চাকর-বাকরকে কতবার ক্ষমা করব? তিনি চুপ রইলেন। সে পুনরায় তাঁকে প্রশ্ন করলে এবারও তিনি চুপ রইলেন। সে পুনরায় তাঁকে প্রশ্ন করলে এবারও তিনি চুপ রইলেন। চতুর্থবার বলার পর তিনি বললেন দৈনিক সত্তর বার ক্ষমা করবে।-আবু দাউদ। ১২) আবু হুরায়রা রা. বলেন নবী করিম সা. বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন আমার দাস, আমার দাসী না বলে কেননা আমরা সকলে আল্লাহর দাস-দাসী।
১৩) রাসূল সা. বলেছেন তোমাদের কেউ তার পিঠে বহন করে কাঠের বোঝা এনে বিক্রি করা, কারো নিকট ভিক্ষা চাওয়ার চেয়ে উত্তম, চাই সে দিক বা না দিক। বুখারী মুসলিম-আবু হুরায়রা। ১৪) যে ব্যক্তি মানুষের কাছে চায়, অথচ তার নিকট বেঁচে থাকার সম্বল আছে, নিশ্চয় সে অধিক জাহান্নামের আগুন সংগ্রহ করছে।-আবু দাউদ। ১৫) দেহের যে অংশ হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। হারাম খাদ্যের গঠিত শরীরের জন্য জাহান্নামের আগুনই উপযুক্ত-আহমাদ-বায়হাকি- জাবের রা.। নবী-রাসূলগণও শ্রমিক হিসাবে কাজ করেছেন। তারা বিভিন্ন পেশায় শ্রম দান করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাদের কাছে শ্রমের মর্যাদা ছিল অনেক উচ্চে। নিজ হাতে কাজ করে শ্রমিক দিয়ে খাবার খাওয়ার মতো উত্তম খানা আর হতে পারে না।
১) হযরত আদম আলাইহিস সালাম কৃষক ছিলেন। ২) হযরত নূহ আলাইহিস সালাম ছুতার (কাঠ মিস্ত্রি) ছিলেন। ৩) হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম কর্মকার ছিলেন। ৪) হযরত ইদ্রিস আলাইহিস সালাম দর্জি ছিলেন। ৫) হযরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম ছুতার (কাঠমিস্ত্রি) ছিলেন। ৬) হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম রাজমিস্ত্রি ছিলেন। ৭) হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম রাজমিস্ত্রি সহকারী (যোগাড়ি) ছিলেন। ৮) হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ছাগলের রাখাল ছিলেন। ৯) আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মদ সা. ছাগল চরিয়েছেন।
হে মানবজাতি আমি তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছি যে, গোলামের সাথে ভালো আচরণ করবে এবং তাদের কোন প্রকার কষ্ট দেবে না। তোমরা কি জান না যে, তাদেরও একটি অন্তর আছে, যা কষ্ট পেলে ব্যথা পায় এবং আরাম পেলে আনন্দিত হয়। তোমাদের কী হয়েছে? তোমরা তাদেরকে হীন মনে কর এবং তাদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর না। এটা কি জাহিলিয়াতের যুগের মানসিকতা নয়? অবশ্য এটাই জুলুম এবং বেইনসাফি। আমি জানি, জাহিলিয়াতের যুগে তাদের কোনো মর্যাদা ছিল না, গোলামদেরকে পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট মনে করা হতো, আল্লাহর সকল বান্দা যে এক, তারা ভুলে গিয়েছিল। সে সমাজের রাষ্ট্রপতি, সমাজপতি ও দলপতিরা সকল মান সম্মান ও মর্যাদা একক অধিকারী হয়ে বসেছিল। অথচ অধীনস্থরা ইনসাফের দাবি করার অধিকার রাখে। আমার সেই যুগের কথা মনে আছে, যখন রাষ্ট্রপতি, সমাজপতি ও দলপতিরা নিজেদেরকে মর্যাদা সম্পন্ন ও সম্মানিত মনে করত এবং নিজেদেরকে নির্লোভ ও নির্দোষ বলে প্রচার করতো। তাদের নিকট অধীনস্থ খাদেমদের জীবনের উদ্দেশ্য ছিল- তারা তাদের মালিকদের খেদমত করবে, তাদের জুলুম নির্যাতন সহ্য করে থাকবে, তাদের সামনে বসাও ছিল অন্যায়, তাদের সামনে কথা বলা ছিল মহাপাপ এবং তাদের কোনো অপকর্মের প্রতিবাদ করা ছিল মৃত্যুদণ্ড তুল্য। কিন্তু ইসলাম এসে তাদের এসব অমানবিক আচরণ ও সকল গর্ব, অহংকার পদদলিত করে দিলো।
হে লোক সকল! আমি তোমাদেরকে তোমাদের প্রভুর ফরমান জানিয়ে দিচ্ছি যে, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তোমাদের মধ্যে মুত্তাকি। তোমরা জান, মানবজাতি আদমের সন্তান এবং আদম হচ্ছে মাটির তৈরি। অতএব অহংকার করার কি কারণ থাকতে পারে? স্মরণ রাখ ইসলামের দৃষ্টিতে সকল মানুষের মর্যাদা সমান। ইসলামী আদর্শের কাছে মনিব-গোলাম, বড়-ছোট, আমীর-গরিব সবাই সমান। মানুষের মধ্যে শুধু তাকওয়া এবং সৎ কাজের মাধ্যমে পার্থক্য হতে পারে। এটাই যখন প্রকৃত ব্যাপার, তবে তোমরা কেন তোমাদের অধীনস্থদের হীন মনে কর, আমি লক্ষ্য করছি যে, যখন কোন চেহারাকে রক্তিম করে নিজেকে পেশ করে এবং খাদেমের পক্ষ থেকে সামান্যতম ভুলও বরদাস্ত করে না, ইহা জাহিলিয়াতের আচরণ ছাড়া আর কিছু হতে পারে? মালিকের চেয়ে গোলাম অনেক ভালো এবং মহান আল্লাহর কাছে তার আমল পছন্দনীয়।
হে লোক সকল! মানুষ জাহিলিয়াতের শাসনব্যবস্থা ভুলতে পারে না, যখন স্বৈরাচার তার সকল শক্তি দ্বারা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয় এবং তাদের স্বাধীনতা হরণ করে। সেই যুগের সাক্ষী আমি নিজেই, যখন অধীনস্থ গোলামদের সাথে পশুর মতো আচরণ করা হতো এবং তাদের প্রতি জুলুম করা হতো, তাদেরকে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট মনে করা হতো। কিন্তু মহান আল্লাহ তাদের প্রতি রহম করলেন, তাদের অধিকারগুলো প্রকাশ করে দিলেন এবং তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দান করলেন। আমি আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তোমাদেরকে বলছি যে, তোমরা তাদের ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে। তোমরা তাদের থেকে এতটুকু কাজ নেবে যা তাদের জন্য সহজ। তোমরা তাদেরকে তাই খেতে দেবে যা তোমরা নিজেরা খাও। তোমরা তাদেরকে তাই পড়তে দেবে যা তোমরা নিজেরা পরিধান কর। তোমরা তাদের সাথে সে রকমের আচরণ করবে যে ধরনের আচরণ তোমরা তোমাদের প্রিয়জনদের সাথে করে থাক। তোমরা তাদের জন্য তাই পছন্দ করবে যা তোমরা নিজেদের জন্য পছন্দ করে থাক। তোমরা যা নিজেদের জন্য অপছন্দ কর, তাদের জন্যও তা অপছন্দ করবে এবং তোমরা তাদের নিকৃষ্ট মনে করবে না। যখন তোমরা তাদেরকে সফরে নিয়ে যাও, তাদের আরাম-আয়েশের প্রতি দৃষ্টি রাখবে, যদি তোমাদের কাছে কোনো বাহন থাকে, কিছু সময় তোমরা আরোহণ কর আবার কিছু সময় তাদেরকেও বাহনে আরাম করার সুযোগ করে দাও। তারা মানুষ হিসেবে তোমাদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তোমাদের যেমন একটি অন্তর আছে তেমনি তাদেরও একটি অন্তর আছে।
আমি তোমাদেরকেও উপদেশ দিচ্ছি যে, যখন তোমার খাদেম তোমাদের নিকট খানা নিয়ে আসে তোমরা তখন তাদেরকে তোমাদের সাথে বসিয়ে খাওয়াবে, যদি পর্যাপ্ত না হয় অন্তত কিছু না কিছু তাকে দিয়ে দাও, গোলামরা যদি কোনো অন্যায় করে তাহলে প্রতি দিন সত্তর বার তাদেরকে ক্ষমা করে দাও। এ জন্য যে, তোমরা যার গোলাম তিনি তোমাদের হাজারও অন্যায় ক্ষমা করে দিচ্ছেন এবং স্মরণ কর যে ব্যক্তি অধীনস্থদের উপর এমন অভিযোগ উত্থাপন করবে মূলত সে তা করেনি তাহলে কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তিকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। তোমাদেরকে আমি বারবার বলছি যে, অধীনস্থরা তোমাদের ভাই আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। অতএব যে ভাইকে অধীনস্থ করে দেয়া হয়েছে তোমরা যা খাও তাদেরকেও তা খেতে দাও। তোমরা যা পরিধান করো তাদেরকেও তা পরিধান করতে দাও। তাদেরকে এমন কঠিন কাজ দিও না যা তাদের শক্তির চেয়ে বেশি। -খুতবাতে নবী করীম সা.।
লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও গবেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন