post

একজন ভাষাসৈনিক

ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম

২২ জানুয়ারি ২০১৬
রক্তের লাল কাপড়ে মোড়ানো একুশে ফেব্রুয়ারি। যাদের আন্দোলন-সংগ্রামের নিরন্তর লড়াইয়ে পাওয়া আমার মায়ের বাংলাভাষা। ত্যাগের রক্তিম শিখরে লেখা আমাদের উজ্জ্বল দিশা ’৫২। জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তি তো সেই ভাষা আন্দোলনই। জাতির সেই শ্রেষ্ঠসন্তান, বীর সেনানী শহীদদের প্রতি আমাদের বিন¤্র শ্রদ্ধা ও সালাম। ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বের ১৯০টি দেশে এখন প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপিত হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের ৩০ কোটিরও বেশি লোক বাংলাভাষায় কথা বলে। এ বিশাল অর্জন একান্তই আমাদের। কিন্তু যাদের ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের মুখের বাংলাভাষা, আমরা দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে কি ভাষা শহীদ আর সৈনিকদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত করতে পেরেছি? সে লড়াইয়ে প্রথম কাতারেরই একজন অধ্যাপক গোলাম আযম। জীবনের শেষ সময়গুলোতে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ভাষাসৈনিকের ওপর চালানো হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। এটি ছিল অমানবিক! মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিশ্বের ইতিহাসে সম্ভবত ভাষার জন্য জীবন দেয়ার ইতিহাস আমরাই কায়েম করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু বিশ্বের ইতিহাসে সম্ভবত আমরাই প্রথম যারা একজন ভাষাসৈনিককে আমৃত্যু কারাগারে আবদ্ধ করে রেখেছি!। এই জাতির শ্রেষ্ঠসন্তানদের মধ্যে ভাষাসৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযম অন্যতম। স্বমহিমায় উদ্ভাসিত একজন মানুষ তিনি। নিজ যোগ্যতাবলে তার ঐতিহাসিক স্বাক্ষর তিনি নিজেই। তিনিই তাঁর গৌরবোজ্জ্বল কর্মের উপমা। তিনি ছিলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত ডাকসুর সাবেক নির্বাচিত জিএস। সময়ের সাড়াজাগানো ছাত্র। বর্তমান সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু, বিশ্বব্যাপী সমাদৃত, কেয়ারটেকার সরকারের রূপকার, ভাষাসৈনিক, বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ, মজলুম মানবতার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, জননেতা অধ্যাপক গোলাম আযম। আজ তিনি নিজেই একটি ইতিহাস, একটি আন্দোলন, একটি চেতনা আর বিশ্বাসের স্মৃতির মিনার হয়ে আমাদের মাঝে দন্ডায়মান। অধ্যাপক গোলাম আযম একজন সৎ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, খ্যাতিমান অহিংস রাজনৈতিক নেতা, যিনি আন্তর্জাতিকভাবে শ্রদ্ধেয় পন্ডিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। এই মেধাবী চৌকস ও অভাবনীয় নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন ক্ষণজন্মা মানুষ ১৯২২ সালে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট ঢাকা থেকে পাস করেন তিনি। স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সম্পৃক্ত হন ছাত্র-আন্দোলনের সাথে। ১৯৪৭-৪৮ ও ’৪৮-৪৯ সালে পরপর দুই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) জিএস (জেনারেল সেক্রেটারি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়ে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কারা নির্যাতিত হন। এই মহান নেতা ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। শেখ মুজিব কর্তৃক ’৬৬ সালের ছয় দফা দাবি প্রণয়নে অংশ নেয়া ২১ সদস্যের অন্যতম। ১৯৫৪ সালে যোগদান করেন জামায়াতে ইসলামীতে এবং প্রত্যক্ষভাবে শুরু করেন রাজনৈতিক জীবন। পাকিস্তানে ১৯৫৫ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। কপ (ঈঙচ- ঈড়সনরহবফ ঙঢ়ঢ়ড়ংরঃরড়হ চধৎঃু), পিডিএম (চউগ- চধশরংঃধহ উবসড়পৎধঃরপ গড়াবসবহঃ), ডাক (উঅঈ- উবসড়পৎধঃরপ অপঃরড়হ ঈড়সসরঃঃবব) ইত্যাদি আন্দোলনে জনাব শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য সকল দলের নেতাদের সাথে অংশগ্রহণ করে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক কারণে ১৯৬৪ সালেও তাকে কারাবরণ করতে হয়েছিল। ভাষাসৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযম একটি আন্দোলন, একটি জাগরণ, একটি বলিষ্ঠ নেতৃত্বের নাম। একটি চেতনা ও বিশ্বাসের গগনজোয়ারি বিশ্বাসের কণ্ঠস্বর। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত কেয়ারটেকার সরকার ফর্মুলার রূপকার। মেধা ও নৈতিকতার সমন্বয়ের একটি সম্ভাবনাময় দেশগড়ার চেতনার অগ্রপথিক। প্রফেসর গোলাম আযম এক জীবন্ত কিংবদন্তি। অধ্যাপক গোলাম আযম বিশ্বব্যাপী উচ্চারিত একটি আওয়াজ। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যে সংগ্রাম শুরু হয়, তার সাথে তিনি প্রথম থেকেই প্রত্যক্ষভাবে ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে তাকে হাজতবাসসহ শত সহস্র নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। এ দেশের ছাত্র-জনতা যখন বুঝতে পারে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করে, বাংলা ভাষাকে নির্বাসনে পাঠানোর যে আয়োজন করছিল, তা বাস্তবায়িত হলে বাংলাভাষাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কার্যত অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। এমন এক প্রেক্ষাপটে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিশেষ করে ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে এই সাহসী বীরপুরুষ প্রত্যক্ষভাবে ভাষা আন্দোলনে শরিক হন। এই দিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে হরতাল পালিত হয়। হরতাল সফল করতে অধ্যাপক গোলাম আযম ডাকসুর জিএস হিসেবে ছাত্রদের সংগঠিত করেন, বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে পিকেটিংয়ের জন্য রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে অবস্থান নেন। হরতালে পিকেটিংয়ের সময় তাকেসহ ১০-১২ জনকে তেজগাঁও থানা পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এ বিক্ষোভের মূলে ছিল প্রধানত ছাত্ররা। ভাষার দাবিতে প্রথম গণবিক্ষোভ, ধর্মঘট বা হরতাল এবং ১১ মার্চ ঐতিহাসিক মর্যাদা পাওয়ার দাবি রাখে। অধ্যাপক গোলাম আযম এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আসেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠে ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তাকে ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সংবলিত একটি ঐতিহাসিক স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এ স্মারকলিপি প্রণয়নের দায়িত্ব ছিল তৎকালীন ছাত্রনেতা সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি (পরবর্তীতে বিচারপতি) আব্দুর রহমান চৌধুরীর ওপর। স্মারকলিপিটি ডাকসুর কাউকে দিয়ে পেশ করার ব্যাপারে চারটি হলের ছাত্র সংসদের নেতৃবৃন্দ ঐকমত্যে পৌঁছেন। ডাকসুর ভিপি ছিলেন অরবিন্দু বোস। তিনি যেহেতু হিন্দু তাই তাকে দিয়ে পাঠ করালে সরকার বিষয়টিকে ভিন্নভাবে চিত্রিত করতে পারে। এই দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত হয় ডাকসুর জিএস অর্থাৎ আমার ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার কথাটি ছিল শেষের দিকে। এর আগে প্রাদেশিকতায় আমরা বিশ্বাস করি না এমনভাবে আঞ্চলিকতার নিন্দার কথা বলা ছিল এ প্যারাটি পড়ার সময় ছাত্রছাত্রীরা তুমুল করতালি দেয়। করতালি শেষে আমার কানে এলো লিয়াকত আলীর স্ত্রী রানা লিয়াকত তার স্বামীকে বলছেন, ‘ল্যাঙ্গুয়েজকে বারে মে সাফ বাতা দেনা।’ তার কথা শোনার পর আমি লেট মি রিপিট দিস বলে আবার ভাষার দাবিসংবলিত প্যারাটি পড়লাম। আবার মুহুর্মুহু করতালি শুরু হলো। আমি এবার করতালির জন্য একটু বেশি সময় দিলাম। আমি লিয়াকত আলী খান এবং রানা লিয়াকত আলী খানের খুব কাছে বসেছিলাম। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম বিষয়টিকে খুব ভালোভাবে নেননি তিনি। আমি মনে মনে স্থির করলাম বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য তিনি তার বক্তব্যে করলে আমি সাথে সাথে প্রতিবাদ করে স্লোগান দেবো। কিন্তু তিনি খুব ঝানু রাজনীতিবিদ হিসেবে উপস্থিতির মনোভাব উপলব্ধি করে বিষয়টি চেপে গেলেন। তার মনে ক্ষোভ থাকলেও এমনকি তার স্ত্রী অনুরোধ করার পরও ভাষার প্রসঙ্গে কোনো কথা বলেননি। শুধু বক্তব্যের একপর্যায়ে ক্ষোভের সাথে বলেন, ইফ ইট ইস নট প্রোভিনশিয়ালিজম, দেন হোয়াট ইস প্রোভেনশিয়ালিজম? তার এ কথাগুলো শুনে আমরা মনে করেছিলাম তিনি হয়তো ভাষার ব্যাপারে আরও কিছু বলবেন। কিন্তু না তিনি এ প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেলেন। আমার আর স্লোগান দেয়া হলো না।’ ১৯৫২ সালে পল্টন ময়দানের এক জনসভায় খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্রদের সাথে করা সাত দফা চুক্তির তোয়াক্কা না করে ঘোষণা করলেন বাংলা নয় উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তিনি রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কায়েদে আযমের বক্তব্যেরও পুনরাবৃত্তি করার পরই শুরু হয় প্রতিবাদ বিক্ষোভ। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি।’ অধ্যাপক গোলাম আযম ছিলেন বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ ও মুসলিম উম্মাহর একজন অভিভাবক। তথাকথিত যুদ্ধাপরাধী বিচারের নামে ৯০ বছর বয়স্ক এ প্রবীণ রাজনীতিবিদকে আমৃত্যু সাজা প্রদান করে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে দেশে-বিদেশে। সর্বশেষ তাঁর কারাগারে ইন্তেকাল, জানাজায় লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি দেশে-বিদেশে অসংখ্য গায়েবানা জানাজা তাঁর ভক্ত-অনুরক্তদের আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদÑ সবমিলে এক শক্তিশালী গোলাম আযম আবির্ভূত হয়েছেন। মনে হচ্ছে এটি তাঁর বিদায় নয়, পুনর্জন্মা এক গোলাম আযম। এই গোলাম আযম বেঁচে থাকবেন মানুষের মাঝে অনন্তকাল। পৃথিবী যতদিন থাকবে আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকেরা তাঁর জন্য দোয়া করতে থাকবে। তাহাজ্জুতে জায়নামাজ ভাসিয়ে আর বায়তুল্লাহর গেলাপ ধরে অনেকেই কাঁদছেন তাঁর জন্য। রাষ্ট্রীয় জাঁতাকলে পিষ্ট, দীর্ঘ কারাবরণ এর মধ্য দিয়ে দেশে-বিদেশে তিনি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। ভাষার জন্য আত্মত্যাগ স্বীকার করেও ভাষার মাসেও তিনি থেকেছেন বন্দী। এটি আমাদের ব্যর্থতা, জাতির জন্য লজ্জাজনক। এটি মানবাধিকারের লঙ্ঘন। বৃদ্ধবয়সে একাকী নিভৃতে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ ছিলেন তিনি। জীবনের শেষ সময়গুলো এ জাতি তাঁর শেষ উপদেশ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, বঞ্চিত হয়েছে তাঁর পরিবার, তরুণসমাজ এবং তাঁর ভক্তরা। ভাষাসৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযম একজন সফল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। বিশ্বের অসংখ্য দেশে তাঁর কেয়ারটেকার ফর্মুলা এখন সমাদৃত। তিনি একজন যোগ্য সংগঠক। তিনি নিজে অনেক উত্থান-পতনের সাক্ষী। তিনি ছিলেন মেধাবী চৌকস ও অভাবনীয় নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন। অধ্যাপক গোলাম আযমের ইন্তেকালের খবর প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। এসব খবরে তাঁকে জামায়াতে ইসলামীর আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে অভিহিত করা হয়। অধ্যাপক গোলাম আযমের জানাজায় উপস্থিতি ছিল ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’, সমসাময়িককালে জাতীয় নেতাদের মধ্যে জানাজায় এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের সমাগম হয়েছে। জানাজার আগে তাঁর চতুর্থ ছেলে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, ‘আমার পিতা সারাজীবন আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দিন প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করে গেছেন। এটাই ছিল তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আপনারা অধ্যাপক গোলাম আযমকে ভালোবাসেন না। আপনারা ভালোবাসেন দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য একনিষ্ঠভাবে নিবেদিত একজন কর্মী গোলাম আযমকে। তার বিদায় মানে ইসলামী আন্দোলনের বিদায় নয়। এ দেশে আরও লাখো লাখো গোলাম আযম তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ, যারা একদিন এ দেশের মাটিতে ইসলামের বিজয় পতাকা ওড়াবে, ইসলামকে বিজয়ী করবে।’ ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার অন্যায়ভাবে তার জন্মগত নাগরিকত্ব অধিকার হরণ করলেও পরবর্তীতে, ১৯৯৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের সর্বসম্মত রায়ে নাগরিক অধিকার ফিরে পান এবং তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। পরে নতুন করে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আবার সেই একই অভিযোগের অবতারণা করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ত্রিশ বছর জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে থেকে সর্বশেষ স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণকারী পদের ও ক্ষমতার প্রতি নির্লোভ একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ অধ্যাপক গোলাম আযম। উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক স্মরণীয় ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত এ প্রবীণ মজলুম জননেতা ও বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। জীবনের শেষ সময়েও এ সংগ্রামী নেতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আর অপপ্রচারের শিকার হয়েছেন। ষড়যন্ত্রকারীরা মিথ্যার কালো পর্দার আড়ালে তার স্বর্ণোজ্জ্বল অনেক অবদানকে ঢেকে রাখার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে নিরন্তরভাবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রফেসর গোলাম আযম সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিত্ব। ১১ জানুয়ারি ২০১২ কারাগারে যাওয়ার আগে জাতির উদ্দেশে দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, জামায়াত ও আওয়ামী লীগ যুগপৎ আন্দোলন করেছিল। সকল আন্দোলনকারী দলের লিয়াজোঁ কমিটি একত্রে বৈঠক করে কর্মসূচি ঠিক করতো। তখন তো কোনো দিন আওয়ামী লীগ জামায়াত নেতৃবৃন্দকে যুদ্ধাপরাধী মনে করেনি। ফেব্রুয়ারি ১৯৯১-এর নির্বাচনের পর সরকার গঠনের জন্য আওয়ামী লীগ জামায়াতের সহযোগিতা প্রার্থনা করে আমার নিকট ধরনা দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতা আমির হোসেন আমু সাহেব জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ সাহেবের মাধ্যমে আমাকে মন্ত্রী বানানোর প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। তখনও তো আওয়ামী লীগের মনে হয়নি যে, জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধী! পরবর্তীতে, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী জামায়াতের সমর্থন লাভের আবদার নিয়ে যখন আমার সাথে সাক্ষাৎ করেন, তখনও তো তাদের দৃষ্টিতে জামায়াত নেতৃবৃন্দ যুদ্ধাপরাধী ছিল না।’ অধ্যাপক গোলাম আযম কখনও এমপি, মন্ত্রী কিছুই হননি সুযোগ থাকার পরও। ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি, চাওয়া-পাওয়া বৃহত্তর স্বার্থে তার ত্যাগ এমন বহু বাস্তবতা এখন দৃশ্যের অন্তরালে। যিনি ক্ষমতায় না থেকেও ক্ষমতাসীন সকলের অপবাদের দায়ভার কাঁধে পড়েছে। যিনি দেশ, জাতি ও মানবতার কল্যাণে সবসময় ভূমিকা রেখেছেন কিন্তু তার বিনিময়ে সব সরকার থেকে উপহার পেয়েছেন কারাবরণ। বিশ্বজুড়ে তার অসম্ভব খ্যাতি, তাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কৌতূহলের শেষ নেই। তাঁর আত্মনির্মাণ এবং বিকাশের ক্ষেত্রে বেশকিছু চিন্তা হিসাব-নিকাশ ছিল সুদূরপ্রসারী। বিশেষ করে ভারতের আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদের ক্ষেত্রে অধ্যাপক গোলাম আযমের ৪২ বছর পূর্বের ভাবনা আজকের সবচেয়ে সত্য ও বাস্তবতা। অধ্যাপক আযম দেশে-বিদেশে সমাদৃত ও প্রশংসিত একটি নাম। ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যবইয়ে তাঁর ফর্মুলা অন্তর্ভুক্ত। ব্যক্তি গোলাম আযম নিজেকে এমনভাবে গঠন করেছেন, তাঁর ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব, কথাবার্তা, চলন, বলন প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন প্রিয় নবী রাসূলে করীম (সা)-এর একনিষ্ঠ অনুসারী। বাইরে এবং ভেতরে মিলিয়ে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন একটি প্রতিষ্ঠানরূপে। অধ্যয়ন, অধ্যবসায়, সময়জ্ঞান সবকিছুই মিলিয়ে তিনি ছিলেন সত্যিই ব্যতিক্রম। সুতরাং রাজনৈতিক চেতনায় সঙ্কীর্ণ শেখ হাসিনার পক্ষে এমন গোলাম আযমকে মানা খুবই অসম্ভব। তাঁর উদ্ভাবন, চিন্তা, আবিষ্কার তাঁকে টিকিয়ে রাখবে শতাব্দী থেকে শতাব্দী। ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর স্যারের সাথে দেখা করতে কাজি অফিসের তাঁর নিজ বাসভবনে হাজির হয়েছি। জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলেন, এ দায়িত্ব অনেক কঠিন। কারণ এ দায়িত্ব পালন একমাত্র নবী-রাসূল (সা)-এর পক্ষেই সম্ভব। দোয়া করি আল্লাহ যেন তোমাদেরকে এ দায়িত্ব পালন সহজ করে দেন। আরেকবার ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে আমরা স্যারের জন্য ভাষাসৈনিকের স্বীকৃতির ক্রেস্ট উপহার দিতে গেলে তিনি বললেন, তোমরা তো ভাষাসৈনিক বলছো, কিন্তু রাষ্ট্র তো এটা স্বীকার করে না। আমি আমার জীবনে কোনো কাজ কারো স্বীকৃতি বা উপহারের জন্য করিনি। আমার প্রতিটি কাজের প্রতিদান একমাত্র আল্লাহর কাছে কামনা করি। প্রিয় পাঠকবৃন্দ, সবমিলিয়ে আজ আমাদের মাঝে এমন এক গোলাম আযম উপস্থিত যার প্রজ্ঞা, লেখনী, চিন্তা, রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি, ক্ষমা; মহানুভবতা, নিয়মানুবর্তিতা, ধৈর্য এবং সহনশীলতার মতো যাবতীয় মহৎ গুণাবলির বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাঝে কালোত্তীর্ণ। নির্যাতিত-নিপীড়িত, নিষ্পেষিত জনতার অধিকার এবং মর্যাদাবোধ এক আবহ তৈরি করতে যার উদাহরণ নিকট অতীতে বিরল। একবিংশ শতাব্দীর উষালগ্নে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, ইসলাম, জাতিগত অধিকার এবং সচেতনতা, পারস্পরিক মর্যাদাবোধ নিয়ে বিশ্ব যখন চরম সঙ্কটের মোকাবেলা করছে, ঠিক তেমনি একটি মুহূর্তে নিজের কর্মমহানুভবতার মাধ্যমে তিনি স্বমহিমায় এখন এক প্রতীক রূপে-রূপায়িত তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। বাংলার বুকে লক্ষ কোটি মানুষ এখন ইসলামের পতাকাতলে সমবেত। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইল তার পদচারণায় মুখরিত হয়ে দ্বীন কায়েমের চেতনায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যারা জীবন দিতে জানে কিন্তু মাথা নত করে না এক আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে। তারা চিরদিন গোলাম আযমকে মনে রাখবে, চিরদিন ভালোবাসবে, সম্মান করতে থাকবে নিজের গরজে। তার সহজ-সাবলীল উপস্থাপনা, লেখনী, বক্তব্য মানুষকে ইসলামের পথে উজ্জীবিত করবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। অনাগত যুবকদের জন্য তিনি হবেন নতুন পথের দিশা এবং ঘটবে নব উত্থান। বিশেষ করে তরুণসমাজকে আকৃষ্ট করেছে তাঁর আদর্শ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের গোড়াপত্তন তিনিই করেছেন। তাঁর সন্তানের বক্তব্য ছিল, ‘এক গোলাম আযমের বিদায়ের মধ্যে এ দেশে হাজারো গোলাম আযমের জন্ম হয়েছে।’ সত্যিই তা-ই হবে ইনশাআল্লাহ। যাকে শ্রদ্ধা পেতে রাষ্ট্রের কোন আইনের প্রয়োজন পড়বে না। তিনি মানুষের হদয়ে থাকবেন শতাব্দীর পর শতাব্দী। অধ্যাপক গোলাম আযমের জানাজায় কারো অনুপস্থিতি আর শোকবাণী দেয়া না দেয়া কিছুই আসে যায় না তাঁর। অধ্যাপক গোলাম আযমের অর্জন করার আর কিছুই নেই। তিনি এই পৃথিবীর সঙ্কীর্ণ ধরা ছেড়ে মহান চিরন্তন জান্নাতের দিকে পাড়ি জমিয়েছেন। আমরা যারা শোকবাণী-শহীদ মিনার আর জানাজার মত মর্মস্পর্শী স্থানে উপস্থিতি নিয়ে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি করি, তা শুধু আমাদের জন্য নয়, বরং গোটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। অধ্যাপক আযমের সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সময় তার সহযোগিতা ও পরামর্শ নিয়েছে তার কাছে ধরনা দিতে বাধ্য হয়েছে। অধ্যাপক গোলাম আযমের আবিষ্কৃত কেয়ারটেকার সরকার আদায়ের আন্দোলনে বাংলাদেশে বড় দুই দলের প্রধান শেখ-হাসিনা আর বেগম খালেদা জিয়া রাজপথে আন্দোলন করেছেন বর্তমানেও করছেন। সুতরাং এ জাতির শত অনৈক্যের মাঝে অধ্যাপক গোলাম আযমের দেয়া ফর্মুলা কেয়ারটেকার ইস্যুতে জাতিকে একবার হলেও তিনি ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন। হে জাতীয় বীর, আপনাকে বিন¤্র সালাম ও অভিনন্দন। এ জাতি আপনার সাথে ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতে পারেনি, এ জন্য আমাদের ক্ষমা করবেন প্লিজ। ১১ জানুয়ারি ২০১২ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে যাওয়ার পূর্বে তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে প্রদত্ত একটি বক্তব্যের কয়েকটি লাইন দিয়ে লেখাটির ইতি টানছি। তিনি লিখেছেন-‘আমার দীর্ঘ ৫০ বছরের কর্মজীবনে সারাদেশে ব্যাপক সফর করেছি। জনগণের মধ্যেই বিচরণ করেছি। উন্নত নৈতিক চরিত্রে ভূষিত হওয়ার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। মানবতাবিরোধী যেসব অপরাধের অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে তোলা হচ্ছে তা কখনো জনগণ বিশ্বাস করবে না। আমাকে ফাঁসি দিলেও জনগণ আমাকে আল্লাহর সৈনিক হিসেবেই গণ্য করবে ইনশাআল্লাহ। পরিশেষে বলতে চাই যে, দেশের মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য আমি নিজের সারাজীবন উৎসর্গ করেছি। আত্মপ্রচার বা আত্মপ্রতিষ্ঠা কখনোই চাইনি। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আমিই একমাত্র কর্মক্ষম থাকা অবস্থায় দলীয় প্রধানের পদ থেকে অবসর নেয়ার মতো নজির সৃষ্টি করেছি। কোনো প্রতিদান বা স্বীকৃতি কারো কাছে কোনোদিন চাইনি; এখনো চাই না। আমার জন্য আমার আল্লাহই যথেষ্ট। তবে আফসোস, দেশ এবং জাতির জন্য যা চেয়েছি তা দেখে যেতে পারবো কি না। দোয়া করি, আল্লাহ এই দেশকে এবং দেশের মানুষকে হেফাজত করুন, দেশের স্বাধীনতা, অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করুন। আল্লাহ তাআলা দেশের মানুষকে দুনিয়ার কল্যাণ ও আখিরাতের মুক্তি দান করুন। আমিন। আপনাদের নিকট দোয়া চাই। আল্লাহ তাআলা যেন আমার নেক আমলগুলো মেহেরবানি করে কবুল করেন, যাবতীয় গুনাহখাতা মাফ করেন এবং আখিরাতে সাফল্য দান করেন।’ প্রতি বছর ঘুরে ফিরে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ আমাদের মাঝে আসবে কিন্তু নেই ভাষাসৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযমসহ এ আন্দোলনের অসংখ্য বীর সেনানী। তাদের আদর্শ, কর্ম এবং বর্ণাঢ্য জীবন তাদেরকে জাগরুক রাখবে আমাদের মাঝে সবসময়। টি. কোলরিজ বলেছেন, ‘জ্ঞান জীবনকে পূর্ণতা দান করে, সুখ জীবনকে দীর্ঘস্থায়ী করে, শুভকর্ম জীবনকে মৃত্যুহীন করে।’

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির