post

কোভিড

ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম

০৮ মে ২০২২
মানুষের দুঃখ, কষ্ট, বেদনাকে কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। কারণ তা এমন এক অব্যক্ত জিনিস যা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি ভিন্ন হয়। এ জন্য বলা হয় মানুষের কষ্ট দেখাটাই বড় কষ্টের। যারা প্রকৃত মানুষ তারা ব্যথা অনুভব করেন হৃদয় দিয়ে। করোনায় সমগ্র দুনিয়া আজ স্তব্ধ! মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিনেই দীর্ঘ হচ্ছে! মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। থমকে গেছে কোলাহল, দাম্ভিক, ক্ষমতাশালী আর বিত্তবানদের অহঙ্কার! প্রতাপশালী আর বিত্তবৈভব আর প্রাচুর্যের অধিকারীরাও বলে উঠছে! আকাশের মালিকই জানে কী হতে যাচ্ছে! সবাই সমস্যার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে কিন্তু কোন কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না! আজ কামান-গোলা বারুদ আর গুলির আওয়াজ নেই কিন্তু প্রতি মুহূর্তে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। মা জানে না সন্তানের মৃত্যুর খবর! সন্তান থাকতে পারছে না পিতা-মাতার জানাজায়! সন্তানের দাফন হচ্ছে পিতা-মাতার অনুপস্থিতিতে। সবাই সবার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে! এ যেন কেয়ামতের সেই দৃশ্য! আল্লাহ বলেন- “সেদিন মানুষ পালাতে থাকবে নিজের ভাই, বোন, মা, বাবা, স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের থেকে। তাদের প্রত্যেকে সেদিন এমন কঠিন সময়ের মুখোমুখি হবে যে, নিজের ছাড়া আর কারোর কথা তার মনে থাকবে না।” (সূরা আবাসা : ৩৪-৩৭) হয়তো কোন দিন খুঁজে পাবে না আপনজনের কবরের হদিসটুকুও! কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন- “ছবি আমার বুকে বেঁধে পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে ফিরবে মরু কানন গিরি সাগর আকাশ বাতাশ চিরি, সেদিন আমায় খুঁজবে বুঝবে সেদিন বুঝবে।” পৃথিবীর এই বোবা কান্নার আওয়াজ আমাদের হৃদয়কে ভেঙে খান-খান করে দিচ্ছে। কবি মতিউর রহমান মল্লিকের ভাষায় আজ বলতে হয়- “পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয়/ মরণ একদিন মুছে দেবে সকল রঙ্গিন পরিচয়.../ মিছে এই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, মিছে গান কবিতার ছন্দ/ মিছে এই অভিনয় নাটকের মঞ্চে, মিছে এই জয় আর পরাজয়।” পৃথিবীর তথাকথিত ত্রাণকর্তারাই আজ ধরাশায়ী! কে এগিয়ে আসবে কাকে রক্ষা করতে? কে বাঁচাবে বিশ্বমানবতাকে? নিরুদ্দেশ গন্তব্যে আজকের পৃথিবীর মানুষের এই যাত্রা--। জ্ঞান-বিজ্ঞান আর তথ্যপ্রযুক্তির শীর্ষে যাদের বাস তারাও আজ বারবার আকাশের পানে তাকাচ্ছে--! পারমাণবিক বোমা, মিসাইল, নভোচারী, কামান ড্রোন সবই এখানে ভোঁতা। এইতো কয়দিন আগে বিশ্ববাসী এগুলোর ব্যবহার দেখেছে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এখন এসব কোনই কাজে আসছে না। সবাই আজ দারুণ অসহায়! পৃথিবীর মোড়লদের আজ বড়ই ক্ষমতাহীন লাগছে!। এবার সবার আগে করোনার আক্রমণে লণ্ডভণ্ড উন্নত রাষ্ট্রগুলো। এর শেষ যেন সবারই অজানা। হ্যাঁ একজনই আমাদের রক্ষা করতে পারেন। তিনি হচ্ছেন আমার-আপনার আমাদের সকলের সৃৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। যিনি করোনা সহ সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। “ইন্নাল্লাহা আলা কুল্লি শ্ইায়্যিন কাদির” পৃথিবী, আকাশসমূহ ও সমগ্র জাতির ওপর রাজত্ব আল্লাহরই জন্য নির্ধারিত এবং তিনি সবকিছুর ওপর শক্তিশালী। (সূরা মায়েদা : ১২০) সেই সুপ্রিম পাওয়ার আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতা নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। ফিরে যেতে হবে তাঁরই দিকে। সু-উচ্চকণ্ঠে বলতে হবে “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।” আল-কুরআনে বলা হয়েছে- “বলো: হে আল্লাহ! হে বিশ্বজাহানের মালিক! তুমি যাকে চাও রাষ্ট্রক্ষমতা দান করো এবং যার থেকে চাও রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনিয়ে নাও যাকে চাও মর্যাদা ও ইজ্জত দান করো এবং যাকে চাও লাঞ্ছিত ও হেয় করো। কল্যাণ তোমার হাতেই নিহিত। নিঃসন্দেহে তুমি সবকিছুর ওপর শক্তিশালী।” (সূরা আলে ইমরান : ২৬) “এখন যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন তাহলে তারা তো আপনার বান্দা আর যদি মাফ করে দেন তাহলে আপনি পরাক্রমশালী ও জ্ঞানময়।” (সূরা মায়েদা : ১১৮) এ সময়ে আমাদের দেশে আজ কী হচ্ছে তা মিডিয়া ও বিভিন্ন মাধ্যমে সবাই জানতে পারছেন। বাংলাদেশের জনগণও এমনি এক কঠিন শঙ্কার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। সামনে কী অপেক্ষা করছে তা আল্লাহ ভালো জানেন। তবে সর্বপর্যায়ে চলছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। মানবতার এই ক্রান্তিকালে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা একমাত্র আল্লাহই দিতে পারেন এটাই সত্য। আর জমিনে উসিলা হিসেবে জীবন বাজি রেখে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন আমাদের প্রিয় ডাক্তাররা। করোনায় আক্রান্ত হয়ে নির্মমভাবে প্রথম জীবন দিয়েছেন। ডেইলি স্টারের রিপোর্টে প্রকাশ- “গত ৮ এপ্রিল, যখন কোভিড-১৯ আক্রান্ত ডা: মো: মঈন উদ্দিনকে সিলেট থেকে ঢাকায় রেফার করা হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে কেনো তাকে সিলেটের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ভর্তি করা হলো না। নাকি সিলেটের আইসিইউ সচল নয়। সে রাতেই জরুরি একটি সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে একটি ব্যাখ্যা দেয় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বুধবার ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে তার মৃত্যুর পর বিষয়টি নিয়ে আবারো আলোচনা শুরু হয়েছে। ডা: মঈন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং এখন পর্যন্ত দেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা একমাত্র ডাক্তার।” যিনি এলাকায় গরিবের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাছাড়া তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য সরকার সামান্য মাস্ক, পিপিই ব্যবস্থা করতে না পারা দুর্ভাগ্যজনক!! এটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক ও অপমানকর। দেশ, জাতি ও মানবতার বন্ধু আমাদের প্রিয় ডাক্তার, নার্স ও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর নিরাপত্তায় রাষ্ট্রীয় আয়োজনে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। মহান মাবুদের দরবারে দোয়া করি আল্লাহ তাদেরকে রহমতের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখুন। একই সঙ্গে যারা দিন আনে দিন খায়-এমন শ্রমিক, নিঃস্ব ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের খাদ্যসামগ্রীসহ অন্যান্য উপকরণ নিশ্চিত করতে খুব বেশি উদ্যোগ নেই রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। শ্রমিকদের ছুটি নিয়ে ঘটে গেল তেলেসমাতি। এখনো চলছে “করোনার ঝুঁকির মধ্যেও পোশাক কারখানা বন্ধ করতে চাননি শিল্পমালিকেরা। তাতে সায় ছিল সরকারেরও। মূলত মালিকদের পাশাপাশি সরকারের শ্রম এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তহীনতা ও সমন্বয়হীনতার কারণেই ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব না মেনে ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক ঢাকা ও আশপাশের শিল্পাঞ্চলে ফিরেছেন।” (সূত্র : প্রথম আলো) এটি দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। এটি সাধারণ শ্রমিকদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনির শামিল। অবিলম্বে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকার কার্যকর রেশনের ব্যবস্থা করবে এটি সকলের দাবি। তা ছাড়া বিত্তবানরা অসহায় মানুষের প্রতি তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবে এটাই সময়ের দাবি। মহামারীর ইতিহাস পৃথিবীতে এ মহামারী নতুন কিছু নয়। এভাবে তিনি দুনিয়ার বুকে বিভিন্ন রকম পরীক্ষা দিয়ে ছাঁটাই-বাছাই করেছেন ইতঃপূর্বে। সেই ইতিহাস থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়নি। সময়ের সাড়া জাগানো আলোচক ড. ইয়াসির কাদি আরো বলেছেন- “পৃথিবীর ইতিহাসে শত শত মহামারীর ঘটনা ঘটেছে। প্রথমটি হলো ধ্বংসাত্মক প্লেগ। ১৩৩২ থেকে ১৩৫০ ইংরেজি সন সময়ে পর্যন্ত এই ব্ল্যাক ডেথ অথবা ব্ল্যাক প্লেগ নামে মহামারীটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এতে সারা দুনিয়াতে প্রায় ২০০ মিলিয়ন (২০ কোটি) মানুষ মারা যায়। বলা হয়ে থাকে যে, এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠে জনসংখ্যা স্বাভাবিক হতে ইউরোপের প্রায় ২০০ বছর সময় লেগে যায়। সে সময়ে মুসলিম দেশগুলোও এই ব্ল্যাক ডেথ নামক মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছিলো যাতে সে সময়কার অনেক ওলামা মারা যান। অনেকেরই পরিবারের সদস্য মৃত্যুবরণ করে। দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো ‘স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা’। এটা একশত বছর ১৯১৮ সালে ঘটেছে। সে সময়ে চলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে এটি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে যাতে প্রায় ১০০ মিলিয়ন বা ১০ কোটি মানুষ মারা যায়। ‘স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা’ হিসেবে নামকরণ করার কারণ এটা নয় যে এ মহামারী শুধু স্পেনেই ঘটেছিল। বরং সে সময়কার মিডিয়া ব্রিটিশ, কানাডা ও আমেরিকা নিয়ন্ত্রণ করত। তারা তাদের দেশের মহামারী সম্পর্কে মিডিয়াতে তেমন কিছু আসতে দেয়নি। যেটি হয়তো আজ মিডিয়া কন্ট্রোল চায়না করেছে। তাদের অনেক খবরই দুনিয়াবাসী জানতে পারছে না। যেমন উইঘর মুসলমানদের উপর দমন-নিপীড়নের দৃশ্য পৃথিবীর মানুষের নিকট এখনো অজানাই রয়ে গেলো! তাই বলছিলাম এই স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা আর বর্তমানে প্রকট হওয়া করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ একই পরিবারভুক্ত ভাইরাস। যদিও এটা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা এখনো অনেক গবেষণা করে যাচ্ছেন। সর্বপ্রথম যে মহামারীর কথা আলোচনা করা জরুরি তা হলো ‘আমাওয়াসের প্লেগ’। এটি ইমাওয়াস নামক এক শহরের নাম হতে এর উৎপত্তি। মুসলিম উম্মাহ সর্বপ্রথম এই প্লেগের সম্মুখীন হয়। এই প্লেগ থেকে বেঁচে যাওয়া কেউ কেউ এটিকে জাস্টিনিয়ান প্লেগও বলে থাকেন। এটা রোমান সা¤্রাজ্যে ৫৪১ খ্রি. হতে ৭৫০ খ্রি. পর্যন্ত কয়েকবার ঘটে। রোমান শাসক জাস্টিনের শাসনামলে শুরু হওয়ার কারণে এটিকে প্লেগ অব জাস্টিনিয়ান বলে অভিহিত করা হয়। প্রতিবার এই মহামারীতে কনস্টান্টিনোপলে প্রতিদিন ১০,০০০ মানুষ মারা যেতো। এতে ইউরোপের অর্ধেক জনসংখ্যা আক্রান্ত হয়। ‘আমাওয়াসের’ প্লেগ এগুলো নবী (সা.) এর ইন্তেকালের পরের ঘটনা। ১৮ হিজরি সনে এটি ঘটে। এটি সে সময়কার কথা যখন উমর (রা) এর নেতৃত্বে মুসলিমরা একের পর এক দেশ জয় করছেন। রোমান সা¤্রাজ্যের অধীনস্থ শাম, দামেস্ক, জেরুসালেম প্রভৃতি জয় করেন। এ সময় মুসলমানদের সাথে রোমান সৈন্যদের মুখোমুখি যুদ্ধ চলছে। অত্র অঞ্চলে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ। যিনি জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জন সাহাবীর অন্যতম। আবু উবায়দা (রা)-কে উমর (রা) সর্বোচ্চ কমান্ডারের দায়িত্ব দেন। তিনি একটি বাহিনী নিয়ে শামের দিকে রওনা হন যারা পূর্বের বাহিনীর সাথে যোগ দিবে। তিনি যখন শামের কাছাকাছি একটি জায়গায় পৌঁছলেন তখন জানতে পারলেন সেখানে প্লেগ রোগ মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় সেখানে প্রবেশ করবেন না ফিরে যাবেন সে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য উপস্থিত মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের কাছ থেকে মতামত গ্রহণ করেন। মুহাজিরগণের মধ্যে দুই ধরনের মতামত প্রদানকারী পাওয়া যায়। আনসারগণের কাছ থেকেও একই রকম মতামত পাওয়া যায়। এ সময়ে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ বললেন, এ বিষয়ে আমি রাসূল (সা.) থেকে একটি হাদীস শুনেছিলাম- “যদি তোমরা কোনো প্লেগ আক্রান্ত এলাকায় থাকো, তাহলে সেখান থেকে পলায়ন করো না। আর যদি এর বাইরের অধিবাসী হও তাহলে প্লেগ আক্রান্ত এলাকায় প্রবেশ করো না।” তখন এ বিষয়টি সুরাহা হয়ে গেলো। তখন উমর (রা) বললেন আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার তাওফিক দিয়েছেন। ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ জীবনাদর্শ। ইসলাম যে ব্যাপারে যার জ্ঞান রয়েছে তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। যেমন করোনার সময়ে মসজিদে নামাজ হবে কি? না বন্ধ থাকবে। তা কিন্তু আলেম-ওলামাদের সাথে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে পরামর্শ করলে আমাদের দেশে সিদ্ধান্ত গ্রহণে এত দেরি হতো না। যেমন দরুন এখন এই দুর্যোগ মোকাবেলায় চিকিৎসা সেবার সাথের লোকেরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু পরের অধ্যায় হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, বেকারত্ব, কর্মসংস্থান, এক কথায় অর্থনীতি সচল রাখার হিসাব নিকাশ কষতে হবে অর্থনীতিবিদদের। সে দুর্যোগের ঘনঘটা কড়া নাড়ছে! জাতিসংঘ বলছে -বিশ্বজুড়ে চলছে করোনাভাইরাসের তাণ্ডব। এ কারণে অনেক দেশে চলছে লকডাউন। আর এ প্রেক্ষিতে বিশ্বজুড়ে খাদ্যসঙ্কটের কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। এমনটাই আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘ বলছে, খাবারের অভাব এখনই তৈরি হয়নি। কিন্তু লকডাউনের জেরে যেভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন এবং পরিবহন বন্ধ হয়ে পড়েছে, তাতেই সঙ্কট সৃষ্টির সম্ভাবনা। করোনা আতঙ্কের জেরে বিশ্বের বহু দেশে সম্পূর্ণরূপে লকডাউন চলছে। বন্ধ আন্তর্জাতিক সীমান্ত। আকাশপথ পুরোপুরি বন্ধ, ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা স্থবির। যে সমস্ত দেশে উপযুক্ত পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন হয় না, যাদের খাদ্যের জন্য অন্য দেশের উপর নির্ভর করতে হয়, সেই সমস্ত দেশ চরম সমস্যায় পড়তে পারে। শুধু তাই নয়, যে সমস্ত দেশ উপযুক্ত পরিমাণ খাদ্য তৈরি করতে পারে, তাদেরও সমস্যায় পড়তে হতে পারে। আন্তঃরাজ্য সীমান্ত সিল করার দরুন সেই দেশগুলিতেও খাদ্য সরবরাহের শৃঙ্খল নষ্ট হতে পারে। এই দেশগুলির কাছে আসল চ্যালেঞ্জ হল, মজুদ খাদ্য অভুক্তদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া। একটি সমীক্ষা বলছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০ কোটি মানুষ ইতোমধ্যেই খাদ্যসঙ্কটে ভুগছেন। জাতিসংঘের ধারণা, আগামী দিনে এই সংখ্যাটা আরও বাড়তে পারে। জাতিসংঘের খাদ্য সুরক্ষা সংক্রান্ত কমিটির আশঙ্কা, খাদ্যের এই সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে গরিব ও প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ। এই উদ্ভূত সঙ্কট থেকে রক্ষা পেতে দ্রুত বিশ্বজুড়ে খাদ্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা উচিত বলে মনে করছে জাতিসংঘের ওই কমিটি। (কালের কণ্ঠ) তাই অর্থনীতিবিদদের সেই ডিজাইন করতে হবে বিশ্বব্যাপী। তাই সমাজের বিশেষজ্ঞ শ্রেণীর ব্যক্তিদের স্ব-স্ব কাজে নিয়োজিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। নচেৎ সর্বপর্যায়ে তৈরি হবে বিশৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমাজের সাধারণ জনগণ। ‘আমাওয়াসের’ প্লেগ দেখা দিলে সে এলাকায় প্রবেশ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মানের সাহাবীদের ক্ষেত্রেও ভিন্ন ভিন্ন মত দেখা গেছে। এখানে প্রথম দিকের মুসলমানদের চেয়ে মক্কা বিজয়ের পর মুসলমান হওয়া কুরাইশ নেতাদের মতামত উমর (রা) এর কাছে বেশি প্রাজ্ঞোচিত মনে হয়েছে। যদিও মর্যাদার দিক থেকে এরা অনেক নিচে। এটা আসে বয়স, অভিজ্ঞতা ও দুনিয়াবি জ্ঞান থেকে। উক্ত ঘটনাটি থেকে এটাই প্রমাণিত হয়। এ জন্য লকডাউন দেয়া, মসজিদে নামাজ পড়া না পড়া, মার্কেট খোলা এ সকল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শ নিতে হবে। নচেৎ ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ইসলামের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে গুরুত্ব প্রদান করে। এরপর উমর (রা) তার সঙ্গীদের নিয়ে মদীনায় ফিরে গেলেন। মদীনায় যাওয়ার পর তিনি আবু উবায়দা (রা)-এর মত একজন দক্ষ সেনাপতি প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে মুসলমানদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে উপলব্ধি করে তাকে ফেরত আনার জন্য একটি চিঠি দিলেন। চিঠিতে লিখলেন আপনার সাথে আমার জরুরি বিষয় আলাপ করা দরকার। পত্র পাওয়া মাত্র মদীনায় রওনা হবেন। আবু উবায়দা (রা) বুঝতে পারলেন উমর (রা) তাকে কেন ডেকেছেন। তিনি জবাব লিখলেন, আমি আমার সৈন্যদেরকে এ অবস্থায় ফেলে যেতে পারব না। আল্লাহর সিদ্ধান্ত যা হবার তা হবেই। আপনি আমার উপর থেকে এ আদেশ প্রত্যাহার করবেন আশা করি। আবু উবায়দা (রা) তার সঙ্গীদেরকে ডেকে নিয়ে বললেন, তোমরা জানো প্লেগ রোগে মৃত্যুবরণ করলে সে শহীদ হবে। অতএব আমরা শাহাদাতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছি। তিনি মারা গেলে বিখ্যাত সাহাবী রাসূল (সা)-এর প্রিয় মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা) সেনাপতির দায়িত্ব লাভ করেন। তিনিও একই দোয়া করেন। পরে সপরিবারে একই রোগে মারা যান। এরপর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন আমর ইবনুল আস (রা)। ততদিনে মুসলমানদের ২৫- ৩০ হাজার সৈন্য প্লেগরোগে মারা গেছে। আমর বিন আস (রা)-এর বিজ্ঞোচিত সোশ্যাল আইসোলেশন উদ্যোগ : আমর ইবনুল আস (রা) রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞাবান নেতা ছিলেন। সাহাবীদের মর্যাদার শ্রেণী বিবেচনায় যদিও মুয়াজ (রা) বা উবায়দা (রা) তার চেয়ে অনেক উপরে। আমর বিন আস (রা) সৈন্যদেরকে নির্দেশ দিলেন ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ে দূরে দূরে গিয়ে ক্যাম্প করে আলাদা আলাদা থাকতে। এতে অনেকেই তাকে কাপুরুষ মনে করে জনসমক্ষে অপমান করে। কিন্তু তিনি তা গায়ে মাখেননি। তিনি বললেন আমি চাই আমার সৈন্যদের জীবন রক্ষা হোক। পরবর্তীতে প্লেগের সংক্রমণ কমে যায়। এতে তার বাকি সৈন্য রক্ষা পায়। এটাকেই এখনকার সময়ে আমরা সোশ্যাল আইসোলেশন বলছি। মুসলমানদের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য ভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে গেলে অনেক ধরনের সমালোচনা হতে পারে যা এই ঘটনা থেকে জানা যায়। আমর বিন আস এর পূর্বের দু’জন সেনাপতি সাহাবার মর্যাদায় অনেক উপরে। ইসলাম গ্রহণের অগ্রগামিতায়ও তারা অনেক এগিয়ে। কিন্তু রাজনৈতিক জ্ঞানের দিক চিন্তা করলে তারা তাদের সৈন্যদের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমর তা করেননি। তিনি পলিটিক্যাল নলেজের দিক থেকে তার পূর্বসূরিদের চেয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এটি জাগতিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ব্যাপার। এর সাথে তাকওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। রাজনৈতিক দক্ষতা, কমিউনিটি লিডারশিপের সাথে তাকওয়া বা শরয়ী জ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলির সব একজন ব্যক্তির মধ্যে নাও থাকতে পারে। একেকজন একেক গুণের অধিকারী হয়। এভাবে আইসোলেটেড থাকার ধীরে ধীরে প্লেগ রোগ সংক্রমণ কমে গিয়ে সম্পূর্ণভাবে দূরীভূত হলে তারা পুনরায় রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। আর এটাই ইতিহাসে আমাওয়াস বা এমাওয়াস প্লেগ নামে রেকর্ড হয়ে আছে। এমাওয়াস বর্তমানে ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত। এই মহামারীতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার মুসলিম সৈন্য মারা যায় যাদের মধ্যে অনেক সাহাবীও ছিলেন। এর মধ্যে অনেক প্রবীণ সাহাবীও ছিলেন। আবু উবায়বা ইবনুল জাররাহ (রা), মুয়াজ ইবনে জাবাল, সুহাইল বিন আমর, ইয়াযিদ বিন আবু সুফিয়ান (রা) (মুয়াবিয়া রা.-এর বড় ভাই)। ইয়াযিদ বিন আবু সুফিয়ান (রা)কে দামেশক বিজিত হওয়ার পর উমর (রা) দামেশকের গভর্নর হিসেবে পাঠান। কিন্তু তিনি প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তার ভাই মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ানকে গভর্নর বানানো হয়। এই মুয়াবিয়া (রা) হতে উমাইয়া খিলাফাতের সূচনা হয়েছে যা ইসলামের ইতিহাসে বিরাট গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে। ২১৮ হিজরি সালে মিশরে একবার যে প্লেগ রোগ ছড়িয়েছিলো তার ফলে মিশরের প্রতিটি ঘরে কেউ না কেউ মারা যায়। এমনকি রাজা বাদশারাও মারা যায়। ২২৮ হিজরিতে এই রোগটি আজারবাইজানে ছড়ায়। এতে এত বেশি মানুষ মারা যায় যে তাদের দাফন করার মত কাপড়ও ছিলো না। এমনকি তাদেরকে দাফন করার জন্য মাটি বা মানুষও ছিলো না। রাস্তার উপর মানুষ মরে পড়েছিলো। একেকটি পরিবারকে দাফন করতে না পেরে তাদের ঘরের দরজা লাগিয়ে দেয়া হয়েছিলো। ইমাম যাহাবী লিখেছেন, ৪৪৮ হিজরিতে মিশর এবং আন্দালুসে এমন এক ভয়াবহ প্লেগ দেখা দেয় যে, মসজিদগুলিতে নামাজ পড়ার মতো মানুষ ছিলো না। ৭৪৯ হিজরিতে ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলসমূহসহ সারা পৃথিবীতে এক ভয়াবহ ব্ল্যাক ডেথ ছড়িয়ে পড়ে যে মসজিদগুলিতে নামাজ তো দূরের কথা আজান দেয়ারও মানুষ ছিলো না। করোনাভাইরাস ভয়াবহ রূপে দেখা দেয়ার পর মুসলিম ভাইদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে তা নিতান্তই অজ্ঞতাবশত। তাদের জানা উচিত ইসলামের ইতিহাসে এরকম বৈশ্বিক মহামারীর ঘটনা নতুন নয়। আগেকার সময়ে একটি রোগ বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নিতে কয়েক বছর এমনকি শতাব্দী পর্যন্ত লেগে যেতো। কিন্তু এবারেই প্রথম এত অল্প সময়ে সারাবিশ্বে করোনাভাইরাস নামক মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে আমাদেরকে শুধু অ্যাকটিভ নয় প্রো-অ্যাকটিভ হতে হবে। ৮৩৩ হিজরিতে এক ভয়াবহ প্লেগে ইবনে হাজার আসকালানি (রা) এর তিন মেয়ে মারা যায়। তিনি প্লেগ সম্পর্কে বিরাট গ্রন্থ রচনা করেন যা এনসাইক্লোপিডিয়া অব প্লেগ বলা হয়। এতে তিনি প্লেগ সম্পর্কে এত নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন যা অন্য কেউ দিতে পারেননি। তিনি একটি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে, রাসূল (সা.) বলেন, প্লেগ রোগ মুমিনদের জন্য রহমত আর কাফিরদের জন্য আজাব। আল্লাহ যেসব কাফিরকে শাস্তি দিতে চেয়েছেন এটা শুধু তাদের জন্যই আজাবস্বরূপ। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ঈমান থাকা অবস্থায় প্লেগ রোগে আক্রান্ত অবস্থায় মারা যায় সে শহীদ। আর মহামারী আক্রান্ত এলাকা ত্যাগ করা যাবে না। তবে যদি অন্যকোনো এলাকায় গেলে ভালো চিকিৎসা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে যাওয়া যেতে পারে বলে কিছু স্কলার মন্তব্য করেছেন। তবে মহামারীর কেন্দ্রে থাকা কেউ সে এলাকা ত্যাগ করতে পারবে না। রাসূল (সা.) এর একটি হাদীস আছে যে, কোনো রোগই ছোঁয়াচে নয়। কারণ রোগী তার রোগ অন্য কাউকে দিতে পারে না যদি আল্লাহ না চান। এ কারণে কিছু রোগ ছড়ায় আর কিছু রোগ ছড়ায় না। যেমন করোনা সহজেই ছড়ায় কারণ আল্লাহ তা এভাবেই চান। ইবনুল খাতিব বলেছেন, কোন ধরনের ছোঁয়াচে রোগের ক্ষেত্রেই ইতিহাস এবং অবজারভেশনকে ইগনোর করা যাবে না। এবং যদি আগের ফতোয়া প্রয়োগ করলে মুসলমানদের জীবনহানির আশঙ্কা দেখা দেয় তাহলে সেই ফতোয়া প্রয়োগ করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মুসলিমদের উচিত হবে সংক্রামক ব্যাধির ইতিহাস, ক্ষমতা এবং ক্ষতিকে পর্যবেক্ষণ করে নতুন সিদ্ধান্ত নেয়া। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাই তা ভালো বলতে পারেন। কারণ ঈমান এবং তাকওয়া এক জিনিস এবং জরুরি পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া অন্য জিনিস। তাই কোনভাবেই এই দু’টিকে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। কারণ জরুরি পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গৃহীত না হলে মানুষ মারা যাবে। পরবর্তীতে যতই তারা তাদের ভুল বুঝতে পারুক না কেন ক্ষতি পূরণ করার কোন উপায় থাকবে না। তাই মুসলমানদের অবশ্যই বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ছোঁয়াচে রোগের ব্যাপারে কেন এত সতর্কতা? বিশিষ্ট মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, প্রফেসর, কর্নেল (অব:) ডা: জেহাদ খান লিখেছেন- কারণ ইসলাম মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। শূকরের গোশত খাওয়া হারাম করা হয়েছে। কিন্তু মানুষের জীবন বিপন্ন হলে তা তখন হালাল হয়ে যায়: “নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের উপর হারাম করেছেন মৃত জন্তু, শূকরের গোশত এবং যা গায়রুল্লাহর নামে জবেহ করা হয়েছে। সুতরাং যে বাধ্য হবে, অবাধ্য বা সীমালঙ্ঘনকারী না হয়ে, তাহলে তার কোন পাপ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (আল কোরআন ২ : ১৭৩) নামাজের জন্য অজু করা ফরজ। কিন্তু পানি না পেলে তায়ামুমের অনুমতি দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আল্লাহ তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করতে চান না, বরং তিনি চান তোমাদের পবিত্র করতে এবং তার নেয়ামত তোমাদের উপর পূর্ণ করতে, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।” (আল কুরআন ৫ : ৬) রাসূল (সা.) নামাজের সময় কোন মায়ের সাথে আগত বাচ্চার কান্না শুনতে পেলে নামাজ সংক্ষিপ্ত করতেন। প্রতিকূল আবহাওয়ায় মানুষের কষ্টের কথা বিবেচনা করে তিনি জামাতে নামাজ পড়াকে নিরুৎসাহিত করতেন। আবু সালিহ তার পিতার থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি হুদায়বিয়ার সময় জুমার দিন নবী (সা.) এর কাছে হাজির হলেন। সেদিন সামান্য কিছু বৃষ্টি হয়েছিল যাতে তাদের জুতাও ভিজল না। এ অবস্থায় নবী (সা.) তাদেরকে নিজ নিজ তাঁবুতে নামাজ পড়ে নিতে আদেশ করলেন। (আবু দাউদ, নামাজ অধ্যায়) ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মুয়াজ্জিন মদিনাতে বাদলা রাতে এবং শীতের সকালে এরকম ঘোষণা করেছিলেন। (আবু দাউদ, নামাজ অধ্যায়) জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আল্লাহ ও তার রাসূলের মূলনীতি করোনাভাইরাস হচ্ছে খুবই ছোঁয়াচে একটি রোগ। প্রায় ১০০ বছর আগে তারই সগোত্রীয় ভাইরাস দ্বারা ঝঢ়ধহরংয ভষঁ তে ৫ কোটি লোক মৃত্যুবরণ করেছিল। ৮ ডিসেম্বর ২০১৯-এ কোভিড-১৯ প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর প্রতিদিনই লোক আক্রান্ত হচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এ পরিসংখ্যানটি প্রধানত উন্নত বিশ্বের যেখানে রয়েছে আধুনিক চিকিৎসার সবরকম সুযোগ সুবিধা। ডাক্তার, নার্স, হাসপাতাল, বেড জনসংখ্যা অনুপাতে পর্যাপ্ত। তারপরও হঠাৎ করে এত রোগী বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা কোথাও প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম। আমাদের কারো কারো ধারণা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে মসজিদে গেলে করোনা হবে না। রাসূল (সা.) সবচেয়ে বেশি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করেছেন। মক্কা থেকে হিজরতের সময় তিনি কত সতর্কতা অবলম্বন করেছেন! রাতের অন্ধকারে বের হয়েছেন। তার আগে বাহন ঠিক করেছেন, একজন পথপ্রদর্শক নিয়েছেন। বিশ্বস্ত বন্ধুকে সাথে নিয়েছেন, পাথেয় নিয়েছেন। পরিচিত পথে না গিয়ে সম্পূর্ণ উল্টো পথে গিয়ে একটি গুহায় তিন দিন লুকিয়ে রইলেন। তিন দিন পর গোপন রাস্তা দিয়ে মদিনার দিকে অগ্রসর হলেন। এত কিছু করে তারপর তিনি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করলেন। হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সা)! আমি কি উট বেঁধে আল্লাহর উপর ভরসা করব নাকি মুক্ত রেখে? তিনি বললেন উট বেঁধে নাও অতঃপর আল্লাহর উপর ভরসা কর। (তিরমিযি) ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া কাফের না মোমেন, রাজা না প্রজা, মক্কা না মস্কো কোন পার্থক্য করে না। ১৮২১ সালে মক্কায় ২০ হাজার হাজী কলেরায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৮৬৫ সালে ১৫,০০০ হাজী একই রোগে মৃত্যুবরণ করেন। উমর (রা) এর সময়ে বড় বড় সাহাবীসহ প্রায় ২৫০০০ মানুষ প্লেগে মৃত্যুবরণ করেন। বেশ কয়েক বছর আগে হজের সময় মিনায় আগুন লেগে গেল। কিছু হাজী তাওয়াক্কুল করে এ বিশ্বাস নিয়ে তাঁবুতে বসে রইলেন যে আগুন হাজীদের স্পর্শ করবে না। অবশেষে তাদের কেউ মারা গেলেন কেউ বা দৌড়ে পালিয়ে গেলেন। হজের মৌসুমে প্রতি বছর হাজার হাজার হাজী ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে আক্রান্ত হন যা হালকা রোগ বলে সেরে যায়। আর করোনা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি মারাত্মক। এর ভয়াবহতা বিবেচনা করে সৌদি আরব, কাতার, জর্ডান, মালয়েশিয়াসহ প্রায় ১২টি দেশ মসজিদে নামাজ আপাতত স্থগিত করেছে। মাত্র কয়েকজন মিলে সীমিত জামাত মসজিদগুলো চালু রেখেছে। ভারতের দেওবন্দ ও নাদওয়ার আলেমরাও একই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মার্কেট, জনসমাগম যোগাযোগ বন্ধ করেছি, সশস্ত্রবাহিনী টহল দিচ্ছে আর মসজিদে মানুষ আরও বেশি ভিড় জমাচ্ছে। এ ধরনের লকডাউনে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা খুবই কম। মসজিদে মানুষ গায়ে গায়ে লেগে দাঁড়ায়, একজনের নাক মুখ অন্যজনের নাক মুখের কাছাকাছি থাকে। দুই হাত বাঁধা থাকে বলে অনেকে মুখে হাত না দিয়ে হাঁচি কাশি দিতে থাকে। দুই হাতে সেজদা দিয়ে জীবাণু নিয়ে মোনাজাতের সময় সে হাত দুটি মুখমণ্ডলে স্পর্শ করে। কাজেই মসজিদে নামাজের মাধ্যমে এই ভাইরাস যত ছড়াতে পারে অন্য কোন সমাবেশে তত ছড়াবে না। মহান আল্লাহ তায়ালা ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসকে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এই নিয়ম অনুযায়ীই তারা কাজ করবে। এই নিয়মের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা তাদের নাই। চায়নার জন্য এই ভাইরাস ভয়ঙ্কর আর আমাদের জন্য হবে বন্ধুত্বপূর্ণ তা হতে পারে না। ভারতের আর্থসামাজিক অবস্থা আমাদের প্রায় কাছাকাছি। সে দেশের সরকার পুরোহিত, আলেম সবাইকে নিয়ে এত বড় দেশকে লকডাউন করেছে। তাতেও তারা এ রোগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আমাদের সরকারের উচিত সবাইকে সাথে নিয়ে সত্যিকারের লকডাউন কার্যকর করা। কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসের মধ্যে অন্যান্য দেশ ও এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণের আশা করছে। এখন যদি আমরা পিছিয়ে থাকি তাহলে কয়েক মাস পর সব দেশগুলো আমাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারে। মধ্যযুগে মিশরে কিছু আলেম প্লেগ মহামারীতে জামাতে নামাজের পক্ষে ফতোয়া দিয়েছিলেন পরে যখন হাজার হাজার মানুষ মারা যেতে শুরু করল, তখন এই ফতোয়া প্রত্যাহার করা হয়েছিল। কিন্তু ততদিনে অনেক প্রাণ ঝরে যায়। মধ্যপ্রাচ্যে অনেক বড় বড় আলেম, এরকম এক ভয়ঙ্কর সময়ের আশঙ্কা করছেন। শেষোক্তজন অত্যন্ত দরদ দিয়ে বলেছেন যে তার নাম যেন ইতিহাসে লেখা থাকে যে এ সময়ে তিনি মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি প্লেগ মহামারী সম্পর্কে রাসূল (সা)কে জিজ্ঞেস করেন। নবী (সা.) তাঁকে জানান যে, “এর সূচনা হয়েছিল আজাবরূপে। আল্লাহ যাদের উপর চান তা পাঠান। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা একে ঈমানদারদের জন্য রহমতস্বরূপ বানিয়ে রেখেছেন। কোথাও যদি প্লেগ মহামারী ছড়িয়ে পড়ে এবং তথাকার কোন বান্দাহ এ কথা জেনে বুঝেই ধৈর্য সহকারে শহরে বা বাড়িতে অবস্থান করে যে, আল্লাহ তার ভাগ্যে যা লিখে দিয়েছেন সেই বিপদ ছাড়া আর কিছুই তার উপর আসবে না, তবে সে শহীদের অনুরূপ সওয়াব পাবে।” (সহিহ আল বুখারী, কিতাবুত তিব্ব, হা: নং: ৫৩১৪) (চলবে) লেখক : সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির