وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوآ إِلآ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ط إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَآ أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَّلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَّهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا. . وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا . “তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে উহ! বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না বরং তাদের সাথে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা বল। তাদের সামনে ভালোবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল: হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।” (সূরা বনি ইসরাইল: ২৩-২৪)
সূরা বনি ইসরাইলের নামকরণ এ সূরায় চারবার বনি ইসরাইল (بنى اسرائيل) শব্দটি উদ্ধৃত হয়েছে। এ শব্দ থেকে সূরাটির নাম ‘বনি ইসরাইল’ রাখা হয়েছে। হযরত ইবরাহিম (আ)-এর পৌত্র ইয়াকুব (আ)-এর অপর নাম ছিল ইসরাইল। এটি হিব্রু ভাষার শব্দ। ইসরাইল অর্থ আল্লাহর বান্দাহ। পবিত্র কুরআনে ইয়াকুব (আ)-এর বংশধরদের বনি ইসরাইল বা ইসরাইলের বংশধর বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এ নামটি কুরআনের অন্যান্য সূরার নামের মতো প্রতীক হিসেবেই রাখা হয়েছে। এ সূরার আরেকটি নাম সূরা ‘ইসরা’ (اسراء) । ‘ইসরা’ শব্দের অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। এ সূরার প্রথম আয়াত থেকে সূরাটির এ নামকরণ করা হয়েছে।
সূরাটি নাযিলের সময়কাল সূরাটির প্রথম আয়াতে মিরাজের বর্ণনা রয়েছে। এ থেকেই বুঝা যায় যে, সূরাটি মিরাজের সময় নাযিল হয়েছে। আর মিরাজ সংঘটিত হয়েছে রাসূল সা.-এর মাক্কী জীবনের শেষের দিকে। সুতরাং বলা যায় যে, সূরা বনি ইসরাইল মাক্কী পর্যায়ের শেষের দিকে নাযিলকৃত সূরাসমূহের মধ্যে একটি নাযিলকৃত সূরা।
সূরাটি নাযিলের প্রেক্ষাপট রাসূলুল্লাহ সা. দীর্ঘ বারো বছর মক্কার কাফিরদের শত বাধার মুখেও ইসলামের দাওয়াত আরবের প্রত্যেক গোত্রে পৌঁছে দিয়েছিলেন। যার ফলে প্রতিটি গোত্রের দু’চারজন হলেও ইসলাম গ্রহণ করে ত্যাগী জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল। এ সময় মদীনার আওস ও খাযরাজের মতো শক্তিশালী দু’টি গোত্রের বিরাট সংখ্যক লোকও তাঁর সমর্থক হয়ে গিয়েছিলো। এমনি প্রেক্ষাপটে হিজরত করে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা মুসলমানদেরকে এক জায়গায় নিয়ে এসে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ সুযোগ দেখা দিল। আর ঠিক এরূপ অবস্থাতেই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিবকে মিরাজের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার যাবতীয় প্রশিক্ষণ দান করেন। ঠিক এমনি একটি সময়ে সূরা বনি ইসরাইল নাযিল হয়।
সূরার আলোচ্য বিষয় সূরা বনি ইসরাইলে মূল বক্তব্য তিনটি। যথা- ক. মক্কার কাফিরদেরকে সতর্ক করা হয়েছে যে, মুহাম্মদ সা.-এর দাওয়াত আন্তরিকভাবে গ্রহণ না করলে বনি ইসরাইলসহ খোদাদ্রোহী অন্যান্য জাতির করুণ পরিণতির ন্যায় ধ্বংস অনিবার্য। খ. মুমিনদের প্রশিক্ষণের জন্য নৈতিকতা ও সামাজিক জীবনে মৌলিক কিছু নীতিমালা পেশ করা হয়েছে। গ. রাসূলুল্লাহ সা.-কে হিদায়াত দান করা হয়েছে যে, সমস্যা ও সঙ্কট যত কঠিনই হোক সকল অবস্থায় মজবুত থাকতে হবে এবং কুফরির সাথে আপসের কোনো চিন্তা করা চলবে না।
নির্বাচিত আয়াতসমূহের আলোচ্য বিষয় সচ্চরিত্র গঠনের জন্য যেসব মৌলিক উপাদান রয়েছে সেগুলোর মধ্য থেকে অত্র আয়াতদ্বয়ে (আয়াত ২৩-২৪) দু’টি বিষয় আলোচিত হয়েছে। যথা- ১. শিরকমুক্ত ইবাদত করা। ২. পিতা-মাতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা।
নির্বাচিত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা আয়াত ২৩-২৪: শিরক না করা এবং পিতা-মাতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা অত্র আয়াতদ্বয়ে মূলত দু’টি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ১. শিরকমুক্ত আল্লাহর ইবাদত বা দাসত্ব করা এবং ২. পিতা-মাতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। আয়াতের মর্ম অনুধাবনের সুবিধার্থে বিষয় দু’টির ওপর নিম্নে আলোকপাত করা হলো। ১. শিরকমুক্ত আল্লাহর ইবাদত বা দাসত্ব: অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ (আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না)। মহান আল্লাহ মানুষ ও জিন জাতিকে একমাত্র তাঁরই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। সকল প্রকার ইবাদত বা দাসত্ব একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত হবে। আকিদা ও ইবাদতে কোনো প্রকার শরিক করা যাবে না। কেননা আল্লাহ এক অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো শরিক নেই। এ পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল আগমন করেছেন, সকলেরই আহবান ছিল তাওহিদ বা একত্ববাদের প্রতি। (সূরা নাহল: ৩৬) আল্লাহ ব্যতীত বা আল্লাহর সঙ্গে অন্যের ইবাদত করাই সর্ববৃহৎ পাপ, যা শিরক বলে গণ্য। যখন কোন জাতি একত্ববাদ ছেড়ে দিয়ে শিরকে লিপ্ত হয়েছে, তখনই নেমে এসেছে আজাব। আল্-কুরআনের প্রধান আহবান তাওহিদের প্রতি। অর্থাৎ শিরক থেকে বেঁচে থাকার প্রতি। প্রত্যেক মুসলিমকে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে কমপক্ষে ১৭ বার সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হয়। এ সূরার চতর্থ আয়াতে বলা হয় (إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ) ‘আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং কেবলমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’ এ বর্ণনা দ্বারা এ কথাটি স্বচ্ছভাবে প্রমাণিত হয় যে, সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। ইবন আব্বাস (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “যখন তুমি কিছু প্রার্থনা কর, তখন শুধুমাত্র আল্লাহর নিকটেই কর; আর যখন তুমি কোনো সাহায্য প্রার্থনা কর, তখন একমাত্র আল্লাহর নিকটেই কর।” কোনো প্রকার মধ্যস্থতা ছাড়াই মানুষের প্রতি আল্লাহর নৈকট্যের বিষয়টি আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত। (সূরা আল বাকারাহ: ১৬৫, ১৮৬; আনআম: ৪০; তাওবা: ৩১; আম্বিয়া: ৬৬; আরাফ: ১৯৪; যুমার: ৩ ইত্যাদি) তাওহিদের বিপরীত শিরক। এটি ইসলামের পরিপন্থী স্বতন্ত্র এক জীবনব্যবস্থা এবং বিধানের নাম। মানুষ তার বিশ্বাস, চিন্তা ও কর্মের মাধ্যমে একে লালন করে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিপথগামী মানুষ নানাভাবে শিরক লালন করে আসছে। শিরক আরবি শব্দ। আভিধানিক অর্থ অংশীদারিত্ব, বহুত্ববাদ, অংশগ্রহণ ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে মহান আল্লাহর জাত, সিফাত, ইবাদত, সার্বভৌমত্ব, প্রতিপালন ইত্যাদিতে অন্য কোনো বস্তুকে অংশীদার বানানোকে শিরক বলে। তাই ‘শিরক হলো, মহান ও পবিত্রতম স্রষ্টার বৈশিষ্ট্যাবলির সাথে সৃষ্টির সাদৃশ্য করা।’ আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরিক মনে করা, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ইবাদতের যোগ্য মনে করা, আল্লাহর মতোই অন্যকে ডাকা, তার কাছে কোন কিছু প্রাপ্তির আশা করা, আল্লাহর কাছ থেকে সাহায্য প্রাপ্তির জন্য মাধ্যম অবলম্বন করা এগুলো সবই শিরক। যেমন- রোগমুক্তির জন্য বা কোন কাজ উদ্ধারের জন্য মাজারে বা পীরের নামে মান্নত করা, পীরের কবরে সিজদা করা ইত্যাদি- এ সবই শিরক। শিরক প্রথমত দুই প্রকার। ১. শিরকে আকবর ও ২. শিরকে আসগর। শিরকে আকবর বলা হয়, কোন সৃষ্টিকে আল্লাহ তাআলার মত সিফাতের অধিকারী বা সমমর্যাদা সম্পন্ন মনে করা। আল্লাহর কাছে কিছু পাওয়ার জন্য মধ্যস্থতা অবলম্বন করা। আর শিরকে আসগর বলা হয়, ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তের সাথে সাথে অন্য কোন উদ্দেশ্য শামিল রাখা। যেমন- লোকদেখানোর জন্য ইবাদত করা, সুনাম অর্জনের জন্য দান-সাদকা করা ইত্যাদি।
শিরকের নিষিদ্ধতা শিরক অবৈধ ও নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ আল-কুরআনে শিরককে অত্যন্ত কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন এবং মানুষকে তা হতে নিবৃত্ত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন, “যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎ কর্ম করে ও প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে।” (সূরা আল্ কাহাফ: ১১০) মহান আল্লাহ আরো বলেন, “তুমি আল্লাহর সাথে অন্যকে ইলাহ রূপে ডেকো না। তিনি ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই। আল্লাহর সত্তা ব্যতীত সমস্ত কিছুই ধ্বংসশীল। বিধান তাঁরই এবং তাঁরই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।” (সূরা আল্ কাসাস: ৮৮) মহান আল্লাহ বলেন, “স্মরণ কর, যখন লুকমান তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, হে বৎস! আল্লাহর সাথে কোন শরিক করো না, নিশ্চয়ই শিরক চরম জুলুম।” (সূরা লুকমান: ১৫) আল্লাহ আরো বলেন, “তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোন কিছুতে তাঁর শরিক করবে না।” (সূরা আন-নিসা: ৩৬)
শিরকের পরিণাম শিরক এক জঘন্যতম অপরাধ, যা পরিপূর্ণরূপে তওবা ছাড়া ক্ষমা ও ছাড় পাওয়ার ভিন্ন কোন পথ নেই। শিরকের ভয়াবহ পরিণাম বহুবিদ। যেমন- ১. শিরকের মাধ্যমে ঈমান বিনষ্ট হয়। ২. শিরককারীর সকল নেক আমল বিনষ্ট হয়। ৩. শিরককারীর জন্য জান্নাত হারাম ইত্যাদি। শিরকের ভয়াবহ পরিণতির ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করবেন, আর তার পরিণতি হবে জাহান্নাম এবং এ রকম জালিমের কোনো সাহায্যকারী নেই।” (সূরা আল-মায়িদা: ৭২) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শরিক করা ক্ষমা করেন না। ইহা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যে কেউ আল্লাহর শরিক করে সে এক মহাপাপ করে।” (সূরা আন-নিসা: ৪৮) শিরকের ভয়াবহ পরিণতির ব্যাপারে আল-কুরআনে অন্যত্রে আরো বলা হয়েছে। যেমন- সূরা ইউনুস: ১০৬; বনি ইসরাইল: ৩৯; আল-হজ্ব: ৩১; আল-আন‘আম: ৮৮ ইত্যাদি।
১. শিরক থেকে বাঁচার উপায়: শিরক থেকে বাঁচতে হলে কুরআন ও হাদীসের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। রাসূল সা. এবং সাহাবীগণ কিভাবে শিরকমুক্ত জীবন যাপন করেছেন তার সঠিক ইতিহাস জেনে সে অনুযায়ী আমল করতে হবে। তাওহিদ বিষয়ক ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন করতে হবে। সর্বোপরি শিরক থেকে বাঁচার জন্য মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। ২. মাতা-পিতার অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষা: সূরা বনি ইসরাইলের ২৩তম আয়াতের শেষাংশ থেকে ২৪তম আয়াতে আল্লাহ তাআলা নিজের হকের পরেই পিতা-মাতার হকের কথা উল্লেখ করে বলেন, “আর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে উহ! বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না বরং তাদের সাথে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা বল। তাদের সামনে ভালোবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল : হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।” উপর্যুক্ত আয়াতদ্বয়ে পিতা-মাতার ব্যাপারে ছয়টি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রথমত: (وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا) পিতা-মাতার প্রতি ইহসান করতে হবে। অর্থাৎ তাঁরা গরিব-ধনী বা শিক্ষিত-অশিক্ষিত যা-ই হোক সর্বাবস্থায় তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। দ্বিতীয়ত: (فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ) বৃদ্ধ পিতা-মাতার খিদমত করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে কিংবা বিরক্ত হয়ে ‘উহ’ শব্দ পর্যন্ত করা যাবে না, অথবা সন্তানের আচার আচরণে যেন পিতা-মাতা মনে কষ্ট পেয়ে ‘উহ’ শব্দ করে না বসে সেদিকে অবশ্যই সতর্ক খেয়াল রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা. বলেন, ‘তার নাক ধুলায় মলিন হোক, অতঃপর তার নাক ধুলায় মলিন হোক, অতঃপর তার নাক ধুলায় মলিন হোক। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল সা. সে ব্যক্তি কে? রাসূল সা. বললেন, যে ব্যক্তি তার মাতা-পিতার যে কোন একজনকে অথবা উভয়কে বৃদ্ধাবস্থায় পেল কিন্তু তবুও সে বেহেস্তে প্রবেশ করতে পারলো না।’ (সহীহ মুসলিম) তৃতীয়ত: (وَلَا تَنْهَرْهُمَا) কোনো সময়ের জন্যও পিতা-মাতাকে ধমক দেয়া যাবে না, কিংবা ধমকের সুরে কথা বলা যাবে না। চতুর্থত: (وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا) বরং পিতা-মাতার সঙ্গে বিনয়ের সাথে ভদ্রভাবে কথা-বার্তা বলতে হবে। পিতা-মাতা খুশি হলে আল্লাহও খুশি হন। পিতা-মাতার অনুগত ব্যক্তিরা দুনিয়া ও আখিরাতে সফল ও সম্মানিতদের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গণ্য হয়। পিতা-মাতার সন্তুষ্টির ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি নির্ভরশীল। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা. বলেন, ‘পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতেই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি, পিতা-মাতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি।’ (জামি’উত তিরমিযী) পঞ্চমত: (وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ) নিজে যতই জ্ঞানী বা ধনাঢ্য ব্যক্তি হোক না কেন আর পিতা-মাতা যতই গরিব বা মূর্খ হোক না কেন তাদের সামনে নম্র-ভদ্র ও বিনয়ী থাকতে হবে। পিতা-মাতার প্রতি নম্র ব্যবহারকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন। হজরত আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, হে আয়িশা! নিশ্চয়ই আল্লাহ নম্র ব্যবহারকারী। সুতরাং তিনি নম্রতা ভালোবাসেন। তিনি নম্রতার জন্য এমন কিছু দান করেন যা কঠোরতার জন্য দান করেন না। (সহীহুল বুখারী; সহীহ মুসলিম) ষষ্ঠত: (وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا) পিতা-মাতার কল্যাণের জন্য সর্বসময় প্রাণ খুলে মনের সবটুকু আবেগ দিয়ে এ দু‘আ করতে হবে যে, “হে আমাদের রব, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।” পিতা-মাতার অধিকারের ব্যাপারে আল-কুরআনের অন্যান্য স্থানেও বলা হয়েছে। (যেমন- সূরা নিসা: ৩৬; আনআম: ১৫১; লুকমান : ১৪; আহকাফ: ১৫; আনকাবুত: ৮; সূরা বাকারা : ২১৫; ইব্রাহীম: ৪১; নুহ: ২৮) উপর্যুক্ত আয়াতদ্বয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যায় এবং পিতা-মাতার অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষার বর্ণনায় নিম্নে ছয়টি বিষয় আমরা আলোচনা করতে পারি। যথা- ক. মাতা-পিতার প্রতি সদাচরণের গুরুত্ব ও ফযিলত খ. মাতা-পিতার প্রতি সদাচরণ না করলে ভয়াবহ পরিণতি গ. পিতা-মাতা কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীত নির্দেশ দিলে করণীয় ঘ. অমুসলিম পিতা-মাতার সাথে কিরূপ আচরণ করতে হবে? ঙ. পিতা-মাতার মৃত্যুর পর সন্তানের জন্য করণীয় চ. পিতা-মাতার মৃত্যুর পূর্বে অসদাচরণের জন্য ক্ষমা নিতে না পারলে সন্তানের করণীয়। ক. মাতা-পিতার প্রতি সদাচরণের গুরুত্ব, পদ্ধতি ও ফযিলত পিতা-মাতা আল্লাহর পক্ষ থেকে সন্তানের জন্য এক বিশেষ নিয়ামত। জন্ম দান থেকে শুরু করে, ছোটবেলায় লালন-পালন, আদব-আখলাক শিক্ষা দেওয়া, লেখাপড়া শিখানো অর্থাৎ পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠায় পিতা-মাতার অবদান ও ত্যাগ অকল্পনীয়। পিতা-মাতার স্নেহ ভালোবাসা ও দুঃখ কষ্ট স্বীকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ সন্তানের কর্তব্য। একমাত্র আল্লাহর দাসত্বের পাশাপাশি মাতা-পিতার খেদমত করাও জরুরি: আল্লাহ তাআলা নিজেকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করে ইবাদতের নির্দেশ দেয়ার পর পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তার সাথে কাউকে শরিক (সমকক্ষ) কর না, আর পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরণ কর।” (সূরা আন-নিসা: ৩৬) পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করার নির্দেশ: আল্লাহ বলেন, “আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দুই বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে।” (সূরা লুকমান: ১৪) পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরণের নির্দেশ: সকল বৈধ ও শরিয়ত সম্মত কাজে পিতা-মাতার অনুগত থাকা সন্তানের কর্তব্য যা পিতা-মাতার ন্যায়সঙ্গত অধিকার। কুরআন ও হাদিসে এ সম্পর্কে অনেক তাগিদ রয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজে দেখা যায় অনেক ছেলে-মেয়ে বড় হয়ে বেয়ারা হয়ে যায় পিতা-মাতার কোন আদেশ নিষেধের কোনো তোয়াক্কা করে না। অনেকে তো বিয়ে করে স্ত্রীর আজ্ঞাবহ হয়ে যায় এবং তারই কথায় পিতা-মাতাকে প্রহার করে থাকে। অনেকে আবার পিতা-মাতার অপছন্দের পাত্র-পাত্রীকে জীবন সঙ্গী হিসেবে নিজেই বেছে নেয়। পিতা-মাতা ও বংশের মুখে চুনকালি দিয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) বর্ণনা করেন, আমার এক স্ত্রী ছিল যাকে আমি ভালোবাসতাম, কিন্তু আমার পিতা ওমর (রা) তাকে অপছন্দ করতেন। তিনি আমাকে বললেন, তাকে তালাক দিতে। কিন্তু আমি তা প্রত্যাখ্যান করি। ওমর (রা) রাসূল সা.-এর কাছে গেলেন এবং এ বিষয়টি তাকে অবহিত করেন। তখন রাসূল সা. আমাকে ডাকলেন এবং তাকে তালাক দিতে বলেন। (সুনান ইবনে মাজাহ) পিতার থেকে মায়ের হক তিনগুণ বেশি: সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে দেখা যায় সন্তানের প্রস্রাব-পায়খানা পরিষ্কার, সন্তানের দেখভাল, অসুস্থ হলে সন্তানকে কোলে নিয়ে নিদ্রাহীন রজনী পার করা, সর্বক্ষণ কোলে নিয়ে থাকা সবকিছু মাতাকেই করতে হয়। আবার সন্তান যদি প্রস্রাব পায়খানা করে সমস্ত শরীর নোংরা করে কান্না করে তাহলে পিতা দেখে মাতাকে পরিষ্কারের জন্য ডাকে, নিজে করে না। এমন সব কষ্টকর কাজ মা-ই করে থাকেন, সাথে সাথে সংসারের সমস্ত কাজও করতে হয়। মায়েদের এমন অপরিসীম কষ্টের কারণেই সাম্যের ধর্ম ইসলাম মাতাকে যোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দান করেছে। অধিক কষ্ট স্বীকারকারী হিসেবে সন্তানের শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা, সদাচরণ, সহানুভূতি পাওয়ার অধিকার পিতার চেয়ে মাতার বেশি। অনুরূপভাবে দুধমাতাকেও নিজের মায়ের মতো সম্মান-মর্যাদা করা উচিত। আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত ‘একব্যক্তি রাসূল সা.-এর খিদমাতে এসে বলল, হে রাসূল সা. আমার পক্ষ হতে সদ্ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার কে? রাসূল সা. বললেন, তোমার মাতা। লোকটি বলল, তারপর কে? রাসূল সা. বললেন, তোমার মাতা। লোকটি বলল, তারপর কে? রাসূল সা. বললেন, তোমার মাতা। লোকটি বলল, তারপর কে? রাসূল সা. বললেন, তোমার পিতা।’ (মুসনাদু আশ-শিহাব) পিতা-মাতার প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকালে হজ্বের সাওয়াব হয়: মাতা-পিতার প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকানো কবুল হজ্বের সমতুল্য প্রসঙ্গে রাসূল সা. বলেন, ‘যে নেক সন্তান পিতা-মাতার প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টিতে একবার তাকাবে তার বদলায় আল্লাহ তাআলা তাকে একটি মকবুল হজ্বের সাওয়াব দান করবেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল সা.! কেউ যদি দিনে একশতবার তাকায় তবুও কি সে সওয়াব প্রাপ্ত হবে? রাসূল সা. বললেন, হ্যাঁ যদি কেউ শতবার তাকায় তবুও সে সাওয়াব প্রাপ্ত হবে। আল্লাহ অনেক বড় ও সম্পূর্ণ পবিত্র।’(শুয়াবুল ঈমান) মায়ের পদতলে সন্তানের জান্নাত: মুয়াবিয়া ইবন জাহিমা (রা) থেকে বর্ণিত, জাহিমা (রা) একবার রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা করেছি এবং এ ব্যাপারে আপনার নিকট পরামর্শ নিতে এসেছি। রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মা আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তাহলে তাকেই ধরে রাখ। কেননা জান্নাত তাঁর পায়ের কাছেই রয়েছে। (আল-মুসনাদ আহমদ) পিতা-মাতার জন্য অর্থ ব্যয়: সন্তানের ধন-সম্পদের প্রকৃত মালিক হলো পিতা-মাতা। সূরা আল-বাকারায় মহান আল্লাহ বলেন, “লোকেরা আপনাকে জিজ্ঞেস করে তারা কিসে খরচ করবে? আপনি তাদেরকে বলে দিন, যা খরচ করবে তার প্রথম হকদার হলো মাতা-পিতা।” একবার রাসূলুল্লাহ সা.-এর দরবারে এক ব্যক্তি এসে তার মাতা-পিতার সম্পর্কে ফরিয়াদ করলো যে, তারা যখন ইচ্ছে তখনই আমার ধন-সম্পদ নিয়ে নেয়। রাসূলুল্লাহ সা. তার পিতাকে ডেকে পাঠালো। এক বৃদ্ধ দুর্বল ব্যক্তি এসে উপস্থিত হলো। রাসূলুল্লাহ সা. বৃদ্ধকে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, তখন বৃদ্ধ লোকটি বলা শুরু করলো: “আয় আল্লাহর রাসূল! এমন সময় ছিল, যখন আমার এ ছেলে ছিল দুর্বল ও অসহায়, আমি ছিলাম শক্তিমান। আমি ছিলাম ধনী আর এ ছিল শূন্য হাত। আমি কখনও আমার সম্পদ নিতে বাধা দেইনি। আজ আমি দুর্বল আর এ শক্তিশালী। আমি শূন্য হাত আর এ ধনী। এখন তার সম্পদ আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে।” বৃদ্ধের এ সকল কথা শুনে দয়াল নবী কেঁদে দিলেন আর বৃদ্ধের ছেলেকে সম্বোধন করে বললেন, “তুমি এবং তোমার ধন-সম্পদ সবই তোমার পিতার।” মানুষের অসহায় কাল দু’টি, শিশুকাল ও বৃদ্ধকাল। এ দু’সময়ের অবস্থার মধ্য বেশ সাদৃশ রয়েছে। ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা ইসলাম সন্তানের জন্য পিতা-মাতাকে অর্থ ব্যয়ের নির্দেশ দিয়েছে, আবার ঐ পিতা-মাতাই যখন বৃদ্ধাবস্থায় কর্মক্ষম হয়ে পড়েন তখন তাদের জন্য ব্যয়ভারের নির্দেশ সন্তানের ওপর দিয়েছে। এ সময় পিতা-মাতাকে সামর্থ্যানুযায়ী অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ আর্থিক সহযোগিতা করা সন্তানদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। পিতা-মাতার খেদমত হচ্ছে বড় জিহাদ: জিহাদ ফরজে আইন এবং ইসলামী শরিয়াতে সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ একটি ইবাদত। তবুও রাসূল সা. একজন সাহাবীকে বাড়ি ফিরে পিতা-মাতার সেবার নির্দেশ দিয়েছেন এবং তার জন্য জিহাদের চেয়ে পিতা-মাতার খেদমত করাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এতেই প্রমাণিত হয় পিতা-মাতার মর্যাদা কত উচ্চে এবং অধিকার কত বেশি। খ. মাতা-পিতার প্রতি সদাচরণ না করলে ভয়াবহ পরিণতি পিতা-মাতা হাড়ভাঙা পরিশ্রমে রক্তকে পানি করে সন্তানদের লেখাপড়া শিখায়, প্রতিষ্ঠিত করে। অথচ অনেক কুলাঙ্গার সন্তান আছে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মায়ের পরিচয় বন্ধু মহলে দিতে লজ্জাবোধ করে। তাদের জন্য পরকালে জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নেই। পিতা-মাতাকে অস্বীকার করা কুফরি। আল-কুরআন ও হাদীসে পিতা-মাতার প্রতি অসদাচরণকারীদের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে বর্ণনা পেশ করা হয়েছে। পিতা-মাতার সাথে মন্দ আচরণ করা হারাম। পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, উপকার করে খোঁটা দানকারী, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান এবং মদপানকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সুনানু নাসায়ী) পিতা-মাতাই আমাদের জান্নাত বা জাহান্নাম। পিতা-মাতার মর্যাদা এতই সুউচ্চে যে, পিতা-মাতার সন্তুষ্টির উপর পরকালে সন্তানের জন্য জান্নাত অথবা জাহান্নাম নির্ভরশীল। আবু উমামাহ (রা) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা.-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সা.! পিতা-মাতার ব্যাপারে সন্তানের জন্য কি দায়িত্ব রয়েছে? তখন রাসূল সা. বলেন, ‘তারা উভয়ে তোমার জন্য জান্নাত অথবা জাহান্নাম।’ (সুনান ইবন মাজাহ) পিতা-মাতার মনে কষ্ট দিলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না। আবু বাকরাহ (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, মহান আল্লাহ (শিরক ব্যতীত) সকল গুনাহ কিয়ামতের দিন ইচ্ছা করলে ক্ষমা করে দিবেন, কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্যতার অপরাধ ক্ষমা করবেন না। (আল-মুসনাদ আহমদ) পিতা-মাতার অবাধ্যতা ও গালি দেয়া কবিরাহ গুনাহ। পিতা-মাতার সাথে খারাপ আচরণকে শিরকের পর সবচেয়ে ঘৃণিত ও নিন্দনীয় কাজ হিসেবে অবহিত করা হয়েছে। এ মর্মে রাসূল সা. বলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে অবহিত করব না? এ কথা তিনি তিনবার বললেন। তখন সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা. আপনি বলে দিন। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরিক করা ও পিতা-মাতার নাফরমানি করা।’ (সহীহুল বুখারী) পিতা-মাতাকে কষ্ট দেয়ার শাস্তি দুনিয়াতেই ভোগ করতে হয়। পিতা-মাতার স্থান ইসলামে এতই উঁচু যে, তাদের নাফরমানির শাস্তি দুনিয়াতেই প্রদান করা হয়। অন্য কোনো অপরাধের জন্য তওবা করলে আল্লাহ মেহেরবান কবুল করেন, না করলে পরকালে শাস্তি দেন। পিতা-মাতার দৃষ্টান্ত স্থাপনকে দুনিয়াবাসীর জন্য মডেল হিসেবে অপরাধীর শাস্তি দুনিয়াতেই প্রদান করা হয়। আবু বাকরাহ (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, আল্লাহ তাআলা ইচ্ছে করলে সকল পাপই ক্ষমা করতে পারেন, কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্যতার অপরাধ তিনি ক্ষমা করবেন না। বরং তিনি এ অপরাধে জড়িতদেরকে মৃত্যুর পূর্বে দুনিয়াতেই শাস্তি ত্বরান্বিত করবেন। (শু’আবুল ঈমান) স্ত্রীর ওপর মাতাকে প্রাধান্য দিলে আল্লাহর লানত বর্ষিত হয়। ইমাম আয্যাহাবী (রহ) স্বীয় ‘আল-কাবায়ির’ গ্রন্থে ইমাম তাবারানি ও ইমাম আহমদের (রহ) সূত্রে বর্ণনা করেন, আবদুল্লাহ ইবন আবি আওফা (রা) বলেন, সাহাবী আলকামা নামায রোজার ক্ষেত্রে খুবই নিয়মানুবর্তী ছিলেন। যখন তার মৃত্যু নিকটবর্তী হলো, লোকেরা তাকে কালেমার তালকিন করলেন। কিন্তু তিনি তা পড়তে সমর্থ হলেন না। তার স্ত্রী এই অবস্থা রাসূল সা.কে জানানোর জন্য লোক পাঠালেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তার পিতা-মাতা বেঁচে আছেন কি না? তাঁকে জানানো হলো, আলকামার মা বেঁচে আছেন। রাসূল সা. তার মাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি অতি দ্রুত রাসূলের কাছে এসে হাজির হলেন। তিনি আলকামা সম্পর্কে তার মতামত জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, সে একজন দীনদার লোক। তবে তার ওপর স্ত্রীকে বেশি প্রাধান্য দেয় এবং তাকে অমান্য করে। তাই তিনি তার ওপর অসন্তুষ্ট। রাসূল সা. তাকে ক্ষমা করে দিতে বললেন। কিন্তু তিনি তাতে সম্মত হলেন না। রাসূল সা. তখন বেলাল (রা)-কে কাঠ সংগ্রহ করে আগুন জ্বালিয়ে জ্বলন্ত আগুনে আলকামাকে নিক্ষেপ করতে বললেন। মা এ কথা শুনে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং রাসূল সা. কে বললেন, তিনি বাস্তবিকই আলকামাকে আগুনে পোড়াতে ইচ্ছুক কি না? তিনি তখন বললেন, হ্যাঁ আল্লাহ তাআলার শাস্তি এই শাস্তি থেকেও অনেক কঠিন। আল্লাহর কসম! আপনি যতক্ষণ আপনার ছেলের ওপর অসন্তুষ্ট থাকবেন, তার না কোন নামায আল্লাহর কাছে কবুল হবে, আর না কোন দান। আলকামার মা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা. আমি আপনাকে এবং উপস্থিত সকলকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আলকামাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। রাসূল সা. তখন আলকামার অবস্থা দেখার জন্য তার কাছে লোক পাঠালেন। তখন সে এই সুসংবাদ নিয়ে ফিরে এলো যে, আলকামা কালেমা পাঠ করে মৃত্যুবরণ করেছে। রাসূল সা. স্বয়ং তার জানাজায় গেলেন এবং বললেন, মুহাজির ও আনসারদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি তার মায়ের অবাধ্য হবে কিংবা তাকে অসন্তুষ্ট করবে, তার ওপর আল্লাহ, তাঁর ফেরেস্তা ও সকল মানুষের অভিসম্পাত বর্ষিত হবে। আল্লাহ তাআলা তার কোন কাজ কিংবা নফল ইবাদত কবুল করবেন না। যতক্ষণ না সে অনুশোচিত হবে, মায়ের যথাযথ পরিচর্যা ও সেবা করবে। (কিতাবুল কাবায়ের) গ. পিতা-মাতা কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীত নির্দেশ দিলে করণীয়: মহান আল্লাহ পিতা-মাতার আনুগত্য ও সদাচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে তা অবশ্যই সঙ্গত বিষয়ে হতে হবে। আর তাদের নির্দেশ যদি কুরআন ও সুন্নাহের বিপরীত হয় কিংবা শিরক ও হারাম এর পর্যায়ে পড়ে তাহলে পিতা-মাতার সে কথা মানা যাবে না, বরং ইসলামী নির্দেশ মোতাবেক জীবন যাপন করতে হবে। পিতা-মাতা যদি অবৈধ উপার্জনের জন্য সুদ, ঘুষ, মজুদদারি, কালোবাজারির নির্দেশ দেয়, কিংবা ইসলামী আইনের বিপক্ষে ও মানবরচিত আইনের পক্ষে ভূমিকা রাখার জন্য আদেশ করে, তাহলে সে নির্দেশ অস্বীকার করে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করা সন্তানের কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়ে শরিক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যে বিষয়ের জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না।’ (সূরা লুকমান: ১৫) স্রষ্টার নির্দেশের বিপরীত সৃষ্টির আনুগত্য করা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। দুনিয়াবি জীবনে সুকৌশলকে ও সাধ্যানুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতার মধ্যে পিতা-মাতার সাথে সদ্ভাবে চলতে হবে। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের সাথে দুনিয়ার জীবনে সদ্ব্যবহার কর এবং অনুসরণ কর তাদের যারা আমার দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।’ (সূরা লুকমান: ১৫; সূরা আনকাবুত: ৮; সূরা তাওবা: ২৪) ঘ. অমুসলিম পিতা-মাতার সাথে কিরূপ আচরণ করতে হবে: মাতা সন্তানকে গর্ভধারণ থেকে শুরু করে জন্মদান, দুধ পান করানো, শিশুকালে লালন-পালন, সন্তানের কল্যাণ কামনা ও সন্তানের জন্য সর্বসুখ ত্যাগ করে। অপর দিকে পিতা মায়ের এসব কাজে সহায়তা ও সমস্ত ব্যয়ভার বহন করে। তাইতো মানবতার ধর্ম ইসলাম শুধুমাত্র মুসলমান পিতা-মাতার মাথে সদাচরণ খাস করেনি বরং পিতা-মাতা কাফির হলেও তাদের সাথে সদাচরণ করতে নির্দেশ দিয়েছে, ‘আসমা বিনতে আবু বকর (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে সময় রাসূল সা. কুরাইশদের সাথে চুক্তি করেছিলেন সে সময় আমার মুশরিকা মাতা আমার পিতার সাথে আসলে আমি রাসূল সা.-এর নিকট এ মর্মে আরজ করলাম যে, আমার মা এসেছেন এবং তিনি মুশরিকা আমি কি তার সাথে রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়তার আচরণ করবো? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তোমার মায়ের সাথে ভালো আচরণ কর।’ (সহীহুল বুখারী) ঙ. পিতা-মাতার মৃত্যুর পর সন্তানের জন্য করণীয় পিতা-মাতার জীবিতকালীন সময়ে সুন্দর করাই শুধু পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য শেষ করে দেয় না। বরং তাদের মৃত্যুর পরও সন্তানের দায়িত্ব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সন্তানের জন্য আবশ্যকীয় কয়েকটি করণীয় রয়েছে। যেমন- ১. দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা ২. ঋণ পরিশোধ করা ৩. অসিয়ত ও অঙ্গীকার পূরণ করা ৪. পিতা-মাতার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দুআ করা ৫. পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধব ও নিকটাত্মীদের সাথে সদ্ব্যবহার। চ. পিতা-মাতার মৃত্যুর পূর্বে অসদাচরণের জন্য ক্ষমা নিতে না পারলে সন্তানের করণীয় যদি কোনো ব্যক্তি তার পিতা-মাতার প্রতি অবাধ্যাচরণ করে এবং এ অবস্থায় পিতা-মাতা মারা যায়, অতঃপর সন্তান নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে ফিরতে চায়, তখন সন্তানের জন্য করণীয় সম্পর্কে আনাস ইবন মালিক (রা) বর্ণনা করেন, রাসূল সা. বলেছেন, “যদি কোন ব্যক্তি তার পিতা-মাতার অবাধ্যাচরণ করে এবং এ অবস্থায় তারা যদি উভয়ে অথবা কোন একজন মারা যায়, অতঃপর সে যদি অবিরামভাবে পরলোকগত পিতা-মাতার জন্য দুআ ও মাগফিরাত কামনা করতে থাকে, তাহলে মহান আল্লাহ তাকে একজন নেক্কার বান্দা হিসেবে লিখে নিবেন।” (শুয়াবুল ঈমান; সুনান ইবন মাজাহ)
৭. নির্বাচিত আয়াতসমূহের (২৩-২৪) শিক্ষা ১. এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বা কিছুকে মাবুদ বা ইবাদতের যোগ্য মনে করা যাবে না। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো আইন মানা যাবে না। ২. পিতা-মাতার প্রতি কোনো অবস্থাতেই অসদাচরণ করা যাবে না এবং সদা সর্বদা তাঁদের সাথে বিনীত ও ন¤্র আচরণ করতে হবে। মাতা-পিতার সাথে কখনো ধমক দিয়ে কথা বলা যাবে না। মাতা-পিতার জন্য সদা-সর্বদা আল্লাহর কাছে তাঁর শিখানো দুআ করতে হবে। মাতা-পিতার সাথে অসদাচরণ করে নেককার হওয়ার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। অতএব যারা নেককার হতে চান তাদেরকে অবশ্যই মাতা-পিতার সাথে সদাচারী হতে হবে। ৩. কখনো কোনো অসতর্ক মুহূর্তে যদি কোনো কারণে মাতা-পিতার মনে কষ্টদায়ক কোনো আচরণ সংঘটিত হয়েও যায়, তখন তাৎক্ষণিক তা ক্ষমা চেয়ে তাঁদেরকে রাজি খুশি করিয়ে নিতে হবে এবং আল্লাহর দরবারে তওবা ইস্তিগফার করতে হবে। আল্লাহ অবশ্যই তওবা কবুলকারী। লেখক: প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মন্তব্য লিখুন