অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার
“আজ যদি শহীদ হতে হয় আমিই হব। আপনারা আসুন আমার সাথে।” আল্লাহরই জন্য জীবন বিলাবার এ ডাক ছিল সেদিন মুন্সী আব্দুল হালিমের। প্রখর রৌদ্রতপ্ত ২০ সেপ্টেম্বরের দুপুর। বি.এল কলেজে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের ছাত্রনামধারী সন্ত্রাসীদের লোমহর্ষক, রক্তক্ষয়ী হামলা চলছে- নামাজ ও খাবারের জন্য ব্যস্ত শিবিরকর্মীদের ওপর মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত খুনিরা রক্তের নেশায় মত্ত। চতুর্মুখী গুলিবর্ষণ। ধারালো অস্ত্রের নির্মম আক্রমণ। আকস্মিক আক্রমণে ক্যাম্পাসে সকলেই হতবিহ্বল। উপস্থিত স্বল্পসংখ্যক সাথীদের নিয়ে প্রচণ্ড ঈমানী প্রত্যয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুন্সী আব্দুল হালিম খুনিদের রুখতে। দিনভর আক্রমণকারী ছাত্রনামধারী সন্ত্রাসীদের হামলা মোকাবেলা ও ক্ষুধায় ক্লান্ত তাঁর দেহ। শাহাদাতের তামান্নায় যেন তেজোদ্দীপ্ত হয়ে উঠল সে। দীর্ঘ মোকাবিলা, প্রাণান্তকর লড়াই, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিন্দাদিল শিবিরকর্মীরা। সত্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে। গুলিবিদ্ধ হচ্ছে। আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত হচ্ছে। রক্তমাখা দেহ নিয়ে এগিয়ে চলছে সম্মুখ পানে, ছাত্রনামধারী সশস্ত্র ক্যাডাররা পরাস্ত ও ভীত হয়ে পিছু হটছে কয়েকবার। ক্যাম্পাস ছাড়ছে। কিন্তু বাহির থেকে আসছে নতুন করে ভাড়াটিয়া খুনি, আর অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের সাপ্লাই। হায়েনারা খুনের নেশায় নবোদ্যমে মেতে উঠেছে। আগ্নেয়াস্ত্রের মোকাবিলায় খালি হাত, ঈমানী শক্তির একক অসম যুদ্ধ। ময়দানে তখন শিবিরনেতা আব্দুল হালিম, আব্দুর রহিম, মাহফুজ, রহমত আলী, মাকসুদুর রহমান মিলন ও হাফিজসহ কয়েকজন। মোকাবিলা হচ্ছে ক্যাম্পাসে বিক্ষিপ্তভাবে। গুলিবিদ্ধ মিলন ভাইকে নিরাপদে রাখার জন্য সাথীরা তাকে নিয়ে চললেন মসজিদে। কিছুক্ষণ পরে হালিম ভাই এসে হাজির হলেন মসজিদে। অমনি রক্ত পিপাসুরা ধেয়ে এল। মসজিদ ঘিরে সশস্ত্র ক্যাডাররা শুরু করল প্রচণ্ড গুলি ও বোমাবর্ষণ। দরজা ভেঙে মসজিদে প্রবেশ করল। এক পর্যায়ে মসজিদের বাইরে ধারালো অস্ত্রের নির্মম আঘাতে আঘাতে, কুপিয়ে কুপিয়ে ওরা ছিন্ন ভিন্ন করল আব্দুল হালিমের দেহ। কাছ থেকে গুলি করে ঝাঁঝরা করল হাফিজের দেহ। লুটিয়ে পড়ল সে, রক্তাক্ত দাগ মসজিদে। রক্তে লাল হয়ে উঠল আল্লাহর ঘর মসজিদ। শেখ রহমত আলীকে তিতুমীর হলের ভেতর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে তার অবশ নিথর রক্তাক্ত দেহ টেনে হেঁচড়ে নিয়ে এল হল থেকে মাঠের দিকে। হলের সিঁড়ি রাস্তা আর সবুজ মাঠ রহমতের ছোপ ছোপ রক্তে রঞ্চিত হয়ে গেল। হালিম ভাইয়ের নিথর দেহ টেনে হেঁচড়ে মসজিদ থেকে বাইরে নিকটস্থ পুকরে ছুড়ে দিল খুনিরা। সেখান থেকে টেনে তুলে অসাড় রক্ত লাল দেহখানি পুকুরের ঘাটের উপর তুলল। গলায় ছুরি চালালো ওরা আব্দুল হালিমের বুক আর মাথা চেপে ধরে। পেশাদার কাসইকেও হার মানালো তাদের এই হত্যাকাণ্ড। সংঘর্ষের দিন দুপুরে খবর পেয়েই আমি ছুটলাম। দেখি গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহ নিয়ে শিবির কর্মীরা আসছেন শ্রমিক কল্যাণ অফিসে। খবর এল খুলনা আলিয়া মাদ্রাসার এতিম আমানকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বি.এল কলেজের ভয়াবহ সংঘর্ষের খবর জানলাম। গুরুতর অবস্থা কয়েকজনের খবর পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে ছুটে এলেন খুলনা মহানগরী জামায়াতের আমীর আব্দুল মতিন ভাই। এলেন শিবির সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ। একে একে এলেন অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। আহাতদের কাউকে কাউকে শ্রমিক কল্যাণ অফিসে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। কাউকে পাঠানো হলো খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কলেজ থেকে সরাসরি অনেক আহতদের পুলিশের গাড়ি ও বিভিন্ন যানবাহনে নেয়া হলো হাসপাতালে। ইমার্জেন্সি থেকে অপারেশন থিয়েটার। যেন লাল রক্তের ¯্রােত বইছে। আহতদের আহাজারি, সাথীদের বুকফাটা কান্না মর্মস্পর্শী সে দৃশ্য। নিথর হালিম, রহমত, হাফিজকে যখন হাসপাতালে আনা হলো তখন লোক মুখে ছড়িয়ে পড়ল বোধ হয় হালিম ভাই নেই, রহমত ভাই নেই। চতুর্দিকে বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়া সংবাদে পাগলের মতো ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা একদিকে হাসপাতাল অন্যদিকে শ্রমিক কল্যাণ অফিসে জড়ো হতে লাগলেন। হু হু করে কাঁদছে শিবির কর্মীরা। হালিম ভাই কোথায়? কী অবস্থা তার ? বহু কষ্ট করেও হালিমের সাথীদের ধৈর্য ধরাতে পারছিলাম না। উপুড় হতে চিৎ হয়ে শ্রমিক কল্যাণ চত্বরে আর্তচিৎকার করছিলেন। আব্দুল হালিমের খবরের জন্য বারবার হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে টেলিফোন করছি। একবার দৌলতপুর কলেজের জি.এস. কামরুল ভাই ইমার্জেন্সি থেকে জানালেন “অবস্থা বেশি ভাল না। তবে ডাক্তাররা চেষ্টা করছেন আপ্রাণ। কিছুক্ষণ পর আবার খবর পেলাম-“হালিম ভাই শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছেন।” শাহাদাতের চির সবুজ লালিত চেতনা ছিল হালিমের। সে তার নিজের ডায়েরিতে এ আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছিল “আমি যেন শহীদ আবদুল মালেক, সাব্বির, হামিদ ও অসংখ্য শহীদের মিছিলের সাথী হতে পারি। আমিও আসছি শহীদদের মিছিলে” মা’বুদের প্রিয়তম সে হালিম চলে গেলেন তারই জীবনের মালিক আরশে আজিমের মালিক, দয়াময় সে মা’বুদের কাছে। শাহাদাতের অমিয় সুধাপানে ধন্য হলো সে। হলো অতৃপ্ত আত্মার মহাতৃপ্তি। নীরব বিস্ময়ে দেখল দুনিয়া এ যুগের কারবালার এক হোসাইনকে। ফিরিশতার দেখল নির্মল এক পড়ন্ত বিকেলে আল্লাহর সাথে তাঁর এক বান্দাহর অকৃত্রিম মহাপ্রেম। হালিম ভাইকে হারানোর শোক যেন প্রচণ্ড বেদনা হয়ে বিদ্ধ হল বুকে পাথর হলাম কী বলব এখন ক্রন্দনরত শত শত শিবির কর্মীদের? কী বলে সান্ত¦না দেবো ওদের? শ্রমিক কল্যাণের সামনে অপেক্ষমাণ শত শত কর্মীকে সান্ত¦না দেবার বুঝাবার চেষ্টা করলাম মহানগরী আমীরসহ সকলে। এহেন শোকাহত পরিবেশ এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড। তবুও খুনিরা ক্ষান্ত না হয়ে হাসপাতালের পথে পথে আহত ও সাধারণ শিবির কর্মীদের ওপর উপর্যুপরি হামলা ও আক্রমণ চালাতে লাগলো। মহানগরী আমীর অধ্যাপক আব্দুল মতিন ভাইয়ের ত্বরিত ও পরিকল্পিত নির্দেশে শহীদের লাশের পোস্টমর্টেম, মামলা, আহতদের সেবা, প্রশাসনিক যোগাযোগ, জনক্তির মোটিভেশন, জানাজা দাফন ইত্যাদি কাজে দায়িত্বশীলরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। খুলনা সদর হাসপাতাল থেকে পোস্টমর্টেমের জন্য শহীদের লাশের সাথে আমিও মর্গে গেলাম। সেখান থেকেই পুলিশের সন্দেহজনক আচরণ ও চরম বৈরিতায় আমরা বুঝতে পারলাম ক্ষমতাসীন দলের ষড়যন্ত্র। লাশ আমাদের দেয়া হবে না। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সব প্রচেষ্টা চালিয়েও লাশ তো পাওয়া গেলই না বরং গভীর রাতে শহীদ আব্দুল হালিমের লাশের কাছ থেকে প্রায় ৪০ জন শিবির কর্মীকে গ্রেফতার করা হলো। শহীদ আমানের লাশ গোপনে পাঠিয়ে দেওয়া হলো সাতক্ষীরায় তার গ্রামের বাড়িতে। সেখানেও পরে নেতৃবৃন্দ রওনা হলেন এবং দাফনে অংশ নিলেন। আমাদের দাবি ছিল শহীদ মুন্সী আব্দুল হালিমের প্রাণের বিদ্যাপিঠ বি.এল কলেজে তার জানাজা ও দাফন হবে। কিন্তু প্রশাসন তাও দিল না। সকালে পুলিশের দায়িত্বে লাশ শহীদের বাড়ি ফুলতলার মশিয়ালী গ্রামে রওনা হলো আমাকে দ্রুত লাশের সাথে শহীদের বাড়িতে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হল। মোটরসাইকেলে ছুটলাম। পথের দু’পাশের গাছপালা, মানুষ, সব যেন শোকাহত আমি যেন এ নির্জন, বেদনাহত মৃতপুরীর মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছি। খালিশপুর থেকে পথের বাজার। পথটুকু কিভাবে সেদিন গিয়েছিলাম, আজও তা ভাবতে বুকের মধ্যে শূন্যতা বোধ করি। খুলনা-যশোর মহাসড়কের পূর্বপার্শ্বে আর শান্ত প্রবহমান ভৈরব নদীর পশ্চিম তীরে প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত শহীদের বাড়ি। যখন পৌঁছলাম, দেখি বাঁধভাঙা জোয়ারের মত শহীদের শোকাহত সাথীরা আসছে দূর-দূরান্ত থেকে। শহীদ আব্দুল হালিমের সম্মানিত পিতা মুন্সী মোহাম্মদকে বুকে জড়িয়ে প্রাণভরে সান্ত¦না দিলাম। পিতাকে ধৈর্যের আবেদন জানালাম কিন্তু পিতা পাথর। শহীদের ভাই আব্দুল হাই, আব্দুল হামিদ, হাকিম ও হাসিবসহ অন্যান্য ভাই-বোন ও মাকে কী বুঝাবো? নিজেকেই তো নিজে সামাল দিতে পারছি না। যা সে অন্তরের আবেগ তাই বললাম তাঁদের। কিন্তু তাতে তাঁদের আহাজারি থামাতে পারলাম না। দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশ “তাড়াতাড়ি দাফন সম্পন্ন করতে হবে”। আমি প্রতিবাদ করলাম। বললাম শহীদের অনেক সাথী আসবে দূর-দূরান্ত থেকে। দেখবে শেষবারের মতো শহীদকে। তাই সময়মত আমরা দাফন করব। শহীদি কাফেলার কেন্দ্রীয় সহসভাপতি শহীদের প্রিয় কামরুল আলম ভাই, আর এক কাছের নেতা কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক গোলাম কুদ্দুস ভাই এসেছেন ঢাকা থেকে। মহানগরী জামায়াতের সেক্রেটারি আহাদ ভাই, শিবির সেক্রেটারি মন্টু ভাই সাংবাদিক বেলাল ভাই, সিরাজ ভাই, মিজান ভাইসহ আমরা কয়েকজন পরামর্শ করলাম বিভিন্ন করণীয় বিষয়ে। মারাত্মক আহত শেখ রহমত আলীকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা হলো সকালেই। বৃহত্তর খুলনা ও যশোরের দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার ঢল নামলো শহীদের বাড়িতে। সুঠামদেহী তরুণ শহীদ মুন্সী আব্দুল হালিমের চেহারায় আল্লাহর নূর যেন চমকে উঠছে। মুখে পরিতৃপ্তির হাসি যেন মিশে আছে। সে দৃশ্য চোখ ভরে দেখে দেখে কাঁদছে শহীদের হাজারো সাথী। শহীদের পিতা আমাকে বললেন, “কবর কোথায় হবে আপনি জায়গাটা দেখিয়ে দিন।” আমি কয়েকজন ভাইকে নিয়ে রাস্তার পাশে কবরের জায়গাটা চিহ্নিত করলাম। বললাম “শহীদের কবর এ রাস্তার পাশে হোক। যুগে যুগে শহীদের অসংখ্য সাথীরা আসবে। রাস্তার পাশে হলে সহজেই কবর দেখতে পাবে।” সেখানেই কবরের জায়গা চূড়ান্ত হলো। এদিকে শহীদের গোসল সুসম্পন্ন হলো জেলা আমীর মাওলানা এ.কে.এম গাউসুল আযম হাদীর দায়িত্বে। জানাজার বিশাল জামায়াত অনুষ্ঠিত হলো শহীদের শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত দামোদর উচ্চবিদ্যালয় ময়দানে। শহীদের বাড়ির সন্নিকটেই এ বিশাল ময়দান। কর্দমাক্ত মাঠে হাজার হাজার শোকাহত মানুষের জামায়াতে ইমাম হলেন এতদঞ্চলের ইসলামী আন্দোলনের প্রবীণ ও ত্যাগী ব্যক্তিত্ব জনাব মাস্টার আব্দুর রাজ্জাক। শোকার্ত মানুষের উদ্দেশে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখলেন। বি.এল.কলেজের অধ্যক্ষ কাজী রফিকুল হকসহ শহীদের সম্মানিত শিক্ষকমণ্ডলীও এলেন জানাজায়। দাফন শেষে আল্লাহর দরবারে শহীদের জন্য তার সাথীদের জন্য কান্নাজড়িত কাতরকণ্ঠে মুনাজাত করলেন বি.এল কলেজের শিবিরের প্রথম সভাপতি ও উত্তর জেলার তৎকালীন আমীর মাওলানা এ. কে.এম গাউসুল আযম হাদী ভাই। পড়ন্ত বেলায় সূর্যের লাল আভা। এখন শহীদকে রেখে সকলের বিদায়ের পালা। কিন্তু শহীদ পরিবারের বুকফাটা কান্নায় কদম যেন থমকে যায় সকলের। এ নির্মমতা এ বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ, মিছিল নিষিদ্ধ হলো ক্ষমতাসীন দলের ষড়যন্ত্রে পুলিশের হুকুমে। শহরে শিবিরের জন্য যেন মহাবিপদ। দৌলতপুর ও খালিশপুরে বিডিআর নামানো হলো। হালিম ভাইয়ের শাহাদাতের ১২ দিন পর ২ অক্টোবর মারাত্মক আহত শেখ রহমত আলী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শাহাদাতের পেয়ালা পান করলেন। এ খবর খুলনায় ছড়িয়ে পড়তেই নগরবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে, মিছিলে মিছিলে খুলনা উত্তাল। পুলিশ কর্মকর্তারা ক্ষমতাসীন দলের মর্জিতে নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব ও হয়রানি শুরু করল। শিবির শহরের যেখানেই সভা ডাকে সেখানে সভাস্থলে ছাত্রদলের সভা, ১৪৪ ধারা। সরকারের এহেন জুলুমে বিক্ষুব্ধ হলো নগরবাসী। ঘৃণা ধিক্কার দিয়েছে খুনিদের। পুলিশ খুনিদের কাউকে গ্রেফতার করল না সুনির্দিষ্ট মামলা থাকা সত্ত্বেও। প্রতিবাদী মানুষের বিবেক জাগ্রত হলো প্রশাসনের বিরুদ্ধে। মুন্সী আব্দুল হালিম ভাইয়ের সাথে আমার শেষ কথা হয় শাহাদাতের ৬ দিন পূর্বে ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে খুলনা জামায়াত অফিসে। আমি এবং শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক হারুনুর রশীদ খান মংলার সাংগঠনিক প্রোগ্রাম সেরে কেবল খুলনা জামায়াত অফিসে এসেছি। কিছু পরেই খুব ব্যস্ত পেরেশান হয়ে হালিম ভাই আর কয়েকজন এলেন অফিসে। সালাম, মুসাফাহ, হারুন ভাইয়ের সাথে পরিচয়, কলেজের খবর ইত্যাদি। হালিম ভাই টেলিফোনে কলেজের খবর নিচ্ছিলেন- কলেজে নাকি বোমাবাজি হচ্ছে। অল্প সময়ে আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে হালিম ভাই হলে ফিরে গেলেন। বি.এল.কলেজের খুব কাছে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন অফিস। তাই হালিম ভাইসহ নেতারা প্রায়ই অফিসে আসতেন। খবর জানাতেন সহযোগিতা চাইতেন। যেন এক দেহ এক মনে একাকিত্ব বোধ হতো। এ যেন শিবিরের অফিস। ছোটখাটো সংঘর্ষে আহতরা ছুটে আসে। বিশ্রাম নেয় এখানে। হালিম ভাইদের গ্রাম একেবারে পাশাপাশি। তাতে দ্বীনি সম্পর্ক যেন গভীরতর অনুভব করতাম আমি। অল্প বয়সে এত দ্রুত সাংগঠনিক প্রজ্ঞা অর্জন, নির্ভীক ও গণমুখী নেতৃত্বের অনুপম গুণাবলিতে সে সমৃদ্ধ হয়েছিল যে, আমরা তাকে বিপুল সম্ভাবনাময় মনে করতাম। নীরবে, একাকী হালিম ভাইকে নিয়ে আমার গর্ব হতো। হৃদয়ে হালিমের ভাবনা আমাকে আবেগময় করে তুলত। বেশি প্রাণবন্ত ও আশান্বিত হয়ে উঠতাম তখন, যখন দেখতাম হালিমের বহুমুখী প্রতিভার বিচ্ছুরণ। নেতৃত্বের দারুণ জাদুকরী-মোহনীয় ক্ষমতা। হালিম ছিল আমাদের প্রায় দু’যুগের লালিত স্বপ্নের গোলাপ। পরম আকাক্সক্ষার ধন। হালিম ভাইয়ের মুখের কুরআন তিলাওয়াত আমাকে মোহিত করত। সব ঝুঁকি মোকাবেলায় হালিম থাকত সামনের সারিতে। নির্ভীকতা ও বলিষ্ঠতা তার সাথী। দায়ী ইলাল্লাহর ভূমিকায় সাধারণ ছাত্রদের কাছে প্রিয় হালিম ভাই। শাহাদাতের দিন শুরু থেকে হুঁশ থাকা পর্যন্ত লড়েছে সে নির্ভীকভাবে। প্রত্যক্ষদর্শীর সূত্রে এক সাংবাদিক বন্ধু আমাকে বলেছিলেন-“পরওয়ার ভাই হালিম ভাইয়ের বুক এবং মাথা চেপে ধরে গলায় যখন খুনিরা ছুরি চালাচ্ছিল তখন সে মোটেই ছটফট করেনি- বাঁচার চেষ্টা করেনি। বরং স্থির শান্ত হয়ে সে নিথর দেহে আকাশের দিকে চেয়েছিল।” খুলনার ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে আরেকটি বলিষ্ঠ কণ্ঠ শহীদ আবুল কাশেম পাঠান। হালিম ভাইয়ের শাহাদাতের এক বছর তিন মাস তিন দিন পর শহীদ আবুল কাশেম পাঠানও হালিম ভাইয়ের মতো আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। ১৯৯৪ ইংরেজি সালের ২৩শে অক্টোবর শহীদ আবুল কাশেম পাঠান খুলনার সিটি কলেজ গেটে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে গুলিবিদ্ধ হলে ঘটনাস্থলে শাহাদাতবরণ করেন। আবুল কাশেম পাঠান এ যুগের ক্ষণজন্মা ব্যক্তি। খান জাহানের দেশে কাশেম এক ইতিহাস। ২২শে অক্টোবর ১৯৯৪। দুপুরে খবর শুনলাম ২৩ অক্টোবর সিটি কলেজের “ছাত্রদল সিটি কলেজে আক্রমণ চালাতে পারে”। ২৩শে অক্টোবর ফজর বাদ আমি বি.এল.কলেজের দিকে গেলাম। পরামর্শ মোতাবেক পরিকল্পনার খোঁজ খবর নিতে। সকাল ১১টার দিকে পূর্ব নির্ধারিত প্রোগ্রাম থাকায় সাতক্ষীরা রওনা হলাম। বিকেলে সুন্দরবন টেক্সটাইল মিল গেটে শ্রমিক জনসভাস্থলে পৌঁছতেই পেছন থেকে ছুটে এসে জেলা শিবিরের সভাপতি আজিজুল ভাই বললেন খুলনা থেকে টেলিফোনে খবর দিয়েছে, সিটি কলেজে মারাত্মক সংঘর্ষ হয়েছে, আবুল কাশেম পাঠান ভাই গুলিতে শহীদ হয়েছেন। আপনাকে এখনই খুলনায় যেতে বলেছে। মুহূর্তেই আমি নির্বাক। আমি যেন পাথর। মাথা একটা চক্কর দিল। কাশেম পাঠানের হাসিমুখ ছবির মতো চোখে ভেসে উঠল। কী ভয়ঙ্কর রূপ এ মুহূর্তে খুলনার? কী করছে খুলনার ভাইয়েরা? শহীদ কাশেমের লাশ কোথায়? আর কে কে আহত? আজিজুল ভাইকে আর কিছু জিজ্ঞাসার ভাষা আমি হারিয়ে ফেলেছি। সঙ্গী-সাথীরা আমাকে ধরে জনসভার স্টেজে উঠালেন। পাঁজর ভাঙা বুক নিয়ে অশ্রুসিক্ত অরস্থায় জনতাকে কাশেম ভাইয়ের শাহাদাতের খবর দিলাম। হু-হু করে কেঁদে উঠল শ্রমিক জনতা। খুলনাভিমুখী দ্রুতগামী গাড়ি। যাত্রীদের মুখে মুখে খুলনার ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি জানার জামায়াত অফিসে ছুটলাম। ভিড় ঠেলে যখন ঢুকলাম জামায়াত অফিসে তখন রাত ৮টারও বেশি। তারপর পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক পর্যালোচনা। করণীয় স্থির, ভোরে সদর হাসপাতালের মর্গ থেকে শহীদের লাশ আনা। শহীদের লাশ নিয়ে স্মরণকালের বৃহৎ শোক মিছিল। ৩ বার জানাজা শেষে বসুপাড়া কবরস্থানে শহীদের লাশ দাফন করা হলো। এ হত্যা ছিলো গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ এবং সুপরিকল্পিত। খুলনায় ইসলামী আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় ভীতু ইসলামবিরোধী খুনিচক্র প্রায় এক যুগ ধরে এ অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। দেশের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ ও দক্ষিণ বঙ্গের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত সরকারি বি.এল.কলেজ। ১৯৭৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এখানে সাধারণ ছাত্র-জনতার কাছে শিবিরের জনপ্রিয়তা এবং বারবার ছাত্র সংসদে শিবিরের বিজয় দেখে ওরা ঈর্ষান্বিত-ক্রুদ্ধ। আদর্শ, যুক্তি ও নৈতিকতার কাছে পরাজিত হয়ে ওরা এ সন্ত্রাস ও হত্যার পথ বেছে নেয়। কাশেম পাঠানের জাদুকরী নেতৃত্বের শক্তির কারণে শিক্ষক-ছাত্রদের মাঝে তিনি ছিলেন অতি ¯েœহভাজন ও জনপ্রিয়। প্রশাসন, সাংবাদিক, পুলিশ, লেখক, কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আলেম, রিকশাওয়ালা, দিন-মজুর, অমুসলিম, এমনকি প্রতিবেশীদেরকেও যেন সে মোহাবিষ্ট করে ফেলেছিল চরিত্র আর আদর্শের মাধুর্য দিয়ে। ক্লাব পাঠাগার-সমিতি তৈরি করে যুবকদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত প্রসার, রিকশাওয়ালা-দিনমজুরদের সংগঠিত করে ইসলামী আন্দোলনের সাথী বানানো, সমাজের উঁচু ও বিত্তশালী মহলে দ্বীনের দায়ী হিসাবে কাজ করা তার চরিত্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল। সত্যের সৈনিক হজরত খানজাহানের পুণ্যভূমি এ মাটি ইসলামের লড়াকুদের দুর্জয় ঘাঁটি। মুন্সী আব্দুল হালিম, আবুল কাশেম পাঠানসহ অসংখ্য শহীদের প্রত্যয়দীপ্ত মুখ দেখছি মিছিলে মিছিলে। রক্তলাল এ মাটি বিপ্লবের ফসলের জন্য এখন অনেক উর্বর। লেখক : সাবেক এমপি ও সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
আপনার মন্তব্য লিখুন