জাফর আহমাদ#
হযরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত। নবী সা: বলেন, যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের পার্থিব কষ্টসমূহের মধ্যে থেকে একটি কষ্ট দূর করে দেয়, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার একটি বড় কষ্ট দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোন অভাবীর অভাবের কষ্ট লাঘব করে দেয়, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার অভাবের কষ্ট লাঘব করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ গোপন রাখে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। বান্দা যতক্ষণ তার অপর মুসলিম ভাইয়ের সাহায্য করতে থাকে, আল্লাহও ততক্ষণ তার সাহায্য-সহায়তা করতে থাকেন। (মুসলিম শরীফ : ২৪৫ সংক্ষেপিত) মুসলিম শরীফের উল্লেখিত হাদিসটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের এমন কতগুলো কাজের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যা জীবন চলার পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি এখানে মাত্র ৪টি কাজ উল্লেখ করলাম। ১. কষ্ট দূর করে দেয়া ২. অভাব লাঘব করা ৩. দোষ গোপন করা ৪. সাহায্য করা। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ মানুষ এককভাবে বেঁচে থাকা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। তাই সমাজের প্রতিটি সদস্যই পরনির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার গুরুত্বকে বিবেচনায় এনে রাসূল সা: একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে উল্লেখিত বিষয়গুলো আলোকপাত করেছেন। আপনি গভীরভাবে চিন্তা করুন, হাদিসে উল্লেখিত চারটি মৌলিক বিষয় যদি কোন সমাজের সদস্যরা দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করতো, তাহলে সেখানকার সামাজিক পরিবেশ কী হতো? এই হাদিসটির ওপর আমল করা হলে, আমাদের সমাজের যত হানাহানি, মারামারি, অভাব-অনটন ও সামাজিক অস্থিরতা বহুলাংশে কমে যেত। শান্তি সুখের সমাজ গড়ে উঠতো। সমাজটি হয়ে উঠতো ফুলে ফলে সুশোভিত। কিন্তু দুঃখের সাথে উল্লেখ করতে হয়, এর একটিও আমাদের সমাজে পরিলক্ষিত হয় না। বরং এর বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়। একটু ক্ষমতার অধিকারী হলে নিজেকে অপ্রতিরোধ্য সমাজের অধিপতি মনে করে। তার দাপট ও প্রতাপে আশপাশ প্রতিবেশীরা থাকে আতঙ্কগ্রস্ত। মানুষের কষ্ট দূর করার পরিবর্তে একে পুঁজি করে নিজের উপার্জনের পথকে সুগম করে। কোন কোন ব্যক্তি মানুষের কষ্টে খুশি হতেও দেখা যায়। কেহ এমনটি রয়েছেন যে, তার অধীনস্থদের ইচ্ছা করে কষ্ট দেন। কোন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের বিশেষ কোন দায়িত্ব পাওয়ার পর তার মানবিক মূল্যবোধের হঠাৎ পরিবর্তন ঘটে। তার এতদিনকার ছড়ানো হাতটি মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়, বিনম্র মুখাবয়বটি শক্ত রূপ ধারণ করে। সে একটি মুহূর্তও চিন্তা করে না যে, তার ওপরে মহাশক্তিধর একজন আছেন, যিনি তাকে এখানে বসিয়েছেন। যে কোন সময় তারও মুষ্টিবদ্ধ হাত আছড়ে পড়তে পারে। হযরত আবু মাসউদ রা: বলেন, আমি একজন ভৃত্যকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছিলাম। এ সময় আমার পশ্চাতে একটা শব্দ শুনলাম : ‘জেনে রেখ, হে আবু মাসউদ! আল্লাহ তা’আলাই তোমাকে এ ভৃত্যের ওপর কর্তৃত্ব দিয়েছেন।’ আমি বললাম : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আর কখনো দাস-দাসী ও চাকর চাকরাণীকে প্রহার করবো না। আমি ওকে স্বাধীন করে দিলাম। রাসূলে করিম সা: বললেন, “এ কাজটি না করলে আগুন তোমাকে কিয়ামতের দিন ভস্মীভূত করে দিত।” (সহীহ মুসলিম) মানবতার মহান বন্ধু রাসূল সা: মানবতার মুক্তির জন্যই কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন অসহায়, দুর্বল ও নির্যাতিতদের বিশ্বস্ত অভিভাবক, অধীনন্থদের প্রতি দয়াদিল ও প্রতিবেশীদের প্রিয় বন্ধু অতি নিকট আপনজন। সুখে-দুঃখে তিনি তাদের পাশে থাকতেন। এদের দুঃখ-বেদনায় তিনি এতটাই ব্যথিত হয়েছিলেন যে, জীবন সায়াহ্নে এসেও এদের কথা বলে বলে পৃথিবীর মানবতাকে সাবধান করে গেছেন। ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্তে তিনি বলে গেছেন: “নামাজ ও অধীনস্থদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো।” (আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ) পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে যে ভাষণ যুগ যুগ ধরে মানবতাকে আলোর পথ দেখায়, যে ভাষণটি ইসলামের পূর্ণ দীপ্তি ও ঔজ্জ্বল্যের প্রকাশ ঘটেছে, সেই ঐতিহাসিক বিদায় হজ্জের ভাষণেও অধীনস্থ ও দুর্বলদের কথা তিনি উল্লেখ করে গেছেন : “অধীনস্থদের সাথে সদ্ব্যবহার সৌভাগ্যের উৎস আর তাদের সাথে দুর্ব্যবহার দুর্ভাগ্যের উৎস।” (আবু দাউদ) মানুষের ক্ষতি করা, মানুষকে কষ্ট দেয়া খুবই সহজ কাজ। তাই বলে মানুষের একটি কষ্ট দূর করা বা তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করা যে খুবই কঠিন তা কিন্তু নয়। প্রয়োজন শুধু একটু সদিচ্ছা আর আল্লাহকে ভয় করা ও রাসূল সা:-এর প্রতি ভালোবাসা। মানুষের একটি কষ্ট দূর করা আপনার জন্য পানি-ভাতের মতোই মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তবে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এখানে কঠিন বলতেও কিছু বিষয় আছে। তা হলো, আপনার বদ অভ্যাস বা বদ মানসিকতা। যা দীর্ঘদিন ধরে আপনার ভেতর বাসা বেঁধে আছে এবং ইতোমধ্যে যা আপনার চরিত্র, আপনার আচার-আচরণ, আপনার ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পেশাগত জীবনের বিশাল অংশ দখল করে নিয়েছে। আর সেই বদ-অভ্যাস বা বদমানসিকতা হলো, আপনি পরশ্রীকাতরতার মারাত্মক রোগে আক্রান্ত, অন্যের কষ্টে আপনার ভেতরটা সব সময় পুলকিত হয়, অন্যের বিপদে মনে আনন্দ অনুভূতির সৃষ্টি হয়, অন্যের উন্নতি আপনার মনোকষ্টের কারণ হয়। আর্তমানবতার ব্যাপারে আপনি এতটাই উদাসীন যে, আপনি তাদের জন্য কোন কিছু করতে না পারলেও, আপনার মনটা তাদের দুর্দশা দেখে কেঁদে ওঠা উচিত ছিল, কিন্তু সেখানেও আপনার মন-মানসিকতা এতটাই রোগাগ্রস্ত যে, আপনার কোন ভাবাবেগ ও অনুভূতিও সৃষ্টি হয় না। এগুলো সারানো আপতত আপনার জন্য একটু কঠিসই হবে। তবে পূর্বেই বলা হয়েছে, ঈমানদারগণ একটু চেষ্টা করলে খুব একটা কঠিন হবে না। যারা জেনে-বুঝে মানুষকে কষ্ট দেয়, তাদের ঈমান নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ ধরনের চরিত্র ও ঈমান পাশাপাশি একসাথে চলতে পারে না। মানুষের ক্ষতি করা বা তাদেরকে কষ্ট দেয়া কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। এমনকি আল্লাহর রাসূল সা: এ ধরনের লোককে মুসলিম বলতেও নারাজ। তিনি বলেছেন, “সেই ব্যক্তি মুসলিম যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকেন।” সুতরাং কোন মুসলিম অন্য কোন মুসলিমকে কষ্ট দিতে পারেন না। যদি কষ্ট দেন তবে তিনি অমুসলিম হিসাবে চিহ্নিত হবেন। আর এটি জুলুমও বটে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: জুলুম সম্পর্কে কঠিন কঠিন বাক্য প্রয়োগ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “জুলুমবাজরা তাদের অত্যাচারের পরিণতি অচিরেই জানতে পারবে।” (সূরা শুরা ঃ ২২৭) কথিত আছে, ‘ক্ষমতা হারানোর পর রাজা খালেদ বিন বারমাক ও তার ছেলে কারাবন্দী হলে তার ছেলে বললো : আব্বা, এত সম্মান ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকার পর এখন আমরা কারাগারে? খালেদ বললেন : হ্যাঁ, বাবা! প্রজাদের ওপর জুলুম চালিয়ে আমরা যে রজনীতে তৃপ্তির সাথে নিদ্রা গিয়েছিলাম, আল্লাহ তখন জাগ্রত ছিলেন এবং মজলুমদের দোয়া কবুল করেছিলেন। জনৈক আরব কবি বলেছেন, ‘ক্ষমতা থাকলেই জুলুম করো না, জুলুমের পরিণাম অনুশোচনা ছাড়া আর কিছু নয়। জুলুম করার পর তুমি তো সুখে নিদ্রা যাও, কিন্তু মজলুমের চোখে ঘুম আসে না। সে সারা রাত তোমার জন্য বদ দোয়া করে, এবং আল্লাহ তা শোনেন। কেননা তিনিও ঘুমান না।” রাসূল সা: বলেন, “আল্লাহ তা’আলা জালিমকে দীর্ঘ সময় দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না। তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন: তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি জুলুমরত জনপদ সমূহকে পাকড়াও করেন। তাঁর পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপ্রতিরোধ্য।” (বুখারী, মুসলিম ও তিরমিযি) সুতরাং আসুন, আমরা আমাদের ভাইয়ের একটি করে কষ্ট লাঘব করি এবং কাল কিয়ামতের দিনে আল্লাহ আমার একটি বড় কষ্ট দূর করবেন। লেখক : প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার
আপনার মন্তব্য লিখুন