মানুষের জীবন যখন পার্থিব প্রাচুর্যের সাময়িক আনন্দ বিহ্বলতায় ভাসতে থাকে, তখন তাদের অবয়বিক চেহারায় এক অত্যুজ্জ্বল গৌরবর্ণাঢ্য রশ্মিচ্ছটা ঝিলিক মারতে থাকে। অতি আনন্দের আতিশয্যে মনের গহিন থেকে অভিব্যক্তি প্রকাশে মুখনিঃসৃত বিভিন্ন ধরনের সুখসম্ভারে আপ্লুত বাহারি বচনভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। সাধারণদের কাছে ঐ আপ্লুত অভিব্যক্তিগুলা তখন একটা ভিন্ন অবিমিশ্র মাত্রায় অনুভূত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের কিংবা বিরোধীদলের নেতৃবৃন্দের বক্তব্য বচনে ঐরূপ অবস্থার প্রতিচ্ছবি পরিদৃষ্ট হচ্ছে বলে অনুমিত হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিরোধী দলসমূহের ইতঃপূর্বে সংঘটিত সরকার পতন আন্দোলনে বিভাগীয় সমাবেশ ১০ ডিসেম্বর/২২ ঢাকা, ১১ জানুয়ারি/২৩ বিভাগীয় অবস্থান কর্মসূচি, পরবর্তীতে ঘোষিত ১৬ এবং ২৫ শে জানুয়ারি/২৩ সারাদেশে সমাবেশ এবং মিছিল এসব পর্যায়ক্রমিক আন্দোলনে সরকারি দলের কাছে যেসব মেসেজ পৌঁছানো হচ্ছে কিংবা ক্ষমতাসীনরা যে সকল বার্তা অনুভব করছেন, তাতে তারা মোটেও বিচলিত নন, শঙ্কিত নন বলে যেসব বচনধারা প্রকাশ করেছেন তাতে যেমন একদিকে মুখাবয়বে আনন্দ উচ্ছলিত অত্যুজ্জ্বল গৌরবর্ণিল রশ্মিচ্ছটা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। অপরদিকে দেশ জাতি পেরিয়ে বহির্বিশ্বের অশেষ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রসমূহ বিশেষ করে যাদের দয়া-দাক্ষিণ্যে এ দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশসমূহকে সদা নির্ভরশীল থেকে চলতে হয় তাদের রাষ্ট্রের ভাষ্যে, ডিপার্টমেন্টাল বিবৃতিতে, কূটনৈতিক বক্তব্যে, উন্নয়নবান্ধব পরিকল্পিত নসিহতে, মাঝে মধ্যে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা কিংবা স্যাংশান অস্ত্র কার্যকরী হওয়ার উদ্বিগ্নতায় সদা তটস্থ কিংবা সন্ত্রস্ত থেকে কী করে ক্ষমতার লাগাম কুক্ষিগত রাখা যায় সে বিষয়ে রাষ্ট্রীয় বক্তব্য কী বচনে, কোন ধারায়, কোন অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করলে শ্যামকেও আস্থায় রাখা যায়, সাথে সাথে কুলকেও রক্ষা করা যায় সেদিকে বিবেচনা রেখেই ক্ষমতাসীনদের বাচনিক বক্তব্য প্রকাশ করতে হচ্ছে। মূলত ঐসব বাচনিক বক্তব্যে দেশ জাতি রাষ্ট্রসহ বিদেশি রাজনীতিক, কূটনীতিক এবং বিশিষ্ট রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে এক অবিমিশ্র ধারায় প্রতিফলিত হচ্ছে যা অনেক ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক, বিহবল সংশায়িত এবং শঙ্কিত বলে প্রতীয়মান হয়। যেমন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরোধীদের প্রতি দৃঢ়চেতা এবং প্রত্যয়ী উক্তি “ধাক্কা দিলেই আওয়ামী লীগ পড়ে যাবে এত সহজ নয়।” টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে প্রতিজ্ঞা “ছিনিমিনি খেলতে দেব না দেশকে নিয়ে।” (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৮.১.২৩) ইত্যাদি।
যেমন “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশের উন্নতি হয়, আর অন্য আমলে সব লুটে পুটে খায়।” আওয়ামী লীগ নেত্রী আরো দৃঢ়তার সঙ্গে উক্তি করেন, “আমরা ভোট চুরি করতে যাব কেন? জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের ভোট দেয়।” দেশের বিরোধীদলকে উদ্দেশ্য করে মাননীয় নেত্রী স্পষ্ট করে ভাষণ দেন, “বিএনপি বেশি বাড়াবাড়ি করলে এবার খালেদাকে জেলে যেতে হবে।” তিনি আরো দৃঢ়চিত্ত নিয়ে বলেন, “এবার ওদের বিরোধীদের হাত আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হবে।” “কোনক্রমেই দেশকে ওদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না।”- ওপরের বচনগুলো পর্যালোচনা করলে যে সত্যগুলো বেরিয়ে আসে তা হলো-
(এক) রাষ্ট্রনীতির ভাষায় একটি দেশের ক্ষমতাসীনদের বলা হয় ‘সরকার’ ‘গভর্নমেন্ট’। আবার সরকার বা গভর্নমেন্ট দেশের যেকোনো দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল হতে পারে চাই সে তারা এককভাবে হোক কিংবা সম্মিলিত জোটবদ্ধভাবে হোক। মূলত ক্ষমতাসীনদের বলা হয় ‘সরকার’ এটা হল রাষ্ট্রনীতির ভাষা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষা। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীনরা রাষ্ট্র সরকারের যে ধারণা তা পাল্টে দিয়ে ক্ষমতাসীনদের দলীয় ধারণায় পর্যবসিত করতে চায়। যেমন দেশের জনগণের আন্দোলন, সংগ্রাম মিছিল, মিটিং বক্তব্য বিবৃতি এসব সংবিধানিক অধিকার। অথচ এসব কার্যক্রম চালাতে গেলে ক্ষমতাসীনরা তার স্বরে চিৎকার দিয়ে বলে-“বিরোধীরা মাঠে থাকলে আওয়ামী লীগ ও মাঠে থাকবে।” কেন? বিরোধীদের সাথে আওয়ামী লীগ সংঘাত করতেই বোধ হয় মাঠে থাকতে চায়। কেননা ওদের পিছনে তথাকথিত সরকার আছে সেই শক্তির জোরে। এখানে তো ক্ষমতাসীন সরকারকে বলা উচিত, “বিরোধীদল মাঠে অপতৎপরতা চালালে- জনগণের জানমালের ক্ষতি হলে সরকার তার ব্যবস্থা নিতে পারে।” কিন্তু তা না বলে আওয়ামী লীগ ব্যবস্থা নেবে এ কথা বলা হয়। কেন? তাদের এই বক্তব্যে দেশের সংঘাত সন্ত্রাস মারামারি, লাঠালাঠি হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে বলে অনুমিত হয়।
(দুই) নেত্রীর বক্তব্যে এই ধারণা জন্মায় যে, দেশটি একমাত্র তাঁরই কিংবা তাদেরই। সে কারণে দেশের ক্ষমতা একমাত্র তাদেরই থাকতে হবে আর কারো নয়। তারা বা তিনি দেশকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেবেন না বলে বক্তব্য দেন। এখানে বিরোধী দলের আন্দোলনে প্রমাণিত হয়েছে দেশের বর্তমানের ৭০ ভাগ জনগণ বিরোধী দলের পক্ষে। আর দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা হাসিনার নেতৃত্বকে আর দেশের ক্ষমতাসীন দেখতে চায় না। তাহলে ৭০ ভাগ জনগণ কি দেশকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে? আর ক্ষুদ্র একটি অংশ দেশ শাসন করবে? এটাতো গণতন্ত্রের কথাও নয়, পদ্ধতিও নয়।
(তিন) “বেশি বাড়াবাড়ি করলে খালেদাকে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।” কে পাঠাবেন? উত্তর শেখ হাসিনা। কারণ তিনি স্পষ্ট বলেছেন, “বিএনপি বেশি বাড়াবাড়ি করলে এবার খালেদাকে জেলে পাঠিয়ে দেবো।” তাহলে বোঝা গেল জেলে যাওয়া নির্ভর করছে একমাত্র শেখ হাসিনার মর্জির উপর। অপরপক্ষে জেল থেকে মুক্তিও নির্ভর করছে একমাত্র তারই ওপর, তাহলে দেশে বিচার বিভাগ থেকে কি লাভ। তারা তো তারস্বরে চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘দেশে বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচার বিভাগের উপর কোনো হস্তক্ষেপ নেই ।
(চার) মাননীয় শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সাথে বলেন, “আমাদের ভোট চুরির অপবাদ দেওয়া হয়।” তিনি বলেন “আমরা ভোট চুরি করতে যাব কেন? জনগণ তো আমাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেয়।” কি সুন্দর সহাস্য কৌতুক বচন। তাহলে দেশে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ১৬৫ জন পার্লামেন্ট মেম্বার বিনা ভোটে পাস করে ঘোষিত হল কি করে। ২০১৮ সালে ভোটের আগের নিশিরাতে ভোট চুরি হলো কি করে, যা সারা বিশ্ববাসীকে অবাক করেছে? এসব তো স্পষ্টতই ভোট চুরি শুধুই না ভোট ডাকাতি, ভোট লুটপাট। এখানে কি জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে? ভোট দেওয়া তো দূরের কথা জনগণকে ভোটকেন্দ্রেই যেতে দেওয়া হয়নি।
এতো গেল দলীয় প্রধান কিংবা তথাকথিত সরকার প্রধানের কথা। এবারে দেখা যায় তার বশংবদ অনুসারী জি হুজুরের ভূমিকায় যারা আছেন তারা কি বলে! জনাব ওবায়দুল কাদের নাটকীয় ভঙ্গিতে বারবার বলে চলেছেন “খেলা হবে খেলা হবে- খেলা হবে” কি খেলা রাজনীতির ময়দানে মারামারি, লাঠালাঠি, লগি বৈঠার খেলা, কি খেলা? ভোটের পূর্বে ভোট চুরির খেলা, কী খেলা? পুলিশের পোশাক পরে অস্ত্র হাতে দিয়ে যুবলীগ, ছাত্রলীগ বাহিনী দ্বারা বিরোধীপক্ষকে খুন করে, গুম করে, গলা ধাক্কা মেরে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে ভরে জেলে ঢোকানোর খেলা।” বিএনপি এবং বিরোধী দলসমূহ বলছে শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। ওবায়দুল কাদের বলছে, “বিএনপিকে নির্বাচনে আসতেই হবে।” আবার কৃষিমন্ত্রী ডক্টর আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “বিএনপি নির্বাচনে না এলে কিছু যায় আসে না।” (নয়া দিগন্ত ৮.১.২৩)
ইতোমধ্যে বশংবদ নির্বাচন কমিশনও এমনতর বক্তব্য দিয়েছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর এ. কে আব্দুল মোমিন বলেন, “ভারতকে বলেছি তারা আমাদের ক্ষমতায় যেতে সাহায্য করবে।” ওবায়দুল কাদের বলেন, “ভারত আমাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে না, তারা পাশে থাকলে শক্তি পাব।” এসব দেশদ্রোহী, অসংলগ্ন, আত্মঘাতী বক্তব্য দেওয়ার অর্থ কী হতে পারে!
ইতঃপূর্বে আমেরিকা বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাবের এবং পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন এবং এখনো তা বহাল আছে। আরো নিষেধাজ্ঞা আসবে কিনা তা নিয়ে কল্পিত বক্তব্য চাউর আছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরোধীদের ওপরে জুলুম, নিপীড়ন করে যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সীমা অতিক্রম না করে সে বিষয়ে বারবার সতর্ক করছে। জনগণ যাতে শান্তিতে এবং স্বতঃস্ফুর্তভাবে আগামী নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সে বিষয়ে বারবার তাগিদ দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হ্যাস বাংলাদেশের শাহীনবাগে গুম হওয়া ব্যক্তির বাড়িতে সাক্ষাতে গেলে পথে সরকার সমর্থিত ‘মায়ের কান্না, গ্রুপের বাধা পেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার নিরাপত্তা চেয়ে বক্তব্য দিলে দেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিককে নিরাপত্তার আশ^াস দেওয়া হলেও বাংলাদেশের কতিপয় মন্ত্রী একটু ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, “দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশীদের নাক গলানো ঠিক নয়।” পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, “আমাদের ব্যাপারে ওদের মাতব্বরি মানায় না।” এক মন্ত্রী বলে বসলেন, “যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিলে আমরাও নিষেধাজ্ঞা দিবো।” আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। তারা মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ব্যাপারে যে নীতিতে বিশ্বাসী আমরাও ওই অভিন্ন নীতিতে বিশ্বাসী। আমরা একযোগে কাজ করতে চাই ইত্যাদি।”
ইদানীং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তাদের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ঊর্ধ্বতন পরিচালক রিয়াব অ্যাডমিরাল আইলিন লাউবাচার চার দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী (দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক) ডোনাল্ড লু ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ ঢাকা এসে গেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র লেড প্রাইস একাধারে বাংলাদেশের ব্যাপারে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন, আবার বিভিন্ন বিষয়ের সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছেন। লেড প্রাইস দিয়েছেন বড় একটি কঠিন বার্তা। তিনি তার ব্রিফিংয়ে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, “বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার বাস্তবায়ন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এসব কথা ও কাজের মধ্যে মিল আছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করবে যুক্তরাষ্ট্র। একটি দেশের নির্বাচন যেভাবে হওয়া উচিত তা করতে বাংলাদেশের সরকার কিভাবে কাজ করবে তা বুঝতে আমাদের পর্যবেক্ষণ অব্যাহত থাকবে, নির্বাচন হতে হবে স্বচ্ছ এবং শান্তিপূর্ণ।” একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্য ভিনদেশের একজন মন্ত্রীর এমনতর বক্তব্য যেমন অনাকাক্সিক্ষত তেমনি সময় ও পরিবেশের প্রেক্ষাপটে তারা এমন বক্তব্য দিতে সুযোগ পেয়েছে কিংবা বাংলাদেশ সুযোগ করে দিয়েছে বলে তারা ঐরূপ বক্তব্য দিতে উদ্যোগী হয়েছে।” কেননা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঐরূপ বক্তব্যে দেওয়ার পরও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে মোমেন বিনয়ের সাথে বলেছেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে চাই। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১১-১-২০২২) যুক্তরাষ্ট্রের ঐ মন্তব্যে বাংলাদেশের এরূপ বক্তব্য দুর্বল মানসিকতার পরিচয়।
আবার এখানে চীনকেও একটু জড়িয়ে বলা হয়েছে বলে বোধ হয় এই কারণে যে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিং গ্যাং তার নির্ধারিত রাষ্ট্রীয় সফর আফ্রিকার ইথিওপিয়া যাওয়ার পথে বিমানের জ্বালানি তেল সংগ্রহের অজুহাতে গতিপথ পরিবর্তন করে রাত ১টায় ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে ঘণ্টাখানিক অনির্ধারিত বৈঠক করেন। বৈঠকে সকল তথ্য জানা না গেলেও এতটুকু জানা গেছে যে, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাৎক্ষণিক আশ্বাস দিয়ে গেছেন এই বলে যে, “তারা সর্বদা বাংলাদেশের পাশে থাকবে।” মন্ত্রী অতি উৎসাহ এবং নির্ভয় দিয়ে বলে গেছেন, “বাঙালি যে গর্বিত জাতি। তাতে তারা কখনো কারো কাছে মাথা নোয়াবে না।” কূটরাজনীতির জটিল মারপ্যাঁচে এটুকু অন্তত বোঝা যায়। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেনেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের একজন ঊর্ধ্বতন সৈনিক কূটনীতিক রিয়াল অ্যাডমিরাল আইলিন লাউবাচার এক্ষণে বাংলাদেশের ৪ দিনের সফরে অবস্থান করেছেন। আবার কয়েকদিন পর যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী (দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক) ডোলান্ড লু বাংলাদেশে আসবেন। যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রীদের এরূপ উপর্যুপরি সফরে এবং ধাক্কায় যেন বীরের জাতি বাংলাদেশ মাথা না নোয়ায়। প্রয়োজনে চীন তাদের পাশে থাকবে, যেন বহুদূরের যুক্তরাষ্ট্রের মোহিনী শক্তিতে বাংলাদেশ দুর্বল না হয়ে যায়। এজন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রকেও খুশি রাখতে আবার চীনকেও পাশে রাখতে তার বিবৃতিতে ঐরূপ শ্যাম ও কুল উভয় রক্ষার মতো বক্তব্য দিয়েছেন। আবার বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ উপমহাদেশের আরেক শক্তিধর হৃদয়ের বন্ধু ভারত যাতে না চটে যায় সে দিকে লক্ষ্য করে জনাব হাসান মাহমুদ প্রায় একই সময়ে একনাতি দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, “বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ।” তিনি আরো একটু বাড়িয়ে ঠিক এমনিতরো সময়ে বক্তব্যটি আরো দীর্ঘায়িত করে হয়তোবা ভারতকে খুশি করতে যেয়ে বলেছেন, “১৯৭১ সালে ভারত শুধু তাদের সীমান্ত খুলে দেয়নি, ঘরের দুয়ার খুলে দেয়নি, মনের দুয়ার খুলে দিয়েছিল। নিজেরা না খেয়ে বা কম খেয়ে সে দেশে যাওয়া শরণার্থীদের তারা খাওয়াইয়েছেন। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন সেটি আমাদের দেশের মানুষ মনে রাখবে। (দৈনিক সংগ্রাম, ১১.১.২৩)
এখানে যে বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য সেটা হলো বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে যে কয়টি দেশ ঘূর্ণায়মান স্রােতের আবর্তে আবর্তিত হচ্ছে তারা হলো মূলত যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপান এবং ইউরোপিয়ান কতিপয় রাষ্ট্র। এসব রাষ্ট্রসমূহের গতিবিধি এবং চলমান কার্যধারা অনুশীলনে মনে হয় যে এরা মূলত বাংলাদেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ উপকারী বন্ধু কিংবা উন্নয়ন সহযোগী। কিছু দান অনুদান উন্নয়ন সহযোগিতার ছিটেফোঁটা পরিলক্ষিত হলেও মূলত এরা তাদের নিজস্ব রাষ্ট্রের এবং জাতীয় স্বার্থসিদ্ধিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কর্তৃত্ব লাভের প্রাধান্য নিয়ে সমধিক তৎপর। যেমন ধরা যায়, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র! এদের কাণ্ড-কারখানা বিশ্বব্যাপী তাদেরই স্বার্থের অনুকূলে পরিচালিত। ইউক্রেনকে বন্ধুর মত নয়, বাবার মত লালনের ওয়াদা করে বিগত প্রায় এক বছর সময়কালীন যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে শুধু হম্বিতম্বি^ করেই চলেছে আর রাশিয়া তার সমগ্র শক্তি সামর্থ্য ইউক্রেনকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রেখেছে। আমেরিকা একদিকে তার অস্ত্রের চালানের অম্লমধুর ব্যবসায়ী স্বার্থকে ঊর্ধ্বে রেখে ফায়দা নেওয়ার প্রচেষ্টায় কৌশলী ভূমিকা পালনে চেষ্টারত। অপর দিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কূটনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে অন্যান্য মিত্র রাষ্ট্র বলয়ের সাথে ঘাঁটছাড়া বেঁধে বিশ্ব মোড়লের ভূমিকায় নিজেকে উপস্থাপন করতে তৎপর, ইউক্রেনকে বাঁচানো আসল উদ্দেশ্য নয়। যেমন, প্রখ্যাত সৌদি সাংবাদিক খাশোগি হত্যাকাণ্ডে যে আমেরিকা সৌদি রাজপুত্রকে একহাত দেখে নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে সৌদিদের মানবাধিকার এবং বিচারবিহীন হত্যাকাণ্ডে সীমালঙ্ঘনে উপযুক্ত সাজা শাস্তির বচন গেয়ে বাজিমাত করার প্রহসন করেছিল, ইদানীং দেখা গেল সেই আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধান মি. জো বাইডেন সশরীরে সৌদি ভূখণ্ডে উড়ে এসে তথাকথিত খাশোগি হত্যার সাক্ষাৎ অপরাধী সৌদি যুবরাজের সঙ্গে গলায় গলায় মধুরেণু শমপায়েত সম্পর্ক সৃষ্টির কসরত করে গেলেন। উদ্দেশ্য ছিল সৌদি এবং যুবরাজের বিরুদ্ধে হম্বিতম্বি করে সৌদিদের কাছ থেকে তেল স্বার্থ উদ্ধার করা, খাশোগি হত্যার প্রতিশোধ এটা আসল উদ্দেশ্য নয়।
বাংলাদেশের ব্যাপারে তথৈবচ পরিকল্পনার প্রহসন লক্ষ্য করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বাঘাবাঘা কূটনীতিক পাঠিয়ে বাংলাদেশকে বারবার বোঝাবার চেষ্টা চালাচ্ছে, এবারে নির্বাচনে বাংলাদেশকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সকলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লি তত্ত্বাবধানে ভারতকে প্রভাব বলয়ে আটকিয়ে রাখার শতচেষ্টা চালাবার কূটচাল চাললেও ভারতও তার বাঘাবাঘা কূটনীতিকদের বারবার বাংলাদেশে পাঠিয়ে তারস্বরে চিৎকার দিয়ে বলে যাচ্ছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পূর্ণ সমর্থণ ভারতের রয়েছে (বিনয় মোহন কোয়াত্রা, ভারতীয় সচিব, ১৬ই মার্চ ২৩)। ভারতীয় কূটনীতিকদের বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে ভিজিটে এসে এমনিতর বক্তব্য দিয়ে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনাকে অতিমাত্রায় উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছেন। এতে করে বোঝা যায়, আমেরিকা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভারতকে যতই গুডবুকে রাখতে সচেষ্ট থাকুক না কেন ভারত তাদেরই মত কূটনৈতিক চাল চেলেই যাচ্ছে, উদ্দেশ্য শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতার মসনদে টিকিয়ে রাখা। কথাটা স্পষ্টত বললাম এ কারণে যে, ভারতীয় কূটনীতিকদের বচন ভাষ্যে বোঝা যায় তারা স্পটত বলে যাচ্ছে, “শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পূর্ণ সমর্থনের অঙ্গীকার।” এখানে সূক্ষ্ম দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যায় ভারতের সমর্থন শুধু কেবল শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে। যদিও শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থেকে ভোটারবিহীন নির্বাচন করুন আর মধ্যরাতে নির্বাচন করুন তাতে আসে যায় না। তার নেতৃত্বই দরকার। এখানে বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক আশা-আকাক্সক্ষার কোনো প্রতিফলন নেই। অথচ ভারত একটি জনগণতন্ত্রিক রাষ্ট্র বলে বিশ্বে পরিচিত। অপর দিকে বাংলাদেশের পরমাণু চুল্লির জন্য প্রয়োজনীয় মাল, মশলা সরবরাহে রাশিয়া যে নিষিদ্ধ জাহাজ ব্যবহার করেছিল ওই জাহাজটি আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকায় বাংলাদেশ ওই নিষেধাজ্ঞাকে আমলে নিয়ে সরাসরি নিজস্ব বন্দরে মালামাল খালাস না করে বিকল্প পথে ভারতের বন্দরে নোঙর করাতে পেরেছিল। রাশিয়া এতে ক্ষুব্ধ হলেও পরবর্তীতে জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট প্রদানে বাংলাদেশ বিরত থেকে রাশিয়াকে খুশি করাতে সক্ষম হয়েছিল।
এদিকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চীনের কৌশলগত অবস্থান চোখে পড়ার মতো। বেশ কয়েকদিন পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের উপর্যুপরি বাংলাদেশ সফরের সময় জনৈক চীনা কূটনীতিক ভিন্ন দেশে সফরে আকাশপথে বিচরণের সময় ডানা ঘুরিয়ে গভীর রাতে বিনা নোটিশে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে এ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে স্বল্পকালীন হলেও রাজনৈতিক বিষয়ে খুবই ক্রিটিক্যাল আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছিলেন। গত ১৫ই মার্চ ২০২৩, চীনের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন “চীন সব সময় বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদার, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশের হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে বাংলাদেশের যে অবস্থান চীন তা সমর্থন করে।” (বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৫ই মার্চ ২০২৩)। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের উপর পড়ুক এটা চীন কোনোক্রমেই চায় না। এতে করে বোঝা গেল বাংলাদেশের ব্যাপারে চীন রাশিয়া ভারত একই নীতিতে অবস্থান করছে। কেননা বিশ্বরাজনীতির মেরুকরণে চীন-রাশিয়া তো একই সমান্তরালে, আর ভারত তথৈবচ অন্তত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। তাহলে উক্ত সমীকরণে বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্র উক্ত ত্রিপক্ষীয় শক্তির মোকাবেলায় বাংলাদেশকে মুহুর্মুহু স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং অংশীদারিত্বমূলক আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অবাধ নির্বাচন করার সবক দিলেও বাংলাদেশে চীন ভারতের বিনিয়োগের কথা চিন্তা করে বলছে “বাংলাদেশ বিনিয়োগে এক নম্বরে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র।” (পিটার হ্যাস, ১৬ই মার্চ ২৩, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন) উক্ত পর্যালোচনায় বিদেশি ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো যতনা বাংলাদেশের ভালাই গাইছে তার চেয়ে বেশি পলিটিক্স করছে বিশ্ব রাজনীতিতে চীন, রাশিয়া এবং ভারতের মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য বিস্তারে, অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লিপনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে বাকি তিনটি ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। আর এ খেলার মুখ্য প্ল্যা-গ্রাউন্ড হচ্ছে বাংলাদেশ। বহির্বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের রাষ্ট্রসমূহের ওইরূপ নাটকীয় আচরণে বাংলাদেশের মাননীয় শেখ হাসিনার বুঝতে বাকি থাকে না এ মুহূর্তে কোন পথে চলতে হবে, কোন মতে বলতে হবে। তিনি ইতোমধ্যে বিরোধী দলসমূহকে এক হাত নিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলতে শুরু করেছেন, “এমন কোন চাপ নেই যা শেখ হাসিনাকে দিতে পারে।” (১৩ই মার্চ/২৩, বাংলাদেশ প্রতিদিন)। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গণতন্ত্রের যদি কোনো সমস্যা থাকে তবে তারা যেন বাংলাদেশ থেকে পরামর্শ নেয়।” তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলেছেন, “এমন শক্তি বাংলাদেশে নেই যারা আওয়ামী লীগকে পরাজিত করতে পারে।” মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকেই ইতোমধ্যে আরো বলাবলি শুরু করেছেন, “নির্বাচন কিংবা তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে বিএনপির সাথে বসাবসির বা সংলাপের কোনো প্রশ্নই আসে না” অথচ বিরোধীদলের আন্দোলনের প্রথম দিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে বঙ্গভবনে চা খাওয়ার দাওয়াত দেয়া এবং মুখোমুখি বসে আলাপচারিতার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের বিরোধীদলেরও তথৈবচ অবস্থা। ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত দেশব্যাপী আন্দোলন, সমাবেশ করে বেশ কিছু উৎসাহ উদ্দীপনার খোরাক পেলেও ২০২৩ এর শুরু থেকে সেই পটুজিতে মণিকাঞ্চন যোগ হচ্ছে বলে বিদগ্ধজনেরা মনে করছেন না। বারবার পরামর্শ আসছে বিরোধী দল এ যাবৎ কাক্সিক্ষত মানের আন্দোলন সংগ্রামের ভিত গড়তে পারেনি। লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে মাঠে নামার কোনো বিকল্প নেই। শুধু কেবল শেখ হাসিনার অধীনে কোন নির্বাচন নয়, তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচন করতে দেয়া হবে না।”- এমন মুখরোচক বুলি বচনে কোন সফলতা আসবে বলে তারা মনে করেন না। বহির্বিশ্বের ক্ষমতাধরদের মুখচেয়ে প্রমাদ গুনে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। তারা কেবল তাদের স্বার্থই বড় করে দেখছে এবং দেখবে। বিশ্বের বুকে সিরিয়া টিকে থাক, ইরাক শির দাঁড়া সোজা করে দাঁড়াক, প্যালেস্টাইন স্বাধীন সার্বভৌমত্ব পাক আর ইদানীং ইউক্রেন পূর্ব অবস্থায় শক্তিশালী অবয়বে ফিরে আসুক এটা তাদের মাথাব্যথা নয়, তাদের মাথাব্যথা ক্ষমতার নেতৃত্বে নিয়ে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে আধিপত্যের বড়াই নিয়ে, মারাত্মক মারণাস্ত্র বিক্রি করে, একে অপরকে দাবিয়ে রেখে, তেলসম্পদ জোগাড়ে, ব্যবসায়িক মুনাফা লোটার অভিপ্রায়। আর এ গরল যাত্রার মরণপণ চক্র জালে কোনো দেশ গড়ে উঠুক কিংবা ভেঙে খানখান হয়ে যাক এতে তাদের কোনো আসে যায় না।
গ্রাম বাংলার একটা প্রবাদ আছে “বাড়ির কুলগাছে সবাই ঢিল মারে।” বাংলাদেশ যেন একটি সুস্বাদু কুলগাছ। কথিত মহা শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে সতর্ক ঢিল মেরে চুপচাপ বসে থাকেনি গাছটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরার কসরত চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া মাঝখানে “কোন স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো ঠিক নয়” বলে যুক্তরাষ্ট্রকে একটা থ্রেট দিয়ে ছোট্ট একটা ঢিল মেরে বসে আছে, যদিও ইউক্রেনের দখলদারিত্বে বিশ^ব্যাপী বদনামে রাশিয়ার ঐ ঢিলটি বেশি কিছু ঝরাতে পারছে না বলে মনে হয়। চীন তার শিডিউল সফরের বাঁকে রাত ১টায় ঢাকা বিমানবন্দরে আকস্মিক অবতরণ করে একটা মারাত্মক ঢিল মেরে ছোঁ দিয়ে উড়ে গেছেন ইথিওপিয়ায়। জাপান মাঝখানে মারাত্মক একটি ঢিল মেরে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার উপর প্রকাশ্যে আঘাত এনেছে। জার্মানিও সতর্ক বক্তব্য দিয়ে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রমের পক্ষে রাশিয়াকে এক হাত দেখে নিয়েছে। সুইডেনও ইতোমধ্যে ছোট একটা ঢিল মেরে বাংলাদেশে স্বচ্ছ নির্বাচন ও গণতন্ত্র রক্ষার নসিহত করেছে। এখন বাকি আছে একেবারে ঘরের সীমানায় হৃদয়ের অন্তরের প্রাণপাখি আরেক শক্তিধর মহাভারত। তাকে কি আর ভোলা যায়! তাই জনাব হাসান মাহমুদ দেরি না করে তার নাতিদীর্ঘ প্রশংসিতমূলক বক্তৃতায় ভারতকে একেবারে হৃদয়ের গহিনে টেনে নিয়ে জড়িয়ে রাখার আকুতি প্রকাশ করেছেন। ভালো কথা, তাহলে এখন বাংলাদেশের কুলগাছের কি হবে? ঢিল তো সবাই ফেলছে তাক করে করে। বাইরের এসব ঢিলের চাপ সহ্য করে, দেশের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকামী মজলুম কোটি কোটি জনগণের উত্তপ্ত নিঃশ্বাসকে হজম করে ক্ষমতাসীনরা কি নিজেদের ক্ষমতার টিকিয়ে রাখতে পারবে নাকি এ সাধের সোনার বাংলাদেশকে লোলুপ দৃষ্টিধর বহিঃশক্তির ঢিল খেলার ক্রীড়নক বানাবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সংসদ সদস্য
আপনার মন্তব্য লিখুন