post

করোনা : আতঙ্ক

ড. মোবারক হোসাইন

০১ জুন ২০২২

একটি জাতির মূল চালিকাশক্তি হলো শিক্ষা। তাই বলা যায়, Education is the backbone of a nation. মানুষের মেরুদণ্ডের মতো শিক্ষাও একটি জাতির অন্যতম প্রধান অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত হয়। শিক্ষার মাধ্যমে জাতি এগিয়ে যায়, উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করে। কবি মিল্টনের বক্তেব্যে; তিনি বলেন Education is the harmonious development of body, mind and soul”. অর্থাৎ শিক্ষা হচ্ছে দেহ, মন এবং আত্মার সমন্বিত উন্নয়নের নাম। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। করোনা নামক মহামারী আমাদের শিক্ষা, অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মধ্যে পড়ে শিক্ষাব্যবস্থা এবং তার প্রধান শিকার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকবৃন্দ। শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে না পারায় তাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

সামগ্রিক শিক্ষা জীবনে করোনার প্রভাব করোনা ভাইরাস মহামারীর প্রভাব পড়েছে সবকিছুতেই। সবচেয়ে বেশি চাপে ফেলেছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিকে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে সাড়ে ৮ মাস ধরে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক থেকে বিশ^বিদ্যালয় সব শিক্ষার্থী দুশ্চিন্তায়। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সঙ্কটে। বেতন-ভাতাসহ নানা কারণেই অস্থিরতা চলছে এসব প্রতিষ্ঠানে। ইউনেস্কোর তথ্য মতে, বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৯০টি দেশের শিক্ষার্থীরা লকডাউনে আছে। সব দেশেই আর্থিকভাবে সচ্ছলদের তুলনায় অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাব্যবস্থা একরকম ঝিমিয়ে পড়েছে, আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে শিক্ষার্থীরা। তারা এখন তাকিয়ে আছে কবে ক্যাম্পাসে প্রত্যাবর্তন করবে এবং নিয়মিত হবে। তাই দ্রুত এ সঙ্কটের মোকাবিলা করতে না পারলে শিক্ষাব্যবস্থা পিছিয়ে পড়বে। যদিও সরকার শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে অটোপ্রমোশনের চিন্তা করছে কিন্তু তা প্রকৃত মেধা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর হবে? এ বিষয়ে অতি দ্রুত এবং বিকল্প কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে শিক্ষাব্যবস্থায় এক অদৃশ্য বিপর্যয় নেমে আসবে। এর চেয়েও ভয়ের বিষয় হলো, শিক্ষার্থীদের একাংশ পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়তে পারে। বাল্যবিবাহের হারও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাড়তে পারে শিশুশ্রমও। জাতিসংঘ বলছে, স্কুল ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিশ্বের ৯৪ ভাগ শিক্ষার্থীই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিম্ন ও নিম্নমধ্য আয়ের দেশের ৯৯ ভাগ শিক্ষার্থীই ক্ষতির শিকার হয়েছে। একটি প্রতিবেদনে সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে অন্তত ১ কোটি শিশু আর স্কুলে ফিরে যেতে পারবে না। এর কারণ, তাদের দরিদ্রতা। বিজনেস ইনসাইডারের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ১৮৮টি দেশের শিক্ষার্থীরা করোনাকালে সরাসরি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী ১ শত ৭২ কোটি ৫০ লক্ষ শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমানে নিম্ন থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা চার কোটির অধিক। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় পৌনে ৩ কোটি। এদের মধ্যে নারী-পুরুষ প্রায় সমান। এত বিপুল সংখ্যক মানুষ বিশ্বের ২০০টি দেশের কোনটিতেই নেই। তাই আমাদের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেশের জন্য কল্যাণকর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই বিপুল শিক্ষার্থীর আউটপুট তেমন সুখকর নয়। কারণ, তারা দক্ষ নয়। ইউনিসেফ ২০১৯ সালের তথ্য মতে, ‘বাংলাদেশের তরুণদের ৭৪% অদক্ষ আর মাত্র ২৬% দক্ষ।’

শিক্ষাব্যবস্থায় ছন্দপতন করোনার প্রভাবে শিক্ষা খাতে ব্যাপক সঙ্কটের তরঙ্গ তৈরি হয়েছে, অর্থনৈতিক সঙ্কটে দরিদ্রতার মহাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে কোটি কোটি মানুষ। সামাজিক বন্ধন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে মানসিক বৈকল্য। বাড়ছে নৈরাজ্য, বাড়ছে বিশৃঙ্খলা। শিক্ষার ক্ষেত্রে করোনা কেবল সাময়িক প্রভাবই ফেলেনি, এটি সৃষ্টি করেছে শিখনের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি। শিক্ষার সব ক্ষেত্রের মোট ৯৮.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্ষতির সম্মুখীন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখে। এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। আশু ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষতি হ্রাসের পদক্ষেপ যদি নেওয়া না হয়, দীর্ঘ মেয়াদে চরম মূল্য দিতে হবে। শিক্ষাবিজ্ঞানে বলা হয়, একটি জাতির প্রকৃত ভাগ্য লিখিত হয় এর বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষগুলোতে। আর করোনা এই শ্রেণিকক্ষ শিক্ষাকে তথা বিদ্যালয় শিক্ষায় মারাত্মক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। করোনার আগে এ দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু লকডাউন ঘোষণার কারণে ৭০ শতাংশ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় দারিদ্র্যের হার ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে বলে সিপিডি জানিয়েছে। লকডাউন খুলে দেওয়া হলেও অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, ব্যবসায় যাচ্ছে মন্দা। ফলে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর অনেকেই শিশু শিক্ষার্থীকে বাধ্য হয়েই অর্থ উপার্জনে নামিয়ে দেওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ৫ থেকে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাধার মুখে পড়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষা’ সম্পর্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের নীতিমালার সংক্ষিপ্ত বিবরণীতে জানানো হয়েছে, দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল বন্ধের কারণে পড়াশোনার যে ক্ষতি হচ্ছে তা সাম্প্রতিক দশকগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থায় অর্জিত অগ্রগতিকে ম্লান করে হুমকির মধ্যে ফেলেছে। জাতিসংঘের নথিতে উল্লেখ করা হয়, করোনা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে প্রভাব ফেলেছে তার কারণে আগামী বছর প্রায় ২ কোটি ৩৮ লাখেরও বেশি শিশু এবং তরুণ স্কুল-কলেজে যেতে পারবে না বা ড্রপ আউটের শিকার হবে। ইউনেস্কো, ইউনিসেফ, ডব্লিউএফপিএ এবং বিশ্বব্যাংক হুঁশিয়ারিও দিয়েছিল, এই মহামারীর কারণে শিক্ষার কার্যক্রম বন্ধ হওয়া, শিশুদের পড়াশোনা এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির সৃষ্টি করবে। বর্তমান এই বিরাজমান পরিস্থিতিতে জাতি একটি ভিন্ন মাত্রায় মহাসঙ্কটে পড়েছে। শিক্ষা তার মধ্যে একটি অন্যতম মহাসঙ্কট। করোনা পরিস্থিতিতে নিম্নলিখিত প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে- দরিদ্র্য শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে। বেকারত্ব বাড়ছে। সেশন জট বাড়ছে। সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। শিক্ষার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বাল্য বিবাহ বাড়ছে। শিক্ষক ও কর্মচারী কর্মকর্তা বেকার হয়ে পড়ছে। সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রাথমিক পর্যায়ের শিশু শিক্ষার্থীদের উপর। স্কুলে পড়ালেখা না হলে বাচ্চারা বাসায় পড়তে চাচ্ছে না। দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের মানসিক বিকাশের উপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

প্রাথমিক শিক্ষার উপর করোনার প্রভাব করোনার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমেই শিক্ষাজীবন শুরু করে শিক্ষার্থীরা, ফলে এটা তাঁদের জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়। প্রায় ৮ মাস ধরে অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মত বন্ধ থাকার ফলে প্রাথমিকের দুই কোটিরও বেশি শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ এখন হুমকির মুখে। করোনা দুর্যোগ দেখা দেওয়ার পর থেকে অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকেরা কর্মহীন হয়ে পড়ে। যা তাঁদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর প্রভাব ফেলছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের মতে, বাংলাদেশে অন্তত দেড় কোটি লোক চাকরি হারাতে পারে। যার প্রভাব পড়বে তাঁদের পরিবারের উপর। বাংলাদেশের তিন কোটি মানুষ গরিব রয়েছে। করোনা দারিদ্র্যের হার বাড়িয়ে দিবে। প্রাথমিকে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার মূল কারণ দারিদ্র্য। ফলে করোনা পরবর্তী অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে। কারণ তাদের অভিভাবকেরা কর্মহীন হলে তাঁদের সন্তানদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভর্ন্যান্সের একটি তথ্যে উঠে এসেছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে শিক্ষার্থীদের ৮০ শতাংশ পড়াশোনা কম হচ্ছে এবং ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী পরিবারের আয়মূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছে। করোনা নিম্ন আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীদের উপর বেশি প্রভাব ফেলবে। কারণ বাবা মায়েরা সন্তানদের কাজে পাঠাবে সংসারের অর্থ যোগানে। অনেকের পক্ষে শিক্ষার উপকরণ ও স্কুলের অন্যান্য খরচ মেটানো সম্ভব হবে না ফলে শিশুশ্রম বাড়বে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাচ্চাদের মেধা মননের বিকাশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি অভ্যাসে ও শারীরিকভাবেও পিছিয়ে পড়ছে। বাচ্চারা স্কুল আঙিনায় খেলাধুলা, দৌড়াদৌড়ি করে যা তাদের শরীর গঠনে ভূমিকা রাখে। এখন সে সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। তার ওপর স্মার্টফোন, টিভির পর্দা আরও অলস করে তুলছে তাদের। শারীরিক সমস্যাও বাড়ছে। করোনার প্রাদুর্ভাবের ফলে সৃষ্ট মহামারীর এসময়ে পৃথিবীব্যাপী স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে প্রায় ৮ মাস। এ দীর্ঘসময়ে শিক্ষার্থীরা অনেক পিছিয়ে গেছে। কাক্সিক্ষত পরিবেশে শেখার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যান্য সকল সেক্টরের কার্যক্রম চালু হলেও শিক্ষাঙ্গন এখনো সচল হয়নি।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা করোনার প্রভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা ব্যাপক হারে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। মাধ্যমিকে স্তরের শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস শুরু হলেও তেমন কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন ইন্টারনেটে সমস্যা, ডিভাইসের অপর্যাপ্ততা এই ক্লাসের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ব্যবস্থা না থাকায় অনলাইন ক্লাসের বাইরে থাকছে। এছাড়াও ইন্টারনেটের গতি অনেক দুর্বল, বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ইন্টারনেট ডিভাইস নেই, শিক্ষকরাও একই সমস্যায় রয়েছেন। প্রশিক্ষণ না থাকাও বড় বাধা হয়েছে তাদের জন্য।

উচ্চশিক্ষা করোনার প্রভাবে উচ্চশিক্ষায় ব্যাপক হারে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বন্ধের মধ্যে অনলাইনে ক্লাস শুরু চালু থাকলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নিচ্ছে না। অনলাইনে ক্লাস করার জন্য সুন্দর পরিবেশ ও পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত সমস্যা রয়েছে। কিছু উদ্যোগ শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে- প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন, ফি সহ অন্যান্য খরচ বহনে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চহারে বেতন দিয়ে পড়তে হয়, ফলে এখানে শিক্ষার্থীদের স্কুলগামী ও ঝরে পড়া রোধ করার কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। শহর অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম চালুর পাশাপাশি গ্রামেও অনলাইনে শিক্ষকার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিতে হবে। উপবৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। এবং যথাসময়ে এর প্রাপ্তি সুনিশ্চিত করতে হবে । নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের কর্মহীন অভিভাবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষি শিল্পসহ সমস্ত সেক্টরকে গুরুত্ব দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে আনন্দমূলক শিক্ষাব্যবস্থার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিটি স্কুলে ডে-মিল চালু করা ও প্রয়োজনে হত দরিদ্র শিক্ষার্থী পরিবারের সদস্যদের রেশন কার্ডের ব্যবস্থা করা। তালিকা ধরে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার খোঁজখবর নিতে হবে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনা বেতনে বা অর্ধ বেতনে পড়ার সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষাখাতে উন্নয়নে পর্যাপ্ত সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে। বাস্তবমুখী ও গবেষণামূলক শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

অনলাইন-ভিত্তিক পাঠদান ফলদায়ক হচ্ছে না অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সরকার যতটা সম্ভব শিক্ষার্থীদের বইমুখী রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু সেটাও কি সফলভাবে করতে পারছেন? না। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বসবাস করে গ্রামে। ফলে নেটওয়ার্ক দুর্বলতার কারণে তারা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সঠিকভাবে সেবাটি পাচ্ছে না। আর যারা এর আওতাধীন আছে তারাই বা এ ব্যাপারে কতটা সফল হচ্ছে তাও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। কারণ, অনেকেরই স্মার্টফোন নেই। সরকার টেলিভিশনে রেকর্ড করা ক্লাস সম্প্রচার করছে, সেখানে উপস্থিতি ভালো নয়। টেলিভিশন ও বেতারে ক্লাস এককেন্দ্রিক হওয়ায় এখানে শিক্ষার্থীরা আনন্দ পায় না। প্রশ্ন করারও সুযোগ নেই। এসবে ক্লাস হলেও মূল্যায়নের সুযোগ নেই। ফলে এটি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। জাতিসংঘের শিশু তহবিল, ইউনিসেফ বলেছে বিশ্বে স্কুলে পড়ছে এমন ছেলেমেয়েদের এক-তৃতীয়াংশই অনলাইন শিক্ষায় অংশগ্রহণে অপারগ। সংস্থাটির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রায় দেড়শ কোটি শিশু প্রত্যক্ষ শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ৪৬ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর কাছেই নেই টেলিভিশন, রেডিও কিংবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণের কোনো সাজ-সরঞ্জাম। নেই বৈদ্যুতিক সুবিধাও। বয়সভিত্তিক দেখা যায়, প্রাক-প্রাথমিক বয়সের ৭০ ভাগ স্কুলছাত্রী ভার্চুয়ালি শিক্ষা গ্রহণ করছে না। যাদের সংখ্যা প্রায় ১২০ মিলিয়ন। সম্ভবত ছোট বাচ্চাদের জন্য অনলাইন ক্লাস করা চ্যালেঞ্জের বিষয়। অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত ডিভাইসের অভাব। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তালিকায়। এই বয়সের ২১৭ মিলিয়ন শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না। শতকরা হিসাবে যার পরিমাণ কমপক্ষে ২৯ শতাংশ। এদিকে প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম না থাকায় কমপক্ষে ১৮ শতাংশ বা ৪৮ মিলিয়ন উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলছাত্র অনলাইনে তাদের পড়ালেখা চালাতে পারছে না। অনলাইনে ক্লাস ফলপ্রসূ না হওয়ার কারণ- অনলাইনে ক্লাসের ব্যবস্থার জন্য ইনটাররেট বিনামূল্যে সুবিধা না দেওয়া মনোযোগী না হওয়া নেটওর্য়াক দূবলতা সঠিক তথ্য প্রযুক্তি না জানা স্মার্ট ফোন না থাকা বিদ্যুৎ বিভ্রাট প্রযুক্তিগত সরঞ্জামের অপ্রতুলতা ই-লার্নিংয়ে অনভ্যস্ততা দুর্বল ইন্টারনেট ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের পড়ার গতি কমে যাচ্ছে। মূলত অনলাইনে শিক্ষা পুরোপুরি ফলদায়ক হচ্ছে না। অনেকটা না হওয়ার চেয়ে কিছুটা হওয়া ভালো। (ঝড়সবঃযরহম রং নবঃঃবৎ ঃযধহ হড়ঃযরহম) বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে অবকাঠামো এবং সুযোগ-সুবিধা সীমিত, অনলাইন শিক্ষার দিকে এই রূপান্তর অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।

উত্তরণের সম্ভাব্য উপায় এক. প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করে প্রয়োজনীয় উপকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষাসমূহ গ্রহণ করা সংশ্লিষ্ট সবার কাছে সহজসাধ্য হয়। দুই. অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদেরকে বিনা পয়সায় ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ইন্টারনেট সার্ভিস ফ্রি করার জন্য ব্যবস্থা করবেন। তিন. অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনমতো এন্ড্রয়েড মোবাইল সেট সরবরাহ করতে হবে।

দীর্ঘ সেশনজট ও তার প্রভাব সেশনজট শব্দটি বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য একটি আতঙ্ক এবং দুর্বিসহ নাম। শিক্ষার্থীরা চরম হতাশায় ভুগছে এবং শিক্ষার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে সেশনজট যেন অনিবার্য। ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ হওয়ার সাথেই পিছিয়ে যাচ্ছে সেমিস্টার। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হবে না গ্রাজুয়েশন। এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে গৃহবন্দী অবস্থায় থাকতে গিয়ে মানসিকভাবে অস্থিরতা কাজ করছে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মাঝে। এমন পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে শিক্ষাক্ষেত্রে চরমভাবে দূরবস্থা দৃশ্যমান হবে এবং দেশের উন্নয়ন বাধার সম্মুখীন হয়ে দেশ পিছিয়ে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এই দেশে বর্তমানে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। করোনা ভাইরাসের প্রকোপে দেশে আরো কমপক্ষে ১২ লাখ শিক্ষার্থী গ্রাজুয়েট বেকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। অন্যদিকে করোনা ভাইরাসের কারণে দেশে কমপক্ষে আরো ৫ লাখ তরুণ চাকরিচ্যুত হবে। সব মিলিয়ে মোট বেকারের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৪৫ লাখ। এই বিশাল সংখ্যার ভারত্ব নেয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা হতাশায় মুষড়ে পড়বে অন্যদিকে জাতীয় ও সামাজিক জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। মানসম্মত শিক্ষার বিস্তার নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে আগামীতে দেশে নানা রকম সঙ্কট সৃষ্টি হবে। কাজেই শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে যে পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে, তাদের সমস্যার সমাধানে সরকারকে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। করোনা সৃষ্ট শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য ঐচ্ছিক ছুটি বন্ধ, অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে গ্যাপ পূরণ, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ইত্যাদি আবশ্যক। সেশন জটের ফলে নিম্নলিখিত প্রভাব পড়তে পারে- দরিদ্র্য শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বেকারত্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে সামাজিক অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাবে শিক্ষার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে পারিবারিক ও সামাজিক মানসিক চাপ বাড়বে অপসংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়বে মাদকসহ বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়বে ইভটিজিং ও ধর্ষণের পরিমাণ বেড়ে যাবে আদর্শ ও নৈতিকতা হারিয়ে ফেলবে।

অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের করণীয় যেহেতু করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কবে শেষ হবে এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। সেহেতু শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন স্বাভাবিক রাখতে শিক্ষক ও অভিভাবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষত প্রাইমারি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পড়ার টেবিলে রাখতে অভিভাবকরা শিক্ষকদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে পড়ালেখার নিয়মিত তদারকি করতে হবে। তাদের সিলেবাস শেষ করার জন্য অভিভাবককে শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্যদিকে শিক্ষককে প্রতিটি শিক্ষার্থীর পড়ালেখার নিয়মিত আপডেট নোট করতে হবে। যেসব শিক্ষার্থী পড়ালেখায় অমনোযোগী তাদের চিহ্নিত করে বন্ধুসুলভ আচরণের মাধ্যমে সঠিক গাইড লাইন দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের করণীয় হচ্ছে অভিভাবক ও শিক্ষকদের নির্দেশনা মেনে পাঠ শেষ করা। কারণ শিক্ষার্থীরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের সমাজ, দেশ, জাতির স্বপ্নপূরণে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীরা হচ্ছে নবোদয় সূর্যের মত। তারা দেশ, জাতি, সমাজকে সূর্যের মত আলোকিত করবে। তাদের যোগ্যতম হয়ে গড়ে উঠতে হবে। শিক্ষার ব্যাপারে তাদের আগ্রহী হতে হবে। বিখ্যাত কবি William Allen White এর ভাষায় বলতে হয়, ও I am not afraid of tomorrow, for I have seen yesterday and I love today! অর্থাৎ, আমরা আগামী দিন নিয়ে ভীত নই, আমরা গতকাল দেখেছি এবং আজকের দিনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিব। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে আলোকিত করব। বর্তমানে কী করতে হবে তা আমরা জানি- প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকতে হবে কোনভাবেই সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না Every day is the school day/ Every day is the মনে করতে হবে জানার জন্য কঠিন দুঃসাহসিক হতে হবে।

William Shakespeare বলেছেন- “To be, or not to be, that is the question: Whether’ this nobler in the mind to suffer The slings and arrows of outrageous fortune” পল্লী কবি জসীমউদ্দীন বলেছেন, ‘বই জ্ঞানের প্রতীক, বই আনন্দের প্রতীক।‘ জ্ঞান আর আনন্দ ছাড়া মানব জীবন নিশ্চল হয়ে পড়ে। জীবনকে সুন্দরভাবে বিকশিত করতে হলে, সুবাসিত করতে হলে জ্ঞানার্জন করতে হবে। আর জ্ঞানার্জন করতে হলে বই পড়ার কোন বিকল্প নাই। নিজেকে জানতে হলে, পৃথিবীকে জানতে হলে বই পড়তে হবে।’ একটা সভ্যতাকে, একটা শতাব্দীকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য মহা কোন পরিকল্পনা করার দরকার নেই। ঐ সভ্যতার সবগুলো বইও পুড়ে ফেলার কোন প্রয়োজন নাই। শুধু মানুষকে বই পড়া থেকে বিরত রাখতে পারলেই তা হয়ে যাবে। তাইতো অ্যামেরিকান লেখক Ray Bradbury বলেছেন, You don`t have to burn books to destroy a culture. Just get people to stop reading them. এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বই পড়া কত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছি। করোনা মহামারীতে শিক্ষার যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেবার জন্য কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। বর্তমান বৈশিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে হবে। এজন্য রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের দ্রুত কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সেই সাথে আমাদের সবাইকে করোনা সচেতনতার পাশাপাশি শিক্ষা সচেতনতার পদক্ষেপ নিতে হবে। যে পদক্ষেপ বাঁচাতে পারে আগামীর শিক্ষাব্যবস্থাকে।

লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির