
কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ স্রোতের বিরুদ্ধে স্রোত
মোশাররফ হোসেন খান
[caption id="attachment_1125" align="alignleft" width="300"]
কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ[/caption]
আমাদের সাহিত্যের এক সব্যসাচী লেখক। প্রবন্ধ, গবেষণা, সম্পাদনা এবং কথাসাহিত্যে তিনি অনন্য। আর কবিতাতে তিনি সর্বদা পরীক্ষাপ্রবণ। ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ থেকে ‘আমার সনেট’ পর্যন্ত তাঁর এ পরীক্ষাপ্রবণতার দুর্বার গতিস্রোত আমাদের বাংলা কবিতাকে আন্দোলিত এবং সমৃদ্ধ করেছে।
‘পরাবাস্তব’ কবিতা বিশ্বের অপরাপর দেশে লেখা হচ্ছে অনেকদিন যাবৎ। ‘পরাবাস্তব’ কবিতাও যে একটি বিশেষ আসন করে নিতে পারে কবিতায়-বাংলাদেশে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দই সেটা প্রথম প্রমাণ করেছেন। এ ধারার সফল কবিতা আমরা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি। এক্ষেত্রেও তিনি ব্যতিক্রমী প্রতিভা। আর তাঁর এই ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের জন্যে তিনি আমাদের কবিতার অনুষঙ্গে বারবার আলোচিত এবং উল্লেখিত হতে থাকবেন। ‘পরাবাস্তব’ কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য হলো-দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে গমনাগমন। অবচেতনের গহিনে প্রবেশ করে কবি সেখান থেকে তুলে আনেন এক অত্যাশ্চর্য মণিমুক্তা; মূলত যার সাথে পাঠক আদৌ পরিচিত থাকেন না। এমনকি সেসব বিষয় থাকে তাদের চেতনার বাইরে, বোধের অতীতে।
কবির থাকে গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং দূরদৃষ্টির এক প্রখর গতি। এই গতি কখনোবা পাঠকের থেকে লক্ষ মাইল দূরত্বে বহমান থাকে। সুতরাং কবি এবং পাঠকের মধ্যে যোজন দূরত্ব থাকা অনেক সময় স্বাভাবিক হয়ে যায়। আর দুর্বোধ্যতার অভিযোগটাও আসে এই প্রেক্ষাপট থেকে।
কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রসঙ্গেও দুর্বোধ্যতার অভিযোগটা ছিল তাই প্রাসঙ্গিক। কেনোনা তাঁর এসব নবধারার কবিতার বিষয়, ভাষা এবং সেসব কবিতার অন্তর্দৃষ্টির সাথে আমাদের পাঠকরা ছিলেন অপরিচিত এবং অপ্রস্তুত।
কিন্তু কবি সৈয়দ তারপরই পাঠকের সম্মুখে খুলে দিয়েছেন এমন এক আশ্চর্য দরোজা, যে দরোজার ভেতর প্রবেশকারী প্রত্যেকটি পাঠকই পেতে পারেন কবিতা পাঠের পরিপূর্ণ আরাম। সেই সাথে খুলে যেতে পারে শুদ্ধ চেতনার দ্বিতীয় দরোজা।
কবি সৈয়দের এই উন্মুক্ত দরোজার নাম-‘সকল প্রশংসা তাঁর’।
‘সকল প্রশংসা তাঁর’ [প্রকাশকাল : ফেব্র“য়ারি ১৯৯৩, প্রকাশনায় : শিল্পতরু প্রকাশনী ঢাকা] কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি তিনি লিখেছেন সেপ্টেম্বর ‘৯২ থেকে জানুয়ারী’ ৯৩ পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে। কবিতাগুলি গ্রন্থভুক্ত হবার পূর্বেই বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। আর প্রতিটি কবিতা প্রকাশের সাথে সাথেই পাঠক ও সুধীজনের দৃষ্টিগ্রাহ্য করতে সক্ষমও হয়েছে। কবিতাবিদ্বেষী এই সমাজে তাঁর এই গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা যে প্রকাশমাত্রই তুমুল আলোচিত এবং আলোড়িত হয়েছে, এতে করেই বোঝা যায় তাঁর এ-গ্রন্থের কবিতাগুলি কতোটা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।
কিন্তু কেন? তার কারণ-কবি সৈয়দ ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার শিরায়-উপশিরায় ধারণ করেছেন এমন এক বিশ্বাসের দ্যুতি-যার আবেদন এ ভূখণ্ডে, আমাদের সমাজে সর্বাধিক।
ইসলাম, নবী-রাসূলকে নিয়ে পৃথিবীতে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। ইসলামের সুমহান আদর্শ, নবীদের ত্যাগ, ঔদার্য এবং মানবতা, সাহাবীদের সৌর্যবীর্যগাঁথা জীবন নিয়ে মুসলমানরা তো বটেই, তাছাড়াও লিখেছেন বিশ্বের অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লেখক-কবি সাহিত্যিকরা। এমনকি পবিত্র কুরআন শরীফের অনুবাদও করেছেন। যেমন শ্রী গিরিশচন্দ্র।
আমাদের বাংলা কবিতায় এই ধারার বহু কবিতা রচিত হয়েছে। প্রাচীনকালের আলাওল, সৈয়দ হামজা প্রমুখ ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর। এরপর সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীসহ আছেন আরও অনেক। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামই কবিতায় অপ্রতিরোধ্য এই গতিধারার সঞ্চারক। এরপর আছেন ফররুখ আহমদের দুঃসাহসী অভিযাত্রার স্বাক্ষর। চল্লিশ এবং চল্লিশোত্তর দশকের আরও অসংখ্য কবি এ ধারায় কবিতা লিখেছেন। লিখেছেন বটেÑ কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে। সুতরাং নজরুল ইসলামের পরে কবি ফররুখ আহমদকেই আমরা আমূল ঐতিহ্যের আধুনিক কবি হিসাবে সনাক্ত করতে পারি।
কবি সৈয়দ এই ঐতিহ্যের সিঁড়ি বেয়ে এলেন। অর্থাৎ ফররুখ আহমদের পর আমরা আধুনিককালে তাঁকে পাচ্ছি যিনি তাঁর কবিতার [সকল প্রশংসা তাঁর] বিষয়বস্তুতে গ্রহণ করেছেন হাজার বছরের আমাদের বহমান ঐতিহ্যের ধারা।
কবি সৈয়দের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রাসঙ্গিকভাবে এসে যায় ষাটের দশকের কবিতার কথা।
ষাটের কবিরা কবিতার আঁটসাঁট দেহকে অবিন্যস্ত করেছেন। ছন্দহীনতায়, বিষয়ের অস্পষ্টতায়, আদর্শহীনতায়, শব্দ-উপমা ব্যবহারের স্বেচ্ছাচারিতায় কবিতাকে তাঁরা মাতাল তরঙ্গে নিয়ে খেলেছেন। কবিতা নিয়ে পরীক্ষা হয়েছে সত্য, আবার কবিতাকে মর্যাদাহীন করার পেছনেও তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই দোষে ষাটের সব কবিরাই যে দুষ্ট-তা অবশ্য বলছিনে। তবে অধিকাংশ। এবং তাদের সেই উন্মাতাল-লক্ষ্যহীন কাব্যধারায় পরবর্তী সত্তর দশকের কিছু কবিও অনেকটা ভেসে গেছেন।
কিন্তু প্রকৃত অর্থে এই মাতাল তরঙ্গ স্তিমিত হয়ে গেছে আশির কবিদের হাতে। তারা আবারও কবিতায় ফিরে গেছেন। কবিতাকে তাঁরা স্থিত করেছেন ছন্দে, বিষয়ে, আঙ্গিকে এবং বিশ্বাসে।
কবি সৈয়দ ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রমী হলেন তাঁর দশকের অন্যান্য কবিদের থেকে। আর দুঃসাহসী হলেনÑতাঁর বিশ্বাসাশ্রিত এই গ্রন্থের [সকল প্রশংসা তাঁর] জন্যে। আর যারা এখনও কাব্য বিশ্বাসের ক্ষেত্রে দোলাচলে ভুগছেন তাদের জন্যে এ গ্রন্থ উৎসাহ, সাহস এবং প্রেরণার উৎসভূমি হিসাবে বারবার কর্ষিত হবে। এ গ্রন্থ হতে পারে তাদের কবিতার জন্যে আর একটি নতুন দরোজা।
সবচেয়ে বড় কথা ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে কবি সৈয়দ অতিক্রম করে গেছেন তাঁর দশক, তাঁর সময়কাল এবং পরবর্তী অস্থির প্রহর। এ গ্রন্থ তাঁকে দিয়েছে একটি স্বতন্ত্র-বৈশিষ্ট্যের মর্যাদা।
‘সকল প্রশংসা তাঁর’ কাব্যগ্রন্থে স্থান পেয়েছে সর্বমোট বত্রিশটি কবিতা। এই কবিতাগুলোকে তিনটি পর্বে বিভক্ত করা যায়। যেমন:
১. প্রথম পর্ব : আল্লাহ এবং তাঁর প্রশংসা।
২. দ্বিতীয় পর্ব : আদম, নবী [সা] এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরাম।
৩. তৃতীয় পর্ব : ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং আত্মজিজ্ঞাসা।
প্রথম পর্বের অন্তর্ভুক্ত কবিতার মধ্যে আছে : ‘সকল প্রশংসা তাঁর’, ‘আল্লাহ’, ‘জ্যোতির উপরে জ্যোতি’ এবং ‘স্তরে স্তরে’। এই অংশের চারটি কবিতাতেই মহান রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা, তাঁর সৃষ্টির মহিমা এবং তাঁর শেষ করুণার কথা বিচিত্র বাকভঙ্গিমায় প্রকাশ পেয়েছে। ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ কবিতাটি এখানে তুলে ধরছি। উদ্ধৃত করছি তাঁর আত্মসমর্পণের প্রথম চমক হিসাবে :
‘সকল প্রশংসা তাঁর যিনি ঊর্ধাকাশের মালিক;
নক্ষত্রের চলাফেরা চলে যাঁর অঙ্গুলি হেলনে;
আমরা আশ্রিত তাঁর করুণায়: জীবনে, মরণে;
তাঁর আলো চন্দ্র-সূর্য-তারাদের আলোর অধিক।
তাঁরই মুক্তা প্রজ্জ্বলিত ঘন-নীল রাত্রির ভিতরে;
তাঁরই হীরা দীপ্যমান দিবসের পূর্ব ললাটে;
যুক্ত করে দেন তিনি তুচ্ছতাকে-অসীমে, বিরাটে;
সমস্ত সৌন্দর্য তাঁরই লোকোত্তর প্রতিভাস ধরে।
বিপর্যয় দিয়ে তুমি রহমত দিয়েছো তোমার,
দুঃখের দিনের বন্ধু, হে পরোয়ার দিগার!
কষ্টের নিকষে তুমি আমাকে করেছো তলোয়ার,
সম্রাটেরও হে সম্রাট, হে পরোয়ার দিগার!
স্বপ্নের ঘোড়ার পিঠে আমাকে করেছো সওয়ার,
হে রহমানুর রহিম! হে পরোয়ারদিগার!’
এ পর্বের ‘স্তরে স্তরে’ কবিতায় কবি সৈয়দের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের আর এক আশ্চর্যধ্বনিতে আমরা বিস্মিত হয়ে উঠি। যেখানে তিনি বলছেন:
‘শপথ দিনের আর পরিপূর্ণ সহাস্য চন্দ্রের,
আমিও জেনেছি এই জীবনের আতীব্র দহন,-
একই সঙ্গে দেখিনি কি গদ্যময় বাস্তবে ছন্দের
দোলাও চলেছে, যেন কুঁড়ে ঘরে দুপুর নিক্কণ?
হে রাজাধিরাজ! হে সর্বব্যপ্ত পবিত্র মহান!
মেলেছি পঞ্চাশে এসে: একান্ত তোমারই সব দান ॥’
[স্তরে-স্তরে ॥ শেষাংশ ॥ পৃ: ১২]
দ্বিতীয় পর্বে স্থান পেয়েছে সর্বমোট পনেরটি কবিতা। এর ভেতর রয়েছে হযরত আদম [আ]কে নিয়ে একটি কবিতা-‘আদম’, ‘দুই ফেরেশতা’, হজরযত মুহাম্মাদকে [সা] নিয়ে চারটি কবিতা- ‘হযরত মুহাম্মাদ [সা]: আবির্ভাব’, ‘হযরত মুহাম্মাদ [সা]: মিরাজ’, ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ এবং ‘হযরত মুহাম্মাদ [সা]: তিরোভাব’। এছাড়া সাহাবীদের ওপর রয়েছে নয়টি কবিতা। কবিতাগুলো হচ্ছে: ‘খুলাফায়ে রাশেদীন’, হজরত আবুবকর [রা]: দৃষ্টিতে-শ্রবণে হজরত উমর [রা] গোলাপে-ইস্পাতে, হজরত উসমান [রা]: অজপ্রস্রবণ, হজরত আলী [রা]: জ্ঞানের দরোজা, সাহাবীরা, বেলালের কণ্ঠ থেকে, খালিদ-বিন-ওয়ালিদ: আল্লাহর তলোয়ার ও আবুজর গিফারী [রা]: দ্রোহী, একা, স্পষ্টভাষী।
এপর্বের প্রতিটি কবিতাতেই রয়েছে কবি সৈয়দের অপরিসীম প্রেম, ভালোবাসা এবং অকৃত্রিম আন্তরিকতার ছোঁয়া। রাসূল [সা] ও সাহাবীদের আশ্চর্য জীবনচরিতে অবগাহন করতে গিয়ে কখনোবা তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়েছেন। আবার কখনোবা হয়েছেন মুগ্ধতায় আন্দোলিত। এধরনের দু’টি উদ্ধৃতি এখানে তুলে ধরছি :
‘আকাশের সূর্য কারো সাধ্য আছে ঢেকে রাখতে পারে?
চাঁদের আলো-কে কারো সাধ্য আছে রাখতে থামিয়ে?
তুমি ব্যাপ্ত হলে এই পৃথিবীর আলো-অন্ধকারে
সূর্য আর চাঁদের মতন। চোদ্দ শো বছর গিয়ে
জ্বলবে আরো শত-শতাব্দীতে দ্বিতীয় সূর্যের মতো;
দ্বিতীয় চাঁদের মতো প্রতি রাত্রে হবে বিকশিত।’
[রাহমাতুল্লিল আলামীন ॥ পৃ: ১৭]
‘তোমার পাহাড় থেকে নেমে-আসা ওরা চার নদী
ভিজিয়েছে আমাদের জমিনের হৃদয় অবধি।
তোমার আকাক্সক্ষা থেকে উড়ে-যাওয়া ওরা চার হাঁস
দখল করেছে চার দিগন্তের সমগ্র আকাশ।
তোমারই সূর্যের রশ্মি চারজন করেছে বিস্তার-
আবুবকর, উমর, উসমান, আলী হায়দার।’
[খুলাফায়ে রাশেদীন ॥ পৃ:১৯]
তৃতীয় পর্বের কবিতাগুলিতে কবি সৈয়দের ব্যক্তিগত-আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসন্ধান, অনুভূতি, আত্মদর্শন এবং আধ্যাত্মিকতার বিরল উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ‘উৎসর্গ’ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত [অদৃশ্যের মৌচাকের’ শিরোনামে অসম্ভব সুখপাঠ্য সুন্দর কবিতাটি ছাড়াও এপর্বের কবিতার মধ্যে আছে তেরটি কবিতা। এগুলি হচ্ছে : ‘সেইসব মানুষেরা’, ‘ঊষা’, ‘দিন’, ‘মধ্য দিন’, ‘তারকা-পুনর্মুদ্রিত রাত্রি’, ফেরেশতা ও মানুষ’, ‘গজল’, ‘স্কেচ’, ‘বেদনার ধাক্কা খেয়ে’, ‘কাল ছিল ডাল খালি’, ‘পাখি’, ‘সালামে-চুম্বনে’ এবং ‘রাস্তা’।
কবি সৈয়দের আধ্যাত্মিকতা, আত্মসন্ধান এবং আত্মজিজ্ঞাসা-এই পর্বের কবিতাগুলিতে বারবার ভাস্বর হয়ে উঠেছে। কখনোবা জীবন্ত জিজ্ঞাসায় দীপ্যমান। তাঁর ‘ঊষা’, ‘ম্যধদিন’, ‘তারকা-পুনর্মুদ্রিত রাত্রি’ এবং ‘ফেরেশতা ও মানুষ’ কবিতাগুলিতে এর ছায়া-চিহ্ন স্পষ্ট। এসব কবিতার মধ্যে সৈয়দের বিশ্বাসের দৃঢ়তা, অকৃত্রিম জীবনদর্শন এবং সুন্দর আত্মসমর্পণেরও একটা উজ্জ্বল স্বাক্ষর রয়েছে। ‘বেদনার ধাক্কা খেয়ে’, ‘কাল ছিল ডাল খালি’, ‘পাখি’ প্রভৃতি কবিতাগুলি এক অসাধারণ দৃষ্টিশক্তি, দৃঢ়চিত্তের পরিচয় বহনকারী কবিতা। তাঁর ‘পাখি’ কবিতার অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত করছি :
‘তাঁরই পাখি আমি, কুল মাখলুকাতের যিনি রব;
তাঁরই গান গেয়ে যাবো কতো রক্ত ঝরবে ঝরুক,
লিখবো তাঁরই স্বরলিপি, যে-অসীম, অদৃশ্য, অজানা;
তাঁরই মুক্তা ভরে রাখে মর্মতলে গহন ঝিনুক’
হোক-না আহত-অদম্য, অপ্রতিরোধ্য এই ডানা।
আবার গুঞ্জন করে লাল-নীল-সোনালি-নীরব।’
[পাখি ॥ পৃ: ৩৮]
কবি সৈয়দ কবিতায় যেমন পরীক্ষাপ্রবণ-তেমনি তিনি পরিভ্রমণশীল। তাঁর দূরগামী অভিযাত্রার স্পষ্ট অবয়ব ধারণ করে আছে ‘রাস্তা’ কবিতাটি। এই কবিতাটি প্রমাণ করে তিনি অভিযাত্রায় ব্যাপ্ত ছিলেন সর্বক্ষণ। প্রমাণ করে ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তিনি থেমে যাননি। থেমে যায়নি তাঁর এই অগ্রযাত্রা। বরং তিনি যে আরও বেশি অন্তঃসন্ধানী, আরও বেশি গতিসম্পন্ন পরিব্রাজক হয়ে উঠেছিলেনÑতারই স্পষ্ট স্বাক্ষর এই কবিতাটিতে দীপ্যমান। তিনি বলছেন:
‘পঞ্চাশ বছর ধ’রে ঘটালে কতো-না স্তরান্তর,
হে পরোয়ারদিগার! বৃত্তে তুমি সম্পূর্ণ ঘোরাবে,
মনে হয়। তা না হলে কীভাবে তোমার পুরো তাঁবে
নিয়ে যাবে আমার কবিতার তাবৎ অক্ষর,
কীভাবে জানিয়ে দেবে অভিজ্ঞান বসন্তে আমায়:
রাস্তা বন্ধ হয়না-নিয়ে যায় নতুন রাস্তায়।’
‘সকল প্রশংসা তাঁর’ কাব্যগ্রন্থখানি কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। পর্যায়ক্রমে সাজালে এভাবে উল্লেখ করা যায় :
১. সত্য উচ্চারণে অকৃত্রিম
পঞ্চাশ থেকে শুরু করে আজকের দশক পর্যন্ত-অনেক কবিই কবিতায় সত্য প্রকাশের ব্যাপারে কুণ্ঠিত। কিছুটা কৃত্রিমতা, কিছুটা দোদুল্যমানতা তাদের কবিতাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বিশ্বাসী কবিদের মধ্যে কেউ কেউ অকপটে তাদের বিশ্বাসকে কবিতায় সংস্থাপন করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছেন। কিছুটা আধুনিকতার ছদ্মাবরণে, কিছুটা প্রগতিশীলদের তুষ্টির জন্যে এবং কিছুটা সর্বজনগ্রাহ্যের হীন-দুর্বল মানসিকতার কারণে এটা ঘটেছে। কবি মান্নান সৈয়দের এই গ্রন্থখানি সেদিক থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তাঁর এই সরাসরি উচ্চারণ-প্রচলিত কাব্যধারার বিপরীত একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপও বটে।
২. ছন্দ
কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ একজন ছন্দকুশলী এবং ছন্দ বিশেষজ্ঞ হিসাবেও সমধিক পরিচিত। তিনি ছন্দের নানান কলা-কৌশল জানেন। তাই তিনি ছন্দ এবং ছন্দহীনতায় তাঁর কবিতায় সব সময় পরীক্ষাপ্রবণ। কবি সৈয়দের এই ছন্দ পরীক্ষার কলা-কৌশল তাঁর ইতিপূর্বের সমস্ত কাব্যগ্রন্থে সমুপস্থিত। এই কবিতাগুলির বিষয়-অবিনশ্বর বিশ্বাসের ধারায় পরিবেষ্টিত, সুতরাং সনেটের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব এই কবিতাগুলিকে দূরতিক্রমী করে তোলা। বিষয় এবং কবিতা তো বটেই, সনেট-ছন্দের কারণেও ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ কবিতাগ্রন্থখানি বিশিষ্ট, মূলবান এবং স্থায়িত্বের ব্যাপারে সন্দেহমুক্ত করে তোলে।
৩. উপমা-উৎপ্রেক্ষা
‘সকল প্রশংসা তাঁর’ কাব্যগ্রন্থে কবি সৈয়দ তাঁর মৌলিক দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। নতুন নতুন শব্দের পাশাপাশি রয়েছে তাঁর অসংখ্য চিত্তাকর্ষক উপমা। এখানে সেসব থেকে মাত্র দু’একটি লাইন তুলে ধরছি :
ক. রাত্রিগুলি হ’য়ে উঠছে সিন্ধুগামী জাহাজের মতোÑ
[সালামে-চুম্বনে ॥ পৃ:৩৯]
খ. ভরেছে হৃদয় আজ নীল-লাল-রূপালি-নীরব,
[কাল ছিলো ডাল খালি ॥ পৃ: ৩৭]
গ. গম্বুজ-গাছের মতো ঊর্ধ্ব হলো আমার পিপাসা
[স্কেচ ॥ পৃ: ৩৫]
ঘ. কোথায় ঝর্ণা ঝরছে পরীর মতন কলস্বরে।
[উৎসর্গের পৃষ্ঠায় মুদ্রিত কবিতা]
ঙ. অদৃশ্যের মৌচাকের আমরা সব পাগল মৌমাছি।
[ঐ]
৪. উদ্ধৃতি ব্যবহার
বাংলা কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থে ব্যাপকভাবে কোনো উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু কবি সৈয়দ-তাঁর এ গ্রন্থে কুরআন, হাদিসসহ বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে বিশেষ বিশেষ উদ্ধৃতি কবিতার সাথে সাযুজ্য রেখেই উদ্ধৃতি হিসাবে ব্যবহার করেছেন। ব্যবহার করেছেন অনেক মনীষীর মূল্যবান উদ্ধৃতি। এটাও আমাদের কাব্যধারায় একটি নতুন সংযোন।
৫. আধুনিকতা
‘সকল প্রশংসা তাঁর’ কাব্যগ্রন্থে কবি সৈয়দ একদিকে যেমন বিষয় নির্বাচনে পরিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন, অপর দিকে প্রত্যেকটি কবিতাকেই তিনি পরিপূর্ণ কবিতা রূপে গড়ে তুলেছেন। ছন্দে, উপমায়, শব্দে এবং বাক্য নির্মাণের কুশলী কারুকার্যে প্রতিটি কবিতাই একদিকে যেমন পরিপূর্ণ কবিতার আস্বাদ এনে দেয়, অপরদিকে তা আধুনিক কবিতার ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর। একজন আধুনিক শক্তিশালী কবির হাতে হাজার বছরের ঐতিহ্য-সুষমা কিভাবে আরও আধুনিক বাকভঙ্গিমায় প্রকাশ ঘটতে পারেÑতারই দৃষ্টান্ত বহন করে ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ কাব্যগ্রন্থটি।
সুতরাং একথা এখন আরও স্পষ্ট করে বলা যায়-কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ যেমন তাঁর পূর্বের সকল কাব্যগ্রন্থ থেকে নিজেকে একটি নতুন বাঁকে বহমান রেখেছেন, ঠিক তেমনি সংযোজিত হলো আধুনিক বাংলা কবিতায় আর একটি নতুন বাঁক।
‘সকল প্রশংসা তাঁর’ -মূলত চলমান কাব্যস্রোতের বিরুদ্ধে বাংলা কবিতায় দুর্বার গতিসম্পন্ন এক দুর্দান্ত বেগবান কাব্যস্রোত।
লেখক : কবি ও সম্পাদক, নতুন কলম ও নতুন কিশোরকণ্ঠ

আপনার মন্তব্য লিখুন