post

জাতির পরিচয় ও অস্তিত্ব সঙ্কটে যুবসমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ

ড. মুহাম্মদ নূরুল আমিন

২৫ জুলাই ২০১৫
এক সময় আমি যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। উন্নয়ন অর্থনীতির ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে একটি কোর্সে অংশগ্রহণ করেছিলাম। তিন মহাদেশের ৫৭ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে আমরা ৪ জন ছিলাম মুসলমান, অন্যরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। ডাইনিং হলে আমাদের জন্য একটা টেবিল নির্দিষ্ট ছিল, তাতে ছয়জন বসার সুযোগ ছিল। এর নাম ছিল হালাল টেবিল। ব্রিটিশ কাউন্সিল স্কলার হিসেবে আমরা আগেভাগেই আমাদের খাবার সংক্রান্ত চাহিদা এবং শরিয়ার বিধিনিষেধ অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকারকে জানিয়ে দেয়ার প্রেক্ষাপটেই তারা এই স্বতন্ত্র টেবিলের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই টেবিলে হালাল খাবার পরিবেশন করা হতো। মাঝে মধ্যে আমাদের অমুসলমান সহপাঠীদের কেউ কেউ খালি চেয়ারগুলোতে বসে আমাদের সাথে হালাল খাবারে শরিক হতেন। চারজনের খাবারেই ছয়জনের চলে যেতো। একদিন আমার দুই চীনা সহপাঠী লিউ এবং সিমেং টাং বিকেল বেলা ডর্মিটরিতে আমার কক্ষে এসে আমার সাহায্য চাইলেন। তারা বললেন যে, তাদের দু’জন মুসলমান গেস্ট আছেন, লন্ডন থেকে আসবেন এবং আমাদের ডাইনিং টেবিলে ঐ দিনের ডিনার এবং পরদিনের ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চে তাদের খাবারের সুযোগ দিতে হবে। এখানে আনুষ্ঠানিকতার কিছু ছিল না। তথাপিও তাদের কার্টেসি মুগ্ধ হওয়ার মতো ছিল। এই দু’জন গেস্টের মধ্যে একজন ছিলেন ঐ সময়ে যুক্তরাজ্যে চীনা দূতাবাসে কর্মরত চীনের ফার্স্ট সেক্রেটারি, অন্যজন তার স্ত্রী। লিউ আমার হাতে একটা ফ্যাক্স বার্তা দিয়েছিলেন তাদের তাদের ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম এবং ডায়েটারি স্পেসিফিকেশনে হালাল/মুসলিম ফুড লেখা ছিল। চীনকে আমরা অনেকেই কম্যুনিস্ট দেশ হিসেবে জানতাম। তারা ধর্মের বিরুদ্ধে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিল বলে তথ্যপ্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু তার নাগরিকদের ধর্মীয় পরিচয় আছে এবং তাদের কূটনৈতিক মিশনে মুসলমানরাও ধর্মীয় পরিচয় অক্ষুন্ন রেখে চাকরি করতে পারেন সেদিন তা দেখে আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম। যাই হোক লিউ এবং টাং-এর অনুরোধ আমরা রক্ষা করেছিলাম এবং এই দুইজন মেহমানের সাথে এই সুবাদে যে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল বেশ কয়েক বছর পর্যন্তই তা অক্ষুন্ন ছিল। ঘটনাটা ১৯৮৪ সালের।ban1 আমি কয়েক বছর আগে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছি। এই পরিচয়পত্রটি পেয়ে যুক্তরাজ্যের লাভ ব্যুরোর ঘটনাটি আমার মনে পড়েছিলো। আমার এই পরিচয়পত্রে আমার বা আমার পিতৃপুরুষের ধর্মীয় কোনও পরিচয় নেই। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা বা অস্ট্রেলিয়ার অনেক দেশ আছে যে দেশের সরকার বা সাধারণ মানুষ আমার নাম দেখে আমার জাত নির্ণয় করতে পারবে না। এটি দেখে আমার মনে হয়েছে যে, নির্বাচন কমিশন আমার ধর্মীয় পরিচয়টি মুছে দিয়েছেন। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ আমলে গত ৪৩ বছরে আমার পরিচয়পত্রে আমি মুসলমান ছিলাম। এখন আমি কি মুসলমান, হিন্দু, না হিন্দু মুসলমান? দেশের কথা থাক, বিদেশে আমার পরিচয় কী হবে? আমার Dietary Specification-ই বা কি হবে? আমার সামনে কি গরুর গোশত, কচ্ছপের বা শূকরের মাংস দুটোই আসবে? বিদেশীরা আমাকে মসজিদের তথ্য  দেবে না মন্দিরের? এ সমস্যা আমার একার নয় সারাদেশের মানুষের। সরকার কেন আমাদের এই পরিচয় বিভ্রান্তিতে ফেললেন তার জবাব চাওয়া দরকার। সরকার আবারো মেশিন রিড্যাবল পরিচয়পত্র প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং এ ক্ষেত্রে তা সংশোধন হওয়া দরকার। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের কিছু কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগ অনুযায়ী বিগত বছরগুলোতে রাজনৈতিক সরকারসমূহের কাছ থেকে ভারত যা আদায় করতে পারেনি অস্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামুক্ত আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে তা আদায় করে নিচ্ছে। কেউ কেউ বলে থাকেন যে এ জন্য কোটি কোটি টাকার লেনদেনও হয়েছে। আমি এটাকে নিছক গুজব বলেই বিশ্বাস করতে চাই, কেন না এর স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ আমার হাতে আসেনি। হাল আমলে বাংলাদেশে আরো কিছু অদ্ভুত ঘটনাও ঘটছে। জন্ম নিবন্ধনের জন্য যে ফরম পূরণ করতে হচ্ছে তাতেও ধর্মীয় পরিচিতির কোনও ঘর নেই, দেশে একদিকে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে দুর্নীতির প্রসার চলছে অন্যদিকে ধর্ম, ধর্মীয় বিধান, আলেম ওলামা এবং গত ৪৪ বছরে যারা এ দেশে সততা ও বিশ্বস্ততার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, দুর্নীতি বা সন্ত্রাস যাদের টাচ করেনি তাদের বিরুদ্ধে কল্পিত অভিযোগ এনে তাদের ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে জনমতকে বিষিয়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। একদিকে ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে সমাজের প্রত্যেকটি স্তরে অনৈক্যের বীজ ছড়ানো হচ্ছে। দেশকে শুধু রাজনীতিশূন্য নয় নেতৃত্বশূন্য করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। শাসনতন্ত্রে বিসমিল্লাহ কেন এলো, ধর্মনিরপেক্ষতা কেন উঠে গেলো তা নিয়েও প্রশ্ন তুলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কেউ কেউ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার দাবি করছেন। এতোদিন পর্যন্ত ক্ষমতাসীনরা কেউ ধর্ম এবং আলেম সমাজকে সরাসরি গালি দেননি। কিন্তু অবৈধ কেয়ারটেকার সরকারের একজন উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী আলেমসমাজকে ধর্মোন্মাদ ও মৌলবাদী বলে প্রকাশ্যে অপমান করার পর মহাজোট সরকারের নামে যারা ক্ষমতায় এসেছেন এবং এখনো আছেন তারা ধর্মের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছেন। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে, প্রতিবেশী ভারতের ইন্ধনে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক ও সরকারি কর্মকর্তা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদকে ঢালাই করে ভারতের সমস্ত দাবি দাওয়া মেনে নিয়ে নতুন করে তাদের বন্ধু হতে চান। তাদের লক্ষ্য হাসিলে জন্য এসময়ই উপযুক্ত, কেননা এই সরকারের কোনও জবাবদিহিতা জনগণের প্রতি নেই। তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হওয়ায় তাদের মধ্যে বেপরোয়া হবার পরিণতি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে কতকাল ধরে তারা এই আত্মঘাতী খেলা খেলতে থাকবেন? এ পর্যায়ে ভারতীয় জাতীয়তার স্বরূপ নিয়ে আমি কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। স্বাধীনভাবে এই জাতীয়তা বলতে যা বুঝায় অর্থাৎ যে আবেগ বা বন্ধন ভারতের বিভিন্ন জাতি সত্তাকে ধরে রেখেছে তা হচ্ছে প্রধানত হিন্দুত্ববাদের সংযোগশীল শক্তি থেকে উদ্ভূত একটা অনুভব। কেউ কেউ মনে করেন যে, যুগ যুগ ধরে ভারত বিভিন্ন জনগোষ্ঠী জাতি ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণের একটি কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে এসেছে। তবে জাতি, বর্ণ, সংস্কৃতি ও গোত্রের পার্থক্য এড়িয়ে এবং সেগুলোর মোকাবেলা করেও এ দেশটিতে কতক জনগোষ্ঠীতে একতার এমন এক ভাবধারা বিদ্যমান যার ভিত্তি হচ্ছে ধর্ম। এই ধর্মের সাহায্যেই ভারতে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীকে পৃথক করা যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুসলমান ছাড়া অতীতে অপরাপর সকল জনগোষ্ঠীই হিন্দুদের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবার প্রবণতা দেখিয়েছে। কেননা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শন ও জীবনধারা যথেষ্ট রকম স্বাতন্ত্র্যসম্পন্ন ছিল না যাতে করে তারা তাদের আলাদা পরিচয়কে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। ভারতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে শুধুমাত্র মুসলমানরাই এই উপমহাদেশে তাদের ইতিহাসের সূচনা থেকে হিন্দুদের থেকে নিজেদের আলাদা করে রেখেছে। মুসলমানদের জীবনধারা হিন্দুদের জীবনধারা থেকে এতো ভিন্ন যে এই দুটি জনগোষ্ঠীর একটি বা অপরটি নিজেদের পরিচয় ত্যাগ করতে সম্মত না হলে এ দুটির মধ্যে কখনো ঐক্য সম্ভবপর নয়। আবার এও দেখা যায় যে যারা চরমভাবে সাম্প্রদায়িক, হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী তারাই ধর্ম নিরপেক্ষতার বুলি আউড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। আধুনিককালের সমাজ বিজ্ঞানীদের ন্যায় প্রাচীনকালের সমাজ বিজ্ঞানীদের কাছেও এই সত্যটি ধরা পড়েছে। আলবিরুনী তার ‘তাহরিকে হিন্দ’ গ্রন্থে উপরোক্ত বাস্তব তথ্যটিই তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, “সামগ্রিকভাবে ধর্মতাত্ত্বিকতায় মূলত তাদের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই, বড় জোর এ সম্পর্কে তারা বাকযুদ্ধে রত হয়। কিন্তু ধর্মীয় প্রশ্নে হিন্দু কখনো তাদের প্রাণ, দেহ বা সম্পত্তি বিপন্ন করবে না। অন্য দিকে সকল বিদেশীর বিপক্ষে যারা তাদের দলভুক্ত নয় তাদের বিপক্ষে নিয়ন্ত্রিত হবে তাদের সকল বিদ্বেষ। বিদেশীকে তারা ম্লেচ্ছ অর্থাৎ অপবিত্র জ্ঞানে সর্বতোভাবে বর্জন করে, কিছুতেই তার সংস্পর্শে আসে না- হোক তা আন্তঃবিবাহ বা অন্যকোন রকম সম্পর্কের মাধ্যমে, অথবা তাদের সাথে এক সঙ্গে উপবেশন করে না, খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করে না। কারণ তাতে করে তারা মনে করে তারা অপবিত্র হয়ে যাবে। বিদেশীর হাতের আগুন বা পানির সংস্পর্শে আসা যে কোন জিনিসকেই তারা অপবিত্র মনে করে। আর আগুন পানি ছাড়া কোনও বাসগৃহই থাকতে পারে না। তাছাড়া কখনো তারা এটা চায় না যে অপবিত্র হয়ে যাওয়া কোন জিনিসকে আবার পবিত্র করে পুনরুদ্ধার করা হোক, তাদের ধর্মভুক্ত নয় এমন কাউকে তারা স্বাগত জানাতে পারে না, তাদের ধর্মভুক্ত হতে চাইলেও নয়।ban2 “হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে, তাদের দেশের মত আর দেশ নেই, তাদের জাতির মতো জাতি আর নেই, তাদের রাজার মতো রাজা আর নেই, তাদের ধর্মের মতো ধর্ম আর নেই, তাদের জ্ঞান, দর্শন, বিজ্ঞানের মতো আর কিছুই নেই। তারা উদ্ধত, মূর্খের মতো গর্বিত, আত্মাভিমানী ও নিষ্ক্রিয়। তাদের জ্ঞান অন্যদের বিতরণ করতে তারা স্বভাবতই কৃপণ; নিজেদের নিম্নবর্ণের নিকট তা প্রচার করতে তারা একান্তই অনিচ্ছুক, বিদেশীর নিকটে তো আরো অনিচ্ছুক।” (তাহরিক এ হিন্দের ইংরেজি অনুবাদ Al-Beruni’s India, Dr. Edward C. Sachau, Vol.I.PP22-23, 26-27)| ভারতীয় হিন্দুদের বিচ্ছিন্নতা ও সঙ্কীর্ণচিত্ততা সম্পর্কে এমএন রায়ের মন্তব্যও আল বিরুনীর মন্তব্যের অনুরূপ। তিনি তার Historical Role of Islam বইতে বলেছেন, “ভারতের অধিবাসীদের মধ্যে সনাতনপন্থী সুশিক্ষিত এমনকি প্রশংসনীয় সংস্কৃতি সম্পন্ন মুসলমানরা পর্যন্ত “ম্লেচ্ছ”-অসভ্য বর্বরই রয়ে গেল। নিম্নতম হিন্দুরা এদের কাছ থেকে যে সামাজিক ব্যবহার পায় মুসলমানদেরও তাদের কাছ থেকে তার চেয়ে কিছু উন্নততর ব্যবহার পাবার অধিকারী বলে এরা মনে করে না। ...শত শত বছরব্যাপী দুটি সম্প্রদায় এক সঙ্গে একই দেশে বসবাস করলো অথচ পরস্পরের সভ্যতা সংস্কৃতি সহানুভূতির সাথে বুঝবার চেষ্টাই করলো না। পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যি এমন দৃষ্টান্ত আর মেলে না। পৃথিবীর কোন সভ্য জাতিই ভারতীয় হিন্দুদের মতো ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে এমন অজ্ঞ নয় এবং ইসলাম সম্পর্কে এমন ঘৃণার ভাবও পোষণ করে না। ভারতীয় হিন্দুদের জাতীয়তাবাদের আদর্শই হলো আধ্যাত্মিক সাম্রারাজ্যবাদ। কিন্তু ইসলাম তথা মোহাম্মদের সা: ধর্মের সাথে সম্বন্ধ বিচারে হিন্দুদের এই অপ্রশংসনীয় মনোবৃত্তি আরো উগ্র আকার ধারণ হিন্দুদেরই করে। ...... ইসলামের অসাধারণ বৈপ্লবিক গুরুত্ব আর তার বৃহত্তর সাংস্কৃতিক তাৎপর্য সম্বন্ধে অধিকাংশ শিক্ষিত হিন্দুরাই সহৃদয় অনুশীলন তো দূরে কথা সামান্যতম ধারণাও নেই।’’ ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারও ভারতীয় জাতীয়বাদের উত্থান সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অনেকটা একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। তিনি তার ‍‍History of Freedom Movement পুস্তকে বলেছেন, ...... বাংলাদেশে দু’টি জাতের মানুষ ছিল, হিন্দু ও মুসলমান। যদিও তারা ছিলো একই দেশের বাসিন্দা তবুও এক ভাষা ব্যতীত অন্য সব বিষয়ে তারা ছিলো ভিন্ন। ধর্মে, শিক্ষায়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে তারা ছয় শ’ বছর ধরে বসবাস করেছে যেন দুটি ভিন্ন পৃথিবীতে। রামমোহন রায়, বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ মুসলমানদের জ্ঞান করতেন ুহিন্দুদের সুত দুর্গতি ও অসম্মানের মূল উৎস হিসেবে- যা হিন্দুরা নয় শ’ বছর ধরে সহ্য করতে বাধ্য হয়েছে। ড. মজুমদার আরো বলেছেন, উনিশ শতকে হিন্দুদের মাঝে উদ্ভূত জাতীয়তাবাদ ছিলো পুরোপুরি হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি ব্যাপক, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে বাঙালি হিন্দুদের অভিজ্ঞতালব্ধ স্বপরিচয়ের এক নব ধারণার প্রকাশ। জাত্যাভিমানের এই বৈশিষ্ট্যই পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের পূর্ব বাংলাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে শিখিয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথই বলুন এরা সকলেই এই বৈশিষ্ট্যের গর্বিত (!) অংশীদার ছিলেন। পূর্ববঙ্গের মুসলিম বাসিন্দারা তাদের দৃষ্টিতে বাঙালি ছিলেন না। বাঙালি আর ভদ্রলোক বলতে যাদের বুঝাতো তারা হিন্দু, মুসলমানরা নিকৃষ্ট প্রাণী। এ জন্যই বঙ্কিম বাবু ১২২৭ সালের অগ্রহায়ণের ‘বঙ্গ দর্শনে’ লিখেছিলেন। “ঢাকাতে দুই চারদিন বাস করিলেই তিনটি বস্তু দর্শকদের নয়ন পথের পথিক হইবে। কাক, কুকুর এবং মুসলমান। এই তিনটিই সমভাবে কলহপ্রিয়, অতি দুর্দম, অজেয়। বিয়া বাড়িতে কাক আর কুকুর; আদালতে মুসলমান।’’ আনন্দ মঠে তিনি লিখেছিলেন, “ধর্ম গেল, জাতি গেল, কুল গেল, মান গেল, এখন তো প্রাণ পর্যন্তও যায়। এই নেড়েদের না তাড়ালে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে? শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র চাটার্জীর প্রায় ১০০ বছর পর আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে “An Eye-witness Accounts” এর জন্য এসেছিলেন বাবু শ্রী বসন্ত চাটার্জী। ঢাকা নগরী ও তার লোকজনদের দেখে শুনে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন;  And the new comer soon finds himself wondering as to what has become of the educated and respectable gentry, those well-dressed people known in Bengali as the bhadraloks, where are the bhadraloks? অর্থাৎ এখানে কোনও নবাগত এসে শিগগিরই অবাক হয়ে ভাববে, শিক্ষিত ও শ্রদ্ধাস্পদ ভদ্র সমাজের বাংলায় ভদ্রলোক বলে পরিচিত সেই সুবেশী লোকগুলোর কি হলো! ভদ্রলোকেরা কোথায়? ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্বরূপ বস্তুত অতি সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদী একটি ধর্মবিশ্বাসেরই অংশ। যারা বিদেশ সফর করেছেন বিদেশে ভারতীয়দের সংস্পর্শে এসেছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, ভারতীয়রা বিদেশ গিয়ে বেশির ভাগই ভেজিটারিয়ান হয়ে যান। এটাও তাদের স্বাতন্ত্র্যের একটি লক্ষণ, এ ক্ষেত্রে বাংলাভাষী মুসলমানদের যদি তারা ভদ্রলোক মনে না করেন এবং তাদের ইতরপ্রাণী কুকুর কাকের সঙ্গে তুলনা করেন তাহলে বিস্মিত হবার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। আমার একটা ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতাও আছে। এটা ভারতীয় হিন্দু নয় এ দেশের হিন্দুদের ব্যাপারেই। বাল্যকালে আমি বাড়ির পাশে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম। আমাদের গ্রামে কোনও হিন্দু ছিলো না। কিন্তু আশপাশ গ্রামগুলো ছিলো হিন্দুপ্রধান। স্কুলটি ছিলো হিন্দু বাড়ির সামনে। আমার সহপাঠীদের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু ছিলো। তাদের অনেকেই আমাদের বাড়িতে আসতো, ঘরে ঢুকতো, খেলাধুলা করতো। একদিন আমার এক সহপাঠীর সাথে আমি তাদের ঘরে ঢুকেছিলাম এবং এতেই লঙ্কাকান্ড বেধে গিয়েছিল। মুসলমানের ছেলে ঘরে ঢুকেছে এতে তারা হইচই শুরু করে দিলো, চিৎকার করে জানিয়ে দিলো যে, তাদের ঘর অপবিত্র হয়ে গেছে এবং খাবারসামগ্রী সব ফেলে দিতে হবে। বিষয়টি দেখে আমি তো হতবাক। আমার অভিভাবকরা ঘটনাটি জানার পর দরবার বসেছিল বলে আমার মনে পড়ে। এখানে মূল কথা হচ্ছে একটা হিন্দু পরিবারে, তার অবস্থান এপারে হোক কিংবা ওপারে, কুকুর যত না অস্পৃশ্য তার বেশি অস্পৃশ্য হচ্ছে একজন মুসলমান। ঘরে কুকুর ঢুকলে তাদের ঘর অপবিত্র হয় না কিন্তু মুসলমান ঢুকলে হয়। আর চল্লিশ বছর নি¤œবর্ণের সাথে সংসার করে হেসেলে ঢুকতে না দেয়ার বড়াই তো তারাই করতে পারে যাদের প্রতিটি ফোঁটা রক্ত সাম্প্রদায়িকতা এবং বর্ণবাদের দোষে দুষ্ট। আমাকে কেউ কেউ সাম্প্রদায়িক মনে করতে পারেন। কিন্তু এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে নিয়ে ভারতীয় জাতীয়বতাবাদের অংশ হয়ে বাংলাদেশের মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না। বাংলাদেশের মানুষকে যদি টিকে থাকতে হয় তাহলে তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সৃষ্ট ভূখন্ডগত বৈশিষ্ট্য নিয়েই টিকে থাকতে হবে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারতীয় ইউনিয়নের জন্ম হয়েছিল। তার ২৪ বছর পর পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়। এই সময় অনেকেই বলতে শুরু করেন যে, দ্বিজাতি তত্ত্বের অসারতা প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ এই তত্ত্বটি ভুল ছিলো এবং তার ভিত্তিতে দেশ বিভক্তিও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এই গোষ্ঠীটি তখন দেশবিভক্তির জন্য মরহুম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকেই শুধু দায়ী করেননি। তারা এই দেশের মুসলিম নেতৃবৃন্দ এবং সম্মানিত আলেম ওলামা যারা স্বতন্ত্র বাসভূমি প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তাদের স্বাধীনতার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করলেন। টুপি দাড়িধারী নামাজী ব্যক্তিরা নির্যাতনের শিকার হলেন। জিন্নাহ ক্যাপ কুকুরের মাথায় উঠলো এবং ইসলামী মূল্যবোধ, আদব কায়দা এবং সামগ্রিক আদর্শকে তারা প্রহসনে পরিণত করলেন। এই ধারণার উৎসে ছিলো তৎকালীন ভারতে ক্ষমতাসীন ভারতীয় কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টি স্বয়ং। তারা ১৩ দিনের সরাসরি যুদ্ধে পাকিস্তানকে হারিয়ে প্রকাশ্যে বাংলাদেশ ভূখন্ডকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত না করে সিমলা চুক্তি অনুমোদন করতে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে অনুমোদন প্রস্তাবে বললেন, ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বাটোয়ারা অবৈধ হয়েছিল। এরপর তাদের এ দেশীয় এজেন্টরা এই বাটোয়ারার জন্য দায়ীদের স্বাধীনতার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করলেন, যারা মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করলেন তাদের সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে সমাজ থেকে নির্মূল করার অভিযান চললো। এই অভিযানকে দার্শনিক ভিত্তি দেয়ার জন্য ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরও অভাব হলো না। তখন প্রশ্ন দেখা দিলো, যদি ৪৭ সালের বাটোয়ারা অবৈধ ও বাতিল হয় তাহলে বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ক কি হবে? অখন্ড মানে পুনর্যুক্ত? ভারতের রাষ্ট্রীয় রূপই বা কি দাঁড়াবে, হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক কি হবে ইত্যাদি মীমাংসিত প্রশ্নের পুনরুন্মুক্তির মত সুদূরপ্রসারী প্রশ্ন উঠে এলো। সিদ্ধান্তহীনতার এই অবস্থায় স্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শাসনের প্রথম সাড়ে তিন বছর কার্যত বাংলাদেশ ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পর্যবসিত হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে এর তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তাদের ভারত বিরোধিতা পাকিস্তান আমলকেও ছাড়িয়ে যায় এবং অতিরিক্ত ভারতপ্রীতি ও তোষণের জন্য তারা সরকারকেই দোষারোপ করতে শুরু করেন। এর ফল এই দাঁড়ায় যে, শেখ মুজিবের ন্যায় জনপ্রিয় নেতা যখন সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হলেন তখন তার জন্য আফসোস করার লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর এই বিষয়টি আর এগোয়নি। ভারতীয় শাসনতন্ত্রের আদলে বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে বিধৃত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র বিদায় নেয়, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস তাতে স্থান পায় এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে শাসনতন্ত্রে ইসলামকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটা ছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিফলন, দেশের সংখ্যাগুরু মানুষের আকিদা বিশ্বাসের অভিব্যক্তি। এদেশের মানুষের ধর্মীয় পরিচয়কে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারে না। ভারতীয় বুদ্ধিজীবী বসন্ত চ্যাটার্জিও তাই মনে করেন, তার ভাষায় : Ever since the emergence of Bangladesh even the leaders in the highest position in our country have been shame-lessly claiming that the event has destroyed the two nation theory. Somebody should ask these hypocrites if they could give one good reason for sparate existence of Bangldesh after the destruction of the two nation theory. If this theory has been demolished as they claim, then the only logical consequence should be the reunion of Bangldesh with India as seems to be the positive stand of Bangladeshi Hindus. Could these highly placed people who are all the time drumming the false news of the death of two nation theory, propose that since the theory on the strength of which we had separated in 1947, exists no more, the country had better revert to its old position of subservience to Calcutta? (Inside Bangladesh Today pp.150) অর্থাৎ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে আমাদের দেশের এমনকি সর্বোচ্চ পদধারীরাও নির্লজ্জের মতো দাবি করে আসছেন যে, এই ঘটনা দ্বিজাতিতত্ত্ব¡ ধ্বংস করে দিয়েছে। এসব কপটাচারীদের জিজ্ঞাসা করা উচিত দ্বিজাতিতত্ত্ব¡ ধ্বংসের পর বাংলাদেশের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের একটিও সুযুক্তি তারা দিতে পারেন কি না। তাদের দাবি অনুযায়ী তত্ত্বটি যদি ধ্বংস হয়ে থাকে তাহলে একমাত্র যুক্তিসিদ্ধ পরিণাম হওয়া উচিত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পুনঃসংযুক্তি, বাংলাদেশী হিন্দুদের এটাই যথার্থ অবস্থান। এইসব উচ্চ পদাসীন ব্যক্তিবর্গ যারা সর্বদা দ্বিজাতিতত্ত্বের মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদের ঢোল পেটাচ্ছেন তারা কি.... প্রস্তাব দিতে পারেন যে, ১৯৪৭ সালে যে তত্ত্বের ওপর দেশ বিভক্ত হয়েছিল তার যেহেতু আর অস্তিত্ব নেই, সেহেতু দেশটি কলকাতার অনুগ্রহনির্ভর সেই পূর্বেকার অবস্থায় ফিরে যাওয়াই ভালো? আমি যদি বলি বাংলাদেশের মানুষের শরীরে এক ফোঁটা রক্ত থাকতেও তাদের কেউ এই অবস্থা মেনে নেবে না, তাহলে হয়তো বেশি বলা হয়ে যাবে। বাংলাদেশে কিছু বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক, শিক্ষক এবং গণবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক নেতা আছেন যারা এই ক্যাটাগরিতে পড়েন না। তারা ভারতীয় অন্ন এবং ক্ষুদ কুঁড়া খেয়ে বেঁচে থাকেন। সাম্প্রতিককালে এদের দৌরাত্ম্য কিছুটা বেড়েছে। এরা এদেশের মানুষের পিতৃ পরিচয় মুছে দিতেই শুধু চায় না তাদের আদর্শকে ধ্বংস করে দিয়ে ভারতের স্বার্থরক্ষায় বদ্ধপরিকর। তারা আমাদের অস্তিত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জকে আমি এদেশের আলেম-ওলামা, জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী শক্তির ঐক্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। অস্তিত্বের পথে থ্রেট না থাকলে ঐক্য হয় না এবং ঐক্য না থাকলে অস্তিত্ব¡ টিকিয়ে রাখা যায় না। আবার এদেশের আদর্শিক বিভ্রান্তিও অব্যাহত থাকতে পারে না। ভাষাভিত্তিক কোনও অঞ্চলের নাম বাংলাদেশ নয়। এটা যদি হতো, তাহলে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের বাঙালি অঞ্চল এর অন্তর্ভুক্ত হতো অথবা আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। কিন্তু তা সম্ভবপর নয়। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশী জাতিসত্তা সৃষ্টিও অবাস্তব। বস্তুত বাংলাদেশ হচ্ছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি রাষ্ট্রসত্তা স্বাভাবিকভাবে যার আদর্শ ইসলাম এবং ইসলাম ছাড়া এই দেশ টিকে থাকতে পারে না। আজকে যারা দ্বিজাতিত্ত্বের বিরোধিতা করেন এক সময় তারাই মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের কথা বলতেন। একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র গঠন না করে আমাদের পূর্বপুরুষরা একটি রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন এবং ২৫ বছর তার অংশ হিসেবে আমরা আমাদের অধিকার পাইনি বলেই আমরা আরেকটি রাষ্ট্র গঠন করেছি, ভারতে ফিরে যাইনি। কাজেই ইসলামী আদর্শকে এই রাষ্ট্রের বুনিয়াদ থেকে বাদ দেয়া যায় না, দিলে রাষ্ট্রের অস্তিÍত্বই থাকে না। আরেকটা কথা বলা দরকার। যে কোন দেশের মুক্তি আন্দোলনে যৌবনের ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুবকদের ভূমিকা ছিল মুখ্য। চীন, রাশিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলন, ভারতের খিলাফত আন্দোলন, মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলন, গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন, আইরিশ মুক্তি আন্দোলন সর্বত্রই সামনের কাতারে ভূমিকা রেখেছে স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীরা। মার্কিন বিপ্লব, ফরাসী বিপ্লব, ইতালির মুক্তি আন্দোলনসহ দুনিয়ার সকল আন্দোলন বিপ্লবে সেনাবাহিনীতে যুবক তরুণদের ভিড়ই ছিল সবচেয়ে বেশি। তারুণ্যের শক্তিই একটি দেশ ও তার আদর্শকে টিকিয়ে রাখতে পারে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম হতে পারে না। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের জাতীয় জীবনে বৃদ্ধেরা গতায়ু, শিশুরা অনাগত, যুবক-তরুণরাই বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। জাতির নেতৃত্ব তাদের হাতেই। এই দেশকে গড়ে তুলতে হলে তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। যে দেশের মানুষ ফজরের আজানের ধ্বনিতে ঘুম থেকে জেগে ওঠে এবং এশার নামাজ পড়ে ঘুমুতে যায় সে দেশে তাদের দায়িত্ব জেগে ওঠা মানুষগুলোকে কাজে লাগিয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা অর্জনে জাতিকে সাহায্য করা। এ জন্য আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং কুরআন সুন্নাহর শিক্ষায় সজ্জিত হওয়া তাদের জন্য অপরিহার্য। এই যুবসমাজ জাতিগঠনের পাশাপাশি শুধুমাত্র ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজই করবে না, তারা ইসলামবিরোধী সকল তৎপরতার বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধও গড়ে তুলবে। আর যেহেতু ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার গ্যারান্টি সেহেতু স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থেই ইসলামকে লালন করতে হবে। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে কোন ইসলামী দল, ইসলামী নেতৃত্ব, পীর-দরবেশ, ওলামা মাশায়েখের ওপর কোনও আঘাত এলে যুবসমাজকেই তার উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। এটা করতে না পারলে আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক কোনও অস্তিত্বই টিকে থাকতে পারবে না। সময় থাকতেই এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সাবধান হতে হবে। লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ পাবলিকেশন লি.

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির