post

জান্নাতের বাড়ি যাদের জন্য

মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন

৩০ জুন ২০২০

عن أمامة الباهلي- رَضِيَ اللهُ عَنْهُ - قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ- صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ- أنَا زَعِيْمٌ بِبَيْتٍ فِيْ رَبَضِ الْجَنَّةِ، لِمَنْ تَرَكَ الْمِرَاءَ، وَ إنْ كَانَ مُحِقًّا، وَ بِبَيْتٍ فِيْ وَسْطِ الْجَنَّةِ، لِمَنْ تَرَكَ الْكِذْبَ، وَ إنْ كَانَ مَازِحًا، وَ بِبَيْتٍ فِيْ أعْلَى الْجَنَّةِ، لِمَنْ حَسُنَ خُلُقُهُ. رواه أبوداود(৪১৬৭) আবু উমামা বাহেলি রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম সা. বলেছেন, ‘আমি সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাতে একটি ঘর নিয়ে দেয়ার জন্য জামিন, যে কলহ-বিবাদ পরিত্যাগ করে। আর একটি ঘর জান্নাতের মাঝামাঝিতে নিয়ে দেয়ার জন্য জামিন, যে মিথ্যা পরিহার করে; এমনকি হাসি-ঠাট্টার ছলেও। আরও একটি ঘর জান্নাতের সর্বোচ্চ মঞ্জিলে নিয়ে দেয়ার জন্য জিম্মাদার, যে তার চরিত্রকে সুন্দর করবে।’ (আবু দাউদ হাদিস নং- ৪৮০০)

রাবি পরিচিতি বর্ণনাকারী আবু উমামা বাহেলি রা. রাসূল সা.-এর বিশিষ্ট সাহাবি। নাম সাদি বিন আজলান আল-বাহেলি। উপাধি, আবু উমামা। পিতার নাম আজলান, বাহেল নামক স্থানের অধিবাসী হওয়ার ফলে তাকে বাহেলি বলা হয়। তিনি রাসূল সা. থেকে জ্ঞানের এক বিশাল ভা-ার সংগ্রহ করেছিলেন। ৮১ মতান্তরে ৮৬ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

ব্যাখ্যা ‘জান্নাত’ চিরশান্তির স্থান। মানুষ ও জিনদের অন্তহীন চাওয়া- পাওয়া, পরম সুখ-শান্তি এবং ভোগ-বিলাসের অকল্পনীয় পূণতা

লাভের একমাত্র স্থান। এর প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করে শেষ করার মতো নয়। আরবি ‘জান্নাত’ অর্থ ঘন সন্নিবেশিত বাগান। আরবিতে বাগানকে ‘রওজা’ এবং ‘হাদিকা’ও বলা হয়। কিন্তু জান্নাত শব্দটি আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব একটি পরিভাষা। জান্নাত শব্দের মৌলিক অর্থ গোপন বা আবৃত থাকা। বাগান যেহেতু গাছপালা দ্বারা আবৃত থাকে তাই বাগানকে জান্নাত বলা হয়। আর পরকালের জান্নাত অসংখ্য নিয়ামত দ্বারা আবৃত, তাই তাকে জান্নাত নামে নামকরণ করা হয়েছে। পারিভাষিক অর্থে জান্নাত বলতে এমন স্থানকে বোঝায়, যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর অনুগত বান্দাদের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, যা

দিগন্ত বিস্তৃত নানা রকম ফুলে-ফলে সুশোভিত সুরম্য অট্টালিকা সংবলিত মনোমুগ্ধকর বাগান; যার পাশ দিয়ে প্রবহমান বিভিন্ন ধরনের নদী-নালা ও ঝরনাধারা। যেখানে চির বসন্ত বিরাজমান। রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য (এমন নিয়ামত) প্রস্তুত করে রেখেছি, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি এমনকি কোনো মানুষতা কল্পনাও করতে পারে না।’ (সহিহ বুখারি) জান্নাতের নাম, অর্থ ও শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, জান্নাতের গুণাবলির বিবেচনায় জান্নাতের নাম একাধিক; কিন্তু জান্নাত একাধিক নয় একটিই। সুতরাং এ দিকটির বিবেচনায় একাধিক নামের অর্থ অভিন্ন আর জান্নাতের গুণাবলির দিক বিবেচনায় প্রতিটি নামের অর্থ ভিন্ন। (হাদিউল আরওয়াহ, পৃষ্ঠা : ১১১) আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে-

وَ بَشِّرِ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَهُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُ ؕ کُلَّمَا رُزِقُوْا مِنْهَا مِنْ ثَمَرَۃٍ رِّزْقًا ۙ قَالُوْا هٰذَا الَّذِیْ رُزِقْنَا مِنْ قَبْلُ ۙ وَ اُتُوْابِہٖ مُتَشَابِہًا ؕ وَ لَهُمْ فِیْهَاۤ اَزْوَاجٌ مُّطَهَرَۃٌ ٭ۙ وَّ هُمْ فِیْهَا خٰلِدُوْنَ আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে তাদেরকে সুসংবাদ প্রদান কর যে, তাদের জন্যে এমন জান্নাত রয়েছে যার নিম্নদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হতে থাকবে। যখনই তা হতে তাদেরকে রিযিক হিসেবে ফলসমূহ প্রদান করা হবে। তখন তারা বলবে- এটা তো পূর্বেই আমরা পেয়েছিলাম এবং তাদেরকে এর দ্বারা ওর সদৃশ প্রদান করা হবে এবং তাদের জন্যে তন্মধ্যে পবিত্রা সহধর্মিণী থাকবে এবং সেখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবে। (সূরা বাকারাহ : ২৫) তিনি আরো বলেছেন-

اَؤُنَبِّئُکُمْ بِخَیْرٍ مِّنْ ذٰلِکُمْ ؕ لِلَّذِیْنَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنّٰتٌ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِیْنَ فِیْهَا وَ اَزْوَاجٌ مُّطَهَرَۃٌ وَّ رِضْوَانٌ مِّنَ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ بَصِیْرٌۢ بِالْعِبَادِ আপনি বলে দিন, আমি কি তোমাদেরকে এসব জিনিসের চেয়ে উত্তম কিছুর সংবাদ দেবো যা মুত্তাকিদের জন্য তাদের রবের নিকট মজুদ রয়েছে? তা হচ্ছে এমন জান্নাত যার নিম্নদেশ দিয়ে নদী প্রবাহিত আছে সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে আর রয়েছে পবিত্র স্ত্রীগণ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে দৃষ্টিদানকারী। (সূরা আলে ইমরান : ১৫) জান্নাত হলো প্রত্যাশীদের সর্বোচ্চ প্রত্যাশা এবং প্রতিযোগীদের সর্বাধিক প্রতিযোগিতার বিষয়। সফলকাম সে যে জান্নাত লাভের জন্য সচেষ্ট হয়। ভাগ্যবান সে যে তা অর্জনের জন্য অধিক পরিমাণে নেক আমল করে। জান্নাত অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ, তা অর্জন করা শুধু তার জন্যই সহজ হয়, যার জন্য ঐশীভাবে বিষয়টি সহজ করা হয়। জান্নাত- যা আল্লাহ তায়ালা মুমিন বান্দাদের জন্য তৈরি করেছেন- বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত। বর্ণিত হাদিসে সেসব লোকদের জন্য

জান্নাতের শুভসংবাদ দেয়া হয়েছে, যারা তিনটি গুণের যে কোনো একটি দ্বারা অলংকৃত হয়েছে।

প্রথম গুণ : কলহ-বিবাদ থেকে দূরে থাকা অনর্থক কলহ-বিবাদ থেকে দূরে থাকা। এরূপ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের ভিতরে বাড়ি বরাদ্দ। কেননা কলহ-বিবাদ মানুষকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে বাধ্য করে ও পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। ফলে তাকে মূল লক্ষ্যে পৌঁছতে অক্ষম করে দেয়। সুতরাং, প্রকৃত মুসলমান সব ধরনের কলহ-বিবাদ পরিহার করে চলে। আবার ঝগড়া-বিবাদে গালাগালি করা নিকৃষ্ট স্বভাবের কাজ। মূলত মুনাফিক ব্যক্তিই অন্যের সাথে কলহ-বিবাদে লিপ্ত হলে মুখ খারাপ করে এবং অবলীলায় অশ্রাব্য গাল-মন্দ শুরু করে দেয়। যাপিত জীবনে কত রকম মানুষের সাথেই মেলামেশা ও লেনদেন করতে হয়। এতে কখনো কখনো মতের অমিল দেখা দেয় এবং মাঝে মধ্যে তা কলহ-বিবাদে পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু একজন প্রকৃত মুমিন কোনো অবস্থাতেই মুখ খারাপ করতে পারে না। সব সময় সে নিজ ভদ্রতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ব্যাপারে সচেতন থাকবে। দৃষ্টিভঙ্গিগত মতভেদ হোক, চিন্তা-চেতনার অমিল হোক, রাজনৈতিক কিংবা ব্যবসায়িক বিরোধ হোক, কোনো অবস্থাতেই একজন মুমিন তার মুখ দিয়ে মন্দ বাক্য উচ্চারণ করবে না। কুরআন এবং হাদিসে ঝগড়া-বিবাদে জড়িত লোকদের মাঝে আপস-মীমাংসা বিধানে সহযোগীদের উচ্চ মর্যাদা এবং প্রতিদান প্রদানে সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাদের অধিকাংশ শলা-পরামর্শ ভালো নয়; কিন্তু যে শলা-পরামর্শ দান-সহযোগিতা করতে কিংবা সৎকাজ করতে অথবা মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক বা সন্ধি স্থাপনে করে তা স্বতন্ত্র। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে এ কাজ করে, আমি তাকে বিরাট প্রতিদান দেব।’ (সূরা নিসা : ১১৪) হাদিসে প্রিয় নবী সা. বিবাদ মীমাংসাকারীর জন্য ঘোষণা করেন- হজরত আবু দারদা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে রোজা, নামাজ ও দান-সহযোগিতার চেয়ে উত্তম কাজের সংবাদ দেবো না? তাঁরা (সাহাবায়ে কেরাম) বললেন, ‘হ্যাঁ’, তিনি বললেন, তাহলো- মানুষের মধ্যে ঝগড়া- বিবাদের মীমাংসা করা। মানুষের মাঝে ঝগড়া-বিবাদ ও বিপর্যয় সৃষ্টি করা মারাত্মক সবনাশা কাজ।’ (তিরমিজি ও আবু দাউদ) আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের ঝগড়া-বিবাদ থেকে নিষেধ করেছেন। কারণ, ঝগড়া-বিবাদ মানুষের অনেক ক্ষতির কারণ হয় এবং অনিষ্টতা সৃষ্টি করে। আল্লামা আওযায়ী বলেন, আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি কামনা করেন, তখন তাদের ওপর ঝগড়া- বিবাদ চাপিয়ে দেন এবং তাদের কাজ থেকে বিরত রাখেন। মুয়াবিয়া ইবন কুরাহ বলেন, তোমরা ঝগড়া-বিবাদ থেকে বেঁচে থাক! কারণ, তা তোমাদের আমলসমূহকে ধ্বংস করে দেয়।

ইমাম শাফেঈ (রহ.) বলেন, ঝগড়া-বিবাদ করা মানুষের অন্তরকে কঠিন করে দেয় এবং পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা তৈরি করে। অনেক মানুষ আছে কেবল মজলিসে বিতর্ক করার কারণে তাদের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হয়। যার কারণে তারা একে অপরের সাথে কথা বলে না, একজন অপরজনকে দেখতে যায় না। এ কারণে মনীষীরা বিতর্ক করা থেকে সতর্ক করেন। ইবন আব্বাস রা. বলেন, তোমার যুলুমের জন্য তুমি ঝগড়াটে হওয়াই যথেষ্ট। আর তোমার গুনাহর জন্য তুমি বিবাদকারী হওয়াই যথেষ্ট। মুহাম্মাদ ইবন আলী ইবন হুসাইন বলেন, ঝগড়া দীনকে মিটিয়ে দেয়, মানুষের অন্তরে বিদ্বেষ জন্মায়। আব্দুল্লাহ ইবন হাসান বলেন, বিবাদ প্রাচীন বন্ধুত্বকেও ধ্বংস করে, সুদৃঢ় বন্ধনকে খুলে দেয়, কমপক্ষে তার চড়াও হওয়ার মানসিকতা তৈরি করে যা হলো সম্পর্কচ্ছেদের সবচেয়ে মজবুত উপায়। (মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জেদ, ঝগড়া-বিবাদ)

দ্বিতীয় গুণ : মিথ্যা না বলা আল্লাহ জান্নাতে যাদের বাড়ি বরাদ্দ করেছেন তাদের দ্বিতীয় গুণ হলো মিথ্যা কথা পরিহার করা। কেননা মিথ্যা বলা সব পাপাচারের মূল। যে মিথ্যাকে বর্জন করে সে কোনো রূপ পাপই করতে পারে না। মিথ্যাই সব ধরনের অপরাধে উৎসাহ-প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। মিথ্যা বলা মুনাফিকের লক্ষণ। মিথ্যা বলে বেচা- কেনাকারীর সাথে বিচার দিবসে আল্লাহ কথা বলবেন না। হাসি- রসিকতা কিংবা স্বাভাবিক অবস্থায়; মিথ্যা সবাবস্থায়ই হারাম ও অবৈধ। শিশুদের সাথে খেলাধুলাতেও মিথ্যা থেকে বিরত থাকা জরুরি। কারণ এটা শিশুদের অন্তরে গেঁথে যায়। রাসূলুল্লাহ সা. মিথ্যা বলা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- اِنَّمَا یَفْتَرِی الْكَذِبَ الَّذِیْنَ لَا یُؤْمِنُوْنَ بِاٰیٰتِ اللّٰهِ ۚ وَ اُولٰٓئِكَ هُمُ الْکٰذِبُوْنَ ‘যারা আল্লাহর নিদর্শনে বিশ্বাস করে না তারা তো কেবল মিথ্যা উদ্ভাবন করে এবং তারাই মিথ্যাবাদী।’ (সূরা নাহল : ১০৫) রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে তাই বলে বেড়ায়।’ (সহিহ মুসলিম) মিথ্যা বলার পরিণাম খুবই ধ্বংসাত্মক। এর জন্য দুনিয়াতে রয়েছে ধ্বংস আর আখিরাতে রয়েছে অপমান ও লাঞ্ছনা। মিথ্যার কারণে অন্তরে কপটতার সৃষ্টি হয়। মিথ্যা পাপাচার ও জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। মিথ্যাবাদীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় না। মিথ্যার কারণে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতেই চেহারা বিবর্ণ ও মলিন হয়ে যায়। বিচার দিবসে মিথ্যাবাদীর চোয়াল চিরে গর্দান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘ধ্বংস তার জন্য যে লোক হাসানোর জন্য কথা বলে এবং এতে সে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। ধ্বংস তার জন্য, ধ্বংস তার জন্য।’ (তিরমিযী ও আবু দাউদ)

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রা. থেকে বণিত। তিনি বলেন, নবী করীম সা. বলেছেন, ‘চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকবে, সে পাক্কা মুনাফিক এবং যার মধ্যে এর একটা থাকবে, তার মধ্যে মুনাফিকির একটা স্বভাব থাকবে, যে পর্যন্ত না সে তা পরিত্যাগ করবে। (১) যখন তার নিকট কিছু আমানত রাখা হয়, তাতে সে খিয়ানত করে, (২) সে যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে, (৩) যখন ওয়াদা করে, ভঙ্গ করে এবং (৪) যখন কারো সাথে ঝগড়া করে, তখন সে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে।’ (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হাদিস নং-৫০)

আবু বকর সিদ্দীক রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম সা. বলেছেন, ‘তোমরা সত্য গ্রহণ কর। সত্য নেকির সাথে রয়েছে। আর উভয়টি জান্নাতে যাবে। আর মিথ্যা থেকে বেঁচে থাক। মিথ্যা পাপের সাথে রয়েছে। উভয়ই জাহান্নামে যাবে।’ (ইবনু হিব্বান, আত-তারগিব ওয়াত তারহিব-৪১৮৬) আবু বকর সিদ্দীক রা. আরো বলেন, ‘তোমরা মিথ্যা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয়ই মিথ্যা ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।’ (বায়হাকি আস সুনানুল কুবরা হাদিস নং-২০৬১৫) সমাজের একটি সাধারণ প্রবণতা তাহলো, মা-বাবা ও গুরুজন শিশুকে নানা আশ্বাস ও প্রলোভন দেখান, অঙ্গীকার করেন যেন তারা গুরুজনের কথা শোনে। অথচ এসব অঙ্গীকার না কখনো পূরণ করা হয় এবং না কখনো তা পূরণের প্রয়োজন বোধ করা হয়। এমনকি তাঁরা মনেও রাখেন না কবে কী অঙ্গীকার করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা. এমন আশ্বাসকে মিথ্যা আখ্যায়িত করে তা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। কারণ এমন কাজে যেমন শিশুর মনে অঙ্গীকার রক্ষার গুরুত্ব হ্রাস পায়, তেমন তারা আস্থা ও শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে গুরুজনের ওপর থেকে। ফলে সাময়িক কিছু সুফল পাওয়া গেলেও শিশুর মানসিক বিকাশে তা স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে। রাসূল সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো শিশুকে ডাকল, এদিকে এসো! (কিছু দেয়ার জন্য) অতঃপর তা দিল না, তবে তা মিথ্যা।’ (মুসনাদে আহমদ হাদিস নং-৯৮৩৬) একইভাবে নির্দোষ মনে করে মিথ্যা বলা হয় আড্ডা ও বৈঠকগুলোতে। হাস্যরসের জন্য দেয়া হয় মিথ্যা উপমা। হাদিসে এমন মিথ্যার ব্যাপারেও কঠোর হুঁশিয়ারি এসেছে। রাসূল সা. বলেন, ‘অভিশাপ তাদের জন্য যারা কথা বলে এবং মানুষ হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে। তার জন্য অভিশাপ! তার জন্য অভিশাপ!!’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং- ৪৯৯০) অন্য হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন, ‘আমি তার জান্নাতের নিশ্চয়তা প্রদান করব যে মিথ্যা পরিহার করবে, এমনকি হাসিরছলে বলাটাও।’ (সুনানে আবু দাউদ হাদিস নং- ৪৮০০) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা সান আনি (রহ.) বলেন, ‘এ হাদিস প্রমাণ করে, মানুষ হাসানোর জন্য মিথ্যা বলা হারাম। এটি বিশেষ ধারার নিষেধাজ্ঞা। শ্রোতার জন্যও তা শোনা হারাম যদি তারা বুঝতে পারে মিথ্যা বলা হচ্ছে। কেননা তা শোনা মিথ্যারই স্বীকৃতি, বরং তার দায়িত্ব হলো প্রতিবাদ করা এবং আড্ডা

পরিহার করা।’ (মুহাম্মদ বিন ইসমাইল আস-সানআনি, সুবুলুস- সালাম : ২/৬৮৩) বাহয ইবনু হাকিম তার পিতা থেকে বর্ণিত। তার দাদা বলেন, আমি রাসূল সা.-কে বলতে শুনেছি, সেই ব্যক্তির জন্য ধ্বংস নিশ্চিত যে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা কথা বলে। তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস।’ (তিরমিজি হাদিস নং-২৩১৫; আত- তারগিব ওয়াত তারহিব হাদিস নং-৪২০৯; মিশকাত হাদিস নং- ৪৮৩৪) সুতরাং হাসির ছলেও মিথ্যা পরিহার করা আবশ্যক।

তৃতীয় গুণ : চরিত্রকে সুন্দর করা আল্লাহ জান্নাতে যাদের বাড়ি বরাদ্দ করেছেন তাদের তৃতীয় গুণ হলো চরিত্রকে সুন্দর করা। মানবজীবনে চরিত্র অমূল্য সম্পদ। চরিত্রহীন মানুষ পশুর সমান। উত্তম চরিত্র এমন একটি মহৎ গুণ, যা প্রতিটি মানুষের মধ্যে উপস্থিত থাকা একান্ত প্রয়োজন। কেউ উত্তম চরিত্রের অধিকারী না হলে সে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনে কখনোই সক্ষম হয় না। উত্তম চরিত্রের কারণেই মানুষ মর্যাদার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করে। এমনকি সে সর্বত্র স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকে। আল্লামা জুরজানি আখলাকে হাসানার একটি যথার্থ ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেছেন ‘কিতাবুত তারিফাত’ নামক গ্রন্থে। তিনি বলেন- ‘খুলুক বা চরিত্র হচ্ছে আত্মার বদ্ধমূল এমন একটি অবস্থা, যা থেকে কোনো চিন্তা-ভাবনা ব্যতীতই অনায়াসে যাবতীয় কার্যকলাপ প্রকাশ পায়। আত্মার ঐ অবস্থা থেকে যদি বিবেক- বুদ্ধি ও শরিয়তের আলোকে প্রশংসনীয় কার্যকলাপ প্রকাশ হয় তবে তাকে আখলাকে হাসানা নামে অভিহিত করা হয়। (শরীফ আলী বিন মুহাম্মাদ আল- জুরজানি, কিতাবুত তারিফাত, পৃ. ১০১) অর্থাৎ কোনো মানুষের নিকট থেকে যদি স্বভাবগতভাবে প্রশংসনীয় আচার-আচরণ প্রকাশ পায় তবে তাকে আখলাকে হাসানা বলা হয়। Oxford dictionary-তে বলা হয়েছে- Character is the particular combination of qualities in a person that makes him different from other. It is such a quality which leads a man to be determined and able to bear dificulties.  ‘চরিত্র হচ্ছে কোনো মানুষের মধ্যে এমন কতগুলো স্বতন্ত্র গুণাবলির সমাবেশ, যা মানুষকে অন্যদের থেকে পৃথক করে। এগুলো এমন কিছু গুণ, যা মানুষকে সঙ্কল্পবদ্ধ হতে ও কঠিন কাজ সম্পাদনে সাহায্য করে। হাসান বসরী (রহ.) বলেন, ‘সচ্চরিত্র হলো হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, দানশীলতা এবং কাউকে কষ্ট না দেয়া।’ (আবু বকর আল জাযাইরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১১৫) সচ্চরিত্র ছাড়া ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তির আশা করা যায় না। একমাত্র সৎ স্বভাব দ্বারাই সমাজে শান্তি আনয়ন করা সম্ভব। কেননা, চরিত্রহীন লোক অন্যায়, ব্যভিচার, অত্যাচার, সংঘাত, কলহ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে

সমাজজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। পক্ষান্তরে, সচ্চরিত্রবান লোক নিজ চরিত্রগুণে সমাজ-চরিত্রকেও সংশোধনের চেষ্টা করে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করে। সচ্চরিত্র ও উত্তম আদর্শ ব্যক্তির জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এ গুণে অলংকৃত ব্যক্তির জন্য রয়েছে জান্নাতের প্রথম শ্রেণীর বাড়ির শুভসংবাদ। যেহেতু এই ব্যক্তি এক মহৎ গুণের অধিকারী, আর তাহল সচ্চরিত্র ও উত্তম আদর্শ, যা ছিল মুহাম্মাদ সা.-এর বিশেষ গুণ। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী। (সূরা কলম : ৪) এই মহান চরিত্রই হলো সর্বোৎকৃষ্ট গুণ, যা মুসলমানদের জন্য জগদ্বাসীর কাছে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী ও পরকালে আল্লাহর নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম উপায়। রাসূল সা. বলেছেন- ما من شيء أثقل في ميزان المؤمن يوم القيامة من خلق حسن، وإن الله ليبغض الفاحش البذيء. কিয়ামতের দিন যেসব আমল ওজন করা হবে তার মাঝে সবচেয়ে বেশি ওজনী আমল হবে সচ্চরিত্র বা উত্তম আদর্শ। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তির উপর অসন্তুষ্ট যে অশালীন ও অসৎ চরিত্রবান। (তিরমিজি হাদিস নং- ১৯২৫) রাসূলুল্লাহ সা. অন্যত্র বলেন, আমি কি তোমাদেরকে বলব না, তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি কে? তাঁরা বললেন, অবশ্যই। তিনি সা. বলেন, তোমাদের মধ্যে তিনিই সর্বোত্তম, যিনি বয়সে বড় এবং স্বভাব-চরিত্রে ভালো। (আহমাদ, মিশকাত হাদিস নং- ৫১০০, সনদ সহিহ) রাসূলুল্লাহ সা. আরো বলেন, আমি কি তোমাদেরকে সংবাদ দিব না, যার উপর জাহান্নাম হারাম আর জাহান্নাম যার জন্য হারাম? তারা হচ্ছে এমন ব্যক্তি যার মেজায নরম, কোমল স্বভাব, মানুষের সাথে মিশুক এবং সহজ-সরল। (আহমাদ, তিরমিজি, মিশকাত হাদিস নং- ৫০৮৪, সনদ সহিহ) আবু হুরাইরা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা.-কে জিজ্ঞাসা করা হলো কোন জিনিস মানুষকে বেশি জান্নাতে প্রবেশ করাবে? তিনি বলেন, আল্লাহভীতি ও সচ্চরিত্র। আবারও জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন জিনিস বেশি জাহান্নামে নিয়ে যাবে? তিনি বলেন, মুখ ও লজ্জাস্থান।’ (তাহকিক তিরমিজি-২০০৪, সনদ হাসান)

হাদিসের শিক্ষা ১. কোনো অবস্থায় কারো সাথে কলহ-বিবাদে জড়ানো ঠিক নয়। ২. সর্বাবস্থায় মিথ্যা পরিহার করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা। ৩. নিজের চরিত্রকে সুন্দর করা। ৪. ওপরের এ তিনটি গুণ যদি কারও ভিতরে থাকে তা হলে জান্নাতে তার জন্য বাড়ি বরাদ্দ থাকবে। লেখক : প্রভাষক, সিটি মডেল কলেজ, ঢাকা

আপনার মন্তব্য লিখুন

md.Borhan udden

- 4 months ago

আলহামদুলিল্লাহ এতো সুন্দর একটা হাদিস উপস্থাপনার জন্য ধন্যবাদ

Ajwad Al Sami

- 3 months ago

আলহামদুলিল্লাহ এতো সুন্দর একটা হাদিস উপস্থাপনার জন্য ধন্যবাদ|

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির