উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, শঙ্কা আর অজানা আতঙ্কে দেশবাসী। সর্বত্র অপহরণ, গুম, খুন সব মিলিয়ে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ। মৃত্যু উপত্যকার ওপর দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। পর্যবেক্ষকদের অভিমত, এ পরিস্থিতিতে মানুষের ওপর মানুষের আস্থা-বিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে। এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ দেখছে একের পর এক নারী নির্যাতনসহ অনেক রক্তাক্ত ঘটনার চিত্র। পত্রিকার পাতা উল্টালে অথবা টেলিভিশনের সুইচ অন করলেই দেখা যাচ্ছে লাশের মিছিল। দেখা যাচ্ছে গুম, খুন, অপহরণ, আটক বাণিজ্য, ক্যাম্পাস দখল, মুক্তিপণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের যত সব ফিরিস্তি। দেশের যেকোনো সময়ের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন সীমা অতিক্রম করেছে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। আর এ দায়ভার থেকে যায় একটি রাষ্ট্রের ওপর। যখন একটি রাষ্ট্র জননিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তখন রাষ্ট্র অরাজক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। ক্রমে ক্রমে আইনশৃঙ্খলার অবস্থা অবনতির দিকে যায়, রাষ্ট্র ব্যর্থতার কিনারে ধাবিত হয়। রাষ্ট্রের ব্যর্থতার সকল দায়-দায়িত্ব সরকারের ওপরেই বর্তায়। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে নাÑ বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে এক পরিচিত নাম। অনেক দেশের কাছে এ দেশটির আবহাওয়া ও জলবায়ুর যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। কিন্তু ইদানীং অপহরণ, গুম, খুন ও নারী নির্যাতন সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণে শুধু দেশবাসী নয়, আন্তর্জাতিক মহলও বাংলাদেশের হালের আইনশৃঙ্খলার এ বিপর্যস্ত অবস্থা নিয়ে চিন্তিত। বাস্তব ক্ষেত্রে গুম, খুন, নারী নির্যাতন, আটক বাণিজ্য, দলীয় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অপসংস্কৃতি এখনকার প্রতিদিনের নিত্য খবর। সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। ফেসবুক, অনলাইন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়, গত ৩ অক্টোবর, ২০১৬ সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিস ডিগ্রি পাস কোর্সের পরীক্ষা শেষে ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা বদরুল আলম তার ওপর চড়াও হয়। মাটিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে চাপাতি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় উপর্যুপরি কোপায়। কোপানোর চিত্র দেখতে পেয়ে আশপাশের সাধারণ জনতা মেয়েটিকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে এবং হাতেনাতে ধরে বদরুলকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। বদরুল এখন জেলখানাতে আর খাদিজার ঠিকানা এখন হাসপাতালের বেডে। উল্লেখ্য, খাদিজাকে দীর্ঘদিন ধরে বদরুল নানাভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করে আসছিল। খাদিজার ওপর এ হামলায় সারাদেশের মিডিয়াগুলো সোচ্চার হয়ে তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। খাদিজার ওপর হামলাকারী বদরুলের বিচার চেয়ে মানববন্ধন, মিছিল করেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীবৃন্দ, বিভিন্ন সাহিত্য ও সামাজিক সংগঠন। খাদিজার ওপর এই নির্মম নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে বিক্ষুব্ধ জনতা। এখন দায়িত্ব প্রশাসনের। দেখা যাক খাদিজা কী ন্যায়বিচার পান নাকি তনুর ভাগ্য বরণ করেন। প্রতিদিন অসংখ্য নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও আমাদের সামনে সব নজির ও সংবাদ আসে না। কিছু দিন আগে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনুর ওপর নির্যাতন ও হত্যার যথাযথ রিপোর্টটি আজও প্রকাশ করতে পারেনি প্রশাসন। গত ২০ মার্চ তনুর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল নিরাপত্তার চাদরে আবৃত কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায়। কিভাবে সেখানে লাশ পড়ে থাকল? এই প্রশ্নের উত্তর দেশবাসীর কাছে এখনও আসেনি। প্রথম ময়নাতদন্তের দুই সপ্তাহ পর ৪ এপ্রিল রিপোর্ট জমা হয়। রিপোর্টে ধর্ষণ বা হত্যার কোনো চিহ্ন নাকি পাওয়া যায়নি। এদিকে ফাইনাল প্রতিবেদন দেয়া-নেয়া চলতে চলতে গড়িয়ে যায় দিনের পর দিন। আজ আর কেউ মনে রাখেনি তনুকে। তনুর বাবা একজন নি¤œ আয়ের সাধারণ কর্মচারী বলে কি তনু হত্যার বিচার হবে না এই দেশে! মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান গত বছর আগস্ট মাসে এক বক্তব্যে বলেছিলেন, “রাজনৈতিক আশ্রয় থাকলে আইন তাকে স্পর্শ করে না।” এবারও তনু হত্যার ব্যাপারে ‘জজমিয়া’ নাটক যেন না হয় সে জন্য তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কঠোর হওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন। নারী নির্যাতন অব্যাহত গতিতে চলছে। কোনো জায়গায়ই যেন নিরাপদ নয় আমাদের মায়ের জাতি। পরিবার থেকে শুরু করে কর্মসংস্থান কোথাও যেন নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই। ছোট্ট শিশু তার পরিবার ও প্রতিবেশীর কাছে নিরাপদ নয়। একজন কর্মজীবী মহিলা তার কর্মস্থলে নিরাপদ নয়। একজন গৃহিণী তার পরিবারেও নিরাপদ নন। অতি সাধারণ একজন রোগী সেফহোম ও নার্সিং হোমে বা হাসপাতালে নিরাপদ নন। এভাবে পদে পদে নারী নির্যাতনের ধারা আরো বেড়ে চলেছে। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম রেঞ্জে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আখতারের স্ত্রী মিতু হত্যার শিকার হন। শিশুপুত্রকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সময় কে বা কারা তাকে গুলি করে হত্যা করল তার খোঁজ আজও জানা যায়নি। দু’টি মাসুম বাচ্চা নিয়ে চাকরিচ্যুত পুলিশ কর্মকর্তা আজ নিরুপায় জীবন যাপন করছেন। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো স্পষ্ট জবাব মিডিয়ার কাছে প্রকাশ করতে পারেনি। সম্প্রতি তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের এক নেতার বিরুদ্ধে আফসানা নামে একটি মেয়েকে হত্যার অভিযোগ উঠেছিল। সে ঘটনাটিও সময়ের স্বাভাবিক প্রবাহে তলিয়ে গেছে। হয়তো মিডিয়ার সামনে যৎসামান্য প্রকাশ করলেও বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার সাহস নেই কারো। প্রতিনিয়ত অহরহ ঘটনা আমাদের চারপাশে ঘটছে। হাজারো খাদিজা, হাজারো তনু, মিতু ও আফসানা বহুমুখী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু সময়ের অনিবার্যতায় তা আবার কালের কঠিন নিয়তির শিকার হয়ে বিচারের বাণীকে নিভৃতে কাঁদায়। এ ব্যাপারে যদি আমরা দেশের কয়েকটি পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিই তাহলে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে, কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সমাজব্যবস্থা। ‘রেকর্ড ভেঙেছে নারী নির্যাতনের হার’ নামক শিরোনামে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তর, ৫ এপ্রিল, ২০১৬ এর প্রতিবেদনে সত্যিই নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক জরিপে জানা যায়, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে নারী নির্যাতনের ঘটনা ৭৪ শতাংশ বেড়েছে। ব্র্যাকের নিজস্ব কর্মীদের মাধ্যমে ৫৫টি জেলায় সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটির তথ্য মতে নারীর প্রতি সহিংস ঘটনার ৬৮ শতাংশই নথিভুক্ত হয় না। নথিভুক্ত হলে সংখ্যাটি আরো বাড়তো। ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির পরিচালক আন্না প্রিন্স বলেন, সাধারণত যে পরিবারের মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হন তারা আইনি সেবা নিতে উৎসাহ দেখান না। বেশির ভাগ ঘটনার ক্ষেত্রেই মাত্র এক-চতুর্থাংশ মামলা হয়। আইনি দীর্ঘ সূত্রতাসহ অর্থসঙ্কটের কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতিত পরিবার আসামিপক্ষের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে বা সামাজিক উপায়ে আপস করে ফেলে। বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইট অনুযায়ী ২০১০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা ছিল ১৭ হাজার ৭৫২। ২০১৫ সালে এ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ২১০। (তথ্যসূত্র : দৈনিক যুগান্তর, ৫ এপ্রিল, ২০১৬) বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন-সংস্থা, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নারী নির্যাতনের তথ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী ২০০৫ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ ১১ বছর দুই মাসে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছে, হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে ও আত্মহত্যা করেছে ৫৬ হাজার ৬৫৬ নারী। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী চলতি বছরে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০৫ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে তিনজনকে। এ দিকে লজ্জাজনকভাবে মেয়েশিশু পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে রেহাই পাচ্ছে না। শিশুদের নিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্যানুযায়ী ২০১৪ সালে ১৯৯টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ঠিক পরের বছর ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার হয় ৫২১টি শিশু, যা ২০১৪ সালের তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ৬৭ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে পাঁচজন গণধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় দুই শিশুকে। এছাড়া সংগঠনটির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ সালে ৮৬ শিশু, ২০১৩ সালে ১৭০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। পুলিশ সদর দফতরের তথ্যানুযায়ী ২০১৫ সালে সারা দেশে ২১ হাজার ২২০ জন নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনাও রয়েছে। ধর্ষণের শিকার নারী-শিশুর চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিদিন গড়ে চার থেকে পাঁচজন ধর্ষণের শিকার নারী-শিশু চিকিৎসার জন্য আসে। মানবাধিকার কর্মীরা মতামতে বলেছেন, ‘ঢাকার মতো শহরে যেখানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে; সেখানে গ্রামে কিংবা নিভৃত পল্লীতে এর প্রবণতা আরও বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা কয়েকগুণ অভিযোগ হয় না।’ মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান বলেন, ‘খবরের কাগজে যা দেখা যায় ধর্ষণের প্রকৃত ঘটনা তার চেয়েও বেশি। অপরাধীরা মনে করে ভিকটিম থানায় মামলা করবে না, এ জন্য ধর্ষণের প্রবণতাও বাড়ছে। (তথ্যসূত্র : দৈনিক যুগান্তর, ৫ এপ্রিল, ২০১৬) অন্য দিকে গণধর্ষণের শিকারের ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে নারীর প্রতি সহিংসতা এবং নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে ২৩ শতাংশ। শুধু ধর্ষণ বেড়েছে ২১ শতাংশ। গত বছর প্রতিনিয়ত গড়ে দু’জনের বেশি নারী এবং শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গণধর্ষণ বেড়েছে ১৪ শতাংশে। তবে ২০১৬ সালে এখন পর্যন্ত যেসব ঘটনা তাতে আগের পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে যাবে। (তথ্যসূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ১ জানুয়ারি, ২০১৬) বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৪২ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৮২ জনকে, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৫৯, এসিড সহিংসতার শিকার হয়েছে ৩৫ জন, অপহৃত হয়েছে ৯২, পাচারের শিকার হয়েছে ৪৭ জন, যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ১৯২ জনকে, যৌতুকের কারণে নির্যাতন করা হয়েছে ১৭৩ জনকে। গৃহপরিচারিকা হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৩০টি, শারীরিক নির্যাতনের চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ৪৬টি, নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৫৭ জনকে। রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে ১৪৫ জনের, আত্মহত্যা করেছে ২৯৮ জন, উক্ত্যক্তের শিকার ৩১৯, বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে ৮৫ জন, পুলিশি নির্যাতনের শিকার ৩৬ জন এবং শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে ৯৩ জন। অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ কর্তৃক ‘নিরাপদ নগরী নির্ভয়ে নারী’ শীর্ষক নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা ও হয়রানির বিষয়ে এক গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। রিপোর্ট তৈরিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও নারায়ণগঞ্জ শহরের ১ হাজার ২০০ নারী-পুরুষের ওপর গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে ৮০০ নারী ও কিশোরী, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ বছরের, তাদের মধ্যে রয়েছে ৪০০ জন পুরুষ। গবেষণায় অংশ নেয়া নারীর ৮৮ শতাংশ বলেন, তারা পথচারী, পুরুষ যাত্রী এবং ক্রেতাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হন। শহরের ৯৭ শতাংশ নারী যৌন হয়রানিকে সহিংসতা মনে করেন। তারা মনে করেন, পুলিশের সাহায্য সহায়তা চাইলে সমস্যা বাড়ে। যৌন সহিংসতা এড়াতে ৬৪ ভাগ নারী রাতে ঘরের বাইরে যান না। নিরাপত্তাহীনতার কারণে ৬০ ভাগ নারী রাতে ঘরের বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে দলগতভাবে যেতে চান। নগরের ৪৭.৫ ভাগ নারী গণপরিবহন, রাস্তা কিংবা উন্মুক্ত জনবহুল এলাকায় চলাফেরা করার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। গবেষণায় অংশ নেয়া ৮১ শতাংশ মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে সহায়তার জন্য যেতে চায় না। গবেষণায় বলা হয়েছে, মানুষ চলাচলের জায়গায় ৮৫ শতাংশ নারী মর্যাদাহানিকর উক্তির শিকার হয়েছেন, ৪৬ শতাংশ নারী যৌনতাপূর্ণ অশ্লীল কথা শুনেছেন। রাস্তায় নারীরা যৌন হয়রানির শিকার বেশি হন। ৮৫ শতাংশ নারী ও ৭৭ শতাংশ পুরুষ বলেছেন, নারী হয়রানির শিকার বেশি হয় রাস্তায় বা ফুটপাথে। ‘বিবাহিত নারীদের ৮০ শতাংশ নির্যাতনের শিকার’ (তথ্যসূত্র : দৈনিক সংবাদ, ৩ অক্টোবর, ২০১৬) দেশে বর্তমানে বিবাহিত নারীদের শতকরা ৮০ জনই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার। আর সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন স্বামীর হাতে। কিন্তু পারিবারিক সম্মানসহ বিভিন্ন বিষয় চিন্তা করে অধিকাংশ নারী নীরবে এ নির্যাতন সহ্য করেন। যদিও সর্বশেষ সরকারি জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে, দেশে গত চার বছরে বিবাহিত নারীদের নির্যাতন কমেছে ৭ শতাংশের মতো। তবে সরকারের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী মনে করেন ‘এ তথ্যে খুশি হওয়ার তেমন কিছু নেই। কারণ নির্যাতনের হার এখনো ভয়াবহ আছে।’ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১৫’ শীর্ষক দ্বিতীয় জরিপের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। বিবিএসের এ জরিপ পরিচালনায় সহায়তা করে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জরিপমতে বর্তমানে বিবাহিত নারীদের ৮০ দশমিক ২ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার। ২০১১ সালে প্রথম জরিপে এর সংখ্যা ছিল ৮৭ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ চার বছরে নির্যাতনের হার কমেছে ৭ শতাংশ। তবে এই বিবাহিত নারীরা আগের মতোই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন স্বামীর হাতে। কিন্তু অধিকাংশই কাউকে কোনো অভিযোগ করেন না। এ ছাড়া স্বামীদের নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের কারণে নির্যাতনের সংখ্যা নিয়ে জরিপ প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিবাহিত নারীর ১৫ শতাংশই এ ধরনের নির্যাতনের শিকার। জরিপে আরো বলা হয়েছে, ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী বিবাহিতা নারীরা শারীরিক নির্যাতনের ঝুুঁকির মধ্যে থাকেন বেশি। দরিদ্র নারীদের বেশি নির্যাতনের শিকার হতে হয়। জরিপ মতে, স্বামীর হাতে নির্যাতনের ঘটনা সিটি কর্পোরেশনভুক্ত এলাকার (৫৪.৪%) তুলনায় গ্রামেই (৭৪.৮%) বেশি। সিটি কর্পোরেশনের বাইরে অন্যান্য শহরে নির্যাতনের হার ৭১ শতাংশ। রাজশাহী বিভাগে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা বেশি। ৪১ শতাংশের বেশি নারী জানিয়েছেন, জীবনভর স্বামীর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের কারণে তাদের বিভিন্ন আঘাতের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ২৮ শতাংশের বেশি নারীকে আঘাতের কারণে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৪ শতাংশের বেশি নারী। (তথ্যসূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ৩ অক্টোবর, ২০১৬) বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রী নিপীড়নের জরিপে বলা হয়েছে, ‘৮৪% শিক্ষার্থী মনে করেন নিরাপত্তা পর্যাপ্ত নয়।’ (তথ্যসূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৫) যৌন হয়রানির ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এমনটি মতামত দিয়েছেন। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। ৮৫ ভাগ শিক্ষার্থীর মতে এসব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বেশির ভাগ ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে না। চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো বিষয়ক প্রকাশের ভিত্তি জরিপে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ‘বিল্ডিং ইনস্টিটিউশনাল ক্যাপাসিটিজ অব সিলেক্টেড ইউনিভাসির্টিজ টু প্রিভেন্ট ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন’ শীর্ষক প্রকল্পের ভিত্তি জরিপটি ‘বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ) এবং জাতিসংঘ নারীবিষয়ক সংস্থা (ইউএন উইমেন)-এর উদ্যোগে করা এ জরিপে বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে নেয়া হয়েছে। দেশের ৮০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৯টি এবং ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি করা হয়েছে। বিএমডব্লিউএল-এর জরিপ বলছে, ৪৩ শতাংশ ছেলে অভিযোগ দেয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানেন। এ ছাড়া গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ওপর এক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা গেছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা কোনো না কোনো ভাবে যৌন নির্যাতন বা যৌন নিপীড়নের শিকার হন। দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ৮৩% ছাত্রী ছাত্রবন্ধু, শিক্ষক, সহপাঠী কর্তৃক ক্লাসে, লাইব্রেরিতে, রেস্তোরাঁয়, ক্যান্টিনে নির্যাতনের শিকার হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক যৌন নির্যাতনের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘আলোর মুখ দেখেনি ঢাবির ২০ যৌন হয়রানির তদন্ত”। (তথ্যসূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ৪ মে, ২০১৫) এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ (কুষ্টিয়া) দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের অসংখ্য ঘটনার সংবাদ বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেছে। কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার নজির খুব কম ঘটেছে। এসব অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয় এবং ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু প্রতিবেদনটি আলোর মুখ না দেখে অধরাই রয়ে যায়। সমাজের সকল ক্ষেত্রে চলছে নির্যাতনের এক ভয়াবহ ধারা। একজন মেয়েশিশু হয়ে তার কোনো নিরাপত্তা যেন সমাজে নেই। যেমন আপনজনের কাছে নেই, আবার সমাজের কোনো স্থানেও যেন নিরাপত্তার বালাই নেই। কথায় বলে ‘রক্ষক যখন ভক্ষক’ সে অবস্থার আরেকটি পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা একান্ত জরুরি। ‘সেবা নিতে আসা ৮৫% শিশুই ছিল ধর্ষণের শিকার’। (তথ্যসূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ৯ আগস্ট, ২০১৬) গত ১৫ বছরে বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়ে সরকারি সেবাকেন্দ্রে আসা নারী ও শিশুর সংখ্যা ২১ হাজারের বেশি। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই শিশু এবং তাদের ৮০ শতাংশই ধর্ষণের শিকার। বাকি শিশুরা গৃহকর্মী হিসেবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের মোট আটটি সেবাকেন্দ্রে গত জুলাই মাস পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে এ চিত্র ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ধর্ষণসহ যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে ৩৪৭টি শিশু। এর মধ্যে শুধু গণধর্ষণের শিকার ছিল ৬১ শিশু। ৩৪৭টি শিশুর মধ্যে চারটি ছেলে শিশুও এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়। ফোরামের তথ্য মতে, ২০১২ সালে শিশুধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৮৬। বছরটিতে ধর্ষণের চেষ্টাসহ মোট ৯১ জন এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়। ২০১৩ সালে ধর্ষণের পর হত্যাসহ সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়ায় ১৮০তে। ২০১৪ সালে শুধু গণধর্ষণের শিকার হয় ২২টি শিশু। সব মিলিয়ে সংখ্যাটি ছিল ২২৭ জন। সঙ্গত কারণে সময়ের অনিবার্য ভাবনায় অনেক পরিসংখ্যান, তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হলো সমাজ ও দেশের মানুষের অবগতির জন্য। যে নারী কখনো মা, কখনো স্ত্রী, কখনো বোন, কখনো সমাজের বিভিন্ন সম্মানজনক পেশায় আসীন হয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। দেশ-জাতির সর্বক্ষেত্রে সমদায়িত্ব পালনে রত রয়েছেন। কিন্তু তাদের প্রতি বিরাগভাজন হয়ে কেন এত নির্যাতন, কেন এত নিপীড়ন। দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নে নারীদের অবদান আজ ফেলে দেয়ার নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশ্বকে বিস্মিত করেছে সেখানেও নারীর অবদান অনস্বীকার্য। সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসে যে খাত, সেই পোশাক শিল্পের ৮০ শতাংশই নারী। এ ছাড়া দেশের সকল পর্যায়ে নারীর অবদান অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু তা আজ সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়। বরং সমাজজীবনে নারী চরমভাবে অবহেলিত, উপেক্ষিত ও নির্যাতিত। পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যেভাবে নারী নির্যাতন অব্যাহত ধারায় চলে আসছে, সেটি সমাজের হীন সংস্কৃৃতিরই পরিচয় বহন করে। এটাই সবচেয়ে লজ্জার কথা, উন্নয়ন নিয়ে গর্ব করার আগে সামাজিক এই ব্যাধি নিরসনের কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয় না। আজ আপনার মেয়ে, আমার বোন যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সেটা কি দেশ ও জাতির জন্য কলঙ্ক নয়? বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের নারী নির্যাতন নিয়ে সাংঘাতিক রকম উদ্বিগ্নতা পরিলক্ষিত। খাদিজা, আয়েশা, তনু, মিতুর মতো আর কোনো নারীই যেন এ জাতীয় সংঘাতের শিকার না হয় সে ব্যাপারে প্রশাসনের সকল পর্যায়ে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। সাথে সাথে সচেতন জনতাকে এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নারীর প্রতি যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। অন্য দিকে নারী-পুরুষ সবাইকে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। একটি সুন্দর জীবনের জন্য যেমন সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার প্রয়োজন, ঠিক তেমনি একটি সমাজকে বাঁচাতে আজ সুস্থ সংস্কৃতির নান্দনিক বিকাশেরও প্রয়োজন। ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটারের এই বাংলাদেশ অসংখ্য শহীদের রক্তে গড়া। আর কোনো বোন কিংবা মায়ের আর্তচিৎকার আমরা শুনতে চাই না। তাদের আহাজারিতে যেনো কেঁপে না ওঠে কারো বুক কিংবা বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস। লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
আপনার মন্তব্য লিখুন