তথ্যসন্ত্রাসের প্রথম ব্যবহারকারী হলো শয়তান। এর প্রথম শিকার হয়েছিলেন পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম আলাইহিস সালাম ও তাঁর স্ত্রী হজরত হাওয়া আলাইহিস সালাম। শয়তান তাদেরকে ভুল তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে তার উদ্দেশ্য হাসিল করেছিল। ঘটনাটি বর্ণিত আছে পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ৩৫ ও ৩৬ নম্বর আয়াতে। তারই ধারাবাহিকতায় হক-বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব বাতিল শক্তি এই হাতিয়ার (তথ্যসন্ত্রাস) ব্যবহার করছে তাদের লক্ষ্য হাসিলের মাধ্যম হিসেবে। তাই যুগে যুগে ইসলামের মহান বাণী প্রচারের জন্য প্রেরিত নবী-রাসূলদের আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে না পেরে বাতিলরা তথ্যসন্ত্রাসকে লক্ষ্য হাসিলের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এর ব্যতিক্রম নন। যখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন তখন আল্লাহ তাআলা সান্ত¡না হিসেবে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম, নূহ আলাইহিস সালাম, সালেহ আলাইহি সালাম এবং অন্যান্য নবী-রাসূলদের প্রতি তাদের কওমের লোকেদের আচরণকে তুলে ধরেছেন এভাবেÑ “তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে যে রাসূলই এসেছে তারা বলেছে এ তো একজন জাদুকর অথবা পাগল।” (সূরা আয্ যারিয়াত: ৫২) উপরের আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝাতে চেয়েছেন আপনার প্রতি যে আচরণ করা হচ্ছে তা অতীতেও এ দায়িত্ব পালনের কারণে আপনার আগে অতিবাহিত নবী-রাসূলদের প্রতিও করা হয়েছিল এবং ভবিষ্যতে যারা এই পথে পা বাড়াবে তাদের সামনে বাতিলের এই চিরন্তন কর্মপন্থা না আসার কোনো কারণ নেই। বর্তমান আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পরিচালিত মহান ইসলামী আন্দোলনগুলোকে এই হাতিয়ারের মোকাবেলা করতে হচ্ছে আরো কঠিনভাবে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের বুকে মানবতার মুক্তির জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া মহান সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রতি আরোপিত নিকৃষ্ট অপবাদের দিকে লক্ষ্য রাখলে তা বোঝা যায়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতার মিথ্যা অপবাদে এই দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ফাঁসি দেয়া হয়, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক তাদের নিবন্ধন বাতিল করা এবং সর্বশেষ তাদেরকে নিষিদ্ধ করার চিন্তাও করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা মূল সমস্যা নাকি দ্বীন প্রতিষ্ঠার মহান কাজ করা এর মূল কারণ তা বুঝা যাবে সমসাময়িক এবং নিকট অতীতের বিশ্বের বিভিন্ন ইসলামী আন্দোলনের প্রতি বাতিলের দ্বিমুখী নীতির দিকে তাকালে। মিসরে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করে আসছে মুসলিম ব্রাদারহুড। মিসরের সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়ে মিসরের স্বাধীনতা আন্দোলন সুয়েজ খাল আন্দোলনসহ অনেকগুলো আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই সংগঠন। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে এর অনেক নেতাকে ফাঁসি এবং সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালে ব্রাদারহুডের পক্ষ থেকে মনোনীত মিসরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করার সময় তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে বিরোধিতা করার কোনো অভিযোগ ছিলো না। আফ্রিকার মরু অঞ্চল লিবিয়ায় গড়ে ওঠা সেনুসি আন্দোলন যারা দাওয়াত, সংস্কার এবং নৈতিক পুনর্গঠন এর মাধ্যমে মরুভূমির উচ্ছৃঙ্খল বেদুইনদের সাথে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক কল্যাণ রাষ্ট্র। ইতালি যখন তাদের উচ্ছেদ করার জন্য তৎপর হয়ে উঠলো তখন ওমর মুক্তারের নেতৃত্বে তারা তাদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়াই করেছিলেন জান দিয়ে। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করা হলো এবং এই আন্দোলনের মহান নেতা ওমর মুক্তারকে ফাঁসি দেয়ার সময়ও তাদের বিরুদ্ধে ছিল না স্বাধীনতা বিরোধিতার কোনো অভিযোগ। তেমনিভাবে আলজেরিয়ায় গত শতকের শেষ দিকে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে ইসলমী সালভেশন ফ্রন্টকে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করতে না দেয়া, ১৯৫৮ সালে আজান পুনরায় আরবিতে চালুর অভিযোগে তুরস্কের বারবার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আদনান মেন্দেরেসকে ফাঁসি দেয়া হয়। তেমনিভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামী পুনর্জাগরণ থামিয়ে দেয়ার জন্য কোথাও মৌলবাদী, কোথাও যুদ্ধাপরাধী, কোথাও স্বাধীনতাবিরোধী, কোথাও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে। তাই হক-বাতিলের এই চিরন্তন দ্বন্দ্বে এ তথ্যসন্ত্রাসকে এক অপরিহার্য বাস্তবতা মেনে নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরও কিছু কৌশল নির্ধারণ ও প্রয়োগ করার প্রয়োজন। এক. যে কোন সংবাদ ও প্রচারণা দেখার ও শোনার সাথে সাথে সত্যতা যাচাই না করে গ্রহণ না করা। “ঈমানদার ব্যক্তিরা যদি কোন ফাসিক লোক তোমাদের কাছে কোনো তথ্য নিয়ে আসে তাহলে তোমরা (তার সত্যতা) পরখ করে দেখবে। (কখনো যেন আবার এমন না হয়) না জেনে তোমরা কোন একটা সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে ফেললে এবং এরপর নিজেদের কৃতকর্মের ব্যাপারে তোমাদেরই অনুতপ্ত হতে হলো।” (সূরা হুজুরাত : ৬) দুই. নাজ্জাশির দরবারে কুরাইশদের দূত হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) যখন মুসলিমদেরকে গোত্রের উচ্ছৃঙ্খল লোক হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন তখন মুসলমানদের পক্ষ থেকে হজরত জাফর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাই নাজ্জাশিকে বলেছিলেন যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। বর্তমানে আন্দোলনের কর্মীদের উচিত হীনমন্যতায় না ভোগে নিজেদের আদর্শকে কোরআন এবং সুন্নাহর আলোকে সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপন করা। তিন. বিরোধিতার মোকাবেলায় এবং অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুরা যেভাবে নিজেদের চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে আদর্শকে উপস্থাপন করেছিলেন বর্তমানেও আন্দোলনের কর্মীদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং কার্যকর পন্থার অনুশীলন বাড়ানো দরকার। চার. বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গুরুত্ব ও প্রভাব অতুলনীয় এবং অনেক গভীর। তাই প্রভাবশালী এ মাধ্যমকে সময় নষ্ট, অন্যদেরকে নিয়ে উপহাস, হিংসা এবং গিবতের ক্ষেত্র না বানিয়ে দাওয়াতের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা। ‘যারা নিজেদেরকে অনর্থক কাজ থেকে বিরত রাখে।’ (সূরা মুমিনুন) পাঁচ. দীর্ঘ মেয়াদে মিডিয়া সৃষ্টি এবং এক্ষেত্রে যোগ্য এবং দক্ষ লোক তৈরি করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন