‘কোলেস্টেরল’ শব্দটার সাথে সবাই কম বেশি পরিচিত। ‘আপনার রক্তে কোলেস্টেরল বেশি। সাবধানে খাওয়া দাওয়া করবেন।’ কথাটি হয়তো চিকিৎসকের মুখে অনেকে শুনেছেন। আসলে কী এই কোলেস্টেরল? এটা আমাদের কী ক্ষতি করে? কোলেস্টেরলের উৎস কী? এর থেকে বাঁচার উপায়ইবা কী? সবার মনে রয়েছে এরকম বহু প্রশ্ন। আমরা সহজ ভাষায় এসব প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করব।
কোলেস্টেরল আসলে কী? কোলেস্টেরল এক ধরনের লিপিড বা চর্বি। বিশুদ্ধ অবস্থায় কোলেস্টেরল মোমজাতীয়, বর্ণহীন, স্বাদহীন, হলদেটে সাদা ক্রিস্টালাইন পদার্থ। কোলেস্টেরলের রাসায়নিক ফর্মুলা C27H46O. কোলেস্টেরল এক ধরনের ফ্যাট। তবে অন্য ফ্যাটের সাথে এর পার্থক্য হল কোলেস্টেরল থেকে শক্তি উৎপন্ন হয় না এবং এটা শুধুমাত্র প্রাণিদেহেই পাওয়া যায়। কোলেস্টেরল মানবদেহের একটি অত্যাবশ্যক উপাদান। বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় কাজে এর প্রয়োজন হয়। তাই কোলেস্টেরল মানেই খারাপ নয়। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোলেস্টেরল অবশ্যই ক্ষতিকর। কোলেস্টেরল মানুষের রক্তে প্রবাহিত হয়। তবে কোলেস্টেরল একা থেকে রক্তে প্রবাহিত হতে পারে না। এটা প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয়ে লাইপোপ্রোটিন তৈরি করে এবং রক্তে প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ লাইপোপ্রোটিন হল রক্ত-প্রবাহের মাধ্যমে সারা শরীরের কোলেস্টেরল পরিবহনের জন্য দায়ী চর্বি জাতীয় পদার্থ এবং প্রোটিন জাতীয় পদার্থগুলোর এক ধরনের সমন্বয়। শরীরে প্রধানত দুই ধরনের কোলেস্টেরল পাওয়া যায়: ১. কম-ঘনত্ব যুক্ত লাইপোপ্রোটিন (LDL) বা খারাপ কোলেস্টেরল : শরীরের অধিকাংশ কোলেস্টেরল হল LDL। LDL ধমনীতে কোলেস্টেরল বহন করে নিয়ে যায়। একে ক্ষতিকারক বলা হয় কারণ এটি রক্তবাহী নালীগুলিতে জমে গিয়ে রক্তনালীকে সংকুচিত করে ফেলে রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে, যা হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। ২. বেশি-ঘনত্বযুক্ত লাইপোপ্রোটিন (HDL) বা ভালো কোলেস্টেরল : HDL উপকারী কোলেস্টেরল হিসাবে পরিচিত কারণ এটি রক্তবাহী নালীগুলি থেকে অতিরিক্ত LDL যকৃতে স্থানান্তর করে এবং শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে। এভাবে HDL হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। অর্থাৎ শরীরের সর্বোত্তম কোলেস্টেরলের মাত্রা হলো যখন LDL স্বল্পমাত্রায় এবং HDL অধিক মাত্রায় উপস্থিত থাকে। এছাড়াও ট্রাইগ্লিসারাইড নামক এক ধরনের উপাদান রয়েছে যা কোলেস্টেরলের সাথে সম্পর্কিত। এটা এক ধরনের ফ্যাট। শরীরের অতিরিক্ত ফ্যাট আমাদের শরীরে ট্রাইগ্লিসারাইড হিসেবে জমা থাকে। মাত্রারিতিক্ত ট্রাইগ্লিসারাইড স্বল্প HDL ও অধিক LDL এর সাথে মিলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
কোলেস্টেরলের উৎস কোলেস্টেরলের উৎস দুটি। অভ্যন্তরীণ উৎস ও খাদ্য। অভ্যন্তরীণ উৎস বলতে মানবদেহ। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেই শরীরের মোট কোলেস্টেরলের প্রায় ৮০ শতাংশ তৈরি হয়। বাকি ২০ শতাংশ আসে খাবার থেকে। মানবদেহে কোলেস্টেরল তৈরি হয় মূলত লিভারে। তবে লিভারের বাইরে অন্যান্য কোষেও কোলেস্টেরল তৈরি হয়। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের দেহে প্রতিদিন ১ গ্রাম (১০০০ মিলিগ্রাম) কোলেস্টেরল সংশ্লেষিত হয় এবং শরীরে মোট কোলেস্টেরলের পরিমাণ ৩৫ গ্রাম। খাবার বলতে প্রাণিজাত খাবার থেকেই শুধু কোলেস্টেরল পাই আমরা। কারণ কোলেস্টেরল শুধু প্রাণিদেহেই তৈরি হয়। উদ্ভিদজাত খাবার থেকে কোলেস্টেরল পাওয়া যায় না। এমনকি অতিরিক্ত তৈলাক্ত উদ্ভিতজাত খাদ্যেও কোলেস্টেরল থাকে না। তবে কিছু কিছু উদ্ভিদজাত খাবারে কোলেস্টেরল সদৃশ্য এক ধরনের উপাদান পাওয়া যায় যা ফাইটোস্টেরল নামে পরিচিত। ফাইটোস্টেরল স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তবে আমাদের শরীরবৃত্তীয় কাজের জন্য প্রয়োজনীয় কোলেস্টেরল আমাদের শরীরেই তৈরি হয়। তাই কোলেস্টেরলের চাহিদা মেটানোর জন্য কোনো বাড়তি খাবার প্রয়োজন নেই।
কোলেস্টেরলের প্রয়োজনীয় দিক কোলেস্টেরল মানেই ক্ষতিকর নয়। এটা মানবদেহের অতিপ্রয়োজনীয় একটি উপাদান। মানুষসহ অন্যান্য প্রাণিদেহে কোষপ্রাচীরের অন্যতম গাঠনিক উপাদান এই কোলেস্টেরল। তাই কোষ ও টিস্যু তৈরিতে কোলেস্টেরল অত্যাবশ্যক। নিউরন বা স্নায়ুর গঠন ও কার্যপ্রক্রিয়ায় কোলেস্টেরলের ভূমিকা রয়েছে। তাছাড়া দেহের প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরিতে কোলেস্টেরল গুরুত্বপূর্ণ। কোলেস্টেরলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বাইল এসিড তৈরি যা তেল চর্বি জাতীয় খাবার পরিপাক ও শোষণে সহায়তা করে। ভিটামিন এ, ডি, ই, কে শোষণেও কোলেস্টেরল পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে।
কোলেস্টেরল কখন ক্ষতিকর? কোলেস্টেরলের নির্দিষ্ট স্বাভাবিক মাত্রা রয়েছে। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে গেলে তাকে হাইপারকোলেস্টেরলেমিয়া বলা হয় যা ক্ষতিকর। রক্তের অতিরিক্ত কোলেস্টেরল (এবং অন্যান্য চর্বি জাতীয় পদার্থও) রক্তনালীর (ধমনীর) প্রাচীরে জমতে থাকে। এগুলোকে বলা হয় প্ল্যাক। প্ল্যাক জমার ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রক্তনালী সঙ্কীর্ণ ও শক্ত হতে থাকে। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস। রক্তনালী সঙ্কীর্ণ ও শক্ত হওয়ার ফলে এক পর্যায়ে এর মধ্য দিয়ে পর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহিত হতে পারে না। ফলে সংশ্লিষ্ট অঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। প্ল্যাক জমতে জমতে কখনো রক্তনালী সম্পূর্ণ বা প্রায় সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক এসব হয়ে থাকে।
হাইপারকোলেস্টেরলেমিয়ার কারণ অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস : খাদ্যতালিকায় অতিরিক্ত সম্পৃক্ত ফ্যাট ও ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি কোলেস্টেরল বৃদ্ধির প্রধান কারণ। তবে কোনো কোনো বিজ্ঞানী খাদ্যে সম্পৃক্ত চর্বির উপস্থিতিকে অতটা ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন না। সম্পৃক্ত ফ্যাট রক্তে LDL এবং HDL উভয় স্তর বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু ট্রান্সফ্যাট LDL বাড়ায় এবং HDL হ্রাস করে। অর্থাৎ ট্রান্সফ্যাট স্বাস্থ্যের জন্য বেশি ক্ষতিকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শিল্পোৎপাদিত যেকোনো খাবারে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ পর্যন্ত সীমিত রাখার পরামর্শ দিয়েছে। স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মৃত্যু হার কমাতে আমেরিকায় খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের ব্যাকারিফুডে ৫ থেকে ৩৯ শতাংশ ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সম্পৃক্ত ফ্যাট হলো সেসব ফ্যাট বা চর্বি যা স্বাভাবিক বা কক্ষ তাপমাত্রায় কঠিন অবস্থায় থাকে। সম্পৃক্ত ফ্যাট সাধারণত প্রাণিজাত খাদ্যে পাওয়া যায়। যেমন লাল গোশত, পোলট্রি ও পূর্ণ ননীসহ দুধের খাদ্যদ্রব্য। পাম তেল ও নারিকেল তেলে কিছু পরিমাণ সম্পৃক্ত ফ্যাট পাওয়া যায়। ট্রান্স ফ্যাট ২ প্রকার হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম। কৃত্রিমভাবে তরল তেলের পূর্ণ বা আংশিক হাইড্রোজেনেশনের মাধ্যমে ট্রান্সফ্যাট তৈরি করা হয়। ট্রান্সফ্যাট কক্ষ তাপমাত্রায় কঠিন অবস্থায় থাকে। যেমন মার্জারিন, বনস্পতি বা ডালডা। কম উৎপাদন খরচ ও অধিক স্থায়িত্বের কারণে ট্রান্সফ্যাট বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক এবং সারা বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়। এছাড়া উচ্চ তাপমাত্রায় দাহ্য তেল, চর্বিও ট্রান্সফ্যাটে রূপান্তরিত হয়। শিঙ্গাড়া, সমুচা, পুরি, বিস্কুট, চানাচুর, চিপসের মতো বেকারি তৈরিতে হাইড্রোজেনেটেড অয়েল বা ট্রান্সফ্যাট ব্যবহার করা হয়। এছাড়া অনেক স্ট্রিট ফুড যেগুলো কড়া করে ভাজা হয় সেগুলোতেও ট্রান্সফ্যাট থাকে। রান্না বা ভাজির কাজে একই তেল বারবার ব্যবহার করলে কিংবা রান্না করা খাবার বারবার গরম করলে তাতে ট্রান্সফ্যাট উৎপাদিত হয়। দুধ এবং গোশতে প্রাকৃতিকভাবে অল্প পরিমাণে ট্রান্সফ্যাট পাওয়া যায়। স্থূলতা : অধিক ওজন বা স্থূলতা হাইপারকোলেস্টেরলেমিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা : যারা শারীরিক পরিশ্রম কম করেন কিংবা মাঝে মধ্যে শরীরচর্চা করার সুযোগ পান না তাদের রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অপরদিকে নিয়মিত শরীরচর্চা রক্তে ভালো কোলেস্টেরল বাড়ায় এবং খারাপ কোলেস্টেরলকে কম ক্ষতিকর করে তোলে। ধূমপান ও মদ্যপান : ধূমপান রক্তনালীতে প্ল্যাক জমতে সহায়তা করে এবং অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। তাছাড়া সিগারেট রক্তে HDL এর পরিমাণ কমায়। মদ্যপান লিভারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বয়স : মানুষের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে লিভারের রক্ত থেকে LDL কোলেস্টেরল অপসারণ ক্ষমতা কমতে থাকে। ফলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। তবে ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের রক্তে LDL এর পরিমাণ কম থাকে। ডায়াবেটিস : রক্তে অতিরিক্ত শর্করা বা চিনির উপস্থিতি LDL ও VLDL (very-low-density lipoprotein) বাড়িয়ে দেয় এবং একইসাথে HDL কোলেস্টেরল কমিয়ে দেয়। তাছাড়া রক্তের অতিরিক্ত চিনি রক্তনালীর দেয়ালকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, রক্তনালীতে প্ল্যাক জমতে সাহায্য করে এবং রক্তনালীকে সঙ্কীর্ণ করে তোলে। বংশগত : বংশগত কারণেও উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল থাকতে পারে কারো কারো ক্ষেত্রে। একে বলা হয় Familial Hypercholesterolemia. এটা একটা জিনগত সমস্যা। দেহ থেকে কোলেস্টেরল অপসারণের জন্য দায়ী জিনে মিউটেশনের কারণে প্রায় প্রতি ২৫০ জনে একজন ফ্যামিলিয়াল হাইপারকোলেস্টেরলেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। এটার কারণে অল্পবয়স্ক কেউ, এমনকি শিশুরাও হৃদরোগ কিংবা স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে জিনগত কারণ ছাড়াও কারো উচ্চ কোলেস্টেরলের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে তার হাইপারকোলেস্টেরলেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
হাইপারকোলেস্টেরলেমিয়ার লক্ষণ রক্তে কোলেস্টেরল অনেক বেড়ে গেলেও সাধারণত কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। এটা মোটামুটি উপসর্গহীন। তবুও মাঝে মধ্যে কিছু উপসর্গ প্রকাশিত হতে পারে। চোখের নিচে হলদেটে ভাব : শুধু জন্ডিস হলেই চোখের নিচে হলদে ভাব দেখায় তা কিন্তু নয়, কোলেস্টেরল বেশি মাত্রায় থাকলেও চোখের নিচে হলদেটে ভাব দেখাতে পারে। এতে দেখতে কোনও সমস্যা হয় না কিন্তু একটানা বেশিদিন এরকম থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। চোখের কর্নিয়ার পাশে ধূসর দাগ : চোখের কর্নিয়ার পাশে ধূসর দাগ দেখা দিলে তা কোলেস্টেরলের লক্ষণ। মাথা ও ঘাড় ব্যথা : রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে অনেক সময় রক্তনালী সংকীর্ণ যায়। তখন মস্তিষ্কের রক্ত চলাচলে বাধা পড়ে। এতে মাথায় ও ঘাড়েও অস্বস্তিকর ব্যথা হয়। অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন : হৃদপন্দন বেড়ে যাওয়া শুধুমাত্র ব্যায়াম, শারীরিক পরিশ্রম অথবা টেনশনের কারণেই হয় না। কখনও কখনও রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলেও অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন হতে পারে। যার থেকে স্ট্রোক বা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
কোলেস্টেরল মানবদেহে কী কী ক্ষতি করতে পারে? রক্তে LDL কোলেস্টেরল কিংবা ট্রাইগ্লিসারাইডের উচ্চমাত্রায় উপস্থিতি হলে কিছু কিছু বিপজ্জনক পরিণতি ঘটতে পারে। উচ্চরক্তচাপ : সংকীর্ণ ধমনীপথ রক্তপ্রবাহের স্বাভাবিক গতিতে বাধা দেয় ফলত রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। ধমনীপথ যত বেশি সংকীর্ণ হয়, ততটাই বেশি পরিমাণে রক্তচাপ বেড়ে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই গুরুতর স্বাস্থ্যগত সমস্যা হৃদরোগের দিকে মোড় নিতে পারে। এনজাইনা (বুকে ব্যথা) : হৃদপিণ্ড রক্ত সঞ্চালনে দায়ী ধমনীগুলিতে প্ল্যাক সঞ্চয় কিংবা অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস এর কারণে রক্তের মাধ্যমে হৃদপিণ্ডে পৌঁছানো অক্সিজেনের পরিমাণ ক্রমে কমতে থাকে। এর ফলে বুকে ব্যথা হতে পারে, যা এনজাইনা নামেও পরিচিত। এটি করোনারি ধমনীর রোগের একটি লক্ষণ এবং এটি আপনাকে সূচিত করে যে আপনার হৃদরোগ হওয়ারও যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে।
হৃদপিণ্ডে হঠাৎ রোগাক্রমণ রক্তনালীতে জমা প্ল্যাক কোনভাবে ছিঁড়ে যেতে পারে বা এর কোনো অংশ ভেঙে যেতে পারে। ভেঙে যাওয়া সে অংশ রক্তের সাথে প্রবাহিত হয়ে রক্তনালীর অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ অংশে আটকে যায়। ফলে রক্তের প্রবাহ আরো বেশি বাধাগ্রস্ত হয় দিতে থাকে বা এমনকি ধমনীকে সম্পূর্ণভাবে ছিপি আটকানোর মতো রুদ্ধ করে দেয়। হৃদপিণ্ডের দিকে চলমান যে কোনো ধমনীর মধ্যে এমনটি ঘটলে তবে সেই অবস্থায় হৃদপিণ্ডে রোগাক্রমণের প্রচণ্ড সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
স্ট্রোক উপরের প্রক্রিয়াটি মস্তিষ্কে রক্ত-সরবরাহকারী ধমনীগুলোর মধ্যে যে কোনো একটিতে ঘটলে স্ট্রোক হতে পারে। অঙ্গ সঞ্চালনসহ শরীরের যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ হয়ে থাকে মস্তিষ্কে। স্ট্রোক এর কারণে এ নিয়ন্ত্রণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার অন্যতম ফলাফল প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাত। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। স্ট্রোকজনিত প্যারালাইসিস থেকে আক্রান্ত ব্যক্তি কখনো কখনো সুস্থতা লাভ করলেও প্রায়শই এই প্যারালাইসিস স্থায়ী রূপ নেয়। মস্তিষ্কে এর অন্যান্য প্রভাবসমূহ। উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল রক্তবাহী নালীগুলোতে ক্রমাগত জমে সৃষ্ট অবরুদ্ধ অবস্থার কারণে রক্তপ্রবাহে বাধা পড়তে থাকে, ফলত পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ না হতে পেরে মস্তিষ্কে ঘটতে থাকা নানা কাজকর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং এমন অবস্থা চলতে থাকলে তা স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া কিংবা হারানোর মতো ক্ষতি বা এমনকি চলাফেরা করার শক্তি হারানোর মতো ভয়ঙ্কর ক্ষতির দিকেও মোড় নিতে পারে।
যকৃতে এর প্রভাব পিত্তরস তৈরিতে কোলেস্টেরল-এর উপস্থিতি অপরিহার্য, পিত্তরস হলো যকৃৎ দ্বারা উৎপাদিত তরল যা পরিপাক ও হজমে সহায়তা করে। কিন্তু পিত্তে উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল থাকলে, এটি পিত্তথলি অর্থাৎ গলব্লাডারে ক্রমাগত জমে অত্যন্ত বেদনাদায়ক গলস্টোন তৈরি করতে পারে।
কোলেস্টেরলের ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় স্বাস্থ্যকর খাবার : আমিষ বা প্রোটিন, শর্করা ও চর্বি সব উপাদানই শেষ পর্যন্ত রূপান্তরিত হয়ে শরীরে চর্বি হিসেবে জমা হতে পারে। তাই মোট ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ কমাতে হবে, বিশেষ করে অতিরিক্ত শর্করা বা চিনি। সম্পৃক্ত চর্বি ও ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার বাদ দিন। সম্পৃক্ত চর্বি প্রাণিদেহ থেকে আসে। সম্পৃক্ত চর্বিতে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি থাকে। খাবার রান্নায় তেল কম ব্যবহার করুন। বারবার একই তেলে ভাজি করা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। অতি তাপমাত্রায় এই তেল পরিবর্তিত হয়ে ক্ষতিকর ট্রান্সফ্যাটে পরিণত হয়। ফাস্টফুড, বেকারির খাবার যথাসম্ভব কম খাওয়া উচিত। এগুলোতে প্রচুর ট্রান্সফ্যাট থাকে। ট্রান্সফ্যাট ও সম্পৃক্ত ফ্যাট দুটিই অস্বাস্থ্যকর হলেও ট্রান্সফফ্যাট অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষতিকর। ২০০৬ সালে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ক্যালরিভিত্তিক পরিমাপে খাবারের মধ্যে অন্য যেকোনো কিছুর তুলনায় ট্রান্সফ্যাটের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। কী খাবেন? : খাদ্যতালিকায় এমন খাদ্য রাখা উচিত যেগুলোতে সম্পৃক্ত বা স্যাচুরেটেড, ট্রান্সফ্যাট, লবণ এবং চিনি বা শর্করা সর্বনিম্ন পরিমাণে থাকে। যেমন চর্বিহীন মাংস, সামুদ্রিক মাছ, ফ্যাটমুক্ত কিংবা কম ফ্যাটযুক্ত দুধ, পনির, দই, ফল ও শাকসবজি। খাদ্যতালিকায় বেশি মাত্রায় থাকা উচিত এমন খাবার যার মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর তন্তু (ফাইবার) রয়েছে। যেমন শস্যদানা, ফল এবং শুঁটিজাতীয় সবজি (উদাহরণ : ওট, আপেল, কলা, নাশপাতি, কমলালেবু, রাজমা বা শিম, ডাল, ছোলা)। সবজি এবং ফলে দ্রবণীয় তন্তু (ফাইবার) কোলেস্টরল শোষণে বাধা দেয়। মাছে খুব ভালো পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড আছে বলে হার্টের বিভিন্ন রোগ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। ভোজ্যতেলের মধ্যে ক্যানোলা তেল সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর। এ ছাড়া ভালো সানফ্লাওয়ার, অলিভ অয়েল ও তারপর সয়াবিন। যে সব খাদ্য কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে সেগুলির মধ্যে আছে ওট, বার্লি, বিনস (রাজমা, ছোলা, ডাল), বেগুন, ঢেঁড়স, বাদাম, ফল (লেবুজাতীয়, আপেল, আঙুর), স্টেরল এবং স্ট্যানল সমৃদ্ধ খাদ্য, সয়া (টোফু, সয়াদুধ), মাছ, (স্যামন, ম্যাকরিল), জোলাপের মধ্যে থাকা ফাইবার।
নিয়মিত শারীরিক কসরৎ : রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে জীবনযাত্রায় আনতে হবে কিছু পরিবর্তন। কেবল তেল-চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া কমালেই হবে না। নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা মাঝারি ধাঁচের শরীরচর্চা করা প্রয়োজন। শিশু-কিশোরদের শারীরিক তৎপরতা অন্তত ১ ঘণ্টার কম হওয়া উচিত নয়। সাইকেল চালানোর অভ্যাস তৈরি করা, স্কুল, কলেজ বা অফিসে হেঁটে যাওয়া, লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার করা বা এই ধরনের অভ্যাসগুলো সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই সহায়ক। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা : অধিক ওজন বা স্থুলতা রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। শরীরের অতিরিক্ত মেয়াদ রক্ত থেকে কোলেস্টেরল অপসারণ মন্থর করে দেয়। তাই গায়ে যাতে অতিরিক্ত মেদ না জমে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি দেয়া দরকার। ওজন এমন থাকা উচিত যাতে BMI (Body Mass Index) ১৮.৫ থেকে ২৪.৯ এর মধ্যে থাকে। আপনার চিকিৎসক কিংবা ইন্টারনেটের সহায়তায় আপনি সহজেই ইগও বের করার পদ্ধতি শিখতে পারে। ধূমপান ও মদ্যপান সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়া : ধূমপান শরীরের রক্তনালীগুলোকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে ফেলে। হৃদরোগসহ অন্যান্য অনেক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। মদ্যপান লিভার ধ্বংসের কারণ। সুস্থ থাকতে চাইলে এগুলো থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন যাপন করা : মানসিক চাপ হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন রোগের অন্যতম কারণ। সুস্থ থাকার জন্য দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন যাপন করা জরুরি।
চর্বি বা কোলেস্টেরল পরীক্ষা হাইপারকোলেস্টেরলেমিয়াকে প্রাথমিক অবস্থাতেই চিহ্নিত করা গেলে এর ক্ষতি থেকে অনেকটাই নিরাপদ থাকা সম্ভব। কিন্তু হাইপারকোলেস্টেরলেমিয়া সাধারণত কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ প্রদর্শন করে না। তাই রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে গেল কিনা এটা বুঝার উপায় হলো মাঝে মধ্যে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করা। এটা খুবই সাধারণ একটা রক্ত পরীক্ষা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এ পরীক্ষাকে বলা হয় লিপিড প্রোফাইল। পরীক্ষা করার পূর্বে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা খাদ্যপানীয় থেকে বিরত থাকলে একে বলা হয় ফাস্টিং লিপিড প্রোফাইল। ফাস্টিং লিপিড প্রোফাইল করাই উত্তম। একজন সুস্থ ও পূর্ণ বয়স্ক মানুষের ৪ থেকে ৬ বছর পরপর লিপিড প্রোফাইল করা উচিত। তবে যাদের হৃদরোগ, ডায়াবেটিস কিংবা উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরলের পারিবারিক ইতিহাস আছে তাদের আরো নিয়মিত কোলেস্টেরল চেক করা প্রয়োজন। শিশু ও কিশোরদের ৯ থেকে ১১ বছরের মধ্যে একবার এবং ১৭ থেকে ২১ বছরের মধ্যে একবার কোলেস্টেরল চেক করা উচিত।
রক্তে কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা Total Cholesterol: এটা হলো HDL, LDL এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের (২০%) সামষ্টিক পরিমাণ। এটার স্বাভাবিক মাত্রা ২০০ মি.গ্রা./ডে.লি. এর কম। LDL বা খারাপ কোলেস্টেরল : এ কোলেস্টেরলের পরিমাণ যত কম হয় তত ভালো। খউখ এর স্বাভাবিক মাত্রা ১০০ মি.গ্রা./ডে.লি. এর কম। HDL বা ভালো কোলেস্টেরল : HDL শরীরের জন্য উপকারি। এটা স্ট্রোক ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। শরীরের ঐউখ এর স্বাভাবিক ন্যূনতম মাত্রা ৬০ মি.গ্রা./ডে.লি. বা তার বেশি। Triglycerides : ট্রাইগ্লিসারাইডের স্বাভাবিক মাত্র ১৫০ মি.গ্রা./ডে.লি. এর কম।
কোলেস্টেরল এর চিকিৎসা রক্তে বর্ধিত কোলেস্টরলের মাত্রা কমাতে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তবে সকল ক্ষেত্রেই ঔষধ গ্রহণের প্রয়োজন নাও পড়তে পারে। কিছু ক্ষেত্রে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার যথেষ্ট হলেও নিম্নলিখিত অবস্থায় বর্ধিত কোলেস্টরলের মাত্রা কমাতে ওষুধ প্রয়োগ জরুরি: - যখন জীবনশৈলী এবং খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন করেও বর্ধিত কোলেস্টরলের মাত্রা কমানো যায় না। - হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস থাকে। - খারাপ কোলেস্টরলের (LDL) মাত্রা বেশি থাকে। - ৪০-৭৫ বছরের ব্যক্তি যাদের হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। - যাদের ডায়াবেটিস অথবা হার্টের রোগ থাকে। তবে কখন ঔষধ গ্রহণ করতে হবে, কোন ঔষধ খেতে হবে, কতটুকু খেতে হবে, সেটা নির্ধারণ করবেন চিকিৎসক। রোগীর বয়স, স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি, হৃদরোগ বা স্ট্রোকের সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে আপনার চিকিৎসক আপনার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেবেন।
লেখক : চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক
আপনার মন্তব্য লিখুন