ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতেই মোঙ্গলিয়ান স্তেপ থেকে যেন স্বয়ং আজরাইল হয়ে নেমে এলেন চেঙ্গিস খান এবং তার মোঙ্গল বাহিনী। মাত্র কুড়ি বছরের ভেতর যেন নরকে পরিণত হলো সারা পৃথিবী। মধ্যখানে তাতারিরা যখন বাগদাদে অবস্থিত আব্বাসী খিলাফত ধ্বংস করেছিল তখন ১২৫৮-৬১ পর্যন্ত মুসলমানদের কোনো খলিফা ছিলেন না। ১২৫৮ সালে মঙ্গোলদের আক্রমণে খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ ধ্বংস হয় ও খিলাফত বিলুপ্ত হয়। মিসরের মামলুক শাসকদের মাধ্যমে আবার আব্বাসীয় খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৫১৭ উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান প্রথম সেলিমের কাছে মিসরের আব্বাসী খলিফা কর্তৃক খিলাফত হস্তান্তরিত হলে উসমানীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে চীন তারপর তুর্কিস্থান, খোরাসান হয়ে মোঙ্গল ঝড় ধেয়ে এলো ককেশাস, আনাতোলিয়া দিয়ে রাশিয়া আর হিন্দুস্থানের দিকে। মরে সাফ হয়ে গেল কোটি কোটি মানুষ। মোঙ্গলদের হাত থেকে কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে ইরান-তুর্কিস্থান থেকে আনাতোলিয়ার দিকে রওনা দিলো কিছু মানুষ। তারপর কী হলো? কী করে তারা গড়ে তুলল বিশাল এক সালতানাত? আর কিভাবেই এই সালতানাতের পতন হলো এবং তারপর কি হলো বিশ^ব্যবস্থার এই কথাই আমরা জানার চেষ্টা করবো এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে।
৩ মার্চ ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আইন পাসের মাধ্যমে উসমানীয় খিলাফতের বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। এর মাধ্যমে উসমানীয় রাজবংশের প্রায় সাত’শ বছরের শাসনের অবসান হয় এবং ইসলাম আগমনের পর প্রথম বার ‘ইসলামী খিলাফত’ ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকতা হারায়। উসমানীয় খিলাফত উম্মাহর জন্য একটি রক্ষাকবচ ছিলো। তিন মহাদেশ জুড়ে প্রায় ৭০০ বছর ধরে চলা এ খিলাফত বিলুপ্ত হয় ১৯২৪ সালে। ফলে বিশ্ব মুসলিমরা বর্তমানে খিলাফতের বরকত থেকে বঞ্চিত। ইহুদি-খ্রিষ্টানরা খিলাফতকে বিলুপ্ত করেও সুখী হতে পারেনি, তার প্রমাণ তাদের ঐতিহাসিক, লেখক, গবেষকদের অসাধারণ মিথ্যাচার। তারা তাদের কলমে/জবানে উসমানীয় সুলতান ও খলিফাগণকে হাজির করেন কতগুলো বুনো মানুষ ও কতিপয় যুদ্ধংদেহী, রক্তখেকো, নির্দয়, মানবতাহীন বিলাসপ্রিয় শাসকরূপে। এখানে আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত উসমানীয় খিলাফত ও খলিফাদের দ্বীনদারি, সততা, মানবতা, গুণ, চালচলন, সাম্রাজ্য পরিচালনা, সমরনীতি, ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের কথা। এখন প্রশ্ন হতে পারে, ইউরোপীয়রা কেন উসমানীয় খিলাফত ও খলিফাদের ইতিহাস বিকৃতি করতে যাবে? এর উত্তর পেতে নির্ভরযোগ্য মুসলিম ঐতিহাসিকদের বইপত্র পড়তে হবে। আমরা উসমানীয় খিলাফতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের উত্তরাধিকারী কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের জানাশোনা অনেক কম। খিলাফত বিলুপ্তির পর এখন একশো বছর হয়েছে মাত্র। এছাড়াও ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়লে জানা যায়, খিলাফতের স্বপক্ষে আন্দোলন ও প্রচারণা হয়েছে এ অঞ্চলে। তবুও আশ্চর্যের ব্যাপার, অল্প সময়ের মধ্যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অনেকটাই যেন মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে! উসমানীয় খিলাফতের স্বপ্নদ্রষ্টা সেলজুক রাজবংশের জামাতা আর্তুগুল গাজি প্রথমে রোমের সেলজুক সালতানাতের নিযুক্ত একজন আঞ্চলিক শাসক ছিলেন। তাঁকেই উসমানীয় খিলাফতের স্বপ্নদ্রষ্টা মনে করা হয়। তাঁর ছেলে প্রথম উসমানের নামানুসারে খিলাফতের নামকরণ করা হয়। ১৫২৬ সালে হাঙ্গেরি জয়ের মাধ্যমে ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল উসমানীয় খিলাফতের অধীন হয়।
উসমানি উসমানীয় খিলাফতের উত্থানকাল: ইতিহাসের পাতায় তখন ১২৫৮ সাল। যেই বছর মোঙ্গল নেতা হালাকু খান কর্তৃক ধ্বংস হয় আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ নগরীর। বাগদাদ পতনের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে ৫০৮ বছরের বায়োবৃদ্ধ আব্বাসীয় খিলাফতের। এদিকে যেই বছর ইরাকে আব্বাসীয় খিলাফতের পতন ঘটে সেই বছরই পশ্চিম আনাতোলিয়ায় আরতুগ্রুল গাজি ও হালিমা সুলতানার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন তাদের তৃতীয় সন্তান, নাম উসমান বিন আরতুগ্রুল। সেই সময় কে জানত যে এই ছোট শিশুটিই বড় হয়ে গড়ে তুলবে এক মহান সাম্রাজ্যের! যেই সাম্রাজ্যের মোট ৩৭ জন শাসক ৬২৫ বছরব্যাপী এশিয়ার মাইনর, গোটা আনাতোলিয়া, বলকান, ককেশাস অঞ্চল, দক্ষিণ আফ্রিকা, পূর্ব প্রাচ্য, উত্তর পূর্ব ইউরোপসহ পৃথিবীর ৫০টি দেশ নিয়ে প্রায় ৫২ লক্ষ বর্গকিলোমিটা এলাকা শাসন করেছিলো। এই সাম্রাজ্যের নাম উসমানীয় সাম্রাজ্য বা অটোমান এম্পায়ার।
বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক ইবনে খালদুনের মতে, যেকোনো সাম্রাজ্যের স্থিতিকাল ১০০ বছর। তার পর সেই সাম্রাজ্যের পতন ঘনিয়ে আসে। কিন্তু উসমানীয় সাম্রাজ্যের বেলায় তেমনটি ঘটেনি। অটোমান সাম্রাজ্যের বিশাল গগনচুম্বী সফলতার মূল কারণ ছিলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রদত্ত জীবনবিধান ইসলাম। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রায় সকল সুলতানই আল্লাহর এই বিধানকে আঁকড়িয়ে ধরে তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেন। অটোমান সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের মূল ভিত্তি ছিলো ঈমান, ইসলাম, ইনসাফ-ন্যায়বিচার ও নৈতিকতা। প্রথম মুরাদ (১৩৬২-১৩৮৯) সালে মিসরের মামলুক সালতানাতের বৈধ দাবিদার খলিফা না থাকায় খিলাফতের দাবি করে, সেই থেকে উসমানীয় সাম্রাজ্যের নাম হয় উসমানীয় খিলাফত। ১৬০০ ও ১৭০০ শতাব্দী ছিল উসমানীয় খিলাফতের উত্থানকাল। যদিও ১৮৭৬ সালে অভ্যন্তরীণ সমস্যায় বিধ্বস্ত ও আন্তর্জাতিক ঋণে জর্জরিত উসমানী খিলাফতের সুলতান ও মুসলিম বিশ্বের আমীরুল মুমিনীন বা খলিফা হিসেবে দায়িত্বে আসেন দ্বিতীয় আবদুল হামিদ। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি সুযোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে সালতানাতকে পুনরায় শক্তিশালী করে তুলতে সচেষ্ট হন। খলিফা আবদুল হামিদ ছানী মুসলিম জাগরণের চেষ্টা করেন, এবং এতে তিনি সফলতাও দেখাচ্ছিলেন।
উসমানীয়দের জয়যাত্রা যেভাবে থেমে যায় : দ্বিতীয় মুরাদের ছেলে দ্বিতীয় মুহাম্মদ রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন করেন। ১৪৫৩ সালের ২৯ মে দ্বিতীয় মুহাম্মদ কনস্টান্টিনোপল জয় করেন। ১৫০০ ও ১৬০০ শতাব্দীতে উসমানীয় সাম্রাজ্য বিস্তৃতির যুগে প্রবেশ করে। প্রথম সুলাইমানের শাসনের সমাপ্ত হওয়ার সময় তিন মহাদেশব্যপী সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। ১৭১৬-১৭১৮ সালের অস্ট্রো-তুর্কি যুদ্ধের পর পাসারোউইতজের চুক্তি অনুযায়ী বানাত, সার্বিয়া ও অল্টেনিয়া অস্ট্রিয়ার হাতে ছেড়ে দিতে হয়। এই চুক্তির পর ইউরোপে উসমানীয়দের জয়যাত্রা থেমে যায়। ১৯০৮ সালে তরুণ তুর্কি বিপ্লবের পর দ্বিতীয় সাংবিধানিক যুগ শুরু হয়। গৃহবিবাদের সুবিধা নিয়ে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ১৯০৮ সালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা দখল করে নেয়। ১৯১৪ সাল নাগাদ উসমানীয় খিলাফত ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকায় তার বেশির ভাগ অঞ্চল হারিয়ে ফেলে। ১৯১৬ সালে আরব বিদ্রোহ শুরু হলে তা মধ্যপ্রাচ্য রণাঙ্গনে উসমানীয়দের স্রোতকে উল্টে দেয়। সময়ের প্রয়োজনে উসমানীয়রা রাষ্ট্র, প্রশাসন, শিক্ষা ও গবেষণা ব্যবস্থায় উন্নয়নে প্রয়াসী হয়।
তুরস্ক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন ও খিলাফত বিলুপ্তির ঘোষণা : ১৯০৯ সালে তরুণ তুর্কি বিপ্লব এর মাধ্যমে খলিফা দ্বিতীয় আবদুল হামিদ অপসারণ এবং ১৯১৮ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মিত্র বাহিনী ও আরব বিদ্রোহ জাতীয়তাবাদীদের হাতে উসমানী খিলাফত বিলুপ্তির মুখে পড়ে। ১৯২৪ সালে সর্বশেষ খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মজিদকে নির্বাসিত করে কামাল আতাতুর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে খিলাফত বিলুপ্ত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর সালতানাত বিলুপ্ত করা হয় এবং শেষ সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ ১৭ নভেম্বর দেশ ছেড়ে চলে যান। সালতানাত বিলুপ্ত হলেও এ সময় খিলাফত বিলুপ্ত করা হয়নি। ষষ্ঠ মুহাম্মদের স্থলে দ্বিতীয় আবদুল মজিদ খলিফার পদে বসেন। ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। খিলাফত আন্দোলনের পক্ষ থেকে তুরস্কের জনগণের মধ্যে ইসলামী খিলাফতের পক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্য কিছু কার্যক্রম চালানো হয়। এর অংশ হিসেবে তুর্কিদের মধ্যে লিফলেট বিতরণ করা হয়। উগ্র সেক্যুলার কামাল পাশার পক্ষ থেকে খিলাফতের পক্ষে চালানো এই প্রচারণাকে তুরস্কের সার্বভৌমত্বের প্রতি অপমান ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এবং এই ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ তুরস্কের পার্লামেন্ট থেকে খিলাফতে উসমানীকে বিলুপ্ত করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উসমানীয় খিলাফত বিলুপ্তি হলে খিলাফতের অধীন বলকান ও মধ্যপ্রাচ্যের সাবেক অংশগুলো ৪৯টি স্বাধীন রাষ্ট্রে আত্মপ্রকাশ করে। একই সাথে খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মাজিদকে নির্বাসনে পাঠায় কামাল পাশা। এর মাধ্যমে উসমানী সালতানাতের প্রায় ৭০০ বছরের গৌরবদীপ্ত ইতিহাসের অবসান ঘটে।
মুসলিম খিলাফত পতনের ১০০ বছরে কী হারিয়ে গেছে? খিলাফত হলো ইসলামী সরকারব্যবস্থা। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক একতার প্রতিনিধিত্ব করে যে ব্যবস্থা। এই ধরনের শাসনব্যবস্থার সরকার প্রধানকে ‘খলিফা’ বলা হয়। ইসলামী খিলাফত বা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু করেছেন শেষ নবী মুহাম্মদ সা.। নবীজির ইন্তেকালের পর ধারাবাহিকভাবে প্রায় সোয়া তেরো শ’ বছর পর্যন্ত খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা চলমান ছিল। মুস্তফা আজাদের ভাষায়, ‘‘খিলাফতের পতনের পর ইনসাফ, আদালত, রহমত, আখলাক (সৃষ্টির স্বভাবজাত গুণাবলি), ইহসান হারিয়ে গেছে। বিলুপ্ত হয়েছে নব্বই ভাগ খাদ্যশস্য ও ফল-ফসল। ৭০ ভাগ বন্যপ্রাণী হারিয়েছে তার অস্তিত্ব। পৃথিবী হারিয়েছে ভারসাম্য। বসবাস অনুপযোগী হয়েছে বিশ্ব। এই ভঙ্গুর বিশ্ব বাসোপযোগী করার দায়িত্ব মুসলমানদের। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের বিন্দুমাত্রও ভাবনা নেই।’’ যতদিন উসমানীয় খিলাফত বিদ্যমান ছিল ততদিন মুসলমানরা নির্যাতনের শিকার হয়নি, মুসলমানদের কোনো ভূ-খণ্ডও হারাতে হয়নি। উসমানীয় খিলাফতের পতনের পরই মুসলমানদের ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচার নির্যাচত, গণহত্যার শিকার হতে হয় মুসলমানদের এবং প্রাণ ভয়ে নিজেদের মাতৃভূমি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয় মুসলমানদের এবং অনেক মুসলমানদের জোর করে নির্বাসনে পাঠানো হয়। আসুন, দেখি! উসমানীয় খিলাফত পতনের পর গত ১০০ বছরে আমরা কী হারালাম? ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন জোরপূর্বক দখল করে সন্ত্রাসী ইহুদিরা অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র বানায়। এতে এ যাবৎ আনুমানিক শহীদ হয়েছে ১৯ লাখ মুসলমান। উদ্বাস্তু হয়েছেন প্রায় ৫০ লাখ মুসলমান। ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয় তখন দাঙ্গায় উগ্র হিন্দুদের হাতে নিহত হয়েছিলেন প্রায় এক কোটি মুসলমান। ইতালির লিবিয়া আক্রমণের সময় শহীদ হন প্রায় ৫ লাখ মুসলমান (ওমর মুখতার অন্যতম)। চেচনিয়ায় এ যাবৎ শহীদ প্রায় ৫ লাখ, বসনিয়ায় ১০ লাখ, বার্মায় ৫ লাখ, আফগানিস্তানে রাশিয়া-আমেরিকা মিলে ২৫ লাখ মুসলমানকে হত্যা করে। ইরাকে ইরান-আমেরিকার কয়েকবারের লড়াইয়ে নিহতের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। চীনের জিংজিয়াংয়ে ১৫ লাখ। ফিলিপাইনে ৫ লাখ, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ৩০ লাখ, কাশ্মিরে ৫ লাখ, ভারতে ১০ লাখ মুসলমানকে হত্যা করা হয় গত ১০০ বছরে বিভিন্ন দাঙ্গা-হাঙ্গামায়।
বুলগেরিয়া, কসাভো, আলবেনিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আরো ১০ লাখ। তাছাড়া ইয়েমেন, লেবানন, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে আরো ১০ লাখ। তাহলে বোঝা গেল- খিলাফত পতনের পর ১০০ বছরে মুসলমানদের নিহতের সংখ্যা হলো প্রায় আড়াই কোটি, উদ্ধাস্তু আনুমানিক ৫০ কোটি। আর হারানো মুসলিম ভূ-খণ্ড হলো- ফিলিস্তিন, পূর্বতুর্কিস্তান (জিনজিয়াং), মিন্দানাও (ফিলিপাইন), দক্ষিণ সুদান, পূর্ব-তিমুরসহ আরো অনেক ভূমি। খিলাফতে রাশেদার আমলে এবং উমাইয়া আমলে বিভিন্ন লড়াইয়ে আনুমানিক দেড় লাখ। ক্রুসেডাররা বায়তুল মুকাদ্দস দখলের সময় এক লাখ এবং পরবর্তী লড়াইয়ে আরো ২ লাখ। তাতারী সয়লাবে বোখারা, সমরকন্দ, শিরাজ, বাগদাদ ও দামেস্কে আনুমানিক ৫০ লাখ। স্পেনে ২০ লাখ। আরো বিভিন্ন লড়াইয়ে আনুমানিক আরো ৫০ লাখ। ভু-খণ্ড হারিয়েছি স্পেন। ইসলামের ছায়াতলে আসা স্পেন এবং ইউরোপের দানিয়ুব নদী পর্যন্ত একসময় মুসলিম বিশ্ব ছিল। আর খিলাফত ছাড়া মাত্র ১০০ বছরে মুসলমানদের নিহত হওয়ার সংখ্যা হলো আড়াই কোটি। বিজয় করেছি শূন্য (০) ভূমি। হারিয়েছি অসংখ্য মুসলিম ভূ-খণ্ড।
কামাল আতাতুর্ক খিলাফাত বিলুপ্ত করে যেসব ইসলামবিরোধী কাজ করে : ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ কামাল আতাতুর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে তুরস্ক থেকে ইসলামী খিলাফত বিলুপ্ত ঘোষণা করে। এর মাধ্যমে উসমানীয় রাজবংশের প্রায় সাতশত বছরের শাসনের অবসান হয় এবং ইসলাম আগমনের পর প্রথম বার ‘ইসলামী খিলাফত’ ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকতা হারায়। এরপর থেকে কামাল আতাতুর্ক তুরস্কজুড়ে শুরু করে অনৈসলামীকরণ অভিযান। কামাল ছিল পশ্চিমা প্রভাবে প্রভাবিত একজন কট্টর ধর্মবিদ্বেষী। কোথাও ধর্মের সামান্য উপস্থিতিও তার জন্য ছিল মাথাব্যথার কারণ। তার কথিত উন্নতির পথে সে প্রধান অন্তরায় মনে করত ইসলামকে। তাই কোথাও যদি ইসলামের সামান্যতম উপস্থিতিও দেখতে পেত সেখান থেকে তা বিলুপ্ত করার ব্যবস্থা করত। কামাল আতাতুর্ক মসজিদ বন্ধ করে দেয়। হিজাবকে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ সাব্যস্ত করে। আরবি ভাষার পরিবর্তে ল্যাটিন অক্ষরে তুর্কি ভাষা লিখতে বাধ্য করে। মদের বৈধতার লাইসেন্স দেয়। জুয়ার আসর উন্মুক্ত করে; ফলে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার উদ্দাম স্রোতে ভেসে যায় নতুন তুরস্ক। যে তুরস্ক একসময় ছিল ইসলামী খিলাফতের ধারক সে তুরস্কেই ইসলাম হয়ে পড়ে নিষিদ্ধ ধর্ম। কুরআন শেখাও অপরাধ ছিল কামাল আতাতুর্কের তুরস্কে। এরই ধারাবাহিকতায় আয়া সোফিয়ার উপরেও পড়ে তার নগ্ন থাবা। তুর্কি খিলাফতের গৌরবের প্রতীকরূপে খ্যাত এ মসজিদকে ১৯৩৪ সালে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে জাদুঘরে রূপান্তর করার ঘোষণা আসে এবং ১৯৩৫ সালে এ ঘোষণা বাস্তবায়ন করা হয়। তখন থেকে একসময়ের ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটি জাদুঘর হিসেবেই ব্যবহৃত হতে থাকে। অতঃপর ২০২০ সালে ৮৬ বছর পর আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আয়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করার ঘোষণা দেয়া হয়।
ভারববর্ষে খিলাফত আন্দোলন : ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে মিত্রশক্তির সাথে লুজান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে আঙ্কারাকে রাজধানী করে তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে খলিফা আবদুল মাজিদ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। খিলাফতের শাইখুল ইসলাম তুরস্ক রাষ্ট্র গঠনকে অনৈসলামিক বলে ফতোয়া জারি করেন। পরবর্তীতে কামাল পাশার চাপে খলিফা নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। নির্বাচনে কামাল পাশার নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদীরা জয়ী হয়। খিলাফত ব্যবস্থা পুনরায় কার্যকর করার লক্ষ্যে তৎকালীন ভারতবর্ষে মুসলিমরা বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলে। যা ইতিহাসে খিলাফত আন্দোলন বা খিলাফত মুভমেন্ট নামে পরিচিত। যেহেতু খিলাফত বিলুপ্তির পিছনে মূল কলকাঠি নেড়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, এবং ভারতও তখন ব্রিটিশদের হাতে, তাই এই আন্দোলনের বিশাল প্রভাব তৈরি হয়েছিলো বিশ্বব্যাপী। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন সব ধারার শীর্ষ আলেম-উলামারা। বিশেষ করে শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান, মাওলানা মুহাম্মদ আলি জওহার, মাওলানা শওকত আলী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ বোখারী, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, হাকিম আজমল, মাওলানা হাসরাত মোহানীসহ অনেকে। এই আন্দোলনে কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধীও অংশ নিয়েছিলেন।
খিলাফত আন্দোলনের পক্ষ থেকে তুরস্কের জনগণের মধ্যে ইসলামী খিলাফতের পক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্য কিছু কার্যক্রম চালানো হয়। এর অংশ হিসেবে তুর্কিদের মধ্যে লিফলেট বিতরণ করা হয়। উগ্র সেক্যুলার কামাল পাশার পক্ষ থেকে খিলাফতের পক্ষে চালানো এই প্রচারণাকে তুরস্কের সার্বভৌমত্বের প্রতি অপমান ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এবং এই ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ তুরস্কের পার্লামেন্ট থেকে খিলাফতে উসমানীকে বিলুপ্ত করা হয়। একই সাথে খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মাজিদকে নির্বাসনে পাঠায় কামাল পাশা।
খিলাফত পতনের ১০০ শত বছরে মুসলমানদের কী কী ক্ষতি : আজ খিলাফত পতনের ১০০ বছর পর মুসলিম উম্মাহ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। উসমানীয় খিলাফত ছিল সর্বশেষ খিলাফত এবং মুসলমানদের শেষ আশা। উসমানীয় খিলাফতের পতনের পূর্ব যুগে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের উপর দমন-নির্যাতন যতটুকু ছিল, খিলাফত বিলুপ্তির পর তা বহুগুণ বেড়ে যায় কারণ মুসলমানদের উপরে বিশাল বটবৃক্ষ অটোমান সা¤্রাজ্যে ছায়া বিলুপ্ত হয়ে যায়। খিলাফত বিলুপ্তির পর ইহুদি সন্ত্রাসীদের ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ভেঙে টুকরো টুকরো হয় যায়। মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের ঐক্য মরুর বালিতে মিশে যায়। যার সুযোগ নিয়ে পশ্চিমা রাক্ষসগুলো শুরু করে তাদের নোংরা বৈদেশিক নীতি। একের পর এক দেশ ধ্বংস করতে থাকে তেলের লোভে মুসলিম দেশগুলোর কালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং মুসলিম যুবকদের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রগুলো। মুসলমানদের ক্ষতিসমূহ হলো: ১. ঐক্য বিনষ্ট হওয়া এবং বিভেদ তৈরি হওয়া। ২. মুসলমানদের উপর ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনা নষ্ট করে দেয়া। ৩. মুসলিম পরাশক্তি বিশ্বরাজনীতিতে দুর্বল হয়ে পড়ে। ৪. উমানীয় খিলাফত পতনের মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের উপর নির্যাতন শুরু! (রোহিঙ্গা, উইঘুর, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সিরিয়া, কাশ্মির, বসনিয়া, কসোভো, চেচনিয়া, মিন্দানাও, আলজেরিয়া, লিবিয়া ইত্যাদি)। ৫. কতিপয় মুসলিম দেশ পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকা-ইসরাইলের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সাথে গাদ্দারি করা শুরু করে। ৬. মুসলমানদের অর্থনীতি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যার ফলে, আফ্রিকাসহ অনেক ছোট মুসলিম দেশগুলোতে হতদরিদ্র মুসলিম দেশগুলো তীব্র কষ্টে জীবনযাপন করছে। ৭. পবিত্র ভূমি (ফিলিস্তিন) থেকে মুসলমানগণ বঞ্চিত হয়ে পড়ে। ৮. ইসলামের প্রচার ও প্রসার ব্যাহত হয়ে পড়ে। এগুলো ছাড়াও আরো অনেক ক্ষতি থাকতে পারে।
খিলাফত পতনের পর জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় পিছিয়ে পড়ে : খিলাফত পতনের পর মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দু’টি কারণে মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি হলো ধর্মজ্ঞানের অভাব, অপরটি অনৈক্য। অনৈক্য শুধু তাদের জাগতিক দুর্দশার জন্য দায়ী নয়, ধর্মীয় অধঃপতনেরও কারণ। ঐক্য ছাড়া কোনো জাতি কোনো ব্যাপারে সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে- মানব ইতিহাসে এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই। এ বিষয়ে মুসলমানরা যে কী পরিমাণে উদাসীন তা সকলেরই জানা।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বর্তমানে যেমন অর্থনৈতিক উন্নতি ও সামরিক শক্তির চাবিকাঠি, অতীতেও তাই ছিল। মধ্যযুগে মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছিল। এক পর্যায়ে মুসলিম অধিকৃত স্পেনের কর্ডোভা এবং ইরাকের বাগদাদ নগরী হয়ে উঠেছিল বিশ্বের জ্ঞানচর্চার প্রধান দু’টি কেন্দ্র। কিন্তু তারা বৈজ্ঞানিক উন্নতির এ ধারা বজায় রাখতে পারেনি। এক সময় তারা স্থবির হয়ে পড়ে, বিশেষভাবে হালাকু খান কর্তৃক বাগদাদ ধ্বংস হওয়ার পর। কয়েক শতাব্দীর চেষ্টায় অর্জিত জ্ঞান যেসব হাতে লেখা ছিল। হালাকু খান সেগুলো নষ্ট করে ফেলে জ্ঞানের জগতের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরে আর কখনো সে সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়নি তবে উসমানীয় খলিফাদের প্রচেষ্টায় সেই জ্ঞানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জনৈক ভূগোলবিদ ১৯৭৬ বা ১৯৭৭ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক নামক সাময়িকীতে প্রকাশিত (ঙহ ঃযব ঃৎরধষ ড়ভ ওংষধস) শীর্ষক একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, মুসলমানরা জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে তা ইউরোপীয়দের হাতে তুলে দিয়ে নিজেরা ঘুমিয়ে পড়েছিল, বহুকাল পর ঘুম থেকে জেগে চোখ কচলাতে কচলাতে তারা দেখতে পেলো ইউরোপীয়রা বহুদূর এগিয়ে নাগালের বাইরে চলে গেছে। তারা কখনও এই পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি, ভবিষ্যতে যে পারবে এমন সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। পক্ষান্তরে উসমানীয় খিলাফত পতনের পর মুসলিম দেশগুলোতে রাজতন্ত্র, স্বৈশাসক, সামরিক শাসক, ক্ষমতার কোন্দল, অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা, প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতা, শাসকদের অপরিণামদর্শিতা ইত্যাদি কারণে মুসলমানদের মূলরাষ্ট্র ক্রমে দুর্বল হতে থাকে। সামরিক বিষয় অবহেলার কারণে মুসলমানদের চরম খেসারত দিতে হয়েছে এবং এর জন্য দায়ী বৈজ্ঞানিক অনগ্রসরতা। রেনেসাঁর যুগে ইউরোপীয়রা যখন সারা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছিল তখন কূপমণ্ডুক মুসলমানরা রাজকীয় ভোগবিলাসে মত্ত ছিল। বর্তমান যুগে প্রযুক্তি হচ্ছে অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। উন্নত দেশগুলো নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সেগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতির অসংখ্য পথ তৈরি করে চলেছে। উসমানীয় খিলাফতের পতনের পর জ্ঞান-বিজ্ঞান অবহেলা করে মুসলমানরা যেমন মার খেয়েছিল এখনও তেমনি মার খেয়ে যাচ্ছে। মনে হয় মুসলমানরা নিজেদের দক্ষতা সম্বন্ধে আস্থাহীন হয়ে পড়েছে।
ধর্ম পরিত্যাগ : উসমানীয় খিলাফত পতনের পর ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ষড়যন্ত্রে তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে সেক্যুলার বানানোর নামে, কমিউনিস্ট বানানোর নামে, প্রগতি-মুক্তমনা বানানোর নামে ধর্মহীন নাস্তিক করে তুলে মুসলিম তরুণদেরকে। যদি সব মুসলমান ধর্মের সকল বিধান মেনে চলত, তাহলে দুনিয়াতে তাদের এত অপমানজনক দুরবস্থার মধ্যে পড়তে হতো না। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার এই যে, বর্তমানের তথাকথিত এই মুসলমানরা একথা বুঝতে অক্ষম যে পৃথিবীতে কারা কত অবহেলিত ও অপমানিত। তারা যে নিজেদের লোক দ্বারা চরমভাবে শোষিত ও প্রতারিত- এ বোধশক্তিও তাদের নেই। বর্ণিত শোষণ ও প্রতারণা তাদের জাগতিক ও ধর্মীয় উভয় ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। মুসলমানদের জন্য আরেকটি বিপজ্জনক বিষয় এই যে, তারা শুধু নিজেদের ধর্মের অনুশীলন ত্যাগ করেন, বরং অমুসলিমদের রীতিনীতি আয়ত্ত করার জন্যও সচেতনভাবে চেষ্টিত। এর অর্থ ইসলামের কল্যাণকর দিক তাদের আকৃষ্ট করে না। বিধর্মীদের অনুসরণ করাকেই তারা জীবনের চরম সার্থকতা মনে করে। এই অবস্থায় এখনও মুসলমানরা যদি ধর্মকে আঁকড়ে না ধরে তাহলে সংখ্যায় মুসলমানরা প্রতিদিন বাড়তে থাকলেও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এদের অধঃপতন কেউ ঠেকাতে পারবে না।
পরিশেষে খিলাফতের পতনের পর এখন মুসলমানদের কর্তব্য হলো ইকামতে দ্বীনের কাজ বেগবান করার মাধ্যমে রাসূল সা.- এর সুন্নাহর আলোকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। যাতে অসহায় মানুষ ইসলামী রাষ্ট্রে আশ্রয় পায় এবং মানুষ ইনসাফ-ন্যায়বিচারভিত্তিক সুশাসন পায়। মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মাণে হজরত মুহাম্মদ সা.-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানটি শুধু ইসলাম প্রচার ছিল না, বরং সেটি ছিল বিশাল ভূ-ভাগ থেকে দুর্বৃত্ত শাসকদের নির্মূল এবং ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা না থাকলে কাফের শক্তির সাথে সংঘাতের কোনো কারণই সৃষ্টি হতো না। তাবলিগ জামাতের কর্মীদের এজন্যই কোনো শত্রু নেই; তাদের জীবনে কোনো সংঘাতও নাই। অথচ সংঘাত এড়াতে পারেননি নবী-রাসূলগণ। মুসলিম জীবনে এরূপ সংঘাত না থাকার অর্থ বস্তুত প্রকৃত ঈমান না থাকা। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের সামনে অনুকরণীয় মডেল রূপে খাড়া করেছেন মুসলিম উম্মাহর আদি পিতা হযরত ইব্রাহীম আ.কে। তাঁর কোনো লোকবল ছিল না; তিনি ছিলেন একা। কিন্তু নমরুদের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত কাফের শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন এ হুঙ্কার দিয়েঃ “শুরু হলো তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ”। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে তাঁর সে সাহসী ঘোষণাটি এতোই ভালো লেগেছিল যে, সেটিকে তিনি রেকর্ড করেছেন পবিত্র কুরআনের সূরা মুমতাহেনার ৪ নম্বর আয়াতে। তাঁকে অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়ে ঈমানদারদের উদ্দেশ্য বলা হয়েছে, “তোমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে ইব্রাহীম আ.-এর জীবনে।” এ থেকে বুঝা যায় মুসলিম জীবনে শত্রুশক্তির সাথে সংঘাতের অনিবার্যতা ও তার নির্মূলে জিহাদটি কত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : সাংবাদিক
আপনার মন্তব্য লিখুন