post

কাছে কিংবা দূরে থাকি হৃদয়ের বন্ধন অটুট রাখি

মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত

০৬ জুন ২০২০

সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী পরিবেশে এবার উদযাপিত হয়েছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। পৃথিবীর ইতিহাসে ঠিক এমন ব্যতিক্রম ধরনের ঈদ উদযাপন আগে কখনো হয়েছে কি না জানা নেই। বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করার পর সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণে একত্রিত হওয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে বহু দেশেই লকডাউন ঘোষণা করা হয়। লকডাউনের অংশ হিসেবে কোন কোন দেশে মসজিদে নামাজ আদায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। একই সাথে পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়ায় ঈদগাহে কিংবা মসজিদে ঈদের জামায়াত আয়োজন বাতিল করা হয়। যদিও কোথাও কোথাও কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করে ঈদের জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। হাসি খুশি ভাগাভাগি করে যে উৎসব, যে উৎসব হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের ভাব বিনিময় করে, হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা একে অপরের প্রতি প্রকাশ করে, সে উৎসব এবার একদমই ব্যতিক্রম। চীনের উহান শহর থেকে শুরু হয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ঈদ উৎসবের রঙ ফিকে হয়ে গেছে। এবারে ঈদের সময় একে অন্যের সাথে সাক্ষাৎ হয়নি, মোসাফাহ হয়নি, কোলাকুলিও হয়নি। ঈদের জামায়াত-পরবর্তী যে হৃদয় নিংড়ানো উৎসবমুখর পরিবেশ তার কিছুই সম্ভব হয়নি। ঈদের চিরাচরিত বহু রেওয়াজ করোনা মহামারীর কারণে এবার বাতিল হয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো, ঈদ-পরবর্তী সাক্ষাৎ, পারস্পরিক সৌহার্দ্য বিনিময় কোনটিই এবার সম্ভব হয়নি। করোনা এমন এক সময়ে এসেছে যখন পারস্পরিক বন্ধনের অবস্থা নাজুক। করোনা এসে তা আরো নাজুক করে দিয়েছে। পৃথিবীতে দিন যত যাচ্ছে মানুষের পারস্পরিক বন্ধনগুলো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। আত্মীয়তার বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে, রক্তের বন্ধন ঠুনকো অজুহাতে ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, ভাইয়ের সাথে আপন ভাইয়ের দূরত্ব বাড়ছে। প্রতিনিয়তই এমন বন্ধন ছিন্ন হওয়ার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। করোনা না এলে বুঝতেই পারতাম না পারস্পরিক বন্ধনের এ পরিস্থিতি আরো কত ভয়াবহ। করোনা না এলে জানতেই পারতাম না সন্তান কিভাবে বৃদ্ধ মাকে করোনা আক্রান্ত ভেবে জঙ্গলে ফেলে আসে। স্বামীর করোনার সংক্রমণের সংবাদে সবচেয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী কিভাবে স্বামীকে একা ফেলে চলে যায়। যে সন্তানের জন্য পিতা-মাতা সব উজাড় করে দেয় সেই সন্তানই করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারণে ঘরে জায়গা পায় না। করোনা আক্রান্তের খবর শুনে স্বামীকে স্ত্রী ঘরে জায়গা দেয়নি, সেই স্বামী নিজ ঘরে ঠাঁই না পেয়ে তার বোনের বাড়িতে গিয়ে ইন্তেকাল করেছে স্ত্রীর সান্নিধ্য পায়নি। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি যে সমাজে বসবাস করেছে সে সমাজ তার কবরের জায়গাটুকু দেয়নি, পরিবার পরিজনেরা জানাজায় হাজির হয়নি। কোথাও কোথাও গ্রামে লাশ প্রবেশে বাধা দিয়েছে, লাশ বহনের খাটিয়াও দেয়নি। যারা এসব আচরণ করেছে তারা সকলেই মানুষ, সকলেই আশরাফুল মাখলুকাত। কিন্তু কারো হৃদয়ে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেনি। তবে হ্যাঁ কোথাও কোথাও মানবিক মানুষেরা পাশে দাঁড়িয়ে মানবিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। ঈদ যদি সঠিকভাবে উদযাপন করা যেতো তাহলে পারস্পরিক বন্ধনগুলো নতুন করে মজবুত হতো। একে অপরের প্রতি পারস্পরিক সম্পর্ক নতুন করে জোড়া লাগানো যেতো। হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও উদারতা সৃষ্টি করা যেতো। ঈদতো তেমনই একটি উৎসব। ঈদ যেখানে বহু পুরনো বন্ধুর সাথে সম্পর্ক মজবুত করে সেখানে এবারের ঈদ কাছের কিংবা নিকট প্রতিবেশী থেকেও একে অপরকে দূরে রেখেছে। বন্ধন অটুট রাখার সুযোগ কিছুটা হলেও এবার করোনা ঠেকিয়ে দিয়েছে। করোনা আমাদের মাঝে সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করেছে কিন্তু হৃদয় থেকে হৃদয়ের দূরত্ব যেন সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এবারের ঈদ বন্ধন অটুট রাখার পর্যাপ্ত সুযোগ না দিলেও আমাদের প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখতে হবে। সরাসরি সুযোগ না থাকলেও বিভিন্নভাবে আত্মীয়, প্রতিবেশী, দ্বীনি ভাই ও অসহায় মানুষের খোঁজ-খবর রাখা দরকার। ফোনের মাধ্যমে কিংবা অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমে পারস্পরিক যোগাযোগ রাখা, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া এ সময়ে খুবই প্রয়োজন। কেউ অসুস্থ হলে আগে সরাসরি দেখে আসার সুযোগ ছিল এবার অন্তত ফোনের মাধ্যমে হলেও খোঁজ-খবর নেয়া, সান্ত¡না দেয়ার সুযোগ রয়েছে। সশরীরে উপস্থিত না থেকেও করোনা মহামারীর এ সময়ে বিভিন্নভাবে মানুষের উপকারে আসা যায়। মানুষের উপকারে আসার যত উপায় উপকরণ আছে সবগুলোকেই কাজে লাগিয়ে এ সময়ে মানবিক হওয়া প্রয়োজন। ইসলাম মানবিকতার শিক্ষা দেয়, ইসলাম ভ্রাতৃত্বের বন্ধন, আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় করতে নির্দেশনা দেয়। করোনার সময়ে মজবুত বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে ইসলাম তা সমর্থন করে না। ইসলামের দৃষ্টিতে মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, মুমিনরা পরস্পর ভাই-ভাই, সুতরাং তোমরা তোমাদের ভাইদের মাঝে আপস মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আশা করা যায় তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে। (সূরা হুজুরাত : ১০)। সুতরাং মুসলমানদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন থাকবে অটুট। এই অটুটবন্ধন যেন করোনা টলাতে না পারে। মুমিনদেরকে রাসূল (সা.) তুলনা করেছেন একটি দেহের সঙ্গে। এক অঙ্গের অসুস্থতায় পুরো দেহই যেমন কাতর হয়ে পড়ে, ঠিক পৃথিবীর এক অঞ্চলের একজন মুসলমানের ব্যথাও অনুভব করতে হবে অন্য সব অঞ্চলের মুসলমানদের। তখনই এই ভ্রাতৃত্বের মর্যাদা রক্ষা হবে। হাদিসে এসেছে রাসূল সা: বলেন, তুমি মুমিনদের দেখবে- তারা পারস্পরিক দয়া-ভালোবাসা আর মায়া-স্নেহের বিষয়ে একটি দেহের মতো। দেহের এক অঙ্গ যখন আক্রান্ত হয়, তখন পুরো শরীরই অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। (সহীহ বুখারি)। রাসূল (সা.) বলেছেন, যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূর্ণ করে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করে দেন। (সহীহ বুখারি)। মহামারীর এ সময়ে আমাদের পক্ষ থেকে আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীর খোঁজ বেশি করে নেয়া প্রয়োজন। এসময় প্রয়োজন আত্মীয়তার বন্ধনকে আরো মজবুত করা, তাদের হক আদায় করা। আত্মীয়-স্বজনের হক সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘তোমরা আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করে দাও এবং মিসকিন ও মুসাফিরের হকও আদায় করো। আর কোনোভাবেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার প্রতিপালকের খুবই অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৭)। হাদিসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে। (সহীহ বুখারি)। প্রতিবেশীর হক আদায়ের উত্তম সময় বর্তমান করোনা মহামারীর সময়। কারণ এ সময়ে প্রতিবেশীর সহযোগিতা বেশি বেশি প্রয়োজন। প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে হযরত ইবনে আববাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় যে পেটপুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে। (আল আদাবুল মুফরাদ)। এবারের ঈদে করোনা আমাদেরকে একে অপরের সান্নিধ্যে যাওয়ার, পাশে গিয়ে খোঁজ-খবর নেয়ার সুযোগ দেয়নি। পরস্পর মোসাফাহ, কোলাকুলি করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার সুযোগ কেড়ে নিয়েছে। এত কিছুর পরও বিশ^াস করি হৃদয়ের বন্ধন মজবুত থাকবে, সুদৃঢ় ও অটুট থাকবে। করোনা মহামারী আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ এসেছে, আমরা আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ফরিয়াদ করবো মহান আল্লাহ তায়ালা যেন দ্রুতই তা উঠিয়ে নেন। বিশ্ববাসীকে মহামারী থেকে মুক্তি দেন। তার পাশাপাশি প্রত্যাশা করবো, করোনা যেন আমাদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করতে না পারে, আমাদের মাঝে যেন বিভেদের দেয়াল তৈরি না করে। করোনা মহামারী যেন আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের মাঝে ফাটল সৃষ্টি না করে, হৃদয়ের বন্ধনগুলোকে যেন দুর্বল করে না দেয়। তাইতো এবারের ঈদুল ফিতরে কাছে দূরের সকলের কাছেই হৃদয়ের বন্ধন অটুট রাখার আহবান জানিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছি, সংক্ষিপ্ত দু’টি লাইনে বন্ধন অটুট রাখার আবেদন জানিয়েছি- “কাছে কিংবা দূরে থাকি হৃদয়ের বন্ধন অটুট রাখি।” লেখক : এমফিল গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির