post

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া) প্রশ্নবিদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি

আমাদের বক্তব্য

২১ অক্টোবর ২০০৯

পূর্বকথা edupol১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশি জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করি। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের জনগণকে স্বাধীনচেতা ও দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরের মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে ড. মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে গঠন করা হয় বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন। এরপর সময়ের ক্রমপরম্পরায় বিভিন্ন সময়ে আরো ৯টি শিক্ষা কমিশন/কমিটি/টাস্কফোর্স গঠিত হয়। সর্বশেষ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ৬ এপ্রিল জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ২০০৯ গঠন করে। গত ৭ সেপ্টেম্বর এ কমিটি তাদের চূড়ান্ত খসড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট পেশ করে। স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ ৩৮ বছরে আমরা সর্বমোট ১০টি শিক্ষা কমিশন/শিক্ষা সংস্কার কমিটি/অন্তর্বর্তীকালীন টাস্কফোর্স/শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির বিশাল বিশাল রিপোর্ট পেয়েছি। এ সকল কমিশন/কমিটির রিপোর্টে প্রদত্ত সুপারিশমালা পর্যালোচনা করে আমরা এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, সামগ্রিকভাবে এসব কমিশন/কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেয়া শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন বাংলাদেশি জাতির শিক্ষার ভিত্তি নির্ধারণ তথা পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি প্রণয়নের পরিবর্তে শিক্ষার কাঠামোগত বিন্যাস, গুণগত ও পরিমাণগত উন্নয়নের জন্য সুপারিশ প্রণয়নের ওপর তাদের পূর্ণ প্রচেষ্টা বিনিয়োগ করেছে। অধিকন্তু এসব কমিশন/কমিটির সুপারিশমালার অধিকাংশই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। তাই আঙ্গিক দিক থেকে আমরা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেলেও আমাদের মনন ও মানসজগৎকে ঔপনিবেশিকতার যাঁতাকল ও নব্য সাম্রাজ্যবাদী/নব্য উপনিবেশবাদীদের কবল থেকে মুক্ত করতে পারিনি। সারসংক্ষেপ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া) প্রধানমন্ত্রীর নিকট পেশ করার পর তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট www.moedu.gov.bd-তে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে এবং সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে পরামর্শ ও মতামত চাওয়া হয়েছে। ই-মেইল ঠিকানা হলো

[email protected] [email protected]

চূড়ান্ত খসড়া রিপোর্ট পর্যালোচনা করার পর এর যে সারসংক্ষেপ দাঁড়ায় তা নিম্নরূপ : প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়ায় শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, “মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়নে ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা। ... এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে সেক্যুলার গণমুখী, সুলভ, সার্বজনীন, সুপরিকল্পিত এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।”

  • শিক্ষার কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস করে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত এবং মাধ্যমিক শিক্ষা নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে; উচ্চ শিক্ষার কাঠামো অপরিবর্তিত রয়েছে।
  • সাধারণ ও মাদরাসা শিক্ষা উভয় ধারাতেই প্রাথমিক স্তর হবে বাধ্যতামূলক মৌলিক শিক্ষার স্তর এবং এতে অভিন্ন পাঠ্যসূচি অনুসৃত হবে। তবে মাদরাসার ক্ষেত্রে কুরআন, হাদিস, আরবি এসব বিষয় অতিরিক্ত পড়তে হবে।
  • প্রাথমিক স্তরে শিশুদের শিখনকার্যে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য এক বছরের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা এবং এর জন্য অবকাঠামোগত সুযোগ সৃষ্টির সুপারিশ করা হয়েছে।
  • প্রাথমিক স্তরে সাধারণ ও মাদরাসা শিক্ষা উভয় ধারাতেই ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলেও মাধ্যমিক  স্তরের সাধারণ শিক্ষাধারার মানবিক শাখা ও ভোকেশনাল শিক্ষায় ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে; কিন্তু বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার পাঠ্যক্রম থেকে তা পুরোপুরি বাদ দেয়া হয়েছে।
  • মাধ্যমিক স্তরের সাধারণ শিক্ষাধারায় তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হলেও মাদরাসা শিক্ষাধারায় তা ঐচ্ছিক হিসেবে রাখা হয়েছে এবং প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষা-উপকরণ (teaching aid) হিসেবে কম্পিউটার ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।
  • তৃতীয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সাধারণ ও মাদরাসা শিক্ষা উভয় ধারাতেই বাংলাদেশ স্টাডিজ নামে সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে; কিন্তু মাদরাসা শিক্ষার নবম-দশম শ্রেণীতে একে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে। খসড়া রিপোর্টের কোথাও এর পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু (content) সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা নেই। এ ছাড়া প্রাথমিক স্তরে তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ‘জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশ’ নামের একটি বিষয় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
  • প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর শেষে পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্তরভিত্তিক পারদর্শিতার মূল্যায়ন করা হবে। এর ওপর ভিত্তি করে সনদ প্রদান করা হবে। এর মধ্যবর্তী সময়ের জন্য পঞ্চম ও দশম শ্রেণী শেষে আঞ্চলিক পর্যায়ে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে।
  • মাদরাসা শিক্ষাধারার শিক্ষাক্রমে পূর্বের সাধারণ ও বিজ্ঞান শাখার পাশাপাশি ‘ব্যবসায় শিক্ষা’ শাখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
  • সাধারণ শিক্ষাধারায় প্রাথমিক স্তর থেকেই ‘ললিতকলা শিক্ষা’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
  • ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাকে বিদেশী ধারার কারণে বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করে কোনোরূপ সংস্কারপ্রস্তাব ও নিরীক্ষা কার্যক্রমের আওতার বাইরে রেখে পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য দেয়া হয়েছে।
  • মাদরাসা শিক্ষাধারার এ যাবৎকাল পর্যন্ত চলমান স্বাতন্ত্র্যকে সমতায়নের (homogenization) যুক্তিতে বহুলাংশে সংকুচিত করে নিয়ে আসা হয়েছে।
  • বর্তমান মাদরাসা শিক্ষার কওমি ও আলিয়া এ দুটো পৃথক ধারাকে পুরোপুরি একইভাবে দেখা হয়েছে এবং একই নীতিমালার আওতায় আনা হয়েছে।

উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক দিকসমূহ চূড়ান্ত খসড়া রিপোর্টটিতে চোখ বুলানোর পর আমরা এর ভেতরে কতক আশাব্যঞ্জক দিক খুঁজে পাই। শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের যে দাবি বহু দিন ধরে উত্থাপিত হচ্ছিল, তার অনেকখানি কমিশন রিপোর্ট ধারণ করছে।

বিশেষ করে শিক্ষার কাঠামোগত সংস্কার সাধনের মাধ্যমে স্তরগত পুনর্বিন্যাস প্রবর্তন ছিল সময়ের দাবি। এর বাইরেও কতক বিষয় উঠে এসেছে, যা শিক্ষার মানোন্নয়নের মাধ্যমে একটি কল্যাণধর্মী উন্নত জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যেমন

  • প্রাথমিক শিক্ষার প্রারম্ভে এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালুকরণ।
  • আট বছর মেয়াদি (প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী) বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালুকরণ।
  • মাদ্রাসার মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে ব্যবসায় শিক্ষা শাখা সংযোজন।
  • কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ।
  • মাধ্যমিক স্তরে বাধ্যতামূলকভাবে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা অন্তর্ভুক্তকরণ।
  • শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩০ নির্ধারণ।
  • প্রাথমিক স্তরে আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষণ-শিখন ((teaching-learning)-এর ব্যবস্থা করা।
  • সমমর্যাদাভুক্ত বা একীভূত শিক্ষা (inclusive education) ব্যবস্থা চালুকরণ।
  • প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিরাজমান বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ।
  • প্রাথমিক স্তরে (তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণী) ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
  • শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি সম্পূর্ণ বিলুপ্তকরণ।
  • উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতির কারণে ন্যূনতম যোগ্যতার শর্ত শিথিল না করা।
  • উচ্চ শিক্ষায় গবেষণাকে উৎসাহিত করা এবং এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কনসালট্যান্ট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেয়া।
  • সকল প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার স্থাপন।
  • সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত নির্বাচনী পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি।
  • জাতীয় শিক্ষানীতি নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য একটি স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন।
  • প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বেসরকারি কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও প্রশিক্ষণের জন্য একটি স্বতন্ত্র শিক্ষক নির্বাচন ও উন্নয়ন কমিশন গঠন।
  • প্রচলিত প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং সেন্টার নিয়ন্ত্রণ ও নিরুৎসাহিত করে ক্রমে এর অবসান।
  • বিজ্ঞান ও প্রায়োগিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ।

কিছু মৌলিক সীমাবদ্ধতা ও আমাদের বক্তব্য জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া) অনেক আশাব্যঞ্জক ও বাস্তবভিত্তিক হওয়ার পরও বিশেষ কতিপয় সীমাবদ্ধতার কারণে তা জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রয়োজনকে ধারণ করতে সক্ষম হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টে স্ববিরোধিতা ফুটে উঠেছে। তাই এই রিপোর্টটিকে কোনোভাবেই পূর্ণাঙ্গ ও সার্বজনীন শিক্ষানীতি হিসেবে গণ্য করা যায় না। এর কারণগুলো নিম্নরূপ:

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়ায় শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে, “জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ প্রণয়নে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বিধৃত সংশ্লিষ্ট নির্দেশনাসমূহ বিবেচনায় রাখা হয়েছে।”

আরো বলা হয়েছে, “এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে সেক্যুলার গণমুখী, সুলভ, সুষম, সার্বজনীন এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।”

খসড়ার সংযোজনী ১-এ সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদের রেফারেন্স দেয়া হয়েছে। অনুচ্ছেদ ১৭-এ বলা হয়েছে,

“অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা রাষ্ট্র ক.    একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা র্নিধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য, খ.    সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য, গ.    আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।”

কিন্তু খসড়া রিপোর্টের ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ অধ্যায়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের এই অনুচ্ছেদকে সুকৌশলে বিকৃত করা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে সেক্যুলার গণমুখী ...’। এখানে সংবিধানের শব্দ চয়ন ‘একই পদ্ধতির গণমুখী’কে সুকৌশলে ‘সেক্যুলার গণমুখী’ বলা হয়েছে। অথচ সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সম্পর্কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে কোনো নির্দেশনা নেই।

সংবিধানের ৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ৪টি। যথাÑ ক)    সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস খ)    জাতীয়তাবাদ গ)    গণতন্ত্র ঘ)    অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র

সংবিধানের ৮(১এ) অনুচ্ছেদে আরো বলা হয়েছে,

“সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি।”

খসড়া রিপোর্টের শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ৩-এ সুনাগরিকের গুণাবলির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘ন্যায়বোধ, ধর্মনিরপেক্ষতা বোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, শৃঙ্খলা, সহজীবন যাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায়’ ইত্যাদি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানসহ কোথাও সুনাগরিকের গুণাবলি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা বোধ-এর কথা উল্লেখ নেই; এটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির নিজস্ব মনগড়া বক্তব্য ছাড়া অন্য কিছু নয়। আবার বাংলাদেশের নাগরিকদের কর্তব্য সম্পর্কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২১(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,

“সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।”

তাই বাংলাদেশের জনগণকে ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের ভিত্তিতে সুনাগরিক তৈরি সম্ভব নয়।

Secularism বা ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ দর্শনটি উনিশ শতকে যুক্তরাজ্য থেকে প্রথমত উদ্ভূত হয়েছে। ১৮৪৬ সালে জর্জ জ্যাকব হোলিওক (George Jacob Holliock) নামক এক ব্যক্তি সেকুলারিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রধানত মানুষের ইহজাগতিক দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত।

Oxford Dictionary-তে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (Secularism)-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, "Belief that religion should not be involved in the organization of society, education, etc.” আবার এ মতবাদের অনুসারী (Secular) সম্পর্কে বলা হয়েছে, “Not connected with spiritual or religious matter.”

মূলত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে যুক্তি ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার নামে Enlightenment Movement-এর সন্তান হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (secularism)-এর উদ্ভব হয়েছে। Enlightenment Movement তথা মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের মাধ্যমে এর অনুসারীরা মহান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে মানবসভ্যতার ইতিহাসে সম্পূর্ণ নতুন দর্শন আমদানি করলেন যে, রাষ্ট্র ও সমাজের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই; ধর্ম শুধু ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা অন্তরের ব্যাপার; অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও শিক্ষা প্রভৃতি থেকে ধর্মকে দূরে রাখতে হবে। তাদের মূল বক্তব্য ছিল, যুক্তি (logic)-ই জীবন পরিচালনার ভিত্তি হবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহপ্রদত্ত নির্দেশনা বা ওহির জ্ঞান (divine guidance)এর কোনো প্রয়োজন নেই। ইউরোপে এই আন্দোলনের সফলতার ফলে ধর্মহীন যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠল, তাতে মানুষ নিতান্তই স্বার্থপর হয়ে গেল, ভোগবাদী হয়ে পড়ল, ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে গেল। সর্বোপরি নীতিবোধের লোপ ও নৈতিকতার অবক্ষয়ই এর চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে প্রকাশ পেল।

সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কোনোভাবেই শিক্ষা ও শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হতে পারে না।

দুই.

এ রিপোর্টের ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ অধ্যায়ের ৪, ৫ ও ১৪ নম্বর পয়েন্টে যথাক্রমে বলা হয়েছে,

“জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা বিকশিত করে প্রজন্ম পরম্পরায় সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা।”

“দেশজ আবহ ও উপাদান সম্পৃক্ততার মাধ্যমে শিক্ষাকে শিক্ষার্থীর চিন্তা-চেতনা ও সৃজনশীলতার উজ্জীবন এবং তার জীবন-ঘনিষ্ঠ বিকাশে সহায়তা করা। ”

“সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে সম-মৌলিক চিন্তা-চেতনা গড়ে তোলা এবং জাতির জন্য সম-নাগরিক ভিত্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে সব ধারার শিক্ষার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যবই বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো। একই উদ্দেশ্যে মাধ্যমিক স্তরেও একইভাবে কয়েকটি মৌলিক বিষয় পড়ানো।”

অথচ এ বিষয় বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়েছে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার ক্ষেত্রে। ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাকে একটি বিদেশী ধারার শিক্ষা হিসেবে গণ্য করে একে বিশেষ শিক্ষা হিসেবে স্বীকৃতি ও পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য দিয়ে সকল প্রকার পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কার আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়ায় অন্য সব বিষয়ের ব্যাখ্যায় পৃথক পৃথক অধ্যায় রাখা হলেও দেশের ক্রমবর্ধমান ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাধারা সম্পর্কে কয়েক বাক্যেই সমাপ্ত করা হয়েছে। অথচ এখানে অধ্যয়ন করছে এ দেশেরই বিপুলসংখ্যক ছেলে-মেয়ে। আবার এ শিক্ষাধারায় এ দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ছোঁয়াও নেই। বাস্তবতা হলো, এ দেশীয় বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, রুচি ও সংস্কৃতির সাথে পরিচয় না থাকায় ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরাই এ দেশে অন্য একটি sub-culture গড়ে তুলছে যা আমাদের সমাজের সাথে খাপ খায় না। তারা বেড়ে ওঠে একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী হিসেবে, যা জাতিগত ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থী।

সম-মৌলিক চিন্তা-চেতনা চেতনা গড়ে তোলা ও সম-নাগরিক ভিত্তি সৃষ্টির পাশাপাশি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা ও common set of cultural values প্রবর্তনের স্বার্থেই ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাধারাসহ প্রত্যেক ধারার সকল শিক্ষার্থীরই আমাদের জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা জরুরি। তাই ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাধারাসহ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রত্যেক ধারাকেই সরকারি পরীবীক্ষণ ও নিরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। আমরা মনে করি, বর্তমান ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাধারাকে বিদেশীদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে এর শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিতে সংস্কার সাধন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত শিক্ষাক্রমের ইংরেজি সংস্করণ (national curriculum in English version) অনুসরণ করা যেতে পারে।

তিন.

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া)-এর সংযোজনী ৩-এ উল্লিখিত সাধারণ শিক্ষাধারার মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম থেকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বাতিল করা হয়েছে। শুধু মানবিক শাখা ও ভোকেশনাল শিক্ষার ৯ম-১০ম শ্রেণীতে একে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে। অথচ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়ায় শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে,

“শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়নে ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা।”

আমরা উপর্যুক্ত মূল উদ্দেশ্য হাসিলের স্বার্থেই প্রত্যেক শিক্ষাধারার সকল স্তরের সকল শাখা ও বিভাগে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাকে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জোর দাবি জানাচ্ছি।

শিক্ষা-মনোবিজ্ঞানের আলোকে বলা যায় যে সাধারণ মাধ্যমিক স্তরের বয়ঃক্রম হলো নানাবিধ টানাপড়েনের সময়। মনো-দৈহিক বিশেষ পরিবর্তনের ফলে তারা বিপথে পা বাড়ায়, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফলে এ সময়টাতে খুব সহজেই বিকৃতি আর অনাচার বাসা বাঁধে তার মনে। এ থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন আত্ম-নিন্ত্রয়ণ। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাই ব্যক্তিকে তার চিন্তা-চেতনা, কর্মকাণ্ড ও আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সুপথে পরিচালনা করে। ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাবই ব্যক্তিকে অন্তঃসারশূন্য করে দেয়। ফলে সে নানারূপ অপরাধ, দুর্নীতি ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ে। আমাদের আজকের সমাজ বাস্তবতা তারই প্রমাণ। কারণ, আমাদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অপ্রতুলতা আমাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছে না। আর আজকের উত্তপ্ত পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে সব স্তরের জন্যই ‘ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা’ অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাধারণ শিক্ষাধারার প্রাথমিক স্তরের তৃতীয় শ্রেণী থেকে ১০০ নম্বরের ধর্মীয় শিক্ষা রাখা হয়েছে, যা খসড়া রিপোর্ট অনুযায়ী গল্প ও জীবনীর মাধ্যমে শেখানো হবে। এটা ধর্ম শিক্ষার একমাত্র পদ্ধতি নয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা যাতে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারে এরূপ অনুশীলনমূলক অন্যান্য শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতিও অনুসরণ করতে হবে।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়া রিপোর্ট এবং শিক্ষামন্ত্রী ও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ প্রণয়ন কমিটির কোনো কোনে সদস্যের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট যে, তারা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা চালু ও শিক্ষার্থীদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার পাঁয়তারা করছে। আমরা বিশ্বাস করি, শিক্ষামন্ত্রী ও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ প্রণয়ন কমিটির সদস্যবৃন্দসহ এ প্রস্তাবের সমর্থক সকলেই প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। তাঁরা অবশ্যই ব্যক্তিক বিকাশে নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব অস্বীকার করবেন না।

নৈতিকতার মূল ভিত্তি হলো, অতিপ্রাকৃতিক শক্তি তথা সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস। এ বিশ্বাসই ব্যক্তিমানুষকে তাঁর আদেশ ও নিয়ম অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করে, কু-কর্মের শাস্তি সম্পর্কে অবহিত করে এবং ভালো কাজের জন্য পুরস্কৃত করে। মূলত নৈতিক মূল্যবোধের জাগরণ ও পরিস্ফুটন ব্যতীত একটি সুশৃঙ্খল ও কল্যাণকর মানবসমাজ কল্পনা করা যায় না। আজকের বিশ্বজুড়ে চলমান অরাজকতা ও অশান্তির মূল কারণও এ নৈতিক শিক্ষার অভাব। আর নৈতিক শিক্ষার মূল বিষয়টি ধর্মীয় শিক্ষা থেকে উৎসারিত। পৃথিবীর সকল ধর্মই মানুষের মঙ্গলের কথা বলে, আত্মার পরিশুদ্ধির কথা বলে, ন্যায়-অন্যায় বোধের শিক্ষা দেয়। আর এসবই নৈতিক শিক্ষার সমন্বয়। তাহলে কি ধর্মীয় শিক্ষা ব্যতীত নৈতিক শিক্ষা অর্জন করা যায় না? হয়তো যায়; কিন্তু তা ভঙ্গুর ও বিক্ষিপ্ত। নৈতিক শিক্ষার এসব বিক্ষিপ্ত স্রোতের আদি উৎসও বিভিন্ন ধর্ম। ধর্মীয় মূল্যবোধই এর মূল স্রোত। ধর্মীয় স্রোতবিহীন নৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি দেয়াল থেকে যায়। ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে যে নৈতিক শিক্ষা তাতে ব্যক্তি নিজের কাছে তার দায়বদ্ধতার কারণে নীতি মেনে চলে। ফলে ব্যক্তি যেকোনো দুর্বল মুহূর্তে প্রলোভনে পড়ে কিংবা মানবিক দুর্বলতার কারণে তার নৈতিক গণ্ডির বাইরে চলে যেতে পারে। তাছাড়া এখানে ব্যক্তি সৎ থাকার, নৈতিক আচরণে অটল থাকার কোনো কারণ খুঁজে পায় না। নশ্বর এই পৃথিবীতে ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের মধ্য দিয়ে জীবন কেটে গেলেই হলো। তাতে কারো ক্ষতি কী উপকার হলো তা দেখার প্রয়োজনই বা কিসের। দুনিয়ার সময়টুকু যেকোনো উপায়ে পার হলেই হলো। ব্যস খালাস!

একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের ধর্মসমূহ ও ধর্মীয় বিশ্বাস হচ্ছে সামাজিক উপাদানসমূহের একটি যৌগিক সমন্বয়। ধর্ম ও নৈতিকতা পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। এদের অবস্থান সর্বদাই পাশাপাশি। মূলত নৈতিকতার উৎপত্তি ধর্মের এমন জায়গা থেকে, যা কখনও আলাদা করার মতো নয়। নৈতিকতা মানুষের একটি সহজাত বিষয়। বয়সের সাথে সাথে এটা বিকশিত হয়ে কিছু বিষয়কে গ্রহণ এবং কিছু বিষয়কে বর্জন করে একটা মানদণ্ডে পৌঁছায়, যাকে আমরা মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে নৈতিক মানদণ্ড বলি। মানুষে মানুষে এ আচরণের ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। এসব কারণেই মানুষের বিবেক কিছু নৈতিক গুণাবলিকে ভালো বলে স্বীকৃতি দেয় এবং কিছু বিষয়কে মন্দ বলে প্রত্যাখ্যান করে।

ধর্মীয় শিক্ষার সকল বিষয়ই স্রষ্টাকেন্দ্রিক। এখানে মানুষের সকল কাজ-কর্ম স্রষ্টার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য উৎসর্গীকৃত। এ পৃথিবীই শেষ নয়; পৃথিবীর জীবন শেষ হলে আছে আরেক অনন্ত জীবন। সে জীবনের ভালো-মন্দ সবকিছু নির্ভর করে পৃথিবীতে ব্যক্তির কৃত সকল কাজ-কর্মের ওপর। ফলে সেই অনন্ত জীবনে বিশ্বাস থেকে এর সাফল্যের জন্য ব্যক্তি নিজেকে ভালো কাজে নিয়োজিত রাখে; মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকে। ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী ব্যক্তি মাত্রই বিশ্বাস করেন যে, স্রষ্টা সর্বদ্রষ্টা; প্রতিটি ভালো ও মন্দ কাজের তিনি সাক্ষী এবং সকল কাজকর্মের জন্য পরকালীন জীবনে স্রষ্টার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এ বিশ্বাসের কারণেই ব্যক্তি সবচেয়ে গোপন ও নিরাপদ জায়গাতেও শত প্রলোভন সত্ত্বেও অনৈতিক কোনো কাজে জড়িত হতে পারে না। কিন্তু এ বিশ্বাসের বীজ যার হৃদয়ে বপিত হয়নি তার কাছে নৈতিকতা অর্থহীন মনে হয়। ফলে তাকে শত নৈতিক শিক্ষা দেয়া হলেও তা বিস্মৃত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক কল্যাণের জন্য প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা তথা ধর্মীয় শিক্ষা।

এখানে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, আচ্ছা, বেশ ভালো কথা! মানলাম, ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে; কিন্তু তা তো পারিবারিক পরিবেশেই দেয়া যায় কেন এটি আবার আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। হ্যাঁ, এ কারণেই দরকার যে, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা সবার জন্য প্রয়োজনীয় এবং অতি আবশ্যক একটি বিষয়, যা কোনোভাবেই বাদ দেয়া যায় না। ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষাবিবর্জিত সর্বোত্তম শিক্ষাক্রমও যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে তা আমাদের সামনে আজ সুস্পষ্ট। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণেই আজ জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রতিযোগিতা, জালিয়াতি-কালোবাজারির ছড়াছড়ি। সুতরাং বেঁচে থাকার জন্য যেমন মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি সেই মানুষগুলোকে সত্যিকারার্থে আলেকিত মানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন ধর্মীয় শিক্ষা। আর এর আয়োজন রাষ্ট্রকেই করতে হবে সর্বজনীন প্রয়োজনের ভিত্তিতে। কেননা, অনেক পরিবারের পক্ষে আলাদাভাবে এ ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া এটি শিশুর অধিকার। সুতরাং মা-বাবার অনিচ্ছা বা অলসতার কারণে যেন শিশু সে অধিকার হতে বঞ্চিত না হয়, সে জন্য প্রয়োজন ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষাকে অন্যান্য জাগতিক শিক্ষার সাথে বাধ্যতামূলক করা।

ব্যক্তির জ্ঞান এবং মানস গঠনের উপযুক্ত সময় শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর। এ সময় শিশুকে যেভাবে শিক্ষা দেয়া হবে সেভাবে তার মানসজগৎ গঠিত হবে; শিশুর গন্তব্যও সেদিকেই হবে। আমরা সবাই চাই, আমাদের শিশুরা জ্ঞানে-গুণে, যোগ্যতা-দক্ষতায় হোক অনন্য। সেই সাথে এ-ও চাই যে, তারা তাদের সেই জ্ঞান ও দক্ষতার কল্যাণকর ব্যবহার নিশ্চিত করুক। আর এর জন্য যে উদ্দীপক দরকার তা সরবরাহ করবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা।

এ জন্যই পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের পর The Philosopy of the Modern Education গ্রন্থে অধ্যাপক বার্বাস বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে বলেছেন, “বাধ্যতামূলকভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অনুশীলন না করলে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। কারণ, মানুষ ধ্বংসের উপকরণ অনেক বেশি জোগাড় করে ফেলেছে।”

চার.

প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির চূড়ান্ত খসড়ার সংযোজনী ২-এ প্রাথমিক স্তরের জন্য শিক্ষাক্রম উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা মাদরাসা শিক্ষার ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) স্তরের শিক্ষাক্রমে কতিপয় সংশোধনী আনার দাবি জানাচ্ছি।

ক.    মাদ্রাসা শিক্ষার ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) স্তরে যেসব বিষয় অতিরিক্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে, মাদরাসা শিক্ষাধারার স্বকীয়তার স্বার্থে সেগুলো মাদ্রাসার জন্য আবশ্যিক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। খ.    ১ম ও ২য় শ্রেণীতে ‘কুরআন মাজীদ’ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। গ.    ৩য় থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত যেহেতু আকাইদ ও ফিক্হ এবং কুরআন মাজীদ ও তাজবিদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেহেতু একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তির কারণে ‘ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টি বাদ দিতে হবে। ঘ.    ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত আরবিতে ১০০ নম্বরের পরিবর্তে আরবি ১ম পত্র ১০০ নম্বর ও আরবি ২য় পত্র ১০০ নম্বর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

পাঁচ.

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া)-এর সংযোজনী ৩-এ উল্লিখিত সাধারণ শিক্ষাধারার মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে মানবিক শাখায় সামাজিক বিজ্ঞানকে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে, আবার নৈর্বাচনিক বিষয় হিসেবে সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ (যেমন-সামাজবিজ্ঞান, পৌরনীতি, অর্থনীতি ও ভূগোল প্রভৃতি) রাখা হয়েছে। পুনরাবৃত্তি হওয়ার কারণে মানবিক শাখার আবশ্যিক বিষয়ে সামাজিক বিজ্ঞানের পরিবর্তে তথ্যপ্রযুক্তি বা সাধারণ বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

খসড়া রিপোর্টের সংযোজনী ৩-এ উল্লিখিত মাদরাসা শিক্ষাধারার মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে কতিপয় মৌলিক বিষয়কে সংকোচন/পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে কিংবা ঐচ্ছিক হিসেবে রাখা হয়েছে অথবা সম্পূর্ণরূপে বাদ দেয়া হয়েছে। যার ফলে মাদরাসা শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল বাধাগ্রস্ত হবে এবং এর মৌলিকত্ব ও স্বাতন্ত্র্য থাকবে না। উল্লেখ্য, এ কথা সর্বজনবিদিত এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া)-এর ২৭ পৃষ্ঠায় মাদরাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে,

“... শান্তির ধর্ম ইসলামের প্রকৃত মর্মার্থ অনুধাবনে সক্ষম করে গড়ে তোলা, তারা এমনভাবে তৈরি হবে যেন তারা ইসলামের আর্দশ ও মর্মবাণী ভাল করে জানে ও বুঝে, সে অনুসারে নির্ভরযোগ্য চরিত্রের অধিকারী হয় এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে সেই আদর্শ ও মূলনীতির প্রতিফলন ঘটায়।” নিম্নে এ রিপোর্টের আলোকে মাদরাসা পাঠ্যক্রমের বাতিলকৃত/ সংকুচিত/ পুনরাবৃত্তিকৃত চিত্র দেখানো হলো

দাখিল-আলিম (মাধ্যমিক স্তর) হিফজুল কুরআন শাখা বাতিল করা হয়েছে মুজাব্বিদ মাহির শাখা বাতিল করা হয়েছে  জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়ায় একদিকে বলা হয়েছে যে মাদরাসা শিক্ষাধারার স্বকীয়তা রক্ষা করা হবে, অন্যদিকে খসড়া রিপোর্টে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে এর মৌলিকত্ব ও স্বাতন্ত্র্যের ওপর অপরিণামদর্শী হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। এর কারণ হলো, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ প্রণয়ন কমিটি মাদরাসা শিক্ষাধারা সম্পর্কে অভিজ্ঞ কারো সাথে আলাপ-আলোচনা করেনি। মাদরাসা শিক্ষাধারা সম্পর্কে অভিজ্ঞদের সাথে আলোচনা করে সময়ের চাহিদার আলোকে এর স্বকীয়তা বহাল রেখে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করার জন্য আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ভারতের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে দেওবন্দ মাদরাসা, সাহারানপুর মাদরাসা এবং একই ধরনের আরো বিখ্যাত কতিপয় মাদরাসা তাদের নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থা, পাঠ্যসূচি, টেক্সট চালু রেখেছে; এবং সরকার কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ ছাড়াই তাদের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের নির্ধারিত যোগ্যতার মানদণ্ডের ভিত্তিতে সকল ধারার শিক্ষার্থীকে ভর্তির সুযোগ প্রদান করে। (এ ক্ষেত্রে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট www.jnu.ac.in ভিজিট করা যেতে পারে।)

এ ছাড়া পশ্চিমা অনেক উন্নত দেশে সনাতন শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, যা তাদের নিজস্ব ধারায় পরিচালিত এবং স্বীকৃত। সুতরাং আমরা মাদরাসা শিক্ষাক্রমে এর মৌলিক বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত রেখে পুনরায় শিক্ষাক্রম প্রণয়নের জোর দাবি জানাচ্ছি।

ছয়.

এ রিপোর্টের ২৮ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “মাদরাসা শিক্ষার উচ্চ পর্যায়ে এবং সাধারণ শিক্ষার উচ্চ পর্যায়ের মধ্যে ডিগ্রীর সমতা সরকার নির্ণয় করবে।” অথচ মাদরাসা শিক্ষার ডিগ্রির মানের বিষয়টি পূবেই নির্ণীত। ২০০৬ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাদরাসা শিক্ষার উচ্চ স্তরের (ফাজিল ও কামিল) ডিগ্রির সমতা নির্ধারিত ও নির্ণীত হয়েছে। সুতরাং এটা নতুন করে সরকার কর্তৃক নির্ণয়ের কিছু নেই।

সাত.

খসড়া রিপোর্টের সংযোজনী ৩-এ একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষাক্রমে মাদরাসা ও ভোকেশনাল শিক্ষাকে উপ-ব্যবস্থা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মাদরাসা ও ভোকেশনাল শিক্ষাকে কোনো উপব্যবস্থা হিসেবে নয়; বরং সাধারণ শিক্ষার সমান্তরাল পৃথক শিক্ষাধারা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

আট.

খসড়া রিপোর্টের ৪৮ নং পৃষ্ঠায় নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে,

“নারীকে সচেতন ও প্রত্যয়ী করা, এবং সম-অধিকারের অনুকূলে নারীর দৃষ্টিভঙ্গি প্রখর করা।” এ প্রসঙ্গে আমরা বলতে চাই যে শুধু দৃষ্টিভঙ্গি প্রখর করলেই হবে না, নারীর স্বকীয়তা বজায় রেখে তাদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

নয়.

নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য খসড়া রিপোর্টের ৪৯ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে,

“উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ ও গবেষণা করার জন্য দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রীদের বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা এবং স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।” আমাদের সমাজবাস্তবতায় দেখা যায়, সুদের চক্রবৃদ্ধি হারের কারণে ঋণগ্রহীতার পক্ষে আসল ফেরত দেয়া সম্ভব হয় না এবং এটা ঋণগ্রহীতার জন্য ক্রমবর্ধমান বোঝা হিসেবে বিবেচিত। ফলে ইচ্ছা থাকলেও এ ধরনের ঋণগ্রহণে শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হবে না। তাই শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহী করতে শিক্ষা বৃত্তি প্রদানের পাশাপাশি সুদমুক্ত ঋণ (করজে হাসানা) প্রদান করতে হবে।

দশ.

খসড়া রিপোর্টের ৫০ নং পৃষ্ঠায় ‘ললিতকলা শিক্ষা’ সম্পর্কে বলা হয়েছে,

“সরকারি উদ্যোগে ও অর্থানুকূল্যে জাতীয় চিত্রশালা, সংগীত, ও নৃত্য অ্যাকাডেমি, নাট্য ও রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা বাঞ্ছনীয়।”

এ সম্পর্কে একই পৃষ্ঠায় আরো বলা হয়েছে,

“সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শহর ও গ্রাম পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ চিত্রকলা ও কারুশিল্পের প্রদর্শনী, সংগীত, নাটক নৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে।”

আমরা এ প্রসঙ্গে বলতে চাই যে ললিতকলা শিক্ষা কার্যক্রমসমূহ প্রত্যেক ধর্মের ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে সুস্থ, সুন্দর ও মৌলিক সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে পরিচালিত হতে হবে যা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

এগারো.

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া)-এর ৫৪ নং পৃষ্ঠায় ব্রতচারী কার্যক্রমকে নীতিগতভাবে স্বীকৃতি দেয়া ও আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে। ব্রতচারীর পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে,

“এটি গীত ও নৃত্য-ভিত্তিক সুশৃঙ্খল একটি কার্যক্রম যা বিদ্যালয়ে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। ... ব্রতচারী কার্যক্রম সিলেট, খুলনা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এবং জয়পুরহাটের অনেক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রচলিত আছে।”

ব্রতচারী কার্যক্রম কোনোভাবেই ঢালাওভাবে আমাদের বিদ্যালয়সমূহে চালু করার মতো বিষয় নয়। এটি কোনো সার্বজনীন, স্বীকৃত ও নীতিগতভাবে গ্রহণযোগ্য কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল আচার-প্রথাও নয়; বরং এটি একটি আঞ্চলিক গোষ্ঠীগত প্রথা। এরূপ গোষ্ঠীগত (local) কোনো চর্চাকে সাধারণভাবে (universally) উৎসাহিত কিংবা চালু করা শুধু অযৌক্তিকই নয়, বরং মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। ব্রতচারীর মূল উদ্দেশ্য হিসেবে যা বলা হয়েছে, তা স্কাউটিং ও গার্লস গাইডিং এবং ক্রীড়া শিক্ষার কার্যক্রম শক্তিশালী করার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি। কিছু সুপারিশ

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিবেচনা করার জন্য নিম্নে কিছু সুপারিশ পেশ করা হলো:

  • জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়ার আলোকে আমাদের দেশে সাক্ষরতার হার মাত্র ৪৯%। নিরক্ষরদের অধিকাংশই আবার বয়স্ক। দেশের অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠীকে নিরক্ষর রেখে উন্নত ও স্বনির্ভর জাতি গঠন সম্ভব নয়। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া) রিপোর্টে বয়স্ক সাক্ষরতার কথা বলা হলেও এর পূর্ণ সাফল্যের জন্য কোনো সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পেশ করছি দেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরক্ষরতা দূর করে শত ভাগ সাক্ষর জাতি হিসেবে পথ চলার লক্ষ্যে এবং সাংবিধানিক (১৭ নং অনুচ্ছেদ) দায়বদ্ধতা পূরণার্থে উচ্চশিক্ষা স্তরে (সকল পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজসমূহ ও মেডিক্যাল কলেজসমূহে) নিদিষ্ট সময়ের জন্য summer/winter schooling program প্রবর্তন করা যেতে পারে। এ program-এর আওতায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা সরকারি ব্যবস্থাপনায় নির্দিষ্ট সম্মানীর বিনিময়ে বাধ্যতামূলকভাবে সাক্ষরতা অভিযানে অংশগ্রহণ করবেন। এ অভিযানে অংশগ্রহণ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য অ্যাকাডেমিক ক্রেডিট হিসেবে বিবেচিত হবে।
  • সমকালীন প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার প্রয়োজনে উচ্চশিক্ষা স্তরে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে medium of instruction হিসেবে ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করা বাঞ্ছনীয় বলে আমরা মনে করি।
  • মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা উৎসাহিত ও গবেষণাকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি এতে উন্নত যোগ্যতা সৃষ্টির লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষা স্তরে বাধ্যতামূলক বাংলা সংযোজন করা যেতে পারে।
  • অনার্স পর্যায়ে ভর্তির ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের ন্যায় বিগত স্তরের শিক্ষাধারা ও ফলাফলের চেয়েও উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বাস্তব যোগ্যতার বিচারকেই মুখ্য করে তোলা উচিত। এ ক্ষেত্রে IELTS, TOEFL, GRE-এর মতো প্রামাণিক মানসম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য অভীক্ষা (standard & reliable test) চালু করা যেতে পারে।
  • জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া)-এর ১৪ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “মেয়ে শিক্ষার্থীরা যেন বিদ্যালয়ে কোনোভাবে উত্ত্যক্ত না হয় সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।” এ ক্ষেত্রে মেয়ে শিক্ষার্থীদেরকে উত্ত্যক্তকরীর জন্য শাস্তির বিধান রাখার পাশাপাশি আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে শালীন ও মার্জিত মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি সার্বজনীন ড্রেস কোড প্রবর্তন করা যেতে পারে।
  • জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া)-এর ৪৯ নং পৃষ্ঠায় নারী শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ৫ নং ক্রমিকে বলা হয়েছে, “প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে পাঠ্যসূচিতে যথাযথ পরিবর্তনের মাধ্যমে নারীর ইতিবাচক ও প্রগতিশীল ভাবমূর্তি ও সমান অধিকারের কথা তুলে ধরতে হবে এবং ইতিবাচক দিকগুলো পাঠ্যসূচিতে আনতে হবে, যাতে নারীর প্রতি সামাজিক আচরণের পরিবর্তন হয়।” আমরা মনে করি, নারীর প্রতি সামাজিক আচরণের পরিবর্তন আনয়নের জন্য সকল প্রকার গণমাধ্যমে নারীকে পণ্যরূপে উপস্থাপন বন্ধ করতে হবে, আকাশ সংস্কৃতিকে সার্বজনীন শালীনতা, স্বকীয়তা ও আমাদের মূল্যবোধের মানদণ্ডে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির ওয়েবসাইটসমূহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে।
  • শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতির প্রবর্তন করতে হবে। ছাত্ররাজনীতির নামে অ-ছাত্রদের রাজনীতি, চাঁদাবাজি ও সাধারণ ছাত্রদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি এবং সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় নয় বরং যোগ্যতাকেই একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পরিবর্তন বন্ধ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় মন্ত্রী-এমপি ও নেতা-নেত্রীদের অনৈতিক ও অবৈধ হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। শিক্ষানীতিতে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত দিকনির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করা বাঞ্ছনীয় বলে আমরা মনে করি।
  • প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির সামগ্রিক পরিচালন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসন কাঠামোতে অতিরিক্ত কেন্দ্রীয়করণ (centralization) প্রবণতা লক্ষণীয়, যা দুর্নীতি ও অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।
  • সাধারণ শিক্ষাধারার মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে (সংযোজনী ৩) ঐচ্ছিক বিষয় তালিকায় আরবির পাশাপাশি সংস্কৃত ও পালি রাখা হয়েছে। একই সাথে আমাদের এ অঞ্চলের ইতিহাসের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত এবং বর্তমানেও অত্যন্ত সচল দুটো ভাষা ফার্সি ও উর্দু রাখা যেতে পারে এবং চলমান বিশ্বের সাথে সম্পর্ক বিচারে ফ্রেঞ্চ অথবা স্প্যানিশও বিবেচনা করা যেতে পারে।
  • সামগ্রিকভাবে প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি দ্বিভাষী (bilingual) নীতি তথা ইংরেজি বনাম বাংলা গ্রহণ করেছে, যা মূলত ঔপনিবেশিক শাসনামলের ফল। একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন ও বহুমাত্রিক চেতনাসম্পন্ন জাতি গঠনে এ থেকে বেরিয়ে এসে বহুভাষী (multilingual) নীতি গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে এবং সময়ও হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রধান আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আদলে মাধ্যমিক স্তরে পর্যায়ক্রমে দেশের ইতিহাস ও চলমান বিশ্বের সাথে সঙ্গতি রেখে একটি তৃতীয় ভাষা নেয়ার অপশন চালু করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আরবি ভাষা অগ্রাধিকার বিবেচনার দাবি রাখে। কেননা, বর্তমানে আরব দেশগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজারে উর্বর কর্মক্ষেত্র হিসেবে স্বীকৃত।
  • শিক্ষানীতি সম্পর্কে শেষ যে কথাটি না বললেই নয় স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকেই শিক্ষা নিয়ে আমাদের দেশে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ৩টি শিক্ষা কমিশন, ২টি অন্তর্বর্তীকালীন কমিশন, ২টি শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি এবং কতক শিক্ষা সংস্কার কমিটি গঠন করা হলেও এর কোনোটিই এ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এর মধ্যে বিভিন্ন সময় নিত্যনতুন তত্ত্ব ও পদ্ধতি যেমন ১৯৯২ সালে নৈর্ব্যক্তিক পদ্ধতি, ২০০১ সালে গ্রেডিং পদ্ধতি, ২০০৬ সালে একমুখী শিক্ষা, ২০০৯ সালে সৃজনশীল (কাঠামোবদ্ধ) প্রশ্নপদ্ধতির মতো বহুবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানানো হচ্ছে। ফলে এর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠছে। সরকার পরিবর্তনের সাথে শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন, পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আসছে। এক সরকার কোনো একটি পদ্ধতি চালু করে তো অন্য সরকার এসে তা বাদ দিয়ে নতুন পদ্ধতি চালু করে; তাদের মতবাদ পাঠ্যবিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করে। ফলে শিক্ষার্থীরা হয় বিভ্রান্ত। তারা কোনটা বিশ্বাস করবে? আজ যেটা আছে তো কাল সেটা পাল্টে গেল। ফলে শিক্ষার্থীরা কোনো বিষয়ে স্থির হতে পারছে না; তাদের শিক্ষার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হচ্ছে। অথচ শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক যে সমস্যা তা সমস্যাই রয়ে গেছে।
  • আমরা কি এটাই চাই? আমরা কি চাই আমাদের শিশুরা বেড়ে উঠুক বিভ্রান্তির ঘূর্ণাবর্তের মধ্য দিয়ে, ভুল ইতিহাস আর দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে হোক দ্বিধান্বিত? তারা একটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার যাঁতাকলে পিষ্ট হোক? ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাবিবর্জিত হয়ে তারা ডুবে যাক দুর্নীতি, অন্যায় আর পাপ-পঙ্কিলতার পাকে?
  • না, আমরা তা চাই না। আমরা চাই না আমাদের শিশুরা গিনিপিগ হোক। আমরা চাই আমাদের সব শিশু বেড়ে উঠুক সমান সুযোগ-সুবিধার মধ্য দিয়ে। কোনো দলীয় মতবাদ নয়, তারা জানুক ইতিহাসের সত্যকে। বাস্তবিক আর ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার সমন্বয়ে গড়ে উঠুক তাদের মন ও মানস, যার মধ্য দিয়ে অঙ্কুরোদ্গম ঘটবে মানবিক মূল্যবোধ, আত্মিক পরিশুদ্ধি আর পারস্পরিক কল্যাণবোধের। আশা করি আমাদের সরকার ও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ প্রণয়ন কমিটি চূড়ান্ত খসড়া রিপোর্ট কার্যকর ও বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন।

এ জন্যই পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের পর The Philosopy of the Modern Education গ্রন্থে অধ্যাপক বার্বাস বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে বলেছেন,

“বাধ্যতামূলকভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অনুশীলন না করলে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। কারণ, মানুষ ধ্বংসের উপকরণ অনেক বেশি জোগাড় করে ফেলেছে।”

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া )-এর পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দেখতে ভিজিট করুন www.moedu.gov.bd জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া ) সম্পর্কে আপনার মতামত ও পরামর্শ জানাতে ই-মেইল করুন [email protected] [email protected]

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির