বর্তমান সময়ে সারা দেশে মিডিয়ার যেন জয়জয়কার। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিকস ও অনলাইন মিডিয়ার পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে মিডিয়াকর্মীর সংখ্যাও। রীতিমত এটি এখন ক্রেজি ও প্রতিযোগিতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা দাবি করেন- তারা দেশ ও সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করেন। তবে প্রত্যেক সংবাদকর্মী কি তা যথার্থভাবে করতে পারছেন? সংবাদকর্মীরা তাদের গণমাধ্যমে সমাজের নানা সমস্যা, অসঙ্গতি, অন্যায়-দুর্নীতি আর অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে এগুলো প্রতিকারের জন্য ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু তাদের নিজেদের ভেতরকার নানা অসঙ্গতি তুলে ধরবেন কে? একবার আমার এক বন্ধু বললেন, ‘তোমরা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের ভালো-মন্দ সব খবর সমাজের সামনে তুলে ধরছ, কিন্তু তোমাদের ভেতরকার খবর তুলে ধরার তো কেউ নেই, যার কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তোমরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে যাচ্ছ।’ তির্যক এই মন্তব্যটি নিয়ে ভাবতে পারেন মিডিয়াকর্মীরা।
ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার বাজারে ‘সংবাদ’ নামক পণ্যটি নিয়ে এখন রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। কার আগে কে সংবাদ সরবরাহ করবেন এ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান সবাই। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অভ্যন্তরীণ স্লোগান- ‘সবার আগে সব খবর’। কিন্তু আমি যে চ্যানেলটিতে কাজ করেছি সেটির ট্রেনিংয়ে আমাদের শেখানো হয়েছে ‘সবার আগে সঠিক খবর’। এই যে খবরটি প্রচারের আগে ‘সঠিক’ বিষয়টি যাচাই করে নেয়া, কিংবা সাংবাদিকতার পরিভাষার ‘ক্রস চেক’ করে নেয়ার বিষয়টি প্রত্যেক সাংবাদিক যথার্থভাবে করছেন কি?
কয়েক বছর আগে বরিশাল অঞ্চলে দু’টি খবরের উদাহরণ উপস্থাপন করছি। ২০০৯ সালের ২৪ মার্চ ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার রামকেশব গ্রামে গ্রিন ক্রিসেন্ট নামের একটি এনজিওর কমপ্লেক্স থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে র্যাব। মিডিয়ার কল্যাণে এ খবরটি সবার জানা। আমি ওই সংবাদটি কভার করার জন্য তৎকালীন ক্যামেরাম্যান জসিম উদ্দিনসহ ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। সেখানে থেকে দিগন্ত টেলিভিশনে ফোনো লাইভ নিউজ এবং প্যাকেজ নিউজ করেছিলাম কয়েকবার। কিন্তু সেখানে আমি কোনো ধরনের মাদরাসাই দেখলাম না। অথচ প্রায় সবগুলো প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় সেদিন গ্রিন ক্রিসেন্ট এনজিওটিকে মাদরাসা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কেউ কেউ তাদের লিড নিউজে লিখেছেন ‘ভোলার মাদরাসায় জঙ্গি ঘাঁটি’। এসব অসত্য শিরোনামের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ ও আলেমসমাজের ভাবমর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? আমরা একবারও কি এ কথা ভেবেছি?
আমাদের কিছু কিছু সংবাদকর্মীর ধর্মবিরোধী মানসিকতা দেখে আমরা হতাশ হই। মুসলিম পরিবারের সন্তান হয়েও তারা কেন যেন ইসলাম, মুসলমান, আলেম-ওলামা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংবাদ লিখে ভিন্নরকম তৃপ্তি পান, নিজেকে উদারপন্থী ও তথাকথিত প্রগতিশীল ভাবেন। কোনো কলেজছাত্র কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে সেই খবরটি ছাপা হয় এক কলামে পত্রিকার কোনো এক কর্নারে। আর একই ঘটনা কোনো মাদরাসা ছাত্র ঘটালে সেটি ন্যূনতম ডাবল কলাম, কালো কালিতে রিভার্স ব্লক, আর প্রথম পাতায় ট্রিটমেন্ট।
মজার আর একটি বিষয় হচ্ছে- আলেম-ওলামা কিংবা হুজুরদের বিরুদ্ধে যারা এরূপ অহর্নিশ বিষোদগার করেন, তাদেরই কোনো পারিবারিক কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হুজুরদের ডাকা হয় খুব সম্মানের সাথে। তাদের কোনো স্বজন মারা গেলে বলা হয়- হুজুর জানাজা পড়ান। আবার ওই সাংবাদিক মারা গেলে তার জানাজাও পড়াবেন কোনো না কোনো মাদরাসা পড়–য়া হুজুর বা আলেম ব্যক্তি। অতএব মাদরাসা পড়–য়াদের প্রতি কতিপয় মিডিয়াকর্মীর এই অহেতুক বিদ্বেষ কেন? আমি বলতে চাইছি না যে, হুজুররা অন্যায় করলে নিউজ হবে না, নিউজ অবশ্যই হবে। তবে তা যেন আমাদের মনের বিদ্বেষপ্রসূত না হয়। কারণ তারাতো আমাদের দেশেরই নাগরিক।
কয়েক বছর আগে বরিশাল নগরীতে কয়েকটি বিদেশি সংস্থায় চিঠি পাঠিয়ে হুমকি দিয়েছিলো জেএমবি। ইংরেজিতে লেখা ওই উড়ো চিঠির কোনো কপি সাংবাদিকদের হাতে না পৌঁছলেও প্রশাসনের বরাত দিয়ে সংবাদটি কয়েকটি মিডিয়ায় পরিবেশন করা হয়েছে। আমার মনে হয় এরূপ স্পর্শকাতর সংবাদগুলো পরিবেশনের ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংবাদকর্মীদের আরো দায়িত্বশীল ও যত্নশীল হওয়া উচিত। কারণ এসব সংবাদের সাথে বহির্বিশ্বে দেশ ও জাতির ভাব মর্যাদা জড়িত। সেটি আদৌ জেএমবির চিঠি ছিল কি না সে বিষয়ে পুলিশ বিভাগ যেখানে সন্দিহান এবং তদন্তাধীন। সেখানে এরূপ খবর ফলাও করে প্রচারের বিষয়টি কতটা যুক্তিযুক্ত। এক্ষেত্রে শুধু সাংবাদিকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, সংশ্লিষ্ট দফতর, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রেস ব্রিফিং কিংবা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার ক্ষেত্রে আরো সংবেদনশীল এবং কৌশলী হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
মিডিয়ায় ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণা ঠেকাতে বিশ্বাসী মানুষগুলোকে ক্যারিয়ার সেক্রিফাইস করে হলেও এ পেশায় আরো বেশি সংখ্যায় এগিয়ে আসতে হবে। মিডিয়ার মোকাবেলা কেবল বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে করা আদৌ সম্ভব নয়। মিডিয়ার মোকাবেলা করতে হবে মিডিয়া দিয়েই। এ জন্য তৈরি করতে হবে একঝাঁক বিশ্বাসী মিডিয়াকর্মী। যারা শত প্রতিকূলতার মাঝেও অকপটে ‘সত্য’ প্রকাশ করে যাবেন সাহসিকতার সাথে। যে মিডিয়াকর্মীরা প্রচার ও প্রকাশ করবেন গণমানুষের মনের কথা। লেখক : সম্পাদক, মক্তবুলি
আপনার মন্তব্য লিখুন