post

কবি আল মাহমুদ ঐশী আলোকপ্রভায় উদ্ভাসিত এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা । মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ্

০৯ জুলাই ২০১৯

আল মাহমুদ নিজেকে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ্র একজন সক্রিয় সদস্য মনে করতেন। মুসলমানদের সাফল্যে তিনি শিহরিত হতেন। আর ব্যর্থতায় অপমান বোধ করতেন। বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের দোসরদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার

কবি আল মাহমুদ ঐশী আলোকপ্রভায় উদ্ভাসিত এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা । মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ্কবি আল মাহমুদ বাংলার সাহিত্যাকাশে ঐশী আলোকপ্রভায় উদ্ভাসিত এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা। যিনি বাংলাদেশের গ্রামীণজীবন, সাধারণ মানুষের ভাষা, সুখ-দুঃখ, মহান স্রষ্টার প্রতি গভীর বিশ্বাস ও স্বদেশপ্রেমকে সার্থকভাবে তাঁর কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি আমাদের গর্ব ও গৌরবের প্রোজ্জ্বল প্রতীক, স্বপ্নের ফেরিওয়ালা, বিবেকের বাতিঘর। আগামী ১১ জুলাই তাঁর ৮৪তম জন্মদিন। সাহিত্যের বিচিত্র পথের পরিব্রাজক আল মাহমুদ। কবিতা লিখেছেন, ছড়া লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন, কলাম লিখেছেন এবং আরও কত কিছু লিখেছেন তিনি। সাহিত্যের বাইরে, নদী খনন করার জন্য যে ড্রেজার ব্যবহার করা হয় তার গেজ রিডার হিসেবে কাজ করেছেন, সাপ্তাহিক কাফেলায় সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন, দৈনিক ইত্তেফাকে প্রুফ রিডার ও মফস্বল সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন, চট্টগ্রামের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘বইঘর’-এ কাজ করেছেন প্রকাশনা অফিসার হিসেবে, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করছেন এবং কাজ করেছেন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগের স্টাফ অফিসার হিসেবে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে কাজ করেছেন দৈনিক গণকণ্ঠ ও দৈনিক কর্ণফুলীতে সম্পাদক হিসেবে, চাকরি করেছেন শিল্পকলা একাডেমিতে এবং সেখান থেকেই পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরকালে দৈনিক সংগ্রামে সহ-সম্পাদক এবং পাক্ষিক পালাবদলের সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। আল মাহমুদের কবিতার বিষয়-আশয় তাই, যা একজন ‘চাষীর বিষয়’। তিনি যখন প্রথম ঢাকা এসেছিলেন, সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন লাল রঙের একটি পুরনো ভাঙা সুটকেস। সেই সুটকেসে করে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিলেন ফুল, পাখি ও নদী ইত্যাদি। অর্থাৎ গ্রামবাংলাকেই সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। নারী, নিসর্গ, নদী এসব নিয়েই তো গ্রাম। এক অর্থে গোটা বাংলাদেশটাই তো একটা গ্রাম। কেননা এখানকার যে সমাজ, তা কৃষিভিত্তিক সমাজ। এখানকার কালচারের সাথে অ্যাগ্রিকালচারের সম্পর্ক নাড়ির মতো নিবিড়। আল মাহমুদ তাঁর নাড়ির স্পন্দনকে নিবেদন করলেন নতুনভাবে। সেটা না জসীমউদ্দীনীয়, না জীবনানন্দীয়- একান্তভাবে আল মাহমুদীয়। আধুনিকতা ও গ্রামের অনার্য শব্দকে অঙ্গীকার করে কবিতায় আনলেন এক আলাদা আমেজ ও আকর্ষণ। তিনি