মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত
মানুষ জীবন বদলাতে কত প্রচেষ্টাই না করে। জীবনকে সাফল্যের কাক্সিক্ষত মঞ্জিলে পৌঁছানোর লক্ষ্যে চলে মানুষের অবিরাম সংগ্রাম। কিন্তু সংগ্রাম অবিরাম চললেও কাক্সিক্ষত সাফল্য মানুষ পায় না। এই কাক্সিক্ষত সাফল্যে পৌঁছতে না পারার কারণ বিশ্লেষণ করলে যে কয়টি মূল বিষয় সামনে উঠে আসে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। একটি সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে দিতে পারে মানুষের জীবন। যারা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অবিরত প্রচেষ্টা চালিয়েও কাক্সিক্ষত সাফল্যে পৌঁছাতে পারেন না তারা যদি সত্যিকারার্থে কাজের শুরুতেই সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ শুরু করতে পারেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সাফল্য তাদের পদতলে আশ্রয় নেবে। ইংরেজি ভাষায় দৃষ্টিভঙ্গি শব্দ একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে। ইংরেজিতে একে বলে ‘অঃঃরঃঁফব’, ব্যক্তিজীবনে সফলতার নিশ্চয়তা এই অঃঃরঃঁফব। আর সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ হলো কাজের উপযোগী, কর্মস্থলের উপযোগী, জীবিকার উপযোগী চড়ংরঃরাব দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা। যিনি একজন ছাত্র তার অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ারে দৃষ্টিভঙ্গি যদি ছাত্রসুলভ না হয় তাহলে তার ক্যারিয়ার কখনো সমৃদ্ধ হতে পারে না। একজন ছাত্রের সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ হবে পড়া পড়া আর পড়া। পড়াশোনা করে হতাশা কাটিয়ে ব্যর্থতা ছাড়িয়ে জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করে কাক্সিক্ষত সাফল্য ছোঁয়া। তেমনিভাবে একজন শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি হবে উত্তম পাঠদানে সুশিক্ষিত জাতি গড়ে তোলা। সে ক্ষেত্রে শিক্ষাদানের পরিবেশ যদি ছাত্রদের প্রতি শিক্ষাসুলভ, ¯েœহসুলভ এবং প্রয়োজনে শাসনমূলক না হয়, তাহলে তিনি প্রকৃত পাঠদানে ব্যর্থ হবেন। ছাত্ররা বঞ্চিত হবে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ থেকে। উন্নত জাতি গঠনের কর্মসূচি চরমভাবে ব্যর্থ হবে। ঠিক এমনিভাবেই কোনো প্রশাসক ভালো প্রশাসক হতে পারেন না যতক্ষণ না তার দৃষ্টিভঙ্গি সুসম্পন্ন না হয়। মায়ের দৃষ্টিভঙ্গি যদি মাতৃসুলভ, বাবার দৃষ্টিভঙ্গি যদি পিতৃসুলভ না হয় তাহলে বাবা-মা কাক্সিক্ষত ইচ্ছা অনুযায়ী সন্তান গড়ে তুলতে পারেন না। মালিক যদি কর্মচারীদের প্রতি উপযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ না করেন আর কর্মচারীরাও যদি কাজের ক্ষেত্রে সুদৃষ্টি না দেন তাহলে শ্রমিক-মালিকের মাঝে বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়। আর সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিই সার্বিক উৎপাদন, উপার্জন এবং সাফল্য ধ্বংস করে দিতে বাধ্য। সাংগঠনিক জীবনে একজন সংগঠকের সুসম্পন্ন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ওপরই সংগঠনের কাক্সিক্ষত সফলতা নির্ভর করে। সমান যোগ্যতা, আন্তরিকতা এবং পরিশ্রম ঢেলে দেয়ার পরও দু’জন দু’রকম সাফল্য পান। এর কারণ হলো কাজের শুরুতে একজন সুসম্পন্ন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন, আর আরেকজন দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি আমলেই নিতে চান না। ব্যক্তিজীবনে প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজ নিজ ক্ষেত্রে উপযোগী দৃষ্টিভঙ্গি লালন না করলে কাক্সিক্ষত সাফল্যে পৌঁছাতে পারেন না। কারণ সাফল্যের মূল ভিত্তি হচ্ছে সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। বিশ্ববিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শতকরা ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তি সফলতা পায় তার সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি জন্মলব্ধ কোনো বিষয় নয়, এটি মনোভাবের পরিবর্তনের মাধ্যমে ধারণ করে লালনের বিষয়। কেউ কেউ ভাবতে পারেন অমুক বিরাট পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে তার দৃষ্টিভঙ্গি তো সুসম্পন্ন হবেই এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং মানুষ যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সমন মনোভাবের (ফিতরাতের) ওপরই জন্মগ্রহণ করে। সবাই হাত, পা, কান ও মাথা নিয়ে মানুষ হিসেবেই জন্মগ্রহণ করে। রাসূল সা. এ প্রসঙ্গে বলেন, সকল মানুষ একই ফিতরাত বা স্বভাবের ওপরই জন্মগ্রহণ করে, এর পর তার পিতা-মাতা এবং তার পরিবেশ তাকে সে অনুযায়ী পরিচালিত করে। আবার বাহ্যিকভাবে মনে হতে পারে মানুষ মানেই শুধুমাত্র দুটো হাত, দুটো পা কিংবা একটি শরীর গঠনের নাম। বরং হাত পাসহ সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, মেধা-মনন মিলিয়েই একজন সম্পূর্ণ মানুষ। এই সব কিছুর সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গিই একটি সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। সত্যিকারার্থেই কোনো মানুষ সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জন্মায় না বরং তার দেহ, মন চিন্তা চেতনার সম্মিলিত ইতিবাচক যোগফলই সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। আমাদের মনে রাখতে হবে পরিবেশ, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা এবং নিজ প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতেই একটি সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠতে পারে। উপরিউক্ত চারটি বিষয়ের প্রভাবে অনেক সময় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়ে সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে রূপান্তিরত হয়। বদলে যায় ব্যক্তির পুরো জীবন। পরিবেশ ব্যক্তির সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যিনি সুন্দর পরিবেশে বেড়ে ওঠেন তার দৃষ্টিভঙ্গি হয় সুসম্পন্ন আর যার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নেতিবাচক হয় তার দৃষ্টিভঙ্গি সুসম্পন্ন হয় না। এটি সাধারণ নিয়ম হলেও সমাজে ব্যতিক্রমও রয়েছে। যারা ¯্রােতের বিপরীতে চলতে জানেন, যাদের মাঝে অদম্য ইচ্ছা এবং সাহস থাকে তারা নেতিবাচক পরিবেশের মাঝে নিজের সার্বিক প্রচেষ্টায় সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে পুরো জীবনটাকেই বদলে দিতে পারেন। একটি সুন্দর পরিবেশে একজন মানুষ যখন বেড়ে ওঠে তখন তার দৃষ্টিভঙ্গি সুসম্পন্ন হওয়াই বাঞ্ছনীয়। পরিবারের সুন্দর পরিবেশ সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সহায়ক। সহপাঠীদের সুন্দর আচরণ একজন ছাত্রকে সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। কর্মক্ষেত্রে মালিক-শ্রমিকের সুসম্পর্কের পাশাপাশি সহযোগীদের সাথে সুসম্পর্ক এবং কর্মক্ষেত্রের সুন্দর পরিবেশ সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠতে সহায়তা করে। পরিবেশ যে কতখানি সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সহায়তা করে তার প্রমাণ আপনাদের আমাদের আশপাশে অহরহই রয়েছে। পাশাপাশি দু’টি খাবার হোটেলের ক্ষেত্রে দেখা যাবে একটি হোটেলের মালিক কর্মচারী এবং এর কাস্টমারদের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি অভদ্রজনিত। ঠিক পাশেই আরেকটি হোটেলে দেখা যাবে সেখানকার মালিক কর্মচারী যেমন রুচিশীল ও ভদ্র তাদের কাস্টমাররাও রুচিশীল এবং ভদ্র ধরনের। এটি শুধুমাত্র তাদের সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই হয়েছে আর এই সৌন্দর্য তৈরিতে পরিবেশই তাদের সহায়তা করেছে। একই দেশের দু’টি রাজনৈতিক দলের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে একটি তার প্রতিপক্ষকে নোংরা, হিংসাত্মক এবং নীচু ভাষায় বক্তব্য দিয়ে গায়েল করার চেষ্ট করে। এই নোংরা চর্চা দলের নিম্নস্তর থেকে শুরু করে মধ্যস্তরকে পেরিয়ে অনেক সময় দলের প্রধানেরও ভাষা হয়ে যায়! আর আরেকটি দলকে দেখা যায় একই বিষয়ে প্রতিপক্ষেকে রুচিশীল কিন্তু তির্যক ভাষায় বক্তব্য দিয়ে মোকাবেলা করতে। এটি সম্ভব হয় দলের প্রধান থেকে শুরু করে সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মাঝে সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লালনের কারণে। সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য শুধু মাত্র পরিবেশই যে সহায়ক তা কিন্তু নয় বরং এর সাথে শিক্ষার বিষয়টিও গভীরভাবে জড়িত। সুশিক্ষিত একটি পরিবারে সন্তানদের সাথে অশিক্ষিত পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গির তুলনা করলে দেখা যায় স্বল্প শিক্ষিতরা যতই সম্পদশালী হোক না কেন তারা উচ্চশিক্ষিত পরিবারের সন্তানদের চেয়ে সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে ওঠেন না। তাদের মাঝে আচরণের পার্থক্য অনেক। তবে শিক্ষিতদের মাঝেও কিছু অথর্ব বা জ্ঞানপাপী থাকেন যারা শিক্ষার পুঁজিকে ঢাল বানিয়ে বড়াই করেন। তখন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্বল্প শিক্ষিতের নীচুতাকেও হার মানায়। সত্যিকারার্থে তারা জীবনকে বদলাতে পারেন না। ব্যক্তি যখন পরিবেশ, শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা পুঁজি করে সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন তখন তার প্রয়োজন হয় আত্মপ্রচেষ্টা। কারণ যতই পরিবেশ সুন্দর হোক না কেন, যতই ব্যক্তির জ্ঞান-গরিমা থাকুক না কেন, অভিজ্ঞতার ঝুলি যত বেশিই থাকুক না কেন, ব্যক্তি যদি নিজকে পরিবর্তন করার মতো দৃষ্টিভঙ্গি লালন না করেন তাহলে এর মধ্যে কল্যাণ নিহিত নেই। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি হতে পাওে না। এ ধরনের প্রচেষ্টা জীবনকে বদলাতে পাওে না। জীবনকে বদলাতে প্রয়োজন আত্মপ্রচেষ্টামূলক দৃষ্টিভঙ্গি যা নিজেকে দিয়েই শুরু করতে হয়। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সূরা রায়াদের ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “আল্লাহ কোন জাতির ভাগ্যের (অবস্থার) পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ পর্যন্ত জাতির লোকেরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা না করে।” বদলে যাও বদলে দাও এটি নতুন কোনো শ্লোগান নয়। বরং সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অভাবেই এটা ধামাচাপা পড়েছিল। যারা মনে করেন ইসলাম সেকেলে ধর্ম, ইসলামে কোন আধুনিকতা নেই এটি তাদেরই কারসাজি। অথচ ইসলাম যে কত আধুনিক তার প্রমাণ হচ্ছে বদলে যাওয়ার জন্য আগে নিজেকে দিয়ে বদলানোর অভিযান শুরু করার তাগিদ ইসলাম ১৪ শ’ বছর আগেই নবী মুহাম্মদ সা.-এর ওপর নাজিলকৃত মহাসত্য গ্রন্থ আল কুরআনের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সুতরাং এই মহা সত্যকে ধারণ করে সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে পারলেই জীবনটাকে বদলে দেয়া সম্ভব। একজন মহা মনীষী বলেছেন, সুসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের জীবনে পবিত্র অনুভূতি সৃষ্টি করে আর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পূর্ণতার সুযোগকে নষ্ট করে দেয়। আমাদের প্রতিটি অনুভূতিই হোক পূর্ণতার, দৃষ্টিভঙ্গি হোক ইতিবাচক আর সুসম্পন্ন। বদলে যাক জীবন, পূরণ হোক লালিত স্বপ্নের। লেখক : কেন্দ্রীয় সাহিত্য সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির
আপনার মন্তব্য লিখুন