এইচএসসির ফল প্রকাশ শতভাগ পাসের গুমর ফাঁস
মুজাহিদুল ইসলাম
২৫ জুলাই ২০১৭
ছোটবেলায় আমরা বড়দের কাছে দোয়া চাইতাম। তাঁদের আশীর্বাদ নিতাম। জীবনে যাতে বড় হতে পারি, পড়াশোনায় ভালো করতে পারি সেই জন্য। বিশেষত পরীক্ষায় ভালো ফলের জন্য। তাঁরাও প্রাণভরে দোয়া করতেন। প্রায়শই তাঁরা বলতেন, ‘মানুষের মত মানুষ হও’। তখন মনে হতো আমরা তো মানুষই; আবার মানুষ হতে বলে কেন? এ বছর উচ্চমাধ্যমিক ফল প্রকাশের পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তেমন কথা বলেছেন। গত ২৩ জুলাই এইচএসসি, আলিম ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এ বছর পাসের হার ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। গত বছর ছিল ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। কমেছে ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এবারের ফলাফল নিয়ে সারা দেশে চলছে আলোচনা-পর্যালোচনা। ফলাফল নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘কত পার্সেন্ট পাস করল, কত পার্সেন্ট পাস করল না; সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। মানুষ হওয়াটাই মুখ্য; পাসের হার নয়।’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৪ জুলাই ২০১৭) প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য নিঃসন্দেহে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য আশীর্বাদ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী, এ বছর ১০টি বোর্ডের অধীনে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১১ লাখ ৬৩ হাজার ৩৭০ জন পরীক্ষার্থী। এদের মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ৮ লাখ ১ হাজার ৭১১ জন। এ বছর ১০ বোর্ডে জিপিএ ৫ পেয়েছে ৩৭ হাজার ৯৬৯ জন। গত বছর পেয়েছিল ৫৮ হাজার ২৭৬ জন। কমেছে ২০ হাজার ৩০৭ জন। শুধু এইচএসসির ৮ বোর্ডে পাসের হার ৬৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। গত বছর যা ছিল ৭২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছে ৩৩ হাজার ২৪২ জন। গতবার পেয়েছিল ৪৮ হাজার ৯৫০ জন। এদিকে মাদরাসা বোর্ডে পাসের হার কমেছে ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ। গত বছর ছিল ৮৮ দশমিক ১৯ শতাংশ। এ বছর নেমে এসেছে ৭৭.০২ শতাংশে। জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ হাজার ৮১৫ জন। অন্য দিকে কারিগরি বোর্ডের ফলাফল গত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে এসে দাঁড়িয়েছে ৮১.৩৩ শতাংশে। এ ছাড়া প্রায় সব সূচকেই নি¤œগামী এ বছরের উচ্চমাধ্যমিক ফলাফল। ফলাফলের এমন চিত্রের জন্য প্রস্তুত ছিলেন বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন খোদ শিক্ষামন্ত্রী।
উচ্চমাধ্যমিকের মতো মাধ্যমিকের ফলাফলেও ধস নেমেছে এবার। গত ৪ মে ২০১৭ তারিখ প্রকাশ হয়েছে এসএসসি-সমমানের পরীক্ষার ফলফল। পাসের হার ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। গতবার ছিল ৮৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। এসএসসি-সমমানের পরীক্ষায় এবার জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৬১ জন পরীক্ষার্থী। গতবারের চেয়ে এই সংখ্যা কমেছে পাঁচ হাজার।
ফলাফলের এহেন বিপর্যয়েও শিক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সত্যই ‘প্রশংসনীয়’। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘আগে পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নপদ্ধতি যথাযথ ছিল না।’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৪ জুলাই ২০১৭) ‘সব পরীক্ষক যাতে সঠিকভাবে খাতা দেখেন, সঠিক নম্বর দেন, এবার সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এবার একটা মান ঠিক করে দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী পরীক্ষকেরা খাতা দেখেছেন। এতে কাউকে কম বা বেশি নম্বর দেয়ার সুযোগ ছিল না। এ কারণে ফলাফলে কিছুটা প্রভাব পড়েছে।’ (প্রথম আলো, ৪ মে ২০১৭) মন্ত্রীর এ বক্তব্য থেকে শিক্ষার মান, পরীক্ষাপদ্ধতি ও খাতা মূল্যায়নের ব্যাপারে দীর্ঘ দিনের অভিযোগ যে অমূলক নয়; তাই প্রতীয়মান হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘লেখাপড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ; পরীক্ষার পাসের হার বিবেচ্য নয়।’ (সমকাল, ২৫ জুলাই ২০১৭) তাঁর এ দৃষ্টিভঙ্গি দেশের শিক্ষা উন্নয়নে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কিন্তু ২০১৪ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাসের হার বৃদ্ধির কেন এত তোড়জোড়? শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত না করে শতভাগ পাস নিশ্চিত করার কেন এত প্রচেষ্টা? ২০০৯ সালে পিএসসি পরীক্ষা চালুর মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে এই পাসের হার বাড়ানোর কী কারণ ছিল সরকারের?
কারণ জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি)। এই লক্ষ্যমাত্রাগুলোর একটা হলো শিক্ষাসংক্রান্ত। যার মূল কথা হলো ২০১৫ সালের মধ্যে সকল শিশু প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করবে ও সকল মানুষ শিক্ষিত হবে। সুতরাং স্পষ্ট যে এই শতভাগ পাস, এই শতভাগ শিক্ষিত নাগরিকের সাথে শিক্ষার মানের কোনো সম্পর্ক নেই; আছে শুধু স্বার্থের সম্পর্ক। সরকারের সে স্বার্থ জাতির সামনে এখন সুস্পষ্ট। তারা মনে করেছে এমডিজি-২ অর্থাৎ ২০১৫ সালের মধ্যে সব শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্য তারা অর্জন করতে পারলে বিশ্বদরবারে তাদের গ্রহণযোগ্যতার একটা ভিত্তি তৈরি হবে। হয়েছেও তাই। বিশ্বব্যাংক ২০১৩ সালের ১০ ডিসেম্বর এই সাফল্যের স্বীকৃতি দিয়েছেন ‘ইধহমষধফবংয যধং সধফব ৎবসধৎশধনষব ঢ়ৎড়মৎবংং রহ ঢ়ৎরসধৎু বফঁপধঃরড়হ, রিঃয ৯৮.৬% বহৎড়ষষসবহঃ ৎধঃব ধহফ ৭৩.৮% পযরষফৎবহ পড়সঢ়ষবঃরহম ঢ়ৎরসধৎু বফঁপধঃরড়হ.’
শতভাগ পাসের মিশনে সরকার শতভাগ সফল হয়েছেন। কিন্তু ভেঙে পড়েছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে শিক্ষার মান। নষ্ট হয়েছে হাজার হাজার ছাত্রের ভবিষ্যৎ। তৈরি হয়েছে ‘আই অ্যাম এ প্লাস’ মার্কা ‘মেধাবী’। প্রচলিত একটি গল্প এখানে প্রণিধানযোগ্যÑ
অনেক দিন আগের কথা। এক দেশে এক প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন। তাঁর ধনদৌলতের কোনো অভাব ছিল না। শান-শওকতেরও কমতি ছিল না। তবে তিনি ছিলেন অশিক্ষিত। একদম নিরক্ষর। এইটুকুন অপূর্ণতা। একদিন তিনি তার প্রিয় ঘোড়া নিয়ে বেড়াতে গেলেন। পথিমধ্যে দেখলেন, একটা নতুন ভবনের সামনে অনেক লোকের ভিড়। কাছে গিয়ে তিনি জানতে পারলেন যে, সেটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে ১ হাজার রুপির বিনিময়ে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়। তবে শর্ত হচ্ছে, তাকে স্বাক্ষর দিতে জানতে হবে! ন্যূনতম টিপসই দিতে পারতে হবে!! জমিদার তো বেজায় খুশি। তিনি শর্ত পূরণ করে সার্টিফিকেট-সমেত বাড়ি ফিরছিলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর তার মনে হলো, আমিতো ভীষণ বোকা! আমার ঘোড়ার জন্য একটা পিএইচডি ডিগ্রি নিলেই হতো। ১ হাজার রুপি তো বেশি কিছু নয়। আর ঘোড়া স্বাক্ষর না হোক, পা দিয়ে হলেও টিপসই অন্তত দিতে পারবে। তিনি পুনরায় সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলেন। ভিসিকে সব খুলে বললেন। সব শুনে ভিসি বললেন, এখানে কেবল গাধাদের ডিগ্রি দেয়া হয়; ঘোড়াদের নয়। বাংলাদেশের অবস্থাও এতদিন তাই ছিল।
এক্ষেত্রে সরকারের বক্তব্য ছিল- শিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের অগ্রগতি। সরকারের অগ্রগতির একটি নমুনা লক্ষ্য করা যায় গত বছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলে। এতে পাসের হার ছিল প্রায় শতভাগ। ৯৮ দশমিক ৫১ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৮৪৬ জন। জেএসসি ও জেডিসিতে পাস করেছিল ৯৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। আর জিপিএ ৫ পেয়েছিল দুই লাখ ৪৭ হাজার ৫৮৮ জন। এ সময় শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ‘শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করছে তাদের যোগ্যতায়।’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬)
২০১৪ সালে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১ হাজার ১৪৭টি প্রতিষ্ঠানে শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে। সে সময় শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ‘শতভাগ পাসে অসুবিধা কী? শিক্ষার মান বেড়েছে বলেই পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।’ (বিডিনিউজ ২৪.কম, ১৩ আগস্ট ২০১৪) এ বছর শতভাগ পাস করেছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৩২টি।
এতদিন সরকার পাসের হারকেই কেবল সফলতার সূচক মনে করতেন। অথচ বিভন্ন মহল থেকে সরকারের এ মানসিকতার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। তথাপি তারা এসবের কোনো তোয়াক্কা না করে পাসের হার নিয়ে দম্ভোক্তি প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এমন মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা ক্ষমতায় আসার আগে পাসের হার কত ছিল, আর এখন কত?’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৪ জুলাই ২০১৭)
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরউদ্দীন উমর বলেন, ‘পরীক্ষার ভালো ফল হওয়া শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি এবং উচ্চমানের কোনো নিদর্শন নয়। অনেক সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই নির্ধারণ করে দেয়, শতকরা কত ছাত্র কোন পরীক্ষায় পাস করতে হবে।’ (সমকাল, ২৫ জুলাই ২০১৭)
বিগত পাঁচ বছরে ১০টি বোর্ডের এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষার ফলাফল
সাল পাসের হার (%) জিপিএ ৫
২০১৭ ৬৮.৯১ ৩৭,৯৬৯
২০১৬ ৭৪.৭০ ৫৮,২৭৬
১০১৫ ৬৯.৬০ ৪২,৮৯৪
২০১৪ ৭৮.৩৩ ৭০,৬০২
২০১৩ ৭৪.৩০ ৫৮,১৫৭
পাঁচ বছরে এইচএসসির ফলাফলে তেমন ধারাবাহিকতা নেই। তাই চলমান শিক্ষাব্যবস্থা যে ত্রুটিমুক্ত, এ কথা বলার সুযোগ নেই। মূলত নিত্যনতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করার ফলে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করা দরকার। পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচি, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, পরীক্ষা গ্রহণ, খাতা মূল্যায়ন সব ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার।
উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষার্থীরা ছুটে উচ্চশিক্ষা অর্জনের দিকে। এ জন্য তারা বেছে নেয় মেডিক্যাল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে ভর্তি হতে হয় পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এ সকল ভর্তি পরীক্ষায় সাধারণত প্রশ্ন করা হয় উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যক্রমের আলোকে। মূলত ভর্তি পরীক্ষা মানসম্মত ছাত্র বাছাইয়ের একটি প্রক্রিয়া। একই সাথে শিক্ষার মান যাচাইয়ের অন্যতম মাধ্যম।
এইচএসসির পাসের হার আর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার পাসের হারের মধ্যে বিস্তর ফারাক দৃশ্যমান। এই ফারাক রেখে শিক্ষার মান নিশ্চিত হয়েছে বলা, প্রকারান্তে জাতিকে ধোঁকা দেয়ারই নামান্তর। প্রতি বছর পাস করা ছাত্ররা ভর্তি পরীক্ষায় বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। জিপিএ ৫ পেয়েও তারা ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বর তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে। এমনকি ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ২ জন শিক্ষার্থী ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে! অথচ ঐ বছর কেবল জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার ৬০২ জন।
এ বছর মাধ্যমিকের পাসের হার ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। গতবারের তুলনায় ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম। সরকার এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে এবং বলছে, ‘খাতা মূল্যায়নে নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করায় এমনটি ঘটেছে।’ (২৪ জুলাই ২০১৭, নয়া দিগন্ত) তাতেও জনমনে প্রশ্ন থেকে যায়, নতুন পদ্ধতির এই মূল্যায়নে কুমিল্লা বোর্ডে অর্ধেকের কম (৪৯ দশমিক ৫২ শতাংশ) শিক্ষার্থী পাস করেছে; অথচ একই মূল্যায়নপদ্ধতিতে শিক্ষামন্ত্রীর নিজ এলাকা সিলেট বোর্ডে কিভাবে ৭২ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করে?
বোর্ড ২০১৭ ২০১৬
ঢাকা ৬৯.৭৪ ৭৩.৫৪
রাজশাহী ৭১.৩০ ৭৫.৪০
কুমিল্লা ৪৯.৫২ ৬৪.৪৯
যশোর ৭০.০২ ৮৩.৪২
চট্টগ্রাম ৬১.০৯ ৬৪.৬০
বরিশাল ৭০.২৮ ৭০.৭৩
সিলেট ৭২.০০ ৬৮.৫৯
দিনাজপুর ৬৫.৪৪ ৭০.৬৪
মাদরাসা ৭৭.০২ ৮৮.১৯
কারিগরি ৮১.৩৩ ৮৪.৫৭
বোর্ডভিত্তিক পাসের হার
শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘ফলাফলের এমন চিত্রের জন্য প্রস্তুত ছিলাম।’ মন্ত্রীর এ বক্তব্য কতটুকু দায়িত্বশীলসুলভ; সে ব্যাপারে সন্দিহান। ফলাফলের এমন চিত্রের জন্য প্রস্তুত থাকার চেয়ে তা রোধ করার পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল। যেহেতু নতুন পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেহেতু ছাত্রদের সেভাবে উপযোগী করে গড়ে তোলা দরকার ছিল। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা দরকার ছিল। কেননা ফেল করা ছাত্রদের দায় কে নেবে?
যাই হোক এটা যদি শিক্ষার মান নিশ্চিত করার জন্য হয়ে থাকে, তবে তা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। দেশের জনগণও এটাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করবে। এ বছর ফল বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে মোটা দাগে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘নতুন পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়ন’কে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এ ছাড়া আরো কিছু কারণ রয়েছেÑ
হ ৫০টি পত্রে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ।
হ ইংরেজি ও পদার্থবিজ্ঞানে অধিকাংশের ফেল।
হ কুমিল্লা বোর্ডের পাসের হার কম থাকা ইত্যাদি।
গত বছর ১৯টি বিষয়ের ৩৬টি পত্রে সৃজনশীল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এ বছর ২৬টি বিষয়ের ৫০টি পত্রে এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সৃজনশীল প্রশ্নে বহু নির্বাচনী অংশে অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। ইংরেজিতে পাস করেছে মাত্র ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী। কুমিল্লা বোর্ডে ফলাফল খুবই শোচনীয়। এ ব্যাপারে কুমিল্লা বোর্ডের বাংলা বিভাগের প্রধান পরীক্ষক কামাল উদ্দীন বলেন, এবার সব বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়েছে। কিন্তু কুমিল্লার গ্রামের শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলপদ্ধতি থেকে অনেক দূরে। সৃজনশীলপদ্ধতি ভালোভাবে বুঝতে না পারায় কুমিল্লা বোর্ডের ফল খারাপ হয়েছে।’ তবে রফিকুল ইসলাম নামে এক শিক্ষক বলেন, কুমিল্লা বোর্ডের পাসের চিত্রই দেশের সার্বিক চিত্র। পরীক্ষা হলে কঠোরতা এবং খাতা মূল্যায়নে উদারনীতি না থাকায় এ বছর পরীক্ষার ফল খারাপ হয়েছে।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪ জুলাই ২০১৭)
অতএব এবারের ফলাফলকে বিপর্যয় না বলে বাস্তবিক বলাই ভালো। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষা কেন্দ্রে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদের উত্তর বলে দেয়া, খাতায় যা-ই লিখুক শিক্ষকদের নম্বার দেয়ার অলিখিত নির্দেশনা দেয়া, মূল্যায়নপত্র তৈরিতে কারচুপি ইত্যাদি রোধ না করে পাসের হার বৃদ্ধি করলে তাতে শিক্ষার মানের কোনো উন্নতি হয় না। নকলের ছড়াছড়ির ফলে শিক্ষার্থীরা আজ বইবিমুখ। এসকল শিক্ষার্থীকে তাদের ক্যারিয়ারের ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। তা ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবি। একই সাথে দেশে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। ভালো শিক্ষকই পারেন ভালো ছাত্র তৈরি করতে। তাই নিয়োগবাণিজ্য বন্ধ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষক নিশ্চিত করতে হবে। তাদেরকে নিয়ে আসতে হবে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের আওতায়। নচেৎ শতভাগ পাস হলেও মানুষের মতো মানুষ তৈরি হবে না।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
আপনার মন্তব্য লিখুন