মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ #
অর্থনীতির চাপে পড়তে যাচ্ছে দেশ। ইউরোপীয় অঞ্চল ও আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দা স্থায়ী হলে রফতানি আয় আরো কমে যেতে পারে। ইতোমধ্যে ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি শেষ পর্যায়ে চলে আসায়, এ খাতের উদ্যোক্তাদের দুশ্চিন্তা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। কারণ বর্তমানে অর্থনীতি রয়েছে চ্যালেঞ্জের মধ্যে। এ ছাড়া অর্থনীতির সূচকগুলো এখন যে অবস্থায় রয়েছে, সামনে তাও ধরে রাখা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে। তাই অর্থনীতির সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে নিতে হবে সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তাহলে যদি আস্তে আস্তে অর্থনীতির চাকা সচলের দিকে ধাবিত হয়। দেশ অর্থনীতির চাপে পড়তে যাচ্ছে। অর্থনীতির তেমন কোনো সুখবর নেই। বিদেশী বিনিয়োগ, জনশক্তি রফতানি, বৈশ্বিক অর্থনীতি মন্দা, রফতানি হ্রাস, গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কট, উৎপাদন হ্রাস, শেয়ারবাজারের শোচনীয় অবস্থা, মূল্যস্ফীতির চাপ, কর্মসংস্থানের সঙ্কটসহ নানা কারণে অর্থনীতি মারাত্মক সঙ্কটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এগুলো থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে প্রথমে যেটা দরকার সেটা হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। তারপর দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা। দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে যদি অর্থনীতির সূচক ভালো দিকে ধাবিত করা সম্ভব হয়। নইলে দেশের অর্থনীতি যে নাজুক দশায় উপনীত হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভালো কোনো খবর নেই। দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সার্বিক অর্থনীতিতে। পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধিতে দেশের সাধারণ মানুষও নেই স্বস্তিতে। এমনকি দেশের ব্যবসায়ী মহলেও দেখা দিয়েছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা। গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে শিল্পের উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। নতুন বিনিয়োগে চলছে চরম মন্দা। এতে বাড়ছে মূল্যস্ফীতির চাপ। আবার ব্যাংকঋণে উচ্চ সুদের হার ও গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কটের কারণে বিনিয়োগের পরিবেশও ভালো নেই। ইতোমধ্যে কমতে শুরু করেছে সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও রফতানি আয়। রফতানি আয়সহ সাধারণ মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা কমে গেছে। রফতানি আয় এবং সঞ্চয় আরো কমে গেলে বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে কমে যাবে। এ ছাড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে শূন্যহাতে বাড়ি ফিরেছেন কয়েক লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। এমন পরিস্থিতিতে ফের বাড়ানো হচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম। এতে আতঙ্কিত দেশের সাধারণ মানুষ। বর্তমানে খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন গবেষণায়ও বাংলাদেশের অর্থনীতি নেতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নানা নেতিবাচক অভিঘাত পার হতে হবে সামনে। এ অবস্থা থেকে পার পেতে সমন্বিত সামষ্টিক অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। ইউরো জোনে অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের রফতানি কমে যেতে পারে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বর্তমানে ভালো থাকলেও আগামীতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে কি না সে ব্যাপারে সংশয় রয়েছে। সে হিসেবে উল্লেখ করা যায় নতুন করে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ রয়েছে। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি এবার ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে। গত অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। সেবা খাতেও এবার প্রবৃদ্ধি কমে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হবে। তবে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে। এসব কারণে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ভালো পরিস্থিতির ওপর। চলতি অর্থবছরে রাজনৈতিক অস্থিরতা স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বিঘœ ঘটাতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যমূল্য বাড়ছে। ইউরো অঞ্চলে অর্থনৈতিক সঙ্কটও তীব্রতর হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি বাজারের অর্ধেকই ইউরো অঞ্চলে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে এখনো ঝুঁকি রয়েছে। বাজেট ঘাটতিতে রয়েছে চাপ। এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বজায় রাখা, বিনিময় হারে নমনীয়তা আনা, ভর্তুকি কমিয়ে আনা, জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয় পদ্ধতি চালু, রাজস্ব খাত, বাণিজ্য, বিনিয়োগ খাতসহ আর্থিক খাতে সমন্বিত সামষ্টিক পদক্ষেপ জরুরি। ৪০-৪২টি নতুন পোশাক কারখানা সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে বসে আছে। এমনকি অর্ডারও নিয়েছে। কিন্তু গ্যাস সঙ্কটের কারণে উৎপাদনে যেতে পারছে না। এসব কারখানা উৎপাদনে গেলে প্রবৃদ্ধি আরো বাড়ানো সম্ভব হতো। বাংলাদেশের বাস্তবতায় ৯ শতাংশ অথবা ডাবল ডিজিট প্রবৃদ্ধি অর্জন করা খুবই কঠিন। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর সমাধান হলে ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা অমূলক ছিল না। গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে বর্তমানে প্রায় অর্ধেক মিল-কারখানায় উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। পাঁচ বছর যাবৎ দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে নতুন কোনো কারখানা গড়ে ওঠেনি। বিদেশী বিনিয়োগ বর্তমানে স্বদেশে নেই বললেই চলে। অন্য দিকে সরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের চিত্র আরো করুণ। বেশির ভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান লোকসানে চলছে। বস্ত্র ও পাট এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ৩৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৪টিই লোকসানে চলছে। ১৩টি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এসব প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকার মতো। দায়দেনার পরিমাণ সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার ওপরে। অন্য দিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিশ্বের যে ১০টি দেশের অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়তে পারে, বাংলাদেশ এগুলোর মধ্যে একটি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে পড়তে পারে। বন্যা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কয়েকটি দেশের শহর ও ব্যবসায়িক কেন্দ্রগুলো ঝুঁকিতে রয়েছে। আবার এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও দেশগুলোর সক্ষমতা কম। এ কারণে দেশগুলোর ব্যবসাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। এদিকে ব্যাংকঋণে উচ্চ সুদের হার ও গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কটের কারণে বিনিয়োগের পরিবেশও ভালো নেই। সামনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতির অনিশ্চয়তা আরো বাড়তে পারে । এই মুহূর্তে প্রবাসী আয় ও রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি ছাড়া তেমন কোনো সুখবর নেই অর্থনীতিতে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১২ বিলিয়ন ডলারের উচ্চতা স্পর্শ করলেও বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার নিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সামনে প্রবাসী আয়ও হুমকির মুখে পড়তে পারে। ইউরোপীয় অঞ্চল ও আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দা স্থায়ী হলে রফতানি আয় আরো কমে যেতে পারে। ইতোমধ্যে ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি শেষ পর্যায়ে চলে আসায় এ খাতের উদ্যোক্তাদের দুশ্চিন্তা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। কারণ বর্তমানে অর্থনীতি রয়েছে চ্যালেঞ্জের মধ্যে। এ ছাড়া অর্থনীতির সূচকগুলো এখন যে অবস্থায় রয়েছে, সামনে তাও ধরে রাখা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে। তাই অর্থনীতির সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে নিতে হবে সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তাহলে যদি আস্তে আস্তে অর্থনীতির চাকা সচলের দিকে ধাবিত হয়।
আপনার মন্তব্য লিখুন