post

ইসলাম মানবতার মুক্তির বাণী। মানবতাকে বর্তমান চারিত্রিক হীনতা থেকে, দুর্নীতি, দারিদ্র্য থেকে উদ্ধার করতে হবে

১০ ফেব্রুয়ারি ২০১২
শাহ আবদুল হান্নান (সাবেক সচিব এবং বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও অর্থনীতিবিদ জনাব শাহ আব্দুল হান্নান। সম্প্রতি বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট ও অন্যান্য অস্থিতিশীলতা নিয়ে খোলামেলা কথা হয় তাঁর সাথে। অর্থনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে রাসূলের (সা) তথা ইসলামের অনুসৃত অনন্য নীতির বাস্তবায়নের কথা উঠে আসে তাঁর কথা থেকে। বর্তমান প্রজন্মকে ইসলামের অনুশাসনসমূহ মেনে সুন্দর ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গঠনেরও পরামর্শ দেন শাহ আবদুল হান্নান। সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য অংশ ছাত্র সংবাদের প্রিয় পাঠক ও সুধীমহলের জন্য তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন মাজহারুল ইসলাম) ছাত্র সংবাদ : বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলুন। শাহ আবদুল হান্নান : আজকে ১৩ জানুয়ারি ২০১২ সালের এ সময় আমার মনে হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য নেই। সরকারের ব্যয় আয়ের তুলনায় অনেক বেশি। এজন্য সরকারকে অতিমাত্রাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। এবং এই ঋণের ফলে মুদ্রাস্ফীতির ওপর চাপ পড়ছে। বার্ষিক যে উন্নয়ন পরিকল্পনা আছে তার ব্যয় মেটানো যাচ্ছে না এবং বৈদেশিক অনুদান কমে গেছে। বৈদেশিক অনুদান কমে যাওয়া যে খারাপ তা নয়। কিন্তু বৈদেশিক অনুদান নেয়া অন্য প্রশ্ন। এই মুহূর্তে প্লানে সেটা কমে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে গেছে এবং দশ বিলিয়ন ডলারের নিচে চলে এসেছে। এর দ্বারা ৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে না। কারণ নিয়ম হচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে ধরা হয় যে তিন মাসের কম যদি রিজার্ভ থাকে, আমদানি ব্যয় মেটাতে না পারে সেটা দেশের জন্য ভালো নয়। তারপর আমরা দেখতে পাচ্ছি যে দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলেছে এবং এসব কারণে স্বাভাবিকভাবে মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে আরো মারাত্মক যেটা সেটা হলো দুর্নীতি ক্রমেই বাড়ছে এবং নানাভাবে বাড়ছে। আমরা যে বলি রাস্তা ঘাট ভালো না, এর মূল কারণ কিন্তু দুর্নীতি। হয় কন্ট্রাক্টর দুর্নীতি করছেন, না হয় ম্যানেজার করছেন, না হয় অফিসার সাহেব, না হয় সবাই মিলেই করছেন। এই একটাই জাতীয় উদাহরণ একইভাবে সবখানে এবং দুর্নীতি আমাদের উন্নয়নকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সুতরাং আমি বলবো যে, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি পরিস্থিতি মোটেই ভালো বলা যাবে না। আমি রাজনৈতিক পরিভাষা ব্যবহার করবো না এবং আমি বলবো না যে একেবারেই ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে।  “ভালো নয়” এটাই আমি বলতে পারি। ছাত্র সংবাদ :  অর্থনীতির এই অবস্থার কারণ কী বলে মনে করেন? শাহ আবদুল হান্নান : অর্থনীতির এই অবস্থার কারণ আমি খুব সংক্ষেপে বলব। আমাদের ম্যানেজমেন্ট ফেলো অর্থাৎ যারা অর্থনীতি ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে তারা ফেইলুর বা তাদের ব্যর্থতা  হচ্ছে যে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতা এবং মিনিস্ট্রি কার্যক্রম করেন ও বাজেট কার্যকর করেন তাদের ব্যর্থতা। যখন যে সরকার থাকে তাকেই আমরা ব্যর্থ বলি। এই ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার বর্তমানের জন্য দায়ী, আর আগের জন্য আগের সরকার। আগের সরকার এইভাবে করে গেছেন বলে আমরাও এইভাবে করব এটা ঠিক নয়। সুতরাং কারণ হচ্ছে ম্যানেজমেন্ট ফেইলুর বা এগুলো চালাতে ব্যর্থ হয়েছি, এগুলো ঠিক মত করতে ব্যর্থ হয়েছি। ছাত্র সংবাদ : এ থেকে উত্তরণের উপায় কী? শাহ আবদুল হান্নান : আমি মনে করি শর্ট টাইমে বা স্বল্প মেয়াদে এর থেকে বেরিয়ে আসা যাবে নাÑ আমি যদি ইকোনমিকসের দৃষ্টিতে বলি, বাস্তববাদী হিসেবে বলি। আর রাজনৈতিক ভাষা বললে আমাকে বকাবকি করতে হয়Ñ এটা করতে আমি মোটেই প্রস্তুত নই বা রাজি নই। স্বল্পমেয়াদে এটা দূর করা সম্ভব নয়, তবে স্বল্পমেয়াদে আমাদের কী করতে হবে এবং মধ্য মেয়াদে কী করতে হবে এটা আমি বলে দিচ্ছি এখনি। স্বল্পমেয়াদে আমরা সব কিছু পারবো না কিন্তু এইটুকুতো করতেই হবে, আমাদের রফতানি আয় বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। সরকারকে আমাদের রাজস্ব ব্যয় কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির পরিমাণ ছোট করতে হবে। যেখানেই সম্ভব উন্নয়নকাজ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে। রাজস্ব বৃদ্ধি করতে হবে। একমাত্র দারিদ্র্য দূরীকরণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখে অন্যান্য ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে। সেটা না করে উপায় নাই। কৃষক যাতে সঠিক দাম পায়, তার জন্য যথাযথ সংগ্রহ নীতি গ্রহণ করতে হবে। এর মানে হচ্ছে ধান, গম, পাট, আলুর মতো ক্ষেত্রে যেখানে সংগ্রহ করা দরকার তা করতে হবে। না হলে কৃষকরা দাম পায় না। এক্ষেত্রে যা হয় তা হলোÑ সরকার এগুলো সংগ্রহ করে না। ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগ (সবাই না) প্রফিট লাভের আশায় থাকেন এবং মনে করেন দাম পড়ে যাক তার পরে কিনবো, তখন কিনলে আমার প্রফিট বেশি হবে। এর থেকে বাঁচাবার দায়িত্ব সরকারের। এর একটা হতে পারে আমরা প্রাইজ ঠিক করে দিলাম হিসাব করে, এর নিচে কেউ কিনতে পারবে না। এটা কার্যকর করা কঠিন তথাপি এটা করে দেয়া দরকার। যাতে অন্তত ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলো সুপারভাইজ করতে পারে যে এই দামের নিচে আপনারা কিনবেন না। সর্বোপরি নিজেকে সংগ্রহ করতে হবে সরকারকে। হয়তো এখনই সরকারের হাজারখানেক গুদাম আছে, দরকার হলে আরো গুদাম বাড়াতে হবে, গুদাম ভাড়া নিতে হবে। অন্তত কয়েকটা জিনিস কিনতে হবেÑ ধানের সময় ধান, গমের সময় গম, পাটের সময় পাট, আলুর সময় আলুÑ এরকম যদি আরো ফসল থাকে যা লক্ষ লক্ষ টন হয়, না করলে অসুবিধা হবে। এরকম পরিকল্পনা তো সরকারের আছেই আশা করি, কিন্তু সেটাকে আরো সঙ্গত করতে হবে, আরো ব্যাপক করতে হবে, চিন্তা করতে হবে আমরা ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করতে পারবো না। এতে ব্যবসায়ীরা ইন্টারেস্টেট হবেন না। কৃষকরা তার মূল্য পেলে এতে ইন্টারেস্টেট হবে। এখানে অনেক প্রশ্ন উঠবেÑ সংগ্রহে আমাদের গুদাম আছে কী না। আমি বলবো আছে এবং না থাকলে ভাড়া করেন। কঠিন হলেও করতে হবে এবং দুই ফসলের মধ্যে আপনি যা সংগ্রহ করতে পারেন রফতানি করেন, না পারলে দেশে ছেড়ে দেন। এগুলো স্বল্পমেয়াদে করতে হবে। এক-দুই বছরে এগুলো সমাধান করা সম্ভব হবে না। কিন্তু মধ্যমেয়াদে যেটা করতে হবে তা হচ্ছে, ২০০৮ সাল থেকে মন্দা শুরু হয়েছে এবং ২০১১ সালে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তার প্রধান কারণ ভারসাম্যহীন বাজেট। পাশ্চাত্যের অনেক দেশই অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সূত্র থেকে ঋণ নিয়ে তাদের খরচ মেটাচ্ছে। তারা অনেক অপ্রয়োজনীয় খরচ করছে, যেমন যুদ্ধের খরচ। এটা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের বেলায় সত্য। যারা আফগানিস্তান ও ইরাকের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তারা ধনীদের চাপের কারণে ট্যাক্স বৃদ্ধি করতে পারছে না, নানা কারণে সে দেশের রাজনীতি বড় বড় শিল্পপতিদের বড় কর্পোরেশনের কাছে বন্দী ফলে রাজনীতিবিদ যারা নির্বাচিত হন তাদের টাকায়। পার্টিগুলো পরিচালিত হয় তাদের টাকায়। এমএলএ হন বা ঐ দেশের সিনেটর হন তাদের টাকায়, পার্লামেন্ট মেম্বার হন তাদের টাকায়। ফলে তারাও ঐসব লবির কাছে বন্দী এবং তারা ধনীদেরকে ট্যাক্স করতে পারেন না। ধনীদেরকে কম ট্যাক্স দিতে হয়। বরং ধনীরা বলে ‘সামাজিক প্রোগ্রাম কমাও, পেনশন বেনিফিট, স্বাস্থ্যসহায়তা কমাও’ এবং সেটার কারণে তারা বাড়াতে পারে না, কমাতে বাধ্য হয়। এখন ইউরোপে এগুলো আরো কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসবের কারণেই দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, গণ-অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অকুপাই আন্দোলনের জন্ম হয়েছে। আমরা জানি অকুপাই আন্দোলন যারা করেছেন তাদের স্লোগান হচ্ছে “সম্পদ চলে গেছে এক পারসেন্টের কাছে, নিরানব্বই পারসেন্টের কাছে সম্পদ নেই”। নিরানব্বই পারসেন্ট এখন এক পারসেন্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। এসবের আরেকটি কারণ হচ্ছেÑ পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণাধীনতা (লেইসেজ ফেয়ারে) মানে অর্থনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এর ফলে পুঁজিবাজারের সুযোগ বৃদ্ধি পায়, এবং মূল্যবোধহীনতা (পজিটিভিজম) নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রেক্ষাপট সামনে রেখে বাংলাদেশের অর্থনীতি মধ্যমেয়াদে ভারসাম্যপূর্ণ করার জন্য কতকগুলো প্রস্তাব পেশ করছি : হ    বাজেট ভারসাম্যপূর্ণ রূপে ফিরিয়ে আনা। বাজেটে আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে। ট্যাক্স আরোপ করেই সরকারি রাজস্ব ও উন্নয়ন ব্যয় মেটাতে হবে। হ    মধ্যমেয়াদে বৈদেশিক ঋণ পরিহার করতে হবে। পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ঋণ করে সরকার খরচ মেটাতে গিয়েই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ যদি না পারে, তাহলে আমরা কিভাবে পারব? যতটুকু উন্নয়ন ট্যাক্স থেকে পারা যায় ততটুকুই সরকারি বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের প্রোগ্রামে রাখতে হবে। বাকি উন্নয়ন বেসরকারি খাতে করবে। বিদেশী বিনিয়োগ প্রয়োজনমতো নেয়া যাবে, তবে তা আমাদের জাতীয় স্বার্থের অনুকূল হতে হবে। এটা করতে গিয়ে যদি রাজস্ব ব্যয় কমাতে হয়, তবে তা কমাতে হবে। এ জন্য মধ্যমেয়াদে কেবল দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ভর্তুকি ছাড়া অন্য সব ভর্তুকি তুলে দিতে হবে অথবা সবচেয়ে কম করতে হবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে গ্যাস ও জ্বালানি উৎপাদন বা ক্রয়মূল্যের (ঈড়ংঃ চৎরপব) কমে বিক্রি করা যাবে না। মূল্য কমে গেলে সাথে সাথে কমাতে হবে। বেড়ে গেলে বাড়াতে হবে। হ    এসব করা কঠিন, তবে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে। এসব যদি না পারি তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি মধ্যমেয়াদেও ঠিক করা কঠিন হবে। সুতরাং আমি ছাত্রসংবাদকে বলতে চাই, ছাত্র সংবাদের মাধ্যমে তার পাঠককে বলতে চাই, আমাদের বাস্তববাদী অর্থনীতি শিখতে হবে। ছাত্র সংবাদ :  রাসূলের (সা) অর্থনৈতিক দর্শন সম্পর্কে বলুন। শাহ আবদুল হান্নান: রাসূল (সা) মানে ইসলাম। ইসলামের অর্থনীতির মূল নীতিগুলো আমরা ক্রমেই দেখতে পাচ্ছি এবং এগুলো সুস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে আরো। প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে আরো। যেমন একটা উদাহরণ দিই। একসময় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ে ছিল সকল সম্পদের ওপরে (মেস অব প্রোডাকশন) সরকারের নিয়ন্ত্রণ হবে এবং সেটা ব্যর্থ হয়ে গেছে। ইসলাম বলে নাই সবকিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। ইসলাম বলেছে শুধু যেখানে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার সেখানে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং যেখানে দরকার সেখানে রেগুলেশন করতে হবে। এ কারণে ইসলামের হিজমা বলে একটা কনসেপশন (অ্যাকাউন্টিবিলিটি) আছে যে, সরকার দেখবে অর্থনীতি সঠিকভাবে চলছে কি না এবং অর্থনীতিতে কোনো গ্যাপ আছে কি না, কোনো অসঙ্গতি আছে কি না। এগুলো দেখবে এবং এগুলো তারা চাইলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সুতরাং আমরা সোসালিজম-এর ফেইলুর দেখলাম। কারণ এতে যে নীতিগুলো আছে সেগুলো ইসলামে নেই। ইসলাম বলেছে যে প্রাইভেট প্রপার্টি থাকবে, মিন্স অব প্রডাকশন থাকবে, দেশে উন্নয়নে সবাই অংশগ্রহণ নেবে, সবার স্বাধীনতা থাকবে। কিন্তু হিজমা থাকবে। অর্থাৎ প্রয়োজনে সরকার নিজে করবে। অনেক কাজ নিজে হাতে নিয়ে নেবে। অনেক কাজ প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ করবে। প্রয়োজনে প্রাইজ কন্ট্রোল করবে। প্রয়োজন ছাড়া ইসলাম প্রাইজ কন্ট্রোল পছন্দ করে না। ক্যাপিটালিজম-এর দুর্দশাগুলোও স্পষ্ট। যেমন ওরা বলছে, ‘লেইস এ ফেয়ার’ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণহীন হবে। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করবে না। কিন্তু ইসলাম বলছে রাষ্ট্র ইন্সপেকশন করবে। সুপারভিশন হবে, যাকে আরবিতে হিজমা বলে। তেমনি তারা বলছে মূল্যবোধ থাকবে না। সেই দুর্বলতা ইসলামে নেই। রাসূল (সা) যে নীতি বলেছেন, তাতে আমরা দেখছি অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি থাকবে, মূল্যবোধ থাকবে। জাসটিস এনসিউর থাকবে। ক্যাপিটালিজমের পরিভাষায় জাসটিস শব্দ নাই। তারা বলে অর্থনীতিকে তার নিজের গতিতে চলতে দাও। এবং তাদের কথা ‘আমার ব্যবসা আমার কাছে, রাষ্ট্রের কী বলার আছে’ এরকম। আর এই ক্ষেত্রে ইসলাম বলছে, তোমার ব্যবসা সীমালংঘন করতে পারবে না। তাহলে আমরা দেখতে পারলাম ক্যাপিটালিজমের যে দুরবস্থা সেখানে ইসলামে নেই। ইসলামের মূল ইনস্ট্রাকচার আমরা জানি। আর আরেকটা দুর্বলতা তাদের প্রমাণ হয়েছে যে সুদের মাধ্যমে সমাজে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পায়, দারিদ্র্যতা বৃদ্ধি পায়। ইসলাম সেটাকে হারাম করে দিয়েছে। ইসলাম চায় বিনিয়োগ অন্য ভাবে, সুদের মাধ্যমে না হোক। ব্যবসায়িক তরিকায় হোক। সেটা শরিকানা তরিকায় হোক। সুতরাং আমরা দেখলাম ওইসব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যে রুলিং আইডিলোজিস ছিল সেসব অসঙ্গতি ইসলামে নেই। ইসলাম প্রাইভেট প্রপার্টিজকে স্বীকার করেছে। মেস অব প্রডাকশনকে স্বীকার করছে। অসঙ্গতিগুলো এর মধ্যে নেই। এবং এটাও ঠিক রাষ্ট্রের যে একটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে, কন্ট্রোল থাকবে। এদিক দিয়ে সোসালিজম-এর একটা মিল আছে। কিন্তু সোসালিজম-এর যে সব কিছু নিয়ে নিতে হবে, সব কিছু সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে, কোনো মালিক থাকবে না, এই সমস্ত অসংগতি ইসলামে নেই। তাই এক ভাষায় ইসলামকে আমি বলবো ফ্রি মার্কেট অব হিজবা। স্বাধীন বাজারব্যবস্থা হিজবার আওতায়, মূল্যবোধের আওতায়। ছাত্র সংবাদের পাঠকদের অনুরোধ করবো আপনারা ড. ওমর চাপরার যে বইগুলো বিশেষ করে অর্থনীতির ওপর তা অধ্যয়ন করবেন। ছাত্র সংবাদ : বর্তমানে রাসূলের (সা) দর্শনকে কিভাবে প্রয়োগ করা যায়? শাহ আবদুল হান্নান : আমার মনে হয় এটাকে দু’ভাবে করা যায়। একটা হলোÑ যেখানে ইসলামী সরকার হয়ে যাচ্ছে সেখানে তারা বেশি চেষ্টা করতে পারে। যেমন আমরা দেখতে পাচ্ছি মিসরে ইসলামী সরকার হতে যাচ্ছে। অথবা তিউনিসিয়াতে, অথবা মরক্কোতে এবং এরকম পরিবর্তন যদি আরো দেশে হয় যেমন ইরান, পাকিস্তান, সৌদি আরবে কিছুটা হলেও এরা চাইলে রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে ইসলামের প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু যেখানে ইসলামী সরকার নেই কিন্তু গণতন্ত্র আছে, সেই ক্ষেত্রে আমরা অনেক কাজ করতে পারি। গণতন্ত্র ইসলামের জন্য খুব সুবিধাজনক। সেই সুযোগে আমরা ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ইনস্যুরেন্স, ইসলামী বীমা করতে পারি। সমগ্র ইসলামী অর্থনীতিকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তো অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর এটা প্রমাণিত হয়েছে যে ইসলামী ব্যাংকিংগুলো সাফল্যজনক হয়েছে। সাধারণ ব্যাংকিংগুলোর যে  দোষত্রুটি থাকে সেটা ইসলামী ব্যাংকিংয়ে নেই। এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে ইসলামকে যারা ভালোভাসেন তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত তারা ইসলামী কার্যব্যবস্থা করবেন অন্য দিকে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, কলেজ, স্কুল করবেন। ছাত্র সংবাদ : আপনি কি মনে করেন সহসাই বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্কট নিরসন সম্ভব? শাহ আবদুল হান্নান : না, এটা সহসাই সম্ভব নয়। এটা আমাদের মধ্যমেয়াদে করার চেষ্টা করতে হবে। ছাত্র সংবাদ : এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে করণীয় কী? শাহ আবদুল হান্নান : সরকার শুধু সেইটুকু করবে তার বাজেটের আওতায় যতটুকু সম্ভব, ট্যাক্স করে যতটুকু করা সম্ভব ততটুকু। এর বাইরে নয়। বাকিগুলো বেসরকারি খাতকে ছেড়ে দিতে হবে। ছাত্র সংবাদ : বাংলাদেশের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? শাহ আবদুল হান্নান : এটাতো ঠিক যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সঙ্কটের মধ্যে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট, রাজনৈতিক সঙ্কট আছে। কেউই বলবে না যে সঙ্কট নেই। এটা আমাদের সরকারও বলবেন না। বিরোধী দল, বুদ্ধিজীবী মহলÑ কেউই বলবেন না যে সঙ্কট নেই। সুতরাং সঙ্কট আছে। সে সঙ্কটটা হচ্ছে রাজনৈতিক। আমি আশা করব এসব সঙ্কট যেভাবে হউক সমাধান হবে। একটা সমাধান করতে হবে। সমাধান না করলে জাতির ক্ষতি হবে। ছাত্র সংবাদ : দেশের গন্তব্য কোথায় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে? শাহ আবদুল হান্নান : খারাপ বলাতো ঠিক নয়, কিন্তু মনে হচ্ছে খারাপ, আমি খারাপ বলতে চাই না। আমি বলবো, আসুন, সবাই মিলে দেশটাকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলি। ছাত্র সংবাদ : স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজনকে আপনি কোন্ দৃষ্টিতে দেখছেন? শাহ আবদুল হান্নান : আমার তো মনে হয় বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার ৪০ বছর পর এ বিভাজনটা আর চায় না। আমার নিজের মত হচ্ছে, আমি মেজোরিটিতে বিশ্বাস করি। আমার যত বন্ধু-বান্ধব আছে, আমি যত লোকের সাথে দেখা করি তারা বলে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর এটা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত নয়। গঠনমূলক আলোচনা হওয়া দরকার। এ নিয়ে বিভাজন করতে যেয়ে দেশকে পেছনে ঠেলে দিতে পারি না। আমাদের চিন্তা করা দরকার সামনে কিভাবে আমরা যোগ্য লোক তৈরি করতে পারি, কিভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। ভালো শিক্ষার ব্যবস্থা করবো, লোকের দারিদ্র্য দূর করবোÑ এরকমটা আমাদের করা উচিত। কিছু লোক চাইতে পারে কিন্তু আমি মেজোরিটির দলে কারণ আমি মেজোরিটিতে বিশ্বাস করি। ছাত্র সংবাদ : ছাত্র সংবাদের পাঠক তথা তরুণ সমাজের প্রতি আপনার কোনো বিশেষ বক্তব্য আছে কি? শাহ আবদুল হান্নান : তাদেরকে আমি বলবো, আপনারা ভালো, আপনারা ভালো ছেলে-মেয়ে। আপনাদের আরো বেশি করে পড়তে বলবো। আপনারা বেশি করে পড়বেন। আমি বলবো পড়বেন, পড়বেন এবং পড়বেন। আর যারা লিখতে পারেন তারা লিখবেন, লিখবেন এবং লিখবেন। এবং বই পড়ার সময় খেয়াল রাখবেন সাধারণ শিক্ষার বইগুলো যেমন পড়বেন, তেমনি ইসলামী শিক্ষার বইগুলোও পড়বেন। বিশেষ করে আধুনিক যুগে যারা বড় বড় স্কলার হয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তাদের বই পড়বেন। তাদের সব নাম আমি উল্লেখ করবো না। আমি যাদেরকে নিয়ে বিদগ্ধ তাদের নাম আমি বলিÑ যেমন ড. জামাল বাদাবি, ড. জাকির নায়েক, ড. আল্লামা কারদাবি তাদের বই বড়বেন এবং যারা লিখতে পারেন তারা লিখবেন। বেশি করে ইসলামের মেসেজ পৌঁছাবেন। ইসলাম মানবতার মুক্তির বাণী। মানবতাকে বর্তমান চারিত্রিক হীনতা থেকে, দুর্নীতি, দারিদ্র্য থেকে উদ্ধার করতে হবে। ইসলামের সঠিক অনুসরণ করতে হবে। এসব মেসেজ সবার কাছে পৌঁছিয়ে দেবেন। ছাত্র সংবাদ : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য। শাহ আবদুল হান্নান : আপনাকেও ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির