post

গাজায় শান্তিচুক্তি কার লাভ কতটুকু?

০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪

মাসুম খলিলী

Gazaগাজায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে সাত সপ্তাহ ধরে যুদ্ধ চলার পর উভয় পক্ষ একটি শান্তিচুক্তিতে সম্মত হয়েছে। এই চুক্তির পর হামাস গাজায় বিজয় মিছিল করেছে। অন্য দিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাস গাজার যুদ্ধ থেকে কিছুই অর্জন করতে পারেনি। আসলে গাজার সর্বগ্রাসী আক্রমণে দুই সহস্রাধিক লোক হত্যা করে ইসরাইল কী অর্জন করতে চেয়েছিল আর যুদ্ধবিরতির পর তারা কী পেয়েছে সেটি এক বিরাট প্রশ্ন দেশটির ভেতরে ও বাইরে। আর এক সপ্তাহ যুদ্ধ চলার পর বিরতি দেয়ার প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে ৫০ দিন লড়াই করে কী অর্জন করতে চেয়েছিল হামাস? তারা অর্জনই বা কী করতে পেরেছে? এ মূল্যায়ন ফিলিস্তিন ছাড়াও আরববিশ্বজুড়ে চলছে। হিসাব-নিকাশ করছে ইউরোপ-আমেরিকাও। শান্তিচুক্তির এই মূল্যায়নের আগে জানা প্রয়োজন কী শর্তে দুই পক্ষ যুদ্ধ বন্ধে ঐকমত্য হলো, আর এই যুদ্ধে হামাস-ইসরাইলের লক্ষ্য আর দাবিই বা কী ছিল? যুদ্ধবিরতির শর্ত হামাস-ইসরাইল স্থায়ী যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরে কিছু তাৎক্ষণিক আর কিছু কিছু বিষয় সময় নিয়ে বাস্তবায়নের ব্যাপারে একমত হয়েছে উভয় পক্ষ। অবিলম্বে যেসব পদক্ষেপ তারা নেয়ার অঙ্গীকার করেছে, তার মধ্যে রয়েছেÑ ক. হামাস ও গাজার অন্য সশস্ত্র গ্রুপ ইসরাইলে সব রকেট ও মর্টার হামলা বন্ধ করবে। খ. ইসরাইল গাজায় বিমান হামলা ও স্থল অপারেশনসহ সব সামরিক তৎপরতা বন্ধ করবে। গ. ইসরাইল মানবিক সাহায্য ও পুনর্গঠন সরঞ্জামসহ পণ্যের সহজ প্রবাহ নিশ্চিত করতে গাজার সাথে তার সীমান্ত পারাপার উন্মুক্ত করবে। ঘ. পৃথক একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে মিসর রাফায় গাজার সাথে তার ১৪ কিলোমিটার (আট মাইল) সীমান্ত খুলে দেবে। ঙ. প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ হামাস থেকে গাজার সীমানা ক্রসিংয়ের দায়িত্ব নেবে। ইসরাইল ও মিসর এর মাধ্যমে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও কোনো দ্বৈত ব্যবহারের পণ্য গাজায় প্রবেশ না করার বিষয় নিজ নিজ সীমান্তে নিশ্চিত করবে। তারা পুনর্নির্মাণের সামগ্রী রকেট নিক্ষেপের টানেলের পরিবর্তে বাসগৃহ ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণে ব্যবহার নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে। চ. ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কাতার, তুরস্ক ও নরওয়েসহ আন্তর্জাতিক দাতাদের সাথে গাজার পুনর্গঠনপ্রচেষ্টার সমন্বয় করবে। ছ. সীমান্তের অভ্যন্তরে গাজাবাসীর জন্য নিষিদ্ধ এলাকা ৩০০ মিটার থেকে ১০০ মিটারে কমানো হবে। জ. ইসরাইল নিরাপত্তা বাফার সঙ্কীর্ণ করে ফিলিস্তিনিদের বন্ধ খামারের জমি আবারো ব্যবহারের অনুমতি দেবে। ঝ. গাজার উপকূলে মাছ ধরার সীমানা প্রসারিত করে তিন মাইল থেকে বাড়িয়ে ছয় মাইল করা হবে এবং পর্যায়ক্রমে এটিকে পূর্ণ ১২ মাইল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে। ঞ. উভয় পক্ষই ফিলিস্তিনি বন্দী মুক্তির বিষয় সুরাহা করতে সম্মত হয়েছে। ট. গাজায় একটি সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে এক মাস পর আলোচনা হবে। এই স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ কার্যকর করার বাইরে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সময়সাপেক্ষ কিছু বিষয় কার্যকর করার ব্যাপারে আলোচনায় উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑ ক. গত জুনে তিন ইহুদি ছাত্র অপহরণ ও হত্যার ঘটনার পর অধিকৃত পশ্চিমতীর থেকে এর আগে মুক্তি পাওয়ার পর আবার গ্রেফতার করা হামাস নেতাদের মুক্তি প্রদান। খ. ফাতাহ প্রধান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস দীর্ঘ দিন ধরে ইসরাইলি কারাগারে আটক ফিলিস্তিনি বন্দীদের যে মুক্তি চেয়েছিলেন, সেটি কার্যকর করা। ভেঙে যাওয়া শান্তি আলোচনার সময় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল। গ. যুদ্ধের সময় নিহত ইসরাইলি সৈন্যদের লাশ বা লাশের অংশ এবং সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্র গাজার হামাস ও অন্যান্য গ্রুপের কাছে ফেরত চেয়েছে তেলআবিব। ঘ. হামাস ফেরির মাধ্যমে পণ্য ও মানুষ আনা নেয়ার জন্য গাজায় একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও তা কার্যকর করতে চেয়েছে। ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি অসলো শান্তিচুক্তিতে এখানে একটি নতুন বন্দর নির্মাণ করার পরিকল্পনা অনুমোদন করা হলেও ইসরাইল এ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করতে দেয়নি। ইসরাইল নিরাপত্তা বিষয়ে অগ্রগতি হলে এ বিষয়ে আলোচনার অঙ্গীকার করেছে। প্রাচীনকালে গাজা ছিল পূর্ব ভূমধ্যসাগরের মধ্যে একটি প্রধান বন্দর, মসলা ব্যবসায়ের জন্য এটি বিখ্যাত ছিল। ঙ. হামাস গাজায় ইয়াসির আরাফাত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালু করতে চেয়েছে। ১৯৯৮ সালে এটি চালু হওয়ার পর কয়েক বছর যেতে না যেতেই ইসরাইল বোমা মেরে এটি ভেঙে দেয়। চালু করার জন্য এটি পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছে। চ. হামাস সরকারের ৪০ হাজার কর্মচারীর বেতন পরিশোধে প্রতিবন্ধকতা প্রত্যাহারে পদক্ষেপ চেয়েছে হামাস। এক বছর ধরে তারা বেতন পাচ্ছেন না। ইসরাইলের বাধার কারণে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ তাদের বেতন দিতে পারছে না। হামাসের দাবি ও অর্জন হামাসের মূল দাবি ছিল গাজার অবরুদ্ধতা প্রত্যাহার, সরকারের কর্মচারীদের বেতনভাতা প্রদান, পশ্চিমতীর থেকে নতুন করে গ্রেফতার করা হামাস নেতাদের মুক্তি প্রদান এবং গাজার সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর পুনর্নির্মাণ, পশ্চিমতীরের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা এবং বাফার জোনের নামে গাজার ভূমি ব্যবহারে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা। এর মধ্যে ইসরাইল ও মিসর তাদের সীমান্ত ক্রসিংগুলো খুলে দিলে প্রথম দাবি পূরণ হবে। এ দাবি না মানার কারণে তারা বারবার যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। সরকারি কর্মচারীদের বেতন দেয়ার বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়নের তালিকায় রাখা হয়েছে। এটি কার্যকর হলে ঐকমত্যের সরকারের স্বীকৃতিতে আর বাধা থাকে না। ইসরাইল কোনোভাবেই এই স্বীকৃতি দিতে চাইছিল না। গাজার পারাপারের ক্রসিংগুলোর দায়িত্ব মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন সরকারের নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এখন মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে টেকনোক্র্যাটদের নিয়ে গঠিত ঐকমত্যের সরকারই মূলত কাজ করছে। গাজার যুদ্ধে ইসরাইলের নিহত যেসব সৈন্যের লাশ রয়ে গেছে, তা ফেরত পাওয়া তাদের জন্য বড় ইস্যু। অপহরণকৃত এক ইসরাইলি সেনা এবং এসব লাশের বিনিময়ে হামাস নেতাদের মুক্তির একটি সমঝোতা করতে পারে। হামাস এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দরকষাকষির উপকরণ তাদের হাতে রাখতে পেরেছে। গাজার সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর নির্মাণের বিষয় ইসরাইলের আগের চুক্তির অঙ্গীকারের বিষয় ছিল। ইসরাইল এক মাস পর এ নিয়ে আলোচনা শুরু করার কথা বলেছে। দেশটি এ ব্যাপারে অগ্রসর হলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় এটি ব্যাপকভাবে কাজ করবে। এতে বাইরের বিশ্বের সাথে গাজার বিচ্ছিন্নতা পুরোপুরি কেটে যাবে। গাজার বাফার জোনের ভূমি ৩০০ মিটার থেকে ২০০ মিটার ছেড়ে দেয়া তাদের ভোগান্তিকে বেশ খানিকটা কমাবে এবং এ এলাকাকে চাষাবাদের আওতায় আনা যাবে। গাজার মানুষের জীবনধারণের জন্য সমুদ্র উপকূলে মাছ ধরার অধিকার পর্যায়ক্রমে ১২ মাইল পর্যন্ত ছেড়ে দেয়া বড় পদক্ষেপ হবে। পশ্চিমতীরের সাথে গাজার যোগাযোগ স্থাপনের বিষয় সমঝোতার মধ্যে দেখা যায় না। দাবির মধ্যে থাকলেও এটি খুব গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে হয়নি। শান্তিচুক্তির সমঝোতার বিষয়গুলোর খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করলে হামাসের জন্য বিজয় মিছিল করার মতো অনেক কিছু পাওয়া যাবে। কিন্তু এর সবকিছু নির্ভর করবে চুক্তির পক্ষগুলো বিশেষত ইসরাইল দীর্ঘস্থায়ী শান্তির ব্যাপারে কতটা আন্তরিকতার পরিচয় দেবে তার ওপর। এর আগে ২০১২ সালের শান্তিচুক্তির পর হামাস যুদ্ধবিরতি ভাঙেনি। একটি রকেটও ১৯ মাসে ইসরাইলে ছোড়া হয়নি। কিন্তু ফাতাহ-হামাস ঐকমত্য সরকারের পর ইসরাইলই উসকানি দিয়ে নতুন যুদ্ধ শুরু করেছে। এ কারণে এবারের শান্তিচুক্তির সাফল্যও অনেকখানি নির্ভর করবে ইসরাইলের ওপর। ইসরাইলের দাবি ও অর্জন গাজা অভিযানে ইসরাইলের প্রধান দাবির মধ্যে ছিলÑ ক. প্রতিরোধ সংগঠন হামাসকে নিরস্ত্রীকরণ খ. গাজার টানেল নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা গ. গাজা থেকে ইসরাইলে যে রকেট ছোড়া হচ্ছে সেই সক্ষমতা পুরোপুরি ধ্বংস করা ঘ. হামাস-ফাতাহ ঐকমত্যের সরকার বাতিল করে ফাতাহর নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হাতে গাজার কর্তত্ব হস্তান্তর। এর বাইরে ইসরাইলের একটি অঘোষিত লক্ষ্য ছিল ‘লনের ঘাস ছেদন’। গাজায় ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও অবকাঠামো ধ্বংস করে সেখানকার অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে গুঁড়িয়ে দেয়া হলো এ ক্ষেত্রে প্রধান কাজ। গাজার যুদ্ধে ইসরাইলের বিজয় হয়েছে এ কথা প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজেও দাবি করছেন না। তিনি বলছেন, এই যুদ্ধ থেকে যে লক্ষ্য অর্জন করতে চেয়েছিল তা হামাস অর্জন করতে পারেনি। তিনি এক সপ্তাহ পর যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গ্রহণ না করে তা সাত সপ্তাহ পর গ্রহণ করায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটাকে হামাসের ব্যর্থতা বলে চিহ্নিত করেছেন। সুনির্দিষ্টভাবে অবশ্য তিনি বলছেন না হামাস যেসব অর্জনের কথা বলছে, সেগুলো অসত্য কি না। ইসরাইলি পত্রিকা জেরুসালেম পোস্ট নেতানিয়াহুর পক্ষে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করলেও গাজা যুদ্ধকে ইসরাইলিরা নেতানিয়াহুর ব্যর্থতা হিসেবে দেখছে। যুদ্ধ যখন নেতানিয়াহু শুরু করেন, তখন দেশের ভেতরে তার সমর্থনের হার ছিল ৫৭ শতাংশের মতো। স্থল অভিযান শুরুর পর ২৩ জুলাইয়ে সমর্থন ৮২ শতাংশে উন্নীত হয়। এখন নেতানিয়াহুর সমর্থন ৩৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ইতোমধ্যে তার কোয়ালিশনে ভাঙনের সুর বেজে উঠেছে। কট্টরপন্থী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এভিগডর লিবারম্যান ও অর্থমন্ত্রী ন্যাফতালি ব্যানেটসহ মন্ত্রিসভার ৫০ ভাগ সদস্য যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্তের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। একজন প্রভাবশালী এমপি বলেছেন, নেতানিয়াহুর উচিত এখনই তার পদত্যাগপত্র প্রেসিডেন্টের কাছে দেয়া। গাজার এই যুদ্ধে ৬৪ জন ইসরাইলি সেনা ও ছয়জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার ক্ষতি স্বীকারের বিপরীতে হামাসের বেশির ভাগ টানেল অক্ষত এবং রকেট ছোড়ার ক্ষমতা বহাল রেখে শান্তিচুক্তি সম্পাদনকে অনেক ইসরাইলি নেতানিয়াহুর ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন। এ ছাড়া গাজাসংলগ্ন ইসরাইলি এলাকা থেকে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয়া এবং হামাসের রকেটে দীর্ঘ সাত সপ্তাহ পুরো ইসরাইল আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ার বিষয়টি নেতানিয়াহুর ইমেজকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যুদ্ধবিজয় মূল্যায়নে দুর্বল পক্ষকে সুস্পষ্টভাবে পরাজিত করতে না পারাকে শক্তিমান পক্ষের পরাজয় হিসেবে দেখা হয়। গাজা যুদ্ধে হামাসকে কোনো সময়ই পরাজিত করা গেছে বলে মনে হয়নি। ইসরাইলের ৭০ জন নিহত হওয়ার বিপরীতে গাজার দুই হাজার ২০০ জন নিহত হওয়া এবং ব্যাপক অবকাঠামো ধ্বংস হওয়াকে ইসরাইলের কেউ কেউ বিজয় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো আন্তর্জাতিক মূল্যায়নেই এটিকে গ্রহণ করা হচ্ছে না। অধিকন্তু ইসরাইলের জন্য বিপর্যয়কর হলো বিশ্ব জনমত দেশটির বিপক্ষে চলে যাওয়া। এবার আমেরিকা ও ব্রিটেনসহ ইউরোপের প্রায় সব বড় শহরে ইসরাইলের আগ্রাসন বিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে শান্তিকামী মানুষের। ইসরাইল আক্রমণ শুরু করার সময় যুক্তরাষ্ট্রের ৮০ ভাগ মানুষ তেল আবিবের অবস্থানকে সমর্থন করেছিল। একপর্যায়ে এই জনমত সমান সমান হয়ে যায়। অনূর্ধ্ব ৪০ বছরের বেশির ভাগ আমেরিকান গাজায় ইসরাইলের হামলার বিপক্ষে চলে যায়, এর প্রভাব কমবেশি আমেরিকান নীতিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এসব বিবেচনায় গাজা যুদ্ধ থেকে এই অবরুদ্ধ উপত্যকাটির এক-তৃতীয়াংশ ধ্বংস করা আর ৫০০ শিশুসহ দুই হাজারের বেশি মানুষ হত্যা ছাড়া ইসরাইলের খুব একটা প্রাপ্তি ঘটেনি। মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব গাজায় ইসরাইলের দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটিকে গোপনে সমর্থনদানকারী আরব দেশগুলোর শাসকেরা। অন্য দিকে লাভবান হয়েছে হামাসকে সমর্থনকারী দেশগুলো। ইসরাইলি মিডিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী, এবার মিসর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জর্ডান ইসরাইলের এই যুদ্ধকে সমর্থন করেছে। ইসরাইলের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ বলেছেন, ইসরাইলের ইতিহাসে আর কোনো যুদ্ধে এতসংখ্যক প্রভাবশালী আরব দেশের সমর্থন পায়নি তেল আবিব। এসব আরব দেশের প্রতিটিতে অভ্যন্তরীণ জনমত গাজা হামলায় সরকারের ভূমিকার ব্যাপারে এতটাই বিপক্ষে চলে গেছে যে, যুদ্ধের তিন সপ্তাহ পর গাজার ধ্বংসযজ্ঞের নিন্দা করে বিবৃতি দিতে হয়েছে সৌদি বাদশাহকে। আরব লিগের বৈঠকেও গাজায় ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞের নিন্দা জানাতে হয়েছে। মিসরের সরকারকে হামাসবিরোধী প্রচার-প্রোপাগান্ডা বন্ধ করতে হয়েছে। সৌদি অভ্যন্তরে পরিচালিত এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, দেশটির দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করেন মিসরে প্রেসিডেন্ট মুরসির সরকার বৈধ ছিল আর বর্তমান সিসির সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় বসেছে। গাজা যুদ্ধের আগে কিন্তু পরিস্থিতি এ রকম ছিল না। জর্ডান-আমিরাতসহ উপসাগরীয় অন্যান্য দেশেও এই ইস্যুতে জনমত সরকারের বিপক্ষে চলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। মিসরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি শেষ পর্যন্ত হলেও দেশটি এককভাবে এটি করতে পারেনি। সিসির মিসর ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও হামাসের শত্রুভাবাপন্ন হিসেবে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় দেশটির যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কাতার, তুরস্ক, নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতার পরই মিসরের পক্ষে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদন সম্ভব হয়েছে। অন্য দিকে হামাসকে সমর্থনকারী ও এর নেতাদের আশ্রয়দাতা কাতার মধ্যপ্রাচ্যে একেবারেই কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। গাজায় হামাসের সফল প্রতিরোধের পর কাতারের গুরুত্ব মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অনেক বেড়েছে। সৌদি আরবের সাথে কাতারের যে টানাপড়েন চলছিল, তার বেশখানিকটা অবসান ঘটেছে গাজায় যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। এ সময় কাতারের আমির সৌদি আরব সফর করেছেন এবং বাদশাহ আবদুল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ এবং ক্রাউন প্রিন্স সালমানের সাথে বৈঠক করেছেন। হামাসের আরেক সমর্থক তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগান নির্বাচনের প্রথম দফাতেই ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। প্রধান দুই বিরোধী দল যৌথ প্রার্থী দেয়ার পরও তাদের ভোটের অংশ আগের স্থানীয় সরকারের সময় পাওয়া ভোটের চেয়ে কমে গেছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গাজায় ইসরাইলি হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরাট প্রভাব পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সার্বিক রাজনীতিতে কাতার-তুরস্ক এই দ্বৈতের প্রভাব ও গুরুত্ব বেড়েছে এই যুদ্ধের পর। পিএলওর অর্জন মার্কিন মধ্যস্থতায় ফিলিস্তিন-ইসরাইল শান্তি আলোচনা নেতানিয়াহুর অনমনীয়তার জন্য ভেঙে পড়া এবং পশ্চিমতীরে অব্যাহতভাবে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণে বেশ বিব্রতকর এক অবস্থার মধ্যে ছিলেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে তিনি হামাসের সাথে ঐক্যচুক্তির মাধ্যমে সমঝোতার সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। এ সরকারকে ভেঙে দেয়ার জন্য ইসরাইলের চাপের মুখে তিনি নত হননি। গাজায় ইসরাইলি হামলা শুরুর পর তিনি বরাবরই ফিলিস্তিনি স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। সেই সাথে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছার জন্য গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি নিজের অবস্থানকে শক্তিমান করতে চেয়েছেন। হামাসের মতো কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত দলের সাথে যুদ্ধে বিজয়ী হতে না পারায় এখন মধ্যপন্থীদের সাথে ইসরাইলের শান্তি আলোচনা ভেঙে দেয়াকে দায়ী করা হচ্ছে দেশটির অভ্যন্তরে। এ অবস্থায় শান্তিপূর্ণ সমাধানের চাপ ইসরাইলে বাড়তে পারে। এতে আন্তর্জাতিকভাবে মাহমুদ আব্বাসের গুরুত্ব বাড়বে। তিনি ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনকে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ পাবেন। ব্রাদারহুডের প্রাপ্তি গোটা মধ্যপ্রাচ্যে মধ্যপন্থী ইসলামিস্টদের প্রধান শক্তি হলো মুসলিম ব্রাদারহুড। ব্রাদারহুড সংশ্লিষ্ট দল হিসেবে পরিচিত হামাস। মিসরে ড. মুরসির গণতান্ত্রিকভাবে প্রথম নির্বাচিত সরকার উৎখাতের পর যে বৈরিতা, হত্যা, নিপীড়ন দলটির ওপর নেমে এসেছিল, তাতে গাজায় হামাসের সাফল্য তাদের যথেষ্ট উজ্জীবিত করবে। এর মাধ্যমে মুসলিম ব্রাদারহুড যে মধ্যপ্রাচ্যের অনস্বীকার্য একটি প্রধান শক্তি, সেটি আবার প্রতিষ্ঠিত হলো। এর মধ্যে ইরাক-সিরিয়ার বিরাট অংশজুড়ে প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক স্টেট আশপাশের সব আরব দেশের জন্য আশু নিরাপত্তা হুমকিতে রূপ নেয়ায় ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে যে সর্বগ্রাসী আঘাত শুরু হয়েছিল, সেটি নমনীয় হবে। মিসরের জেনারেলরা ইতোমধ্যে সমঝোতার প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন ব্রাদারহুড নেতাদের কাছে। সৌদি আরবও দলটির প্রতি কিছুটা নমনীয় হতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে গাজায় হামাসের সাফল্য মধ্যপ্রাচ্যের এই ইসলামি আন্দোলনে নতুন শক্তি সঞ্চার করতে পারে। ফিলিস্তিনে শান্তি কত দূর? গাজায় ইসরাইলি ব্যর্থতার একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে। দেশের অভ্যন্তরে নেতানিয়াহুর ওপর কট্টর ও উদারপন্থী দুই পক্ষের চাপই বাড়তে পারে। নেতানিয়াহুর কোয়ালিশন সরকার ভাঙনের মুখেও পড়তে পারে। তেমন কিছু হলে দেশটিতে নতুন একটি মধ্যপন্থী সরকার গঠন হতে পারে। অথবা হতে পারে নতুন নির্বাচন। সেটি হলে শান্তিপ্রক্রিয়া থেকে ইসরাইল যেভাবে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে পশ্চিমতীরে সর্বাত্মক কর্তত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তার পরিবর্তন হতে পারে। উপসাগরীয় নেতৃস্থানীয় আরব দেশগুলোর নিজেদের জনগণের কাছে ইমেজ পুনরুদ্ধারের জন্য ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দৃশ্যমান কিছু একটা করার প্রয়োজন হতে পারে। এসব কারণে শান্তিচুক্তির প্রক্রিয়া আবার শুরু হতে পারে। অন্য দিকে গাজা যুদ্ধের পর শান্তি আলোচনায় হামাসকে পক্ষ করার ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলোতে চাপ অনেক বেড়েছে। এ ব্যাপারে সরাসরি কথা বলেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও ব্রিটিশ উপপ্রধানমন্ত্রী নিক ক্লেগ। এতে করে ফিলিস্তিন সমস্যা শিগগিরই সমাধান হয়ে যাবে এমন কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও এ ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি হতে পারে। যে ভূখণ্ডে দখলদারি শক্তির হামলায় যুদ্ধাহত একটি ছোট্ট শিশু হাপাতালের বেডে শুয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বিজয়ের চিহ্ন দেখায়, সে জনপদে প্রতিরোধের শক্তির যে প্রবল উত্থান ঘটছে তাতে সন্দেহ থাকে না। এই শক্তিটিই এক সময় ফিলিস্তিনিদের জয়ী করবেÑ এমন বার্তা পাওয়া যায় এবারের গাজা সঙ্ঘাতে।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির