post

গাদ্দাফির পতন স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র দুটোই চাই

১৮ নভেম্বর ২০১১
মীযানুল করীম আফ্রিকার লৌহমানব গাদ্দাফির মৃত্যু ঘটেছে। ইস্পাতদৃঢ় জনগণের বিদ্রোহে বিজয়ের চূড়ান্ত ঘটনা হিসেবে ২০ অক্টোবর তিনি লিবিয়ার সাগরতীরবর্তী সিরতে শহরে বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার সাথে সাথে নিহত হন। যেখানে ১৯৪২ সালে এক বেদুঈন পরিবারে মুয়াম্মারের জন্ম, সে শহরটিতেই ২০১১ সালে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হলো। গাদ্দাফি গোত্রের এই ব্যতিক্রমধর্মী ও উচ্চাভিলাষী মানুষটি আসল নামের বদলে গাদ্দাফি হিসেবে ছিলেন সারা বিশ্বে পরিচিত। মূলত ক্বদ্দাফি হলেও উত্তর আফ্রিকার সাগরের অঞ্চলের আরবি ভাষায় এর উচ্চারণ গাদ্দাফি। যা হোক, তার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শুধু লিবিয়া নয়, মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের এক উদ্ভট বর্ণিল আলোড়নসৃষ্টিকারী মহাচরিত্রের চিরবিদায় ঘটলো। নন্দিত-নিন্দিত গাদ্দাফি মুসলিমবিশ্ব ও আফ্রিকার মহানায়ক হতে চেয়ে কর্মদোষে ও ভাগ্যবিপর্যয়ে খলনায়করূপে প্রস্থান করেছেন। বছরের প্রথম দিকে সূচিত গণ-আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহের রূপ নিয়ে তাঁকে ত্রিপোলিতে কোণঠাসা করে ফেলেছিল অনেক আগেই। ২২ আগস্ট এই রাজধানীর পতন গাদ্দাফিকে বাধ্য করে সমর্থক বাহিনীসমেত পলায়নে। তবে প্রতিবেশী আলজেরিয়া কিংবা নাইজারে তার আশ্রয় নেয়ার সম্ভাব্যতার পরও তিনি স্বদেশ ছাড়েননি। অনমনীয় গাদ্দাফি রাজধানী হারিয়ে আরো দু’মাস সর্বশেষ অবস্থানে টিকে থেকে লড়ে গেলেও পরাজয়ই ছিল তার জন্য নির্ধারিত। বিদ্রোহীদের ত্রিপোলি দখলের সাথে সাথেই গাদ্দাফিযুগের অবসান হয়ে গেছে। নতুন প্রশাসন ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (এনটিসি) ঘোষণা দিয়েছিল, পুরোপুরি গাদ্দাফিমুক্ত হলেই লিবিয়াকে স্বাধীন ঘোষণা করা হবে। আমরা আশা করি, এই চেতনায় দেশের ভেতরের স্বৈরতন্ত্র যেমন পরাস্ত হয়েছে, তেমনি বাইরের সব আগ্রাসন বা এর হুমকিরও সকল মোকাবেলা করা হবে। স্বাধীন লিবিয়া গণতন্ত্র ও সুশাসনের মাধ্যমে প্রকৃত উন্নয়ন ঘটিয়ে জনকল্যাণমূলক সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হওয়াই আমাদের প্রত্যাশা। গাদ্দাফির জীবনের শেষ পরিণতি তার কৃতকর্মের বিবেচেনায় যেমন স্বাভাবিক, তেমনি মর্মান্তিকও। একটি ইংরেজি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় অভিমত হলো, Tragically cruel as has been the end of Gaddafi, the truth is, as he lived by bullet, so he died by it. It was his hubris that dragged the end-game on.  অর্থাৎ গাদ্দাফির বিদায় ঘটেছে মর্মান্তিক নিষ্ঠুরতার সাথে। সত্য হলো, তিনি বুলেটের জোরে জীবন কাটিয়েছেন, এখন বুলেটাই তার মরণ ডেকে এনেছে। তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ অহঙ্কার শেষ পর্বটি প্রলম্বিত করেছে। স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী গণ-আন্দোলনের সময় প্রেরণা জোগাতেন সিভিল সোসাইটির যেসব অগ্রণী ব্যক্তিত্ব, বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন তাদের একজন। এরশাদ ক্ষমতা জবরদখল করে অন্যায়ভাবে সরিয়ে দেন আবদুর রহমান চৌধুরী ও মোহাম্মদ হোসেনের মতো বিচারকদের। সেই বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন বলতেন, ‘এরশাদের সামনে তিন ধরনের ত্যাগের পথ খোলা। তার পরিণতি হবে হয় পদতাগ, না হয় দেশত্যাগ, অন্যথায় প্রাণত্যাগ।’ এরশাদ অনেক দেরিতে হলেও পদত্যাগ করায় অন্য দুই ধরনের ত্যাগের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু লিবিয়ার গাদ্দাফিকে বারবার পদত্যাগ করতে বলা হলেও তিনি বিদ্রোহীদের এ দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন। এমনকি পদ ও প্রাসাদ হারিয়েও ক্ষমতায় ফেরার খায়েশ হারাননি। দেশে লুকিয়ে থেকেছেন দুই মাস। দেশত্যাগ না করার পরিণামে আজ পর্যন্ত প্রাণত্যাগ করতে হলো। গাদ্দাফি হয়তো ক্ষমতাচ্যুত ও বিতাড়িত হয়েও বিদেশে না গিয়ে নিজেকে দেশপ্রেমিক হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু ১৯৬৯-এ ক্ষমতাদখলের সময় জনগণের যে আস্থা ছিল তাঁর প্রতি, ২০১১-তে ক্ষমতা ছাড়ার অনেক আগেই তিনি সে আস্থা হারিয়েছেন। জনগণ আশ্রয় না দিলে দেশের ভেতর-বাইরের কোনো শক্তির প্রশ্রয়ও স্বেচ্ছাচারী ও গণবিরোধী শাসককে বাঁচাতে পারে না। মনে করা হতো, নিজে ক্ষমতা না ছাড়লে যাকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না, তিনি হলেন গাদ্দাফি। বাস্তবে জনবিদ্রোহের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে তাঁকে কিভাবে পালিয়ে লুকাতে হলো আর লাঞ্ছিত হয়ে মরতে হলো, তা আজ বলার অপেক্ষা রাখে না। গত বছর ডিসেম্বরে গণতন্ত্রের দাবিতে মুক্তিকামী জনতার অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনের সূচনা আরব বসন্তের আবির্ভাব ঘটায় । এর শুরু লিবিয়ার পাশের ছোট দেশ তিউনিসিয়ায়। পতন ঘটে স্বৈরশাসক বেন আলীর। এরপর লিবিয়ার আরেক পাশের অপেক্ষাকৃত বড় পড়শিরাষ্ট্র, মিসরে গণঅভ্যুত্থান আরম্ভ হয়ে যায়। সেখানেও দীর্ঘদিনের একনায়ক অর্থাৎ মোবারককে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়। তখন লিবিয়ায় এর প্রভাব পড়লেও তা সামান্য। গাদ্দাফি শিক্ষা নেননি দুই প্রতিবেশী শাসকের পতন থেকে। ভেবেছিলেন, আমি ছাড়া লিবিয়া তো চলবে না’ আর ‘জনগণ আমাকে ভালবাসে’। বশংবদবেষ্টিত, গণবিচ্ছিন্ন গাদ্দাফির এই বিভ্রমের ঘোর কাটতে না কাটতে ক্ষমতা ও জীবন দুটোই হারিয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারিতে লিবিয়ায় গণ-আন্দোলন আবার শুরু হয়ে ক্রমশ উত্তাল হয়ে ওঠে। পরের মাসে সেনাবাহিনীর একাংশ বিদ্রোহ করে এতে যোগ দিলে ‘গাদ্দাফি হঠাও’ সংগ্রামে নতুন মাত্রা যোগ হয়। দেশজুড়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। সুযোগ বুঝে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী সাহায্যের হাত বাড়ায়। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে জাতিসংঘের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পাশ্চাত্য তাদের ‘জানের দুশমন’ গাদ্দাফিকে শায়েস্তা করতে চায়। সরকারি ও বিদ্রোহী বাহিনীর হামলা- পাল্টাহামলা, দখল-পুনর্দখল, সাফল্যের পাল্টাপাল্টি দাবি ইত্যাদির মাঝে মাসের পর মাস অতিবাহিত হয়। এর পাশাপাশি জনসমর্থিত বিদ্রোহীরা ‘এনটিসি’ নামে অস্থায়ী সরকার গঠন করে। গাদ্দাফির সামরিক- বেসামরিক কর্মকর্তা ও কূটনীতিকদের উচ্চপর্যায় থেকে অনেকেই বিদ্রোহী পক্ষে শামিল হলেন। এনটিসি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে থাকে। তবে জুন-জুলাইতে গৃহযুদ্ধ অচলাবস্থায় উপনীত হয়। যখন মনে হচ্ছিল গাদ্দাফিকে হঠাতে অনেক সময় লাগবে যদিও তার পক্ষ কোণঠাসা, তখন হঠাৎ ২২ আগস্ট বিদ্রোহীরা রাজধানী ত্রিপোলি দখল করে। সদলবলে গাদ্দাফির পলায়ন। এরপরও তার হুঙ্কার থামেনি, যদিও লুকিয়ে ছিলেন। শোনা গিয়েছিল, তিনি পাশের আলজেরিয়া বা নাইজারে পালাতে পারেন। তবে রহস্যজনকভাবে দেশেই নিজ এলাকায় আত্মগোপন করে থাকেন এবং ক্ষমতায় ফেরার দিবাস্বপ্ন দেখেছেন। আসলে ত্রিপোলি থেকে বিতাড়িত হওয়ার সময়েই তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। গাদ্দাফির মৃত্যুর ফলে এনটিসি পূর্ণাঙ্গ সরকার গঠনের পথ সহজ হলো। ঊষর মরুভূমির গর্ভ ‘কালো সোনা’ বা জ্বালানি তেলে এতই সমৃদ্ধ যে, গাদ্দাফির উত্থান ও পতনের পেছনে এটা একটা বড় ফ্যাক্টর হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। ন্যাটোসহ পাশ্চাত্যের কাছে লিবিয়ার গুরুত্বের একটা বড় কারণও এই তেলের খনি। গাদ্দাফি তার চমক, ধমক ও ঠমকের জন্য বহুলালোচিত ছিলেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ‘অন্যরকম’ পদক্ষেপের চমকের পাশে ধমক দেয়া ছিল তাঁর স্বভাব। তবে এই ধমক বা হুমকি এক পর্যায়ে শুধু দেশের ব্যাপারেই সীমিত হয়ে পড়ে। তদুপরি ছিল, জীবনযাত্রায় রাজকীয় আড়ম্বরের ঠমক বা জাঁকজমক। অথচ এই গাদ্দাফিই বেদুঈন জীবন যাপনেকে শ্রেয় ভেবে তাঁবুতে থাকতেন প্রাসাদ ছেড়ে। এমনকি, নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে সেখানেও রাস্তায় তাঁবু বানিয়ে রাত কাটালেন। গাদ্দাফি রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান হলেও আনুষ্ঠানিক পদবি বর্জন করতেন। ‘প্রধানমন্ত্রী’ হয়ে আবার এই পদবি বিসর্জন দিলেন। বিদেশে দূতাবাস ও রাষ্ট্রদূতের পদবির নামও বদলালেন। তাঁর দেহরক্ষীরা ছিল দুর্ধর্ষ, তবে নারী। এদের মধ্যে ইউরোপের কোনো কোনো দেশের তরুণীও ছিল। গাদ্দাফি না ক্ষমতা ছেড়েছেন, না দল গড়েছেন, আর না উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করেছেন। গাদ্দাফি চলে গেছেন, তবে রেখে গেছেন সবার জন্য শিক্ষা। তার চার দশকের শাসনকাল, তথা উত্থান-বিকাশ-পরিণতি থেকে শুধু তার মতো স্বৈরাচারীদেরই নয়, অন্যদেরও শেখার আছে অনেক কিছু। যেমন : ১. আদর্শের নামে জগাখিচুড়ি দিয়ে প্রথমে চমক লাগানো যায়, তবে দেশ চালানো যায় না। গাদ্দাফি ক্ষমতায় এসেই একই সাথে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ইসলামকে তার আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। পরস্পর ভিন্ন ও বিপরীতধর্মী আদর্শের এই সম্মিলন শুরুতেই তার সম্পর্কে নিদারুণ বিভ্রান্তি ও সন্দেহের জন্ম দেয়। ২. স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র দু’টিই মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাদ্দাফি আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদের মোকাবেলায় স্বাধীনতার চেতনায় জাতিকে জাগাতে চেয়ে দীর্ঘদিন সফল হয়েছিলেন। তবে সেই সাথে গণতন্ত্রকে গুরুত্ব না দেয়ায় ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারিয়ে এবং ইমেজ খুইয়ে তিনি জাতির কাছে এক অবাঞ্ছিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। ৩. জামাহিরিয়া বা জনগণের রাষ্ট্রের নামে গাদ্দাফি তাদের নাগরিক অধিকার হরণ করেছেন। মৌলিক অধিকার না দিয়েই নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রকৃত অর্থে কোনো নির্বাচন দেননি। ফলে তিনি যে ক্রমবর্ধমান হারে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে এক পর্যায়ে পরিণত হয়েছেন গণশত্রুতে, তা বুঝতে পারেননি। ৪. গাদ্দাফি ভাবতেন, তিনি ও তার বশংবদ মহলটিই দেশপ্রেমিক, তার সমালোচকেরা দেশদ্রোহী। স্বাধীনতার সোল এজেন্ট ভাবতেন নিজেকে। বিরোধী দল এবং ভিন্নমতের ব্যক্তিকে মনে করতেন স্বাধীনতার শত্রু। দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড তার কাছে ছিল অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি আর সরকার উৎখাতের যড়যন্ত্র। এমন মানসিকতা যে সন্দেহ ও অহঙ্কার জন্ম দিয়েছিল, তা তাকে আরো ক্ষমতাদর্পী ও নিপীড়ক করে তোলে। ৫. জননন্দিত শাসক স্বেচ্ছাচারী হয়ে জননিন্দিত হয়ে ওঠে। মোসাহেববেষ্টিত এবং কঠোর প্রহরায় ‘সুরক্ষিত’ একনায়ক দমন ও দুর্নীতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। স্বজনপ্রীতি, পরিবারতন্ত্র, ক্ষমতালোলুপতা, জনসম্পদের অপচয় ও আত্মসাৎ, মানবাধিকার হরণ প্রভৃতি মিলে শাসকের ওপর জনআস্থা তো নষ্ট করেই। তদুপরি ক্রমশ তাকে জনগণের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ছাড়ে। তখন বেনিফিশিয়ারিদের নেতৃপূজা সে নেতা বা নেত্রীর ইমেজ মোটেও উন্নত করে না। ৬. অ্যাডভেঞ্চারিজম ও রোমান্টিসিজম অনেক ‘বিপ্লবী’র প্রবণতা। এই হঠকারী ও উগ্র স্বভাবের পেছনে চরম আবেগ থাকলেও বাস্তবতার মূল্যায়ন থাকে না। তাই হঠকারিতা অনেক ক্ষেত্রে বিপরীত মেরুতে স্থানান্তরিত হয়, অর্থাৎ আপসকামিতা ও সুবিধাবাদে রূপ নেয়। গাদ্দাফির প্রথমদিকের পাশ্চাত্যবিদ্বেষ এবং বিপ্লবী হঙ্কার অবশেষে আপস ও গোপন সমঝোতায় রূপ নিয়েছিল। ৭. গণতন্ত্র, দেশপ্রেম, সুশাসন, মানবাধিকার, বিপ্লব ইত্যাদির সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য কেউ খেয়ালখুশিমতো নির্ধারণ করে তা চাপিয়ে দেয়ার অধিকার রাখে না। গাদ্দাফি সেটাই করতে চেয়েছেন। নিজের সর্বময় ও স্বৈরাচারী কর্তৃত্ব স্থায়ী করার জন্য তিনি তাঁর উদ্ভট স্টাইলের গণতন্ত্র ও বিপ্লব আবিষ্কার করেছিলেন। বাস্তবে এই গণতন্ত্র ছিল তার স্বেচ্ছাতন্ত্র এবং ‘বিপ্লব’টি জনগণের মুক্তি না এনে বরং তাদের চরম দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। ৮. দমনপীড়ন, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ, আইনের অপব্যবহার, নির্যাতনের স্টিমরোলার, মিথ্যা প্রচারণা ইত্যাদি যতই হোক না কেন, স্বৈরাচারীর শেষ রক্ষা হয় না। স্বেচ্ছাচারী শাসনের পতন তো হবেই, সাধারণত তা হয় মর্মান্তিকভাবে। গাদ্দাফি বিদেশী কর্তৃত্বের অবসান ঘটানোর মাধ্যমে স্বাধীনতার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা বলে ক্ষমতায় এসেছিলেন যৌবনে। সেই মানুষটিই গণতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে দীর্ঘকাল শাসন করে বার্ধক্যে বিদায় নিলেন জনগণের ধিক্কার কুড়িয়ে। রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানে যার আগমন, রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানে তার নির্গমন। জাতির ভাগ্য ফিরিয়ে লিবিয়ার মহানায়ক হওয়ার প্রত্যাশা ছিল তাঁর প্রতি। তার বদলে নিজের আর পরিবারের ভাগ্য গড়ায় ব্যস্ত গাদ্দাফি হয়ে উঠলেন একনায়ক। তাঁর বহুল ঘোষিত ‘সবুজ বিপ্লব’-এর বাগাড়ম্বর গাদ্দাফি পরিবারে আড়ম্বর আনলেও লিবীয় মরুর ধূসরতাই জাতির নিয়তি হয়েছিল। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেননি গাদ্দাফি। যারা তাকে হঠিয়ে এখন ক্ষমতায় তাদের ওপর জাতির প্রত্যাশা বিপুল। তাঁরা গাদ্দাফির দৃষ্টান্ত যেন ভুলে না যান। গাদ্দাফিমুক্ত লিবিয়াকে তারা পুনঃস্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এই স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে, যদি লিবিয়াকে যে কোনো বহিঃশক্তির আধিপত্য থেকে মুক্ত রেখে জাতীয় সম্পদের ওপর জাতির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে সুরক্ষা এবং যুদ্ধে বিজয়ের চেয়ে এর লক্ষ্য পূরণ করা কঠিন হলেও তা করতে হবে। গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ার জন্য তাই বিরাট পরীক্ষা । মুসলিম বিশ্বসহ তাবৎ শান্তিকামী মানুষের আশা, লিবিয়া প্রকৃত স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে একটি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী জাতির পরিচয় লাভে সফল হবে। গাদ্দাফি রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে শাসকের আসনে বসেছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন, এবার গণতন্ত্র কায়েম হবে এবং তা-ও জনগণের গণতন্ত্র, অর্থাৎ একশ ভাগ খাঁটি। বাস্তবে ‘প্রজাতন্ত্র’ হয়নি, বর জনগণকে প্রজা ভেবেছেন রাজার আমলের মতো । সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে রাজা ইদ্রিসের যতটা না ক্ষমতা ছিল, কথিত জনগণতন্ত্রে গাদ্দাফির প্রতাপ ছিল অনেক বেশি। হয়তো এ জন্যই তার নামে বিশেষণ প্রযুক্ত হয়েছিল ‘রাজার রাজা’। তিনি মধ্যযুগীয় সামন্তকায়দায় শাসন করেছেন আধুনিক যুগে সাম্যবাদের বুলি ঝেড়ে। দেশের মানুষের নাগরিক অধিকার ছিল না। গণতন্ত্র থাকলেই না দেশবাসী ‘প্রজা’ থেকে ‘নাগরিক’-এর মানে উন্নীত হয়। গাদ্দাফি বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে দেশে দেশে বিপ্লব ঘটাবেন, তাঁর নিজস্ব স্টাইলে নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ঘটাবেনÑ এমন রোমান্টিক স্বপ্ন দেখতেন। লিবিয়াকে জামাহিবিয়া বা ‘জনগণের রাষ্ট্র’ ঘোষণা দিয়ে জনগণের অধিকার হরণ করেছেন। ‘গণতন্ত্র’ নাম দিয়ে বাস্তবে কায়েম করেছেন স্বৈরতন্ত্র। নিজে ইচ্ছামতো স্বপ্ন দেখলেও দেশের মানুষ কী স্বপ্ন দেখেছে, তার খবর রাখেননি। গণতন্ত্র ও দেশপ্রেমের হোতা সেজে এমন ভাব দেখাতেন যে, শুধু তাঁর স্বপ্নই বাস্তবায়িত হওয়ার অধিকার রাখে। লিবিয়ায় গাদ্দফির দীর্ঘ স্বৈরশাসনের কারণে আমরা যেন তার ক্ষমতায় আসার পটভূমি ভুলে না যাই। তেমনি ইঙ্গ-মার্কিন সহায়তায় গাদ্দাফি উৎখাত সম্ভব হওয়ার আনন্দে যেন অতীতে লিবিয়ার জাতীয় সম্পদে এই দু’টি বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণের কালো ইতিহাস বিস্মৃত না হই। একই সাথে এটাও উল্লেখ করা দরকার, গাদ্দাফির চার দশকে লিবিয়ার অবকাঠামো, শিক্ষা ও জ্বালানি সম্পদসহ যতটা উন্নতি হয়েছে, তারও যথাযথ স্বীকৃতি দেয়া উচিত। তবে শিক্ষণীয় হলো, স্বৈরশাসনের দরুন গাদ্দাফি জনআস্থা হারিয়ে ফেলায় তার শাসনের ইতিবাচক দিকগুলো ম্লান হয়ে গেছে। আজ লিবিয়ার জন্য স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র, দুটোই জরুরি। নিজ দেশে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সাহসী ভূমিকা রাখলেও যে, পজিটিভ ইমেজ গড়ে ওঠে না, গাদ্দাফি তার প্রমাণ। এখন ক্ষমতাসীন এনটিসি এই একনায়কের পতন থেকে শিক্ষা নেবে এবং লিবিয়ার ইতিহাসের বিস্মৃতি বা বিকৃতি কোনোটাই ঘটবে না বলেই আমাদের প্রত্যাশা। গাদ্দাফি ইতিহাস ভুলে স্বাধীনতার সোল এজেন্ট সেজে গণতন্ত্র নস্যাৎ করেছিলেন। তাঁর উত্তরসূরিরা ইতিহাস ভুলে গেলে গণতন্ত্রের ডামাডোলে স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে ইরাক-আফগানিস্তানের মতো। গাদ্দাফি জনগণের বিরাট প্রত্যাশাকে পুঁজি করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। এরপর ক্রমান্বয়ে জাতিকে করেছেন হতাশ। তাই তার পতন ঘটেছে লিবীয় জনগণের বিরাট আশাবাদের মধ্যে। তারা দেখিয়ে দিয়েছেন জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতি ভালো হয় না। যারা মানবাধিকার হত্যা করে নির্বিচারে, অনেক সময় তাদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও নিহত হয় বিনাবিচারে। গাদ্দাফি এর জ্বলন্ত প্রমাণ। এখন নয়াশাসক এনটিসি এবং তাদের উত্তরসূরিদের জনপ্রত্যাশা উপলব্ধি করতে হবে। জনগণ স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করবে না এবং গণতন্ত্রের প্রশ্নে ছাড় দেবে না- এটাই লিবিয়ার শিক্ষা। গাদ্দাফি-উত্তর ত্রিপোলির শাসকরা এটা ভুলে গেলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিই স্বাভাবিক।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির