ছোট্ট হয়ে আসছে সুন্দরবন!
জিবলু রহমান
১৩ আগস্ট ২০১৭
সুন্দরবন হচ্ছে ইউনেস্কো ঘোষিত প্রাকৃতিক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ এলাকা। বাংলাদেশের দক্ষিণের পাঁচটি জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও বরগুনার প্রায় ১৯টি উপজেলার কয়েক লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে তাদের জীবনজীবিকার জন্য সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। এই সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে সুন্দরবনসংলগ্ন জমিতে চিংড়ি চাষের জন্য লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ফসলাদি না হওয়া এবং নদী ভরাট হওয়া ইত্যাদি।
২০১৬ সালের এপ্রিলে ভারতের বন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘স্ট্যাটাস অব টাইগার ইন সুন্দরবন ল্যান্ডস্ক্যাপ ইন্ডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের বাঘ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সুন্দরবনের পাশের সম্ভাব্য শিল্পাঞ্চল।
বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সুন্দরবনের ভূমি ও উদ্ভিদের পরিবর্তনের ধরন নিয়ে করা দু’টি গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
সিইজিআইএসের ‘সুন্দরবন জয়েন্ট ল্যান্ডস্ক্যাপ ন্যারেটিভ-২০১৬’ শীর্ষক ওই গবেষণায় দেখা গেছে, গত ২৪০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার কমেছে। ১৭৭৬ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ছিল ১১ হাজার ২৫৮ বর্গকিলোমিটার। ২০১৬ সালে তা কমে প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটারে নেমে এসেছে। গত ২৭ বছরে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৭৬ বর্গকিলোমিটার কমেছে, আর জলাভূমি অংশে আয়তন বেড়েছে ৩০ বর্গকিলোমিটার। মূলত সুন্দরবনে নদীতীরবর্তী এলাকায় ভাঙনের কারণে আয়তন কমেছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আবদুল আজিজ এবং বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন সংরক্ষক অসিত রঞ্জন পাল যৌথ গবেষণা ‘বাংলাদেশ সুন্দরবন : পরিবেশ ও জৈব সম্পদের বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক আরেকটি গবেষণা করেছেন। এতে দেখা গেছে, সুন্দরবনে ১৯৫৯ সালে প্রতি হেক্টরে ২৯৬টি গাছ ছিল। গাছের সংখ্যা নিয়মিতভাবে কমে ১৯৮৩ সালে হেক্টরপ্রতি গাছের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৮০-তে। ১৯৯৬ সালে তা আরও কমে হয় ১৪৪। এভাবে চলতে থাকলে ২০২০ সালের মধ্যে গাছের সংখ্যা নেমে আসবে হেক্টরপ্রতি ১০৯টিতে।
১৯৫৯ সালে প্রতি হেক্টরে সুন্দরবনের প্রধান গাছ সুন্দরীর সংখ্যা ছিল ২১১। কিন্তু তা ১৯৮৩ সালে ১২৫ ও ১৯৯৬ সালে ১০৬-তে নেমে আসে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে হেক্টরপ্রতি সুন্দরী গাছের সংখ্যা নেমে আসবে ৮০-তে।
সিইজিআইএসের গবেষণায় ভারতীয় অংশে সুন্দরবনের আয়তন ৫ হাজার ১২৪ বর্গকিলোমিটার কমেছে বলে উল্লেখ করে বলা হয়, গত ২৭ বছরে ভারতীয় অংশে ভূমির আয়তন কমেছে ৬২ বর্গকিলোমিটার এবং জলাভূমির আয়তন ৫৮ কিলোমিটার বেড়েছে। গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের আয়তন যা বলা হয়, বাস্তবে তার চেয়ে কম। বর্তমানে বাংলাদেশ সুন্দরবন অংশের মোট আয়তন ৫ হাজার ৩২০ বর্গকিলোমিটার। আর ভারতীয় অংশের আয়তন ৩ হাজার ৯৪ বর্গকিলোমিটার।
তবে বাংলাদেশ ও ভারত-দুই দেশের সরকারি নথি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাবে সুন্দরবনের আয়তন বলা হয় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ বাংলাদেশ অংশে ছয় হাজার ও ভারতীয় অংশের আয়তন চার হাজার বর্গকিলোমিটার। ১৯১৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে ৪২০ বর্গকিলোমিটার ভূমি কমেছে। সিইজিআইএসের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৭৭৬ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ছিল ১১ হাজার ২৫৮ বর্গকিলোমিটার। ২০১৫ সালে হিসাব করে দেখা গেছে, তা কমে হয়েছে ৫ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবন ঘিরে নানা ধরনের বাঁধ, পোল্ডারসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কারণে সুন্দরবনের আয়তন কমে আসছে। একই অবস্থা ভারতীয় সুন্দরবনের ক্ষেত্রেও। ১৭৭৬ সালে ভারতীয় অংশে সুন্দরবনের আয়তন ছিল ৮ হাজার ৭৩৩ বর্গকিলোমিটার। ২০১৫ সালের হিসাবে তা কমে ৩ হাজার ৫২ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে।
উদ্ভিদ নিয়ে করা গবেষণায় বলা হয়, সুন্দরবনে গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার জন্য লবণাক্ততা দায়ী। এতে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবন প্রতি সেকেন্ডে শূন্য থেকে ১৭০ ঘনমিটার পলিযুক্ত মিঠা পানি গ্রহণ করেছে। সেখানে লবণাক্ততার পরিমাণ ঠিক রাখার জন্য কমপক্ষে ১৯৪.৪ ঘনমিটার পানিপ্রবাহ প্রয়োজন। কম পানিপ্রবাহ থাকায় সাগরের লবণাক্ত পানি বনের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। যদিও ১ শতাংশের বেশি লবণাক্ততা থাকলে সুন্দরীগাছের বেঁচে থাকা কঠিন।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, গঙ্গা নদীর মিঠা পানি গড়াই হয়ে পশুর নদ ও শিবসা নদীর মাধ্যমে সুন্দরবনে প্রবাহিত হয়। ফারাক্কা বাঁধের পর পানিপ্রবাহ কমে গেছে। ফলে মিঠা পানির প্রবাহ কম থাকায় লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ছে বনের মধ্যে। এ কারণে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বেঁচে থাকতে পারছে না। এর সঙ্গে সাইক্লোন ও বিভিন্ন কারণে বনভূমি ভেঙে ছোট ছোট নদী তৈরি হয়েছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেছেন, ‘সুন্দরবনের প্রতিবেশগত ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে সুন্দরী গাছ কমে যাওয়ার পাশাপাশি বনের বিভিন্ন অংশে অনেকদিন ধরেই ভাঙন লক্ষ করা যাচ্ছে। সুন্দরবন রক্ষা করতে চাইলে সবগুলো ঝুঁকি আমলে নিয়ে কাজ করতে হবে।’ (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬)
সুন্দরবন ক্রমাগত ছোট হয়ে আসছে। বাংলাদেশ ও ভারত-দুই দেশের সুন্দরবনেই ভূখণ্ড কমছে আর জলাভূমি বাড়ছে। সেই সঙ্গে সুন্দরবনে সুন্দরীসহ সব ধরনের গাছের সংখ্যাও কমছে। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে ফেলে এর চারপাশ ঘিরে ভারী শিল্প স্থাপনের জন্য জমি কেনার হিড়িক পড়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০০ শিল্পগোষ্ঠী, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আশপাশ গ্রামগুলোতে প্রায় ১০ হাজার একর জমি কিনেছেন। জমি কেনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের মধ্যে সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, শিল্পগোষ্ঠী ও সরকারি দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রয়েছেন।
সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হলেও পরিবেশ অধিদফতর এই এলাকাতেই ১৫০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পকে অবস্থানগত ছাড়পত্র দিয়েছে। ইসিএ ঘোষণার পর ছাড়পত্র বাতিল করার বিধান থাকলেও এখন পর্যন্ত তা করা হয়নি।
রাষ্ট্রপতির পক্ষে উপসচিব আবু ফজল মো: রফিকউদ্দিন ইসিএ ঘোষণা করা গেজেটে সই করেন। এতে বলা হয়, ইসিএ এলাকায় ভূমি এবং পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট ও পরিবর্তন হবে এমন কোনো কাজ করা যাবে না। মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দদূষণকারী শিল্প বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না।
এর আগে বন বিভাগ থেকে সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে সুন্দরবনের বর্ধিত অংশ বা প্রভাবিত প্রতিবেশ ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ওই এলাকায় সুন্দরবনের বাঘ, হরিণ, ডলফিনসহ অন্যান্য বন্য প্রাণীর বিচরণ হয়ে থাকে এবং ওই এলাকাকে বন্য প্রাণীর জন্য নিরুপদ্রব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
পরিবেশ অধিদফতর যে ১৫০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পকে অবস্থানগত ছাড়পত্র দিয়েছে তার সবগুলো ওই ১০ কিলোমিটার বা ইসিএ এলাকার মধ্যে অবস্থিত। তবে ছাড়পত্রগুলো দেয়া হয়েছিল এলাকাটিকে ইসিএ ঘোষণার আগে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কোনো এলাকাকে ইসিএ ঘোষণা করা হলে সেখানে আর কোনো ধরনের শিল্পকারখানা থাকতে পারবে না।
পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘সুন্দরবনের পাশে যারা জমি কিনে শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য অনুমোদন পেয়েছে, তাদের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় থেকে নয়, সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। কেননা, দেশের জন্য সুন্দরবনও দরকার আবার শিল্পও দরকার। আমরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে উত্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো ৯ আগস্ট ২০১৬)
শুধু এই ১৪৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পই নয়, আরও প্রায় ১৫০টি শিল্পগোষ্ঠী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি সুন্দরবন লাগোয়া ওই ১০ কিলোমিটারের মধ্যে জমি কিনেছেন। বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের সদর থেকে জয়মনিরগোল গ্রাম, রামপাল উপজেলার বিদ্যারবাহন, দ্বিগরাজ থেকে রামপাল সদর পর্যন্ত বেশির ভাগ কৃষি ও জলাভূমি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো কিনে নিয়েছে। খুলনা জেলার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলাতেও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জমি কেনা শুরু করেছেন।
পরিবেশ অধিদফতরের অবস্থানগত ছাড়পত্র পেয়েছেন বাগেরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি এম এ সালামের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। সালাম সেখানে পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন। বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে এস আলম গ্র“প, ইনডেক্স গ্র“প। তবে ছাড়পত্র পায়নি কিন্তু ওই ১০ কিলোমিটারের মধ্যে জমি কিনেছে মীর গ্র“প, লিথি গ্র“পসহ আরও ১৫০টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি।
রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের অবশ্যই ক্ষতি হবে। তবে তার চেয়েও বড় ক্ষতি হবে যদি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কেনা জমিগুলোতে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠে। সরকার যেভাবে সুন্দরবন-সংলগ্ন ওই এলাকায় রেললাইন সম্প্রসারণ, বিমানবন্দর নির্মাণ ও সড়ক যোগাযোগ বাড়াচ্ছে তাতে জমি কেনা ও দখলপ্রক্রিয়া সুন্দরবনের ভেতর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। যা হবে আরও ভয়ঙ্কর।
ছাড়পত্র পায়নি কিন্তু ইসিএ এলাকায় জমি কিনে তাদের প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখেছে আরও শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং সরকারি দলের রাজনৈতিক নেতা ও সমর্থক ব্যবসায়ী ওই এলাকায় নামে-বেনামে জমি কিনেছেন।
মোংলা উপজেলায় ১২টি, বাগেরহাটের শরণখোলায় ১ ও মোরেলগঞ্জ ২, সাতক্ষীরার শ্যামনগরে ৮, খুলনার কয়রায় ৪৯ ও দাকোপে ৩৩টি প্রকল্পকে পরিবেশ অধিদফতর থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। তবে এই ছাড়পত্রগুলোর বেশির ভাগই দেয়া হয়েছে ওই এলাকাকে ইসিএ ঘোষণা করার আগে। অর্থাৎ ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারির আগে।
ছাড়পত্র পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ২১টি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদনকারী প্রকল্প রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে উল্লেখ্যযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে ইনডেক্স পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি লি., ওমেরা পেট্রোলিয়াম, পেট্রোডেক এলপিজি, পেট্রোম্যাক্স, বসুন্ধরা এলপিজি গ্যাস লি., এসকেএস এলপিজি লি., রূপসা ট্যাংক টার্মিনাল অ্যান্ড রিফাইনারি।
ছাড়পত্র পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৫০টি চালকল, ১৯টি করাতকল, সিমেন্ট কারখানা ৯টি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান ১৩টি, ৬টি অটো মিল, ৪টি লবণ-পানি বিশুদ্ধকরণ প্রকল্প, দুইটি জাহাজ নির্মাণ প্রকল্প ও অন্যান্য ৩৮টি প্রকল্প রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ছাড়াও ইটভাটা আইন এবং করাতকল বিধিমালা অনুযায়ী বনভূমির পাশে করাতকল ও ইটভাটা স্থাপন নিষেধ।
সুন্দরবনের লাগোয়া জয়মনিরগোল গ্রামে সানমেরিনের নামে ৭০ একর জমি কেনা হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে ২০১০ সালে নিবন্ধন পাওয়া সানমেরিন শিপইয়ার্ড লি. কোয়েস্ট গ্র“প অব কোম্পানির একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। কোয়েস্ট গ্র“পের চেয়ারম্যান মাহবুব উল আলম হানিফ। সানমেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন তার ভায়রা কাজী হাসান শরীফ। হাসান শরীফের নামেও জয়মনিরগোল গ্রামে ১৮০ একর জমি কেনা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নামে ২০১২ সালের ১৩ মে পরিবেশ অবস্থানগত ছাড়পত্র দেয়া হয়।
সাগুফতা ইয়াসমিনের ভাই তোহা ইসলাম থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। তার কেনা ৬০ একর জমিতে বর্তমানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা মাছ চাষ করছেন। তোহা ওই জমিতে সেখানে সাইফ শিপইয়ার্ড লি. ও নিকসন্স লিমিটেড, গ্রিন রিসাইক্লিং শিপইয়ার্ড লি. নামের দু’টি প্রতিষ্ঠানের নামে জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ড স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
সুন্দরবনের পাশে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ প্রায় ৬০০ একর জমি কিনেছে লিথি গ্র“প। তবে আবেদন করা হলেও এখনো প্রতিষ্ঠানটিকে ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বিদ্যুৎপ্রকল্প, জাহাজ নির্মাণ কারখানা, ইটভাটা মারাত্মকভাবে পরিবেশদূষণকারী বা লাল ও কমলা ক্যাটাগরির শিল্পপ্রতিষ্ঠান। সুন্দরবনের ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে সরকার ইতোমধ্যে দেশ ও বিদেশের পরিবেশবাদীদের আন্দোলন ও চাপের মুখে রয়েছে।
তবে সুন্দরবনের পাশে ইসিএ এলাকায় বড় অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করে সরকারের খাদ্য বিভাগ। ২০১৩ সালে ৫০ হাজার টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি সাইলো (বড় খাদ্যগুদাম) এবং জেটি স্থাপন করেছে। সুন্দরবনের এক কিলোমিটারের মধ্যে নির্মিত এই সাইলো ও জেটি বর্তমানে পুরোদমে চালু রয়েছে।
জীববৈচিত্র্যকে ধরে রাখা দরকার। এমনকি বাঘের মতো প্রাণীকেও। সুন্দরবন সিডর ও আইলার মতো বড় ঝড়-তুফান থেকেও জনপদকে রক্ষা করে। সুন্দরবনের বনজসম্পদ, সুন্দরবনের মৎস্যসম্পদ সরাসরি আমাদের কাজে লাগে। মোট কথা সুন্দরবন ধ্বংস হোক তা আমরা কোনোক্রমেই চাইতে পারি না।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য বিদ্যুৎ অপরিহার্য নয়, কিন্তু বিশুদ্ধ পানি ও বায়ু অপরিহার্য এবং এটা মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। মহান স্রষ্টার সৃষ্টি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এই বিশ্ব পরিমন্ডলের সব কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে সেখানকার মানুষের বসবাসের উপযোগী করে। প্রত্যেকটা জনপদে একটা প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, যেটা সাধারণ মানুষের আয়ের উৎস বা জীবিকার একমাত্র মাধ্যম হিসাবে বিদ্যমান। যেমন, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মানুষ মাছ, মাছের পোনা, মধু, গোলপাতা ও কাঠ সংগ্রহ করে জীবন চালাচ্ছে। যে কোন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে বিপুল জনগোষ্ঠীর এসব জীবিকার মাধ্যমকে বিবেচনায় নিয়ে কাজ করা। সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে এলাকার কয়েক হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে মাত্র ৬০০ লোকের কর্মসংস্থান হবে। তবে দিন দিন আমরা যদি সুন্দরবনকে ধ্বংস করি তাহলে ধ্বংস হবে আমাদের পরিবেশ। হারিয়ে যাবে আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের ইতিহাসও অনেকটা সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। তাই আমরা যেন নিজের বিপদ নিজেরা ডেকে না আনি; নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল না পারি।
আপনার মন্তব্য লিখুন