যখন কলম ধরেছিলেন, তখন তিরিশের ও চল্লিশের কবিদের দারুণ দাপট। রবীন্দ্রনাথের দিগন্ত বিস্তারকারী প্রতিভার প্রতাপ ও নজরুলের বিদ্রোহী উন্মাদনার উত্তাপ ইত্যাদিও ছিলো। এসব দাপটকে অগ্রাহ্য করা দুঃসাহসের কম নয়। আল মাহমুদ তাঁর কবিতায় সেই কাজটিই করেছেন সচেতন ও সতর্কভাবে। ফলে তাঁর দ্বারা সম্ভব হয়েছিল স্বতন্ত্র পথ রচনা ও স্বকীয়তাকে প্রতিষ্ঠা করা। সার কথা সৃষ্টির স্বকীয়তা বা স্বাতন্ত্র্যে ও সজীবতায় সমুজ্জ্বল তাঁর কবিতা। গদ্যেও সফল সুন্দর কবিতা লিখেছেন তিনি, কিন্তু গদ্য তাঁর গতিপথ নয়; ছন্দেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য, ছন্দেই তাঁর আনন্দ। তিনি ছন্দ শিখেছেন প্রকৃতির কাছ থেকে। ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ শীর্ষক এক রচনার একস্থানে তিনি লিখেছেন, ‘বৃষ্টির ফোঁটা গোলাপের বোঁটায় লাগলে গোলাপ তার কাঁটাকে অতিক্রম করে যেমন গোলাপি পাপড়ি মেলে দেয়, আমিও কাব্যরচনায় এই প্রাকৃতিক নিয়মকে অনুসরণ করার প্রয়াসী। আমি ছন্দ শিখেছি প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতি যেভাবে লতায়-পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা ধারণ করে প্রায় মূর্ছাহত অবস্থায় দোল খেতে থাকে, আমি সেই দোলা আপন অন্তরে ধারণ করে কবিতার ছন্দ-মিল-অনুপ্রাস সৃষ্টির কবিসুলভ কায়দা আয়ত্ত করেছি।’ (দৈনিক প্রথম আলো, ২৮ জুন ২০১৩)। সনেট হচ্ছে কবিতার সংহত রূপ। খনির কঠিন পাথর কেটে কেটে যেমন হীরক তৈরি বা সংগ্রহ করা হয়, সনেটও সৃষ্টি হয় সে রকম সংগ্রাম বা সাধনায়। সে জন্য সনেট রচনায় সবাই সাহস করেন না। যারা করেন, তাদের সংখ্যা সামান্য। সেই সামান্যদের সারিতে অসামান্য সৃষ্টির সওগাত দিয়ে সাহিত্যকে, বিশেষ করে আধুনিক বাংলা কবিতাকে কেউ যদি সমৃদ্ধ করে থাকেন, তিনি হলেন আল মাহমুদ। আর সে ক্ষেত্রে তাঁর সোনালি ফসল হচ্ছে ‘সোনালী কাবিন’-এর অমর সনেটগুচ্ছ। এর মধ্যে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে, প্রেম-পুরাণকে তিনি প্রবিষ্ট করেন প্রখর প্রতিভায়। সনেটের সংহতি ও সৌন্দর্যের সম্মিলনে স্বীয় ভাবনাকে যেভাবে তিনি ভাষা দিয়েছেন, আশার কথা শুনিয়েছেন, বাংলা কবিতায় তার দৃষ্টান্ত বিরল ও ব্যতিক্রম। ছড়ায়ও আল মাহমুদ ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন তাঁর প্রতিভার প্রভা। কবিতার তুলনায় তাঁর ছড়া কম, কিন্তু গুণে মানে অসাধারণ। তাঁর ছড়াকে ঠিক ছড়াও বলা যায় না। এর আঙ্গিকটা যদিও ছড়ার, কিন্তু অভ্যন্তরটা কবিতার। তাঁর ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ পড়লে প্রসঙ্গটা প্রত্যেকের কাছে পানির মতো পরিষ্কার হবে। আল মাহমুদ নিজেও ছড়া বলতে আলাদা কিছুকে ভাবেন না, ছড়াকেও তিনি মনে করেন কবিতা। একসময় ছিলো, ছড়াকে কবিতার কাতারে ফেলা হতো না। কিন্তু সে বিচার বর্তমানে বাতিল হয়ে গেছে। ছড়াও যে কবিতা- এ কথা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আল মাহমুদের ভাষায়- ছড়া সেও কাব্যকথা হৃদয় ভাঙা মিল, ঠিক দুপুরে উড়তে থাকা পাখ ছড়ানো চিল। এই মিলের মেলায়, মনের খেলায়ও আল মাহমুদ যেমন আধুনিক, তেমনি অনতিক্রম্য। ছড়াকে সবসময় হতে হয় মুখের ভাষার কাছাকাছি। মুখের ভাষার কাছাকাছি না হলে মনের কথা মিল পায় না, পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে না। সেদিক থেকে আল মাহমুদের ছড়া মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি। সে কারণে কৃত্রিমতার কলুষমুক্ত। ছন্দের মিল, মুখের ভাষার মিল এবং ভাবের মিল- এই তিন মিলে তাঁর ছড়া যেমন ধন্য, তেমনি অনন্য। কবিতার মতো তাঁর ছড়ায়ও গ্রাম, গ্রামের মানুষ, নারী, নদী, নিসর্গ প্রভৃতির প্রতাপ প্রত্যক্ষ করা যায়। এসব প্রত্যক্ষ করার জন্য ‘পাখির মতো’ হওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন তিনি। লিখেছেন- সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে কর্ণফুলীর কূলটায়। দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি ফেরেস্তারা উল্টায়। তখন কেবল ভাবতে থাকি কেমন করে উড়বো, কেমন করে শহর ছেড়ে সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো! ‘নোলক’, ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ’, ‘মনপবনের নাও’, ‘রাত দুপুরে’, ‘বোশেখ’, ‘তারিকের অভিলাষ’ প্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত ছড়া। কথাসাহিত্যেও আল মাহমুদ তাঁর প্রতিভার স্বকীয়তাকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন পরিষ্কারভাবে। তবে তাঁর কবিতা নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে, আলোচনা-সমালোচনা বা মূল্যায়ন হয়েছে, সে তুলনায় তাঁর কথাসাহিত্য নিয়ে হয়েছে কম। তাঁর গল্পের কথাই যদি ধরি, গল্পেও তিনি সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘জলবেশ্যা’, ‘কালোনৌকা’, ‘খনন’, ‘বুনো বৃষ্টির প্ররোচনা’, ‘গন্ধবণিক’ প্রভৃতি পাঠ করলে বোঝা যায় গল্পেও তিনি কতটা দক্ষ ও সৃষ্টিশীল। আল মাহমুদ যেহেতু একটি দেশে জন্মেছেন, সে জন্য তিনি বাংলাদেশের কবি ঠিকই, সাথে সাথে তিনি বিশ্বেরও কবি, বিশ্বাসেরও কবি। তাঁর মতো বড় কবি বিশ্বে বেশি নেই। বিস্ময়কর প্রতিভা তিনি; বিরল এবং ব্যতিক্রমও। পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবুল বাশার তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আল মাহমুদ উপমহাদেশের খুব বড় কবি। আমি বলছি, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষ- এই তিনটি জায়গায় যদি হিসাব করি, তাহলে কিন্তু এখন জীবিত কবিদের মধ্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। এত বড় কবি এই উপমহাদেশে নেই।’ (সাপ্তাহিক, ঈদসংখ্যা ২০১৫, ঢাকা) কেবল সাহিত্যচর্চা, সাংবাদিকতা বা সম্পাদক হিসেবে স্বীয় দায়িত্ব পালন করে ক্ষান্ত থাকেননি আল মাহমুদ, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে সমগ্র জাতিকে ঋণী করেছেন তিনি। আল মাহমুদকে বলা হয় ফেব্রুয়ারির ফেরারি পাখি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন আল মাহমুদ ছিলেন নবম শ্রেণির ছাত্র এবং তিনিও তাতে অংশগ্রহণ করেন। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ভাষা আন্দোলন কমিটির যে লিফলেট বের হয়, তাতে স্থান পায় কিশোর কবি আল মাহমুদের লেখা চার লাইনের একটি কবিতা। কবিতাটি লেখার দায়ে পুলিশ তাঁকে খুঁজতে থাকে এবং সে কারণে অনেকদিন তাঁকে আত্মগোপনে থাকতে হয়। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় বিখ্যাত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনটি প্রকাশিত হওয়ার পর ১৯৫৪ সালে কবি আজিজুল হাকিম ও কবি আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরীর সম্পাদনায় ‘একুশের কবিতা’ নামে দ্বিতীয় যে ঐতিহাসিক সংকলনটি বের হয়, তাতে স্থান পায় ‘যদি পারতাম’ শীর্ষক আল মাহমুদের একটি কবিতা। তাতে তাঁর বেদনাঘন মর্মস্পর্শী উচ্চারণ- ‘আহা, আমি যদি হাত বুলিয়ে দিতে পারতাম/ওদের রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্নগুলোতে/যদি পারতাম/ওদের শেষ আর্তনাদকে বন্দী করে রাখতে/কোনো অলৌকিক শব্দের প্রাকারে/তবে নিশ্চয়ই নিষ্ঠুর মৃত্যু চিৎকারে/শতাব্দীর পর শতাব্দীকে/অতন্দ্র প্রহরীর মতো সজাগ করে/রাখা যেতো।’ ১৯৭০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে সংস্কৃতি সংসদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ করে একুশের স্মরণে একটি সংকলন। একটি কবিতা ও একটি চিত্রকলা পাশাপাশি। এতে আল মাহমুদের কবিতাও প্রকাশ পায়। (দৈনিক প্রথম আলো, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৭)। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি থেকে ‘একুশের সংকলন’ নামে যে সাহসী সংকলনটি বের হয়, তাতেও স্থান পায় তাঁর কবিতা। (একুশের নির্বাচিত সংকলন, আহমদ আখতার, দৈনিক ইনকিলাব, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫) ঊনসত্তরের উত্তাল সময়ে স্বৈরাচারী পাক শাসকদের বিরুদ্ধে সারা দেশে যখন গণঅভ্যুত্থান আরম্ভ হয়, তখনও তিনি কলমসৈনিকের ভূমিকা পালন করেন অত্যন্ত সাহসের সাথে, লেখেন ‘ঊনসত্তরের ছড়া’- ১ ও ২। ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাতে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর প্রকাশিত অত্যন্ত শক্তিশালী পত্রিকা গণকণ্ঠের সম্পাদক ছিলেন কবি আল মাহমুদ। তৎকালীন স্বৈরশাসক পত্রিকাটি বন্ধ করে দিয়ে কবিকে জেলে পাঠায়। এই জেল জীবনই আল মাহমুদের জীবনাদর্শ বদলে দেয়। ভুল ভেঙে দেয় মার্কসবাদের মেকি তন্ত্রমন্ত্র এখানে তিনি পবিত্র কুরআন অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করেন। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কবিতায় আল মাহমুদ যে অলৌকিক সত্যে সিদ্ধিলাভ করেছেন তার সাক্ষ্য দিয়েছেন এভাবে- পৃথিবীর সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থটি বুকের ওপর রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হয় এ ছিল সত্যিকার ঘুম কিংবা দুপুরে খাওয়ার পর ভাতের দুলুনি। আর ঠিক তখুনি সেই মায়াবী পর্দ দুলে উঠলো, যার ফাঁক দিয়ে যে দৃশ্যই চোখে পড়ে, তোমরা বলো, স্বপ্ন। আল মাহমুদ ‘সুদিনের সারগামে সত্য সমাগত’ শীর্ষক লেখার একস্থানে লিখেছেন, ‘এক বছর বিনা বিচারে জেল খেটে তৎকালীন সাংবাদিক নেতা, সদ্য প্রয়াত গিয়াস কামাল চৌধুরীর আন্তরিক চেষ্টায় আমি মুক্তি পেয়েছিলাম। গিয়াস কামালের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা এবং আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না।’ (দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, ১ নভেম্বর ২০১৩) আল মাহমুদ নিজেকে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ্র একজন সক্রিয় সদস্য মনে করতেন। মুসলমানদের সাফল্যে তিনি শিহরিত হতেন। আর ব্যর্থতায় অপমান বোধ করতেন। বিশ্বব্যাপী সা¤্রাজ্যবাদের দোসরদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর কলম স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠতো। বাংলার হারানো ঐতিহ্য ও গৌরবের কথা তাঁর কবিতায় প্রাধান্য পেতো। এদেশে মদিনার সৌরভ ছড়িয়ে পড়–ক তিনি মনে প্রাণে কামনা করতেন; কামনা করতেন মুসলমানদের বিজয়। এ বিজয় সহজ পথে কখনো সম্ভব নয়। চাই অসীম সাহসী বীরদের পুনরাগমন। কবি আল মাহমুদ ‘বখতিয়াড়ের ঘোড়া’ কবিতায় তা সুস্পষ্ট করেছেন এভাবে- মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি; আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি। জেগেই দেখি কৈশোর আমাকে ঘিরে ধরেছে।.... আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা মনে হয় রক্তেই ফয়সালা। বারুদই বিচারক। আর স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠা। আল মাহমুদ বিশ্বব্যাপী তরুণ মুসলিম যুবকদের ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন। তাঁর ছড়া-কবিতায় এর সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে। মুসলিম যুবকদের শাহাদাতকে তিনি স্বাগত জানিয়েছেন। ‘আমাদের মিছিল’ কবিতা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের এ মিছিল নিকট অতীত থেকে অনন্ত কালের দিকে... আমরা বদর থেকে ওহুদ হয়ে এখানে, শত সংঘাতের মধ্যে এ শিবিরে এসে দাঁড়িয়েছি। কে প্রশ্ন করে আমরা কোথায় যাবো? আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্তকালের। উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোনদিনই বিহ্বল করতে পারেনি। আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত, আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মুতার প্রান্তর। পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুল ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত, তার সুগন্ধ আমাদের নিঃশ্বাসবায়ু। আমাদের হাতে একটি মাত্র গ্রন্থ আল কুরআন, এই পবিত্র গ্রন্থ কোনদিন, কোন অবস্থায়, কোন তৌহিদবাদীকে থামতে দেয়নি। আমরা কি করে থামি? আমাদের গন্তব্য তো এক সোনার তোরণের দিকে যা এই ভূ-পৃষ্ঠে নেই। আমরা আমাদের সঙ্গীদের চেহারার ভিন্নতাকে গ্রাহ্যের মধ্যে আনি না, কারণ আমাদের আত্মার গুঞ্জন হু হু করে বলে আমরা এক আত্মা, এক প্রাণ। শহীদের চেহারার কোন ভিন্নতা নেই। আমরা তো শাহাদাতের জন্যই মায়ের উদর থেকে পৃথিবীতে পা রেখেছি। কেউ পাথরে, কেউ তাঁবুর ছায়ায়, কেউ মরুভূমির উষ্ণবালু কিংবা সবুজ কোন ঘাসের দেশে। আমরা আজন্ম মিছিলেই আছি, এর আদি বা অন্ত নেই। পনের শত বছর ধরে সভ্যতার উত্থান- পতনে আমাদের পদশব্দ একটুও থামেনি। আমাদের কত সাথীকে আমরা এই ভূ-পৃষ্ঠের কন্দরে কন্দরে রেখে এসেছি- তাদের কবরে ভবিষ্যতের গুঞ্জন একদিন মধুমক্ষিকার মত গুঞ্জন তুলবে। আমরা জানি, আমাদের ভয় দেখিয়ে শয়তান নিজেই অন্ধকারে পালিয়ে যায়। আমাদের মুখাবয়বে আগামী ঊষার উদয়কালের নরম আলোর ঝলকানি। আমাদের মিছিল ভয় ও ধ্বংসের মধ্যে বিশ্রাম নেয়নি, নেবে না। আমাদের পতাকায় কালেমা তাইয়্যেবা, আমাদের এই বাণী কাউকে কোনদিন থামতে দেয়নি; আমরাও থামবো না।। বাংলা সাহিত্যের এ মহান কবি ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের মৌড়াইল গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সুদীর্ঘ কর্মময় জীবন লাভ করে পরিণত বয়সে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে ইন্তেকাল করেন। আমরা মহান আল্লাহ্র দরবারে তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।

লেখক : সম্পাদক, মাসিক দ্বীন দুনিয়া

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির