post

গণতন্ত্রে আমলাতান্ত্রিক উপাখ্যান

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

১৩ নভেম্বর ২০২১

স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম ও সীমালঙ্ঘন আমাদের জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রাচারের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই সমন্বয়হীনতা এখন চরমে উঠেছে। আমাদের দেশে সরকার ও নির্বাহী বিভাগ বা আমলাতন্ত্রের মধ্যে সেতুবন্ধ না থাকায় দেশে সুশাসন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে নাগরিকরা মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্রের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অধিকারের পরিবর্তে অনধিকারই জোরালো ভিত্তি পেয়েছে। যা কাক্সিক্ষত না হলেও এটাই এখন রূঢ় বাস্তবতা। শাজাহান নাটকে নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ‘দিলদার’ চরিত্রের মাধ্যমে একটি পরিহাসের অবতারণা করেছিলেন। নাটকের এক সংলাপে শাহজাদা সুজার বিদুষক ‘দিলদার’ জিজ্ঞাসিত হয়েছিলেন, ‘কুকুর; না লেজের শক্তি বেশি? দিলদারের সপ্রতিভ জবাব, কুকুরের। কারণ, কুকুর লেজ নাড়ে। এর বিপরীত হলে তো লেজই কুকুর নাড়তো’। বিষয়টি হাস্য-রসাত্মক হলেও খানিকটা কৌতূহলোদ্দীপকও। কারণ, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সে স্বাভাবিকতা আর নেই। কারণ, কোন কিছুই এখন স্বাভাবিক গতিতে চলছে না। অস্বাভাবিকতা আমাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে। মহাজন ফড়িয়ার পর্যায়ে নেমে এসেছেন; আর ফড়িয়ারাই এখন রীতিমত মহাজন। রাখাল মনিব প্রসব করতে শুরু করেছে। রাষ্ট্র গণপ্রজাতান্ত্রিক ও কল্যাণমুখী বৈশিষ্ট্য হারিয়ে আমলাতান্ত্রিক গণতন্ত্রের পথেই যাত্রা শুরু করেছে বলে জোরালো অভিযোগ উঠেছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা প্রবাহ সে অভিযোগের পালেই রীতিমত হাওয়া দিচ্ছে। যা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত।

স্বাধীনতা ও ক্ষমতা কখনো অবারিত হয় না বরং তা আইন ও সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর স্বাধীনতায় কোন ভাবেই স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদের দেশের রাষ্ট্রাচারের সকল ক্ষেত্রেই এখন স্বেচ্ছাচারিতা স্থান করে নিয়েছে। আমলাতন্ত্রও এ থেকে বাদ যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে আমলাদের অবারিত ক্ষমতাচর্চার বিষয়টি সেদিকেই অঙ্গলী নির্দেশ করে। যা সাংবিধানিক শাসনে বড় ধরনের ব্যত্যয় সৃষ্টি করছে। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিচ্যুতি ও সরকার আমলা নির্ভর হওয়ায় আইন-কানুন, বিধি-বিধান ও চাকরিবিধির কোন কিছুরই তোয়াক্কা করছেন না একশ্রেণির অতি উচ্চাভিলাষী আমলা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এখন বাঁশের কঞ্চিই বেশি পরিপুষ্ট। এমতাবস্থায় আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্যে রাজনীতিকরা অসহায় হয়ে পড়েছেন বলে খোদ রাজনীতিকরা আত্মস্বীকৃতি দিতে শুরু করেছেন। আর এজন্য আমাদের চলমান ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতিকেই দায়ী করছেন অভিজ্ঞমহল। বস্তুত, আমলারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হলেও রাজনীতিকদের পৌনঃপুনিক ব্যর্থতা কারণেই তারাই এখন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। এ বিষয়ে রাজনীতিকদের আহাজারি-আর্তনাদ কোন কাজে আসছে না। অথচ সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘Every person in the service of the republic has a duty to strive at all time to serve the people.’ অর্থাৎ ‘সব সময় জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য’।

একশ্রেণির অসাধু আমলা এখন ধরাকে সরা জ্ঞান করা শুরু করেছেন। কিন্তু এ অবস্থা সৃষ্টির জন্য কারা দায়ী তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। এ বিষয়ে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিচ্যুতি, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি ও রাজনীতিকদের পর্বত প্রমাণ ব্যর্থতাকে জোরালোভাবে দায়ী করা হচ্ছে। আর এই বিষয়টিই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করা হচ্ছে। কারণ, রাজনীতিকদের ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে আমাদের দেশের রাজনীতি কক্ষচ্যুতি ঘটেছে। অরাজক রাজনৈতিক পরিস্থিতির পুরোপুরি সুযোগ গ্রহণ করছেন সুবিধাভোগীরা। আর এর অসহায় ভিকটিম সাধারণ মানুষ। বিষয়টি অভিনব না হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই অভিযোগের মাত্রা আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে। মেঠো বিরোধী দলগুলো বিষয়টি বেশ আগে থেকে সোচ্চার হলেও এখন জাতীয় সংসদে ‘চ্যারিটি ম্যাচ খেলা’ বিরোধীদলীয় শীর্ষ নেতার মুখেও এমন অভিযোগের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এই অসময়োচিত খিস্তিখেউর কোনো কাজে আসছে না। সম্প্রতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের অনেকটা খেদোক্তি করেই বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী দেশের মালিক হচ্ছেন জনগণ। আর তাদের ভোটে নির্বাচিতদেরই দেশ পরিচালনার কথা। কিন্তু কাজকর্মে এমপি সাহেবদের খবর নেই, আর সচিব-সাহেবরা সব কাজ করেন, মন্ত্রী মহোদয়েরা শুধু জানতে চান’। বিষয়টি জাতীয় পার্টি নেতার বিলম্বিত উপলব্ধি হলেও সভ্য ভাষণের জন্য তিনি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু দেশের এই বেহাল দশার জন্য রাজনীতিকরা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না।

জি এম কাদের যে পরিস্থিতির কথা বলেছেন তাতে দেশের বাস্তব চিত্রই ফুটে উঠেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে গণতন্ত্রের জন্য আরো দুঃখজনক পরিণতির আশঙ্কা করছেন। আমলারা যে জোর করে রাজনীতিতে আসছেন এ কথাও ঠিক নয়। রাজনীতিবিদদের উপর্যুপরি ব্যর্থতা ও ক্ষমতালিপ্সার ছিদ্রপথেই সুযোগ নিচ্ছেন একশ্রেণির উচ্চাভিলাষী আমলা। আর রাজনীতিকরা ক্ষমতার খুঁটি ঠিক রাখার জন্য এসব আমলাদের বরাবরই তোষণ করে চলেছেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যদি আমলাতন্ত্র-নির্ভর হতে হয় তাহলে আমলারা সুযোগ নেবেন এটাই স্বাভাবিক। আর বাস্তবেও ঘটেছে তা-ই। এতে আমলা ও ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরা ভাগবাটোয়ারায় লাভবান হলেও সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে রাজনীতি হারিয়েছে গণমুখী চরিত্র।

তবে একশ্রেণির আমলাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ এজন্য কম দায়ী নয়। কারণ, এখন প্রশাসনের সচিব বা পদস্থ কর্মকর্তারা অবসরের পরই রাজনীতিতে যোগ দিয়ে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার খোয়াব দেখতে শুরু করেন। এজন্য তারা গ্রাউন্ড প্রস্তুত করেন সরকারি চাকরিতে থাকার সময়ই। সরকারি চাকরিতে থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। সভা-সমাবেশে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন, যা চাকরি বিধির সুস্পষ্ট লংঘন হলে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। আর সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার কারণেই উচ্চাভিলাষী সরকারি কর্মকর্তারা প্রায় অপ্রতিরোধ্য। এমতাবস্থায় নানা কারণেই এক শ্রেণির আমলারা সরাসরি দলীয় রাজনীতিতে অংশ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আমাদের দেশে করোনা ব্যবস্থাপনা ও এ নিয়ে নানা কাজে মন্ত্রী এমপিসহ মাঠ পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের তেমন কোনো ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ হয়তো কিছু করছেন। কিন্তু প্রশাসনিক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে তারা অনুপস্থিত। ফলে যারা জনপ্রতিনিধি তাদের কাজ চলে গেছে আমলাদের কাছে। আমলারা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। তাই তারা স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিতে কসুর করছেন না। এটা কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয় বরং রাজনীতিকদের বড় ধরনের ব্যর্থতা।

আমলারাও এই অযাচিত ক্ষমতা পেয়ে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার নানাবিধ অপরাধ প্রবণতায়ও জড়িয়ে পড়ছেন। জনপ্রশাসন সচিব ঢাকায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘কর্মকর্তাদের অপরাধপ্রবণতা এত পরিমাণে এখন বেশি যে প্রতিদিন তিন-চারটি করে বিভাগীয় মোকদ্দমা শুনতে হয় এবং বিভাগীয় মোকদ্দমায় অনেকের শাস্তি হচ্ছে। এটা জনপ্রশাসনের জন্য সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। মূলত, সুস্থধারার রাজনীতি চর্চার অভাবেই আমলাদের প্রভাব এখন অনেক বেশি বেড়ে গেছে। আর তা চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। ক্ষমতার প্রয়োজনে আমলা নির্ভরতার পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে রাজনীতিবিদদের দক্ষতার অভাবেও এটা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘রাজনীতি করবেন রাজনীতিবিদরা। কিন্তু এখন তা করছেন আমলারা। তারা চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন এবং রাজনৈতিক তৎপরতাও চালাচ্ছেন।’ যা রাজনৈতিক ব্যর্থতার প্রামাণ্য দলিল।

আমলাতন্ত্র (Bureaucracy) এমন এক ব্যবস্থা যাতে স্থায়ী সরকারি কর্মকর্তারা দায়িত্ব বিভাজনের মাধ্যমে সরকারের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। আমলারা জনপ্রতিনিধি নয় বা ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নয়। ফলে রাজনৈতিক সরকার পরিবর্তিত হলেও আমলারা পদ হারান না। এই চরিত্রের কারণে আমলাতন্ত্রে সরকার পরিচালনার ধারাবাহিকতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংরক্ষিত হয়। আমলারা হলেন সরকারের অংশ যারা অনির্বাচিত। ঐতিহাসিকভাবে, আমলারা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। যারা জনগণের ভোট দ্বারা নির্বাচিত নন। বর্তমান সময়ে, আমলাদের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বড় একটি অংশ পরিচালিত হয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনীতিবিদ তথা জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্রের আইনকানুন, নীতিকৌশল আর উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করবেন, আর জন-আকাক্সক্ষা পূরণে জনপ্রশাসনের সদস্যরা জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শ ও মতামতকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে উন্নয়নকে নিশ্চিত করবেন-এটিই তো স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত। কিন্তু আমলাদের হাতেই এখন সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণ। আর রাজনীতিকদের ভূমিকা ‘ধর হে লক্ষ্মণ’ আর ‘তাল পাতার সেপাই’ এর মত। যা কোনো গণতান্ত্রিক ও সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।

রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতা হারাচ্ছেন আর আমলারা ক্ষমতা অর্জন করছেন একথা বলতে কোন বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না বরং গরু-ছাগল চেনার যোগ্যতা থাকলেই তা উপলব্ধি করা যায়। কারণ, স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা এখন ইউএনও/ডিসির কাছে পুরোপুরি অসহায়। বস্তুত জনপ্রতিনিধিরা এখন প্রায় ক্ষেত্রেই ক্ষমতাহীন সাক্ষীগোপাল মাত্র। ডিসি, ইউএনওর ওপর তারা কোনভাবেই প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না। এ বিষয়ে একজন সংসদ সদস্যের উপলব্ধি গণমাধ্যমের খবরে এসেছে। আর তা খুবই হতাশাব্যঞ্জক ও বেদনাদায়ক। তিনি এক তদবিরকারীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘কোনোরকম মানসম্মান নিয়ে বেঁচে আছি, দেখো কোনোভাবে ইউএনও বা ডিসি সাহেবকে বলা যায় কিনা’! একজন সংসদ সদস্যের এরচেয়ে বড় আত্মপ্রবঞ্চনা ও অসহায়ত্ব আর কী হতে পারে? যা আমাদেরকে ঔপনিবেশিক শাসনের কথায় স্মরণ করিয়ে দেয়। এ বিষয়ে এক উপজেলা চেয়ারম্যানের অভিমত আরও বেদনাদায়ক। তার ভাষায়, ‘আমরা তো নিয়ম রক্ষার পরিষদ চেয়ারম্যান, ইউএনও সাহেব রাজি না হলে কাজ হবে না’। এসব ঘটনায় প্রমাণ হয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের পরিবর্তে আমলারাই অতিমাত্রায় শক্তিশালী হয়ে উঠছেন। আর রাজনীতিবিদরা ক্রমেই প্রাসঙ্গিতা হারাচ্ছেন। যা দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য অশনিসঙ্কেত।

এ বিষয়ে সরকারি দলের সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ সংসদে দাঁড়িয়ে জেলায় জেলায় সচিবদের দায়িত্ব পালন নিয়ে যে আবেগঘন বক্তব্য রেখেছেন তা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকারের বৈশিষ্ট্য নয়। জনগণের সাথে সদা সম্পৃক্ত, এলাকার সমস্যা, সুবিধা-অসুবিধা আর সুখ দুঃখের সাথী জনপ্রতিনিধিদের পাশ কাটিয়ে সচিব আর প্রশাসনের আমলারাই যে উন্নয়ন আর থোক বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন- তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যে তা খুবই স্পষ্ট। এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফের বক্তব্যও উল্লেখ করা দরকার। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘জনগণের দুর্যোগে, বিপদে-আপদে রাজনীতিবিদরাই কাছে থাকেন, সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা করা, কোনোভাবেই উন্নয়ন বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গ্রহণ নয়’। হানিফের বক্তব্যেও আমলাদের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষের চিত্রই ফুটে উঠেছে। যা দেশ ও জাতির জন্য মোটেই সুখবর নয়। স্বাধীনতার মাত্র ৫ দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। স্বৈরাচার এরশাদের আমলে এদেশে উপজেলা পদ্ধতি চালু হয়েছিল। এই একনায়কের আমলের উপজেলা পদ্ধতিকে আমর খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। সেই সময়ে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদের কাছে উপজেলার কর্মকর্তাদের কাজের জন্য জবাবদিহির ব্যবস্থা ছিল। পরিষদের সভায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শুধুমাত্র সাচিবিক দায়িত্ব পালন করতেন। জনপ্রতিনিধি উপজেলা পরিষদের সদস্যরা মাসিক সভায় সামনের কাতারে আর কর্মকর্তারা পেছনের সারিতে বসতেন। কর্মকর্তারা উপজেলার মাসিক সভায় হাজির হওয়ার আগে জনপ্রতিনিধিদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হওয়ার ভয়ে তটস্থ থাকতেন, অপেক্ষাকৃত দুর্বল নৈতিকতার অধিকারী কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক নাজেহালের ভয়ে আতঙ্কে সময়ের হিসাব কষতেন। এখন স্বৈরাচার না থাকলেও পরিস্থিতির কিন্তু বড় ধরনের অবনতি হয়েছে। ফলে সুশাসন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রেই চলছে নানা ধরনের অসঙ্গতি।

কারণ, হাল আমলে পুরো গণেশই উল্টে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এখন তো জনপ্রতিনিধিরা তটস্থ থাকেন, কর্মকর্তাদের উচ্চকণ্ঠের ভয়ে চেয়ারম্যান সাহেবরা করুণা আর দয়া দাক্ষিণ্যের অনুসন্ধানেই ব্যস্ত থাকেন, উপজেলা চেয়ারম্যান সভাপতির চেয়ারে বসলেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সন্তুষ্ট করাই যেন উপস্থিত সদস্যদের একমাত্র কর্তব্য হয়ে ওঠে। কোনোভাবে নির্বাহী কর্মকর্তার চক্ষুশূল হলে বাজেট বরাদ্দ কাটছাঁটের ভয়ে জনপ্রতিনিধির হৃদয় কেঁপে ওঠে। সামরিক স্বৈরাচারের আমলেও যে জনপ্রতিনিধিরা বুক ফুলিয়ে উপজেলার মাসিক সভায় হাজির হয়ে কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতে বাধ্য করতেন। কিন্তু সে অবস্থা আর অবশিষ্ট নেই। কারণ, আমরা এখন আমলাতান্ত্রিক গণতন্ত্র চর্চা করছি। তারাই এখন সবকিছুরই নিয়ামক। এমনকি নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের অনুষঙ্গও। জাতির যেকোনো সঙ্কটে রাজনীতিকরাই ভরসা। আমলাতন্ত্রের প্রতিভূরা এখনো ‘ভাই’ বা ‘আপা’ সম্বোধনে বিব্রত বোধ করেন, বিনা অনুমতিতে দপ্তরে প্রবেশ আইনত দণ্ডনীয় বলেই বিশ্বাস করেন, সেই আমলাতন্ত্র কখনো রাজনীতি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনের জন্য সহায়ক হতে পারে না। আমলা নির্ভরতাকে সহনীয় পর্যায়ে এনে গণপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে, কাগুজে মর্যাদা নিয়ে যতই আত্মতৃপ্তি খোঁজা হোক, তা কখনোই সম্মানজনক নয়; বরং তা রীতিমত আত্মপ্রবঞ্চনা। উন্নয়নের নামে আমলাতান্ত্রিক গণতন্ত্র জনবিচ্ছিন্নতার পথকেই করবে আরও দীর্ঘায়িত। আর এর ভিকটিম হতে হবে রাজনীতিকদেরই।

মূলত, একশ্রেণির রাজনীতিকের অতিমাত্রায় ক্ষমতালিপ্সার কারণেই আমলারাই এখন ক্ষমতার প্রতিভূ হিসাবে আবির্ভূত। ফলে রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গই স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারছে না। সরকার সুশাসনের পরিবর্তে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতারক্ষার জন্য আমলাতোষণসহ শ্রেণিতোষণের নীতি গ্রহণ করেছে। ফলে আমাদের দেশের সুশাসনের সূচক এখন প্রান্তিক পর্যায়ে নেমে এসেছে। সরকার জনগণের কল্যাণে কাজ করার পরিবর্তে বিরোধী দল ঠেকানোর জন্য অতিমাত্রায় তৎপর রয়েছে। আর সে নেতিবাচক রাজনীতির ধারাবাহিকতায় তিনবারের সফল প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। জনগণের প্রতি দায়িত্বহীনতার কারণেই দেশের মূল্য পরিস্থিতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বরং সরকার শ্রেণি তোষণ ও দলীয় স্বার্থে জ¦ালানী ও বিদ্যুতের দাম বারবার বাড়িয়ে দিয়ে গণদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। সরকারের অতিমাত্রায় শ্রেণি তোষণের কারণেই কোনোকিছুর ওপরই সরকারের সুনিয়ন্ত্রণ নেই। আর সে সুযোগই যথাযথভাবে কাজে লাগাচ্ছেন একশ্রেণির রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী আমলারা। যা পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র স্থবির ও প্রাণহীন করে তুলেছে। এমতাবস্থায় আমলাতন্ত্রের অনাকাক্সিক্ষত দৌরাত্ম্য বন্ধ এবং দেশকে আইন ও সাংবিধানিক শাসনে ফিরিয়ে নিতে এই অশুভবৃত্ত থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজ কক্ষপথে ফিরিয়ে আনতে হবে আমলাতন্ত্রকে। কারণ, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আমলাদের অপেশাদারি ও দলবাজ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অগ (Ogg) বলেন, (‘The body of the civil servants is an expert, professional, non-political, permanent and subordinate staff.’) অর্থাৎ ‘রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা হবে সুদক্ষ, পেশাদারি, অধীনস্থ কর্মকর্তা যারা স্থায়ীভাবে চাকরি করেন এবং রাজনীতির সাথে যাদের কোনো সংশ্রব নেই’। অন্যথায় গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও স্বাধীনতার স্বপ্ন অধরায় থেকে যাবে। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির