post

উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া । এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান

৩১ অক্টোবর ২০১৯

উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া । এইচ. এম. মুশফিকুর রহমানমানুষের জ্ঞান যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততই আল্লাহর বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের সৃষ্টির কল্যাণকর দিকগুলো বুঝতে পারছে। তাই সব বুদ্ধিমান, সচেতন মানুষের উচিত আল্লাহর সৃষ্ট সব জীব ও প্রাণিকুলের প্রতি যথাযথ আচরণ করা। যেসব জীব ও প্রাণী আমাদের প্রত্যক্ষ উপকারে আসে বলে আমরা জানি, শুধু তাদের প্রতি যত্নবান হয়ে তাদের উপকার গ্রহণ করতে হবে তা নয়, সব ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণীর ক্ষেত্রেই আমাদের সদয় হতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে আল্লাহকে হিসাব দিতে হবে। জগতের সৃষ্ট বস্তু বা বিষয়ের মধ্যে বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল আল্লাহর এক মহাগুরুত্বপূর্ণ সৃজন। মানুষের জন্য এগুলো আল্লাহর বিশেষ দান। আল্লাহ বিভিন্নভাবে মানুষকে এটা বোঝাতে চেয়েছেন। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে বৃক্ষ এক অনন্য সৃষ্টি। এর রয়েছে বহুমুখী গুরুত্ব বা তাৎপর্য। এখানে উল্লেখ্য, আল্লাহ মানুষকে তার সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা প্রদান করেছেন। আর জগৎ-সংসারের সবকিছুই তিনি কোনো না কোনোভাবে মানুষের কল্যাণের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। বৃক্ষ বা তৃণাদিও মানুষের কল্যাণের জন্য আবশ্যক। আল্লাহ নিজেই এর গুরুত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন; যেমন আল্লাহ বলেছেন, ‘যিনি সুষম বিকাশ সাধন করেন ও পথনির্দেশ করেন এবং যিনি তৃণাদি উৎপন্ন করেন।’ (সূরা আ’লা : ৩-৪) আল্লাহ এখানে প্রকৃতির ভারসাম্যের কথা উল্লেখ করেছেন। এ ভারসাম্য জগতের জন্য অত্যন্ত আবশ্যক। আমরা জানি, মানুষ ও বৃক্ষের মধ্যেও বিদ্যমান রয়েছে এক গভীর সম্পর্ক, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। বিশেষ করে মানুষ ও উদ্ভিদের পরস্পরের দেহপোযোগী সামগ্রীর জন্য একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। মানুষ কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে (শ্বাস-প্রশ্বাসের সময়) এবং অক্সিজেন গ্রহণ করে। অন্যদিকে উদ্ভিদ অক্সিজেন ত্যাগ করে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। পৃথিবীতে বৃক্ষের পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকলে এক সময় মানুষের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে। এমনকি এটা মানবজীবনের জন্য অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। বৃক্ষরাজি ও উদ্ভিদ আল্লাহর সৃষ্টির বৈচিত্র্য প্রকাশক। আল্লাহ সুনিপুণ স্রষ্টা, তিনি সৃষ্টি করেছেন বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘নিশ্চয় আমি প্রচুর পরিমাণে পানি বর্ষণ করি। তারপর জমিনকে যথাযথভাবে বিদীর্ণ করি। অতঃপর তাতে আমি উৎপন্ন করি শস্য, আঙ্গুর ও শাক-সবজি, যায়তুন ও খেজুর বন, ঘনবৃক্ষ শোভিত বাগ-বাগিচা, আর ফল ও তৃণগুল্ম। তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুগুলোর জীবনোপকরণস্বরূপ।’ (সূরা আবাসা : ২৫-৩২) আল্লাহর কী নৈপুণ্য! একই মাটি একই পানিতেই আমরা ভিন্ন ভিন্ন উদ্ভিদ জন্মাতে দেখি, যাতে ভিন্ন ভিন্ন ফুল ও ফল ধরে। এসবই মানুষের কল্যাণের জন্য। কুরআনে বেশ কিছু জীবজন্তু ও প্রাণিকুলের নাম ও প্রসঙ্গ এসেছে। কুরআনের দ্বিতীয় সূরাটির নাম বাকারা, যার অর্থ গাভী। আল্লাহ মূসা আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়কে নির্দেশ দিয়েছেন গাভী জবাই করতে, যা পরিণত বয়সের নয় এবং কুমারীও নয়; উভয়ের মাঝামাঝি, যা উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের ও দর্শকদের জন্য পরম আনন্দদায়ক, এমন বশীভূত নয় যে, জমি চাষ করে ও ক্ষেতে সেচ দেয়। নিখুঁত, যার মধ্যে কোনো ত্রুটি নেই। তারা এটি জবাই করে এর একাংশ দিয়ে মৃত ব্যক্তিকে আঘাত করে ও সে আবার জীবিত হয়ে ওঠে। (সূরা বাকারা : ৬৭-৭৩) এর বিপরীত চিত্র হচ্ছে- তাদের কর্তৃক গোবৎসকে উপাস্য হিসেবে পূজা-অর্চনা প্রদান। (সূরা বাকারা : ৫১, ৫৪, ৯২, ৯৩) পঞ্চম সূরা মায়েদার প্রথম আয়াতেই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, তোমাদের জন্য বৈধ করা হলো চতুষ্পদ গবাদি পশু। তৃতীয় আয়াতে আছে, শূকর, মৃত পশু, হিংস্রজন্তু খাওয়া ও দেব-দেবীর নামে উৎসর্গ করা পশু প্রভৃতি গ্রহণ নিষিদ্ধ। ষষ্ঠ সূরা আনআম, যার অর্থ গবাদিপশু। এগুলোর কতেক ভারবাহী ও কতেক ক্ষুদ্র আকৃতির। আল্লাহ তা‘আলা এখানে ভেড়া, ছাগল, উট ও গরু এই চার শ্রেণির নর ও মাদী হিসেবে আট প্রকার পশুর প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। এ সূরায় এসেছে পাঁচ স্থানে। এ ছাড়া অন্যান্য সূরার আরও ১২ স্থানে সরাসরি এ শব্দ ও প্রাসাঙ্গিক আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে। ষোড়শ সূরার নাম নাহল, মানে মৌমাছি। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমার রব মৌমাছির কাছে প্রত্যাদেশ করেছেন, পাহাড়ে, বৃক্ষে ও মানুষ যে মাচা বানায় সেখানে তোমরা বাসা বানাও।’ (সূরা নাহল : ৬৮) ২৭তম সূরা নামল, যার অর্থ পিঁপড়া। নবী সোলায়মান আলাইহিস সালাম পিঁপড়ার উপত্যকায় এসে তাদের কথোপকথন বুঝতে পেরে মৃদু হাসেন। আল্লাহ তাকে জিন, পাখি ও হুদহুদসহ সব প্রাণীর ভাষা বোঝার ও তার বশীভূত থাকার বিশেষ সক্ষমতা দান করেছেন। (সূরা নাহল : ১৫-৪৪) ২৯তম সূরা আনকাবুত, বাংলায় যা মাকড়সা অভিধায় খ্যাত। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন ‘যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে তাদের উপমা মাকড়সা; যে ঘর বানায়। নিশ্চয়ই মাকড়সার ঘর সবচেয়ে দুর্বল ঘর।’ (সূরা আনকাবুত : ৪১) উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া । এইচ. এম. মুশফিকুর রহমানকুরআনে আছে, মূসা আলাইহি সালাম এর লাঠি সুস্পষ্ট অজগরে পরিণত হয়। (সূরা আরাফ : ১০৭, সূরা শুআরা : ৩২) আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘তিনি তোমাদের আরোহণের জন্য ও তোমাদের শোভাবর্ধনের জন্য সৃষ্টি করেছেন ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা এবং তিনি সৃষ্টি করেছেন এমন অনেক কিছু যা তোমরা জান না।’ (সূরা নাহল : ৮) আল্লাহ তা‘আলা গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমাদের জন্য শীত নিবারণকারী ও বহু উপকার নিহিত রয়েছে।’ (সূরা নাহল : ৪) ‘মাছ ভক্ষণ করে ইউনুস আলাইহিস সালাম কে।’ (সূরা সাফফাত : ১৪২) আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘তোমরা সমুদ্র থেকে তাজা মাছ আহার কর।’ (সূরা নাহল : ১৪) কুরআনে বর্ণিত প্রাণিকুলের আলোচনা থেকে বুঝা যায়, সমগ্র জগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোনো কিছুই বৃথা সৃষ্টি করেননি। জগতের সব সৃষ্টিই আল্লাহর উদ্দেশ্য সাধনে সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি পৃথিবীতে সবকিছুই সঠিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশ ঘটিয়েছি।’ (সূরা হিজর : ১৯) মানবজগতের ন্যায় উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল সদয় আচরণ পাওয়ার যোগ্য। এ ব্যাপারে ইসলামে যে বাণী উচ্চারিত হয়েছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণে যা ফুটে উঠেছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণিত এ বিষয় সংক্রান্ত কতিপয় বাণী এবং তদ্বিষয়ে কিছু আলোচনা নিম্নে তুলে ধরা হলো: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু মানবজাতির প্রতি দয়ালু ছিলেন না, তিনি দয়ালু ও দয়াবান ছিলেন বিশ্বব্যাপী মাখলুকাতের প্রতিও। যারা নিজেদের দুঃখ-কষ্টের কথা মানুষের মতো স্বাভাবিকভাবে অন্যের নিকট ব্যক্ত করতে পারে না, সেসব বাকহীন জীব-জন্তু ও পশু-পাখির দুঃখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রাণ আকুল করতো। আসলে তিনি রহমাতুল্লিল আলামিন বা সারা বিশ্ব জগতের জন্য রহমত স্বরূপ। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আমি তো আপনাকে বিশ্বজগতের প্রতি রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭) মানুষ শুধু মানুষের জন্যই নয় বরং মানুষ সমগ্র জীবের জন্য, ইসলাম এই সুমহান বাণীর প্রবক্তা। এক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি একটি বৃক্ষ রোপণ করল অথবা কোন ফসল উৎপাদন করল, আর উক্ত বৃক্ষের ফল বা ফসল কোন মানুষ বা কোন চতুষ্পদ জন্তু বা কোন হিংস্র জন্তু বা কোন পাখি ভক্ষণ করল তাহলে সে ব্যক্তির জন্য উহা সাদকাহ হিসেবে পরিগণিত হবে।” (মুসনাদু আহমাদ : ১৫২৩৫) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি বৃক্ষরোপণ করে তা ফলদার হওয়া পর্যন্ত তার পরিচর্যা ও সংরক্ষণে ধৈর্য ধারণ করে, তার প্রতিটি ফল যা নষ্ট হয়, তার বিনিময়ে আল্লাহপাক তাকে সদকার নেকি দেবেন।’ (মুসনদে আহমদ : ১৬৭০২) শিশুর পুষ্টির জন্য মায়ের দুধ যেমন অপরিহার্য তেমনি পরিবেশ রক্ষার জন্য বৃক্ষ অপরিহার্য। পরিবেশ শান্ত, শীতল ও মনোমুগ্ধকর রাখে মাটি থেকে বেড়ে ওঠা বৃক্ষ। অপ্রয়োজনে বৃক্ষ নিধন করাকে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করেছেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে, আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন।’ (আবু দাউদ : ৫২৪১) তবে কোনো গাছ এমন স্থানে অবস্থিত হয় যার জন্য মানুষের চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটে, ঘর-বাড়ির ক্ষতি হয় এবং মানুষের দরকারে কাটার প্রয়োজন হয়, তাহলে গাছ কাটতে কোনো নিষেধ নেই। আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি এক ব্যক্তিকে দেখেছি জান্নাতে সে ওই গাছের ছায়ায় চলাচল করছে যা সে রাস্তার মোড় থেকে কেটেছিল, যা মানুষকে কষ্ট দিত।’ (মুসলিম : ৫৮৩৭) জীবকে কষ্ট দেয়া অমানবিক ও গর্হিত কাজ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “একজন স্ত্রীলোক একটি বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল। অতঃপর অনাহারে বিড়ালটি মারা যায়। এ অপরাধে স্ত্রীলোকটিকে শাস্তি দেয়া হয় এবং জাহান্নামি বলে ঘোষণা দেয়া হয়। সে উহাকে বেঁধে রেখেছিল, অথচ তাকে আহারও করায়নি, পানও করায়নি। অপরপক্ষে তাকে ছেড়ে দেয়নি, যাতে সে জমিনের লতা-পাতা খেয়ে বাঁচত।” (সাহীহ মুসলিম : ৫৯৮৯) আবু হুরায়রাহ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “একদা একটি কুকুর প্রচণ্ড গরমের দিনে একটি কুয়ার পাড়ে পিপাসায় কাতর হয়ে জিহবা বের করে হাঁপাচ্ছিল এবং কুয়ার চারদিকে ঘুরছিল। এ অবস্থা দেখে বনি ইসরাইলের একজন স্ব-ঘোষিত বেশ্যা মহিলা নিজের ওড়না দ্বারা মোজা বেঁধে কুয়াতে নামিয়ে পানি উত্তোলন করে কুকুরটিকে পান করাল। এর ফলে তার সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেয়া হলো।” অপর এক বর্ণনায় হাদীসের শেষাংশে আছে- সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের চতুষ্পদ জন্তুগুলোকে পানি পান করালেও কি সাওয়াব পাব? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বলেন, প্রতিটি জীবকে পানি পান করালেই সাওয়াব পাওয়া যাবে।” (সাহিহুল বুখারি : ২৫৫২) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ভ্রমণের জন্য একমাত্র যানবাহন ছিল জন্তু। জন্তুকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কষ্ট দেয়াও অমানবিক। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো জন্তুর উপর আরোহণ করত কারো সাথে কথা বলে বা অন্য কোন প্রয়োজনে সময় নষ্ট করে জন্তুকে কষ্ট না দিতে ফরমান জারি করেন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমরা সুস্থ অবস্থায় এ সমস্ত পশুদের ওপর আরোহণ কর এবং সুস্থ অবস্থায় এদেরকে ছেড়ে দাও। আর তোমরা সেগুলোকে চেয়ারে পরিণত কর না।” (মুসনাদু আহমাদ : ১৫৬৭৯) পশুদেরকে অভুক্ত রাখা এবং তাদেরকে দুর্বল ও কৃশকায় করে তোলাও সমীচীন নয়। এ ব্যাপারে সাহল ইবনুল হানযালিয়্যাহ আল আনসারী রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি উটের নিকট দিয়ে গমন করছিলেন। তিনি দেখলেন, ক্ষুধায় উটটির পেট পিঠের সাথে লেগে গেছে। এ অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এসব নির্বাক পশুদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। এরা কথা বলতে পারে না এবং প্রয়োজন ব্যক্ত করতে পারে না, এরা যখন আরোহী বহনের যোগ্যতা রাখে তখন তাদের পিঠে আরোহণ কর এবং সুস্থ অবস্থায় তাদেরকে ছেড়ে দাও।” (সুনানু আবি দাউদ: ২৫৪৮, ২৫৪৯ ও ২৫৫০) কোন জন্তুর দ্বারা তার সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ নেয়া বৈধ নয়। আবদুল্লাহ ইবন জা‘ফার বর্ণিত হাদীসে আছে, “একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক আনসারীর বাগানে গমন করেন। সেখানে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি উট দেখতে পান। উটটি রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল। তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটটির কাছে গিয়ে চোখের পানি মুছে ফেললেন। ফলে সে শান্ত হলো। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, এটি কার উট? মালিক এসে বললেন, আমি এর মালিক হে আল্লাহর রাসূল! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ পশুর ব্যাপারে তুমি কি আল্লাহকে ভয় কর না? আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন এ পশুকে তোমার মালিকানায় দিয়েছেন। সে আমার নিকট অভিযোগ দায়ের করেছে যে, তুমি তার কাছ থেকে কাজ নাও ঠিকই কিন্তু তাকে ঠিকমত আহার করাও না।” (সুনানু আবী দাউদ : ২৫৫১) পশু-পাখিকে অযথা বিরক্ত করা, তাদের ধরা ও আঘাত করা নিন্দনীয়। শিকার করাও ভালো নয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “কোনো প্রাণীকে লক্ষ্যবস্ত বানিও না।” (মুসলিম : ১৯৫৭) সাঈদ ইবনে যুবাইর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একবার হজরত ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু কোরাইশ গোত্রের একদল বাচ্চাকে দেখতে পেলেন যে, তারা পাখি শিকার করছে। এটা দেখে ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু তাদের তাড়িয়ে দেন এবং বলেন, “মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে কোনো প্রাণবিশিষ্ট বস্তকে অহেতুক লক্ষ্যবস্তু বানায়।” (মুসলিম : ১৯৫৮) পশু-পাখির প্রতি দয়া দেখভালে পুণ্য মিলে। এক সময় লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! জীবজন্তুর প্রতি দয়া প্রদর্শনেও কি আমাদের সওয়াব আছে? তিনি বললেন, প্রত্যেক প্রাণবিশিষ্ট জীবের (প্রতি দয়া প্রদর্শনে) সওয়াব রয়েছে।” (বুখারি : ২৪৬৬, মুসলিম : ২২৪৪) ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতা পশুপাখির নেই। কোনো কারণে সম্পদের; বিশেষ করে ফসলের ক্ষতি করতে পারে। এ জন্য এর মালিক যিনি বা সঙ্গে রাখাল যিনি থাকবেন তাকে জরিমানা দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “চতুস্পদ জন্তুর অনিষ্ট ক্ষমাযোগ্য।” (বুখারি : ৬৯১২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি অধিকার ছাড়া (অযথা) একটি বা তার বেশি চড়ুই হত্যা করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সে চড়ুই সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন।’’ (সুনান নাসাঈ, সহীহ তারগিব ২২৬৬) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একবার একটি গাছের নিচে একজন নবীকে পিঁপড়ে কামড়ে দিলে তিনি গর্তসহ পিঁপড়ের দল পুড়িয়ে ফেললেন। আল্লাহ তাঁকে ওহি করে বললেন, ‘‘তোমাকে একটি পিঁপড়ে কামড়ে দিলে তুমি একটি এমন জাতিকে পুড়িয়ে মারলে, যে (আমার) তাসবিহ পাঠ করত? ...’’ (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, হা/২২৪১) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, ‘‘আল্লাহর নিকট সব চাইতে বড় পাপিষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে কোন মহিলাকে বিবাহ করে, অতঃপর তার নিকট থেকে মজা লুটে নিয়ে তাকে তালাক দেয় এবং তার মোহরও আত্মসাৎ করে। (দ্বিতীয় হলো) সেই ব্যক্তি, যে কোন লোককে মজুর খাটায়, অতঃপর তার মজুরি আত্মসাৎ করে এবং (তৃতীয় হল) সেই ব্যক্তি, যে অযথা পশু হত্যা করে।’’ (হাকিম, বাইহাকি, সহিহুল জা’মে হা/১৫৬৭) বাক-শক্তিহীন প্রাণীদের বিষয়ে সতর্ক থাকা কাম্য। কষ্ট দেয়া, প্রহার করা ও হত্যা করা যাবে না। পশুপাখির অঙ্গহানি করাও সম্পূর্ণ নিষেধ। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, “মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে প্রাণীদের অঙ্গচ্ছেদ করে।” (বুখারি, ৫১৯৫) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “জীবিত অবস্থায় যে প্রাণীর কোনো অংশ কাটা হয় সেটা হারাম হয়ে যাবে।” (তিরমিযি-১৪৮০) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘প্রাণিকুল সৃষ্টির (অন্যতম) কারণ হলো, এগুলোতে তোমরা আরোহণ করে থাকো আর এগুলো সৌন্দর্যের প্রতীক।’ (সূরা নাহল : ৮) প্রাণিজগৎকে পৃথক জাতিসত্তার স্বীকৃতি দিয়ে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘পৃথিবীতে বিচরণশীল যত প্রাণী আছে আর যত পাখি দুই ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়, তারা সবাই তোমাদের মতো একেক জাতি।’ (সূরা আনআম : ৩৮) প্রাণিজগৎ সতত মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত। আল্লাহ তা‘আলা কুদরতিভাবে এগুলোকে মানুষের করায়ত্ত করে রেখেছেন। প্রাণীরা অবশ্যই করুণা ও মমতা পাওয়ার যোগ্য। ইসলাম পশু-পাখির সঙ্গে যথাসম্ভব দয়াশীল আচরণ করার শিক্ষা দেয়। পশু-পাখির যথেচ্ছ ব্যবহারে নিষেধ করে। ইসলামে পশু-পাখির অঙ্গহানি করা নিষিদ্ধ। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে প্রাণীদের অঙ্গচ্ছেদ করে।’ (বুখারি : ৫১৯৫) পশু-পাখিকে আল্লাহর জমিনে অবাধ বিচরণের সুযোগ দিতে হবে। প্রাণী প্রতিপালন করলে, সেগুলোর সুস্থতা ও খাবারদাবারের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা ওয়াজিব বা অত্যাবশকীয়। অগণিত প্রাণীর মধ্যে ইসলাম সীমিত কিছু পশু-পাখি খাদ্য হিসেবে গ্রহণের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু সেগুলো জবাই করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অনুকম্পা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যখন তোমরা জবাই করবে, সর্বোত্তম পন্থায় করবে। জবাইয়ের ছুরি ভালোভাবে ধার দিয়ে নেবে, আর পশুটির প্রাণ স্বাভাবিকভাবে বের হওয়ার সুযোগ দেবে।’ (মুসলিম : ১৯৫৫) তাই ফিকাহবিদগণ লিখেছেন, জবাই করার জন্য পশুদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। এক পশুর সামনে অন্য পশু জবাই করা যাবে না। পরিপূর্ণ নিস্তেজ হওয়ার আগে ছুরিকাঘাত কিংবা চামড়া সরানো যাবে না। এসব কাজ মাকরুহে তাহরিমি। এ ছাড়া কোনো জীবন্ত পশু-পাখি আগুনে পোড়ানো ইসলামে নিষিদ্ধ। আবদুর রহমান বিন আবদুল্লাহ রাদিআল্লাহু আনহু তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, এক সফরে আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গী ছিলাম। তিনি দেখতে পেলেন, আমরা একটা মৌমাছির বাসা জ্বালিয়ে দিয়েছি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘কে এটি জ্বালিয়ে দিয়েছে?’ আমরা নিজেদের কথা বললাম। তিনি বলেন, ‘আগুনের স্রষ্টা ছাড়া কারো জন্য আগুন দিয়ে শাস্তি দেয়া শোভা পায় না।’ (আবু দাউদ : ২৬৭৫) ফিকাহবিদরা বলেন, পিঁপড়া দংশন না করলে তাদের মেরে ফেলা মাকরুহ। আর এদের পানিতে নিক্ষেপ করা সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ। বিচ্ছুকেও আগুনে পুড়ে ফেলা মাকরুহ।’ (ফতোয়ায়ে বাজ্জাজিয়া, ৬/৩৭০) জীবিত থাকা অবস্থায় পশু-পাখির কোনো অঙ্গ কাটা যাবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জীবিত অবস্থায় যে প্রাণীর কোনো অংশ কাটা হয়, সেটা মৃত তথা হারাম হয়ে যাবে।’ (তিরমিজি : ১৪৮০) পশু-পাখির চেহারায় প্রহার করা, অঙ্কিত করা ও চিহ্ন ব্যবহার করে চেহারা বিকৃত করা ইসলামে নিষিদ্ধ। জাবের রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চেহারায় প্রহার ও অঙ্কন করতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম : ২১১৬) আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উত্তম চরিত্রের সর্বোচ্চ চূড়ায় অধিষ্ঠিত করেছেন। সকল দিক থেকে তাকে করেছেন শ্রেষ্ঠ। জগতের প্রাণিকুল তাঁর কাছে কষ্টের কথা বলতো। তার নান্দনিক চরিত্রমাধুরী দেখে কত মানুষই না ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে তা গণনা করে শেষ করা যাবে না। সুন্দর চরিত্রের এমন কোন দিক নেই যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্বে পূর্ণতা পায়নি। পৃথিবীতে তিনিই একমাত্র ও অদ্বিতীয় ব্যক্তি যাকে ঘিরে সুশোভিত হয়েছে সকল প্রকার নান্দনিক গুণাবলী। দান, বদান্যতা, ভদ্রতা, ক্ষমা, মহানুভবতা, ধৈর্য, সহনশীলতা, ন¤্রতা, সবর, বন্ধুত্বসুলভ আচরণ, বিনয়, ন্যায়পরায়ণতা, দয়া-করুণা, অনুগ্রহ, সাহসিকতা, বীরত্বসহ সকল দিক থেকে তিনি ছিলেন পরিপূর্ণতার অনন্য দৃষ্টান্ত। মানবসমাজের উন্নতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক ও চারিত্রিক সকল ক্ষেত্রে গৌরবময় উত্তরণের পথই হলো অনুসরণীয় আদর্শ। আদর্শহীন কোনো জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে সমাদৃত হতে পারে না। তাই আজকের এই করুণ ও অবক্ষয় মুহূর্তেও যদি মুসলিম উম্মাহ ফিরে পেতে চায় তাদের হারানো অতীত, তাহলে তাদের অনুসরণ করতে হবে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনাদর্শ। সুতরাং সেই আদর্শের পথেই হোক আমাদের নবযাত্রা। আদর্শিক প্রত্যয়ে প্রাণবন্ত হয়ে উঠুক আমাদের জীবন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির