ডিজিটাল চোরের কবলে বাংলাদেশ ব্যাংক
সাদমান সাদী
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
গত ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ৮১ মিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৬৩২৪৯১৬০৯ টাকা ডিজিটাল পদ্ধতিতে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি করা হয় যা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে গচ্ছিত ছিল। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের বাংলাদেশ অ্যাকাউন্ট থেকে চুরি হওয়া এই ডলার ফিলিপাইনের জুয়ার বাজারে পাওয়া গেছে। এ অর্থ পাচার ফিলিপাইনের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ অর্থ পাচার ঘটনা।
হ্যাকাররা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাব থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলার চুরির চেষ্টা করে। তাও যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যালয় বন্ধ ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহজ পরিচালনাপদ্ধতি ও ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার সহযোগিতায় তারা সহজে হ্যাক করে বাংলাদেশ ব্যাংকের হয়ে ৩৫টি অর্থ স্থানান্তরের আবেদন জমা দেয়। এই আবেদনসমূহের মধ্যে ৫টি আবেদন কার্যকর হয়। ৫ ফেব্রুয়াারি ২০১৬ তারিখে ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক করপোরেশনের মাধ্যমে জালিয়াতি হয় এবং পরে তা জুয়ার বাজার ঘুরে হংকংয়ে স্থানান্তরিত হয়। অন্য ২০ মিলিয়ন ডলার পাওয়া গেছে শ্রীলঙ্কায়। যার মালিক বাংলাদেশ ব্যাংক। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক আরো ৮৭০ মিলিয়ন ডলার লেনদেন অবরোধ করে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আসলে কী
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হলো কোন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা আর্থিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা অধিকৃত সম্পদ, সাধারণত কোন রিজার্ভ মুদ্রা, যেমন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মার্কিন ডলার, স্বল্প ক্ষেত্রে ইউরো, পাউন্ড ইত্যাদিকে বোঝানো হয়ে থাকে। রিজার্ভ মুদ্রা সাধারণত একটি দেশ তার ঋণ পরিশোধসহ মুদ্রাস্ফীতি বা মুদ্রাসঙ্কট সমস্যার নিরসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব পালন করে। যেমন, একটি দেশের আমদানি ব্যয় প্রাথমিকভাবে রিজার্ভ থেকে নির্বাহ করা হয়। কোন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যত বৃদ্ধি পায়, তত ঐ দেশের মুদ্রার মান ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে বাড়তে থাকে।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে কোনো লেনদেন সম্পন্ন করতে অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু দুর্ধর্ষ এই হ্যাকাররা সিস্টেম ভেঙে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ ফিলিপাইন আর শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন ভুয়া অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেয়।
ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে ম্যালওয়ার ইনস্টল করে দেয়ার মাধ্যমে এই হ্যাক পরিচালনা করা হয় বলে জানিয়েছে হ্যাকিং-বিষয়ক খবরের সাইট দ্য হ্যাকার নিউজ।
কয়েকবারের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের সমান অর্থ চুরি করতে সক্ষম হয় হ্যাকাররা। অর্থচুরির বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি, আরও ৮৫ কোটি ডলার লেনদেনেরও একটি পাঁয়তারা ছিল। শেষ পর্যন্ত ওই লেনদেন আটকে দেয় টাইপের একটিমাত্র ভুল।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হ্যাকাররা কিভাবে এত সহজে, কোনো চিহ্ন না রেখেই অর্থ হাতিয়ে নেয়ার কাজটি করতে পারল?
এই সাইবার আক্রমণের ঘটনা তদন্তে ঢাকার তদন্তকারীদের সহায়তা করছে নিরাপত্তা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফায়ারআইস ম্যানডিয়্যান্ট। তদন্তকারীদের বিশ্বাস, এই আক্রমণ ঘটার কয়েক সপ্তাহ আগেই হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে কিছু বিশেষ ম্যালওয়্যার ইনস্টল করে দেয়। আর এরপর নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে কিভাবে অর্থ লেনদেন করা হয়, তা পর্যবেক্ষণ করে তারা।
এই ম্যালওয়্যার ঠিক কী ধরনের ছিল, তা এখনও শনাক্ত করা না গেলেও, এই ক্ষতিকারক সফটওয়্যারে গুপ্তচরবৃত্তির প্রোগ্রাম করা ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে অর্থ পাঠানো, গ্রহণ ও পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয় তা শিখে নেয় অপরাধীর দল।
এটি একটি রিমোট অ্যাকসেস ট্রোজান (আরএটি) ভাইরাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার স্পাইওয়্যারের কাছাকাছি কোনো সফটওয়্যারও হতে পারে যা আক্রমণকারীদের হাতে ব্যাংকের কম্পিউটারের রিমোট নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেয়। ব্যাংকটির সিস্টেমে কোনো ‘জিরো-ডে’ ত্রুটিও থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তদন্তকারীরা।
‘জিরো-ডে’ ত্রুটি হচ্ছে, সফটওয়্যারের এমন একটি বিশেষ ত্রুটি যা প্রতিষ্ঠান পক্ষ জানে না। আর ওই ত্রুটি সম্পর্কে অবগত হওয়ার আগেই হ্যাকাররা এটি কাজে লাগিয়ে নেয়।
এরপর, হ্যাকাররা সুইফট মেসেজিং সিস্টেমের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের প্রমাণাদি চুরি করতে সক্ষম হয়ে যায়।
সুইফটের পুরো অর্থ হচ্ছে- ‘সোসাইটি অফ ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন’। এটি ব্যাংকগুলোর মধ্যে টেলিযোগাযোগভিত্তিক আর্থিক লেনদেন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। বেলজিয়ামভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলোর মধ্যে আর্থিক লেনদেনের তথ্য নিরাপদ রেখে তথ্য আদান প্রদানের সেবা দিয়ে থাকে।
নিজেদের সিস্টেমে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে ফেডারেল ব্যাংক। অন্য দিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই তাদের সিস্টেমে সমস্যা খুঁজে পেয়েছে।
আমেরিকার বড় বড় ব্যাংক, যেমন ব্যাংক অব আমেরিকা, জেপি মরগান চেস, ওয়লস ফারগো, সিটি ব্যাংক ইত্যাদি বেসরকারি ব্যাংকের প্রতিটিতে ডিপোজিট আছে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো। এগুলোকে বলা হয় মানি সেন্টার ব্যাংক। এ মানি সেন্টার ব্যাংকের ব্যাপারটা এ রকম যে, ধরুন আপনার হাতে কিছু বাড়তি টাকা হয়েছে। আপনি সেই টাকা একটি ব্যাংকে জমা দিলেন। সেই ব্যাংক আবার আপনার মতো অনেক গ্রাহকের টাকা ডিপোজিট হিসেবে গ্রহণ করার পর এর কিছু অংশ আরো বড় কোনো ব্যাংকে জমা রাখে। এ প্রক্রিয়ায় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ছোট ব্যাংকের টাকা বড় ব্যাংকে যেতে যেতে প্রধানত আমেরিকান ও কিছু ইউরোপীয় ব্যাংকে এসে শেষমেশ জমা হয়। এ ব্যাংকগুলোকে সারা বিশ্বের রিজার্ভ ব্যাংক বলা যেতে পারে।
নিউ ইয়র্ক ফেডসহ আমেরিকার অন্যান্য ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠান, কিন্তু এদের বেতনভাতা আমেরিকান কংগ্রেস নির্ধারণ করে না। আমেরিকান বেসরকারি ব্যাংকগুলো ফেডারেল রিজার্ভের শেয়ারের মালিক। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকগুলোর প্রেসিডেন্টরা ফেডারেল রিজার্ভের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে ভোট দিতে পারে। সারা বিশ্বে আমেরিকান ফেডারেল রিজার্ভের মতো আর দ্বিতীয় কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক নেই, যা সরকার ও রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, ফেডারেল রিজার্ভের ডিপোজিটের পরিমাণ ১ ট্রিলিয়ন ডলারের ওপর।
অন্য দিকে আমেরিকান ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেমে সারা বিশ্ব থেকে টাকা এসে জমা হওয়ার কারণ মূলত তিনটা। এক. আমেরিকায় অর্থসম্পদের মালিকানা নিয়ে বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে অধিক নিশ্চিন্ত থাকা যায়। দুই. আমেরিকান সরকারব্যবস্থা ও সরকারের অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে স্ট্যাবল। তিন. আমেরিকান ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেম ও কারেন্সির (ডলার) ওপর মানুষের আস্থা বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের সিস্টেম ও কারেন্সির চেয়ে বেশি। এই আলোচনায় মূল যে বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে তা হলো, ১০০ মিলিয়ন ডলার আমেরিকান সিস্টেমে তেমন বড় অঙ্কের অর্থ নয়, যা নিয়ে আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ মিথ্যা কথা বলবে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০ মিলিয়ন ডলার খোয়া যাওয়া নিয়ে একটি মারাত্মক রিপোর্ট এসেছে রয়টার্সে। খুব মনোযোগ দিয়ে না পড়লে রিপোর্টের অনেক বিষয় সাধারণ মানুষের চোখে ধরা নাও পড়তে পারে। এর থেকে যে আশঙ্কা জন্ম নিয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষত, লক্ষ করা উচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা চুরি হয়েছে ফেব্রুয়ারির ৪-৫ তারিখে, কোনো এক শুক্রবারে। কিন্তু ইস্যুটি নিয়ে বাংলাদেশে আলোচনা শুরু হয়েছে মার্চের প্রথম সপ্তাহে। সবচেয়ে অবাক কান্ড, এটিই অপরাধীদের একটা সিকিউর এক্সিট পয়েন্ট ঠিক করে দিয়েছে। এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে অনেকে অর্থনীতির নানা তত্ত্বকথার অবতারণা করতে পারেন। তবে বাস্তবতা তত্ত্ব মানে না, বরং কয়েকটি নির্মম বাস্তবের বিশ্লেষণে জন্ম নিতে পারে একটি ধ্বংসাত্মক তত্ত্বকথা। এটি বাস্তব যে, মোটা লোকের হিপ পকেটে রাখা মানিব্যাগ চুরি করার কাজটা পকেটমারদের জন্য অনেক সহজ। এ ক্ষেত্রে তারা আয়েশ করে বসে কাজটা যেমন সহজ করে দেন, তেমনি চোরের জন্য দ্রুত পগার পার হওয়াও সম্ভব হয়। তাই আমাদের ২৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ থেকে প্রায় এক বিলিয়ন চুরি হতে যাওয়ার পরও বাংলাদেশে সেই চুরির আলোচনা কেন এক মাস পরে শুরু হলো, এ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। কে বা কারা এই দীর্ঘ বিরতির জন্য দায়ী? এ ক্ষেত্রে ২৮ বিলিয়ন অলস অর্থ নিয়ে আমাদের দেশটা কি শুধুই অর্থনীতির মুখ দেখেছে নাকি আত্মনিয়ন্ত্রণহীন একটা নির্জীব প্রাণীতে পরিণত হয়েছে, তা নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে অনেক আগেই।
রয়টার্সের রিপোর্টে এটি কনফার্ম করা হয়েছে যে, হ্যাকিং বলেন আর পাসওয়ার্ড চুরি বা পাসওয়ার্ড শেয়ারিং বলেন, যা কিছু হয়েছে তা বাংলাদেশ সাইডে। আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমে হয়নি। রিপোর্টের এক জায়গায় বলা হয়েছে যে, চুরির পর পরই নাকি বাংলাদেশ মনে করেছিল কোনো হ্যাকিং-ফ্যাকিং হয়নি। এর পর আইটি এক্সপার্টরা এসে বুঝিয়ে বলার পরেই নাকি বাংলাদেশ বুঝতে পেরেছে যে হ্যাকিং হয়েছে। এখন জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, হ্যাকিং না হলেও চুরি যে হয়েছিল তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঠিকই বুঝেছিলেন কি না? এই চুরির ঘটনা জাতিকে তারা কেন তাড়াতাড়ি জানালেন না? এমন চুরি কি তাহলে ডাল-ভাত হয়ে গেছে?
রয়টার্সের রিপোর্টে আরও ভয়ঙ্কর খবর হলো ‘হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরের কাজকারবার সম্পর্কে গভীরভাবে ওয়াকিবহাল ছিল। তারা খুব সম্ভবত ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ওপর স্পায়িং বা গোয়েন্দাগিরি করেছিল।’ লাইনটি মারাত্মক এ কারণে যে, এখানে শুধু ডিজিটাল হ্যাকিং বা স্পুফিংয়ের কথা বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে একেবারে অ্যানালগ, হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স বা মনুষ্য গোয়েন্দাগিরির কথা। এ বিষয়ে আগে থেকেই ভেবে দেখার প্রয়োজন ছিল, যা আদতে কারো চিন্তাতেই নেই।
অন্য দিকে রিজার্ভের টাকা যারা লুট করেছে, তারা হয় নিজেরা বাংলা জানে বা তাদের মধ্যে কেউ বাঙালি ছিল, কিংবা তারা বাঙালি কারো সাহায্য নিয়েছে, অথবা ক্ষমতাধর। এ কারণে কথাটা বলতে হয় যে, শ্রীলঙ্কার যে ভুয়া ফাউন্ডেশনের নামে টাকা পাঠানো হয়েছিল, তার নাম দেয়া হয়েছিল ‘শ্যালিকা ফাউন্ডেশন’। হ্যাঁ, তবে এটা স্ত্রীর ছোট বোন সেই শ্যালিকা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি হয়ে শ্রীলঙ্কার যে প্রতিষ্ঠানের হিসাবে গিয়েছিল, সেটির প্রধান হাগোদা গমেজ শালিকা পেরেরা দাবি করেছেন, তিনি তার বন্ধুর মাধ্যমে ওই অর্থ পেয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে মোট ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হওয়া অর্থের মধ্যে ২ কোটি ডলার শ্রীলঙ্কায় শালিকা ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা হয়েছিল। ওই অর্থ শ্রীলঙ্কায় পৌঁছায় ডয়চে ব্যাংকের হাত ঘুরে। তাদের সন্দেহের কারণেই শেষ পর্যন্ত শালিকার হিসাবের ওই অর্থ আটকে যায়। অর্থ স্থানান্তরের অনুরোধে প্রাপকের জায়গায় ‘ফাউন্ডেশন’ বানান ভুল থাকায় ডয়চে ব্যাংক বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিল। এর মাধ্যমেই বেরিয়ে আসে, অর্থ স্থানান্তরের অনুরোধটি ছিল ভুয়া। পরে এই অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংককে ফেরত দেয়া হয়।
শালিকা দাবি করেছে, শ্রীলঙ্কায় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ কয়েকটি প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) কাছ থেকে ওই অর্থ তাকে এনে দেয়ার কথা বলেছিলেন এক বন্ধু। কিন্তু সেটি যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চুরি করা অর্থ, সে বিষয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না। এ দিকে, শ্রীলঙ্কার আদালত শালিকা ফাউন্ডেশনের ছয় পরিচালকের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এ ঘটনায় দেশটিতে মামলাও হয়েছে। আর জাইকার মুখপাত্র নাওয়োকি নেমোতো বলেছেন, শালিকা ফাউন্ডেশন নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই।
এখানে ভুয়া নামে শালিকা ফাউন্ডেশনে টাকা পাঠানো আর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মচারীদের ওপর সরাসরি গোয়েন্দাগিরি করার অভিযোগ থেকে যা ধারণা করা যায় তা হলো, চীনা কিংবা ভুটানি কারো এ হ্যাকিংয়ে জড়িত থাকার যে শঙ্কা, তার থেকে ‘বাঙালি’ বা বাংলাদেশী কারো জড়িত থাকার শঙ্কা ঢের বেশি।
তবে এটা মানতেই হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা এভাবে চুরি হওয়ার ব্যাপারটা বাংলাদেশের ন্যাশনাল সিকিউরিটির জন্য একটি মারাত্মক হুমকি।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া অর্থের ২ কোটি ডলার শ্রীলঙ্কায় শালিকা ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছিল। ছবিটি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হাগোদা গোমেজ শালিকা পেরেরার। ছবি : রয়টার্স
আমেরিকান ব্যাংকিং সিস্টেমে হ্যাকিং খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ধরা হয়। সারা আমেরিকার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ ইন্টারনেট ও ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে অর্থ আদান-প্রদান করেন। এ কারণে তারা হ্যাকিংয়ের রিয়াল ডেঞ্জার নিয়ে খুব সচেতন। এ-যাবৎকালের বড় বড় হ্যাকিংয়ের ঘটনা যদি কেউ খেয়াল করে থাকেন, তাহলে জানতে পারবেন হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে কোনো মেজর ব্যাংকের বড় অঙ্কের টাকা তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা খুব বিরল। হ্যাকাররা মূলত তথ্য চুরি করে, ক্রেডিট কার্ড নাম্বার চুরি করে, তার পর সেগুলো ব্যবহার করে। কিছুদিন আগে খুব বড় একটি হ্যাকিং হয়েছিল, একসঙ্গে অনেক এটিএম মেশিনে। আমেরিকান ব্যাংকগুলো এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে হ্যাক হয়ে যাওয়া কিংবা জালিয়াতির শিকার হওয়া পুরো টাকা গ্রাহককে ফেরত দিয়ে দেয়। এ ধরনের বড় কোনো ঘটনা ঘটলে সেই ক্ষতিকে নন-রিকারিং লস হিসেবে দেখিয়ে ব্যাংকগুলো তাদের বার্ষিক মুনাফার হিসাব করে। প্রতি বছর ব্যাংকগুলো বিলিয়ন ডলারের ওপর ফ্রড কিংবা জালিয়াতির ক্ষতিপূরণ দেয়।
এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের লুট হয়ে যাওয়া টাকার ব্যাপারে একটি অল্টারনেটিভ ন্যারেটিভ নিয়েও চিন্তা করার সময় এসেছে। দুর্বল দেশে সোনার খনি থাকার মতো বাংলাদেশের ২৮ বিলিয়ন ডলারের একটি রিজার্ভ জমা হয়েছে। এ অর্থ অ্যাকাউন্টে পড়ে থাকে, অলস টাকা হিসেবে যার ওপর কারো নজর পড়েছিল কি? এভাবে চুপিসারে এর আগেও ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশের ২৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভের টাকা সরানো হয়েছে কি? শুধু এবার কিছু শ্রীলঙ্কান ব্যাংকার ও ফিলিপিনো মানিলন্ডারিং মনিটরিং অথরিটির কারণে ব্যাপারটা ধরা পড়েছে? যদি তা-ই হয়, সেটি নিঃসন্দেহে আমাদের আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থাপনা ও আইটি সিকিউরিটির জন্য অনেক লজ্জাজনক একটি বিষয়। এ ক্ষেত্রে আগেই যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে থাকে এবং এর সুরতহাল প্রতিবেদন বের হওয়ার আগে আরো ক্ষতির সুযোগ কিভাবে তৈরি হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্নের কোনো উত্তর মিলছে না। দেশের এত প্রথিতযশা তথ্যপ্রযুক্তিবিদ থাকা সত্ত্বেও ব্যর্থ মানুষের হাতে হাজারো মানুষের রক্ত পানি করে জমানো টাকার ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব কেন দেয়া হলো?
বাংলাদেশ ব্যাংকের আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী ব্যবস্থা সুইফটের (এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরের সঙ্কেতলিপি) সঙ্কেত ব্যবহার করেই যে যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভ ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়েছিল এ বিষয়ে অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তকারীরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমেই হ্যাকার ঢুকেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে নয়। তাই অর্থ স্থানান্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিয়ে সন্দেহের দানা বাঁধছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দিকে। সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুইফট কোড ব্যবহার করেই এ ধরনের ঘটনা ঘটায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি আরও জোরালো হচ্ছে। কারণ এই কোডের নির্দেশনাসংবলিত সঙ্কেত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দিষ্ট কর্মকর্তারাই জানতেন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত সুইফট এখন পর্যন্ত কোথাও হ্যাক হয়নি। এ পদ্ধতি নানা ধাপে নিরাপত্তার জালে আবদ্ধ। সুইফটে যে বার্তা যায়, এটিও অনেক নিরাপদ। বার্তাটি যায় গার্বেজ আকারে। এটি যেখান থেকে পাঠানো হচ্ছে এবং যেখানে যাচ্ছেÑ দুই স্থানেই একই সফটওয়্যার থাকতে হবে। তা না হলে বার্তাটির ভাষা উদ্ধার করা যাবে না। ফলে ডলার চুরির নেপথ্যে ওই দুই স্থানের যে কোন এক স্থানের পদ্ধতি সম্পর্কে হ্যাকারকে জানতে হবে, যা হ্যাক করে জানা সম্ভব নয়। এ ছাড়া সব কম্পিউটার থেকে সুইফট বার্তা পাঠানোও সম্ভব নয়। অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিলিং (যে কক্ষ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করা হয়) রুম থেকেই বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করা হয়। ডিলিং রুমে এ ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রে তিনটি বিভাগ কাজ করে। এর মধ্যে ফ্রন্ট অফিস বার্তা তৈরি করে, মিডল অফিস বার্তাটি পাঠায় এবং ব্যাক অফিস বার্তার আলোকে লেনদেন ঠিকমতো হচ্ছে কি-না তা তদারকি করে। ফ্রন্ট ও মিডল অফিসের তিনজন কর্মকর্তা জড়িত থাকেন লেনদেনের বার্তা পাঠাতে। যে কোন লেনদেনের আদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপর্যায় থেকে অনুমোদিত হলে ডিলিং রুমের একজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি বার্তা তৈরি করেন। আরেকজন কর্মকর্তা ওই বার্তাটি ঠিকমতো হয়েছে কি-না তা যাচাই করেন। অন্য এক কর্মকর্তা বার্তাটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে পাঠান। এসব লেনদেন ঠিকমতো হচ্ছে কি-না এবং লেনদেনের পর অ্যাকাউন্টে কী পরিমাণ অর্থ থাকল সেগুলো তদারকি করে ব্যাংক অফিস। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের অধীন। এ দিকে এ ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড বাজেট ডিপার্টমেন্টের ব্যাক অফিসের (সিলিং) ৮ কর্মকর্তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি এদের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ সরকারের তদন্ত কমিটির সদস্য তানভীর হাসান জোহা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী ব্যবস্থা সুইফটের সঙ্কেতলিপি ব্যবহার করেই যে যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভ ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়েছিল এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তকারীরা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমেই হ্যাকার ঢুকেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে নয়। তবে যেখান থেকেই হ্যাকড হোক না কেন- প্রযুক্তি ব্যবহার করে জানা গেছে, ভাইরাস ইনফেকশন অথবা অভ্যন্তরীণভাবে পিন কোড না দিলে এ অর্থ স্থানান্তর করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার থেকে ব্যাপক ডাটা চুরি হয়েছে। এটা ভবিষ্যতে মিস ইউজের আশঙ্কা করে তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা কে ঘটালো সেটা বের করা না গেলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার আরো বড় আক্রমণের শিকার হতে পারে। তখন সার্ভার আপডেটও কোনো কাজে আসবে না।
সূত্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সিস্টেমে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর, গোপন পাসওয়ার্ড ও বার্তা পাঠানোর সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে প্রচলিত নিয়ম মেনেই অর্থ লেনদেনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশনার আলোকেই মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ লেনদেন হয়েছে। তবে ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে নির্দেশনার কারণে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিস্টেমে এক সময় লেনদেনগুলো সন্দেহজনক বলে মনে হয়। তখন তারা বাংলাদেশ ব্যাংককে বার্তা পাঠালে পরবর্তী নির্দেশনাগুলো স্থগিত রাখা হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অর্থ চুরির যে পাঁচটি নির্দেশনা কার্যকর হয়েছে সেসব নির্দেশনা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেয়া হয়নি। আবার যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভ ব্যাংকও এই অর্থের নির্দেশনাগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কি-না সেটি নিশ্চিত না হয়েই লেনদেন করেছে। ফলে তারা এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক থেকে রিজার্ভ চুরির ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। তবে সেটা অবশ্য আশির দশকে। সে সময় উগান্ডার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ চুরি হয়।
ওই ঘটনায় উগান্ডার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। ওই কর্মকর্তারা ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগব্যবস্থা ‘টেলিপ্রিন্টার’ ব্যবহার করেছিলেন। বুধবার ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল এ খবর জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আশির দশকে ব্যাংক অব উগান্ডার দুষ্কৃতকারী কর্মীরা ব্যাংকটির প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগব্যবস্থা টেলিপ্রিন্টার ব্যবহার করে অল্প পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিল। তখন টেলেক্স বার্তায় ফেডারেল রিজার্ভ থেকে অর্থ ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের হিসাবে হস্তান্তর করা হতো।
উগান্ডার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ সুইজারল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশে ব্যাংকে চলে যায়। এর মধ্যে সুইস ব্যাংকের কয়েকটি হিসাবেও এ অর্থ জমা হয়। পরে ওই হিসাবধারী ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু অপরাধের সঠিক প্রমাণ মেলেনি। ওই সময় ফেডারেলের অ্যাটর্নি টমাস বক্সারের নেতৃত্বে তদন্ত পরিচালনা করা হয়। এখন বক্সার ফেডারেল রিজার্ভের জেনারেল কনসাল।
হ্যাকারদের অস্ত্র ম্যালওয়্যার ও
ট্রোজেন হর্স!
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন রিজার্ভ সিস্টেমের আইডি হ্যাক করতে হ্যাকাররা ম্যালওয়্যার ও ট্রোজেন হর্স নামে দু’টি ভাইরাস ব্যবহার করেছেন বলে তদন্তকারীরা ধারণা করছেন। তবে ব্যাংকের কেউ যদি সহযোগিতা করে থাকেন তাহলে এটা সরাসরি হ্যাকড হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে জমা থাকা ১০ কোটি ডলার হ্যাকিংয়ের তদন্ত উপদেষ্টা হিসেবে এখন কাজ করছেন রাকেশ মাস্তান। তিনি বিশ্বব্যাংকের সাবেক আইটি উপদেষ্টা। গত ৯ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকে ৫৬টি ব্যাংকের আইটি এক্সপার্ট এবং সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে এই হ্যাকিংয়ের বিভিন্ন দিক এবং আশঙ্কা নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা উপস্থিত ছিলেন।
তানভীর হাসান বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে ম্যালওয়্যার ভাইরাস ইনফেকশনের মাধ্যমে হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের আইডি (সুইফট কোড) নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এরপর তারা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে অ্যাডভাইস পাঠায়। তবে পাঁচটি অ্যাডভাইসের পরই হ্যাকিংয়ের বিষয়টা টের পায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক।’ তিনি বলেন, ‘এর সঙ্গে ট্রোজেন হর্স নামে আরও একটি ভাইরাসকে কাজে লাগানো হয়েছে। এখানে ম্যালওয়্যার ও ট্রোজেন হর্স একসঙ্গে কাজ করেছে।’ তিনি জানান, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমেই হ্যাকার ঢুকেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে নয়। হ্যাক হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম।’
এ নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও সাইবার অ্যাট হোমের চিফ স্ট্র্যাটেজিক অফিসার সুমন আহমেদ সাবির বলেন, ‘ম্যালওয়্যার হলো এক ধরনের ভাইরাস বা অ্যাপ্লিকেশন। এটাকে যদি কোনো কম্পিউটারে ইনফেক্ট করানো যায় তাহলে তিনি ওই কম্পিউটারের সব তথ্য যিনি ইনফেক্ট করেছেন তার কাছে পাঠিয়ে দেবে। ট্রোজেন হর্সেরও একই বৈশিষ্ট্য। তবে ট্রোজেন হর্স একটি নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ যদি জড়িত না থাকেন তাহলে এটাই হলো হ্যাকিংয়ের পদ্ধতি।’
এই দু’টি ভাইরাস কম্পিউটারে পাঠাতে সরাসরি কম্পিউটারের সংস্পর্শে যেতে হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা সোস্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফেসবুক বা অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহায়তায় ইনফেক্ট করা সম্ভব। এটা বিভিন্নভাবে বিভিন্নরূপে থাকে, কেউ তার কম্পিউটারে ডাউনলোড করলেই তিনি এর শিকার হবেন। তিনি জানতেও পারবেন না।’
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক থেকে ৫ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট থেকে সরিয়ে নেয়া ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ৮১ মিলিয়ন পাঠানো হয় ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) মাকাতি সিটির জুপিটার স্ট্রিট শাখার একটি অ্যাকাউন্টে। মাত্র ৫০০ ডলার করে জমা দিয়ে ফিলিপিন্সের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনে (আরসিবিসি) ২০১৫ সালের ১৫ মে চারটি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই অ্যাকাউন্টগুলোতে আর কোনো লেনদেন হয়নি। অর্থ উত্তোলনের দিন দেশটির সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সিসি ক্যামেরা বন্ধ ছিল। তদন্ত কর্মকর্তারা সেদিনের সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজ চাইলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা দিতে পারছেন না।
ফিলিপিন্সের ইনকোয়ারার পত্রিকা জানায়, সে দেশের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) জুপিটার শাখা থেকে যেদিন ওই অর্থ উত্তোলন করা হয় সেদিন ওই শাখার সব সিসি ক্যামেরা বন্ধ ছিল। কমিটির প্রধান সিনেটর তেওইফিস্তো গুইনগোনা সিসিটিভি অকার্যকর হওয়াকে ‘বড় সন্দেহজনক’ ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন।
অন্য দিকে, যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ উত্তোলন করা হয় সেসব অ্যাকাউন্ট খোলার সময় ভুল তথ্য দেয়া হয়েছিল। এ জন্য চুরি যাওয়া অর্থ ঠিক কোথায় গেল সে বিষয়ে সঠিক তথ্য পাচ্ছে না দেশটির প্রশাসনও। তবে ফিলিপাইনের সিনেট বলছে অর্থ যেখানেই থাকুক খুঁজে বের করা হবে।
সূত্র মতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার পাচার হওয়ার পুরো বিষয়টি জানতেন ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি) শীর্ষ কর্মকর্তারা। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক থেকে ফিলিপাইনের ওই ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখায় প্রথমে টাকা আসার পর তা দু’টি ক্যাসিনোতে পাঠানো হয়। ক্যাসিনো অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট শাখা ব্যবস্থাপক মাইয়া সান্তোস ডিগুইতো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) লরেন্স ট্যানের কাছে বিষয়টি জানান। তিনি পুরো টাকা লেনদেন করার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশেই জালিয়াত চক্র পুরো টাকা নিয়ে যায়। ক্যাসিনোর মাধ্যমে পরবর্তীতে এই টাকা হংকংয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংস্থা ফিলিপাইন অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং কর্তৃপক্ষ।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সম্পর্কে আরো তথ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রের একটি অন্যতম শক্তিশালী এবং গোপনীয়তা বজায় রাখা (Powerful and Secretive) প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ফেডারেল রিজার্ভ। নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২৫০টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থ লেনদেন হয়।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বা কংগ্রেস কারো নিকটেই এর কোনো জবাবদিহিতা নেই। তাদের বাজেট তারা কিভাবে খরচ করে- কাকে তারা ধার দেয় এসব কোন কিছুই আমেরিকার সংসদ সদস্যরা জানেন না। সুতরাং অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী ‘ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকও দায় এড়াতে পারবে না।’ বলে রিজার্ভ চুরির এই দায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের ওপর চাপানো বা তদন্তের আওতায় নিয়ে আসা অসম্ভব বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আশ্চর্যের বিষয় হলো ১৯১৩ সালে ফেডারেল রিজার্ভের জন্মের পর আজ পর্যন্ত কোনো অডিট হয়নি। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হওয়ার পরে আমেরিকান নাগরিকদের প্রতি ৪ জনের মধ্যে ৩ জন-ই ফেডারেল রিজার্ভের অডিট দাবি করেছেন। আমেরিকার প্রখ্যাত কংগ্রেস সদস্য রন পল আন্দোলন করে রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্যদের সকলের এবং ডেমোক্র্যাট পার্টির ১০০ জন সদস্যের সম্মতি পেয়েছিলেন ফেডারেল রিজার্ভের বিষয়ে একটি তদন্ত করার জন্য।
আমেরিকার প্রখ্যাত কংগ্রেস সদস্য রন পলের চেষ্টায় ২০০৯ সালে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিদের এক শুনানি শুরু হলো। এতে এমন সব অবিশ্বাস্য তথ্য বেরিয়ে এলো যে প্রশ্নকর্তারা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। জানা গেল যে ফেডারেল রিজার্ভ ৯ ট্রিলিয়ন ডলার (৯০০০০০০০০০০০০) কাউকে দিয়ে দিয়েছে যার কোনো উল্লেখ তাদের ব্যালান্স শিটে নেই। এই বিপুল অঙ্কের অর্থ কাকে দেয়া হয়েছে এ প্রশ্ন যখন করা হলো ফেডের ইন্সপেক্টর জেনারেল এলিজাবেথ কোলম্যানকে- তিনি বললেন যে তিনি কিছু জানেন না অথচ তার কাজ-ই হলো এটা জানা।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের কার্যকলাপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে শুনানির সময় এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের উত্তর এবং আচরণ দেখে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে তারা সত্য বলছে না এবং কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছেন। তারা যে আমেরিকার কংগ্রেসকে আদৌ কোন তোয়াক্কা করেন না এটাও পরিষ্কার বোঝা যায়। এমনকি ফেডারেল ব্যাংকের চেয়ারম্যান বেন বারনাংকিকে যখন সিনেটর স্যান্ডার্স জিজ্ঞেস করলেন ২.২ ট্রিলিয়ন ডলারের (২.২০০০০০০০০০০০০) ডলারের একটি ঋণ এর বিষয়ে- মানে এতো বিপুল পরিমাণ ডলার কাকে দেয়া হয়েছে-তখন তিনি স্রেফ তা এড়িয়ে যান। অথচ এটা তো আমেরিকান জনগণের টাকা।
টেক্সাসের প্রখ্যাত কংগ্রেস সদস্য রন পল যখন অভিযোগ করলেন যে ফেডারেল রিজার্ভ ৮০ এর দশকে সাদ্দাম হোসেনকে ৫.৫ বিলিয়ন ডলার দিয়েছিলেন যেই টাকা দিয়ে সাদ্দাম হোসেন আমেরিকার কাছ থেকেই পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য যন্ত্রপাতি কিনেছিল- তখন ফেড চেয়ারম্যান তা উদ্ভট তথ্য বলে উড়িয়ে দিলেন। রন পল যখন ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের পর ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃক সেখানে বিপুল পরিমাণ ডলার পাঠানোর বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন মি: বারনাংকি তা অস্বীকার করেন। অথচ এর আট মাস আগে ইরাকবিষয়ক কংগ্রেসের আরেকটি শুনানিতে রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য হেনরি ওয়াক্সম্যান বলছেন যে ২০০৩ সালের মে মাস থেকে ২০০৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত ফেডারেল রিজার্ভ বিশাল অঙ্কের ডলার ইরাকে পাঠিয়েছে। ১০০ ডলারের এই নোটগুলো ইরাকে পাঠানোর জন্য সামরিক বাহিনীর সি-১৩০ কার্গোবাহী প্লেন দরকার পড়েছিল কারণ এই ডলারের ওজন হয়েছিল ৩৬৩ টনের বেশি !
ফেডারেল রিজার্ভের ওপর সাধারণ আমেরিকান জনগণের ক্ষোভের একটি বড় কারণ হলো বিরামহীন মুদ্রাস্ফীতির (Inflation) এবং ডলারের অবমূল্যায়ন। অথচ ফেডারেল রিজার্ভের জন্মই হয়েছিল মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং ডলারের মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য। কিন্তু হাওয়া থেকে ডলার বানিয়ে এবং তা দেশে-বিদেশে সরবরাহ করে ফেডারেল রিজার্ভ উল্টো মুদ্রাস্ফীতির জন্ম দিয়েছে এবং তা জিইয়ে রাখছে। ডলারের এতটাই অবমূল্যায়ন হয়েছে যে ১৯১৩ সালের ১ ডলারের মূল্য এখন ৪ সেন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। এক দিকে বাতাস থেকে ডলার বানিয়ে তারা যেমন মুদ্রাস্ফীতি ঘটাচ্ছেÑ আবার ব্যাংকের সুদের হার কমিয়ে সাধারণ মানুষের সেভিংস এবং পেনশন আয়েরও বারোটা বাজাচ্ছে। আবার যেসব ব্যাংক এবং ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠানের কারণে এই অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ তাদেরকেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিচ্ছে, যার জন্য আবার বাড়তি ট্যাক্স দিতে হবে জনগণকেই। এই সকল নীতির কারণে আমেরিকার মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র শ্রেণী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে অল্প কিছু ধনিক শ্রেণী বা এলিটদের হাতে।
বিশ্বায়নের এ যুগে আর্থিক লেনদেনে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি অবলম্বনের বিকল্প নেই। প্রযুক্তির উৎকর্ষকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন ব্যাংকিং সেবা উদ্ভাবন ও আত্তীকরণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রদান নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অর্থ তছরুপের এই ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন। এই পদত্যাগই সমাধান নয়; উচিত ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করা।
উন্নত বিশ্বে ব্যাংকিং খাতে সাইবার আক্রমণ অনেকটা নৈমিত্তিক ঘটনা হলেও বাংলাদেশের জন্য একেবারেই নতুন। আর্থিক খাতের অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক এ সাইবার অপতৎপরতার বিষয়ে অবহিত হওয়ায় কতটুকু সচেতন হলো সময়ই তা বলে দেবে।
লেখক : সমাজকর্মী
আপনার মন্তব্য লিখুন