সহীহ মুসলিমের একটি হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন, “যারা এক আল্লাহর ইবাদত করে তাদের কাছ থেকে ইবাদত পাওয়ার বিষয়ে শয়তান আশা ছেড়ে দিয়েছে। এ কারণে শয়তানও তার কৌশল বদলেছে। শয়তান এ উম্মতকে মূর্তিপূজারি বানানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে এখন তাদের মধ্যে বিভক্তি আর বিভাজনকে প্রবেশ করে দিয়েছে। ইমাম নববি (রহ.) এ হাদিসের আলোকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, মূলধারার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম আর কখনোই মূর্তিপূজায় ফিরে যাবে না।’ বাস্তবতা তাই বলে, ইসলাম যেভাবে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে বিশ^জুড়ে ছড়িয়েছে এবং যেভাবে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছে তা অন্য কোনো ধর্মের ক্ষেত্রেই হয়নি। ইসলামের আগমনের ওপর যেভাবে বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ নতুন এ ধর্মকে মেনে নিয়েছে এবং তারপর যেভাবে তার ওপর দৃঢ়তার সাথে অটুট থেকেছেন, বিশ্বে সে দৃষ্টান্ত বিরল।
কাজাখস্থান থেকে আন্দালুস, ভারতবর্ষ থেকে শুরু করে আফ্রিকা অবধি যেখানেই ইসলাম গিয়েছে, ইসলাম টিকে থেকেছে। রাজনৈতিক কারণে কিছু জায়গা থেকে ইসলামকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে কিন্তু মুসলিমরা আবার আইয়ামে জাহেলিয়াতের মতো পৌত্তলিকতায় ডুবে গিয়েছে- এরকম কোনো নজির আমাদের সামনে নেই। তাই শয়তান যেহেতু মূর্তিপূজা বা পৌত্তলিকতায় মুসলিমদেরকে শামিল করতে পারছেই না, তাই সে মুসলিমদেরকে বিভক্ত করতে, তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে ষোল আনা শক্তি বিনিয়োগ করেছে। বিভক্তি-বিভাজন মূলত শয়তানেরই একটি কৌশল। কারণ উম্মাহ যখন বিভক্ত হয়, তখন আমরা সবাই মিলে তার ভোগান্তি সহ্য করি। উম্মাহ যখন বিভাজিত হয়, তখন আমরা সার্বিকভাবে দুর্বল হয়ে যাই। শয়তান প্রতিনিয়ত তার সেনাপতি, কমান্ডার আর সাধারণ সেনাদেরকে নিয়ে বসে, বৈঠক করে এবং উম্মতকে পথভ্রষ্ট করার জন্য একের পর এক কৌশল করে বেড়ায়। রাসূল সা.-এর ওফাতের পরপরই শয়তান মুসলিমদের মধ্যে নানা ইস্যুতে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। অনেকেই যাকাত দিতে অস্বীকার করে। কেউ কেউ নিজেকে নবী বলেও দাবি করতে শুরু করে। কিন্তু শয়তানের এসব কূটকৌশল সফল হতে পারেনি, কারণ সাহাবিরা শেষ পর্যন্ত একত্রিত থেকে এসব অপকৌশলের বিরুদ্ধে ভূমিকা নিতে পেরেছিলেন।
শয়তান উম্মতের মধ্যে বিভক্তি ছড়ানোর জন্য কয়েকটি কৌশলে অগ্রসর হয়। প্রথমত, সে উম্মতের মধ্যে নানা শ্রেণী, গ্রুপ ও সম্প্রদায় তৈরি করে তাদের মাঝে সংঘাত সৃষ্টি করে দেয়। শয়তান মানুষের ভেতর কল্পিত কিছু ইস্যুর জন্ম দিয়ে তার ভিত্তিতে বিভাজন সৃষ্টি করে। শয়তান কিছু ইস্যু আমাদের সামনে শয়তান হাজির করে, আর আমরা সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই। অথচ, প্রকৃতপক্ষে এ ইস্যুগুলোর হয়তো কোনো অস্তিত্বই নেই। শয়তান রাষ্ট্র, বর্ণ, গোত্রের ইস্যুকে ব্যবহার করে আমাদেরকে বিভক্ত করে। এসব ব্যবধান বা পার্থক্য আল্লাহ সৃষ্টি করেননি। আল্লাহ বৈচিত্র্যময় করে সব সৃষ্টি করেছেন। অথচ মানুষ এ বৈচিত্র্যের চেতনাকে ধারণ করতে না পেরে উল্টো নিজেদের মাঝে পার্থক্যের দেয়াল গড়ে নিয়েছে।
আমরা কে কোথায় জন্মেছি, কোন দেশে বা কোন বংশে তাতে কিই বা আসে যায়? আমাদের বাবা-মা কোথাকার কিংবা কে কোন জাতীয়তার-তাতে আল্লাহর কিছুই আসবে যাবে না। আল্লাহ তো বলেই দিয়েছেন, “হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।” (সূরা আল হুজুরাত : ১৩) অথচ আমরা মানুষেরা এগুলো নিয়েই ঝগড়া ফ্যাসাদ করে থাকি। নিজের দেশ বা নিজের সংস্কৃতিকে ভালোবাসার মধ্যে কোনো দোষ নেই। কিন্তু দোষ হয় তখন যখন আপনি নিজের সংস্কৃতি বা সত্তাকে ওপরে উঠানোর জন্য অন্য কারো সংস্কৃতিকে হেয় করার চেষ্টা করেন। আপনি নিজের দেশের ভাষা, খাবার, পোশাক নিয়ে স্বস্তিতে থাকতেই পারেন, তবে তা করতে গিয়ে অপরের নিজস্ব বিষয়াবলিকে আপনি অপমান করতে পারেন না। নিজেকে এবং নিজের অবস্থানকে শ্রেষ্ঠতর মনে করার মানসিকতা সঠিক নয়।
শয়তান আমাদেরকে দিয়ে আরেকটি খারাপ কাজ করায়। তাহলো আমরা জেনারেলাইজ করি। ধরুন, বলে বসলাম, অমুক লাইনের সবাই খারাপ। অমুক দেশের বা অমুক অঞ্চলের মানুষ ভালো না- এ টাইপের জেনারেলাইজেশন করা সঠিক নয়। সব জায়গাতেই ভালো মন্দ আছে। কিন্তু ঢালাওভাবে কাউকে নেতিবাচকভাবে চিত্রায়ণ করা উচিত নয়। অথচ আমরা শয়তানের পাল্লায় পড়ে হরহামেশাই এমনটা করে থাকি। রাসূল সা. বিদায় হজের ভাষণে গোত্রপ্রথার অবসান ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি আরবের ওপর অনারবের এবং অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্বকে খারিজ করে দিয়েছিলেন। আমরা যেন সে শিক্ষার কথা ভুলে না যাই। যাহোক, শয়তান যদি গোত্রীয় স্তরে বিভক্তি সৃষ্টি করতে না পারে তাহলে সে ব্যক্তি পর্যায়ে তার অপচেষ্টা শুরু করে। একজন ভাই যেন তার অপর ভাইয়ের সাথে কথা না বলে, আত্মীয়দের মাঝে যেন অসন্তোষ জমে থাকে, পরস্পরের মধ্যে যেন হিংসা লেগে থাকে, কেউ যেন কারো ভালো দেখতে না পারে- শয়তান এমন পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করে। আপনার সাথে যদি কারো আগে সম্পর্ক ভালো থেকে থাকে আর এখন যদি কোনো দূরত্ব অনুভব করেন- তাহলে বুঝবেন শয়তান আপনাদের মাঝে প্রবলভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
গিবত চর্চা করা, পরনিন্দা করা, গুজব ছড়ানো- এগুলো সব শয়তানি কৌশল। কেউ এসে আপনার কাছে অপরের নামে নিন্দা করছে, আপনার বিরুদ্ধে অপরকে কথা বলতে উসকানি দিচ্ছে- তাহলেই বুঝবেন সেখানে শয়তান সক্রিয় হয়ে পড়েছে। এ কারণে যিনি গিবত করেন আর যিনি তা ছড়িয়ে দেন, উভয়েই সমান অপরাধী। কারণ এসব কাজের ফলে সামাজিক বন্ধন নষ্ট হয়ে যায়। হযরত ইউসুফের (আ) কথা ভাবুন। তার ভাইয়েরাই তার বিরুদ্ধে যাবতীয় চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করলো। কিন্তু সব কিছুর শেষে অনেক বছর পর আল্লাহ যখন গোটা পরিবারকে একত্রিত করলেন, তখন কিন্তু হযরত ইউসুফ (আ) একটিবারের জন্য তার ভাইদেরকে দায়ী করেননি। বরং তিনি শয়তানকে দায়ী করে বলেছিলেন, “শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করে দেয়। আমার পালনকর্তা যা চান, কৌশলে সম্পন্ন করেন।” (সূরা ইউসুফ : ১০০) শয়তান সবচেয়ে খারাপ যে বিভক্তিটি সৃষ্টি করে তা করে তাহলো স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। সহীহ মুসলিমের ২৮১৩ নং হাদিস থেকে জানা যায়, শয়তান প্রতিদিন তার সেনাদেরকে নিয়ে সম্মেলন করে এবং সেদিন কে কী খারাপ কাজ করে জানতে চায়। যে কাজেরই প্রতিবেদন তার সামনে দেয়া হয় সে তাকেই তুচ্ছ জ্ঞান করে। অবশেষে যখন কোনো শয়তান সেনা তাকে জানায় যে, আজ আমি ততক্ষণ পর্যন্ত একটি দম্পতিকে ওয়াসওয়াসা দিয়ে গিয়েছি যতক্ষণ না তাদের মধ্যে তালাক হয়ে যায়। এ কথা শুনে শয়তান হাসে আর সে সেনাকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি আজ কাজের কাজ করেছো।”
শয়তান যেভাবে সম্প্রদায় ও সামগ্রিক কাঠামোতে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল ধরায়- আমাদেরকে সে বিষয়ে অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সাহায্য করুন। আমিন। শয়তানের এসব কৌশলকে প্রতিহত করার ৩টি উপায় আছে। প্রথমত আমরা যা বলি, তার বিষয়ে সংযত হতে হবে। আমাদের জিহবাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর একইসঙ্গে আমরা যা শুনি, তার বিষয়েও আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে। একটা কথা শুনলেই তাতে রিঅ্যাক্ট করা যাবে না। কথা শুনেই যাচাই না করে কাউকে খারাপ ভেবে নেয়া যাবে না। আল্লাহ বলেন, “যারা মনোনিবেশ সহকারে কথা শুনে, অতঃপর যা উত্তম, তার অনুসরণ করে। তাদেরকেই আল্লাহ সৎপথ প্রদর্শন করেন এবং তারাই বুদ্ধিমান।” (সূরা যুমার : ১৮) আল্লাহ পাক আরো বলেন, “আমার বান্দাদেরকে বলে দিন, তারা যেন যা উত্তম এমন কথাই বলে। শয়তান তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধায়। নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা বনি ইসরাইল : ৫৩) তাই আমাদের কান ও জিহবার বিষয়ে আমাদের এখন থেকেই আরো বেশি সতর্ক হওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, আল্লাহর কাছে দুয়া করতে হবে যাতে আমাদের অন্তর বিশুদ্ধ হয়। আমাদের অন্তর যেন গিবত, হিংসা ও পারস্পরিক ঘৃণা থেকে মুক্ত হয়। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বারবার পবিত্র মনের অধিকারী মানুষগুলোর প্রশংসা করেছেন।
আর তৃতীয়ত খারাপের উত্তর ভালো দিয়েই দিতে হবে। আপনি যদি দেখেন কোথাও খারাপ কোনো বিষয়ে চর্চা হচ্ছে, তাহলে সে স্থান ত্যাগ করুন। সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন এমন কোনো বিষয় নিয়ে বাহাস দেখবেন যা ইসলাম অনুমোদন করে না, তখন নিজে তাতে যুক্ত হবেন না, বরং সেখান থেকে বেরিয়ে আসুন। অন্যদেরকে এ অভ্যাস ত্যাগ করতে উৎসাহিত করুন। যদি কেউ আপনার বিরুদ্ধে খারাপ কোনো প্রচারণা চালায় তাহলেও তার বিষয়ে উত্তম মন্তব্য করুন। আপনি আবার পাল্টা নেতিবাচক মন্তব্য করে পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবেন না। এরকম করলে আপনি আল্লাহর সন্তুষ্টি যেমন অর্জন করতে পারবেন ঠিক তেমনি আপনার ঘোর শত্রুর সাথেও আপনার মহব্বত সৃষ্টি হবে। যেভাবে আমরা নিজেরা সবাই বিভাজিত হয়ে আছি, বিভক্তি আর টানাপড়েন যেভাবে আমাদেরকে পেছনে ফেলে রেখেছে, এ অবস্থা বজায় রেখে আমরা এগোতে পারবো না। আমাদেরকে অনুধাবন করতে হবে যে, এত সব সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে শয়তানের ওয়াসওয়াসার কারণেই।
শয়তানের জিম্মায় চলে যাওয়া আমাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক। আল্লাহ যেন আমাদেরকে শয়তানের ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে উম্মতের চেতনা লালন করার এবং একনিষ্ঠতার সাথে উম্মতের জন্য দায়িত্ব পালন করার তাওফিক দেন। আল্লাহ যেন আমাদের অন্তরকে বিশুদ্ধ করেন, আমাদের জিহবাকে সংযত রাখেন, আমাদের কানকে নিয়ন্ত্রণ করার তাওফিক দিন। আমরা যেন ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব সর্বত্র প্রচার করতে পারি, আমরা যেন নিজেদের জীবনে ইসলামের শিক্ষাকে বাস্তবায়ন ও ধারণ করতে পারি। আমিন। (ড. ইয়াসির কাদিরের একটি আলোচনা থেকে অনুপ্রাণিত - লেখক)
লেখক : সাংবাদিক, অনুবাদক ও কলামিস্ট
আপনার মন্তব্য লিখুন