বর্তমানে খাদ্য উৎস থেকে ধীরে ধীরে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি। স্পষ্ট করে বললে, শত কিংবা হাজার বছর আগেও এরকম সুপার মার্কেট বা বাজারের এত প্রসার ছিল না। আম খাওয়ার জন্য গ্রীষ্মকালের অপেক্ষা করতে হতো কিংবা মজাদার সবজির জন্য শীতকালের। এখন বাজারে গেলে অনেক কিছু আমরা বারোমাসি পাচ্ছি। শেলফের একপাশে হয়ত বাংলাদেশী আম, অপর পাশেই রয়েছে তার্কিশ আপেল কিংবা আমেরিকান স্ট্রবেরি। নিউজিল্যান্ডের ডেইরি প্রোডাক্টসের পাশাপাশি আরবের গোশতও একই বাজারে স্থান পাচ্ছে। এই ধরনটাকেই আমরা ‘গ্লোবাল ফুড কনসেপ্ট বা বৈশ্বিক খাদ্য পর্যাপ্ততা’ হিসেবে নাম দিতে পারি। এখানে খাদ্যদ্রব্য ঋতু কিংবা স্থাননির্ভর নয় এবং এটি নতুন কোনো ধারণাও নয়। নতুন হচ্ছে এটিই যে আমাদের হাতে বিকশিত হওয়া এই আইডিয়া আজ ছড়িয়ে পড়েছে তবে এর বৃদ্ধিতে আমাদের বর্তমান অবদান খুবই সামান্য।
নবম শতকের কথা। মুসলিমদের স্বর্ণযুগের সূচনার পর দ্রুতলয়ে তা এগিয়েই চলছিল। বিশেষ করে মুসলিম কৃষকদের হাতে উৎপন্ন হচ্ছিল নতুন নতুন পদ্ধতি, বিশ্বের নানা প্রান্তের বহুবিধ ফসলের সাথে তারা পরিচিত হচ্ছিল। বৈশ্বিক বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় ব্যবস্থায় সেচকার্যক্রমের প্রভূত উন্নয়ন এবং ব্যক্তিগত জমি মালিকানায় চাষাবাদসহ অনেক কাজই জোরেশোরে হচ্ছিল। এর মাধ্যমে যেসব আগে নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাইরে অনুপযুক্ত ছিল সেসব শস্যও বিভিন্ন অঞ্চলে চাষাবাদের সুযোগ হলো।
কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায়, জমির প্রতি ভালোবাসা এবং বিজ্ঞানকে ব্যবহারিক ভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে এত উন্নতি করা সম্ভব হয়েছিল। বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপত্তি এখানে অবশ্যই বাধা দিয়েছিল। তারা পাহাড় কেটে টানেল করেছিল, কৃত্রিম জলাধারগুলো গভীর গিরিখাদ দিয়ে পার করেছিল ও তারা ধৈর্য, পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে স্প্যানিশ সিয়েরার পাহাড়ি ঢালকেও চাষযোগ্য করেছিল।
কৃষি সংক্রান্ত বৈশ্বিক জ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি
আমেরিকান ঐতিহাসিক এস পি স্কটের ভাষায়, “মুসলিমগণ শুরু থেকেই ছিল ভ্রমণপিয়াসু। অজানা এই বিশ্বকে জানতে তারা ছুটেছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। ব্যবসা ছিল এসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। তথ্য এবং জ্ঞানের জন্য তারা হেঁটেছে এশিয়ার বিস্তীর্ণ উপত্যকা থেকে ইউরোপের পাহাড়শ্রেণিতে। তারা সবকিছু লিপিবদ্ধ করে রাখত। এর মাধ্যমে আমরা যেরকম বিস্তারিত ম্যাপগুলো পেয়েছি একইসাথে এসেছে এলাকাভিত্তিক কৃষি সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্যও। এককথায় উত্থাপন হয়েছিল এক অসাধারণ সভ্যতার যেখানে হাজারো সংস্কৃতি এসে মিশেছিল এবং পূর্ব ও বর্তমানের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের যুগপৎ গবেষণা হয়েছিল। তাদের বিস্তৃতি ছিল পূর্ব থেকে পশ্চিমের আন্দালুসিয়া পর্যন্ত।”
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্ড্রে ওয়াটসন আরো যুক্ত করেছেন, “তিন থেকে চার শতাব্দীব্যাপী মুসলিম বিশ্ব ছিল একটি একক সংযুক্ত ভূখণ্ড, যেখানে নতুন যাই আসত তাকেই গ্রহণ করা হতো। এই ভূখণ্ডের সংস্পর্শে আসলেই সব যেন কেমন করে ইসলামী আদর্শের সাথে একাকার হয়ে যেত। এটাকে বলা যেতে পারে “ইসলামাইজেশন অব এভরিথিং বা সবকিছুর ইসলামীকরণ”। আমরা এখানে ভাবভঙ্গি, সামাজিক গঠন, প্রতিষ্ঠান, কৃষি, স্থাপনা, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সহ যাবতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলছি। এরকমভাবে অর্থনৈতিক সব শাখাসহ জীবনের বিভিন্ন পর্যায়েও এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে থাকে। যেন এর কাছে আসলেই সব এর রঙে রঞ্জিত হয় এবং নবরূপে উদ্ভাসিত হয়।”
এভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামী আদর্শের বিজয়ের ফলে এক বৃহৎ অঞ্চল মুসলিমদের অধীনে আসে, একইসাথে সেসব অঞ্চলের জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিও। এতসব জ্ঞানের মিলনের ফলে মুসলিমরা লালন করতে পেরেছিল পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ঘোড়া এবং পশুপাল, তারা চাষ করতে পেরেছিল বিবিধ কৃষিজ পণ্য যেসব হয়ত কোনো অঞ্চলের জন্য আগে অনুপযোগী ভাবা হতো। তারা গবেষণায় পেয়েছিল কিভাবে ফসলের পোকামাকড়ের সাথে লড়তে হয়, সার ব্যবহার করতে হয়, কিভাবে গাছে কলম দিতে হয় এবং বিভিন্ন প্রজাতির সমন্বয়ে ক্রসিং করে কিভাবে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন নতুন প্রজাতির সন্ধান পেতে হয়।
নতুন শস্য এবং প্রজাতি উদ্ভাবন
প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে শুধুমাত্র শীতকালীন শস্যই জন্মানো যেত। প্রতি দুই বছরে একটি শস্যক্ষেত্রে মাত্র একবারই ফসল ফলত। তখনো মুসলিমগণ আন্দালুসে পা রাখেনি। অবশেষে তারা যখন আসল তখন কিছু নতুন পদ্ধতি এবং নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটাল। একটি ছিল “ক্রপ রোটেশন টেকনিক”, অর্থাৎ একটি মাঠে সবসময় একই ফসল চাষ না করে কাল এবং আবহাওয়া অনুযায়ী বিভিন্ন ফসল চাষ করা। এতে করে দেখা গেল প্রয়োজনীয়তা পূরণের স্বার্থে এবং প্রক্রিয়া চলমান রাখার জন্য বেশকিছু নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হলো। বিশেষত সেখানে ভারত উপমহাদেশীয় ফসলও ছিল। আমরা জানি ভারতীয় অঞ্চলের ফসলের ক্ষেত্রে সাধারণত উষ্ণ আবহাওয়ার প্রয়োজন হয় এবং লম্বা গ্রীষ্মকালের গুরুত্ব এসবের ফলনে অপরিসীম। যদিও এই অঞ্চলে হালকা বৃষ্টির সাথে শুষ্ক মওসুমের দেখাও পাওয়া যায়। মুসলিম বিজ্ঞানীরা চমৎকার সেচ কার্যক্রমের মাধ্যমে আন্দালুসে বিপ্লব ঘটিয়েছিল, তারা বছরে চারটি ফসলি মওসুম নিয়ে আসতে পেরেছিল।
প্রায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের ফসল, যেমন কলা, আন্দালুসের উপকূলীয় অংশে চাষ হতো। এ ছাড়াও ধান, লেবুজাতীয় ফল, পিচ, আলুবোখারা, রেশম, খুবানি, সুতা, শাকজাতীয়, জাফরান এবং আখও উৎপাদন শুরু হয়। আন্দালুসে আখের পরিচিতি পাওয়া ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণে বিরাট অবদান রেখেছিল। মুসলিমদের হাত ধরে এটি ইথিওপিয়াতেও পৌঁছে। পূর্ব আফ্রিকান দ্বীপ জাঞ্জিবার আখ থেকে উৎকৃষ্টমানের চিনি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল।
অরিয়েন্টালিস্ট গাই লি স্ট্রেঞ্জের বক্তব্যে, “পাশ্চাত্যে আখের আবাদ পারস্যের খুরজিস্তান থেকে ছড়িয়েছিল। পুরো মধ্যযুগ জুড়েই প্রাচীন সুসা আখের বৃহৎ উৎপাদনের জন্য পরিচিত ছিল। চিনিশোধনবিদ্যা আরবদের দ্বারা বিশেষভাবে লাভবান হয়েছিল। মুসলিম শাসনামলেই ভারত থেকে মরক্কো পর্যন্ত এর বৃদ্ধি এবং উৎপাদন হতো। স্পেন এবং সিসিলি মুসলিম শাসনাধীনে এলে ইউরোপেও এর বিস্তৃতি ঘটে।”
এভাবে রেশম শিল্পেরও বিকাশ ঘটে। শণ চাষ করা হয় এবং পাটজাত কাপড় তৈরি করা হয়। এস্পার্টো ঘাস (কাগজ বানানোর জন্য বিশেষ ঘাস) স্পেনের শুষ্ক অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে জন্মাত। এগুলো সংগ্রহ করে ঝুড়ি এবং পাপোশ বানানো হতো।
দশম শতাব্দীর মুসলিম ঐতিহাসিক এবং পর্যটক আল-মাসুদী কমলা এবং লেবুজাতীয় ফল নিয়ে আলাপ লিখেছিলেন। তার লেখায় এসেছে, “কমলা গাছ বা শাজার আল-নারানজ এবং লেবুজাতীয় গাছ বা আল-উতরুজ আল-মুদাওয়ার ৩০০ হিজরি/ ৯১২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ভারতীয় অঞ্চল থেকে এনে ওমানে রোপিত হয়েছিল। সেখান থেকে বসরা হয়ে ইরাকে পৌঁছে সিরিয়াতেও স্থান নিয়েছিল। খুবই কম সময়ে এরা বাড়ি বাড়ি বিস্তার পেয়েছিল বিশেষত তারসাস এবং অন্যান্য সিরিয়ান সীমান্ত ও উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে। শিগগিরই তারা অ্যান্টিয়োক, কুদস এবং মিসরেও ছড়িয়ে পড়েছিল যেখানে কিছুদিন আগেও এসব অপরিচিত ছিল।”
এভাবে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ইচ্ছার কারণেও বিভিন্ন শস্যের আগমন হতো। প্রথম আব্দুর রহমান, যার সিরিয়ান উপত্যকার জন্য আলাদা ভালোলাগা ছিল, তিনি বেশকিছু প্রজাতি নিয়ে আসেন, খেজুর গাছ সেসবের অন্যতম। তিনি আন্দালুস অঞ্চলকে যতটা পারা যায় তার মাতৃভূমির মত করে সাজাতে চেয়েছিলেন। মুয়াবিয়া বিন সালিহ, কর্ডোভার বিচারপতি ছিলেন, তার মাধ্যমে দামেস্ক থেকে আনা ডালিমের বিভিন্ন প্রজাতিও চাষ হয়েছিল। ছফর নামীয় একজন জর্ডানিয়ান সৈনিক একটি ডুমুরের চারা নিয়ে গিয়ে মালাগায় তার সম্পত্তিতে বুনেছিল। পরবর্তীতে ছফরী নামে পরিচিত হওয়া এই প্রজাতিটি পুরো আন্দালুস জুড়েই ছড়িয়েছিল।
এসব নতুন শস্যগুলোর সম্পূর্ণ আলাদা পরিবেশ এসে সফল হওয়ার পিছনে কৃষকদের ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির জন্য উপযুক্ত মাটির সন্ধান পাওয়া একটি বড় ব্যাপার ছিল। তারা কলম এর মাধ্যমে বিভিন্ন উদ্ভিদের মাঝে পারদর্শিতার সাথে সমন্বয় ঘটাত। এছাড়াও তাদের থাকত বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তি, গবেষণা এবং সংরক্ষিত থাকা প্রাচীন পদ্ধতিগুলো যাচাই ও ব্যবহারের পূর্ণ অনুমোদন। মূল কথা হচ্ছে, বিশেষজ্ঞদের সাথে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের থাকত সার্বক্ষণিক, সহজ ও স্বচ্ছ যোগাযোগ এবং লাইব্রেরিগুলো আকণ্ঠ ছিল কৃষি নিয়ে উচ্চতর সব গবেষণায়।
যুগোপযোগী সেচব্যবস্থা
আমরা আগে জেনেছি উষ্ণ অঞ্চলের শস্যগুলোও আন্দালুসের মাটিতে জন্মাত। স্বভাবতই তাদের প্রয়োজন হতো অতিরিক্ত পানির যেহেতু আন্দালুস শুষ্কপ্রধান এলাকা। যেমন, আখ, প্রতি চার কিংবা আট দিনে এটায় পানি দিতে হয়। ধানকে জলমগ্ন করে রাখা লাগে। সুতা ১১ শতকের শেষভাগে উৎপাদন শুরু হয়। ঐতিহাসিক ইবনে বাসালের মতে, ফুল ফোটার পর থেকে প্রতি দুই সপ্তাহে পানি দিতে হতো আগস্ট মাস পর্যন্ত। আন্দালুস সুতায় স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকায় উৎপন্ন দ্রব্যগুলো আলজেরিয়া, আফ্রিকায় রফতানি করা হতো। কমলা, লেবুজাতীয় ফল, বিভিন্ন শুষ্ক শস্যসহ অন্যান্য ফলের জন্যও প্রয়োজন হতো নিয়মিত সেচ কার্যক্রমের।
প্রশ্ন আসে কিভাবে তারা এই প্রয়োজনগুলো মেটাত? তাদের ছিল বৃহৎ এবং প্রকাণ্ড সেচব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা শুধু কিছু ইলেকট্রিক পাম্প এবং প্লাস্টিক পাইপ দিয়ে তৈরি ছিল না বরং তৎকালীন উন্নত প্রযুক্তির বুদ্ধিকৌশলময় যন্ত্রপাতির ব্যবহারও ছিল। পানিকে পৃষ্ঠ থেকে কয়েক মিটার উঁচুতে নিয়ে ধারাবাহিক প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য পাইপসহ জলচাকা ব্যবহার করা হতো। শুধুমাত্র ভ্যালেন্সিয়াতেই এরকম প্রায় আট হাজারটি জলচাকা ছিল যেগুলো পার্শ্ববর্তী ধানক্ষেতসমূহে পানি সরবরাহ করত।
কৃষির বিভিন্ন অনুষঙ্গে বিশেষত ভারী যন্ত্রপাতি সংক্রান্ত কাজে পশুদের কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়াও কর্কশ ভূমিতে ভূগর্ভস্থ নল খননে কিংবা বিরান মরুতে নল বানানোতে তারা ব্যবহৃত হতো যেমন সাহারায় হয়েছিল। এভাবে জলাধার থেকে মাঠে পানি নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন হতো সঠিক এবং যথার্থ হিসাব-পরিমাপের। আমরা জানি গণিত, ক্রিকোণমিতি এবং ক্যালকুলাসে মুসলিমদের প্রভূত উন্নতির কথা, যা তাদের এই কাজগুলো অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিক করে দিয়েছিল। এসপি স্কটের বর্ণনা আবারো সামনে আসে। তিনি বলেন, “স্প্যানিশ মুসলিমদের কৃষিব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত জটিল তবে মানুষদের দ্বারা তৈরি হওয়া সবচেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক এবং যথার্থ একটি প্রক্রিয়া”।
নতুন জমি মালিকানা পদ্ধতি
এই বিপ্লবের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ছিল এই নতুন জমি মালিকানা পদ্ধতি। খাবার উৎপাদন শিল্পে এটি ছিল সাহসী এবং সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত। এতে করে কৃষকরা নিজেদের এবং সমাজের জন্য আরো বেশি কাজ করতে পারত। কোনো লোভী, অপরিণামদর্শী জমিদারের অধীনে তাদের থাকতে হতো না। এখানেই আমরা শ্রমিকদের অধিকার সংক্রান্ত আইনের কথা পাই। বলা যায় এটি ছিল একটি বিপ্লবী সংস্কারধর্মী সামাজিক পরিবর্তন। যেকোনো ব্যক্তিরই জমি বেচাকেনা, বন্ধক, উত্তরাধিকার কিংবা চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কৃষি, প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্য কিংবা চাকরি সম্পর্কিত সব ধরনের কাগজপত্রই সংরক্ষিত হতো। কর্মচুক্তির দলিল উভয়পক্ষের নিকটেই থাকত। মাঠকর্মীরা তাদের পরিশ্রমের জন্য উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেত। তখনকার সময়ের উদ্ধার পাওয়া বিভিন্ন রেকর্ড থেকে এসবের বিস্তারিত জানা যায়।
উপরোক্ত চারটি উদ্ভাবন- যথাক্রমে কৃষি সংক্রান্ত বৈশ্বিক জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, নতুন শস্য ও প্রজাতি উদ্ভাবন, যুগোপযোগী সেচব্যবস্থা এবং নতুন জমি মালিকানা পদ্ধতি, এই চারটি কৃষির পট এতটাই পাল্টিয়েছিল যা বিশ্ব আগে অবলোকন করেনি। মানুষ আগে দৈনন্দিন জীবিকা নির্ভর বসবাস করত। হঠাৎ করেই তাদের জীবনযাত্রার মানের নাটকীয় উন্নতি হলো এবং সামর্থ্যানুযায়ী লোকদের দস্তরখান তাজা ফলমূল ও শাক-সবজি দ্বারা ভরে উঠল। এসব পুরো বছর জুড়েই পাওয়া যেত। লেবুজাতীয় ফল এবং কমলার চাষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাজার বাহারি ফুল-ফলের ঘ্রাণে ডুবে থাকত। এসব সম্ভব হয়েছিল ভারী এবং শ্রমসাধ্য চাষাবাদের মাধ্যমে। এতে যদিও মাটির উর্বরতা কমে যাওয়ার প্রবণতা থাকত তবে উন্নত কৃষিপদ্ধতি এবং উপযুক্ত সারের যুগপৎ ব্যবহার তা হওয়া থেকে আটকাত। এসব ক্ষেত্রে কবুতরের গোবরের ব্যাপক ভূমিকা ছিল।
পশুর ভূমিকা শুধু কৃষিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, বিবিধ আরো উপকার পাওয়া যেত। বিভিন্ন অঞ্চলের একই জাতের পশুদের মাঝে ক্রসিং করার ফলে আরো উন্নত এবং বেশি অভিযোজী পশু জন্ম নিত। এতে করে তারা পেয়েছিল অধিক বলশালী ঘোড়া থেকে শুরু করে সাহারা পাড়ি দেওয়া ক্লান্তিহীন উটও। গোশত ছিল এখানে সহজাত পণ্য। গোশতকে পূর্বে বিলাসীয় বস্তুর সাথে গণনা করা হতো। এছাড়াও পশুর গোবর থেকে সারও পাওয়া যেত। সবশেষে তাদের চামড়া থেকে আসত উৎকৃষ্ট মানের উল। সেসব দিয়ে তৈরি হতো পোশাক, ঢাল, থলে থেকে শুরু করে জুতাও। তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া এবং মরক্কো চামড়া শিল্পের দক্ষতার জন্য বিশ্বজুড়ে সুনাম অর্জন করেছিল। রেশম এবং তুলা উৎপাদনেও সমৃদ্ধি এসেছিল। ভারতীয় পণ্য তুলা সিসিলি এবং আন্দালুসের প্রধান রফতানি দ্রব্য হয়ে উঠতে বেশিদিন সময় নেয়নি। স্বল্প সময়েই মানুষের পোশাকের আভিজাত্যতা এবং বিচিত্রতা ছিল লক্ষণীয়।
একজন ফ্রেঞ্চ অধ্যাপকের বক্তব্য দিয়েই সমাপ্তি টানা যাক। তিনি বলেছেন, “একটি যাযাবর গোষ্ঠী শুধু ময়দা এবং বার্লি মাখানো ছেড়ে কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে এত বিশেষ বিশেষ অবদান রেখেছে তা স্বীকার করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। যদি সঠিক ইতিহাস এবং প্রাচীন নথির দিকে তাকাই তবে আমাদের অনেক ভুল ধারণাই উবে যাবে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হবে।”
আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেভাবে পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৎকালীন মানুষদের সর্বোৎকৃষ্ট জীবনযাত্রার সুযোগ দিয়েছিলেন আমাদেরকেও সেই পথে হাঁটতে হলে একই পরিমাণের কষ্ট, পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর নতুন কৃষি বিপ্লবে তবেই আমরা অংশ নিতে পারব।
লেখক : আন্তর্জাতিক ইতিহাস গবেষক ও এমিরেটাস প্রফেসর
অনুবাদক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মন্তব্য লিখুন