post

জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রেক্ষিত আগামীর বাংলাদেশ

শাহরিয়ার ফয়সাল

০৩ নভেম্বর ২০২২

২০২৩ সাল থেকে বাংলাদেশে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। এ শিক্ষাক্রম নিয়ে নানা মহল থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়েছে। কুদরত-ই-খুদা শিক্ষানীতিকে ভিত্তি ধরে সাজানো হয়েছে এ শিক্ষাক্রম। ৯০ শতাংশের অধিক মুসলিম জনগোষ্ঠীর এ দেশে যে ধরনের শিক্ষানীতি বা শিক্ষাক্রম হবার কথা ছিল ব্রিটিশ ভারত থেকেই তা অবহেলার জীর্ণকুঠিরে আবদ্ধ রয়েছে। নামকাওয়াস্তে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত কিছু পাঠ্যবই রাখা হলেও তার প্রতি চরম অবহেলা পরিলক্ষিত হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোতে নেই কোনো ধর্মীয় শিক্ষার কাঠামো। যুগের পর যুগ পার হচ্ছে কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষার কোনো পরিমার্জন হচ্ছে না বরং আধুনিকায়নের কথা হলে মাদ্রাসা শিক্ষার মৌলিকত্ব নষ্ট করে একই সিলেবাস স্কুল এবং মাদ্রাসার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তাতে একজন মাদ্রাসার ছাত্র কুরআন পড়লেও শিরক এবং বিদয়াতকে হালাল মনে করছে (যেমন: বেদিতে ফুল দেওয়া, শিখা চিরন্তন ও শিখা অনির্বাণ প্রজ্বলন, সুদ-মুনাফাকে একই মনে করা ইত্যাদি)। এসবের মূল কারণ হলো শিক্ষাক্ষেত্রে পশ্চিমাদের নগ্ন হস্তক্ষেপ। এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের অধিকাংশই তথাকথিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। ফলের এর প্রভাব তাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত। শিক্ষা কাঠামোতে আধুনিকতার কথা বলে ধর্মশিক্ষাকে করা হচ্ছে চরমভাবে অবজ্ঞা। বিনিময়ে দেশে শিক্ষিত মানুষ বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু মনুষ্যত্ব আজ চরমভাবে বিপর্যস্ত এক জীর্ণকুঠিরে ইলশেগুঁড়ির দানা গুনছে। যত সময় যাচ্ছে শিক্ষিতের হার, মাথাপিছু আয়, বড় বড় দালান, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আর বড় বড় অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। এর সাথে তালমিলিয়ে বাড়ছে ধর্ষণ, মাদকের ব্যবহার, হত্যা, টাকা পাচার, দুর্নীতি, ঘুষ, বিবাহ বিচ্ছেদ আর ক্ষমতার লালসা। আর এ সকল অপকর্মসমূহ সংঘটিত হচ্ছে শিক্ষিত সমাজ দ্বারা। অথচ শিক্ষার উন্নয়নের সাথে সাথে এসব নিম্নগামী হবার কথা ছিল। তাহলে কি শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য টাকা কামানোর মেশিন তৈরি?

যাইহোক এর পেছনের আসল কারণ আমরা আজ খুঁজবো। আর এ কারণ খুঁজে পেতে গেলে আমাদের সর্বপ্রথম এ উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিবর্তনের দিকে চোখ বুলাতে হবে। মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের মূলেই রয়েছে শিক্ষা। সভ্যতার শুরুতে শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার রূপ যেমন ছিল তা পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান আধুনিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। মানুষ নিজের প্রয়োজনেই শিক্ষা গ্রহণ করে এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ঘটায়। আর উত্তম শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থাই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে চলে। যুগে যুগে শিক্ষাবিদগণ পরিবর্তন হওয়া সময়ের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত প্রয়োজন, সামাজিক কাঠামো, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত গতিধারা, জাতীয় উন্নয়ন, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ইত্যাদি বিষয়ে বিবেচনা করে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করেছেন। বাংলাদেশের শিক্ষানীতির ইতিহাস আলোচনা করতে হলে শুরুতেই আমাদের ব্রিটিশ ও পাকিস্তান  আমলের  নানা শিক্ষানীতি, শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষা কমিটির প্রভাবগুলো জানাটা জরুরি। একটি দেশের শিক্ষানীতিতে শুধুমাত্র কিছু নেতা ও কথামালার সমষ্টিই মনে করলে হবে না, বরং এটি সে দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং সামগ্রিক জাতিসত্তার গতিধারা ও পরিচয় বহন করে। 

মুসলিম আমলে শিক্ষা

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমনের সাথে সাথে ভাষা, শিল্প ও সাহিত্যের ধারা অনেকাংশেই বদলে যায়। মুসলমানদের প্রভাবে শিক্ষাক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। মুসলমানরা ধর্মীয় প্রয়োজনে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর মসজিদ নির্মাণ করে। এসকল মসজিদ শুধু ধর্মীয় কাজেই ব্যবহার হয়নি, এখান থেকে শিক্ষাদান করাও হতো। খুব কম সময়ের মধ্যে মসজিদভিত্তিক অনেক মক্তব ও মাদরাসা গড়ে ওঠে, যেখান থেকে খুব সহজেই শিক্ষা কর্মসূচি পরিচালিত হতো।

বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় দেখা যায় শুধু ব্রাহ্মণরাই শিক্ষাগ্রহণ করার সুযোগ পেত। কিন্তু মুসলিম আমলে শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে গেছে সবার দুয়ারে। ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাধারণ শিক্ষাও মিলিয়ে দেওয়া হয় এক সময়। সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের নেতৃত্বে ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাধারণ শিক্ষার মিশ্রণ ঘটানো হয়। মাদরাসাগুলোতে সাহিত্য ও দর্শনের পাশাপাশি কুরআন, হাদিস, ফিকাহ ও উসুল শেখানো হতো।

সুলতান ইলতুৎমিস তাঁর শাসনামলে বহুসংখ্যক মক্তব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকও বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক তাঁর রাজধানী ফিরোজাবাদে একটি সুবিশাল মাদরাসা স্থাপন করেছিলেন। মুসলমানদের আগমনে ভাষায় অনেকটা পরিবর্তন আসলে সুলতানি আমলে সাধারণ মানুষ মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ পেত।

বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে শিক্ষা, শিল্প ও সাহিত্যে অবদানের জন্য আলাউদ্দিন হুসেন শাহ অন্যতম ভ‚মিকা পালন করেন। এ সকল ক্ষেত্রে তাঁর উৎসাহ এবং পৃষ্ঠপোষকতার কারণে তিনি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি প্রচুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। পরবর্তিতে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের পুত্র নাসিরউদ্দিন নসরৎ শাহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।

মুঘল আমলে দেখা যায়- সম্রাটদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে মক্তব, মাদরাসা ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাকেন্দ্র চালু হয়। সেসব শিক্ষাকেন্দ্রে প্রখ্যাত আলেমগণের মাধ্যমে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। মুঘল আমলে অনেক হিন্দু ফারসি ভাষা শেখায় আগ্রহী হয়, এ কারণে হিন্দুরাও তখন মাদরাসায় যেত। মুঘল আমল হলো শিক্ষার এমন একটি সময়কাল, যখন পরিমাণগত ও গুণগত (quantitative and qualitative) উভয় দিকে উন্নতি লাভ করে।

ব্রিটিশ শাসিত ভারত বর্ষের শিক্ষাব্যবস্থা

শিক্ষানীতির আনুষ্ঠানিক যে রূপের সঙ্গে আমরা বর্তমানে পরিচিত, ভারতীয় উপমহাদেশে তার প্রাথমিক ভিত্তি ঘটে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে। এর অর্থ এটি নয় যে উপনিবেশ স্থাপনের পর ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশরা স্থানীয় মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়েছে। মূলত কোম্পানি তার কাজের জন্য সহায়ক জনগোষ্ঠী তৈরির প্রাথমিক উদ্দেশ্য নিয়েই তারা উপমহাদেশে শিক্ষার বিস্তার করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে শিক্ষার পুনর্গঠনের দিকে মনোনিবেশ করার অনেক আগেই এখানে খ্রিষ্টান মিশনারিরা শিক্ষার প্রসারে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কোম্পানির শাসনামলে ১৮১৩ সালে প্রথমবারের মতো কোম্পানি সনদ আইন বা চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় শিক্ষার প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করে। সাথে সাথে এ আইন উপমহাদেশের শিক্ষার গতিপ্রকৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।  

শিক্ষা যে সমাজ ও শাসনব্যবস্থার বাইরে কিছু নয়, তার প্রমাণ পেতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৮৩৫ সালে লর্ড থমাস ম্যাকলে সরাসরি জানিয়ে দেন, কোম্পানির এমন কিছু ভারতীয় মানুষ প্রয়োজন যারা মূলত তাদের এবং কোম্পানি যাদের শাসন করে তাদের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করবে। এটি দ্বারা বার্তা সুস্পষ্ট হয় যে, কোম্পানি তাদের প্রয়োজনেই শিক্ষার কাঠামো তৈরিতে আগ্রহী হয়। ম্যাকলে আরো জানান যে, এ মানুষগুলো শরীরে ও রক্তে হবে ভারতীয় কিন্তু চিন্তাচেতনায় হবে ব্রিটিশ। অর্থাৎ শুধু ভৌগোলিকভাবেই নয় বরং মনজগতেও গোলামির জিঞ্জির পরানো তাদের লক্ষ্য। 

এ ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শিক্ষা নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যদিও ম্যাকলের শিক্ষানীতিকে এ অঞ্চলের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু ১৮৫৪ সালে চার্লস উডের তৈরিকৃত উডাস ডেসপ্যাচ অন এডুকেশনকে (১৮৫৪ সালে চার্লস উড নিজের তত্ত্বাবধানে ১০০ অনুচ্ছেদ বিশিষ্ট একটি ঐতিহাসক শিক্ষা দলিল প্রণয়ন করেন; চার্লস উডের নামানুসারে এটি উডের ডেসপ্যাচ নামে পরিচিত হয়) অনেকে ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষার ম্যাগনা কার্টা হিসেবে অভিধা দেন। 

এ কথা অবশ্য একই সঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, কোম্পানির শাসনের সুবিধার্থে ভারতের শিক্ষাকে সাজানো হলেও ব্রিটিশদের মাধ্যমেই ভারতীয় উপমহাদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার কাঠামো ও রূপরেখার প্রবেশ ঘটে এবং কোথাও তা ইতিবাচক হিসেবেই কাজ করে। ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ১৮৮২ সালের হান্টার কমিশন, ১৯০৪ সালের লর্ড কার্জনের শিক্ষা সংস্কার, ১৯১৯ সালের স্যাডলার কমিশন (প্রখ্যাত ইংরেজ শিক্ষাবিদ এবং লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মাইকেল স্যাডলারের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে একটি কমিশন গঠন করে। ১৯১৯ সালে শেষ দিকে এ রিপোর্ট পেশ করা হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড স্থাপনসহ আরো অনেক সুপারিশ করেছেন। স্যাডলার কমিশন ইন্টারমেডিয়েট পাসকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা বলে বিবেচিত করেন। এ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়) কিংবা  সর্বশেষ ১৯৪৪ সালের জন সার্জেন্ট স্কিম শিক্ষার উন্নয়নে নানা সুপারিশ ও সিদ্ধান্ত প্রদান করলেও সেগুলো মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষার বিকাশকে ত্বরান্বিত  করেছে।

পাকিস্তান আমলে শিক্ষাব্যবস্থা 

পাকিস্তান স্বাধীন হলেও ব্রিটিশ আমলের ধারাবাহিকতায় এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা চলছিল। ব্রিটিশ আমলে ২৯টি শিক্ষা কমিশন বা শিক্ষানীতি মানুষকে যতটুকু ক্রোধান্বিত করেছিল তার চেয়ে বেশি বিদ্রোহী করে তোলে পাকিস্তান আমলের ৬টি শিক্ষা কমিশন বা শিক্ষানীতি। যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ-

১৯৫১ সালের মওলানা আকরাম খাঁ কমিটি : পাকিস্তান গঠনের পর পরই একটা প্রশ্নের উদ্বেগ হয় যে, কেমন হবে পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা? এরই সমাধানকল্পে ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর-১ ডিসেম্বর করাচিতে প্রথম শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে ১৯৪৯ সালে ঢাকায় ৩য় শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ইসলামের ভাবাদর্শের ভিত্তিতেই পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার সঙ্কল্প ব্যক্ত করেন। ১৯৪৯ সালে সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের গণমানুষের আশা আকাক্সক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সময়োপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের লক্ষ্য মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁকে প্রধান করে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ববঙ্গ শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিটি আকরম খাঁ কমিটি অন এডুকেশন নামে পরিচিত। কমিটি ১৯৫২ সালে রিপোর্ট পেশ করে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো, আকরাম খাঁ কমিশনের যৎসামান্য অংশই বাস্তবায়িত হয়েছিল।

আকরাম খাঁ কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ দিক : আকরম খাঁ শিক্ষা কমিশন যেসকল প্রস্তাবনা বা সুপারিশ দিয়েছিল সেগুলো ছিল ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আজকের কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আকরম খাঁ কমিশনেরই ফসল। তাছাড়া কমিশনের সুপারিশগুলো ছিল বৈজ্ঞানিক এবং যুগোপযোগী। শিক্ষা দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা পূর্ববঙ্গের উন্নয়নকল্পে শিক্ষার যে সকল উন্নয়ন অত্যাবশ্যক ছিল তার বেশিরভাগ অংশই আকরম খাঁ কমিশনের সুপারিশে ছিলো কিন্তু বাস্তবায়নের অভাবে তা আর হয়ে ওঠেনি।

আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন : আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় ১৯৫৭ সালের ৩ জানুয়ারি। এই কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান। এই কমিশন মূলত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা পুনর্বিন্যাস ও সংস্কার সম্বন্ধে পরামর্শ দানের জন্য গঠন করা হয়। এই কমিশনের প্রথম সভা ৩ ফেব্রæয়ারি ১৯৫৭ সালে মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়। এই কমিশন সুপারিশ প্রণয়নের পূর্বে ব্রিটিশ আমলের সকল সুপারিশ পর্যালোচনা করেন। তা ছাড়া, এ কমিশন ১৯৫২ সালের শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আতাউর রহমান শিক্ষা কমিশন তৎকালে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক, শিক্ষকদের গুণগত মান ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করার জন্য সুপারিশ করেছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি।

শরীফ ও হামিদুর রহমান কমিশন : পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের জন্য যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার জাতীয় শিক্ষা কমিশন নিয়োগ করেন। ১৯৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কমিশন উদ্বোধন করেন। এই শিক্ষা কমিশনের প্রধান ছিলেন পাকিস্তানের শিক্ষাসচিব এস এম শরীফ। পাকিস্তানের শিক্ষা সংস্কার ও পুনর্গঠনের জন্য প্রথম কমিশন হচ্ছে শরীফ শিক্ষা কমিশন। এ কমিশন ১৯৫৯ সালের আগস্টে রিপোর্ট প্রণয়নের কাজ শেষ করে ১৯৬০ সালে সরকারের নিকট রিপোর্ট পেশ করে।

এ ছাড়া ১৯৬৯ সালের এয়ার মার্শাল এম নূর খান কমিশন বা ১৯৭০ সালের শাসসুল হক কমিশনের কোনোটিই বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণীয় হয়নি।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় ১৯৭২ সালে, ড. কুদরাত-এ খুদাকে প্রধান করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের তৎকালীন সীমিত সম্পদ, রাষ্ট্রীয় নীতি ও জনমানুষের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে কমিশন ১৯৭৪ সালে তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে রাজনীতির পরিবর্তন ঘটায় এ প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের বিশেষ দিকসমূহ-

১. এ কমিশন দায়িত্ব পাবার পর তাদের একটি টিম ভারতে সফর করে তার আদলে শিক্ষানীতির প্রস্তাব করেন। যা দারিদ্র্যপীড়িত ও মুসলিম অধ্যুষিত দেশের জন্য ছিল অসামঞ্জস্য।

২. এই শিক্ষানীতি তৈরির জন্য শিক্ষিত এলিট শ্রেণির লোকদের থেকে মতামত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু শিক্ষার সাথে জড়িত সকল স্তরের মানুষদের থেকে মতামত নেওয়াটা জরুরি ছিল।  

৩. ধর্মীয় মূল্যবোধকে পাশ কাটিয়ে দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের উপর ভিত্তি করে কমিশন তার রিপোর্ট পেশ করে।

৪. শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে মৌলিক কিছু বিষয়ের সঙ্গে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। (শিক্ষার সকল স্তরে সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে)

৫. শিক্ষার্থীর চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব গঠনে শিক্ষার প্রত্যেক স্তরে ব্যাপক কর্মসূচি থাকলেও ধর্মীয় শিক্ষাকে মাধ্যমিক স্তরের পূর্ব পর্যন্ত পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। (যদিও তা প্রতিটি স্তরে বাধ্যতামূলক করার প্রয়োজন ছিল)

৬. মাধ্যমিক স্তর থেকে নামমাত্র আরবি শিক্ষাকে পাঠের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

৭. জ্ঞান অর্জনের চেয়ে শিক্ষাকে অধিক কর্মমুখী করার কথা বলা হয়েছে। যা একটি জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

৮. এ শিক্ষানীতিতে একজন সাধারণ ধারার শিক্ষার্থী শিক্ষা জীবনের সূচনা হতে প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করা ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে।

পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালের অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি কিংবা ১৯৮৩ সালের মজিদ খান কমিশন প্রতিবেদনের সুপারিশ মানুষের প্রতিবাদে বাস্তবায়ন হতে পারেনি। দুটোর কোনোটিই জনগণের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করতে  পারেনি, উল্টো  বৈষম্য সৃষ্টির নানা উপাদান ছিল এগুলোতে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে ১৯৮৮ সালের  মফিজ উদ্দিন আহমদের কমিশনের সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি। এর দীর্ঘদিন পর ১৯৯৭ সালে অধ্যাপক এম শামসুল হককে প্রধান করে যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি করা হয়, তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯৯৯ সালের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি (খসড়া) তৈরি করা হয় এবং ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শিক্ষানীতি সংসদে গৃহীত হয়।

কিন্তু সেই শিক্ষানীতিও আসলে বাস্তবায়ন হয়নি বা হতে দেওয়া হয়নি। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন শিক্ষাকমিশন গঠনের সংস্কৃতি ততদিনে বাংলাদেশের বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। এ ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালে ড. এম এ বারীকে প্রধান করে নতুন কমিশন গঠন করা হয়। অবোধগম্যের কারণে পরবর্তী বছরই অর্থাৎ ২০০৩ সালে অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞাকে প্রধান করে নতুন আরেকটি কমিশন গঠন করা হয় এবং এই কমিশনের সুপারিশগুলোও বাস্তবায়ন করা হয়নি। সর্বশেষ ২০০৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে প্রধান করে জাতীয় শিক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭৪ সালের শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন ও ২০০০ সালের শিক্ষানীতিকে ভিত্তি ধরে নতুন একটি শিক্ষানীতি তৈরির কথা এই কমিটিকে বলা হয়। সেটি কিছুটা সংশোধিত হয়ে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে শিক্ষানীতি হিসেবে গৃহীত হয়। ২০১০ সালের এ জাতীয় শিক্ষানীতিই বাংলাদেশের দ্বিতীয় ও বর্তমান শিক্ষানীতি, যা ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কার্যকর রয়েছে।

বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাক্রম

ইসলামবিদ্বেষী বলে খ্যাত এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের আদলে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন করা হয়। প্রশ্নবিদ্ধ একটি শিক্ষানীতি ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ছত্রছায়ায় নাস্তিকদের একটি অংশ কালো নকশা প্রণয়ন করে যাচ্ছে। একটি জাতিকে গড়তে বা ভাঙতে হলে প্রয়োজন সে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাকে ডোমিনেট করা।

এক অশনিসঙ্কেত নিয়ে জাতিকে অনেকটা ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেই বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২৩। বর্তমানে বাংলাদেশে যে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম চালু রয়েছে তার মাধ্যমে দেশে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি হবার কথা থাকলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যত দিন যাচ্ছে ততবেশি অবক্ষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে জাতীয় জীবনে। অথচ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- Harmonious development of body, mind and soul of mankind কিন্তু এ দেশের শিক্ষিত সমাজের মধ্যে দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, সুদখোর, অবৈধ টাকার লেনদেন, চাঁদাবাজ, মাদকাসক্ত, ধর্ষক এবং দখলদারের পরিমাণ দিন দিন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। 

অসহিষ্ণু মনোভাবের কারণে মানবিক আচরণগুলো আজ ভ‚লুণ্ঠিত হচ্ছে। প্রকাশ্য দিবালোকে ছাত্ররা চাঁদাবাজি করছে, কুপিয়ে মানুষ হত্যা করছে। দায়িত্বশীল অবস্থানে বসে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। শিক্ষকেরা অর্থ উপার্জনের জন্য শিক্ষকতার ন্যূনতম নৈতিকতাকেও বিসর্জন দিচ্ছে। আর এসকল ঘটনা ঘটেছে শুধু শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির কারণে।

এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পাঠ্যক্রমে ধারাবাহিক পরিবর্তন সাধন করেছে। পাঠ্যক্রমের কনটেন্টগুলোতে পশ্চিমা সাংস্কৃতি এবং নাস্তিকতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে মাদ্রাসার ছাত্ররাও নানা ধরনের শিরক এবং বিদয়াতকে বৈধ মনে করছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম যারা প্রণয়ন করছে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিন্তাগত দিক থেকে ইসলাম বা ধর্মবিদ্বেষী। যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন টকশোতে।

প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমের অসারতা

প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে ধর্মীয় শিক্ষাকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। কিন্তু ধর্মকে বাদ দিয়ে যে আদর্শ নৈতিক জনগোষ্ঠী গঠন সম্ভব নয় তা বর্তমান সরকার আমলে নিচ্ছে না। নতুন শিক্ষাক্রমে পূর্বের ধারাবাহিকতায় যে অসারতাসমূহ রয়েছে তা হলো-

১. মাদ্রাসা এবং স্কুলের জন্য কমন পাঠ্যপুস্তক চালু করা। যা মাদ্রাসার দ্বীনি আকিদার সাথে সাংঘর্ষিক। যেমন: বাংলা বইয়ে পহেলা বৈশাখ পালন, জাতীয় দিবসসমূহে বেদিতে ফুল দেওয়া, বিভিন্ন উৎসব পালনে হিন্দুয়ানা সাংস্কৃতিকে বাংলার আবহমানকালের সাংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে মুসলিম লেখকদের লেখনী বাদ দিয়ে ইসলামবিদ্বেষী লেখকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

২. শিক্ষাক্রম প্রণয়ন কমিটিতে মাদ্রাসার শিক্ষা এবং শিক্ষকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি।

৩. উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ধর্ম শিক্ষাকে শিখনকালীন মূল্যায়ন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। 

৪. উচ্চশিক্ষার সকল স্তরে ধর্মকে এক প্রকার উপেক্ষিত রাখা হয়েছে।

৫. মাদ্রাসা শিক্ষার কাঠামোতে নিজস্ব স্বকীয়তাকে বজায় রেখে কোনো কাঠামো পরিবর্তন বা পরিমার্জনের সুপারিশ নেই।

৬. ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের ক্ষেত্রকে সংকীর্ণ করা হয়েছে।

বর্তমান শিক্ষাক্রমে আমাদের দাবিসমূহ

১. শিক্ষার সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

২. শিক্ষাক্রমের বিষয়সমূহ হতে ইসলাম ও ইসলামী আকিদাবিদ্বেষী সকল বিষয়সমূহ বাদ দিতে হবে।

৩. আলেমদের সমন্বয়ে জাতীয় শিক্ষাকমিটি গঠন করতে হবে।

৪. ছাত্র এবং ছাত্রীদের জন্য আলাদা পাঠদান রুম করতে হবে।

৫. মাদ্রাসার শিক্ষার কাঠামোকে সমুন্নত রেখে স্বতন্ত্র পাঠ্যক্রম রাখতে হবে।

সর্বোপরি শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় মূল্যবোধ ব্যতীত একটি আদর্শ জাতি গঠন করা অসম্ভব। এ ব্যাপারে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির