এ.কে.এম. নাজির আহমদ| (গত সংখ্যার পর)
[caption id="attachment_2174" align="alignleft" width="258"] রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী[/caption]ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর এই সময় পরাশক্তি ছিলো তিনটি : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পাকিস্তানের শক্ত সমর্থক ছিলেন। চীনের জাঁদরেল প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া খানকে লেখা এক চিঠিতে পাকিস্তানের ‘জাতীয় স্বাধীনতা’ এবং ‘রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব’ রক্ষায় চীনের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কথা জানান।১ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পোদগর্নি প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়াকে লেখা চিঠিতে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ ও ‘পাকিস্তানের আপামর জনগণ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী এলেক্সি কোসিগিন চাচ্ছিলেন অখণ্ড পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠিতকরণ। “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সে (সোভিয়েত ইউনিয়ন) কখনই খোলাখুলি সমর্থন করেনি বা খোলাখুলিভাবে পাকিস্তানের বিরোধিতা করেনি।”২ তখন মুসলিম জাহানের শ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন সাউদী আরবের কিং ফায়সাল। তিনি বলিষ্ঠভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করতেন। তাঁকে অনুসরণ করতো মুসলিম জাহানের অন্য দেশগুলো। ভারত চাচ্ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার। ভারত বুঝতে পেরেছিলো, বাংলাদেশকে ত্বরিৎ স্বাধীন করতে হলে যুদ্ধ প্রয়োজন। কিন্তু দুনিয়ার সামগ্রিক পরিস্থিতির নিরিখে ভারত একাকী পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে নামা সমীচীন মনে করেনি। সেই জন্য ‘জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে’র প্রবক্তা হওয়া সত্বেও ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭১ সনের ৯ই অগাস্ট ‘ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঁদ্রে গ্রোমিকো এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ‘স্বাক্ষরিত মৈত্রী চুক্তির সমূহ গুরুত্ব ছিলো এর নবম ধারায়। এই ধারা অনুযায়ী চুক্তিবদ্ধ দুই দেশের কারো বিরুদ্ধে যদি বহিরাক্রমণের বিপদ দেখা দেয়, তবে এই বিপদ অপসারণের জন্য উভয় দেশ অবিলম্বে পারস্পরিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে এবং তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য যথোচিত ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।’৩ এই চুক্তির খবর শুনে হেনরী কিসিঞ্জার এটিকে ‘বারুদের স্তূপে একটি জ্বলন্ত শলাকা নিক্ষেপ’ বলে উল্লেখ করেন।
পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার গঠন ১৯৭১ সনের ১লা সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া খান কঠোর প্রকৃতির মানুষ লে. জেনারেল টিককা খানকে সরিয়ে মুসলিম লীগের ডা. আবদুল মুত্তালিব মালিককে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর এবং লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজীকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করেন। ৩রা সেপ্টেম্বর ডা. আবদুল মুত্তালিব মালিক গভর্ণর হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা চালাবার লক্ষ্যে তিনি একটি সিভিলিয়ান মন্ত্রীসভা গঠন করেন। জনাব আবুল কাসেম অর্থ দফতর, জনাব আব্বাস আলী খান শিক্ষা দফতর, জনাব আখতার উদ্দিন বাণিজ্য ও শিল্প দফতর, জনাব এ.এস.এম. সুলাইমান শ্রম, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা দফতর, মি. অং শৈ প্র“ বন, সমবায় ও মৎস্য দফতর, মাওলানা এ.কে.এম. ইউসুফ রাজস্ব দফতর, মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক স্থানীয় স্বায়ত্ব শাসিত সংস্থা বিষয়ক দফতর, জনাব নওয়াজিশ আহমদ খাদ্য ও কৃষি দফতর, জনাব মুহাম্মাদ উবাইদুল্লাহ মজুমদার স্বাস্থ্য দফতর এবং অধ্যাপক শামসুল হক সাহায্য ও পুনর্বাসন দফতরের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। নব নিযুক্ত গভর্ণর মুসলিম লীগ, নেযামে ইসলাম পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী এবং আওয়ামী লীগের পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। এই সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কন্যা বেগম আখতার সুলাইমান ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগের পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্কে মামা এডভোকেট আবদুস সালাম খান এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দীর্ঘকালের সহকর্মী এডভোকেট জহিরুদ্দিন।৪ এটি ছিলো পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের সাথে সংযুক্ত রাখার সর্বশেষ প্রয়াস। ১৯৭০ সনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত যেইসব সদস্য অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী ছিলেন তাঁরা হলেন : (১) আবু মুহাম্মাদ সুলাইমান মণ্ডল (রংপুর-৬), (২) আজিজুর রহমান (রংপুর-৭), (৩) মো. নুরুল হক (রংপুর-৮), (৪) মো. হাবিবুর রহমান (বগুড়া-৪), (৫) মো. জাহিদুর রহমান (বগুড়া-৫) (৬) সৈয়দ হোসেন মনসুর (পাবনা-৪), (৭) এম.এ. গফুর (খুলনা-৪), (৮) মো. আবদুল গাফফার (খুলনা-৭), (৯) মো. আবদুল বারেক (বাকেরগঞ্জ-৪), (১০) আজহার উদ্দিন আহমদ (বাকেরগঞ্জ-৭), (১১) এ.কে. ফয়জুল হক (বাকেরগঞ্জ-৮), (১২) গোলাম আহাদ চৌধুরী (পটুয়াখালি-২), (১৩) এ.বি.এম. নূরুল ইসলাম (ফরিদপুর-১), (১৪) আদেল উদ্দিন আহমদ (ফরিদপুর-৭), (১৫) আমজাদ হোসেন খান (ফরিদপুর-৮), (১৬) মো. নুরুল ইসলাম (ঢাকা-১), (১৭) জহিরুদ্দিন (ঢাকা-৭), (১৮) ওবায়দুল্লাহ মজুমদার (নোয়াখালি-১) এবং (১৯) অধ্যাপক শামসুল হক (চট্টগ্রাম)। তদুপরি আওয়ামী লীগ থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে যাঁরা অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী ছিলেন তাঁরা হলেন : (১) তাহেরুল ইসলাম খান (বগুড়া-৬), (২) রিয়াজ উদ্দিন আহমদ (রাজশাহী-১০), (৩) আবদুস সালাম (রাজশাহী-১৭), (৪) এ.বি.এম. আবু হেনা (পাবনা-৫), (৫) এ.কে.এম. মাহবুবুল ইসলাম (পাবনা-৬), (৬) জাহিরুল হক (কুষ্টিয়া-১), (৭) মো. মোশাররফ হোসেন (যশোর-৯), (৮) হাবিবুর রহমান খান (খুলনা-৬), (৯) মোহাম্মাদ সায়ীদ (খুলনা-১০), (১০) মজিবুর রহমান তালুকদার (পটুয়াখালি-৪), (১১) মোশাররফ হোসেন শাহ জাহান (বাকেরগঞ্জ-১), (১২) আক্তারুজ্জামান (ময়মনসিংহ-৫), (১৩) সৈয়দ বদরুজ্জামান (ময়মনসিংহ-৩২), (১৪) মো. নুরুল ইসলাম (বাকেরগঞ্জ-১৭), (১৫) আবদুল হাকিম মাষ্টার (ঢাকা-১৭), (১৬) সাজেদ আলী মিয়া (ঢাকা-২৮), (১৭) কাজী হেদায়েত হোসেন (ফরিদপুর-১), (১৮) কাজী সিরাজ উদ্দিন আহমদ (সিলেট-৭), (১৯) মাসুদ আহমদ চৌধুরী (সিলেট-১১), (২০) ডা. আবুল হাশেম (সিলেট-১৯), (২১) গোলাম মহিউদ্দিন আহমদ (কুমিল্লা-৭), (২২) মোহাম্মদ হাশেম (কুমিল্লা-১০), (২৩) এড. সাখাওয়াতুল্লাহ (নোয়াখালি-৭), (২৪) শামসুল হক (চট্টগ্রাম-২), (২৫) মির্যা আবু মনসুর (চট্টগ্রাম-৪), (২৬) আক্তারুজ্জামান চোধুরী বাবু (চট্টগ্রাম-১২), (২৭) সিরাজুল ইসলাম (রংপুর), (২৮) এম.এ. হান্নান (ময়মনসিংহ), (২৯) শরীফ উদ্দিন (ময়মনসিংহ), (৩০) আবদুল জলিল মিয়া (ময়মনসিংহ), (৩১) জাফর আলম চৌধুরী (চট্টগ্রাম), (৩২) মঈনুদ্দিন মিয়াজী (যশোর), (৩৩) সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (চট্টগ্রাম), (৩৪) ইনসান আলী মোক্তার (পিই-১৩৪), (৩৫) আবদুল মতিন ভূঁইয়া (পিই-১৫০), (৩৬) আফজাল হোসেন (পিই-১৯৯) এবং (৩৭) অং শৈ প্র“ চৌধুরী (পিই-৩০০)।
ভারতের সাথে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর ১৯৭১ সনের অকটোবর। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সাথে একটি সমঝোতা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ‘প্রশাসনিক বিষয়ে স্থির হয় যে যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করছে, তারাই কেবল প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকতে পারবে। অন্যদেরকে চাকুরিচ্যুত করা হবে। শূন্য জায়গা পূরণ করবে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ। সামরিক বিষয়ে সমঝোতা হয় যে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য অবস্থান করবে। বাংলাদেশের নিজস্ব কোন সেনাবাহিনী থাকবে না। অভ্যন্তরীণ আইন শৃংখলা রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনীকেন্দ্রিক একটি প্যারামিলিটারী বাহিনী গঠন করা হবে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে ভারতের সেনাপ্রধান যুদ্ধে অধিনায়কত্ব করবেন, মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নন। যুদ্ধকালে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে থাকবে। বিদেশ বিষয়ে ভারত যা বলবে তা মেনে নিতে হবে। সীমান্তের তিন মাইল জুড়ে খোলাবাজার চালু হবে। বছর শেষে হিসেব নিকেশ হবে। পাউন্ড স্টার্লিং দিয়েই প্রাপ্য পরিশোধ করা হবে।’৫ এটি ছিলো প্রকৃত পক্ষে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। সমঝোতা চুক্তির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে স্বাক্ষর দানের সাথে সাথেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।৬ “১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদনের পর অকটোবরে ভারতের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার একটি সাত দফা মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করেছিল। একাত্তরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার যে ৭ দফা মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করেছিল, তা ছিলো নিম্নরূপ ঃ ১. যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে শুধু তারাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োজিত থাকতে পারবে। বাকীদের চাকুরীচ্যুত করা হবে এবং সেই শূন্যপদ পূরণ করবে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। ২. বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করবে। (কতদিন অবস্থান করবে তার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় না।) ১৯৭২ সালের নবেম্বর মাস থেকে আরম্ভ করে প্রতি বছর এ সম্পর্কে পুনরীক্ষণের জন্য দু’দেশের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ৩. বাংলাদেশের কোন নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকবে না। ৪.অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনীকে কেন্দ্র করে একটি প্যারামিলিটারী বাহিনী গঠন করা হবে। ৫. সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অধিনায়কত্ব দেবেন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নন এবং যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়কত্বে থাকবে। ৬. দু’দেশের বাণিজ্য হবে খোলাবাজার (ওপেন মার্কেট) ভিত্তিক। তবে বাণিজ্যের পরিমাণ হিসাব হবে বছরওয়ারী এবং যার পাওনা, সেটা স্টার্লিং-এ পরিশোধ করা হবে। ৭. বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রশ্নে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে এবং ভারত যতদূর পারে এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহায়তা দেবে। ১৯৭১ সালের অকটোবর মাসে ভারতরে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পাদিত উক্ত সাত দফা গোপন চুক্তির তথ্য সাংবাদিক মাসুদুল হককে ব্যক্তিগত সাক্ষাতকারের সময় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দিল্লী মিশন প্রধান জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী প্রদান করেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সাত দফা গোপন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দানের পরপরই তিনি মুর্ছা যান।”৭
পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী ব্যক্তিদের ভারতভীতির কারণ (ক) কংগ্রেস কর্তৃক পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতার স্মৃতি দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলো। এই দলের দাবি ছিলো ভারতীয়রা সকলে মিলে একটি জাতি। আর এই জাতির প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন হচ্ছে দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস। অতএব বৃটিশ সরকার দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশ ছেড়ে যাবার সময় এই দলটির হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে যেতে হবে। এই দাবির বিপরীতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ দাবি করলো যে উপমহাদেশে বসবাসকারী মুসলিমগণ একটি স্বতন্ত্র জাতি। অতএব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। কংগ্রেসের ‘এক জাতি তত্বে’র বিপরীতে মুসলিম লীগের ‘দ্বি-জাতি তত্ব’ (two nation theory) সমর্থন করে গোটা উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস কোমর বেঁধে পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করতে থাকে। মি. গানধি তো বলেই ফেললেন, “ভারতের অঙ্গচ্ছেদ করার আগে আমার অঙ্গচ্ছেদ কর।” “যখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ভারত ত্যাগ করতে ব্রিটিশ মনস্থির করে ফেলেছে, তখন কংগ্রেসই যে তার একমাত্র যথার্থ ও একক উত্তরাধিকারী, এই দাবির বিরুদ্ধে সব মহল থেকেই চ্যালেঞ্জ করা হয়। ১৯৪৫-৪৬ সনের সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস সাধারণ হিন্দু নির্বাচনী এলাকায় খুবই ভালো করে, কিন্তু ভারতীয় মুসলিমদের প্রতিনিধিত্বের দাবি প্রমাণে সে ব্যর্থ হয়। কেন্দ্রীয় আইন সভার নির্বাচনে মুসলিম লীগ মোট মুসলমান ভোটের মধ্যে শতকরা ৮৬.৭ ভাগ ভোট পায়; অথচ এর বিপরীতে কংগ্রেস পায় শতকরা ১.৩ ভাগ। প্রদেশগুলোতে সব মুসলিম ভোটের মধ্যে মুসলিম লীগ ভোট পায় শতকরা ৭৪.৭ ভাগ, আর কংগ্রেস পায় শতকরা ৪.৬৭ ভাগ।”৮ উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় আইন সভার নির্বাচন ১৯৪৫ সনে এবং প্রাদেশিক আইন সভাগুলোর নির্বাচন ১৯৪৬ সনে অনুষ্ঠিত হয়। দেশ ভাগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে দেখে হিন্দুদের উগ্র অংশটি মারমুখো হয়ে ওঠে। তারা ভাবলো, ‘ভারত মাতা’কে ভাগ করার আন্দোলন ঠেকাতে হলে মুসলিমদেরকে নির্মূল করতে হবে। এই চিন্তারই ফসল ১৯৪৬ সনের দিল্লী রায়ট। এর পর ১৯৪৬ সনের ১৬ই অগাস্ট রায়ট শুরু হয় বাংলা প্রদেশের রাজধানী কলকাতায়। কলকাতা রায়টে কমপক্ষে পাঁচ হাজার লোক নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা ছিলো বেশি। ক্রমশ হিন্দু-মুসলিম রায়ট সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৭ সনের ১৮ই জুলাই বৃটেনের হাউস অব কমন্স-এ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি উত্থাপিত ঞযব The Indian Independence Act 1947 পাস হয়। কংগ্রেস যখন দেখলো দেশ ভাগ ঠেকানো যাচ্ছে না, তখন দলটি দাবি করলো পাঞ্জাব প্রদেশ এবং বাংলা প্রদেশকে মুসলিম ও অমুসলিমদের ঘনত্বের নিরিখে দুই ভাগে বিভক্ত করতে হবে। শত চেষ্টা করেও মুসলিম লীগ পাঞ্জাব প্রদেশ ও বাংলা প্রদেশের বিভক্তি ঠেকাতে পারলো না। বৃটিশ সরকারকে পাঞ্জাব প্রদেশ এবং বাংলা প্রদেশ ভাগ করতে সম্মত করাতে পেরে কংগ্রেস অনিচ্ছাসত্বেই দেশ ভাগ মেনে নেয়। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ভেবেছিলেন, খণ্ডিত পাঞ্জাব ও খণ্ডিত বাংলা নিয়ে পাকিস্তান হবে একটি দুর্বল রাষ্ট্র। ফলে এই রাষ্ট্র বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না। সেই সময় সরদার বল্লভভাই প্যাটেল বলেছিলেন, ‘আমি জানিনা পাকিস্তানে তাঁরা কী করতে পারবেন, তাঁদের ফিরে আসতে খুব বেশিদিন লাগবে না।”৯ জওহর লাল নেহরু তাঁর ভাইপো বি.কে. নেহরুকে বলেন, ‘দেখা যাক কতদিন ওরা আলাদা থাকে।’১০
(খ) ভারত কর্তৃক জম্মু-কাশমির দখল করে নেওয়ার স্মৃতি দূর অতীত থেকে শুরু করে আঠারো শতক পর্যন্ত কাশমির মুসলিমদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। ১৮১৯ সনে পাঞ্জাবের শিখ রাজা রণজিৎ সিং দুররানী বংশের হাত থেকে কাশমির কেড়ে নেন। গুলাব সিং নামক একজন প্রশাসকের সার্ভিসে সন্তুষ্ট হয়ে রণজিৎ সিং ১৮২০ সনে তাঁকে জম্মুর রাজা বানান। ১৮৪৫ -১৮৪৬ সনে ইংরেজদের সাথে শিখদের যুদ্ধ হয়। এই সময় জম্মুর রাজা নিরপেক্ষ থাকেন। যুদ্ধের পর ইংরেজগণ ৭৫ লাখ রুপির বিনিময়ে জম্মুর রাজা গুলাব সিং-এর হাতে কাশমির তুলে দেন। গুলাব সিং-এর পর যথাক্রমে রণবীর সিং, প্রতাপ সিং এবং হরি সিং জম্মু-কাশমিরের মহারাজা হন। বৃটিশ শাসনকালে জম্মু-কাশমির একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় রাজ্য হিসেবে অবস্থান করে। ১৯৪৭ সনে বৃটিশগণ উপমহাদেশ ছেড়ে যাবার সময় দেশীয় রাজ্যগুলোর সামনে তিনটি অপশন রেখে যায়। যথা- (১) রাজ্য ইচ্ছা করলে ভারতে যোগ দিতে পারবে। (২) রাজ্য ইচ্ছা করলে পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবে। (৩) রাজ্য ইচ্ছা করলে স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রেখে স্বতন্ত্র থাকতে পারবে। জম্মু-কাশমিরের জনগণের শতকরা ৭৭ জন ছিলেন মুসলিম। তাঁরা পাকিস্তানে যোগ দিতে আগ্রহী ছিলেন। মহারাজা হরি সিং চাচ্ছিলেন স্বাধীনভাবে অবস্থান করতে। কিন্তু জম্মু-কাশমির ছিলো দি ইনডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নিকট অতি লোভনীয় একটি স্থান। তদুপরি ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ছিলেন কাশমিরের একটি ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। তিনি চাচ্ছিলেন জম্মু-কাশমির ভারতের অন্তর্ভুক্ত হোক। নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয় মহারাজার ওপর। এই চাপ তিনি প্রতিরোধ করতে পারেননি। ১৯৪৭ সনের ২৭শে অকটোবর মহারাজা হরি সিং Instrument of Accession to India নামক দলিলে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। অতি দ্রুততার সাথে অগ্রসর হয়ে ভারতীয় সৈন্যরা গোটা জম্মু-কাশমির ছেয়ে ফেলে। এইভাবে কেড়ে নেওয়া হয় জম্মু-কাশমিরের স্বাধীনতা। (গ) ভারত কর্তৃক হায়দারাবাদ দখল করে নেওয়ার স্মৃতি হায়দারাবাদ ছিলো বৃটিশ শাসিত দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে সবচে’ বড়ো দেশীয় রাজ্য। আয়তনে এটি ছিলো বৃটেনের চেয়েও বড়ো। The Indian Independece Act 1947-এ প্রদত্ত অপশন অনুযায়ী হায়দারাবাদের ঐতিহ্যবাহী বংশের নিযাম হায়দারাবাদকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভারত সরকারের ইচ্ছা ছিলো ভিন্ন। ১৯৪৮ সনের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত হায়দারাবাদ আক্রমণ করে। ১৩ই সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী পাঁচটি রুটে হায়দারাবাদের দিকে অগ্রসর হয়। নিযামের কোন শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছিলো না। তাঁর অনুগত ব্যক্তিরা প্রধানমন্ত্রী কাসেম রিজভীর নেতৃত্বে রেযাকার বাহিনী গঠন করে ভারতের আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে। কিন্তু সুসজ্জিত বিশাল ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে তারা এঁেট উঠলো না। ভারতীয় সৈন্যরা প্রাসাদে ঢুকে নিযামকে ঘিরে ফেলে। ১৮ই সেপ্টেম্বর তিনি The Instrument of Accession to India স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এইভাবে ভারত হায়দারাবাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া খানের সাথে অধ্যাপক গোলাম আযমের সাক্ষাত ১৯৭১ সনের ২২শে নবেম্বর অধ্যাপক গোলাম আযম জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য লাহোর পৌঁছেন। কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের অধিবেশনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে বিরাজমান পরিস্থিতির একটি বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করেন। রিপোর্টের একাংশে তিনি বলেন, “সেনাবাহিনীর আচরণে জনগণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করছে। যারা পূর্বে বিরোধিতা করতো তারাও আর বাধা দেয় না। সীমান্ত এলাকায় রেযাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের মুকাবিলায় এগিয়ে আসে না। কারণ তারা আর জনসমর্থন পায় না। “সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ভারতের সেনাবাহিনী সরাসরি পেছন থেকে সাহায্য করছে। এটা জানা গেছে যে ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শীতের মওসুমেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করার কাজ সমাধা করতে হবে এবং প্রয়োজনে সেনাবাহিনী সরাসরি যুদ্ধ করবে।” অধ্যাপক গোলাম আযমের রিপোর্ট শুনে সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী তাঁকে রাওয়ালপিন্ডি গিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া খানের সাথে সাক্ষাত করার পরামর্শ দেন। কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের অধিবেশন শেষ হওয়ার পর অধ্যাপক গোলাম আযম রাওয়ালপিন্ডি পৌঁছেন এবং অনেক চেষ্টার পর প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পান। সেনাবাহিনীর সদস্যদের অন্যায় আচরণের কথা তিনি প্রেসিডেন্টকে অবহিত করেন এবং তাঁকে পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে সব কিছু প্রত্যক্ষ করার অনুরোধ জানান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া খান অধ্যাপক গোলাম আযমকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান সংকটের সমাধানের একটা ফর্মুলা নিয়ে কথাবার্তা চলছে। এই মুহূর্তে এই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দেওয়া সম্ভব নয়। একটা মিমাংসা হয়ে যাবে বলে আশা করি।’১১
মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি মুক্তি যুদ্ধের প্রথম দিকে ভারত তেমন কোন সাহায্য করেনি। ইস্ট বেংগল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ এবং তাদের হাতে তৈরি নতুন মুক্তিযোদ্ধারা তাদের হাতে যা ছিলো তা নিয়েই লড়াই করে। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শহরে বন্দরে তাদের অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছিলো সুকঠিন। ৩০শে এপ্রিল ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার দায়িত্ব ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর ওপর অর্পণ করে। ৯ই মে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ট্রেনিং দেওয়ার দায়িত্ব তাদের হাতে দেওয়া হয়। এতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও প্রত্যাশিত সাহায্য পাওয়া গেলো না। ভারত তখনো বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। একটি রাজনৈতিক সমাধান হয়ে যায় কিনা এবং পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ লেগে গেলে ভারত একা পড়ে যায় কিনা ইত্যাদি চিন্তা ভারত সরকারকে দ্বিধান্বিত করছিলো। এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৭১ সনের ৯ই অগাস্ট ‘ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। এতে ভারতের একা হয়ে পড়ার ভয় উবে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা জোরদার করে। বিভিন্ন স্থানে মুতায়েন পাকিস্তানী সৈন্যদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিটগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত হামলায় দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। ইতোমধ্যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ একটি প্রতিবেদনে বলে, “এ সময়ক্ষেপন কৌশল শুধুমাত্র মুক্তিবাহিনীকে আরো সুসংঘটিত হতে অধিক সময় প্রদান করে। ‘র’ এর বিশ্লেষণ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে যে, মুক্তিবাহিনীর দিনদিন শক্তিবৃদ্ধি সত্ত্বেও পাকিস্তান বাহিনীকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। সুতরাং ‘সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণই’ হচ্ছে একমাত্র সমাধান।”১২ অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা বাংলাদেশ স্বাধীন করা সময়সাপেক্ষ বিধায় ভারতীয় সেনাবাহিনীই এই কাজটি অবিলম্বে সম্পন্ন করে ফেলা প্রয়োজন। ১৯৭১ সনের ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া খান ভারত আক্রমণ করে ভারতকে এই কাংখিত সুযোগ এনে দেন। ১৯৭১ সনের ৬ই ডিসেম্বর ভারত সরকার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। অতপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীনে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে “ভারত-বাংলাদেশ মিত্র বাহিনী” গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। উল্লেখ্য “ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তি” স্বাক্ষরিত হওয়ার এক সপ্তাহ পরেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণা করে যে পাকিস্তানের প্রতি তার আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ক্রেমলিন নেতৃবৃন্দ তাঁদের পলিসিতে পরিবর্তন আনেন। এবার তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে যুদ্ধে ভারতের বিজয় নিশ্চিত করার মাধ্যমেই তাঁদের লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারগণ এটি মোটেই পছন্দ করেননি। মুক্তিযুদ্ধের ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করার পর বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের চাষের ফসল নিজের গোলায় তোলার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্রুত ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়।
লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর আত্মসমর্পণ ১৯৭১ সনের ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়। ৬ই ডিসেম্বর ভারতের বিমান বাহিনী ঢাকা বিমান বন্দরে বোমা ফেলে এটি অকেজো করে ফেলে। ১৪ই ডিসেম্বর গভর্ণর ডা. আবদুল মুত্তালিব মালিক গভর্ণর হাউসে মন্ত্রীসভার মিটিং ডাকেন। খবর পেয়ে যায় ভারতীয় সামরিক বাহিনী। ভারতীয় বিমান বাহিনীর এক ঝাঁক হান্টার বিমান গভর্ণর হাউসের ওপর বোমা হামলা চালায়। গভর্ণর ডা. এ. এম. মালিক দৌড়িয়ে নেমে যান ভূ-গর্ভস্থ বাংকারে। সেখানে তিনি ছালাত আদায় করেন। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে তিনি তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যগণ সমেত পদত্যাগ করে আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটি ঘোষিত নিরপেক্ষ এলাকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরে তাঁরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত হন। বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাংগনে পাকিস্তানী সেনাগণ মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সেকটার কমান্ডারদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাগণ এগিয়ে আসছিলেন ঢাকার দিকে। এইদিকে লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেক শ-র কাছ থেকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ পেতে থাকেন। লে. জেনারেল নিয়াজী এবং ফিল্ড মার্শাল মানেক শ-র মাঝে কী কী বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে তার কিছুই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার জানতো না, জানতেন না মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মাদ আতাউল গনী ওসমানীও।১৩ ১৬ই ডিসেম্বর বিকেল দুইটার দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জ্যাকব তাঁর কয়েকজন উচ্চ পদস্থ সহকর্মীকে নিয়ে তিনটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে ঢাকা আসেন। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ৮/১০টি সামরিক হেলিকপ্টারে করে লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা তাঁর সহকর্মীগণকে নিয়ে ঢাকা পৌঁছেন। তাঁর সাথে এসেছিলেন গ্র“প ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার। বিকেল চারটা ঊনিশ মিনিটে রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সম্মুখে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। হাজার হাজার মানুষ এবং শতাধিক দেশী-বিদেশী সাংবাদিক এই অনুষ্ঠান অবলোকন করেন। বিস্ময়ের ব্যাপার, এতো বড়ো ঘটনায় ভারত সরকার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কোন মন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মাদ আতাউল গনী ওসমানীকে হাজির রাখার কোন প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেনি। এতে অবশ্যই বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরব ম্লান হয়েছে। সেই দিনই বাংলাদেশের বহুসংখ্যক মানুষের মনে নানা প্রশ্ন সৃষ্টি হয়। (চলবে) তথ্যসূত্র : ১. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাশক্তির ভূমিকা, পৃষ্ঠা-২৭ ২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৪৫। ৩. মঈদুল হাসান, মূলধারা ’৭১, পৃষ্ঠা-৬৮। ৪. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-১০৪। ৫. মতিউর রহমান চৌধুরী, শেখ মুজিব চুক্তিটি অগ্রাহ্য করলেন, সাপ্তাহিক কাগজ, জানুয়ারি, ১৯৯০। ৬. প্রাগুক্ত। ৭. মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ নূরুল কাদির, দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা, পৃষ্ঠা-৩২৫। ৮. জয়া চ্যাটার্জি, বেঙল ডিভাইডেড : হিন্দু কমিউনালিজম এন্ড পার্টিশান, বাংলা অনুবাদ : আবু জাফর, বাঙলা ভাগ হল, পৃষ্ঠা-২৬২। ৯. ঔধংধিহঃ ঝরহময, ঔরহহধয : ওহফরধ-চধৎঃরঃরড়হ-ওহফবঢ়বহফবহপব, বাংলা অনুবাদ : শামছুল ইসলাম হায়দার, জিন্নাহ : ভারত-দেশভাগ-স্বাধীনতা, পৃষ্ঠা-৪০৬। ১০. প্রাগুক্ত। ১১. অধ্যাপক গোলাম আযম, জীবনে যা দেখলাম, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২০৭। ১২. অশোকা রায়না, ইনসাইড‘র’, অনুবাদ - লেঃ (অব) আবু রূশ্দ, পৃষ্ঠা-৭০। ১৩. আবুল আসাদ, কালো পঁচিশের আগে ও পরে, পৃষ্ঠা-১৭৭। লেখক : নায়েবে আমীর বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী
আপনার মন্তব্য লিখুন