post

করোনাকালেও অনেক দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার নেপথ্যে

হারুন ইবনে শাহাদাত

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২

করোনাভাইরাস অদেখা এক অণু-জীবাণু। চোখে দেখা যায় না। কিন্তু অদেখা শত্রুর ভয়ে গোটা বিশ্ব এখনো কাঁপছে। চোখে দেখা যায় না বলে নেই, অবিশ্বাসীদের এই কথা কতটা মিথ্যে ও অসার তার আবারও প্রমাণিত হলো। এর দ্বারা বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা চেয়েছেন তাঁর প্রিয় বান্দারা তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করুক। এই বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ফিরে আসুক মুক্তির আলোকিত পথে। কিন্তু দুনিয়ার নেশায় পাগল তার বান্দারা যারা পরিবার-পরিজনকে সময় না দিয়ে ছুটে চলেছেন অর্থবিত্ত আর বৈভবের প্রত্যাশায় তারা করোনাকালের অখণ্ড অবসরকে কতটা কাজে লাগিয়েছেন? সেই হিসাব কারো কাছে না থাকলেও বিশ্বের অনেক দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী প্রায় দুই বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দূরে ছিল এবং কেউ কেউ এখনো আছে। সেই হিসাব ঠিকই রেখেছে বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘ। সাথে সাথে সেই হিসাব রাখতেও ভুল করেনি কোন কোন দেশ সংক্রমণ ও মৃত্যুর প্রচণ্ড তাণ্ডবকালে খোলা রেখেছিলো তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুয়ার। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিকল্প কায়দায় তারা শিক্ষার আলো বিলিয়ে শিশু-কিশোর তরুণ শিক্ষার্থীদের মাঝে। কিন্তু তারা কেন করোনার মৃত্যু ভয়ের চেয়ে শিক্ষা বিস্তারকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এর নেপথ্যে কী রহস্য লুকিয়ে আছে?

করোনায় সুইডেনের স্কুল বন্ধ হয়নি

বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্যানুসারে, পুরোপুরি ও আংশিকভাবে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে বিশ্বব্যাপী ৮৮ কোটি ৮০ লাখের বেশি শিশুর পড়াশোনা অব্যাহতভাবে বাধার মুখে পড়েছে। দেশগুলোর দুই-তৃতীয়াংশ দক্ষিণ অ্যামেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের। এসব দেশে প্রায় ৯ কোটি ৮০ লাখ স্কুলগামী শিশুর ওপর এর প্রভাব পড়েছে। এই ১৪ দেশের মধ্যে পানামাই সবচেয়ে বেশি দিন স্কুল বন্ধ রেখেছে। প্রতিবেদনে যে পরিসংখ্যান দেখানো হয়েছে তাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ২২ শতাংশ শিশুর শিক্ষা করোনাকালে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে এক বছরের বেশি ধরে স্কুল বন্ধ রাখা ১৪টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। তবে একদিনের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়নি এমন দেশও আছে। যেমন: ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘করোনায় সুইডেনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি এবং সেখানে লকডাউনও দেয়া হয়নি। ভরা দুর্যোগেও সেখানে বার-রেস্টুরেন্ট খোলা ছিল। তারপরেও তারা মহামারী মোকাবিলা করে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরেছে। তাদের বক্তব্য, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার, তাকে স্থগিত করার, বন্ধ করার অধিকার সরকারের নেই। যদি সবকিছুর ধ্বংসাবস্থা, অচলাবস্থা তৈরি হতো, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। এটাই হচ্ছে সে দেশের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার মানদণ্ড এবং তা সংরক্ষণে সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে, যেমনটা করোনায় করছে। কানাডাও প্রতিনিয়ত অভিভাবকদের মতামতের ভিত্তিতে অফলাইন-অনলাইন স্কুল নিয়মিত চালু রেখেছে।’ (সূত্র : ডেইলি স্টার অনলাইন, জুন ১৭, ২০২১)। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতেও একটানা বন্ধ ছিল না

ইউরোপ আমেরিকার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে একটানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়নি। ডেইলি স্টারে ওপরে উল্লিখিত প্রতিবেদনে ড. মঞ্জুরে খোদা লিখেছেন, ‘শিক্ষা উন্নয়ন গবেষক করোনা মহামারীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবার ক্ষতির পরিধি ও ব্যাপকতা এক নয়। করোনা মোকাবিলার পথ, পদ্ধতি, দৃষ্টিভঙ্গিও সবার একই রকম ছিল না। সম্প্রতি ইউনেস্কো করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে। সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ (আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইতালি) মাঝারি (ভারত, ইরান) ও সর্বনিম্ন ক্ষতিগ্রস্ত দেশ (বাংলাদেশ, পাকিস্তান)।’ কিন্তু অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশের দীর্ঘ সময়ের জন্য একটানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়নি। কিন্তু কম মৃত্যু আক্রান্ত ও সংক্রমণের দিক থেকে কম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হওয়ার পরও বাংলাদেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে আছে। ইউনেস্কোর অপর গবেষণায় দেখা যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও এই করোনায় খোলা ও বন্ধ দুইই ছিল। আর কিছু দেশে একেবারেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়নি। বিশ্বে এমন দেশের সংখ্যা ১৬টি। এই দেশগুলো হলো: উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমার, সৌদি আরব, ভেনিজুয়েলা, মাদাগাস্কার, লাওস, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, সুরিনাম, সুদান, তুরস্ক, ইরাক, পেরু, উরুগুয়ে, মেক্সিকো। এই ১৬টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ যেখানে আজ (সেই প্রতিবেদন প্রকাশের সময়কাল) পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ থাকা এই দেশগুলোতে মূলত রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, গণবিরোধী ও এককেন্দ্রিক শাসকরা ক্ষমতায় আছেন। করোনায় সবচেয়ে কম ক্ষতির তালিকায় থাকা বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণ কী? নীতিনির্ধারকরা কী বলছেন? তাদের বক্তব্য, স্কুল খুলে দেয়া হলে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হবে। করোনা সংক্রমণ বহুগুণ বেড়ে যাবে, শিক্ষার্থীরা মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। সে কারণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রায় দেড় বছর টানা বন্ধ আছে। ভারত-পাকিস্তানেও বিরতি দিয়ে স্কুল খুলে দেওয়া হয়েছিল, আবারও খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ এখনো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে কি আসলেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংক্রমণ বহুগুণ বেড়ে যাবে? এ বিষয়ে গত বছর আমেরিকার ফ্লোরিডায় একটি চমকপ্রদ গবেষণা প্রকাশিত হয়। সেখান থেকে জানা যায়, মার্চে জরুরি অবস্থা জারির পর আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাসে স্কুল পুনরায় খোলা হয়। সে সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যায়। দেখা যায়, স্কুল খোলা থাকার সময়টায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী করোনা আক্রান্ত হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায় সংক্রমিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ স্কুলের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছে, বাকি ৫৯ শতাংশ শিক্ষার্থী আক্রান্ত হয়েছে কমিউনিটি ও সামাজিক মেলামেশার মাধ্যমে। আর উচ্চমাধ্যমিকের বা ১২ ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মাত্র ১১ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে, বাকিটা এসেছে সামাজিক মেলামেশা থেকে। যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। সে অবস্থায় সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে- বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে বাধা কোথায়? ফ্লোরিডার গবেষণা বলছে, স্কুল খোলার কারণে যেসব শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হয়েছে তার খুব সামান্য দায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। করোনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ব্রিটেন প্রথম ঢেউয়ের শুরুতেই তাদের শিক্ষাকার্যক্রম অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা-ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। তারা প্রথমেই বুঝতে পেরেছিল এ দুর্যোগ সহজেই যাবে না।’

জার্মান বার্তা সংস্থা ডয়চে ভেলের (ডিডব্লিউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারীর সময়ও বিশ্বের সর্বত্র স্কুল খোলা রাখার কথা বলেন জার্মানির ইউনিসেফ শাখার প্রেস অফিসার ক্রিস্টিনে কাহমান। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, জোর করে স্কুল বন্ধ রাখার কারণে বিশ্ব শিক্ষাসঙ্কটের কবলে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী স্কুল বন্ধ করার ফলে শিক্ষাসঙ্কট ছাড়াও আগামী কয়েক দশক ধরে বহু দেশের সমাজে এর প্রতিফলন থাকতে পারে। যার পরিণতিতে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হবে শিশুরা বিশেষ করে প্রান্তিক শিশুরা।’ ক্লাসরুম সংক্রমণমুক্ত ধরে নিয়ে জার্মানি সর্বশেষ লকডাউনের ব্যবস্থা গ্রহণের পরে স্কুল খোলা হয়। তবে নভেম্বরের মধ্যেই তিন লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীকে কোয়ারেন্টিনে যেতে হয়। এবং তারপরেও জার্মানির সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়ার ১০টি স্কুলের মধ্যে একটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু জার্মানির সর্বোচ্চ দৈনিক সংক্রমণের হার বাভারিয়া রাজ্য আংশিকভাবে ক্লাস বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করে। সংক্রমণের হার আরও বেড়ে গেলে এইট থেকে ওপরের ক্লাসের শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল এবং অনলাইন ক্লাসের মধ্যে বিকল্প ব্যবস্থা বেছে নেয়া হবে। তবে ফ্রান্সে লকডাউন মোটামুটি কঠোর থাকলেও স্কুল খোলা রয়েছে। গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়, মহামারী বিস্তারে স্কুলের ভূমিকা তেমন বড় নয়। ছোট বাচ্চাদের চেয়ে বড়দের সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী স্কুল এবং ডে কেয়ার সেন্টারগুলো সতর্ক থাকায় পুনরায় খোলার পরেও ভাইরাসের বিস্তার ঘটেনি।

ইউনিসেফ স্কুল খুলে দেয়ার পক্ষে

নতুন বছর ২০২২ সালের প্রথম মাস জানুয়ারির ২৮ তারিখ শুক্রবার জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর এক বিবৃতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে স্কুল খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। বিবৃতিতে বিশ্বের সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, স্কুল খোলা রাখুন। স্কুলগুলো পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ থাকার কারণে বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৬১ কোটি ৬০ লাখ শিশু ক্ষতিগ্রস্ত। কোভিড-১৯-এর ওমিক্রন ধরনটি সারা বিশ্বে যখন ছড়িয়ে পড়ছে, এটি যাতে শিশুদের পড়াশোনাকে ব্যাহত করতে না পারে, সে জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে আমরা সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানাই। পড়াশোনার ক্ষেত্রে বিপর্যয় এড়াতে এবং শিশুদের তাদের শেখার পথে ফিরিয়ে আনতে ইউনিসেফ কিছু সুপারিশও করেছে। এগুলো হলো- - শিক্ষক ও স্কুলকর্মীদের অবিলম্বে টিকা দিতে হবে। প্রথম সারির স্বাস্থ্যকর্মী ও উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে কোভিড-১৯-এর টিকাদানের পরপরই এই টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে শিক্ষক ও স্কুলকর্মীদের সম্পূর্ণরূপে সমর্থন ও অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। - স্কুল খোলা রাখুন। স্কুলগুলো পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ থাকার কারণে বর্তমানে প্রায় ৬১ কোটি ৬০ লাখ শিশু ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা জানি, কোভিড-১৯ ঝুঁকি প্রশমনের ব্যবস্থাগুলোই স্কুলগুলোকে খোলা রাখতে সাহায্য করে। আমরা আরও জানি, ডিজিটাল সংযুক্তির পেছনে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে পারলেই কোনো শিশু পেছনে পড়ে থাকবে না। প্রতিটি শিশুকে স্কুলে ফিরিয়ে আনতে আমাদের জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিটি কমিউনিটির প্রান্তিক শিশুদের ওপর বিশেষ লক্ষ্য রেখে কিছু বিষয়ে বিস্তৃত সহায়তা প্রদান করা। যেমন শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ঘাটতি পূরণে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া, মানসিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসহায়তা, সুরক্ষা ও অন্যান্য পরিষেবা প্রদান। - অগ্রাধিকারপ্রাপ্য জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি সুরক্ষিত করার পর এবং টিকার যথেষ্ট প্রাপ্তি নিশ্চিত হলে ইউনিসেফ শিশুদের টিকাদানকে সমর্থন করে। সশরীরে স্কুলে যাওয়ার জন্য টিকাদানকে পূর্বশর্ত করবেন না। কোভিড-১৯ টিকা প্রাপ্তি সাপেক্ষে সশরীরে স্কুলে যাওয়ার শর্ত আরোপ করলে তা শিশুদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ না পাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইউনিসেফ শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের টিকাদান ছাড়াই স্কুলগুলো খোলা রাখার এবং কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ কৌশল যাতে পড়াশোনা ও সামাজিক জীবনের অন্যান্য দিকে শিশুদের অংশগ্রহণকে সহজতর করে, তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করে। - সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে সব সময় কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্বজুড়ে শিক্ষাব্যবস্থায় যে নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, তা আমরা স্বীকার করি। তবে এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি খুবই বেশি। শিশুদের স্কুলে রাখার জন্য সম্মিলিতভাবে আমাদের পক্ষে সম্ভব সবকিছু করতে হবে। এর আগে ইউনিসেফ এক বিবৃতিতে বলেছে, করোনাভাইরাস মহামারীতে দেড় বছরের বেশি সময় স্কুল বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে তিন কোটি ৭০ লাখ শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে। ইউনিসেফের এক জরিপ করে বলছে, মহামারীকালে বিশ্বজুড়ে স্কুল সম্পূর্ণ বা আংশিক বন্ধ থাকার কারণে ৬৩ কোটি ৫০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

নেতিবাচক প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে

মহামারীর কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ ছিল বাংলাদেশে। দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে খোলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এবার করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার ফলে সরকার নতুন করে ২৩ জানুয়ারি থেকে স্কুল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। স্কুল বন্ধ থাকার কারণে এর নেতিবাচক প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। লেখাপড়ার ক্ষতি ছাড়াও আরো যেসব ক্ষতির মুখে পড়ছে তরুণরা তাহলো: হতাশা, মানসিক বিকার, মাদকাসক্ত, পর্নো আসক্তি, বাল্যবিয়ে, বেকারত্ব। এর ফলে অনেকে বেছে নিচ্ছে আত্মহননের মতো নির্মম পথ। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০২১ সালে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা যায়, আত্মহত্যাকারীদের ৬১ শতাংশের বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আর আত্মহত্যার প্রবণতা ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্রদের বেশি। দেশের প্রায় ৫০টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার আত্মহত্যার সংবাদ বিশ্লেষণ করে সংখ্যাটি পেয়েছে আঁচল ফাউন্ডেশন। আঁচলের হিসাবে, ৫০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও অনার্স কলেজের শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করেছেন। আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, দুটি জাতীয় দৈনিকের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২০ সালে ৭৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিলেন। আঁচলের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গত বছর আত্মহত্যা করা ১০১ জনের মধ্যে ৬২ জন বা ৬১ দশমিক ৩৯ শতাংশই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একই সময়ে মেডিক্যাল কলেজ ও অনার্স কলেজের ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন, যা মোট আত্মহত্যাকারীর ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। গত বছর ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২২ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা সংখ্যায় ২৩। আঁচলের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ তিনজন আত্মহত্যা করেছেন। দেখা গেছে, ২২ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। এই বয়সসীমার ৬০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে ১৮ থেকে ২১ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ২৭ জন। আঁচলের গবেষণা থেকে দেখা গেছে, গত বছর আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৬৫ জন ছাত্র, অর্থাৎ আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৪ দশমিক ৩৬ শতাংশই ছাত্র। ছাত্রীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ছাত্র গত বছর আত্মহত্যা করেছেন। করোনাকালে সারা দেশেই বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা। আঁচল বলছে, আর্থিক টানাপোড়েন, লেখাপড়া ও পরীক্ষা নিয়ে হতাশা, পারিবারিক সহিংসতা, অভিমান এসব কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বিশ্লেষকরা করোনার প্রকোপকালেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তারা মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটানা বন্ধ রাখা করোনা মহামারীর চেয়েও শিক্ষার্থীদের বেশি ক্ষতিকর।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির