post

জেলখানায় আবদুল কাদের মোল্লা ভাইকে যেমন দেখে এসেছিলাম

০৩ মার্চ ২০১৪

মুহাম্মদ সাজ্জাদ হুসাইন

Kader-Mollaদীর্ঘ ১০ মাস জেল খাটার পর ১২টি মামলার সর্বশেষটি জামিন হয় হাইকোর্ট থেকে। আর ক’দিন বাদেই কোরবানির ঈদ। জেলখানায় কোরবানির ঈদ পালনের সরকারি উদ্যোগ চলছে জোরেশোরে। কয়েদি-হাজতিদের জন্য সপ্তাহে দুই দিন রাতের বেলায় ডায়েট বরাদ্দ। ডায়েট মানে জনপ্রতি ২০-২৫ গ্রাম মাছ অথবা গোশত। নেহাতই কম। ঈদের খাবারের জন্য তার এক মাসের পুরোটাই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আর তার টাকা চলে যাবে জেল কর্তৃপক্ষের বড় কর্তাদের পকেটে। পুরোটাই হালাল! আর টিভিতে, পত্রিকায় নিউজ হবে ঈদের দিন কয়েদি-হাজতিদের ভূরিভোজ সম্পন্ন। ইতোমধ্যে কাদের মোল্লা ভাইয়ের ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট। স্বাধীন বিচারব্যবস্থার স্বাধীন বিচারকদের সুবিচারের নমুনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রিভিউ আবেদন করার বিষয়টি দোদুল্যমান। আর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। সব মিলিয়ে ভবিষ্যতের ঘটনাটি তখনও পর্যন্ত অস্পষ্ট। কাসিমপুর-২ কারাগার। শুনেছি এটি নাকি এশিয়ার বৃহত্তম কারাগার। এ জেলেই ডিভিশন বন্দীর মর্যাদায় থাকতেন আমাদের সকলের প্রিয় আবদুল কাদের মোল্লা ভাই। একবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ট মুজাহিদ আমাদের প্রেরণার বাতিঘর আবদুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের সাথে আরও থাকতেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম, শিবিরের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি মীর কাসেম আলী ভাই, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ভাই। আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং তারেক জিয়ার বন্ধু ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুন। ট্রাইব্যুনাল থেকে সাজা ঘোষণার পর কাদের মোল্লার ভাই এবং কামারুজ্জামান ভাইয়ের জেল কোড অনুযায়ী ডিভিশন বাতিল হয়ে যায়। কাদের মোল্লা ভাইকে নেয়া হয় ৬০ সেল পূর্বের ২১ নং রুমে এবং কামারুজ্জামান ভাইকে ফাঁসির সেলে। সেই সাথে বন্ধ করে দেয়া হয় তাদের জন্য বরাদ্দ সকল সুযোগ সুবিধা। সেল এলাকার বন্দীদের সাথে অন্যান্য কয়েদি এবং হাজাতিদের সাথে সাক্ষাৎ সম্পূর্ণ নিষেধ। ৬০ সেলে সাধারণত শীর্ষ সন্ত্রাসী, জেএমবি, হিজবুত তাহরিরের সদস্যদের রাখা হতো। কাদের মোল্লা ভাইয়ের সাথে তার রুমে যেয়ে সাক্ষাৎ করার সুযোগ না হলেও প্রতি সপ্তাহে দু-একবার ইন্টার রুমে (সাক্ষাৎ কক্ষে) দেখা হয়ে যেত। এ সুযোগে আমাদের প্রিয় দায়িত্বশীলের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ আমরা পেতাম। তা ছাড়া কাদের মোল্লা ভাইয়ের রান্না যিনি করতেন তিনি আমাদেরও রান্না করতেন। তার মাধ্যমেও মোল্লা ভাইয়ের খবরাখবর পেয়ে যেতাম। সকল মামলায় জামিন হয়ে যাওয়ায় ভাবলাম নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্য দেখা করতে যাবো। ডিভিশনে এ টি এম আজহার ভাই এবং মীর কাসেম আলী ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করা যত সহজ ছিল তার চেয়ে অনেক কঠিন ছিল কাদের মোল্লা ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া। তারপরও সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। বিকেলে সুবেদার আমার এলাকার লোক হওয়ায় তাকে অনুরোধ করলাম তিনি বললেন, ভাই বিকেলের দিকে জেলার সুপার ভেতরে প্রবেশ করে না তখন আপনাকে নিয়ে যাবো। ৩টার দিকে ৬০ সেলের দিকে গেলাম জমাদার বললেন, মোল্লা সাহেব ঘুমাচ্ছেন আপনি একটু পরে আসেন। হাতে সময় থাকায় ৬০ সেলের পাশেই হাসপাতালে থাকা সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ডা: ফখরুদ্দিন মানিক ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আবার যখন গেলাম তখন তিনি আসরের সালাত আদায় করছিলেন। জমাদার আমাকে তার রুমে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। দোতলার বারান্দা দিয়ে তাঁর কক্ষে যাওয়ার সময় দেখলাম আসরের সালাত জামায়াতের সাথে আদায় করছেন আমাদের প্রিয় কাদের মোল্লা ভাই। জামায়াতের পাশ দিয়ে আমি তার রুমে প্রবেশ করলাম। একটু পরেই তিনি এলেন। আমি দাঁড়ালাম, গরম লাগাতে বললেন তুমি কিছু মনে করো না আমার পাঞ্জাবিটা খুলতে হবে। তিনি একটা টুল দেখিয়ে বসতে বললেন এবং তিনিও একটা টুল নিয়ে মুখোমুখি বসলেন। পটে রাখা কিছু চিঁড়া ভাজা এবং চানাচুর একটা বাটিতে নিয়ে বাম হাতে ধরলেন এবং আমাকে সেখান থেকে খেতে বললেন। আমি বললাম বাটিটা আমার হাতে দিন আমি ধরি। আমি বললাম, আমার সর্বশেষ মামলার জামিন হয়েছে। আপনার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছি, জানি না জীবনে আর আপনার সাথে দেখা হবে কি না? শিবির সেক্রেটারি জেনারেল এবং দায়িত্বশীল ও কর্মী ভাইদের প্রতি আপনার কোনো নির্দেশনা থাকলে আমি সেটি তাদের কাছে পৌঁছে দেবো। তিনি বললেন, সবাইকে আমার জন্য দোয়া করতে বলবে। আর সেক্রেটারি জেনারেলকে বলবে আল্লাহর ওপর ভরসা করে দৃঢ়তার সাথে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর কক্ষের চারদিকে নজর বুলাতে দেখলাম। তাঁর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পরিপাটি করে গোছানো। নেহাত সাদামাটা তার প্রয়োজনীয় জিনিস। পানি গরম রাখার জন্য একটি ফ্লাস্ক, ওষুধপত্রের বোতল, বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক, কিছু শুকনো খাবার, শসা, সামান্য ফল-মূল, ফ্লোরে বিছানো চাদর সমেত কয়েকটি কম্বল। জেলে থাকা অবস্থায় আমার আব্বা ইন্তেকাল করাতে ইন্টাররুমে সাক্ষাৎ হওয়ার পর তিনি আমাকে সান্ত¦না দিয়ে বলেছিলেন, তোমার আব্বাতো জানতেন না তার মৃত্যু কবে হবে অথচ আমি তো ফাঁসির রশি গলায় নিয়ে ঘুরি। দীর্ঘ এক ঘণ্টা সাক্ষাতে তিনি বর্তমান ইসলামী আন্দোলনের অবস্থা নিয়ে অনেক কিছু বললেন। বললেন এটি আমাদের জন্য পরীক্ষা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যুগে যুগে তাঁর প্রিয় বান্দাদের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। অনেক নবী-রাসূলকেও শহীদ করে দেয়া হয়েছে। লকআপ ঘণ্টা বাজাতে আমি আমার ওয়ার্ডে চলে এলাম। আর এটিই ছিলো আমাদের প্রিয় দায়িত্বশীলের সাথে আমার সর্বশেষ সান্নিধ্য লাভের সুযোগ। দু’টি ঘটনা। না বললেই নয়, সুপ্রিম কোর্ট যেদিন কাদের মোল্লা ভাইয়ের মৃত্যুদ-র রায় ঘোষণা করল সেদিনের একটি ঘটনা জমাদার গোলাম রহমান আমার ওয়ার্ডে এসে বললেন তার পরদিন। তিনি বললেন, গতকাল আমার ডিউটি পড়েছিল ৬০ সেলে। সুপার এবং জেলার মাগরিবের একটু আগে কাদের মোল্লার সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেন ডিউটি থাকায় আমিও তাদের সাথে গেলাম। কাদের মোল্লা সাহেবের রুমের সামনে গিয়ে তারা তাঁকে সালাম দিলেন। বললেন স্যার, কেমন আছেন, আপনাকে দেখতে এলাম। তিনি বললেন, আমি জানি। জমাদার আমার কাছে তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বললেন, আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। মৃত্যুর সংবাদ জেনেও একজন মানুষ কিভাবে এতটা স্বাভাবিক থাকতে পারেন। জেলার জিজ্ঞাসা করলেন, স্যার কী করছেন। তিনি জবাব দিলেন, ইফতার প্রস্তুত করছি। তারপর তারা সেখান থেকে চলে এলেন। আরেকটি ঘটনা বললেন বিডিআরের এক ভাই। তার মালামাল দাফায় কামপাস ছিল। তিনি জেলখানার ভেতরে একটি ভ্যান দিয়ে বিল্ডিংগুলোতে মালামাল পৌঁছে দিতেন। তিনি বললেন, একদিন কাদের মোল্লা ভাইয়ের মালামাল আসে। তিনি মালামাল দফার কাছাকাছি থাকায় তাঁকে ভ্যানে উঠানোর জন্য বিডিআরের ভাইটিকে বললেন। ভ্যানে বসে মোল্লা ভাই তার মালামালগুলো হাত দিয়ে ধরে রেখেছিলেন। বিডিআরের ভাইটি পরবর্তীতে আমাদের জানালেন। এত বড় মানের একজন নেতা এত সাধারণভাবে সহজ সরল জীবন যাপন করতে পারেন। এটি আমার জীবনের দেখা প্রথম ঘটনা। আমার কাদের মোল্লা সাহেবের এ সরলতা দেখায় খুব মায়া হলো। ঠিক এভাবেই আমাদের প্রিয় কাদের মোল্লা ভাই কারাগারের ছোট্ট পৃথিবীতে তার সকল বাসিন্দাদের হৃদয়ের মনিকোটরে স্থান করে নিয়েছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সকলকে তাঁকে অনুসরণ করার তৌফিক দান করুক। আমিন। লেখক : কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় বিতর্ক কার্যক্রম সম্পাদক বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির